প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রবন্ধ
কমলকুমার মজুমদারের একটি নিজস্ব
ভাষা ছিল। যে ভাষায় তিনি তাঁর উপন্যাস লিখেছেন সেই ভাষা তাঁর গল্পের ভাষা নয়।
উপন্যাসের ভাষা ও তার দুর্বোধ্যতা নিয়ে পাঠককুলের সমস্যা চিরকালীন। কেউ কেউ মনে
করেন তাঁর এই আপাতদুর্বোধ্য ভাষা একরকমের অহংকারের ভাষা। কেউ আবার ভাবেন তাঁর
ভাষার এই দুর্বোধ্যতা আসলে সাধারণ মজারু ও বিনোদনপিয়াসী পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখার
প্রয়াস। এরকম মনে করার বিশেষ কারণ আছে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন শোনা যায় যে, তাঁর লেখার মাত্র পঁচিশটি পাঠক হলেই যথেষ্ট। অর্থাৎ তাঁর সংশয় বা প্রতীতি
যাই বলি না কেন, সেটি যথার্থ। তবু কোনো কারণে তাঁর একটি
উপন্যাস পাঠ করা হয় এবং অনুভব হয়, তাঁর লেখা পড়ার জন্য একটি
অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। তা হল, জীবনের বহিরঙ্গের
সুখবিলাস ও তৎসম্পর্কিত ধর্মীয় আচারের ভণ্ডামি থেকে নিজেকেও চাবুক মেরে জাগিয়ে
দিতে হবে। নিজের সেই সব আসক্তি সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত থাকতে হবে। সেই উপন্যাসটি,
যা কমলকুমারের ভাষার আড়ালে তাঁর গভীর জীবন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার
সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে ছিল, তার নাম ‘অন্তর্জলী যাত্রা’।
বহিরঙ্গে কুৎসিত সামাজিক ব্যাধি ও পুরুষতান্ত্রিকতার আড়ালে যা আসলে আধ্যাত্মিক
জগতের গূঢ় রহস্যের কথা বলে।
এরপর গোলাপসুন্দরী ও শ্যামনৌকা তাঁর সেই দর্শনেরই পুনঃনির্মাণ। বলা উচিত
সচেতন নির্মাণ। কারণ বাস্তবে এমন বহু চরিত্রই আমাদের অদেখা। যা শুধু তাঁর দর্শনের
মূল কথাটি বলতেই নির্মিত হয়েছে। ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ আরও দুর্বোধ্য বলে জানা ছিল,
যা নাকি হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য, তবু আকর্ষণ বড়
ভয়ানক। তাঁর বর্মের মতো কঠিন ভাষা যেন
লোহার অঙ্গরক্ষা। সে ভাষাকে ভেদ করা দুরূহ। যেন শব্দের অতীত এক অনুভূতি তিনি
বারবার প্রকাশ করতে চেয়েছেন। বাস্তবের পটভূমিতে এক অবাস্তব কথামালা। হয়তো তিনি
ইচ্ছে করেই একটি নিজস্ব সাহিত্যভাষা সৃষ্টি করেছিলেন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মতো
অজস্র গুণমুগ্ধ চাননি। যা চেয়েছেন তা হল,
তাঁর অন্তর্জগতে উদ্ভাসিত এক অপূর্ব উপলব্ধির প্রকাশ।
প্রথম কথাটি, তিনি উপন্যাসে যে মায়ের মতো
নারীচরিত্রটি এঁকেছেন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীমা সারদার
মন্ত্রশিষ্যা। সেই সময়ের নিরিখে তিনি এবং তাঁর স্বামী সংস্কারমুক্ত। একটি ডোমের
ছেলে (ডোম চরিত্র কমল কুমারের অতি প্রিয়, সম্ভবত তাদের
পবিত্র কাজের কথা ভেবেই তিনি তাদের প্রতি এত আকৃষ্ট, কারণ
মৃতদেহ সৎকারের চেয়ে বেশি পুণ্যকাজ আর কিইবা আছে!) সুঘরাইকে তিনি দেওঘরে বৈদ্যনাথ দর্শনে এনেছেন। বালক ভোজনের
সময়ে সুঘরাই তার পাতে নিজের পোষা পাখিটিকে নিয়ে বসে। সম্ভবত পাখিটি তিতির। এই
দৃশ্যে সেই রমণী যারপরনাই পুলকিত। মনে পড়ে ভারতবর্ষের অন্যতম আধ্যাত্মিক সম্পদ
উপনিষদে বর্ণিত পাখিটির কথা। তৈত্তিরীয় উপনিষদে এমনই দুটি পাখির কথা আছে। একটি
স্থির অপরটি চঞ্চল। স্থির পাখিটি পরমাত্মা, চঞ্চলটি
জীবাত্মা। সুঘরাই যেন তার দেহপিঞ্জর থেকে মুক্ত করে আনে আত্মাকে। তারপর প্রসাদ
গ্রহণ করে। এ দেহখাঁচায় সুঘরাই যেন নিজেই শুক। তার আত্মার মুক্তি কখনোই তার
বাহ্যিক জগতের পরিচয়ের ওপরে নির্ভর করে না। অথচ কাহিনী যতই এগিয়েছে লক্ষ করা
যায় যে সুঘরাই আধুনিক জগতের আবর্তে যেন
ডুবতে থাকা একটি মানুষের মতো এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইছে। কমল কুমারও কি তাইই
চেয়েছেন? একথা ভুললে চলবে না যে সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার
মনস্তত্ত্বকেই খুঁজে পাওয়া যায়। যে কারণে তাঁর উপন্যাস শুরু হয় একটি প্রার্থনার
মধ্যে দিয়ে -জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো—জয়
রামকৃষ্ণ। মাত্র দশ বছরের এক বালকের
অনুভূতিকে তিনি হঠাৎ কাহিনীরূপ দিলেন কেন? এ প্রশ্ন মনে
জাগতেই বোঝা গেল তাঁর মনের সেই গতি। তিনি আদতে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই চিরকালীন
বালকভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বালক, যে কিনা ইন্দ্রিয়ের দাস
নয়। ভোগ যাকে বিচলিত করে না। সেই বালক সুঘরাই একটি পবিত্র পরিচয় বহন করে। সমাজ
তাকে যতই অন্ত্যজ করে রাখুক। সে ডোম। আর সে একটি পোষা পাখিকে খাঁচায় নিয়ে ঘোরে। সেটি
তার প্রিয়জন। কমল কুমারের এই রূপকের আড়ালে কি সেই চিরন্তন সত্যটি দেখতে পাওয়া
যায়না? এই দেহ, যা মানুষের অতি প্রিয়,
যা জগতে নানা ভোগের আয়োজনে মত্ত থাকে তা আসলে হাড়মাসের খাঁচাটি।
অন্তরাত্মা বন্দী থাকে সেখানে। সেই অচিন পাখিটিকে চিনতে পারলে মনোবেড়ি তার পায়ে পরানো সোজা।
একটি বিশেষ মুহূর্তে সুঘরাই দেখতে পায় বৈদ্যনাথ ধামে শিবের সঙ্গে বিবাহ
দেবার জন্য পরমাসুন্দরী গৌরী সালংকারা কন্যাকে শোভাযাত্রা করে আনা হচ্ছে। কন্যাটি
শিবের পরিণীতা হতে চলেছে। এই অলৌকিক পরিণয় প্রকৃতপক্ষে দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
করে। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পাণ্ডারাজের ভোগের বিকট আয়োজন।
আর একটি মর্মার্থ পাওয়া যায়। অলৌকিক এই শোভাযাত্রায় যে অনাঘ্রাতা নির্মল কুমারীটি
ঈশ্বরকে স্বামীত্বে বরণ করতে চলেছে সে প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নয়। তার অস্তিত্ব জাগতিক
নয়। আত্মিক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন -তাঁকে লাভ করতে গেলে একটি প্রেমের শরীর চাই।
এই শরীর নয়। কিন্তু এই অন্নময় শরীরের অন্তরে আর একটি শরীর আছে। তাকে বলে ভাগবতী
তনু বা কারণ শরীর। এই শরীরে ঈশ্বরীয় আনন্দের আস্বাদন হয়। সে আনন্দ রমণানন্দের চেয়ে
কোটিগুণ বেশি। এই অলৌকিক পরিণয় তাই চিরন্তন, যা কমল কুমারের
আধ্যাত্মিক দর্শনের নির্যাস।
স্বল্প পরিসরে আর একটি বিশেষ দিক প্রকট হয়। সুঘরাই কিন্তু এই অন্নময় শরীর
নিয়েই জগতে বিচরণ করে। সে তার খাঁচাটিকে
নানা ভূষণে সাজাতে চায়। কারণ, এই শরীরখাঁচা বিনা সে যে কোনো
আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না! তাই খাঁচাটি প্রতিনিয়ত সাজাতে চায়। রিখিয়ায় উপস্থিত
সেকালের সব চেঞ্জারবাবুরা ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করার সব উপকরণ নিয়ে হাজির। অথচ সুঘরাই
ব্যতিক্রম। তার পাখিটিকে মুক্ত করতে পারল কিনা স্পষ্ট বোঝা যায়না। পারা সম্ভবও নয়,
কারণ সে পাখি মুক্ত হলে আকাশে বিচরণ করবে। মাটির পৃথিবী তার দেখা
পায় না।
কমলকুমার তাঁর এই সমৃদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তাই আমাদের ভাষাকে পরিত্যাগ
করেন। তাঁর শব্দ শুধুই আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বাহক।
[অপ্রকাশিত]