প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রবন্ধ (১)
ভূমিকা
নিও -নর্মাল কে সি পাল
নতুন শতাব্দীর দুটো দশক পেরিয়ে গেলো। বিশ্বায়নের যুগে ঘরে বসে দুনিয়ার খবর— অডিও এবং ভিস্যুয়াল মাধ্যমে— আমরা পেয়ে যাচ্ছি। কথা চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে গেছে। নতুন কোনও জায়গায় গেলে আমরা অচেনা লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করি না। বরং মোবাইলে জিপিএস দেখে ঠিকমতো পৌঁছে যাই আমড়াতলার মোড়ে।
কিন্তু আচমকা চারদিকে শুনতে পাই যে এসবই নাকি ‘বেদে আছে’! সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট করছিলেন। গণেশের নাকে হাতির শুঁড় প্লাস্টিক সার্জারি করে লাগানো হয়েছিলো। রামায়ণের পুষ্পক বিমান আসলে প্রাচীন যুগের এয়ার ইন্ডিয়া।
অথচ কেউ খেয়াল করেন না যে পৌরাণিক যুগে রাজপ্রাসাদেও ইলেকট্রিসিটি ছিলো না। সর্বত্র দীপদান এবং মশালের আলো। এমনকি বৌদ্ধযুগেও বাসবদত্তা সন্ন্যাসী উপগুপ্তকে দেখছে প্রদীপের আলোয়— “প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাহার নবীন গৌরকান্তি”।
আর পৌরাণিক যুগে তো সবাই যাতায়াত করেন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে, মানে পশুতে টানা শকটে বা রথে। তাই দেবতারাও সব বলদবাহন, ময়ূরবাহন, অশ্ববাহন, হস্তীবাহন এবং মকর বা সিংহবাহিনী, এমনকি মুষিকবাহনও।
বাস্তববুদ্ধি ঘুলিয়ে দেওয়ার এ জাতীয় চেষ্টা যে কয়েক দশক আগেও হয়নি এমন নয়। যেমন সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য নয় পৃথিবী। এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তখন এসব শুনে বা কলকাতায় ও হাওড়া ব্রিজের গায়ে লেখাগুলো পড়ে আমরা সবাই হাসতাম, দেওয়াল লেখক কে সি পালকে কিছুটা প্রশ্রয়ের সুরে বলতাম পাগল। কিন্তু আজকাল অবস্থা বদলে গেছে। ওই কথাগুলো বলা হচ্ছে জোরগলায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে।
যেমন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে পেপার গবেষণাপত্র পড়া হচ্ছে যে প্রাচীন যুগে ভারতে বিমান ব্যবস্থা ছিলো। সেই বিমান অনেক উন্নত টেকনোলজিতে চলতো। তাতে মোটরগাড়ির মতো ‘ব্যাকগিয়ার’ ছিলো। হাইকোর্টের বিচারপতি বলছেন ময়ূর হলো খাঁটি ব্রহ্মচারী। তার চোখের জলে ময়ূরীর গর্ভসঞ্চার হয়। বোকাবাক্সতে দেখছি এমন দাবি যে জ্যোতিষেও ক্যানসার সেরে যায়। বা পতঞ্জলি আশ্রমের ৭৫০ টাকার প্যাকেজে করোনা রোগী ১০০% সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যে পরে কা কথা, দেশের প্রধানসেবক নিজেই গণেশের শুঁড়কে প্রাচীন প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বলে দাবি করছেন।
এখন কেউ হাসতে সাহস করে না। এ নিয়ে প্রশ্ন করে না। করলেই আপনি হয় দেশদ্রোহী, নয় তো ভারতের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্টে ঘা দিচ্ছেন।
মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা?
খবরের কাগজ বলছে রাজস্থানে নাকি মনু মহারাজ বা মনুস্মৃতির প্রণেতা মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপন করা হবে। তাঁকে দেখতে কেমন কেউ জানে না। কোথাও ছবিটবি দেখিনি। ইদানীং একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার হুজুক শুরু হয়েছে। সর্দার প্যাটেল, সাভারকর ,শ্যামাপ্রসাদ, নাথুরাম গডসে হয়ে গেছে। এবার আমাদের প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থের রচয়িতা মনুর পালা। যদিও দলিত সমুদায়ের বক্তব্য আমাদের সমাজে জাতপাতের ভাগাভাগি, ছোঁয়াছুঁয়ি এসব নাকি মনুস্মৃতিতে লিপিবদ্ধ, সেখান থেকে শুরু। তাই ওঁরা দেশের অদলাবদলি করে শাসন ক্ষমতায় থাকা বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোকে মনুবাদী পার্টি বলেন।
ইদানীং দলিতদের উপর অত্যাচার বেশ বেড়েছে।
অর্থাৎ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নামে যা খুশি বলাটা নিও-নর্মাল হয়ে গেছে। কারণ এর পৃষ্ঠপোষক হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা।
এর সামাজিক প্রতিফলন দেখছি বিশেষ করে তিনটে ব্যাপারে।
এক হলো খাদ্যাখাদ্য। ডাক্তার নয়, সরকার ঠিক করে দেবে আপনি কী খাবেন বা কী খাবেন না। শুধু তাই নয়, ফ্রীজে গোমাংস রাখা আছে এই সন্দেহে আদালতে না গিয়েই লোককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে।
দুই, নারীর কীসে ভালো তা অবলা কোমল ভারতীয় নারী বোঝে না। তার কেমন পোশাক পরা উচিত, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা চলাফেরা করা উচিৎ, কাকে বিয়ে করা উচিৎ নয়, সব ঠিক করে দেবে পুরুষের বা যুবকের দল, থুড়ি রাষ্ট্র। অর্থাৎ ভারতীয় নারী কোনওদিনই প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। তার বিয়ে তো ঠিক করে দেবে তার বাবা-মা। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য। কাজেই প্রাপ্তবয়স্ক চাকুরে মেয়ে যদি অন্যধর্মের ছেলেকে ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় বিয়ে করে তাহলে তার কথায় কান না দিয়ে তার বাবা-মা বা সমাজের কোনও অতি উৎসুক যুবকের তরফে ‘জোর করে ধর্মান্তরণ করা হচ্ছে’ অভিযোগ পেয়ে নতুন স্বামীকে জেলে পোরা যাবে। এটাই কয়েকটি রাজ্যে নতুন তৈরি ‘লাভ জিহাদ’ আইন।
তিন, দলিতদের ভারতীয় সমাজে ঠিক জায়গা কোথায়? আম্বেদকর কি হিন্দু ধর্মের দলিতদের প্রতি ক্রুরতার প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়ে যাননি? আম্বেদকর যে কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়েছিলেন, সে কি হিন্দু সমাজে দলিতদের প্রতি হয়ে চলা ক্রুরতার প্রতিবাদে?
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত মেয়েটিকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে হত্যা করার বীভৎস ঘটনাটিকে মেয়েটির মৃত্যুপূর্ব জবানবন্দী সত্ত্বেও যেভাবে সরকারি পুলিশ, ডাক্তার ও কিছু মিডিয়া মিলে মিথ্যে, এবং নিহতের পরিবারের ‘অনার কিলিং’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
তাহলে ভারতীয় বা হিন্দুসমাজের এই তিনটে বিষয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য কী? দেখুন, এখন আর একটি নতুন সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ হলো যাহা হিন্দু তাহাই ভারতীয়। বিশুদ্ধ বেদান্তদর্শন চর্চার সূত্রগ্রন্থে দেখছি বিভিন্ন মনু, গৌতম, পরাশর এবং যাজ্ঞবল্ক্য আদি বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকে উল্লেখ করে বলা হচ্ছে— শূদ্রের নেই বেদ পাঠে বা শ্রবণের অধিকার।1
আর মনুসংহিতায় নাকি আমাদের প্রাচীন আচার-বিচার, উচিত-অনুচিত মায় সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড সবই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমনকি কলোনিয়াল যুগে বৃটিশরা এ নিয়ে বেশি খোঁচাখুচি করেনি। তাই হিন্দু কোড বিল রচিত হয়েছিলো স্মৃতিশাস্ত্র বা সংহিতা বিশেষ করে মনুস্মৃতি মেনে।
--------------------------------
ব্রহ্মসূত্র; প্রথম ভাগ, ১/১/৩৮।
কেন? কারণ পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য ইত্যাদি অনেকগুলো সংহিতা থাকলেও মতভেদ হলে মনুর বিধানই বেদ-অনুসারী এবং মান্য বলে ধরা হয়।
“মন্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রশসস্যতে”। যার ব্যাখ্যা মনুর সাথে মেলেনা তা স্মৃতিশাস্ত্রের মর্যাদা পাবে না।
আবার ‘যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎক্বচিৎ’। অর্থাৎ যা এই বইয়ে আছে তা অন্য স্মৃতিগ্রন্থেও আছে, আর যা এতে নেই, বুঝতে হবে তা কোথাও নেই।
কাজেই রাজস্থানে মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপিত হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। মনুসংহিতাতে বাস্তবে কী বলা হয়েছে তা নিয়ে খতিয়ে না দেখেই বাজারে অনেক কথা বলা হয়।
দেখা যাক, সংহিতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুস্মৃতিতে বাস্তবে কী বিধান দেওয়া আছে।
বারোটি অধ্যায়ঃ
এতে রয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়।
প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। আরও বলা হয়েছে যে ব্রহ্মা এই শাস্ত্র মনুকে শিখিয়েছিলেন। (শ্লোক ১/৫৮)। মনু দশজন প্রজাপতি মহর্ষি (মরীচি, অত্রি, বশিষ্ঠ, নারদ, ভৃগু আদি)কে শিখিয়েছিলেন। এখন ভৃগু উপস্থিত জিজ্ঞাসু মহর্ষিদের শোনাচ্ছেন। (১/৫৯)।
এতে কী কী আছে?
প্রায় চল্লিশটির বেশি বিষয়ে এতে আলোচনা আছে। কিছু উল্লেখ করছি— পৃথিবীর উৎপত্তি, সংস্কারের নিয়ম, স্ত্রী সম্ভোগ, বিবাহের প্রকার, মহাযজ্ঞবিধি, শ্রাদ্ধবিধি, জীবিকা, খাদ্যাখাদ্য, সাক্ষীকে প্রশ্ন করার নিয়ম, স্ত্রীপুরুষের পারস্পরিক ধর্ম, মহাপাতক, উপপাতক, প্রায়শ্চিত্ত, দন্ডবিধি, সম্পত্তির নিয়ম, বর্ণসঙ্কর, বিভিন্ন বর্ণের আপদ্ধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম ইত্যাদি। (১/১১৮)।
এই তালিকাটি দেখুনঃ
--------------------------------------
2 মনুস্মৃতি, ডঃ রামচন্দ্র বর্মা শাস্ত্রী; পৃঃ ৯।
অধ্যায় ক্রমাংক বিষয়
১ সৃষ্টি থেকে প্রলয়
২ ভূগোল— আর্যাবর্ত, ইত্যাদি; ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে পালনীয় বিধি
৩ গার্হস্থ্য আশ্রম, আট প্রকার বিবাহ, কন্যার লক্ষণ, শ্রাদ্ধের নিয়ম
৪ গৃহস্থের আচারসংহিতা
৫ খাদ্যাখাদ্য বিচার, বেদবিহিত হিংসাকে অহিংসাকে মানা
৬ বানপ্রস্থের আচার আচরণ
৭ রাজার আচরণ; করব্যবস্থা, সাম-দান-ভেদ ও দন্ডের প্রয়োগ
৮ দন্ড বিধি (পেনাল এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড)
৯ স্ত্রীপুরুষ সম্পর্ক, উত্তরাধিকার, (সিভিল ও সিভিল প্রসিডিওর কোড)
১০ বর্ণাশ্রম ধর্ম, তাদের আচার-আচরণ বিধি
১১ নিয়মের অলঙ্ঘন করলে প্রায়শ্চিত্ত ও শাস্তি
১২ শরীর উৎপত্তি, স্বর্গ ও নরক গমন, ব্রহ্মবেত্তার লক্ষণ
এবার তিনটে কিস্তিতে মনুসংহিতা অনুযায়ী সমাজে শূদ্রের স্থান, নারীর স্থান ও খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে কথা বলবো। আমি চেষ্টা করবো এই স্বল্প পরিসরে মনুসংহিতার স্বরূপের বর্ণনা করে তিনটি ভাগে খাদ্যাখাদ্য, জাতিপ্রথা এবং নারীর অবস্থান নিয়ে উনি কি বলেছেন তা তুলে ধরতে। মনে হয় জাতিপ্রথা নিয়ে আগে কথা বলা উচিত। কারণ, ওটাই আমাদের সমাজের প্রাচীন কাঠামো। খাদ্যাখাদ্য বা নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে ওই কাঠামোকে মেনে।
[চলবে]