প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সোমেন দে
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা থেকে জানা যায় হাজার বছর আগে সাধারণ বাঙালিরা কোনো জুতোই পরতেন না। তখন জুতো পায়ে দিত শুধু যোদ্ধা, দাররক্ষী এবং পেয়াদা এই ধরণের কিছু লোক।কিছু অবস্থাপন্ন বাঙালিরা খড়ম বা ঐ ধরণের পাদুকা পরতেন। আপামর বাঙালিরা খালি পায়েই চলা ফেরা করতেন।তারপর অবশ্য অনেকদিন কেটে গেছে। মানবসভ্যতা এক পা এক পা করে এগিয়েছে।বঙ্গ দেশে অনেক বিপ্লব, যুদ্ধ, নবজাগরণ, মন্বন্তর, দেশভাগ, যুগবদল,রাজাবদল হয়েছে। খালি পা থেকে জুতো পরার অভ্যেসটি আমবাঙালি ঠিক কবে রপ্ত করেছে তা বলা মুসকিল।তবে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের বাটা কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে জনগণকে জুতো পরতে উৎসাহী করা হচ্ছে এই ভয় দেখিয়ে যে খালি পায়ে থাকলে ধনুষ্টংকার হতে পারে। ধরে নেওয়া যেতে পারে উনিশের দশকে এসেই বাঙালির জুতো পরার অভ্যাস করতে শুরু করে। তবে সে জুতো ছিল প্রধানত চটি।
পলাশীর যুদ্ধে জিতে ইংরেজ যখন কলকাতাকে তাদের রাজধানী করে এ দেশের শাসন ব্যাবস্থা নিজের হাতে নেওয়ার দিকে এগোতে লাগল, তখন বিলেত থেকে এ দেশের শাসক প্রতিনিধিদের জন্য যে আচরণ বিধি পাঠানো হত তাতে বলা ছিল এ দেশের ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারে ভারতে চাকরি করতে আসা ইংরেজরা যেন মাথা না গলায়। কিন্তু সমস্যা ছিল সাদা চামড়ার লোকগুলি এ দেশে এসেই নিজেদের প্রভু এবং এ দেশের সব মানুষকেই ‘নেটিভ’ নামক এক নিম্ন শ্রেণীর জীব বলেই মনে করত। তাদের ভিতরে কোথাও একটা ভয় কাজ করত যে এই নেটিভরা বুঝি তাদের ঠিক ততটা খাতিরদারি করছে না যতটা তাদের দেশীয় হুজুরদের করে থাকে। তাই মাঝে মাঝেই তাদের দেশ থেকে আসা আচরণ বিধি না মেনে এমন সব হুকুম জারি করত যা এ দেশের মানুষের সংস্কৃতির বিপক্ষে। গরীব এবং নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে তাদের বিশেষ সমস্যা ছিল না। তাদের সহজেই হুকুমের দাস বানিয়ে ফেলা যেত। কিন্তু ইংরেজ তাদের দিয়ে তো সব কাজ হবে না। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সব বাঙালিরা ঠিক ততটা ততটা নির্বিবাদী ছিল না।
স্বদেশী আন্দোলন তেমন ভাবে দানা বাঁধার আগেই কিন্তু বাঙালি তার নিজস্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল ছোটো ছোটো প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে।ব্যাক্তিগত স্তরে কিছু কিছু ব্যাপারে ইংরেজদের সংঘাত বাধাতেও পিছপা হয় নি।উনিশ শতকের শেষের দিকে কিছু কিছু সংবাদপত্র ইংরেজদের নানা কাজকর্মকে সমালোচনা করতে ভয় পেতনা।
এই সময়ে একটি সংঘাত লেগেছিল বুট জুতো এবং চটির মধ্যে। তখনকার দিনে একেবারে দেশজ পদ্ধতিতে বানানো একধরণের চটি পাওয়া যেত। যাকে বলা হত তালতলার চটি বা ঠনঠনিয়ার চটি।
বুটজুতো কোনোদিনই বাঙালির পোষাকের অঙ্গ ছিল না। তবে শহুরে শিক্ষিত বা বাবু বাঙালিদের মধ্যে এক শ্রেণীর সাহেবদের অনুকরণ করে ডবসনের জুতো পায়ে দিয়ে সাহেব সাজার চেষ্টা করলেও কিছু আত্মাভিমানী বাঙালিরা চটি জুতো ছাড়তে চাইল না। তাতে অবশ্য ইংরেজদের সরাসরি কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গণ্ডগোলটা বাধল অন্য জায়গায়।
তখনকার বাঙালিদের মধ্যে রীতি ছিল কোনো গন্যমান্য লোকের বাড়ি গেলে চটি জুতো খুলে বাইরে রেখে সে বাড়িতে ঢোকার। সন্মান জানানো ছাড়া তার আর একটা কারণ ছিল তখনকার দিনে অবস্থাপন্ন বাড়ির গৃহসজ্জা এমন থাকত যে অতিথিদের বসার জন্যে বাড়ির মেঝেতেই গদি বা জাজিম পাতা থাকত। তাই সবাইকেই জুতো খুলে বাড়িতে ঢোকার রেওয়াজ ছিল। ইংরেজদের বাড়িতে বা দপ্তরে গদি বা জাজিম থাকত না, চেয়ার টেবিল সোফা থাকত। সেখানে চটি জুতো খোলার দরকার হত না।নেটিভদের জুতো খুলে রাখার ব্যাপারে এই ভেদাভেদ দেখে ইংরেজদের মনে হল যে লোকগুলি দেশীয় লোকেদের বাড়িতে যাবার সময় চটিখুলে ঢোকে সেই লোকগুলিই সাহেব বাড়ি বা দপ্তরে এলে জুতো না খুলেই ঢুকে যায়। এর থেকে তাদের মনে এক ধরনের ধারণা তৈরি হয় যে তাদের এই নেটিভ্রা যথাযোগ্য সম্মান করছেনা।
এই রকম ধারনা থেকে কোথাও কোথাও এক ধরনের সংঘাত তৈরি হতে থাকে। সে কালের সংবাদপত্র থেকে এই ধরণের একটি ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে।
১৮৭৩ সালে বহরমপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েবেল সাহেব হুকুম দিয়েছিলেন – “কেহ ইংরেজি জুতা না ব্যবহার না করিয়া তাঁহার কাছারি মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবেনা।” এই নিয়ে বেশ চারিদিকে বেশ সোরগোল পড়ে গেল। কাছারিতে তো বহু সাধারণ লোককেই যেতে হয়। সবার পক্ষে ‘ইংরেজি জুতো’ পরা সম্ভব ছিল না। কাগজেও এ নিয়ে লেখালেখি হল। ব্যাঙ্গ করে ‘ভারত-সংস্কারক’ পত্রিকা লিখল ‘ম্যাজিস্টেট সাহেবের এত জুতার প্রতি নজর কেন ?’
কিন্তু এখানে ওখানে এরকম ঘটনা ঘটতেই লাগল। ১৮৫৫ সালে এক সাহেবের বাড়িতে এক নেটিভ যখন দেখা করতে যায়, তখন তাকে বলা হয় সিঁড়ির কাছে খুলে রেখে যেতে। তিনি তাতে রাজী না হওয়াতে তাকে পদাঘাত করে সেখান থেকে বার করে দেওয়া হয়। সেই ভদ্রলোক সহজে ছেরে দেবার পাত্র ছিলেন না। সোজাসুজি সুপ্রিম কোর্টে কেস করে দিলেন। বিচারক সাহেব হলেও তিনি সুবিচার করেছিলেন, সেই সাহেবকে তিনশো টাকা জরিমানা করে দেন। এ খবর ‘সংবাদ প্রভাকর’ ফলাও করে ছেপেছিল। ইংরেজরা তখন একটা তত্ব খাড়া করার চেষ্টা করলেন – সাহেবী জুতোর যে ‘মানবর্ধনকারি’ শক্তি আছে চটি জুতোর তা নেই।
এতে ‘সোমপ্রকাশ’ কাগজের সম্পাদক লিখলেন – ‘একে মান বৃদ্ধি ও অপরের মানহানি হয়, সে কাহার গুণ ? কারিগরের না গঠনভেদের ? মনুষ্য ঈশ্বরের সৃষ্টি, সকল মনুষ্যই সমান ; এই উদার বাক্যটি কি কেবল মুখেই থাকিবে ? কার্যে পরিণত হইবে না ?’
এই চটি জুতো আর বুটজুতোর লড়াই চলতেই থাকল। উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এ রকম ঘটনা ঘটতেইও থাকল।সব ঘটনার কথা আমরা জানতে পারিনা। তবে এক ব্রাহ্মণের লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে তিনি যখন তিনি এক সাহেবের দপ্তরে একটা মামলার নিষ্পত্তির জন্যে যান, তখন সাহেব মামলার নিষ্পত্তি তো করে দিলেন। কিন্তু তারপর ব্রাহ্মণের ঠনঠনিয়ার চটি পরা পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি কি আমার সঙ্গে এই ভাবে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারবে ? ব্রাহ্মণ জানালেন না সেখানে গেলে আমি চটি খুলেই প্রবেশ করব। সাহেব এবং সাহেবের নেটিভ কেরানী তখন ব্রাহ্মণকে প্রশ্ন করল তবে সে এখানে কেন চটি খুলে আসেনি। ব্রাহ্মণ জানাল সাহাবের দপ্তরে তো সকলেই জুতো পরেই ঢুকছে, তাই আমিও চটি পরেই ঢুকেছি। তাতে সাহেব বললেন – সে তো ইংরেজি জুতো !
রসিক ব্রাহ্মণ বিনীত ভাবে সাহেবকে জানালেন – ‘ ইংরাজী জুতায় মান থাকে, আর চটি জুতায় মান যায়, এ কথা আমি আপনার ও সাহেবের মুখেই নতুন শুনিলাম ‘
তালতলার চটি বললেই অবশ্য বিদ্যাসাগর মশাইয়ের নামটিই সব চেয়ে বেশি করে মাথায় আসে। তার অনেকগুলি কারণ আছে। তালতলার শুঁড়তোলা চটিকে বিধ্যাসাগর মশাই এখনকার ভাষায় তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট করে ফেলেছিলেন। তিনি যে তাঁর ব্রাহ্মণত্বের তেজে বঙ্গদেশ কে কাঁপিয়ে রেখেছিলেন, এই চটিই তাঁর ছিল তাঁর ব্রহ্মতেজের অন্যতম প্রতীক। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইতে লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই একবার তাঁকে বলেছিলেন – ‘ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটীজুতাশুদ্ধু পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।’
তা যে সত্যি তিনি পারতেন তার প্রমাণ অনেকবার পাওয়া গেছল। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে বিদ্যাসাগর মশাই দু জন সঙ্গী সহ গেছলেন যাদুঘর আর তার পাশেই এসিয়াটিক সোসাইটি দেখতে। বিদ্যাসাগর মশাই যথারীতি তাঁর চিরাচরিত পোষাক পরে গেছেন, থান ধুতি, থান চাদর আর সেই তালতলার চটি। যাদুঘরের দারওয়ান তাঁকে আটকে জানালো ভিতরে যেতে হলে চটি খুলে যেতে হবে। অথচ তিনি দেখলেন কিছু সাহেব জুতো পরেই ভিতরে যাচ্ছে। বিদ্যাসাগর মশাই ভিতরে না ঢুকে ফিরে চলে এলেন এবং যাদুঘরের ট্রাস্টির সম্পাদককে একটি পত্রাঘাত করলেন। লিখলেন – ‘ ... এই জুতা রহস্যের কারণ আমি কিছু বুঝতে পারছি না। যাদুঘর তো সাধারণের আরাম বিশ্রামের স্থান। এখানে জুতা বিভ্রাট দোষাবহ। জাদুঘর যখন মাদুর মোড়া, কার্পেটযুক্ত বিছানা বা কারুচিত্রিত নয় তখন এরূপ নিষেধ বিধির আবশ্যকতাই বা কি? তা ছাড়া যাদের পায়ে বিলিতি জুতো, কিন্তু এসেছে পদব্রজে, তারা যখন প্রবেশ করতে পারছে তখন তাদের সমান অবস্থাপন্ন লোকের পায় শুদ্ধ দেশী জুতা বলে প্রবেশ করতে পায় না কেন তা আমি ঠিক করিতে পারছছি না। ... এ বিষয়ে মীমাংসার জন্য আপনি পত্রখানি অনুগ্রহ করে ট্রাস্টিদের দেখাবেন।
স্বাঃ শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।
এ বিষয়ে অনেক চিঠি চাপাটি চলেছিল সে সময়ে। সমস্যার সমাধান হয় নি। এই ব্যবস্থাই চলতে থাকল।তবে ‘ইংলিশম্যান’ কাগজে লেখা হয়েছিল – ‘বিদ্যাসাগরের মত একজন পণ্ডিতের প্রতি যখন এইরূপ ব্যবহার, তখন এসিয়াটিক সোসাইটিতে আর কোনো পণ্ডিত যাইতে চাহিবেন না।’
রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী খুব সঠিক ভাবে বলেছিলেন – ‘চটি জুতার প্রতি তাহার (বিদ্যাসাগরের) একটা আন্তরিক আসক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যে চটিজুতা ভিন্ন অন্য জুতা পায়ে দিতেন না, এমন নহে। আমরা যে স্বদেশের প্রাচীন চটি ত্যাগ করিয়া বুট ধরিয়াছি, ঠিক তাহা দেখিয়াই বিদ্যাসাগরের চটির প্রতি অনুরাগ বাড়িয়া গিয়া ছিল, বাস্তবিকই এও চটিজুতাকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া একটা অভিমান, একটা দর্প তাঁহার অভ্যন্তর হইতে প্রকাশ পাইত। ‘
তবে শুধু বিদ্যাসগর মশাই নন, সে সময় বুটজুতো বনাম চটিজুতো এই নিয়ে একটি অঘোষিত জাত্যাভিমান গরে উঠেছিল কিছু মর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে। তার প্রতিফলন ঘটেছিল নানা ভাবে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন দেশী চটিজুতো পরে। একই কোচে এক মিলিটারি সাহেব ছিল। সাহেবের সামনে তাঁর স্বদেশী চটিটি খুলে রেখে স্যার আশুতোষ একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মিলিটারি সাহেবটির এতে প্রচন্ড অপমান বোধ হয়। তিনি চটি জুতোটি দূরে ফেলে দেন। স্যার আশুতোষ ঘুম থেকে উঠে তাঁর জুতো খুঁজে পাচ্ছেন না। বুঝতে পারলেন এটি সাহেবেরই কীর্তি। কিছুক্ষণ পরে সাহেবও ঘুমিয়ে পড়েছেন। স্যার আশুতোষ সেই সময় তাঁর কোটটি নিয়ে দূরে রেখে চলে আসেন। সাহেব উঠেই হুম্বি তুম্বি করে জিজ্ঞেস করলেন – আমার কোট কোথায় ? স্যার আশুতোষ খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন – তোমার কোট আমার জুতো আনতে গেছে।
দ্বিজেন্দলাল রায় তাঁর ‘বিলেত ফের্তা’ কবিতায় তীব্র শ্লেষের সঙ্গে লিখেছিলেন-
আমরা ছেড়েছি টিকির আসর
আমরা ছেড়েছি ধুতি চাদর
আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোর্ট পরে
সেজেছি বিলিত বাঁদর।
সত্যেন দত্ত বিদ্যাসাগরের সে তালতলার চটি নিয়ে সোজাসুজি বন্দনা করেছিলেন একটি কবিতা দিয়ে –
সেই যে চটি –দেশী চটি- বুটের বাড়া ধন
খুঁজব তারে আনব তারে এই আমাদের পণ;
সোনার পিঁড়েয় রাখব তারে, থাকব প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দীগাঁয়।
সত্যেন্দ্রনাথের দেওয়া কথা অবশ্য আমরা রাখতে পারিনি। সোনার পিঁড়েতে কেন আমরা তাকে সামান্য সম্ভ্রমের জায়গাই দিতে পারিনি। দেশ একদিন স্বাধীন হয়েছে। ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তালতলার চটির মধ্যে যে প্রতীকী স্বদেশীয়ানার অহংকার ঘোষিত হত তার ছিটে ফোঁটাও বাঙালির চরিত্রে অবশিষ্ট নেই।বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে স্বদেশী বিদেশী বস্তুর আলাদা সীমারেখা হয়ত সরে গেছে। কোনো এক ধরণের পোশাক পরে জাত্যাভিমান দেখানোর প্রয়োজন মিটে গেছে। কিন্তু আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে জাত্যাভিমানের সদর্থক প্রকাশ বাঙালির কোনো কিছু মধ্যেই তেমন করে দেখতে পাওয়া যায় না।
তবে চটি জুতোর সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক একেবারে ঘুচে গেছে তা নয়। চটি বাঙ্গালির ক্যাসুয়াল পোষাকের অঙ্গ।
তিরিশের দশকে কোলাপুরের সওদাগর পরিবার নামে এক পরিবার এক ধরণের চপ্পল কে নতুন করে রূপান্তর করেন। পুরোপুরি চামড়া দিয়ে সম্পুর্ন দেশীয় পদ্ধতি ও অকৃত্তিম রং দিয়ে তৈরি করা চপ্পল জন্ম লগ্ন থেকেই বাঙালিদের খুব পছন্দ হয়ে গেল।
হলুদ প্যাকেটে চারমিনার সিগারেট, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, শান্তিনিকেতনী কাপড়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ‚ লিটল ম্যাগাজিন‚ কফি হাউস এই সবের সঙ্গে কোলাপুরি চপ্পলের আত্নীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে। সে সম্পর্ক আজও ছিন্ন হয়নি। তবে কলেজ স্টিটে বেশ কয়েকটি দোকান শুধু কোলাপুরি চটিই বিক্রি করতো, সেগুলি আজকাল বোধহয় অন্য চটিও বিক্রি করে। এই কিছুদিন আগেও পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ধুতি পাঞ্জাবীর সঙ্গে কোলাপুরি চটি পরিহিত অবস্থায় দেখা যেত।
আর আমাদের এখনকার মুখ্যমন্ত্রী যে চটি জুতো পরেন, সে চটিরও কিন্তু অন্য একটা ইতিহাস আছে। এ চটি ঠিক বাঙালিয়ানার প্রতীক না হলেও এ চটি আন্তর্জাতিক চটি।নানান দেশে এর নানান নাম আছে।
আমেরিকায় ফ্লিপ ফ্লপ, জাপানে Zori, কোথাও গো এহেড, কোথাও স্ল্যাপিস ইত্যাদি।
তবে সবই সম্ভবত জাপানের Zori ই আদি হাওয়াই চটি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আমেরিকান সৈনিকরা এটি আমেরিকায় নিয়ে আসেন। তার পর এটির নানা রকম রূপান্তর ঘটে। আমাদের দেশে পঞ্চাশের শেষের দিকে বা ষাটের দশকে বাটা কোম্পানি এটিকে ভারতের বাজারে ছাড়েন। এবং বাজারে আসতেই বাম্পার হিট হয়ে যায়। প্রথম দিকে অবশ্য এটির একটু এলিটিস্ট ইমেজ ছিল।দামও বেশী ছিল। পরে এটি নেহাতই জনগণের ঘরে পরার চটি হয়ে যায়।আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর এই বিশেষ ধরণের চটি পরা বেছে নেওয়ার কোনো প্রতীকী কারণ আছে কিনা আমার জানা নেই।
শেষ করার আগে একটি বাংলা সিনেমায় চটির প্রতীকী হয়ে ওঠার কথা বলে নিই। ঋত্বিক ঘটকের একটি সিনেমাটির কথা নিশ্চয় সবারই মনে আছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা গেছল একটি মেয়ে কলকাতা রাস্তা ধরে হাঁটছে। মলিন শাড়ি পরা বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ে, রবীন্দ্রনাথের কথায় যারা বিকিয়ে যায় মরীচিকার দামে, সেই সাধারণ মেয়েদের একজন। এই সিনেমায় দেখা গেল হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটির এক পাটি চটি ছিঁড়ে গেল, বিব্রত মেয়েটি চটি জোড়া হাতে নিয়ে আবার হাঁটতে থাকে,কারণ তাকে হাঁটতেই হবে, তার এবং হয়ত বা তার পরিবারের জীবনধারণের রসদ জোগানোর জন্য। এ ছবির প্রথম দৃশ্যেও ছবির নায়িকা নীতাকে দেখা গেছলো ছেঁড়া চটি পায়ে পা ঘষটাতে ঘষটাতে হেঁটে যেতে। আসলে এই ঋত্বিকের নীতা ঠিক কোনো বিশেষ গল্পের নায়িকা নয়।এই নীতা হল আমাদের অনেকবার দেখা সেই মেয়েটি যে টিউশনির টাকা পেয়ে নিজের ছেঁড়া চটিটা বদলে একটা নতুন চটি না কিনে সেই টাকা দিয়ে বোনের জন্যে শাড়ি, ভাইয়ের জন্যে ফুটবল, দাদার জন্যে পাঞ্জাবীর কাপড় কিনতে গিয়ে সব টাকা শেষ করে ফেলে। তার নিজের জন্যে আর কিছু কেনা হয় না।
আমি জানিনা নীতার গল্প এই একুশ শতকে আর প্রাসঙ্গিক কিনা।
তবে বাঙালির কাছে সেই চটির গল্প বোধহয় আজও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।