Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



















১৮

স্মৃতির শহর - ৪

রান্নার জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে গেলে একটি জরুরি শর্ত আছে। তা হলো বাজার চিনতে হবে, উপকরণ বুঝতে হবে আর বিক্রেতাদের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে সখ্যতা। এই শিক্ষাটি একেবারে ছেলেবেলার। বাবার সঙ্গে নেহাতই কৌতূহলবশে বাজারে আনাগোনার সুবাদে। কিন্তু এমনই সেই শেখা, যার তাৎপর্য উপলব্ধি করলাম পরিণত বয়সে এসে। এবং এও অনুভব করলাম, শুধু বিক্রেতারা নয়, এক অনির্বচনীয় যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায় আনাজ-ফলমূল-মাছ- মাংসের সঙ্গে। প্রকৃত হেঁশেল যাত্রার সেই শুরু।

শীতের কুয়াশামাখা ভোরে বাজারগুলি যখন আনাজের সম্ভারে সেজে ওঠে, অপূর্ব সেই দৃশ্য ক্রেতার মনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন। কিন্তু অন্তর্লিন সেই প্রক্রিয়া একজনকে রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে কিনা, সেটাই হলো মূল প্রশ্ন। আর এ বিষয়ে সেই মানুষটির কিছুই করার থাকে বলে মনে হয়না। মোহাবিষ্টের মতো সে এগিয়ে যায় সেই গন্তব্যের দিকে। একথাও অবশ্যই ঠিক, সবার এমন ঘটে না, কারও কারও ঘটে। আর সেই কারও কারও জীবনটা যে বদলে যায় অনেকাংশেই, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পাড়ার বাজারে তাই থরে থরে যখন কচি ফুলকপি দেখা যায়, চকচক করে ওঠে রন্ধনবিলাসী মানুষটির চোখ। মস্তিষ্কের মধ্যে পাকটি শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। ফলত হেঁশেলের খুঁটিনাটিতে তেমন দড় না হয়েও জিভের অনু-পরমাণুর সঙ্গে আজন্ম একাত্ম হয়ে থাকা একটি স্বাদ নির্মাণ করা সম্ভব হয় শুধুমাত্র অনুমানক্ষমতার সঠিক প্রয়োগে। গুহামানবের যুগ থেকে এই আধুনিক কাল পর্যন্ত হেঁশেল সংস্কৃতির বিপুল বিবর্তনের পিছনে লুকিয়ে আছে এই অনুমানক্ষমতা আর সাধারণকে অনন্য সাধারণে বদলে নেওয়ার প্রতিভা। তাই আগুন আবিষ্কারের পর যখন মানুষ আহার্য তৈরিতে তার ব্যবহার শিখল, আমূল পরিবর্তন ঘটলো এই বিষয়টির – একদিন যা ছিল নিছক বন্য পশুর মাংস ভক্ষণের উপায়, কালক্রমে তাই হয়ে উঠল বারবিকিউ।

বারবিকিউ। অসীম আগ্রহ, উত্তেজনা আর ভালো-লাগা ভর করে এই বিষয়টির অনুসঙ্গে। আসলে বারবিকিউ তো শুধু রান্না নয় একটা উদযাপন। দলবদ্ধভাবে খাওয়ার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে যে ব্যাপারটার সূত্রপাত, শেষ পর্যন্ত সর্বদাই তা পরিণত হয় একটা পার্টিতে। বারবিকিউ-এর কথা উঠলেই প্রথম যে স্মৃতি ভেসে ওঠে, তা হলো ডালহৌসি ইন্সটিটিউট ক্লাবে অশোকদার সঙ্গে, বছরে অন্তত দুবার সেই উৎসবে যাওয়া। সে অনেকদিন আগের কথা। কাঠ-কয়লার আঁচের ওপর একটা লোহার জাল বিছানো আর তার ওপর নানান ধরনের মাংসের টুকরো পুড়ছে আর লাইনবদ্ধ ক্ষুধার্ত মানুষের দল প্লেটে তুলে নিচ্ছে স্যালাড এবং পছন্দসই মাংস। ততক্ষণে মাংস পোড়ার গন্ধে পেট অর্ধেক ভরে এসেছে। এইরকম অনেক বছর চলার পর বারবিকিউ-এর যে অসামান্য অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল, তা স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিভুঁইয়ে, উত্তর জার্মানির টোডেনহফ নামক একটি ছোট্ট জনপদে। জার্মান ভূখণ্ড ওখানেই শেষ। সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের ওপরে দাঁড়ালে অপর প্রান্তে দেখা যায় ডেনমার্কের তটরেখা। সেবার আমি একটু বেশি দিনের জন্য ওদেশে। হামবুর্গ শহরের কাছে আহরেনস্‌বুর্গ নামের একটি ছোটো শহরের এক বৃহৎ মুদ্রণালয়ে প্রশিক্ষণের সূত্রে। এক সপ্তাহান্তে বন্ধুনি কারিনের পাল্লায় পড়ে গাড়ি বোঝাই নানান সামগ্রী নিয়ে আমরা রওনা হলাম সেই টোডেনহফের উদ্দেশে। এই পথ দিয়ে বারবার যাওয়া-আসা করে চলেছি সেই নব্বই সাল থেকে। সেই কারণেই জানা ছিল আমাদের যেতে হবে ল্যুবেকের ওপর দিয়ে। ল্যুবেক। প্রাচীন এই শহরটির ইতিহাস ব্যপক এবং সমৃদ্ধ। প্রায় একহাজার বছর আগে তৈরি হওয়া ইউরোপীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ‘হান্সিয়াটিক লীগ’- এর মূল কেন্দ্র ল্যুবেক বল্টিক সমুদ্রের উপকুলে আজও জার্মানির একটি প্রধান বন্দর শহর। লাল ইঁটের তৈরি এই শহরের প্রধান প্রবেশপথ, যা ‘হলস্টেনটোর’ (Holstentor) নামে সুপরিচিত এক অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন। মধ্যযুগে যার কাজ ছিল শত্রুর আক্রমণ থেকে পুরনো শহরকে রক্ষা করা। এই শহর অবশ্য বিখ্যাত একাধিক কারণে। বরেণ্য সাহিত্যিক টোমাস মানের জন্ম উত্তরের এই ‘ভেনিস’-এ আর অন্য যে বিষয়টি ল্যুবেককে করে তুলেছে পৃথিবীবিখ্যাত, তা হচ্ছে ‘মারৎসিপান’ (Marzipan)। যাঁরা এ বস্তুটি খাননি, তাঁদের কাছে এর স্বাদ ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল আর যাঁরা খেয়েছেন, তাঁরা আশাকরি বলবেন ‘এ স্বাদের ভাগ হবেনা’। খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এমনও দেখেছি যে কেউ কামড় মেরে যখন বুঝতে পারছেন, তা মারৎসিপান, ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বিচিত্র এর অতীত। সপ্তম শতক নাগাদ চিনে জন্ম। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে পৌঁছল মধ্যপ্রাচ্যে। শেষ পর্যন্ত ইউরোপ। স্পেন, ইতালি, এস্তোনিয়া আর জার্মানি – এই দেশগুলিতেই মারৎসিপানের জনপ্রিয়তা। মূল উপাদান যদিও সব ক্ষেত্রেই সেই চিনি আর বাদামের মিহিগুঁড়ো, যাকে বাদাম ময়দাও বলা যেতে পারে। এর একটি ফরাসি অবতার আছে, যার নাম ‘ফন্দান্ত’ (Fondant) – যেখানে চিনি আর বাদাম ময়দা ছাড়াও ব্যবহার হয় কর্ন সিরাপ, ফলে মণ্ডটির চরিত্র বদলে যায় অনেকটাই। তাই ‘ফন্দান্ত’ ‘মারৎসিপান’ হলেও ‘মারৎসিপান’ ‘ফন্দান্ত’ নয়। যাই হোক, যা বলছিলাম। দুশো বছরেরও আগে, ১৮০৬ সালে ইয়োহান গেওর্গ নিডারেগার ল্যুবেক শহরে প্রতিষ্ঠা করলেন যে কোম্পানি, আজ তা একটি সোনায় মোড়া ব্র্যান্ড। এই বস্তুটি নিয়ে উন্মাদনা কেমন হতে পারে, ল্যুবেক শহরে অন্তত একবার না গেলে অনুমান করা খুব মুশকিল। যতদূর জানি, প্রায় তিরিশ রকমের মারৎসিপান পাওয়া যায় ল্যুবেক –এ। তার মধ্যে এই নিডারেগার (Niederegger) ব্র্যান্ডটির খ্যাতি ভুবনজোড়া। এঁদের যে ক্যাফেটি আছে, সেখানে বসার জায়গা পাওয়াই কঠিন হয় অনেকসময়। তাহলে কী সেই রহস্য, যে কারণে ল্যুবেক-এর মারৎসিপান এর অন্য সংস্করণগুলির থেকে আলাদা? এর উত্তর লুকিয়ে আছে বাদাম-ময়দা আর চিনির আনুপাতিক ব্যবহারের মধ্যে, যেখানে বাদাম-ময়দা থাকে প্রায় সত্তর ভাগ। বাকিটা চিনি। যদিও এই তথ্যগুলি ‘অতি সযত্নে রক্ষিত’ এবং কোনও পরিস্থিতিতেই সরকারিভাবে এর কোনও সমর্থন পাওয়া যাবে না। আরেকটি জরুরি বিষয়। মারৎসিপান হচ্ছে এই মিষ্টান্নটির অভ্যন্তর। বাইরের খোলসটি সাধারণত চকলেট। সেই চকলেট আবার নানারকম হতে পারে। সাদা, কালো (dark), অতি-কালো (extra-dark) বা যা-খুশি। লিখতে লিখতেই আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি, চকলেটের পাতলা অথচ মুচমুচে আস্তরণটি দাঁতের আলতো চাপে ভেঙে গিয়ে ভিতরের নরম মারৎসিপানের স্বাদ যখন জিভে লাগে আর চকলেট-মিশ্রিত সেই স্বাদ ছড়িয়ে যায় সমগ্র মুখগহ্বরে, তার অনুভূতি অতীন্দ্রিয়।

সেবার যখন কারিন, উহ্বে আর আমি দুপুর নাগাদ ল্যুবেক-এ গিয়ে পৌঁছলাম, পেট তখন চুঁইচুঁই। সেটা মোটেই মারৎসিপান খাওয়ার সময় নয়, কিন্তু দিনটা ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস। সারা শহর জুড়ে সেদিন শুধুই মারৎসিপান আর মারৎসিপান। উপহার দেওয়ার জন্য ওই বিশেষ দিনে মারৎসিপান সত্যিই অতুলনীয়! আমরা সেদিন দুপুরের খাওয়া সারলাম এরবসেনসুপ্পে বা কড়াইশুঁটির স্যুপ দিয়ে। যেটি ওদেশের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার। সে আলোচনা বিশদে, অন্যসময়। তা সেদিন আমরা কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে আবার রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম টোডেনহফে। জায়গাটি এতই ছোটো, আধঘণ্টা এদিক ওদিক হাঁটলেই শেষ হয়ে যায়। কারিনদের যে বন্ধুর বাড়িতে আমরা অতিথি হয়ে উঠেছিলাম, সেই বাড়িটি অপূর্ব! বাড়িটির দুটি অংশ – একটি দোতলা আর অন্যটি একটা আউটহাউস মতো, যেখানে একটি লম্বা ঘর আর তার লাগোয়া একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো ঘর – যেখানে দুতিনটি বাঙ্ক বিছানা। তারই একটিতে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল আমার। কিন্তু সে তো পরের কথা। তার আগে তো বাকি অনেক হুল্লোড়! বিকেল – সন্ধে নাগাদ একটু ঘোরাঘুরির পর আমরা জড়ো হলাম বাগানে। সাজানো হলো বারবিকিউ –এর সরঞ্জাম। এল নানাধরণের মাংস। আগে থেকেই যেগুলি ম্যারিনেট করা ছিল। এল প্রচুর বিয়ার আর ওয়াইন। শুরু হলো পার্টি। অন্ধকার ঘন হয়ে এল। বাতাসে তখন মাংস পোড়ানোর গন্ধ। তাপমাত্রা নেমে আসছে দ্রুত। একটু ওম টেনে নিতে আমরা আরও আগুনের কাছাকাছি। বিয়ার আর ওয়াইন ততক্ষণে আমাদের রক্তস্রোতের মধ্যে খেলা করছে। শেষরাতে বিছানার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল আমাদের শ্রান্ত শরীরগুলি।

বারবিকিউ-এর আরেকটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা শান্তিনিকেতনে। আমাদের পরম বন্ধু গুগলির অতিথিশালায়। যার অন্য নাম ‘ছোটা কোঠি’। সেবার বর্ষশেষে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম সেখানে। কলকাতা থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম সেখানে। দেবস্মিতাদি – শ্রীধরদা নিয়ে গিয়েছিল মুরগির টুকরো। গুগলির দায়িত্বে ছিল বিফ আর মাটন। ইয়ান জাকারিয়া নিয়েছিলেন সল্ট বিফ। আর আমাদের সঙ্গে ছিল কিছু মাছ। এসব তো হলো। আসল কাজ? বাড়ির পিছনদিকের বাগানে আবিষ্কার করা গেল এক বিশালাকার উনুন। সারাদিন অনেক কসরতের পর সেটিকে বারবিকিউ-এর জন্য প্রস্তুত করা গেল। এও ঠিক হলো এর মূল দায়িত্বে থাকবো আমি। সন্ধে থেকে শুরু হয়ে গেল মাংস পোড়ানোর কাজ। এই বিষয়টিকে রসসিক্ত করে রাখার জন্য গুগলি একটু পর পরই দিয়ে যাচ্ছিল পানীয়। চিমটে দিয়ে আগুনের ওপর পুড়তে থাকা মাংস বা মাছের টুকরোগুলি ওলট পালট করার মধ্যে যে অনির্বচনীয় আনন্দ আছে, তা একমাত্র যে সেই স্বাদ পেয়েছে, তার পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব। সেবারের সেই বারবিকিউ অ্যাডভেঞ্চার গড়িয়ে গিয়েছিল ভোরের দিকে, অনেক আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ার পর দেবস্মিতাদির মুখে শোনা ভূতের গল্প দিয়ে।

এ লেখার শিরোনাম ছিল স্মৃতির শহর। লেখার শেষদিকে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করছি, সে কোন শহর? কলকাতা, হামবুর্গ, ল্যুবেক, টোডেনহফ না শান্তিনিকেতন? এক অর্থে সবগুলি শহরই কি স্মৃতির শহর নয়? স্মৃতির ওপর আমাদের কি কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে? কোন স্মৃতির সঙ্গে সরল অথবা বক্র রেখায় মিলে যাবে অন্য কোন স্মৃতি, আমরা কি আগেভাগে তা আন্দাজ করতে পারি?