Next
Previous
1

প্রবন্ধ - অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়

Posted in




















(কয়েক মাস আগে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞস করেছিল, ‘তোমার সবচেয়ে সুখের অবকাশ কি?’ আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলেছিলুম, ‘কি আবার? কোন কাজকম্ম না করে, ঠ্যাং ছড়িয়ে বালিশে ঠেসান দিয়ে বই পড়া! ওর থেকে সুখের আর কিছু নেই।’

‘তাহলে চেন্নাইতে যাবার পর,ওখানে কি কি বই পেয়েছ আর পড়েছ,তাই নিয়ে লেখো না। দেখি কেমন হয়।’

‘আরে, আমার সাবজেক্টের মা বাপ থাকে না, কিন্তু। যখন যা ইন্টারেস্টিং মনে হয় তাই পড়ি। পাঠক ভাবতে পারে এ আবার কি। লাল নীল বেলুন নিয়ে এই বেলুনওলা কোথা থেকে এলো।

আরে,এক্সপেরিমেন্ট হোক না ।’

এই লেখাটি সেই ‘হোক নার’ ফসল। ছড়িয়ে থাকা জীবনের কয়েকটা বই আর তার স্মৃতি।)


তখন আমি সদ্য মাদ্রাজে এসেছি। চেন্নাই নাম তখনো আসেনি। সাধারণ মানুষ তখন জানতো না যে চেন্নাইপত্তনম বলে সাবেক কালে এক নুনের বন্দর ছিল। উত্তর মধ্য পুরনো চেন্নাই জমজমাট ছিল। কিন্তু নতুন গড়ে ওঠা দক্ষিন চেন্নাই সেসময় ফাঁকাফাঁকা। তখনো মোটরগাড়ির কারখানা আর সফটওয়্যার ব্যবসা গড়ে ওঠেনি। দক্ষিনে তেমন জমাটি বইয়ের দোকানপত্তর ছিল না।সেই পুরনো মাদ্রাজে বইয়ের দোকান বলতে সবচেয়ে নামকরা ছিল হিগিনবোথাম। মধ্য চেন্নাইয়ের বিখ্যাত মাউন্ট রোডে। বিশাল কলোনিয়াল বাড়ি। খুব ফরমাল পরিবেশ। সেখানে বেশি যাওয়া হোত না।

ফাঁকা মনে দিন কাটত। কলেজ স্ট্রিট, শশীভূষন দে স্ট্রীট আর মির্জাপুরে তেলেভাজা চা। চৌরঙ্গীতে গ্র্যান্ড হোটেল আরকেডে ফরেন পাবলিশার্স, নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলের উলটো ফুটপাতে, মডার্ন বুক। মোহন তেওয়ারীর দোকান। ভবানীপুরে সিগাল বুক—সন্ধ্যেবেলায় মন চলে যেত এইসব ফেলে আসা আড্ডায়।

এইসময়, একদিন চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে বুকিং অফিসের পেছনের পুরনো ভাঙা মুরমার্কেটের পুরনো বই আর রেকর্ডের জগৎ প্রথমবার দেখি। মুরমার্কেটের কথা নতুন বন্ধুদের থেকে শুনতুম। রেলের নতুন বড় অফিস বিল্ডিং ওই পুরনো মুরমার্কেটের জমিতে গড়ে উঠেছে। শীতকালে এর পাশেই সার্কাসের তাঁবু পড়ে। প্রথমদিন গিয়ে দেখি, আরে এতো একদম দিল্লির দরিয়াগঞ্জের দক্ষিণী এডিশন। যে কোন বড় শহরের পুরনো বইয়ের বাজারের মতো, প্রচুর নীলমার্কা ক্যাসেট আর বই এর ভিড়। এক ছোট্ট দোকানদার। আমায় দেখে হিন্দিতে কথা বলল। নাম আমেদ। উচ্চারনে আহমেদ ছিল না। হাফ মিনিট কথার মাঝে বার করে দিয়েছিল, সমরসেট মমের মুন এন্ড দ্য সিক্স পেন্স। চার টাকায়। ত্রিশ বছরের পুরনো কপিটা আমার এখনো আছে। মুন এন্ড দ্য সিক্স পেন্স যে ১৯শতকের শেষভাগের ইউরোপিয়ান পেন্টার পল গগ্যাঁর জীবন নিয়ে লেখা, সে খবর জানতুম। পল গগ্যাঁ যে ধারার(স্টাইল-মুভমেন্ট) ছবি আঁকতেন তার নাম যে পোস্ট-ইম্প্রেজনিজম, এটাও জানতুম। সমরসেট মম দক্ষিন সমুদ্র(south seas} বেড়াতে গিয়ে এ উপন্যাস লিখেছিলেন, সেটাও জানতুম। ব্যস, আর কিছুই জানতুম না। মুরমার্কেটের চারটাকা দামের ওই বই আমাকে পোস্ট-ইম্প্রেসনিজম পেন্টিং এর প্রতি শুধু যে আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিল তা নয়। আমেদ আমাকে বইয়ের দোকানের শুলুক সন্ধান দিয়েছিল। ওর সম্পর্কে ভাই জালাল, আমার পাড়ায়, মানে দক্ষিন চেন্নাইতে ট্রলিতে সেকেন্ড হ্যান্ডড বই বিক্রি করে সে খবরও দেয়। জালাল আমাকে তার ট্রলি থেকে দিয়েছিল এরিক হবসবমের চার ভল্যুমে ইউরোপের ইতিহাস।

সেই সময়ে সদ্য আলাপ হওয়া বন্ধুরা আমাকে নিয়ে যান, মধ্য মাদ্রাজের টিনগরে আর সানথম হাই রোডে। বসে আড্ডা মেরে বই কেনার দোকান সব টিনগরে ছিল। টিনগরের বালাজি বুক সেনটার আর সানথম হাই রোডের ধারে কাচেরি রোডে, ওয়েসিস বুক সেন্টা্র। ওয়েসিস বুক সেন্টারে প্রথমে চোখে এসেছিল নোম চোমস্কির হাল আমলের বই। চোমস্কির সিজ অন স্টেট, প্রফিট ওভার পিপল, অন এ্যানার্কিসম আর ডেটেরিং ডেমোক্রেসি। তাকের সামনেই। চোমস্কি কলকাতায় খুব পপুলার। যত না ভাষাতত্ত্বের নতুন চিন্তার জন্যে, তার থেকে বেশি পলিটিকাল ইকনমির লেখার জন্যে। একদম ফ্যাশানে পরিনত হয়েছিলেন। তবে এটাও ঠিক, মার্কিন দাদাগিরির মুখোশ খুলে অন্য চরিত্র তুলে ধরার মত যে অল্প কয়েকজন আমেরিকা্ন আছেন, চোমস্কি তাদের মধ্যমণি। চোমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন ভিয়েতনামে গিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের নিন্দে করেছিলেন। মানতেই হবে, যুদ্ধের সময় শত্রুদেশের রাজধানীতে গিয়ে নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে অনেক হিম্মত লাগে। চোমস্কি সেই ধাতের মানুষ। নিজেকে তিনি এ্যানার্কিস্ট বলেন এবং এ্যানার্কিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে পপুলার চরিত্র মিখাইল বাকুনিনের ভাবশিষ্য ভাবেন। সোভিয়েত রাষ্ট্র ও মার্কসের তত্ত্বের খোলাখুলি সমালোচক। কিন্তু সেই সময় তাঁর রাষ্ট্র(স্টেট) বা এ্যানারকিজম নিয়ে লেখাপত্তর কলকাতায় খুব পপুলার ছিল না। কলকাতায় আমার বন্ধুরা চোমস্কির ওইসব বই এড়িয়ে যেত। এ্যানার্কিসম শব্দটাকে তখন কিছুটা খারাপ চোখে দেখার চল ছিল, কলকাতায়। চোমস্কি কিন্তু কখনো রেখেঢেকে কথা বলেননি। প্রসঙ্গত বলি চেন্নাইতে কিন্তু এ্যানারকিসমের চর্চা ভালোই ছিল। চোমস্কিপন্থী বা এ্যানারকিজম মতবাদী লোকেদের বইমেলায় দেখতে পাওয়া যায়। দ্য হিন্দু পত্রিকার আতিথ্যে চোমস্কি যখন মধ্য চেন্নাইয়ের সবচেয়ে নামকরা প্রেক্ষাগৃহ, মিউজিক এ্যাকাডেমিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, হাউসফুল হয়ে গিয়েছিল।

চোমস্কির ভাবগুরু বাকুনিন রাশিয়ার লোক ছিলেন। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার পথীকৃৎ বলা যেতে পারে। লেনিন বা লেনিনের প্রথম জীবনের গুরু প্লেখানভের অনেক আগে বাকুনিন সমাতান্ত্রিক রাজনীতির প্রচার করেছেন। বাকুনিনের সঙ্গে কার্ল মার্কসের প্রথমে বন্ধুত্ব ছিল, পরে তুমুল মতভেদ হয়। এমনকি মার্কসের চাপের সামনে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে বাকুনিন বহিস্কৃত হয়েছিলেন। এসব কথা কিছু কিছু কলকাতায় শুনেছিলাম। কিন্তু এই সাবজেক্টে মার্কসের বা বাকুনিনের লেখা কলকাতায় সহজে পাওয়া যেত না।

আর চেন্নাইয়ে ঠিক সেই সময়ে এক সুখকর আবিস্কার হয়েছিল। প্রথমবার টিনগরে বালাজি বুক স্টলে ঢুকে পেছনের তাকের দিকে তাকাতেই দেখেছিলাম, বাকুনিনের অন এ্যানার্কিসম, আর গড এ্যান্ড দ্য স্টেট। বাকুনিন? মানে এ্যানার্কিসিট মিখাইল বাকুনিন!! এদেশে পাওয়া যায়! লোক পড়ে! বেশ অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলুম। বাকুনিনের লেখা মার্কসিজম, ফ্রিডাম এ্যান্ড দ্য স্টেট, রিকালেকশন অন মার্কস এ্যান্ড এঙ্গেল। মার্কস আর বাকুনিনের মধ্যে রাষ্ট্রের তত্ত্ব নিয়ে, সমাজতন্ত্রের চরিত্র নিয়ে মতবিরোধ, ছাড়াছাড়ি কেন হয়েছিল সে সব জানার কারুর ইচ্ছে থাকলে দুজনের লেখাই পড়া উচিত। আগেই বলেছি বাকুনিনের লেখা সহজে পাওয়া যেত না। আরো সমস্যা ছিল এ্যানার্কিজমের জন্মদাতা, আদিপুরুষ প্রুধোঁর(pierre joseph Proudhon) লেখা, কলকাতায় সহজলভ্য ছিল না। প্রুধোঁ এ্যানার্কিজম তত্ত্বের সৃষ্টিকর্তা। । মার্কসের প্রথম জীবনে প্রুধোঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরে মতভেদ, চরম ডিবেটে পরিনত হয়েছিল। মার্কসের প্রথম জীবনের প্রুধোঁকে আক্রমণ করে লেখা পভার্টি অফ ফিলসফি’(প্রূধোঁকে ব্যঙ্গ করে লেখা) কলকাতায় সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু ডিবেট শুরুর প্রথম বা অরিজিনাল লেখা, প্রুধোঁর ‘ফিলসফি অফ পভার্টি’ বা প্রপার্টি ইজ থেফট, পাওয়া যেত না। কিন্তু চেন্নাইতে পেয়েছিলাম।

আজ মনে হয় এ্যানার্কিজমের(নৈরাষ্ট্রবাদ, কিছুটা ভুলভাবে অনেকসময় নৈরাজ্যবাদ বলা হয়) মধ্যে এক স্বপ্নিল মায়াময় ইউটোপিয়া আছে। আর মার্কসিজমে আছে, দিন আনি দিন খাই গেরস্থের নির্মম বাস্তব থেকে উঠে আসা এক ভোরের বিশ্বাস। এসব গল্প পরে কোনদিন হবে।

তখন আমার আড্ডা জমে গেছে। দুবার দোকানে যাবার পর টিনগরের দোকানরা অথবা ওয়েসিস বুক সেন্টার শুধু যে বসতে চেয়ার দিত তা নয়। এখনো স্মৃতিতে আছে, মালিক চেঁচিয়ে বলছে-‘স্ট্রং কাপি কুড়ুপা’(স্ট্রং কফি নিয়ে আয়) সঙ্গে মসালা বড়া (বেসনের সঙ্গে ডাল আর শাক মেশানো চ্যাপ্টা বড়া) নিয়ে আড্ডা বসত। আপনি প্রান ভরে বই দেখুন। কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। এইভাবে টিনগরে আর কাচেরি রোডের দোকানে আড্ডা দিচ্চি। গ্র্যান্ড হোটেল আরকেডের ফরেন পাবলিশার্সের তপনের(চট্টোপাধ্যায়) কথা মনে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপের সোশালিস্ট আন্দোলন, তার তাত্ত্বিক আন্দোলনের পলিটিকাল ফিলসফিতে মজে আছি। সেই সঙ্গে সমসাময়িক পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক ইতিহাস- এরিক হবসবমের এজ অফ ক্যাপিটাল, এজ অফ এমপায়্যার। এককথায় ১৯শতকের দ্বিতীয়ভাগের ইউরোপীয় পলিটিকাল ফিলসফি আর ইতিহাসে ডুব দিচ্ছি তখন একদিন আলোয়ার তাথার( তাথা মানে দাদু) দোকানে আমরা গিয়েছিলাম। আলোয়ার তাথার কথা না বললে চেন্নাইয়ের বইএর দোকানের কথা অসম্পুর্ন থেকে যাবে।

চেন্নাইয়ের বই পড়ার ঐতিহ্য আর তার ইতিহাসের সঙ্গে এই পুরনো বইয়ের দোকানটা অচ্ছেদ্য গাঁটছড়ায় জড়িয়ে আছে। যে কোণ পুরনো বইএর দোকানের কথা বলতে গেলে চেন্নাইয়ের মাইলাপুর লাজ কর্নারে (Luz corner) আলোয়ারের বইয়ের দোকানের কথা আসবেই। দোকান আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে আলোয়ার(alwar) শুরু করেছিলেন। দোকান বলতে ফুটপাতে বই থাক দিয়ে ডাঁই করা আছে। ত্রিপল ঢাকা। এখানে আসেনি এমন বিদগ্ধ তামিল বুদ্ধিজীবি প্রায় নেই। তরুণ বয়সে আন্নাদুরাই, করুনানিধি (দুজনেই তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং আধুনিক তামিল ভাষা ও চলচ্চিত্র চিত্রনাট্যের আধুনিক রুপকার বলা যেতে পারে), নাট্য ব্যক্তিত্ব চো রামস্বামী, কবি ভারতীদশন সবাই দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজে আসতেন।

অনেকেই হয়ত ব্লসমের(blossom) কথা বলবেন। নিঃসন্দেহে পুরনো বইয়ের সবচেয়ে খানদানি দোকান ব্যাঙ্গালুরুর ব্রিগেড রোডের পাশে ব্লসম। এক ছাদের তলায় এত বড় সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের পসরা আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।

কিন্তু চেন্নাইয়ের লাজ কর্নারের ফুটপাতের ঐ নামহীন দোকান যা আনন্দ দিয়েছে তা আর ভুলব না। একদম খোলা আকাশের নিচে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে বই দেখুন। আলোয়ার তাথা আজ আর জীবিত নেই। তাঁর মেয়ে এখন দোকানটা চালান। আলোয়ার তাথা আমাকে দিয়েছিলেন মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড। আমি তখন, ওই আগে যা লিখেছি, ইউরোপের ১৯শতকের রাজনৈতিক দর্শন, রাজনীতিআর তার সামাজিক ইতিহাসে গলা ডুবিয়ে স্নান করছি। সেই সময় আলোয়ার তাথার হাত ধরে আমার মার্কেজ জীবন শুরু। মার্কেজ আমার বিদেশী সাহিত্যের বন্ধ হয়ে যাওয়া জানলাটা আবার খুলে দেয়। এর আগে রাশিয়ান সাহিত্য পড়েছি, অনুবাদে। সেসব সস্তায় পাওয়া যেত বলে। ইংরেজি উপন্যাস বলতে হেমিংওয়ের, ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি। আর দু একটা কিছু।

(২)

গার্বিয়েল গ্রাসিয়া মার্কেজ, একটা আকাশ। চেন্নাইয়ের পরিবর্তন আর এই আকাশের ঘুড়ির দিকে লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একসঙ্গে আমার ঘটেছে।

মার্কেজের লেখাতে আমার একটা মানসিক বাধা বা রেসিসটেন্স ছিল। তখন মার্কেজ ভীষন পপুলার। সারা বিশ্বের বহু ভাষায় তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ কপি তাঁর লেখা বই বিক্রি হয়, সারা পৃথিবীতে। ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর বন্ধু। বিল ক্লিন্টন থেকে বিল গেট তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। মেক্সিকোর বিপ্লবী গেরিলারা তাঁকে সরকারের সঙ্গে মধ্যস্ততা করতে অনুরোধ করেন। এমন লেখক তো এস্ট্যাবলিশমেন্টের কাঁধে হাত রেখে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লেখা কি আর পড়ব!! এরকম একটা মানসিকতা আমার ছিল। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে শুরু করেছিলুম। এবং হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান তার যাদুকাঠি আমার সামনে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এখনো সম্মোহন কাটেনি। সেই অমর লাইন, “ অনেক বছর পরে, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অর্লিয়ানো বুয়েনদিয়ার মনে পড়েছিল, আরো অনেক আগের এক বিকেলে কথা, বাবা তাকে বরফ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মাকোন্দো এক দশ ঘরের নদীর ধারের গ্রাম।” এক ঝটকায় ফাতনায় আমাকে গেঁথে ফেলেছিল, বুয়েনদিয়া পরিবার। পরিবারের আদিপিতা জোস আরকাদিয়ো বুয়েনদিয়া ভেবেছিলেন, সমুদ্রের ধারে বাসা বাঁধবেন। সমুদ্র তিনি কোনদিন দেখেননি। মাঠ ঘাট পেরিয়ে একদিন একটা ছোট্ট গ্রাম দেখলেন। দশ ঘরের বাসিন্দা নিয়ে । নাম মাকোন্দো। মাকোন্দো এক কল্পনার গ্রাম। এ ঠিক আর.কে নারায়নের মালগুডি নয়। বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নালতে হরিশপুর’ বা ‘নিশ্চিন্দিপুর’ এ গ্রামের কাছাকাছি(যেখানে হরিহর, ছেলেকে নীলকন্ঠ পাখি দেখাতে নিয়ে যায়)। বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু বছরে একবার কি দুবার জিপসিরা আসে। তারা তাঁবুর মধ্যে গ্রামের লোককে দুরবিন দেখায়। বরফ দেখায়। ঘড়ি দেখায়। সময় কাকে বলে বোঝায়। ম্যাগনেট বিক্রি করে। সেই ম্যাগনেট নিয়ে সোনা খুঁজে পাবার আশায় আরকাদিয়ো পাগলের মত জঙ্গলে নদীর ধারে বালিতে ঘুরে বেড়ায়। জিপসি এমন আতর বিক্রি করে তাতে শুধু হলুদ প্রজাপতি গায়ের কাছে আসবে। হঠাৎ গ্রামের মানুষ ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা্র শিকার হয়। সারা গ্রামের লোকের ঘুম আসেনা। তারা নিদ্রাহীনতা থেকে স্মৃতি হারাতে শুরু করে। গ্রামেরা বুড়োরা ভয় পায়, তবে বুঝি সব কিছু গ্রামের লোক ভুলে যাবে। তারা গ্রামের মুখে লিখে রাখে ‘ভগবান আছে’(God exists)। মোরগ লড়াইয়ের ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ রাগের মাথায় একজন আরেকজনকে খুন করে। তারপর সারা জীবন সেই মৃত মানুষের প্রেতাত্মা খুনীর সঙ্গে মাঝরাতে গল্প করতে আসে। রাজমিস্ত্রি লুকিয়ে ছাদের খড় সরিয়ে বিবসনা তরুণীকে দেখতে চেষ্টা করে। তারপর ছাদ ভেঙ্গে ঘরে পড়ে মাথা ফেটে মারা যায়। ফাটা মাথা থেকে হলুদ ঘিলু বেরোয়। সেই ঘিলু থেকে নারী শরীরের গন্ধ ভেসে আসে। গ্রাম বড় হয়। আরকাদিও বুয়েনদিয়া, ম্যাকদালেনা নদীর মোহনা ধরে সমুদ্র দেখতে বেরোয়। পথ হারিয়ে উপনদীর চড়ায় পুরনো জাহাজের মাস্তুল খুঁজে পায়। আমেরিকান ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি কলা রপ্তানির ব্যবসা খোলে। হাজার হেক্টরের কলাবাগান করে। শ্রমিকরা হরতাল করলে, কয়েক শো শ্রমিককে গুলি করে মারা হয়। কতজন তার ঠিক থাকে না। এই হরতাল, শ্রমিক বস্তি,আন্দোলন, হরতাল ভাঙতে মিলিটারির পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে দুদিক থেকে মেসিনগান চালানো, প্রায় সাত পাতা জুড়ে তার কথা। একটা বাচ্চা ছেলে খালি বেঁচে যায়। বুড়ো বয়সে তার স্মৃতি উঠে আসছে। একদম কাটা কাটা নির্মম ভাষায়। ওই সাত পাতা আমাকে একঝটকায় জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠের সামনে এনেছিল।

আমি আস্তে আস্তে ঘূর্ণিপাকে ঢুকে যাচ্ছি বুঝতে পেরেছিলুম। এই জাদুবাস্তবতা তো অবাস্তবের ঠোঙায় ঢাকা এক গভীর রিয়ালিজম। ল্যাটিনো মানুষ গ্যার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মাকোন্দোর মধ্যে দিয়ে, আমার গ্রামের কথা টেনে আনছেন। সেই হাওড়া জেলার গ্রাম, যেখান থেকে বেরিয়ে এসে সারাজীবন শহুরে হবার বেকার চেষ্টা করেছি, এতো সে গাঁয়ের কথা। আমরা, বন্ধুরা একবার প্রাচীন কৌশিকি নদীর(কাণা দামোদর) উৎসমুখ থেকে মোহনা দেখবার আশায় বেরিয়েছিলাম। বর্ধমান জামালপুর থেকে শিয়াখালা চাঁপাডাঙ্গায় ‘মরা নদীর সোঁতা’ দেখেছিম। সন্ধ্যের গল্পের আসরে, শুনেছি এই কাণা দামোদরের বালির তলায় এখনো সপ্তডিঙ্গার কাঠ পাওয়া যায়। সে হাজার মণি নৌকো যেত তাম্রলিপ্ত ছুঁয়ে শ্রীলঙ্কা। পূর্ণিমায় আমাদের বাড়ির বেলগাছের আড়াল থেকে ব্রহ্মদৈত্য এসে আমাদের বাড়ি পাহারা দিত। বাঁশবনে দপ করে জ্বলে উঠত শঙ্খমালার আগুন। বাঁকুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহে, জালিয়ান ওয়ালাবাগে, তেভাগা্র ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। উনষাটের কার্জন পার্কে আমার গাঁয়ের ক্ষ্যাপা হাড়ি, ভোলা দুলে, ঋষি খাঁড়া গুলি খেয়েছিল। -

পাতার পর পাতা ঘন ঠাস বুনোনের কাহিনী। উপন্যাসের প্রথম লাইনের সেই, ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা আসছে না। সে কথা আসবে অনেক পরে। তার ওপর গল্প বলার স্টাইল। একেতো ঠাস বুনোনে দম ফেলার জায়গা না রেখে কাহিনী গড়িয়েছে। তার ওপর পরিবারের সবায়ের নাম একধরনের। আমার মত সাধারন পাঠককে এ লেখা অন্তত দুবার পড়তে হবে। আমাদের প্রথম যৌবনে জেমস জয়েসের ইউলিসিস নিয়ে এরকম কথা চলত—‘ তিনবার পড়ে যে বুঝতে পেরেছে তার বুদ্ধি সাধারনের থেকে ওপরে।’ এ লেখা অবশ্য ইউলিসিসের মত দুরুহ নয়। কিন্তু যাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম আপনাকে স্মৃতি কার্পেটে বসিয়ে দেবে। বুঝবেন কেন সলমান রুশদি এই ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড পড়ে বলেছিলেন, ‘সব শেষ হয়ে যায়। জীবন যৌবন সব। জেগে থাকে শুধু স্মৃতি। কুমারী মেয়ের তীব্র কামেচ্ছার মত স্মৃতি।’ ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউডের মধ্যে দিয়ে, আমার গ্রাম, তার টোকো আমবাগান, লাল ঠোঁট টিয়াপাখি, পেটভাতায় থাকা বাগাল, পাট পচানো গন্ধ আর রাতের জোনাকি নিয়ে উঠে আসতো।

আমি শুধু মার্কেজ পড়ে যাচ্ছি। যা পাচ্ছি তাই। তাঁর ওপর উইলিয়াম ফকনার আর হেমিংওয়ের প্রভাব, তাঁর আত্মস্মৃতি, নোবেল পুরস্কার বক্তৃতাতে-এল ডোরাডো শব্দটা নিয়ে ইউরোপিয়ানদের অকারণ রহস্য তৈরির চেষ্টা নিয়ে ঠাট্টা।

আমি বুঝতে চাইছিলুম কিভাবে এই এক লেখক বিশ্বগদ্যসাহিত্যের স্টাইলকে পালটে দিলেন। কেন দক্ষিন গোলার্ধের লেখকরা উপন্যাস শুরু করতে গেলেই ওই কর্নেল বুয়েনদিয়ার ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার বাক্যবন্ধণীকে এড়াতে পারেন না। সালমান রুশদি থেকে নাইজেরিয়ার বেন ওকেরি সবাই এই ম্যাজিক রিয়ালিজম বা যাদুবাস্তবতাকে না না রঙে ভরিয়ে তুলছেন।

আমার এরকম মানসিক সময়ে একদিন তামিল লেখক ডি দিলিপকুমারের সঙ্গে ওনার বইয়ের দোকানে(দোকানটা উনি পরে তুলে দিয়েছেন) আড্ডা মারছি। আড্ডার মধ্যে দিয়ে বুঝে ছিলুম, উত্তরউপনিবেশিক বা পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যের জন্মদাতা আসলে মার্কেজ। উনিই প্রথম ন্যারেটিভ স্টাইলকে ইউরোপের হাত থেকে বার করে এনেছেন। নভেল বা ফিকশন মানেই ডিকেন্স, টমাস হার্ডি বা সমরসেটে মমের গল্প বলার স্টাইল, স্বতঃসিদ্ধ ট্রাডিশন--এখান থেকে কাহিনীকে বার করে এনেছেন। দক্ষিন গোলার্ধের সাহিত্যিকরা, আম গাছের তলায় বা মাইমোসা গাছের ছায়ায় বসে ঠাকুমা পায়ে তেল মাখতে মাখতে যেভাবে গল্প তৈরি করতেন অথবা বাবার পিসতুতো বোন মায়ের খুড়তুতো ভায়ের সঙ্গে চড়কের কি দশেরার মেলায় দেখা হয়ে গেলে যেভাবে গল্প করতো, সেই ঐতিহ্যকে ধরতে চাইছেন।

দিলিপকুমার আমাকে দিয়েছিলেন তামিল দলিত সাহিত্যের অনুবাদ। বলেছিলেন, তামিল সাহিত্য প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ আর চেকফের দিকে তাকিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপের দিকে নয়। সেকথা অন্য কোন দিন হবে।

অপার সমুদ্র। সাঁতার তো শেখা হয় নি।