গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পহিরে বসানো ঝুমকো
অচিন্ত্য দাস
শুভা আর প্রীতম। দুজনেই অতি-সাধারণ, এদের বিয়েও হয়েছে সাধারণ সম্বন্ধ করে। তবে আজকাল যেটা প্রায় দেখাই যায় না সেই অসাধারণ ব্যাপারটা কী করে যেন এদের মধ্যে আছে। মনের মিল। বিয়ে করে সংসার পাততেই দেখা গেল আয় বড় কম, কুলোচ্ছে না। যা হয় আর কি। শুভাও যদি চাকরি করত তাহলে ভালো হত কিন্তু সে কেবল পার্ট-ওয়ান পাশ। এই বাজারে কোথায় চাকরি। প্রীতম খাতা লেখার যে কাজটা করে তাতে উন্নতির আশা নেই। তবু দিন চলে, চালাতেই হয়। মাসের শুরুতে দু-একদিন রুই-কাৎলা এলেও হপ্তা যেতে-না-যেতে তা ছোট হতে হতে মৌরলা-টৌরলায় গিয়ে ঠেকে আর তারপর স্রেফ নিরামিষ। এ নিয়ে অবশ্য শুভা কোনোদিন কিছু বলেনি, এই মাইনেতে প্রীতম আর কত করবে? তবে সেদিন শুভাকে বলতেই হলো। -
“এই, শোনো – সামনের মাসে দাদার ছেলের অন্নপ্রাশন, সোনার কিছু একটা তো দিতে হয়।”
- “ সোনা!”
- “ না দিলে কথা উঠবে। দ্যাখো না কিছু করা যায় কি না…”
শুভার দাদার অবস্থা ভালো, আলাদা থাকে। বৌদি মুখরা। সমস্যাটা প্রীতমের কাছে জলের মত পরিষ্কার। কিন্তু সমাধান? সমাধান একটাই ছিল। প্রীতমকে আপিস থেকে টাকা ধার করতে হল। তারপর একদিন সোনার কিছু একটা কিনতে গেল দুজনে। প্রথমটায় ওরা ভুল করে ওদের পকেটের আন্দাজে একটু বড় দোকানে ঢুকে পড়েছিল। ঝকঝকে চকচকে। সারিসারি কাচের বাক্সে সোনার গয়না সাজানো রয়েছে। বলাই বাহুল্য এখানে সুবিধে হলো না। কিন্তু বেরোবার সময় দেয়ালে সাজিয়ে রাখা একজোড়া হিরে বসানো ঝুমকো শুভার চোখ টেনে নিল।
-“ এই দ্যাখো, কী সুন্দর না …”
দোকানটা থেকে প্রীতম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে চাইছিল, শুভার কথায় দাঁড়িয়ে গেল। বলল –“ হ্যাঁ, বেশ সুন্দর।”
-“ আচ্ছা, আমাকে কীরকম লাগবে বলতো, মানাবে?”
প্রীতম একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল –“ তা মানাবে। ভালো .. খুব ভালো লাগবে তোমাকে…”
–“সোনার ওপর হিরে বসানো। অনেক দাম হবে, না গো…”
-“তা তো হবে, অতটা সোনা তারপর আবার হিরের কাজ…” হিরের দাম সম্বন্ধে অবশ্য প্রীতমের কোনো ধারণা ছিল না। দোকান থেকে বেরোবার সময় প্রীতম দেখল শুভা ওই হিরে বসানো ঝুমকোর সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। হয়তো ভাবছে সত্যি যদি এটা ওর হতো…
প্রীতমের বুকের ভেতর একটা নিশ্বাস পড়ল। ছোট্ট চাপা শ্বাস। সে ছাড়া অবশ্য আর কেউ শুনতে পেল না। যদি সামর্থ থাকত তাহলে এক্ষুণি, এই মুহূর্তে সে শুভাকে হিরে বসানো ঝুমকোর জোড়া কিনে দিত।
*****
দিন আসে দিন যায় একই রকম ভাবে। তবে ঘটনা ঘটা পৃথিবীর নিয়ম – সেরকম একটা ঘটনা প্রীতমের জীবনেও ঘটে গেল। ওর এক অবিবাহিত কাকা মারা গেলেন। দ্যাখা গেল তিনি তাঁর গ্রামের জমিজমা ভাগ করে ভাইপো ভাইঝিদের লিখে দিয়ে গেছেন। প্রীতমের ভাগেও ছিল খানিকটা। সম্পত্তি হিসেবে সামান্যই কিন্তু সেখান দিয়ে হাইওয়ে যাবার সরকারি নকশা পাশ হয়ে যাওয়াতে জমিটার দাম পট করে উঠে গেল। মোটামুটি ভালো দর দিয়ে প্রীতমের জমিটা এক কোম্পানী কিনে ফেলল। কারখানা বানাবে।টাকাটা নিয়ে প্রীতম দুটো ট্রাক কিনে ব্যবসায় নেমে পড়ল। ব্যবসা আগে না করলেও খাতা লেখার কাজ করতে করতে ব্যবসার কিছুটা ধারণা তার ছিল। আর ভাগ্যও ভালো বলতে হবে – ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল চট করে। ট্রাক জিনিসটা বেশ মজার। ব্যাবসা ভালো চললে এরা বংশবৃদ্ধি করে। দেখতে দেখতে দুটো থেকে চারটে ট্রাক হয়ে গেল প্রীতমের। বছর দুএকের মাথায় এখন আবার একটা বাস কেনার কথা ভাবছে। অনেক লাভ, অনেক রোজগার। আলমারিতে, ব্যাঙ্কে অনেক অনেক টাকা।
প্রীতম আর শুভা কি পালটা গেছে? ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে পালিস তো লেগেছে খনিকটা। বড় বাড়ি। ‘মাসের শেষ’ বলে যে একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ঘুরেঘুরে আসত তা আর নেই। প্রীতমের কাজ বেড়েছে, সময় কমেছে। শুভা এখন দু-চারটে মহিলা সমিতি, এন-জি-ও র মধ্যমণি। সেদিন কী কাজে যেন প্রীতম সেই গয়নার দোকানটার কাছে গিয়েছিল। আরে, এই তো সেই দোকানটা। সেই ঝুমকোটা কি এখনো আছে? কৌতুহলের বশে প্রীতম ঢুকেই পড়ল। দোকানটার সাজসজ্জা পালটে গেছে। আগে চুড়ি, হার, দুল সব এমনিই রাখা থাকতো। এখন কাচের বাক্সে বাক্সে গয়না পরা মেয়েদের আবক্ষ মুর্তি। কালো পাথরের মনে হচ্ছে, প্লাসটিকেরও হতে পারে অবশ্য। আরে, এই তো সেই ঝুমকোটা! এইটাই তো? মনে তো হচ্ছে। ফোনে একটা ছবি তুলে এক্ষুণি শুভাকে পাঠিয়ে জিগেস করে নেওয়া যায় … কিন্তু না। তাহলে তো ‘চমক’টাই চলে যাবে। শুভাকে চমকে দিতে হবে।
দাম কত হবে জিগেস করতে দোকানের মেয়েটি হিসেব করে যা বলল তাতে প্রথম চমকটা অবশ্য প্রীতমই পেল। এক লাখ বেয়াল্লিশ। যাই হোক, এখন প্রীতমের যেরকম টাকাপয়সা হয়েছে তাতে এ ঝটকা তেমন কিছু নয়। দুতিনটে কার্ড মিলিয়ে সে দাম মিটিয়ে জিনিসটা কিনে ফেলল। আর কাজে ফিরে না গিয়ে সোজা বাড়ি – অনেকদিন পরে নটার আগে বাড়ি ফিরল প্রীতম।
-“শুভা, এসো! একটা জিনিস দেখবে এসো!”
শুভার কাছে একজন মহিলা এসেছিলেন কিছু কাগজপত্র নিতে। সমিতি থেকে বোধহয়। সে চলে গেলে শুভাকে পাওয়া গেল।
-“দ্যাখো তো সেটাই কি না !”
শুভা দেখল। -“ হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তো সেটাই। ওঃ, শেষ পর্যন্ত তুমি কিনেই ফেললে!”
অবাক শুভা হয়েছে, কিন্তু প্রীতম যতটা উচ্ছ্বাস আশা করেছিল ততটা যেন দেখা গেল না। শুভা বলল –“ খুব ভালো জিনিসটা। তবে গতবার ধনতেরসে যে দুলটা কিনেছিলাম সেটা এর থেকে … যাক গে। তুমি পারোও বটে, খুঁজেখুঁজে ঠিক নিয়ে এসেছ!”
শুভার একটা ফোন এলো, মহিলা-সমিতির থেকে কেউ। কথা বলতে বলতে শুভা অন্য ঘরে চলে গেল।গয়নার বাক্সটা টেবিলে খোলা পড়ে রয়েছে। প্রীতম চুপ করে সে দিকেই চেয়েছিল। একদিন এই হিরে বসানো ঝুমকো ছিল অনেক দূরের মায়াকাননের পরীর মত। শুভা আর প্রীতমের ইচ্ছেপ্রদীপের মিটিমিটি আলোতে সে পরী ঝিকমিক হাসতো। আর আজ এই বাক্সের ভেতর কী নিস্তেজ কী অসহায় লাগছে তাকে। শুভা হয়তো আর একবার দেখবে তারপর আর পাঁচটা গয়নার সঙ্গে বাক্সবন্দী হয়ে জিনিসটা চলে যাবে আলমারির কোটরে কিংবা ব্যাঙ্কের ভল্টে।
প্রীতমের বুকের ভেতর একটা নিশ্বাস পড়ল, ঠিক সেদিনের মতো। ছোট্ট চাপা শ্বাস। সে ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না। ওর ভেতর থেকে কেউ যেন বলছিল – সব ইচ্ছে টাকার জোরে মুঠোতে ধরে ফেলতে হবে এমন কি কথা আছে? কিছুকিছু চাওয়া অধরা থেকে যাওয়াই ভালো।