প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র
Posted in প্রবন্ধবাংলা সাহিত্যে নর-নারীর যৌন সম্পর্ক নিয়ে যুগান্তকারী কালোত্তীর্ণ কোনও উপন্যাস নেই। কিংবা অন্যান্য উপন্যাসেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নর-নারীর সম্পর্কের বিন্যাসে প্রেম ভালোবাসা যতই থাক। যৌনতা থাকলেই বিপদ। সাহিত্য মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের পরতে পরতে দেশ-কাল সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি শরীর এবং মনের ঘাত-প্রতিঘাতের রূপকার। বাংলা সাহিত্যে নর-নারীর জীবনের বাকি সকল দিকগুলি উপস্থিত থাকলেও। নর-নারীর যৌন সম্পর্কের গভীরে বাংলা সাহিত্য আজও সেভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। পারেনি তার অনেক কারণ রয়েছে। সামাজিক ট্যাবু। প্রকাশক সম্পাদকের বিরুদ্ধতা। যৌন সম্পর্কের গভীরে পৌঁছানোর বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব। ইত্যাদি নানান কারণেই বাংলার সাহিত্যিকরা মূলত এই বিষয়টিকে সাহিত্যের অন্যতম সামগ্রী করার পথে এগোতে পারেননি। যাঁরা এগোতে চেয়েছেন। তাঁদের অবস্থা প্রায় ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। আরও পরিষ্কার করে বললে, বাংলা সাহিত্যের ভাষা আজও যথেষ্ট সাবালক বা প্রাপ্তবয়স্কও হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে নর-নারীর যৌন সম্পর্কের গভীরে ডুব দেওয়ার মতো ভাষার শক্তি বাংলা সাহিত্যের ভাঁড়ারে নেই। এও একটা বড়ো কারণ। বাংলার সাহিত্যিকদের এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে। আমাদের সাহিত্যের আলোচনাতেও যৌনতার বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করাই আমরা শ্রেয় মনে করি। লেখকের লিখতে দ্বিধা। আলোচকের আলোচনায় দ্বিধা। পাঠকের পড়তে আগ্রহ। কিন্তু হাতের কাছে সেই সাহিত্য নেই। সেই সিনেমা নেই। সেই নাটক নেই। সেই ভাস্কর্য নেই। সেই চিত্রকলা নেই। ফলে পাঠকও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারে না বাংলায়। তাকে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয় বিদেশী সাহিত্য মুখে করে। ফলে চেতনার বলয় অপুষ্টই রয়ে যায় আগাগোড়া। এটা বাংলা সাহিত্যের দূর্দৈব। বাংলার দুরবস্থা। বাঙালির দুর্দশা।
সাহিত্য মূলত সমাজের চলনের রূপকার। যে সমাজের যে চলন। সেই সমাজের সাহিত্যের স্বরূপ সেই চলনের অনুরূপ। কিংবা রকমফের। বাঙালি সাহিত্যিকের পক্ষে ইউরোপের গল্প বলা সম্ভব নয়। এমনকি যে সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন একজন সাহিত্যিক, তাঁর পক্ষে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর গল্প বলাও সহজ কথা নয়। ফলে সাহিত্যিকের জীবনযাপন ও তার সামাজিক পরিবেশ থেকেই তার কলম কীভাবে চলবে তার ধরন ও স্বরূপ রূপ নিতে থাকে। এটাকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় না স্বভাবতই। ফলে বাঙালি সমাজের চলনই বাংলা সাহিত্যের ধারা ঠিক করে দিতে থাকে। আবার সমাজ চিরকাল একই জায়গায় থেমেও থাকে না। দাঁড়িয়ে থাকে না। সমাজও চলতে থাকে সময়ের সাথে। ফলে সমাজ যতটুকু চলে, যেভাবে চলতে থাকে, সেই সমাজের সাহিত্যও সেইভাবে চলতে থাকে। এখন আমাদের বাংলায় আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার একটি বড়ো বিষয়। সব সমাজেই এই বিষয়টি সক্রিয় থাকে। আমাদের আজকের চলন যতই এই সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক না কেন। আমাদের চলনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে সে কখনওই অস্বীকার করতে পারে না। উল্টে তার চলনের মজ্জায় মজ্জায় সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের শিকড় ও তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে জড়িয়ে থাকে। ফলে আমাদের পোশাক হয়তো আধুনিক হতে পারে। আমাদের হাতে প্রযুক্তির নানান উদ্ভাবনী সামগ্রী আধুনিক থাকতে পারে। কারণ সেগুলি চটজলদি আমদানি করা যায়। নকল করা যায়। কিন্তু আমাদের চলনের গভীরে রয়ে যায় আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়। আমাদের ঐতিহ্যের শতাব্দী প্রাচীন উত্তরাধিকার। তার সাথে সঙ্গতি রাখতে রাখতে অতি অতীব ধীরগতিতে আমাদের চলন অল্প-স্বল্প করে বদলাতেও থাকে। কারণ বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়তে থাকে। সেই প্রভাব আমাদের চলনের তাল-লয়-মাত্রায় যতটুকু নতুনত্ব নিয়ে আসে। ততটুকুই এগোতে থাকে আমাদের সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি। এই এগোনোর মূল অনুঘটক আমাদের অভ্যন্তরীন বদল ততটা নয়। যতটা বাইরের প্রভাব। মূল সমস্যা এইখানেই।
বাংলার সমাজে শরীর একটা সামাজিক ট্যাবু। শরীর নিয়ে যত কম বলা যায় ততই শোভনীয়। যত কম ভাবা যায় সেটাই কাম্য। এই যে একটি মান্ধাতার আমলের ধরন আমাদের সমাজের চলনের উপরে কর্তৃত্ব করতে থাকে, এর ভিতর থেকে আমরা কেউই বেড়িয়ে আসতে পারিনা। বিশেষ করে যার লেখাপড়ার বহর যত বেশি। আমাদের নাগরিক জীবন-যাপনের পরতে যে অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলির ভিতরে আমাদের ওঠাবসা, চলাচল। তার বাইরের সমাজের কথা আমরা কতটুকু জানি? তাই আমাদের আলোচনা সেই শিক্ষিত নাগরিক বাঙালি সমাজকে কেন্দ্র করেই। যাদের হাতেই সচল থাকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। এই যে একটা শ্রেণী। আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী বললেও, নিজেদেরকেও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দূরবর্তীও ভাবতে পারি না কখনওই। আমাদের আলোচনার বৃত্ত এই সামাজিক পরিসরকে নিয়েই। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীরও একটা বড়ো ভূমিকা রয়ে গিয়েছে। আমাদের এই শ্রেণী চেতনার বৃত্তে। তাই আমাদের সামাজিক পরিসর থেকে ব্যক্তি পরিসরে আমরা শরীর নিয়ে সদাসর্বদা শশব্যস্ত থাকি। শরীর নিয়ে বেশি দূর আলোচনা করা যাবে না। ভাবা যাবে না মন খুলে। ভাবতে বসলে সেটিকে আমরা প্রথমেই মনের বিকার ও পরে মনোরোগ বলে ভাবতে শুরু করে দেবো। মূল গণ্ডগোলটা ঠিক এইখানেই। মানুষের জীবনে শরীরটাই যে প্রথম এবং শেষ। মন যে শরীরেরই একটা বিস্তার। গোড়ার সেই সত্যটুকু আমাদের চেতনায় অধরাই রয়ে যায়। আমাদের ভিতরে শরীর নিয়ে যে গভীর একটা লজ্জাবোধ ক্রিয়াশীল থাকে, সেই মনোবৃত্তি থেকেই যৌনতা নিয়ে আমরা মুখে কুলুপ আঁটতেই অভ্যস্থ। ফলে যে মানুষ শরীর নিয়েই সদাসর্বদা শশব্যস্ত, লজ্জিত, শঙ্কিত, সেই মানুষের পক্ষে যৌনতা নিয়ে পরিষ্কার মনে আলোচনা করা কী করে সম্ভব? মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো, এরপরে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ণত্বষত্ব। ফলে শরীর নিয়ে চলার ভিতরেও আবার নারী-পুরুষের জন্য আলাদা নিয়ম।
বাঙালি মেয়ে সমুদ্র স্নানে গেলে শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে ঢেউয়ে ভিজে চান করবে। নয়তো খুব আধুনিক হলে জিন্সের প্যাণ্ট-টপ। কিন্তু সমুদ্র স্নানের পোশাক বিকিনি পড়ে বঙ্গললনারা পুরী-দীঘাতে জলে লম্ফঝম্ফ করছে, আমাদের সমাজে এখনও ভাবা যায় না। এই যে বাধা। এই বাধা একেবারে মজ্জাগত। হ্যাঁ একটা পিছিয়ে থাকা সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও খুবই নড়বড়ে। কিন্তু আমাদের মন-মনন-মানসিকতায় আমরা আমাদের শরীরকে নিয়ে আজও কোনওভাবেই সহজ হয়ে উঠতে পারি না। ফলে যৌনতার বিষয়টা যেন এক নিষিদ্ধ এলাকা। সেই এলাকায় একজন সাহিত্যিকের কলম প্রবেশই বা করবে কী করে? তাই বলে কি বাংলা সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ নেই? আছে বইকি। অনেক সাহিত্যিক এই বিষয়ে তাঁদের নিজের মতো করে চেষ্টা করে গিয়েছেন নতুন পথকাটার। কিন্তু সেই পথ কতটা পথ আর কতটা গোলকধাঁধা প্রশ্ন তো সেখানেই। বাংলা সাহিত্যিকের কলমে যৌনতার ব্যবহার আমাদের মেয়েদের শাড়ি-সালোয়ার কামিজ পড়ে সমুদ্র স্নানের মতোই। তার বেশি কিছু নয়। এই কারণে, জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে দিক। সেই যৌনতার দিকটাই আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আর মনে রাখা দরকার। যৌনতাকে এড়িয়ে গিয়ে নর-নারীর সম্পর্কের বয়নের গভীরে পৌঁছানো যায় না কখনওই। এবং দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্য, বাংলা-সাহিত্য আজও নর-নারীর সম্পর্কের রসায়নের অতলান্ত গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি আদৌ। অনেকেই হয়তো বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের নামধাম স্মরণে উদাহরণসহ এইকথা খণ্ডনে প্রয়াসী হবেন। কিন্তু একথা কোনওভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলা সাহিত্য আজও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলা উপন্যাস। আবার একথা বলার উদ্দেশ্যেও নয়, প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাস সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে কেবলমাত্র যৌনতা নিয়েই টানাটানি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। একদমই সেকথা নয়। কিন্তু নর-নারীর সম্পর্কের গভীরে পৌঁছাতে গেলে সাহিত্যকেও নর-নারীর যৌনতার পরতের পর পরতে প্রবেশ করতে হবে। মুশকিল হলো এটাও যে। তার জন্য উপযুক্ত ভাষা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষা এই বিষয়ে আমাদের উপন্যাস সাহিত্যের মতোই অপ্রাপ্তবয়স্ক রয়ে গিয়েছে আজও। আমাদের সাহিত্য কুলের কলমে ভাষার দৈন্য ঘোচেনি আজও। তার অন্যতম বড়ো কারণ, শরীর নিয়ে সেই সামাজিক ট্যাবু। এবং অতিরিক্তি পরিমাণে বিদেশী ভাষার উপরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নির্ভরতা। এই ট্যাবু ও বিদেশী ভাষার উপরে নির্ভরতা আমাদের ভাষার স্বাভাবিক অগ্রগতিকে খর্ব করে রেখে দিয়েছে। ফলে আমাদের আর বয়ঃবৃদ্ধি ঘটলোনা। যৌনতার প্রসঙ্গকে আমাদের স্বাভাবিক ভাবনা-চিন্তা আলোচনায় এড়িয়ে চলতে চলতে। আমরা বিষয়টিকে বন্ধ ঘরের দরজার ভিতরে একটা নিশিক্রিয়ার বেশি কিছু অনুভব করে উঠতেই শিখলাম না। জাতি হিসাবে, সাহিত্য হিসাবে এইখানে বাংলা আজও খোঁড়া হয়ে খোঁড়াচ্ছে।