প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধজনজাতি ও জনগোষ্ঠী মানুষের সংখ্যা নিরিখে ভারতবর্ষের স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়, আফ্রিকার পরেই। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই আছে অসংখ্য জনজাতি সমাজের মানুষ যারা এখনও অবহেলিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, যারা সাধারণ সমাজের মানুষের কাছে অ-সংস্কৃত, অ-ভদ্রজন হিসাবে এখনও পরিচিত, তবু তারা আপনাতে আপনি উজ্জ্বল।
মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজ ও সমাজজীবন নিয়ে গবেষক, শিক্ষিত মানুষ, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানীদের জানার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। এই সময়েই আবিষ্কৃত হয় সারা পৃথিবী জুড়ে নানান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষগুলিও। আমাদের দেশেও আবিষ্কৃত হয় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাচীন সভ্যতা যা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রাথমিক অনুমান ছিলো এগুলি নগর সভ্যতা এবং সেখানকার মানুষগুলি ছিলেন নাগরিক সভ্যতায় সুশিক্ষিত। কিন্তু পরে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে তারা নাগরিক সভ্যতায় সুশিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। বস্তুতঃ তথাকথিত ‘আর্য’ নামে কোনও উন্নত বহিরাগত সম্প্রদায় বলেও কিছু ছিলো না। মানুষের বৃত্তির যেমন বিভিন্ন স্তর থাকে, তৎকালীন ‘আর্য, নিষাদ, শবর ইত্যাদিও ছিলো সেইরূপ সভ্যতার বিভিন্ন স্তর। আর্য স্তর ছিলো তৎকালীন সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত স্তর।
কিন্তু সেই প্রাচীনকালেও ছিলো উচ্চ-নীচ ভেদ, সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের নিম্নস্তরের মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, উৎপীড়ন এবং শোষণ। আসলে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গে উচ্চস্তরের মানুষের সংষ্কৃতির পার্থক্য। ফলস্বরূপ সমাজের উচ্চকোটি মানুষ বা উচ্চস্তরের মানুষ যারা আর্য নামে পরিচিত, সেই তথাকথিত আর্যগণের কাছে পরাজিত, অসম্মানিত ও বিতাড়িত হয়ে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন নানান গুহা, গিরিকন্দরে, পর্বতের সানুদেশে, গভীর অরণ্যে এবং ক্রমশঃ মূল জনসমাজ থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরে এইসব মানুষেরা নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পরিচিতি লাভ করেন জনজাতি ও জনগোষ্ঠী রূপে। এক স্থান থেকে আর এক স্থানে তারা যাযাবরের মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হন এবং নানা জায়গায় গোষ্ঠীগুলি ছড়িয়ে পড়লেও অক্ষত থাকে গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি, যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে ছড়িয়ে পড়া নানাভাগে বিভক্ত মানুষগুলিকে জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসাবে।
এই জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মধ্যে অধিক সংখ্যায় দেখা যায় সাঁওতাল জাতির মানুষ। আমাদের দেশেও জনজাতি সমাজের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যার মানুষ হ’লেন সাঁওতাল যা মূলতঃ অস্ট্রোলয়েড সমাজের অন্তর্গত। তৎকালীন সমাজ ছিলো অরণ্যসমৃদ্ধ সমাজ। অরণ্যচারী, প্রকৃতির কোলে লালিতপালিত মানুষগুলির জীবনে অরণ্যের ছিলো প্রধান ভূমিকা। শুধুমাত্র খাদ্য, বাসস্থানই নয়, জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা অর্থাৎ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ছিলো অরণ্যের একটি প্রধান ভূমিকা।
যতদূর জানা যায় অথর্ব বেদেই সর্বপ্রথম লিখিতভাবে ভারতীয় চিকিৎসাবিধি সম্বন্ধে রোগ-যন্ত্রণার মুক্তির উপায় নির্ণয় করা হয়। যে কারণে অথর্ব বেদে বৃক্ষের কাছে মানুষের করুণা ভিক্ষার শ্লোক উল্লেখিত হয়েছে—
“হে ভৈষজগুল্ম, তুমি মজ্জার সাথে মজ্জার, অঙ্গের সাথে অঙ্গ যুক্ত কর, মাংসের এবং অস্থির যে অংশ পতিত হয়েছে তা পুনরায় পুর্ববৎ হোক। অস্থি সবল হোক আর ছিন্ন ত্বক ত্বকের সাথে একাত্ম হোক। হে ভৈষজগুল্ম, তুমি শোণিত সবল কর, কেশের সাথে কেশের ভগ্নাংশ যুক্ত কর।”
এই প্রার্থনার মাধ্যমে যা জানা যায় তা হলো তখনকার সমাজে শল্যচিকিৎসা, ঔষধির সম্যক জ্ঞান ইত্যাদি চিকিৎসকদের ছিলো। যদিও তা বর্তমানের আধুনিক চিকিৎসা ছিলো না, যা ছিলো তা হলো আয়ুর্বেদের চিকিৎসা। ক্রমে ক্রমে শিক্ষা ও নাগরিক সভ্যতায় উন্নত সমাজে নানাভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলেও জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষগুলির চিকিৎসায় অরণ্যের প্রভাব রইলো অবিচ্ছিন্ন। মনুষ্যজীবনে অরণ্যের উপকারিতা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন সর্বতোভাবে। অরণ্যের প্রতিটি গুল্ম, লতাপাতা সবই মানুষের জীবনে সুফল দান করে। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এইসব আদিম অধিবাসীরা, যাদের আমরা জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষ বলে মনে করি, গাছ-গাছড়ার পরিচয়, তার নির্যাস থেকে ঔষধ প্রস্তুত ইত্যাদিতে অনেক এগিয়ে এবং তাঁদের সমাজে কিন্তু বর্তমানেও তাঁরা এই ঔষধপত্র ব্যবহার করে থাকেন।
সাঁওতাল সমাজের মানুষদের চিকিৎসা করেন সমাজের ওঝা। সাঁওতাল সমাজের ওঝাই হলেন তাঁদের চিকিৎসক। ওঝা ও সাঁওতাল সমাজের রোগ-অসুখের চিকিৎসা নিয়ে Rev. P.O. Bodding তাঁর ‘Studies in Santal Medicine And Connected Folklore’’ বইতে (This book was first published in three volumes between 1925—1940 from The Asiatic Society of Calcutta. And was republished all three volumes in the year 1986 in one volume.) সাঁওতালদের রোগ-অসুখ ও ওঝা নিয়ে চমৎকার বর্ণনা করেছেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে তিনি জনজাতি-জনগোষ্ঠী তথা সাঁওতাল সমাজে গাছ-গাছড়া ও তার ব্যবহার নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন এই বইয়ে। আধুনিককালে এটিই প্রথম এই ধরনের গবেষণামূলক বই, যদিও ঔষধি হিসাবে গাছ-গাছড়ার ব্যবহার সম্বন্ধে এই সমাজের মানুষেরা অনেক আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। সেই বই থেকে তাঁর কিছু নিদর্শন এখানে দেওয়া যেতে পারে। আমরা তাহলে ‘সাঁওতাল সমাজের রোগ-অসুখ ও তাঁর চিকিৎসা’ সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা করতে পারবো।
সাঁওতালদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা বা বিশ্বাস আছে যে অসুস্থতা, রোগ-ব্যধি স্বাভাবিক নয়। এই বিশ্বাস থেকেই তারা নিজেদের মতো একটি ধারণা তৈরি করে নেন। সাঁওতালদের মতে, ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতার (তাঁরা যাকে বলেন Supreme God) নির্দেশেই সবকিছু চলে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু আত্মাও আছে, যাদের তারা বলেন বোঙ্গা (Bonga). এই আত্মারা ভালো এবং মন্দ দুইই হয়ে থাকে। তাদের মতে, মানুষ সবসময় ভালো কাজ করে না, মানুষ সবসময় ভালোও হয় না। ভালো কাজ না করলে এই দুষ্ট বা মন্দ আত্মারা তাদের উপর ভর করে এবং তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করিয়ে নেয়। দুষ্ট আত্মা মানুষের উপর ভর করলে মানুষ ভালো কাজ করে না, ভালো থাকতে পারে না। দুষ্ট আত্মাদের দ্বারাই মানুষের দেহে নানারকম আধি-ব্যধির সৃষ্টি হয়, মানুষ কষ্ট পায় এবং পরিশেষে মৃত্যু বরণ করে। এগুলি হলো সরাসরি অসৎ কর্ম করার ফল। অসৎ কর্মের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে এবং অনেকসময় দুষ্ট আত্মারা মানুষকে ‘খেয়ে’ও ফেলে।
যখন পরিবারের কেউ একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন, সাধারণভাবে আমরা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকি, বা নেওয়া উচিত বলে মনে করি যা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সাঁওতাল পরিবারের মনে ঠিক এই প্রতিক্রিয়া হয় না। তাঁরা অসুস্থ মানুষটির দিকে লক্ষ্য রাখেন, রোগ ও রোগীর অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করেন। যদি রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাহলে চিকিৎসার ব্যাপারে করণীয় কিছুই থাকে না। তারা অপেক্ষা করেন কারণ তারা মনে করেন রোগ নিজেই একদিন ক্লান্ত হয়ে রোগীকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু তা যদি না হয়, রোগীর অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে তারা তখন ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করেন।
আগেই বলেছি, জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষ অরণ্য-নির্ভর এবং তাদের প্রায় সকলেই গাছ-গাছড়া থেকে নির্যাস তৈরি করে গৃহেই সাধারণ চিকিৎসা করে থাকেন, সুতরাং, একজন রোগীর রোগ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তাঁরা ঘরোয়া চিকিৎসা শুরু করেন। এই চিকিৎসা হলো Root-Medicine অর্থাৎ গাছ-গাছড়া সম্বন্ধিত। প্রায় প্রতিটি পরিবারের মানুষজন, কিংবা পারিবারিক আত্মীয়জন অথবা প্রতিবেশীদের কেউ এই চিকিৎসা শুরু করেন। সাঁওতালদের মধ্যে প্রায় সকলেই ঘরোয়া চিকিৎসা সম্বন্ধে কিছু না কিছু ধারণা রাখেন। কিন্তু এরপরেও যদি রোগীর রোগ না সারে, কিংবা রোগী চিকিৎসায় সাড়া না দেন, তাহলে তখন ওঝাকে বা সাঁওতাল সমাজের চিকিৎসককে ডেকে আনা হয়। তিনি প্রথমে ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্র, ম্যাজিক ইত্যাদির সাহায্যে রোগকে বশে আনার চেষ্টা করেন। রোগী সুস্থ হয়ে না উঠলে তখন তিনি চিকিৎসক রূপে ঔষধি প্রয়োগ করেন। ওঝা হিসাবে তাঁর প্রথম কাজ হলো রোগীর দেহে বাসা বেঁধে থাকা অশুভ আত্মা বা আত্মাগুলিকে রোগীর দেহ থেকে উন্মুক্ত করা বা তাড়িয়ে দেওয়া। তারপর প্রয়োজনমতো ঔষধ দেন। ওঝাদের মধ্যে দেখা যায় এক আশ্চর্য ক্ষমতা, বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে নানাধরনের ঔষধ তৈরি করে তাঁরা রোগীর দেহে প্রলেপ দেন এবং রোগীকে সেবন করান। যেহেতু জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষগুলির অরণ্যের গাছপালা থেকে ঔষধ তৈরির এক ক্ষমতা আছে, প্রায় সব ওঝাই এই ক্ষমতা রাখেন। কারণ তাঁদের সমাজে ওঝাই চিকিৎসক এবং যেহেতু এই সমাজে অরণ্যজাত ঔষধির প্রয়োগ ও গ্রহণ বেশি, তাই একজন ওঝার পক্ষে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে বলা যেতে পারে, বর্তমানে আমরা যাঁদের ‘কবিরাজ’ বলি, আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে ওঝার ভূমিকাও অনেকটাই তাই।
একজন সাঁওতাল ওঝা এবং একজন হিন্দু সমাজের ‘ওঝা’ পদবীধারী ব্যক্তিকে সমগোত্রীয় ভাবা ভুল। সাঁওতাল সমাজের একজন ওঝা সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও আরও কিছু জ্ঞানের অধিকারী যে জ্ঞান কেবলমাত্র তারাই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন তাঁদের গুরুর কাছে।
পাতা চিকিৎসা—
সাঁওতালদের ‘পাতা চিকিৎসা’ একটি অন্যতম চিকিৎসা যা হলো মৌখিক চিকিৎসা, পরম্পরাগতভাবে দেখে বা শুনে শিখে থাকেন। কী তার পদ্ধতি?
এটি যেহেতু মৌখিক চিকিৎসা, তাই লিখিত কোনও রূপ এর নেই। Rev, Bodding তাঁর অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন, সেটিই এখানে বিবৃত করছি। সাঁওতাল সমাজে ‘পাতা-চিকিৎসা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা যার দ্বারা ওঝা রোগের মূল কারণ নির্ধারণের চেষ্টা করেন।
পাতা-চিকিৎসায় একজন ওঝার প্রয়োজন হয় কয়েকটি পাতার, যেগুলি মূলত হয় শালপাতা। আমরা জানি, সাঁওতাল সমাজে শালগাছের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাঁরা শালপাতাই ব্যবহার করেন। পাতার সঙ্গে প্রয়োজন হয় সামান্য তেল ও জলের। এগুলি সরবরাহ করেন সেই গৃহী বা সেই ব্যক্তি যিনি ওঝাকে রোগ নির্ধারণের জন্য নিযুক্ত করেন। পাতা, জল ও তেল নিয়ে ওঝা সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসেন। এরপর ওঝা তাঁর মাথাটি একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে তেলের মধ্যে ডান হাতের তর্জনী ডুবিয়ে সেটি সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে ছিটিয়ে দেন। আবার একবার তর্জনীটি তেলের মধ্যে ডুবিয়ে তা ছিটিয়ে দেন ধরতী-মায়ের উদ্দেশ্যে। যদিও সাঁওতালদের মধ্যে এঁর পূজা খুব প্রচলিত নয় কিন্তু রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁরা এটি করেন।
দেবতার উদ্দেশ্যে তেল ছিটানো হয়ে গেলে ওঝা পাতা দুটিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করেন, তারপর দুটি পাতারই যে শিরাগুলি আছে, তার মধ্যের অংশগুলি ছিঁড়ে ফেলেন এবং ওই ছেঁড়া পাতাগুলি মুড়ে একপাশে রেখে দেন। শালপাতার শিরাগুলি খুব শক্ত হয় এবং পাতার অংশগুলি ছিঁড়ে ফেলার পর সেগুলি দেখতে জালির মতো মনে হয়। পাতাদুটি মাটিতে রাখা হয় এবং ফাঁকা অংশগুলিতে ওঝা ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঢালেন এবং প্রতিটি রোগের কারণ ও নিরাময়ের উপায় ব্যাখ্যা করেন।
ওঝার মতে রোগের কারণগুলি চার রকমের হতে পারে।
ক) প্রাকৃতিক কারণ
খ) মনুষ্যজনিত কারণ
গ) বোঙ্গা বা আত্মা দ্বারা সৃষ্ট কারণ
ঘ) পূর্বপুরুষ দ্বারা ঘটিত কারণ
প্রাকৃতিক কারণ বলতে সাধারণতঃ কোনও মহামারী ইত্যাদি বোঝান।
মনুষ্যজনিত কারণ হলো ডাইনী দ্বারা কোনও রোগের উৎপত্তি। সাঁওতাল সমাজে ডাইনীর প্রভাব খুব বেশি এবং মনে করা হয় নারীদের মধ্যেই এই ডাইনীদের বসবাস এমনকি প্রত্যেক নারীর মধ্যে ডাইনী বাস করে এমন ভাবনাও তাঁদের আছে। রোগীর গৃহে কোনও নারী, তার পিতার গৃহে কোনও নারী, পরিবারের বিভিন্ন নারীর মধ্যে এমনকি গ্রামের অন্য কোনও পরিবারের নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ডাইনী দ্বারাও এই রোগের সৃষ্ট হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
বোঙ্গা অর্থাৎ আত্মার বিষয়টি খানিক আলাদা। প্রথমতঃ ওঝা মনে করেন এটি পারিবারিক কোনও আত্মার অশুভ প্রভাবের ফলে রোগের সৃষ্টি। রোগী বিবাহিত হলে তাঁর স্ত্রীর পিতার অশুভ আত্মার প্রভাবেও রোগের সৃষ্টি হতে পারে। আবার অনেক সময় ‘সীমা বোঙ্গা’ বা গৃহের সীমানার বাইরে অবস্থিত বোঙ্গা বা আত্মার দ্বারা অশুভ প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। এইভাবে সমস্ত কারণ একটি একটি করে পাতার শিরার ফাঁকে ফাঁকে তেল ঢালতে ঢালতে তিনি একটি একটি বোঙ্গা বা আত্মার নামে কিছু মনে মনে বিড়বিড় করে মন্ত্র বা ওইজাতীয় কিছু উচ্চারণ করতে থাকেন। সঙ্গে ওই জায়গাগুলিতে তেলের সাহায্যে কিছু ছবিও আঁকেন। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, প্রতিটি চিহ্ন বা ছবি কিন্তু আলাদা।
আবার কখনও জোরে জোরে শিরার ফাঁকে আঙ্গুল দিয়ে তেল ও প্রতিকৃতি আঁকার সময় কিছু মন্ত্রও বলেন, যা অনেকটা এইরকম—
‘তেল তেল, রাই তেল, মন তেল, কুসুম তেল, কড়চার তেল, ভেরান্ডার তেল, রাই রুই তেল, আই তেল, পোড়াতে কি উঠ? ডান উঠ, ভুত উঠ, যুগিন উঠ, বিষ উঠ, কে পোড়ে, গুরু পোড়ে, গুরু গিয়া মা পোড়ে, পোড়া হাসে কাহরি গিয়া, কামরু গুরু দোহারে, দোহাই পোড় হে...’
এই মন্ত্র পড়ার পর সেই পাতার উপরে জোরে জোরে ফুঁ দেন ওঝা। তারপর দুটি পাতা একটির উপর আর একটি রেখে ঘষতে থাকেন। পাতা ঘষারও মন্ত্র আছে। সেটি এইরকম—
‘পাত, পাত, শাল পাত, চিহুর পাত (অন্য এক ধরনের পাতা), ভেলার পাত, কি কি উঠে, ডান উঠে, যুগিন উঠে, ধর কার উঠে, দেবতা উঠে, কে দেখে? গুরু দেখে, দেখ সে উঠাস্!’
মন্ত্র শেষ হওয়ার পর পাতাগুলিকে মাটিতে রেখে দেন। হাওয়ায় যাতে উড়ে যেতে না পারে, সেজন্য পাতার উপর অল্প একটু মাটি কিংবা ছোটো মাটির ঢেলা চাপা দিয়ে রাখেন। তারপর পাতা দুটিকে নমস্কার করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে পাতা দুটির মধ্যে কী ধরনের তেলের ছবি ফুটে উঠেছে ও সেই ছবির দ্বারা কোন রোগ নির্ণয় করা গেছে তার ব্যাখ্যা করেন।
পাতা চিকিৎসার এই পদ্ধতি হলো রোগ নির্ণয়। এবং সেই অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলতে থাকে।
যে কথাটি বলার, ওঝাদের এই চিকিৎসাকে তুকতাক, মন্ত্রগুপ্তি, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির সঙ্গে মিলিত কিছু বলা যেতেই পারে। সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম্য মানুষগুলিকে একরকমের ঠকানোও হয়তো। যদিও না জেনে কিছু বলা সমীচীন নয়, তবু এই ধরনের চিকিৎসায় জটিল কোনও রোগ সারানো সম্ভব বলে মনে হয় না। আশার কথা, বর্তমানে সমাজের উন্নতির ফলে, মানুষ শহরে ডাক্তারের কাছে যেতে শুরু করেছেন এবং গ্রামেও ডাক্তারের আগমনের ফলে তাঁরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন।
আর একটি কথা না বললে হয়তো সব কথা বলা হবে না। ওঝাদের এই যে প্রতিটি নারীর মধ্যে ডাইনী বাস করা, কিংবা কোনও বিবাহিত পুরুষ অসুস্থ হলে তাঁর শ্বশুরবাড়ির কোনও নারীর আত্মা এই রোগের কারণ, এমনকি ভিন্ন পরিবারের কোনও নারীর আত্মার অশুভ প্রভাব ব্যক্তিটির রোগের কারণ এবং একজন নারীই যে তার কারণ— এটি বুঝি সেই পুরাতন নারী সম্পর্কিত ধারণা থেকেই এই রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি জন্ম নিয়েছে। আধুনিক সমাজে এই ব্যাখ্যা একেবারেই অচল। যদিও সাঁওতালদের এই রোগ-নির্ণয়, ওঝাদের চিকিৎসা পদ্ধতিও এখনকার সময় থেকে কিছু আগে যা Rev. Bodding তাঁর বইতে লিখে গেছেন।
আশা করবো, সাঁওতাল সমাজে ওঝাদের রোগ-নির্ণয় পদ্ধতির কিছু উন্নতি ঘটেছে।