Next
Previous
0

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in




অফিস থেকে ফিরে গোমড়া মুখে সরোজেশ বলল –“ছুটি বাতিল। মানে এক হপ্তা পিছিয়ে দিতে হোলো..”

-“তাহলে?”

-“তাহলে আবার কী, তোমার ছুটিও পেছিয়ে নাও। আবার নতুন করে টিকিট করতে হবে”

-“অসম্ভব। আমাকে এখনই ছুটি নিতে হবে, নয়তো পরে দেবে না..”

বিয়ের পর থেকেই আমেরিকায় রয়েছি। এতদিনে মানে পাঁচ বছরে এই দ্বিতীয়বার দেশে যাচ্ছি। এত আয়োজনের পর বাতিল করতে একটুও মন চাইল না। ঠিক করলাম আমি আগে চলে যাই, সাতদিন পরে নয় সরোজ চলে আসবে। তবে একটা কথা। দেশে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আমার যাবার জায়গা তেমন নেই। মাকে হারিয়েছি ছোটবয়সে। আর আমার বিয়ের কয়েকদিন পরেই বাবা মারা গেলেন, যেন মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই তাঁর সংসারের শেষ দায়িত্ব ছিল।

আজকাল চারদিকে যা আকছার হচ্ছে আমাদের বাড়িতেও তাইই হলো। বাবা মারা যাবার পর দাদা-বৌদি সুযোগ বুঝে চালাকি করে বাবার সম্পত্তি হাতিয়ে নিল। আমাকে কিছু দেয়নি। আমার সঙ্গে সম্পর্কও কেটে দিল – যদি আবার কোনদিন আমি আমার ন্যায্য ভাগ চেয়ে বসি। দাদার কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

দেশে সেরকম আপনজন বলতে একজনই আছে – আমার পিসীমা। বাবার দিদি, বাবার থেকে বছর দশেকের বড়। ভীষণ ভালবাসে আমাকে। এখনও। পিসেমশায় মারা গেছেন বহুদিন আগে। ছেলে আছে মুম্বাই না নাগপুর কোথায় যেন। তবে সে ছেলে, মানে সানুদা শুনেছি একটুও দেখাশোনা করে না। পিসীমার বয়স আশির কাছাকাছি। বারাসতের কাছে একলাই থাকে। ঠিক করলাম ওখানেই উঠব। তারপর কটা দিন পরে, সরোজেশের আসার সময় হলে শশ্বুরবাড়ি চলে যাব। আসছি বলে পিসীমাকে খবর পাঠিয়ে দিলাম।

*****

জায়গাটা এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে সোজা পিসীমার বাড়ি চলে এলাম। বাড়িটা পিসীমার নিজের, পিসেমশায় ভাগ্যিস করে গিয়েছিলেন। নয়তো কী যে হতো। তা পিসীমার বাড়িটা বেশ – দুটো শোবার ঘর। তার একটাতে কাচা চাদরে বিছানা-টিছানা পেতে আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। পেছনে উঠোন। বাথরুম। সামনে বারান্দা আর এক ফালি বাগান।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আমাকে এতদিন পর দেখে পিসীমা কী যে খুশি হলো কী বলব। আমারও খুব ভালো লাগছিল। তবে হ্যাঁ, পিসীমার চেহারাটা দেখলাম বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বয়সের ছাপ সর্বাঙ্গে। লাঠিতে ভর করে কোনো রকমে পা ফেলছে। সে যাই হোক, পিসীমা খুব সুন্দর করে মাছ রান্না করেছিল আমি আসছি বলে । সর্ষেবাটা দিয়ে পার্শে মাছের ঝাল – উফ কতদিন পরে যে খেলাম!

আমেরিকা দেশটা আমাদের দেশের উল্টোপিঠে। ওখানকার দিন মানে এদেশের রাত। সেই জন্যই ওদেশ থেকে এলে প্রথম কটা দিন বিচ্ছিরি গা ম্যাজম্যাজ করে, যাকে ‘জেট-ল্যাগ’ বলে। ভারি ক্লান্ত লাগছিল, তাই একপেট খেয়ে সটান শুয়ে পড়লাম। তোষকটা কড়া হলেও জেট-ল্যাগের ঘোরে মনে হল দারুন আরামের বিছানা। শুলাম আর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো যখন তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে। ঘড়িতে দেখলাম ছটা বেজে গেছে। পিসীমার গলা শুনতে পেলাম – সামনের বারান্দায় পিসীমা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। যাক, বাবা ভালো। সঙ্গীসাথী তো সকলেরই দরকার। উঠে একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবলাম যাই ওদের আড্ডায় আমিও একটু যোগদান করি। একা ঘরের ভেতর কীই বা করব।

দরজার ফাঁক দিয়ে পিসীমাকে দেখে আমি কিন্তু হকচকিয়ে গেলাম। এ আবার কী !

পিসীমা রসিয়ে রসিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে যাবার গল্প করছে। - “ আরে না গেলে বুঝতেই পারবি না যে জল কত ঠাণ্ডা হতে পারে। কিন্তু জানিস তো, সাহস করে জলে নেমে একটা ডুব দিতেই কী আরাম যে লাগল তোকে কী বলব! তবে হ্যাঁ, যা স্রোত না, ওই লোহার শিকলগুলো ধরে না থাকলে ভেসে যাবে মানুষ … ও মা এ কী রে … তোর হরিদ্বারের গল্প ভালো লাগছে না, আচ্ছা, তোকে কন্যাকুমারীর গল্প বলি। জানিস, নৌকো করে আমরা সমুদ্রের ওপর দিয়ে বিবেকানন্দ শিলায় গেছিলাম। দ্বীপের মাঝখানে কী সুন্দর মন্দির যে করেছে না রে …”

শ্রোতা কেউ নেই। একটা বাদামী রঙের নেড়ি কুকুর একটু তফাতে বসে আছে। পিসীমার হাতে একটা প্লাসটিকের থালায় দুটো রুটি, পিসীমা মাঝেমাঝে তা থেকে রুটির টুকরো দিচ্ছে ওকে। গল্পের টানে না হোক রুটির টানে প্রাণীটি বাধ্য শ্রোতা হয়ে বসে আছে।

আমি দরজা ঠেলে বারান্দায় আসতেই সে চার-পাঁচ পা পেছিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সন্দেহের চোখে আমাকে দেখছিল। এ আবার কে এলো? একে তো দেখিনি কখনো। আমার রুটিতে ভাগ বসাবে না তো!

আমি পিসীমার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম –“ পিসীমা, তুমি যে এতসব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছ জানতাম না তো! তা তোমার সঙ্গীটি কিন্তু বেশ..”

আমি যে এখন এসে পড়বো, পিসীমা আন্দাজ করেনি।। ভেবেছিল আমি ঘুমোচ্ছি। আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল –“ না রে না”

-“ তাহলে?”

-“ আমার অত ভাগ্য কোনোদিন হয়নি রে। জানিস, আমার না বরাবর বেড়াতে যাবার ভীষণ সখ। তোর পিসে আপিসের বন্ধুদের সঙ্গে একবার কেদার-বদ্রি গেল। কত করে বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে চল না গো। তা কানই দিল না। বলে – ও নাকি আমি পারব না। অনেক হাঁটতে হবে। আরও একবার পুরী গেলো, তাও আমাকে নিল না। তারপর তো সে আমাকে ছেড়ে সত্যিসত্যিই চলে গেল ওপারে”

আমি পিসীমার পাশে মোড়াটায় বসে পড়লাম। পিসীমা একটা রুটির টুকরো দিল বন্ধুকে তারপর আমার হাত ধরে বলল –“ জানিস তারপর আমার যে কী কষ্ট গেছে কী বলব। পেনশনের টাকা অনেকদিন পাইনি। ছেলেকে মানুষ করার জন্য লোকের বাড়িতে বাড়িতে রান্নার কাজ করতাম। তা সানু কলেজ পাশ করলো। চাকরিও পেল। তখন সবকিছু একটু সামলেছে দেখে আমার ইচ্ছেটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল। সানুকে বললাম – চল, তোতে-আমাতে কাশীধাম, মথুরা, বৃন্দাবন সব দেখে আসি। যাবি? সে বলল – আরে পাগল হলে নাকি? এই শরীরে তুমি পারো কখনো। তাছাড়া সে অনেক খরচ। আরো বার দুয়েক কাছাকাছি নিয়ে যাবার কথা বলেছিলাম, সে আমলই দিত না। তারপর তো নিজে বিয়ে করলো। বৌমা তো আমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। কদিনেই তারা আলাদা হয়ে গেল। তারপর তো দূরের শহরে কাজ নিয়ে ওরা চলে গেছে। আসা-যাওয়াও আর তেমন নেই ...”

আমি পিসীমার আরও কাছঘেঁষে বসলাম। বললাম তাহলে তুমি যে এত জায়গার কথা বলছ …

টের পেলাম পিসীমা আমার হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরেছে। বলল –“ এই টিভিতে যা দেখায়, কাগজে মাঝেসাঝে ফটো দিয়ে লেখা বার হয় – সেগুলো থেকেই যা পাই তাই নিয়ে এর সঙ্গে গল্প করি রে। যাওয়া তো হয়নি, মনে মনে তাই চলে যাই আর একে বলি…”

পিসীমার গলাটা একটু ধরে গেছে কি, না আমার মনের ভুল? বয়স্ক মানুষদের বেড়াতে নিয়ে যাবার তো অনেক সংস্থা আছে … কিন্তু পিসীমার তো সে বয়সও পেরিয়ে গেছে। শরীরের যা অবস্থা তাতে আর তো যেতে পারবে না। আমি চুপ করেই রইলাম।

পিসীমা বলল – “ এই শোন, আমি যে এই ঝুড়িঝুড়ি মিথ্যে বলছি বানিয়ে বানিয়ে – ঠাকুর আমাকে পাপ দেবে না তো রে?”

আমি পিসীমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম – “ না গো না। একটুও না। তোমার কাছের মানুষেরা কেউ তোমার ইচ্ছেগুলো একটি বার কানেও নেয়নি, দামও দেয়নি। তাই তোমার মানুষ-নয় বন্ধুটির সঙ্গে মনের ইচ্ছেটুকু ভাগ করে বেড়াতে যাও রোজ। ভগবান কক্ষনো তোমার কোনো দোষ ধরবে না গো পিসীমা...। মনের ইচ্ছে তো মনের ইচ্ছে। তার আবার সত্যিমিথ্যে কি! এই বিকেল বেলায় সাধ মিটিয়ে যত খুশি ঘুরে বেড়াও না তুমি …