Next
Previous
0

নাটক - অংশুমান দাশ

Posted in








পাখোয়াজের বোল । যুদ্ধের আভাস । আলো জ্বলে উঠছে । দর্শকের দিকে পিছন ফিরে বসে কথক। পাখোয়াজ থামলে - ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন।

যুদ্ধ শেষ হল সবে
কোলাহল কলরবে
এতদিন কাক পক্ষীটিও আসেনি ধারে কাছে
এখন গাছে গাছে
কেবল চিল ও শকুনি
রোজ রোজ এমন ভোজ
আগে তো মেলেনি ।

আঠেরো দিন, আঠেরো দিন ধরে
কাতারে কাতারে
হাতি ঘোড়া রথ
পদাতিক সেনাবাহিনী
- সে এক মস্ত কাহিনী ।

যুদ্ধ মানেই গল্প
শুরু তার যতই অল্প
হোক না, নারী বা ভূমি –
অথবা নিছক খনিজ তেল –
ব্যবসা অঢেল –
অস্ত্র সৈন্য জোয়ান মানুষ ।

আসল যুদ্ধ তো যুদ্ধের পরে
ঘরে ঘরে
ফেরেনি মানুষ – ছেলে, ভাই
অনিচ্ছুক সাধারণ লোক – নিছক চাকরির খাতিরে ।

আসল যুদ্ধ এই না-থাকার সঙ্গে থাকা
শূন্যস্থানের পাশে
মনে হয়, যদি আসে – যদি ফিরে আসে ।

যুদ্ধ শেষ হল সবে –
কি আর হবে
সে কথা ভেবে,
পাণ্ডব কৌরব নয় –
এখন দুই দল – জীবিত ও মৃত ।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঠে
হাজারে হাজারে চিতা
আগুনেই শেষ শয্যা পাতা
যতটুকু পাওয়া গেছে, টুকরো টাকরা
শরীরের আভাসের মত ।

যতটুকু হৃদয়ের ক্ষত
তাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় ।

পাখোয়াজের শব্দ – যেন হৃদস্পন্দন । কথক নির্দেশ করেন একটি পড়ে থাকা সাদা কাপড়ের দিকে।

মাঠের প্রান্তে কে ওই নিশ্চল
কেউ নেই আশেপাশে
কেবল উড়ে আসে
আগুনের ফুলকি - ঈষৎ অগ্নিভ রং ?

মৃতদেহের কপালে রাখা হাতে জ্যা-এর দাগ?
সূর্যাস্তের অস্তরাগ
ঘটোৎকচের শীতল বুকের উপর এসে পড়ে –
হিড়িম্বা জননী তার মূর্তি পাথরের ।

শেষ শক্তিটুকু তার, ওই শুয়ে – একা
যেমন একাকী ছেড়ে যেতে একদিন, দুবারও ভাবেনি কেউ ।

সেই কথা মনে করে আজ,
ছেলের বুকে হাত রেখে হিড়িম্বা ভাবেন –
এইবার শেষ হল কাজ ।

কোন কথা? কোন কাজ?
এইবার মনে করা যাক ।

বাজনা – দ্রুত । কথক স্থান বদলাচ্ছেন ।

সারারাত্রি জুড়ে জতুগৃহ পুড়ে
অনলে হয়েছে ছাই
কিরাত রমণী পঞ্চপুত্র তার
পুড়েছে সে পাঁচ ভাই ।

পুড়েছে, নাকি পুড়িয়ে মেরেছে
সে কথা কে আর গায়
ওদিকে পাণ্ডব সাথে কুন্তীমাতা
যেদিকে দুচোখ যায়
পালিয়ে পালিয়ে বনে জঙ্গলে
ধূলায় রাত্রিবাস
জেগে আছে ভীম, বীর ভীমসেন
সাথে জেগে হা হুতাশ ।

সেই জঙ্গলে আসলে রাজ্য
অনার্য প্রজাতির
হিড়িম্ব ও তার বোন হিড়িম্বা
মহাবাহু মহাবীর ।

তাদের আহার মাংসই শুধু
মানুষে অরুচি নাই
হিড়িম্বা চলে, দেখে আসি কোথা
মানুষের ঘ্রাণ পাই ।

শিকারে বেরোল অনার্য নারী
যোদ্ধা সে বিভীষণ
দূর থেকে দেখে পাঁচটি মানুষ
ঘুমে ঘুমে অচেতন ।

তার পাশে ও কে? কে আছেন জেগে
অমিত পরাক্রম
ভুলে গেল মেয়ে, ঘরে হিড়িম্ব
খিদেয় মতিভ্রম ।

ভুলে গেল তার যুদ্ধ পোশাক
ভুলে গেল ধনুতীর
হাজার দ্বিধায় পায়ে বেড়ি দিল
গতি হয়ে এল ধীর ।

চোখ তুলে চেয়ে ভীমও সহসা
ভুলে গেল যেন সব
যেমন আহত হিড়িম্বা
তেমনই মধ্যম পাণ্ডব ।

কথকের প্রকাশ ভঙ্গী – যেন ভীম ও হিড়িম্বার পূর্বরাগ । *

মঞ্জু বিকচ কুসুমপুঞ্জ
মধুপশবদ গুঞ্জ গুঞ্জ
কুঞ্জরগতি-গঞ্জি গমন
মঞ্জুল কুলনারী ।

ঘন গঞ্জন চিকুরপুঞ্জ
মালতী ফুল-মালে রঞ্জ
অঞ্জনযুত কঞ্জনয়নী
খঞ্জনগতি-হারি ।।

হিড়িম্বার দেরি দেখে জঙ্গল তোলপাড় করে এসে পড়ে ভাই হিড়িম্ব । যাদের ধরে আনতে পাঠানো খাদ্য হিসেবে – তাদের সঙ্গে কিনা সখ্যতা । হিড়িম্ব হুঙ্কার দিয়ে ওঠে ।

হিড়িম্বা বলে – ভীম, এই আমার ভাই । এর কথাই বলছিলাম । রাজপাটে মন নেই – শুধু খাওয়া ।

হিড়িম্ব দুকথা শোনায় বোনকে – এইজন্যেই মেয়েছেলের উপর ভরসা করতে নেই । পাঠালাম শিকারে – এখন তারই বশ্য হয়ে উঠল ।

হিড়িম্ব ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ভীমের উপর । রুখে দাঁড়ায় হিড়িম্বা ।

আগে আমার সঙ্গে লড়াই কর, আমাকে মার – তারপর হাত দিবি ওদের গায় ।

এদিকে কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেছে চারভাই আর কুন্তীর । মহাবাহু পুরুষপুঙ্গব ভীমসেনের লেগেছে আত্মসম্মানে ঘা – মেয়েছেলে, এক মেয়েছেলে কিনা বাঁচাবে আমাকে ? হিড়িম্বাকে ঠেলে সরিয়ে ভীম নেমে পড়ে হিড়িম্বর সঙ্গে যুদ্ধে ।

পাখোয়াজ । ভীম ও হিড়িম্বর যুদ্ধ – হিড়িম্বর মৃত্যু ।

হিড়িম্ব নিধন হল জঙ্গল তোলপাড়
এবার হিড়িম্বার দিকে নজর সবার
ভুলে গেল ভীমসেন, কিছুক্ষণ আগে
দেখেছিল পরস্পরে, দৃষ্টি - পূর্বরাগে ।

ভাইএর সঙ্গে একে নরকে পাঠাই
পৃথিবীতে অনার্যের নাই কোন ঠাই ।

রুখে দাঁড়াল হিড়িম্বা ।

শোন ভীম – আমি অনার্য হতে পারি, তোমাদের ভাষায় মেয়েছেলে হতে পারি – কিন্তু আমি এই রাজ্যের রক্ষক । দেবতা । যুদ্ধবিদ্যায় কারো থেকে কম নই । আমার সাথে লড়তে চাও – এসো । কিন্তু আমি যুদ্ধ করবনা – কারণ তোমাকে আমার ভাল লেগেছে – আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই । নাহলে আমি তোমাকে হিড়িম্বর কথা বলতাম না – তোমাদের বাঁচানোরও চেষ্টা করতাম না । এখন সকলের সামনে পড়ে তোমার মত বদলাতে পারে – তোমার মন একে ছেলেখেলা ভাবতে পারে । কিন্তু আমি আমার মনোভাবে অনড় । এই নামিয়ে রাখলাম আমার ধনুক – তুমি মারতে চাইলে আমাকে মারো ।

পাঁচ ভাই মাতা কুন্তী ধরম সঙ্কটে
বিনাযুদ্ধে প্রাণনাশ অধর্ম বটে
এদিকে নারীর রক্তে অস্ত্র রাঙ্গা হলে
কি করে মহান যোদ্ধা তাকে আর বলে ?
আবার অনার্যকে আত্মীয় স্বীকার
রাজরক্তে এও কি মানা চলে আর ?

এ সব শোনে হিড়িম্বা – অপমানে জ্বলে ওঠে । এদের জন্যে সে ভাই-কেও হারাল । চলে যেতে চায় – কিন্তু ভীম কি পুরোটাই মিথ্যা বলেছে তাকে? নাকি এখন পারিপার্শ্বিকের চাপে ফিরেও তাকাচ্ছেনা আর । ফিরে যাব না যাবনা । অপমান কি ভালোবাসার থেকেও বড় ? হিড়িম্বা এক পা দু পা ফিরে যায় । আবার ফিরে তাকায় ভীমের দিকে ।

মাতা কুন্তী বলেন শোন অনার্য দুহিতা
তুমি ভুল বল নাই, মানি সেই কথা
ভীমসেন বিবাহ করুক গান্ধর্বমতে
কিছুকাল থাক তোমরা থাক একসাথে
তারপর ভবিষ্যতে হওয়া রাজরানী
এ চাওয়া অনার্য রক্তে অসম্ভব জানি

রাজরানী ? আমি যাবই না তোমাদের সঙ্গে । কে দেখবে আমার রাজ্য ? - হিড়িম্বা ঘুরে তাকায় ।

যুধিষ্ঠির বলেন, তবে পুত্রসন্তান হলে
তখন ভীমসেন ফিরে আসবেন চলে
যখন যেমন হবে যুদ্ধে প্রয়োজন
সত্বর পাঠাবে তুমি পুত্রকে তেমন

রাজি আমি । হিড়িম্বা বলেন – দু দণ্ড কাটাবো ভীমের সঙ্গে, এর থেকে বেশি আর কী চাইব । তোমাদের রাজ্য ধন রত্ন সম্মান, এসবের পরোয়া করিনা আমি । বদলাইনা মন, বদলাইনা মত, তাই এই অসম্মান মেনে নিলাম । ভীমের পুত্র হবে ভীমের মতই বীর ।

মিলনের আভাস ।

সঘন বরষা জলদ গম্ভীর
আনন্দে থরথর দেহ
মিলন পিয়াসী বারিষে আঁধার
যেন হেথা নাহি কেহ
কত রম্য সুরে কত ফুল সাজে
ভ্রমিয়া স্বপনপুরে
ভ্রমে ভ্রমে কেটে গেল কিছুদিন
অতীতের থেকে দূরে ।

কথক ধীরে ধীরে সেই প্রথমের পিছন ফিরে বসা অবস্থায় ফিরে গেছেন ।

এইবার শেষ হল কাজ ।
মাতা নাকি জায়া –
কোন দায়, আজ?
ফিরেও তাকায়নি কন্যা
তাচ্ছিল্যে ঢেকেছে অধিকার
ভালবাসাটুকু বুকে ধরে
বড় করে করে
এই ভীমপুত্র আমার ।

সেই কাঁধ, বাহু, প্রশস্ত বক্ষ, শার্দূলের পেশীময় দেহ,
নাই সন্দেহ
ভীম, এইটুকু বেঁচে আছ তুমি ।
অথবা ছিলে ।

সহসা স্বচ্ছ হয় –
কোন শলা দিয়েছিলেন কুন্তী
কেন রাজী গান্ধর্ব বিবাহে,
যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধের প্রস্তুতি
হিড়িম্বার মাধ্যমে যদি ভীমসম মহাবাহু এক
পাওয়া যায় অতিরিক্ত হাত যুদ্ধের সময়ে ।
কারণ অস্ত্র নয়, অর্থ নয়
যুদ্ধে আসল প্রয়োজন যুবক জোয়ান ছেলে ।

এই ছলে
হিড়িম্বাবিদায়,,
তবু পুত্রকে তার
ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে বিশেষ দরকার ।

কথক ফিরে আসেন সেই সাদা চাদরের কাছে, ঠিক যেখানে ছেলের বুকে হাত রেখে পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া হয়েছিল।

আমার রয়েছে অহং
রাজরক্ত তোমাদেরই থাক,
যাক
যেটুকু মায়া
জমা ছিল কঠিন খোলসে ।

কার ছায়া
এসে পড়ে ম্লান চন্দ্রিমায়
এসে বসে
পাশটিতে তার ?
ভীম তুমি ? এ পুত্র একার আমার ।
যেরকম তাকাওনি ফিরে,
বুকের গভীরে
এতদিন –
আমিও ফিরি না আর
আমি তো স্বাধীন ।

আর্যরক্ত, এ পুরুষকার – তোমাদের পায়ের শিকল,
তার কাছে বিক্রি চিরকাল ।
এ কথা ভাবেন তিনি - বলার প্রয়োজন গেছে ঘুছে ।
দুই কাল পায়ে মুছে,
হিড়িম্বা, আসল মানুষ
পা রাখেন সামনের দিকে ।

ঘটোৎকচের মৃতদেহ দুই হাতে তুলে কথক বেরিয়ে আসেন ।
----

* পদটির পদকর্তা জগদানন্দ