ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৮)
সুখমণি সমুদ্রের মুখে প্রস্তাবটা শুনে হাঁ হয়ে গেল। প্রকাশ পাখিরা দের দলের এত খারাপ অবস্থা শেষে সুখমণিকে আগামী পঞ্চায়েৎ ভোটে প্রার্থী করতে চায়। সুখমণির কাকা সনাতন কিস্কু লাল পার্টী করত বলে ওদের দল একদিন ওদের ভিটে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ও তখন ছোট। শোবার ঘর থেকে দেখা জ্বলন্ত আগুনের বিভীষিকা সুখমণি কখনো ভুলতে পারবে না। তারপর অনেকবছর ওরা গ্রামছাড়া হয়ে ছিল। পার্টী তখন বেআইনী। সুখমণির বাবা লালচাঁদ, নীলরতন জোয়ারদারের রাইস মিলে মজদুরী করত। বাবাকেও তখন ওরা ছাড়িয়ে দেয়। ওর বেশ মনে আছে হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে কাকা ওদের ঘরে এসে হাজির হত। গোটা দশেক পোড়া রুটি আর একখাবলা চিটে গুড় কাপড়ে বেঁধে একলাফে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। ওই ঘটনার কয়েকমাস পরে কাকার মুন্ডু বিহীন দেহটা কাঁকসাড়ের কালভার্টের ওপর পাওয়া গেছিল। রাজনৈতিক খুন বলে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়ে দিলেও প্রকাশ পাখিরাদের দল এই খুনে জড়িত ছিল সেটা সবাই জানত কিন্তু কেউ মুখে বলতে সাহস পেত না।
সেই দলের প্রার্থী হওয়ার আগে ওর মরণ হওয়াই ভাল। প্রকাশ খুব চালাকি করেছে। সমুদ্র এতসব জানবেনা বলেই ওঁকে দিয়ে টোপ ফেলেছে। ওর ঘরে এসে বলতে গেলে সুখমণি টাঙি দিয়ে বেজন্মাটার গলা নামিয়ে দিত।
"কি ঠিক করলে তুমি? আমি কিন্তু কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। তুমি যেটা ভাল বুঝবে তাই করবে। তবে কয়েকটা সুবিধা যে আছে সেটা আমি অস্বীকার করার মত অবস্থায় আজ আর নেই.."
"আপনি আপোস করতে বলছেন আমায়?" সুখমণি অবাক গলায় বলে ওঠে।
এ কোন কমরেড সমুদ্রকে সামনে দেখছে সে আজ। এই কি সেই সমুদ্র যে একদিন কৃষক বধূ লক্ষ্মীমণির ধর্ষণ আর হত্যাকে কেন্দ্র করে কাটিয়াজোতে প্রতিবাদ আন্দোলন করেছিল। আবার নিজের বিশ্বাসের সাথে দলের মতপার্থক্যের পরিমাণ বাড়তে থাকায় সেই পার্টির সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে দু'বার ভাবেনি...সেই একই মানুষ আজ প্রকাশ পাখিরার টোপ গিলতে সুখমণিকে প্রভাবিত করছে! সময়ের সাথে সাথে কোনো মানুষ এতটা বদলাতে পারে কখনো?
*********
মিসেস লোবোর ঘরে খাওয়াদাওয়া পর একচোট আড্ডা বসল। কত পুরনোদিনের কথা, বাবা মা'র বিয়ের পরে পরে এখানে বেড়াতে আসা, চাঁদাগিরি বেড়াতে যাওয়া, দাদার কথা সব ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। মিসেস লোবোর ইসকিমিক হার্টডিজিজ ধরা পড়েছে। পেসমেকার বসাতে হবে খুব শিগগির। ডাক্তার প্রকাশ জেনা সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। তবে তারজন্য ভুবনেশ্বর যেতে হবে। আর লোবো আন্টি কোত্থাও যেতে রাজি নন। মা এর হাত দুটো ধরে ছলছল চোখে বলল -
"রাধা, আমি মরে গেলে এই পাম গ্রোভসের তলায় আমায় কবর দিও। তোমায় রিক্যুয়েস্ট করে গেলাম। এই সমুদ্র আর বেলাভূমি ছেড়ে আমি অন্য কোথাও মরতে চাইনা...!"
শ্রীরাধা আলতো করে মিসেস লোবোর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল -
"কি যে বল সই! বুকে পেসমেকার বসালে কিচ্ছু হয়না! বরং তুমি আগের থেকে অনেকটা সুস্থ বোধ করবে। আমরা তো এখনো দিন সাতেক থাকবো। রিমির স্কুলে ছুটিও আছে। কাজেই এরমধ্যে তোমার এই ব্যাপারটা করে নেওয়াই যায় তাইনা! "
সাগরিকা বলল " দাঁড়াও! আমি আজই ডাক্তার জেনা'র সাথে কথা বলে নিচ্ছি। আর যোসেফ ভাইনার জীপটা নিলেই হয়ে যাবে! এত ভেবনা তো! তুমি কি একা নাকি? "
খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় লোবো আন্টির দুটো পুরনো ধূসর ছবির অ্যালবাম দেখবে বলে সাগরিকা চেয়ে নেয়।
********
নাচের সময়টুকু ছাড়া অন্য মন্দিরের সারাদিনের সময়গুলোর আয়তন খুব লম্বা ও একঘেয়ে। সকাল আর বিকেলে দু ঘন্টা নাচ শিখতে হয়। আর কখনো সখনো মন্দিরের সেবার কাজ যেমন মালাগাঁথা, বিরাটবিরাট দেওয়াল আর মেঝে পরিষ্কার করা এইসব। রুদ্রগণিকাদের মধ্যে যারা রঙ্গভোগিনী তাদের মূল কাজ হল নাচে গানে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা। একটু ভুল হলেই বড়া মঞ্চাম্মা খুব বকুনি দেয়।
অথচ গুড়িয়াম্মা কখনো কখনো ডেকে পাঠিয়ে এটা সেটা নানান গল্প করে। গুড়িয়াম্মা বছর সাতেক বয়স থেকেই বুঝতে পারে তার বাইরে খেলতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বরং মেয়েদের মত বুকে কাঁচুলি বেঁধে পুতুল খেলতেই সে ভালবাসত। গুড়িয়াম্মার এক দিদি ছিল মীনাক্ষী। তাকে ওর বাবা মা যমেশ্বর শিবের মন্দিরে দান করে দেয়। আর ওর মেয়েলী স্বভাবের জন্য কিন্নরদের দলে পাঁচ তঙ্কায় বেচে দেয়। এখন ওর বাবা সেই টাকায় দুটো গরু কিনেছে। খন্ডগিরির কাছে খারাবেল্লায় বাবা নাকি দুধের ব্যবসা করে। ওর মত নাচনেওয়ালী ছেলে নিয়ে তাদের আজ আর কোনও আগ্রহ নেই। গুড়িয়াম্মাও কিন্তু ওর মতো ছেলেবেলার গ্রাম, সঙ্গীসাথী, বাবা মা এদের কথা মনে করে কষ্ট পায়। ওদের সাথে আর দেখাই হবে না এ জীবনে আর কখনো।
যমেশ্বর মন্দিরের গুরুমা ওকে গুড়িয়াম্মা নাম দেয়। ওকে কিন্নর বানাতে গিয়ে ওরা 'ছিন্নি' বলে একটা শল্যচিকিৎসা করে ওর পুরুষত্ব চিরদিনের মত শেষ করে দিয়েছে। এতে অবশ্য গুড়িয়াম্মা নিজে খুব খুশী। পুরুষের অকারণের দেহচিহ্নটাকে আর বয়ে বেড়াতে হয়না। গুড়িয়াম্মা এখন কিন্নরী। তবে দুটো আফশোষ রয়ে গেছে তার জীবনে। কাপড়ের পুঁটলী দিয়ে বাঁধা বুকদুটোয় যেমন কখনো দুধ আসবেনা, নিজের পেটে নারীর মতন কখনো বাচ্চা ধরতে পারবেনা। তাই সেসব দুঃখ ভুলতে গুড়িয়াম্মা সাজগোজ, ঠমকচমক আর নাচগান নিয়ে মেতে থাকে। তবে মঞ্জীমাকে ও খুব ভালবাসে। মন্দিরের মেঠাই বা ফল এনে লুকিয়ে খাওয়ায়। মঞ্জীমাও গুড়িয়াম্মাকে একলা ঘরে চোখের জল ফেলতে দেখেছে। ওর খুব ইচ্ছে করে কখনো গুড়িয়াম্মাকে একবার ছুটে গিয়ে 'মা' এর মত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।