Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





   
 আমার ভারতবর্ষ
গোলকোণ্ডা: কুতুবশাহি করামত
গোলকোণ্ডা দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিলো চারশো ফুট উঁচু একটি গ্র্যানাইট পাহাড়ের উপরে। চারদিকে ধু ধু ঊষর সমভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজকীয় নির্মাণটির দৃশ্য এককথায় রোমাঞ্চকর। দুর্গটির আকার রম্বাস সদৃশ। চারদিকের ভূবলয় ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। দুর্গের বাইরের প্রাকারটির পরিধি সাত কিমি।প্রাকারটি গভীর, প্রশস্ত পরিখা দিয়ে ঘেরা। তিনটি প্রাচীরের বৃত্ত এই
দুর্গকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছিলো। পাহাড় থেকেই গ্র্যানাইট পাথর কেটে প্রাকার ও অন্য নির্মাণগুলি করা হয়েছিলো। ভিতরে ঢোকার পথ ছিলো মোট আটটি। তবে তার মধ্যে চারটি ছিলো প্রধান। পূর্বদিকে ফতেহ দরওয়াজা। পশ্চিমে মক্কা দরওয়াজা। উত্তরে বঞ্জারা আর উত্তর-পশ্চিমে পত্তনচেরু দরওয়াজা। হায়দরাবাদের দিক দিয়ে এলে ফতেহ দরওয়াজা দিয়েই ঢুকতে হয়। ফতেহ দরওয়াজা অর্থাৎ বিজয়দ্বার।

তিনটি প্রাকারশ্রেণীর প্রথম প্রাকারটি ঘিরে আছে সম্পূর্ণ পাহাড় এবং চারদিকের সমভূমি। দ্বিতীয় প্রাকারটি রয়েছে পাহাড়ের পদদেশে। তৃতীয়টি ঘিরে আছে Citadel বা বালা হিসার অংশটি। প্রাকারগুলি মোটামুটিভাবে সতেরো থেকে চৌঁত্রিশ ফুট চওড়া। পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট উঁচু। তিনটি প্রাকার মিলিয়ে মোট সাতাশিটি অর্ধচন্দ্র বুরুজ রয়েছে। যেখানে সান্ত্রী ও অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত থাকতো। বিশাল গ্র্যানাইটের ব্লক সাজিয়ে তাদের নির্মাণ
করা হয়েছিলো। উত্তর -পশ্চিম কোণায় রয়েছে পেটলা বুর্জ। মানে বিশাল উদর বুরুজ। অওরঙ্গজেবের কামানের গোলায় এই বুরুজটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সুলতানের কারিগররা মুঘল সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য একরাতের মধ্যে কাগজবোর্ড দিয়ে অবিকল একটি নকল বুর্জ তৈরি করে দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি।
বহু বুরুজে তেলুগু লিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি কুতবশাহিদের আনুকূল্য বেশ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

বাইরের প্রাকারটির আটটি দরওয়াজার নাম, ফতেহ, বাহমনি, মক্কা, পত্তনচেরু, বঞ্জারা, জামালি, নয়াকিলা আর মোতি দরওয়াজা। প্রধান দরওয়াজাটি এখন ফতেহ দরওয়াজা। কুতবশাহি পতনের পর এই প্রবেশ পথ দিয়ে বাদশা অওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মোয়াজ্জেম গোলকোণ্ডার দখল নিতে ঢুকেছিলেন।


গোলকোণ্ডা দুর্গের যে অংশটি চলতি কথায় এখন 'গোলকোণ্ডা', সেটির আসল নাম 'বালা হিসার'(Citadel)।একটা উঁচু গ্র্যানাইট পাহাড়ের চূড়ায় এই সুরক্ষিত রাজমহলটির নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। এই মুহূর্তে পর্যটকরা প্রবেশ করেন বালা হিসার দরওয়াজা দিয়ে। এটাই দুর্গের কেন্দ্রস্থল। ঢোকার মুখে বিশাল দরজাটি কাঠের। তার সর্বাঙ্গে পিতল বাঁধানো কীলক হাতিফৌজের আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষা করতো। বালা হিসারের স্থাপত্যের আদর্শ ছিলো বাহমনি রাজ্যের নির্মাণ কৌশল।

বালা হিসার দেউড়ির রক্ষী ছিলেন অ্যাবিসিনিয়া থেকে আসা সৈন্যদের বাহিনী। ঐ পথ দিয়ে ঢুকলেই শুরু হয়ে যেতো হাবসি সৈন্যদলের এলাকা। নাম, হাবসি কমান। ভিতরে প্রথমেই একটি খিলান দেউড়ি রয়েছে। যার নাম 'তালি ফটক' বা Clapping Pavilion। ওখানে দাঁড়িয়ে তালি দিলেই সুদূর পাহাড় শিখরে বারাদরির রক্ষীরা শুনতে পেতেন সেই শব্দ। তার সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি সেকালের কামানের নমুনা। বাঁদিকে বাদশাহি আশুরখানা। ফতেহ দরওয়াজা আর মুসা বুর্জের মাঝামাঝি যে বিশাল প্রাসাদের অবশেষ দেখা যায় সেটি দিওয়ান মহল। সেখানে মীর জুমলা মহম্মদ সয়ীদ থাকতেন। পরবর্তীকালে তা মদন্না-অক্কান্নার বাসভবন হয়ে যায়। ডানদিকে চলে গেছে গোলকোণ্ডা কিলার বিশ্বখ্যাত মিনাবাজার, নগিনাবাগ। যেখানে ছিলো এদেশের সব চেয়ে বিলাসবহুল ও মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিপণীগুলি। নগিনাবাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুলতানের অনুগত সেনাধ্যক্ষ আব্দুল রজ্জাক লারি'র নাম। যিনি শেষ পর্যন্ত মুঘল সৈন্যদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তাঁকে আহত, মুমূর্ষূ অবস্থায় নগিনাবাগেই পাওয়া গিয়েছিলো। তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। স্থানীয় লোককথার সূত্রে লারি একজন প্রবাদপ্রতিম বীর হয়ে যান। হাবসি কমান ধরে সোজা পশ্চিমদিকে গেলেই প্রথমে হাতিশালা আর অতিথিশালার টানা কাতার।

বালা হিসার দরওয়াজা পেরোলেই টানা রাস্তার বাঁদিকে রয়েছে সিলাহখানা বা অস্ত্রাগার। সিলাহখানার ডানদিকে ছিলো সেনাবাস। তৃতীয় প্রাকারটি পর্যন্ত সেটি বিস্তৃত ছিলো। অস্ত্রাগার পেরোলেই দুর্গের 'অন্দরমহল' শুরু হয়ে যেতো। সিলাহখানার বিপরীতদিকে একটি প্রাচীন মসজিদের অবশেষ পাওয়া যায়। তার পর থেকে দেখা যাবে একের পর এক বিস্তৃত অঙ্গন। রাজপ্রাসাদের পূর্বদিকে একটি সমতল স্থান রয়েছে যেখানে সুলতান সৈন্যদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন। তাকে ময়দান-এ-জিল্লুখানা -ই আলি বলা হতো। তাত্ত্বিকভাবে সৈন্যরা ঐ মসজিদের সামনে আল্লাহ তালার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু সেখানে সুলতান নিজে উপস্থিত থাকার জন্য তিনিও একসঙ্গে অভিবাদিত হয়ে যেতেন।এর দক্ষিণদিকেই বিখ্যাত মদন্না-অক্কন্নার প্রাসাদ ও প্রশাসন ভবন। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের আর্থিক মেরুদণ্ডের ভিত্তি ভবনগুলি। আর ছড়ানো ঘাসজমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট্টো, কিন্তু নয়নাভিরাম প্রার্থনা ভবন, তারামতী মসজিদ। এই নির্মাণগুলো পেরিয়ে এগোলেই শুরু হয়ে যায় গোলকোণ্ডার সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত্য ও জেল্লাদার অংশ। মূল রাজপ্রাসাদটির আবাসিক অংশ এখান থেকেই আরম্ভ হয়। এই অট্টালিকাগুলি দোতলা থেকে ছ'তলা পর্যন্ত উঁচু। হারেম, সরাই, ঘরের পর ঘর,অন্তঃপুর, বিশাল হলঘর, ফোয়ারা, ঝিল সব কিছু নিয়ে সেকালের স্থপতিদের শিল্প ও নির্মাণকৌশল এখনও দর্শকদের মুগ্ধ করে। সমগ্র রাজপ্রাসাদ মহার্ঘ গালিচা, বাতিদান, বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, পর্দা দিয়ে সাজানো ছিলো। গোলকোণ্ডা দুর্গ দখল করার পর অওরঙ্গজেব সেখানে বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি এতো বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকতে পছন্দ করতেন না।

একটি বিশাল অঙ্গন ঘেরা রানিমহল থেকেই দুর্গের জনানামহল শুরু হয়ে যায়। অঙ্গনের ঠিক মাঝখানে একটি সুরম্য ফোয়ারা। আয়তাকার ক্ষেত্রটিকে ঘিরে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সারিসারিপ্রাসাদ আর অট্টালিকা। একের পর এক দেখা যাবে রাজসিক প্রাসাদ আর তার ভিতরের বিশাল আর্চদেওয়া ঘরদুয়ার। একের ভিতর দিয়ে অন্যটি চলে যাচ্ছে। গোলকোণ্ডা দুর্গের স্থপতিদের আরেকটি বিস্ময়কর কীর্তি এই জলসম্পদে কৃপণ প্রকৃতি থেকে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করা। পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত দুর্গমচেরুভু ( গোপন জলাশয়) থেকে তাঁরা জল প্রবাহিত করে আনার কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন। আরও চমকপ্রদ ছিলো নিচে থেকে চারশো ফুট উপরে জল তোলার প্রযুক্তি।

বালা হিসার ওঠার সিঁড়ি এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পাহাড় চড়ার পাথরের ধাপগুলি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে উপরে। মাঝামাঝি জায়গায় সম্প্রতি একটি দেবীমন্দির তৈরি হয়েছে। এটি অর্বাচীন নির্মাণ। তার দুদিকে দুটি বিশাল গ্র্যানাইট পাথরের প্রাকৃতিক স্তম্ভ অজানা রহস্যে সোজা ,সন্তুলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পরেই রয়েছে বিশাল অম্বরখানা বা শষ্যাগার। আর একটু উপরেই রাজপরিবারের প্রার্থনার জন্য ইব্রাহিমশাহের তৈরি করা মসজিদটি। এর স্থাপত্য মূলত বাহমনি মেহরাবের ধরনে হলেও পরবর্তীকালে এই নির্মাণে কুতবশাহি মিনারগুলি যোগ করা হয়েছিলো। মানে চোদ্দো শতক থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ক্রমপর্যায়ে এর নির্মাণ হয়েছিলো। পাহাড়ের শিখরে বালা হিসারের শীর্ষ প্রাসাদ ‘বারাদারি’ দেখা যায়। এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকাটি নির্বাধ দেখা যায়। 'বারাদারি' শব্দের অর্থ বারোটি দুয়ার দেওয়া উদ্যানভবন। কিন্তু এর অর্থসম্প্রসারণ ঘটে গেছে সময়ের সঙ্গে। এই প্রাসাদটি দোতলা । এর শীর্ষে রয়েছে সুলতানের মসনদ বা সিংহাসন। সেখানে বসে তিনি আয়েশ করে পারস্যের শিরাজি সেবন করতে করতে নিজের রাজ্যদর্শন করতেন। এই সমস্ত নির্মাণের স্থাপত্যের প্রধান অবলম্বন ছিলো বিশাল মাপের, নানা আকারের গ্রানাইট পাথরের চাঁই। দুর্গের নিরাপত্তাই ছিলো প্রধান শর্ত। তাই তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হতোনা। বালা হিসারের এক কোণে একটি বৃহৎ সুড়ঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায়। সংকটকালে রাজপরিবার এই সুড়ঙ্গটি দিয়ে আট কিমি দূরের গোশামহল নামে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে পারতেন। এখন সেটি বন্ধ আছে।
এদেশে ​​​​​​​মধ্যযুগে ​​​​​​​স্থানিক ​​​​​​​রাজা ​​​​​​​বা ​​​​​​​সুলতানদেরও ​​​​​​​কী ​​​​​​​পর্যায়ের ​​​​​​​সম্পদ ​​​​​​​বা ​​​​​​​সমৃদ্ধি ​​​​​​​ছিলো, ​​​​​​​গোলকোণ্ডার ​​​​​​​দুর্গ ​​​​​​​বা ​​​​​​​কুলি ​​​​​​​কুতুব ​​​​​​​শাহি ​​​​​​​রাজবংশের ​​​​​​​প্রতাপ ​​​​​​​দেখলে ​​​​​​​সেটা ​​​​​​​টের ​​​​​​​পাওয়া ​​​​​​​যায়।