ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক১৭
স্মৃতির শহর – ৩
বাঙাল – ঘটি। এই দুটি শব্দের মধ্যে দিয়ে একসময়ের অবিভক্ত বঙ্গদেশ দু’ভাগে বিভক্ত স্মরণাতীত কাল থেকে। পুব আর পশ্চিম। বিশাল এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক বিভাজন পর্যন্ত এই ভাগাভাগি ছিল অনেকটা আচার-আচরণের মধ্যে আর বাকিটা মানসিক। এই আচার-আচরণের মধ্যে আবার খাদ্যের ভূমিকা নির্ণায়ক। বংশপরম্পরায়, যুগ, যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আলাদা দুটি রন্ধনশৈলী। যেখানে নির্দেশনামা অমান্য করে কিছু করা মানে ঘোরতর অপরাধের বিষয়! আমার বরাবর মনে হয়েছে এটি অর্থহীন এক ক্রিয়াকলাপ। হেঁশেল সংস্কৃতির মধ্যে যে সৃজনশীলতার পরিসরটি রয়েছে, তা অকারণে বিঘ্নিত হয় এর দ্বারা। আমি কিন্তু স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেওয়ার কথা বলছি না। বরং কোনও বিশেষ ঘরাণাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য তার নিজস্বতার রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি। সেটা বহু ক্ষেত্রে হয়নি বলেই চিরতরে হারিয়ে গেছে অসামান্য অনেক পদ। কিন্তু বিষয়টাকে মৌলবাদের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই কিছুই। বরং নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে আদানপ্রদান সহজ হয়, যা খুবই দরকারি। কারণহীন বৈরিতা অনেকসময় স্বাভাবিক বিবর্তনের পথটি সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে।
আমার জন্ম হয়েছিল কলকাতার অনতিদূরে একটি ‘ঘটি’ একান্নবর্তী পরিবারে। আশেপাশে পূর্ববঙ্গের অনেক মানুষজনের বাস থাকলেও ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে ‘বাঙাল’ শব্দটি প্রায় নিষিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, আমাদের রান্নাঘরে এই মানসিকতার কোনও সচেতন প্রভাব লক্ষ্য করিনি। একটা আঞ্চলিক চরিত্র অবশ্যই ছিল এবং তাকেই আমি স্বাতন্ত্র্য বলে মনে করি। যেমন ধরা যাক, আলু পোস্ত। সাধারণভাবে এই পদটি ঘটি হেঁশেলের হলেও আপামর বাঙালি এর প্রেমে গদগদ। কম বয়সের স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ছে বর্ধমানে, মাতুলালয়ে যখনই যেতাম অন্তত তিন রকম (কখনও কখনও চারও) পোস্ত রান্না হতো। পোস্ত বাটা, পোস্তর বড়া, আলু বা ঝিঙে পোস্ত আর হয়তো মাছের কোনও একটা পদ পোস্ত দিয়ে। এইরকম আর কি!
এই পোস্ত রান্না নিয়ে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে দেখেছি ছোটোবেলা থেকে। প্রথমত আলু কাটা। তার একটা নির্দিষ্ট আকার এবং আকৃতি থাকবে। তারপর বাটা। শিলে বাটতে পারলে সবচেয়ে ভালো। মিক্সির ব্যবহার স্বীকৃত হওয়ার পর মিক্সিতেও পোস্ত তৈরি করে নেওয়া হয়ে থাকে। আর সেটাই নিঃসন্দেহে আজকের পরিস্থিতিতে যথাযথ কারণ শিলের পাট অনেক বাড়ি থেকে উঠেই গেছে। আর কোনও বড় হোটেল বা রেস্তোরাঁয় শিলে বেটে পোস্ত রান্না কি সম্ভব? যাই হোক যা বলছিলাম। আলু কেটে নেওয়া হলো, পোস্ত বেটে নেওয়া হলো। এরপর কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে সামান্য অপেক্ষা। ধোঁয়া উঠলেই আলুর টুকরোগুলো তেলে দিয়ে অল্প নাড়াচাড়া করতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টা এই যে আমাদের বাড়িতে পোস্ত রান্নায় ফোড়ন দেওয়া বারণ ছিল চিরকাল কারণ মনে করা হয় যে ফোড়নের গন্ধ পোস্তর সুগন্ধকে ঢেকে দেয়। তাই আলুর কাঁচাভাবটা চলে গেলেই বাটা পোস্তটি তাতে দিয়ে দেওয়া হয়। দেওয়া হয় পরিমাণমতো নুন আর কয়েকটি পেট-চেরা কাঁচালঙ্কা। কাঁচালঙ্কা অবশ্য বাটার সময়েও দেওয়ার কথা! এরপর আর বিশেষ কিছু করণীয় থাকে না, চাপা দিয়ে কম আঁচে রান্নাটা হতে দেওয়া ছাড়া। এই পুরো প্রক্রিয়াটা এতই সরল যে কখনও যে রান্নাঘরে ঢোকেনি, তার কাছেও এটা জলভাত বলে মনে হতে পারে আর ফাঁদটা ঠিক সেখানেই। এক মাহেন্দ্রক্ষণে খুলে দিতে হবে ঢাকনা আর গ্যাসটা বাড়িয়ে কয়েকমিনিট ভালো করে নাড়তে হবে যতক্ষণ না পোস্তর রঙটা সাদা থেকে হালকা বাদামির দিকে যাচ্ছে। ছোটবেলায় বাড়িতে কয়লার উনুনে এই রান্না হতে দেখেছি বারংবার। একথাও বলা বাহুল্যমাত্র যে তার স্বাদ তর্কাতীতভাবে হতো ব্যতিক্রমী। আর হ্যাঁ বলা হয়নি হলুদের প্রয়োগ নৈব নৈব চ! কেন ? সে প্রশ্ন কাউকে করিনি কখনও। আর সত্যি কথা বলতে কি পোস্তর সঙ্গে হলুদের রং ঠিক মানায় না। কেমন যেন জাতভ্রষ্ট মনে হয়! এই পোস্ত রান্নার প্রসঙ্গে একটি বিশেষ পদের উল্লেখ করতেই হচ্ছে। যার সঙ্গে আমার আজন্মলালিত স্বাদের অনুষঙ্গ জড়িত। আলুপেঁয়াজ পোস্ত। যেকোনও দিন, যেকোনও সময় যদি আমাকে একটিই পোস্ত রান্না বেছে নিতে বলা হয়, চোখ বন্ধ করে আমি জুলিয়েন করে কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে আলু আর পোস্তর অপূর্ব মেলবন্ধনের এই পদটিকেই নির্বাচন করে নেবো। চোখ বন্ধ করে যেকোনও মুহূর্তেই অনুভব করতে পারি বিউলির ডাল আর ধোঁয়াওঠা ভাতের সঙ্গে আলু পেঁয়াজ পোস্তর সেই অপূর্ব স্বাদ, যা সারাজীবন আমায় তাড়া করে বেড়াবে।
শুরু করেছিলাম দুই বঙ্গের হেঁশেল সংস্কৃতির আলাদা-আলাদা ধরন-ধারণের কথা দিয়ে। এ বিষয়ে মূল যে জায়গাটা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, তা হলো শ্রেণীবিভাগ যদি করতেই হয়, তা অঞ্চলের ভিত্তিতেই হওয়া ভালো কিন্তু সেই ভাগ যদি হয় পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের মতো কোনও বৃহৎ এলাকার ভিত্তিতে, যা আসলে একাধিক ভিন্নধর্মী অঞ্চলের সমষ্টি, তাহলে বিষয়টি একটু অন্য দৃষ্টি দিয়ে দেখতেই হয়। পুরুলিয়ার রান্না আর বর্ধমানের রান্না কি এক? অথবা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রন্ধনশৈলী? তাহলে পুব-পশ্চিমের হিসেবটা গৌণ হয়ে গেল না কি? ঘটি রান্না মানেই ‘মিষ্টি সরবত’ আর বাঙাল হেঁশেল মানেই ‘ঝালের ঠ্যালায় অস্থির’ – এমন নাও হতে পারে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। তা হলো অন্য সমস্ত শিল্পের মতো রন্ধনশিল্পেও পরিমিতিবোধের প্রয়োজন অপরিসীম। পরিমিতিবোধ, ‘সেন্স অফ টাইমিং’ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা – যে কোনও শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই তিন মূল উপাদানের সমন্বয় জন্ম দিতে পারে ‘মির্যাকল’ বা অত্যাশ্চর্য কোনওকিছুর। রান্না শিল্প এর ব্যতিক্রম নয়। চূড়ান্তভাবে ঐতিহ্যনির্ভর এই শিল্পটির ইতিহাস ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসের মতোই। ভাষা যেমন বহমান নদীর মতো – এক এক অঞ্চলে তার এক এক রকম রূপ। হেঁশেলের সংস্কৃতিও তেমনই। যুগ-যুগান্ত ধরে সে হস্তান্তরের নানান পর্ব পেরিয়েই চলেছে। তার কোনও অন্ত নেই। শেষ পর্যন্ত যা বেঁচে থাকে তা হলো স্বকীয়তা আর তাকে জিইয়ে রাখা দরকার যেকোনও মূল্যে। ছোটো ছোটো উপকরণ একটা রান্নাকে এত নাটকীয়ভাবে বদলে দিতে পারে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। পোস্তর মতোই আরেকটি খুব প্রচলিত রান্নার কথা বলি। ছোটো কচি বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল। এই রান্নাটি পূর্ববঙ্গের। আটের দশকের মধ্যভাগে এই পদটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। যে কোনও রান্নার একটি বিষয় আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। তা হলো সারল্য। এত সহজ একটা রান্না অথচ টাটকা উপকরণ আর হাতের গুণে তা হয়ে ওঠে অনবদ্য। স্বাস্থ্যের অজুহাত দিয়ে আমার শাশুড়ি মহাশয়া তাঁর রান্নাগুলিকে করে তুলেছিলেন সহজ থেকে সহজতর। প্রচলিত বহু নিয়মেরই তিনি তোয়াক্কা করতেন না। খুব ভোরে উঠে দুবেলার রান্না করে তিনি কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। সে কারণে রান্নার জন্য তাঁর সময় ছিল নির্দিষ্ট আর এই বিষয়টিই তাঁর রান্নাগুলিকে দিয়েছিল আলাদা একটি মাত্রা। বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে একটি বড় নজির। এই রান্নার পদ্ধতি বর্ণনা করে সময় নষ্ট করতে চাই না কেননা সব মাছের ঝোলের মতোই এই অবতারটি রান্নার উপকরণ এবং মৌলিক পদ্ধতি সবক্ষেত্রে প্রায় এক, তফাৎ হয় অন্যত্র। কিন্তু কাঁচালঙ্কা-কালোজিরের সেই স্বাদ, যার মধ্যে লঙ্কার গন্ধটি সদা-জাগ্রত আর প্রথমবার গলাধঃকরণ করার সঙ্গে সঙ্গে গলার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি, যা আসলে মুখের ভিতরের পেলব অংশে কাঁচালঙ্কার অভিঘাত। আদ্যন্ত বাঙাল এই রান্নাটিকে আমি পরবর্তীকালে আমাদের ঘটি পরিবারে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম এবং অচিরেই তা মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়। এই রান্নার ক্ষেত্রে বেগুনের জায়গায় ঝিঙে, কুমড়ো বা কাঁচকলার ব্যবহারও দেখেছি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ফলাফল হতো অতি চমৎকার।
ঘটি – পোস্ত আর বাঙাল- ইলিশ বেগুনের ঝোল, এই দুই রান্নার মধ্যে আদতে যা লুকিয়ে আছে, তা হলো এক অদ্ভুত আবেদন, যাতে সাড়া দেওয়ার জন্য ঘটি বা বাঙাল না হলেও চলে। প্রশ্নটা এক্ষেত্রে একটু আলাদা। এই দুই পদের হাত ধরে ঠিক কোথায় পৌঁছতে চেয়েছিলাম? সেই জায়গাটি হলো, শুরুর দিকে যা বলেছি - একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি হচ্ছে যে হেঁশেলে, তার ভৌগলিক অবস্থানও অত্যন্ত জরুরি। কলকাতা শহরে এই রান্নাগুলির বর্ণ, স্বাদ ইত্যাদি যা হবে, স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা অনেকখানিই বদলে যেতে পারে বললে ভুল হবে, আসলে বদল অবশ্যম্ভাবী। Local Palate বা স্থানীয় স্বাদ বলে একটা বিষয় আছে না? এমনকি এক শহরের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে নাম-না-জানা কত রকমারি রান্নাঘর। তার হদিশ আমরা কজন জানি? আমার শাশুড়ির পরিবার আদতে বরিশালের। অগ্রজ তিন দাদারই জন্ম সেখানে। আর তাঁদের একমাত্র সহোদরা জন্মালেন গড়পাড়ে, বড়ো হয়ে উঠলেন হুগলিতে। অতএব ঘটলো চরম অনর্থ। সারাজীবন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে নিবিড় আত্মিক যোগ অনুভব করেও হেঁশেলে ঢুকতে দিলেন না শুঁটকি আর ঝালের সঙ্গে ছিল তাঁর সারাজীবনের আড়ি। অথচ তাঁর হাতেরই অনেক পূর্ববঙ্গীয় রান্না আমাকে মুগ্ধ করেছিল। রান্না বিষয়টি নিয়ে অনেককে খুব বিব্রত হয়ে পড়তে দেখেছি কিন্তু তিনি কর্মক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হেঁশেল সামলানোর কাজটি বরাবর করে এসেছেন অনায়াসে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত হেঁশেল-দর্শন বলে কে কত বড়ো মাপের রন্ধনশিল্পী, সেই বিচারের ক্ষেত্রে দক্ষতার পাশাপাশি রান্নাবান্নার এলাকাটিকে আমাদের জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়ে চলা এক সৃজনের পরিসর বলে মেনে নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন। বাঙাল-ঘটির আঞ্চলিক আধিপত্য জাহির করার লড়াইটি সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।