Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















কালকে দার্জিলিং যাওয়ার গ্রুপটা রওনা হয়ে যাবে। প্রায় ৪৫ জন। বাকি দেড়শ জন পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাব সাতদিন পরে।
অর্থাৎ এই সাতদিন লাকি একলা হয়ে যাবে, মিতা তো দার্জিলিং গিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে মশগুল হবে।
আমরা যথারীতি প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় হাতধরাধরি করে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি।
পূজোর পনের দিন ছুটি। লক্ষ্মীপূজোর পর হোস্টেলে ফিরতে হবে। বিসর্জনের পর বাড়িতে কেমন একঘেয়ে লাগবে। বাড়ির রান্না, পূজোর নতুন জামাকাপড়, পার্কসার্কাস পাড়ায় দূর্গোপূজো বা অষ্টমী-নবমীতে সকালের অঞ্জলি ও সন্ধ্যেয় ঘুরে ঘুরে বালিগঞ্জ ভবানীপুরের ঠাকুর দেখা-- তার রোমাঞ্চ আর আগের মত নেই।
মিতা বলে-- একদিন আমার বাড়িতে আয় না? দুজনে খেয়েদেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে --।
--- কোথায়?
-- আমহার্স্ট স্ট্রীট পাড়ায়।
--বেশি চিনি না। শ্যালদা চিনি, আর কলেজ স্ট্রিটে গোপাল পাঁঠার দোকান চিনি। কয়েকবার কাকার সঙ্গে মাংস কিনতে গেছি।
--ব্যস্‌, ব্যস্‌! ওতেই হবে। তুই পার্কাসার্কাস ডিপো থেকে শ্যালদার ট্রাম ধরে আয়। তারপর হ্যারিসন রোড ধরে কলেজ স্ট্রীটের দিকে দুটো স্টপ এগিয়ে যা। ছবিঘর সিনেমার সামনে দাঁড়াবি। আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। দুপুর একটা নাগাদ আয়।
-- মাকে বলতে হবে। ট্রামের ভাড়া চেয়ে নিতে হবে না?
-- হ্যাঁ, বলেই আসবি। তাইতো একটা নাগাদ আসতে বললাম। নইলে মাসিমা ভাববেন ম্যাটিনি শো'তে সিনেমা দেখার ধান্দা করেছিস।

আমরা বেশ উদ্দীপ্ত হই। এটা দারুণ হবে।
এমন সময় খেলার মাঠের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকারে চমকে উঠি। নাঃ, বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর চিৎকার।
আমরা উঠে পড়ি, দ্রুত পা চালাই হট্টগোলের উৎস সন্ধানে।
ফুটবল মাঠের কাছে বিশাল ভীড়। এর ওর কাঁধের ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি--- আমাদের রুম ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে দোতলার ওয়ার্ডেন সন্তোষদা বেধড়ক পেটাচ্ছেন। কিন্তু তালঢ্যাঙা আর পেস বোলার রাজুদাকে পেটানো সহজ নয়। ও প্রাণপণে মারগুলো ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সন্তোষদা হাঁফিয়ে উঠেছেন। এবার বেত ফেলে দিয়ে ওর কায়দা করে সিঙাড়া করা চুলের মুঠি ধরে ঘাড়ে রদ্দা।
আর তক্ষুণি একটা তীক্ষ্ণ খ্যানখেনে গলাঃ অ্যাই ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন বলছি! ও কিচ্ছু করে নি। মারতে হয় আমাকে মারুন!
বিমানদা!
রাজুদার ভালবাসার পার্টনার!
বিমানদা অনুরোধ করছে না, সন্তোষস্যারের কাছে ভিক্ষে চাইছে না, বরং ওর রাগে গলা কাঁপছে, ও কাঁদছে!
সন্তোষদা হতভম্ব। ভিড়ের মধ্যে নানান আওয়াজ, অধিকাংশই সন্তোষস্যারের বেত চালানোর বিরুদ্ধে।
উনি ছেড়ে দিয়ে বললেন-- যা! ফের কখনো--!
বিমানদা, ক্লাস টেনের বিমানদা, কাঁদতে কাঁদতে সবার সামনে রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে আমাদের রুমের দিকে নিয়ে যায় আর রাজুদা শরীরের সমস্ত ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে কেমন ঘসটে ঘসটে চলে যায়।
ভিড় পাতলা হয়। অনেকের সঙ্গে আমরাও কলতলার দিকে এগিয়ে যাই। একটু পরেই প্রেয়ারের ঘন্টা বাজবে।

প্রশান্ত আমাকে বলে--দেখলি! এই হল সত্যিকারের ভালবাসা।
-- আচ্ছা, বিমানদা ওরকমভাবে সবার সামনে রাজুদার জন্যে স্ট্যান্ড নিল, কাঁদল; তারপর মার খাওয়া রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল।
-- গেল তো! তাতে কী হয়েছে?
-- লজ্জা করল না?
-- কেন করবে? ঠাকুর বলেছেন না?--লজ্জা-মান-ভয়, তিন থাকতে নয়!
--- ভাগ শালা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা?
--- হ্যাঁ হ্যা`; কোথায় নেতাজি আর কোথায় পেঁয়াজি!
বিশু ফান্ডা দেয়-- ভুল কী বলেছে! ঠাকুর যে তিনটে আকর্ষণ বা টান এক হলে ঈশ্বর থাকতে না পেরে ভক্তকে দেখা দেন বলেছেন তার মধ্যে একটা হল --নষ্ট মেয়ের উপপতির জন্যে টান।
--ঠাকুর এরম উদাহরণ দিতেই পারেন না।
-- কথামৃত পড়িস নি তো! না পড়ে তক্কো করছিস। পড়লে জানবি ঠাকুরের উদাহরণগুলো সব গ্রামের জীবনের থেকে নেওয়া। তাতে মাটির সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া যায়।

প্রেয়ার হলে ঢোকার মুখে বিপ্লব থুড়ি মিতা আমার হাত ধরে টানে।
-- লাকি, আজ বিমানদাকে দেখে কেমন সেদিনের বিশুর বলা কথাটা একটু যেন বুঝতে পারলাম।
-- কোন কথাটা?
-- ওই যে-- "আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম,
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম"।


এরপর রাত্তিরে দরজায় ঠক্ঠক বা চাপা গলায় রাজু-রাজু ডাক শুনলে আর বিচলিত হই না। সবার আগে গিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে দিই। তারপর বিমানদা ক্যাপ্টেনের মশারিতে ঢুকে গেলে আমিও নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওদের মশারি থেকে কথাবার্তা বা বেড়ালের দুধে চুমুক দেওয়ার আওয়াজ কিছুই আর আমার কানে ঢোকে না; আমি অঘোরে ঘুমোতে থাকি।