গল্প - মৌসুমী ঘোষ
Posted in গল্প(এক)
অফিস যাওয়ার আগে তমোঘ্নর ভীষণ তাড়া থাকে। ছোটাছুটি করে রেডি হবে তবু পাঁচ মিনিট আগে বিছানা ছাড়বে না। এই সময়টায় সুলগ্নারও নিঃশ্বাস ফেলবার সময় থাকে না। তমোঘ্নকে কখনও সুলগ্না আগের রাতের রেঁধে রাখা খাবার দেয় না। ব্রেকফাস্ট, অফিসের টিফিন সব সকালে উঠে রেডি করে দেয়। তমোঘ্ন অফিসে বের হলে তবে নিজে চা-জল মুখে দেয়। এ যেন মা-ঠাকুমার ঠাকুরকে জল দিয়ে খাবার মতো ব্যাপার। এই কথাটা ভেবে মনে মনে নিজেই একেকদিন হাসে। এক সময় মাকে কত বকাবকি করতো, ঠাকুরকে পুজো না দিয়ে মা জল-খাবার খেত না বলে। সুলগ্নাকে অবশ্য বকুনি দেওয়ার কেউ নেই। এমনকি তমোঘ্নও কখনও জিজ্ঞেস করে না— সুলগ্না খেয়েছে কিনা। যদিও তমোঘ্নকে সুলগ্না বহুবার আড়েঠারে বলেছে তার সকালে আর সন্ধ্যেতে চা না খেলে মাথা ধরে যায়।
তমোঘ্নকে টিফিন, রুমাল, মানিব্যাগ, টাই, মোজা, ঘড়ি এগিয়ে দিয়ে নিজের জন্য চা টা আনতে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আগেই খেয়াল করলো তমোঘ্নর অস্বাভাবিক ভাবটা। রোজকার মতো রেডি হয়ে সুলগ্নার হাত থেকে রিস্ট-ওয়াচটা নিয়ে নিজের কব্জিতে চেপে ধরা মাত্র এক চক্কর খেয়েছিলো তমোঘ্নর মাথাটা। নিজেকে সামলে ঘড়ির ছোটো কাঁটা দশটার ঘরে দেখে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝে গেলো হাত-ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। ধপ্ করে বসে পড়লো পাশের টুলটায়।
‘ব্যাটারি পাল্টাতে হবে মনে হয়।’
‘না, ব্যাটারি ফুরালে প্রথমে স্লো চলে কয়েকদিন। আমি কাল অফিস থেকে ফিরে ঘড়িটা খোলার সময়ও সময় মিলিয়েছি, কাঁটায় কাঁটায় সাতটাই বাজছিলো তখন।’
সুলগ্না এই দু’বছরে জেনে গেছে তমোঘ্নর সময়-জ্ঞান মারাত্মক। ছ’টা মানে ডট ছ’টা।
‘এটা তোমার মাধ্যমিকের টেস্টের পর তোমার বাবা তোমায় কিনে দিয়েছিলেন, তাই তো!’
‘শুধু মাধ্যমিক কেন তারপর থেকে প্রতিটা পরীক্ষাতেই এই ঘড়ি কব্জিতে বেঁধে চড়কিপাক খাইয়েছি সময়কে। তবেই না ছুঁতে পেরেছি স্বপ্নকে।’ তমোঘ্নর গলার আওয়াজ ফ্ল্যাটের জানলা ছাড়িয়ে আশেপাশের হাইরাইজ ফ্ল্যাটগুলোয় ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।
সুলগ্না বুঝতে পারলো তমোঘ্ন অনেকদিন বাদে স্মৃতির ঝাঁপি খুলছে। এই অমূল্য স্মৃতিটাতে ভাগ বসানোর সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইলো না। তমোঘ্ন ঘড়িটা ডাইনিং-এর শোকেসে রেখে দিলো। সুলগ্না সময় নষ্ট না করে ঘড়িটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললো, ‘তুমি কি ঘড়িটা রাতে শোবার সময়ও খুলতে না?’
‘মানে!’
‘না আসলে তোমার কব্জিতে এই ঘড়িটার জন্য একটা পার্মানেন্ট সাদা দাগ পরে গেছে সেটা খেয়াল করেছো?’
‘হোস্টেলে যখন রাত জেগে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম তখন সারাক্ষণ এই ঘড়িই আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে, তাড়া দিয়েছে, মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার স্বপ্নের কথা, বারবার।’
সুলগ্না বুঝতে পারলো দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা তমোঘ্নর অফিস বেড়োনোর সময়কে পার করে ছুটে চলেছে। তমোঘ্ন আর যাই করুক দেরিতে অফিস যাবে না। কথাটা ভেবে খুশিতে হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো রিস্ট-ওয়াচটাকে। তমোঘ্নর কাছে নিজের খুশিটা লুকাতে জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকালো, বহুতলের ওপরের আকাশ দেখতে পেলো।
‘পরে বহু ঘড়ি দেখে পছন্দ হয়েছে, কিনতেও গেছি, কিন্তু কোনওটাকে ছোটো ডায়ালের জন্য কোনওটাকে সরু স্ট্র্যাপের জন্য নাকোচ করেছি। পুরোনো সময়ে ডায়াল আর স্ট্র্যাপ দুই বড়ো ও মোটা ছিলো তো। তাছাড়া এটা কখনও বেঠিক সময় দিতে শুরু করেনি এর আগে।’
‘এটা তোমার বাবার আশীর্বাদ।’
‘একি যাঃ! আজ আর অফিস যাওয়াই হলো না ঘড়ি ঘড়ি করে।’ বলেই জুতো মোজা খুলে সু-কেসে রেখে টাই খুলতে শুরু করে দিলো তমোঘ্ন।
সুলগ্না রান্না ঘরে গিয়ে দু’জনের চায়ের জন্য দুধ আর জল দিলো ইলেক্ট্রিক কেটলিতে। তমোঘ্নর স্মৃতিগুলোকে আজ সে কিছুতেই জানলার বাইরে যেতে দেবে না ঠিক করলো।
বিয়ের পর পরই সেক্টর ফাইভের কাছাকাছি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে চলে আসা। তমোঘ্নর উচ্চাশা ছুঁতে স্কাই টাচিং ফ্ল্যাটের কমিউনিটি হলে মাসে একটা করে পার্টি অ্যারেঞ্জ করা। মাঝে মাঝেই অফিস ট্যুরে তমোঘ্নর সাথে হিল্লি-দিল্লি যাওয়া। এসব উচ্চবিত্তের সংস্কৃতি দু’বছর ধরে সুলগ্নাকে গভীরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। সেখান থেকে কীভাবে ভেসে উঠবে তার সরু পথ যেন আজ দেখতে পেয়ে গেলো সুলগ্না।
অসময়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেও না করলো না তমোঘ্ন। টেবিলে নিজের ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বসে গেছে ঘড়িটা খুলতে। সুলগ্না পাশের জানলাটা খুলে দিতে প্রচুর আলো এসে পড়লো তমোঘ্নর গায়ে। তমোঘ্ন আলোর উৎসের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মনোযোগ দিলো ঘড়ির দিকে। সুলগ্না দেখলো সেই আলোয় তমোঘ্নর সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ভেসে যাচ্ছে।
‘এক যুগ আগের কথা মনে আছে তোমার!’ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সুলগ্না বললো।
‘সেদিন ছিলো আমার জন্মদিন। বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় ঘড়িটা কিনে এনে আমায় দিয়েছিলো। জন্মদিনে সেই প্রথম উপহার। বাবা অবশ্য বলেছিলো, মাধ্যমিকের জন্য কিনে দিলাম। ঘড়ি দেখে সময় ধরে উত্তর লেখা অভ্যাস কর এখন থেকে।’
মাথা নিচু করে ঘড়িটা চোখের কাছে এনে সন্না দিয়ে ঘড়ির ভিতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টসগুলো নাড়াচাড়া করছিলো তমোঘ্ন। আর সুলগ্না তমোঘ্নর কব্জির সাদা দাগটা দেখছিলো এক দৃষ্টে। সে মনে মনে ঠিক করলো, ওটা সে কিছুতেই মুছে যেতে দেবে না। ওটাই ওর নতুন জীবনের আশ্চর্য-জানলা।
‘যাবে একবার পুরুলিয়াতে?’
‘গেলেই হয় এই উইকেন্ডে।’
‘সত্যি! এই উইকেন্ডে!’
মনে মনে লাফিয়ে উঠলো সুলগ্না। ছুটি মানেই বিদেশে বেড়াতে যাওয়া। উইকেন্ড মানেই শপিং কিংবা পার্টি। হাঁপিয়ে উঠেছে পলাশের দেশের মেয়ে সুলগ্না। জড়িয়ে ধরলো তমোঘ্নকে। তমোঘ্নও জড়িয়ে ধরে কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখিয়ে বললো, ‘অন্যের কোম্পানি ছেড়ে এবার নিজে কোম্পানি খোলার সময় এসে গেছে। আমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র এরা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। আর না। উইকেন্ডে বাড়ি গিয়ে কাকার কাছে আমার অংশের জমিটা চেয়ে নেবো। সেখানেই কারখানা হবে। গ্রামের কিছু চেনা মানুষকে কাজ তো দিতে পারবো।’
জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই সুলগ্না অন্য দিনের মতোই তখনও আকাশের বুকে মেঘেদের আড়মোড়া ভাঙা শেষ হয়নি দেখলো। এত ওপর থেকে জানলা দিয়ে আকাশ দেখলে দু’বছর বাদেও আশ্চর্য লাগে সুলগ্নার। কিন্তু কেন যে আশ্চর্য লাগে তা জানে না। সুলগ্না এখন বুঝে গেছে, পৃথিবীতে এখনও কিছু আশ্চর্য আছে যা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে সারাজীবন কেটে যায়। কিন্তু যতদিন না সে নিজে ধরা দেয় ততদিন বোঝাই যায় না সেই আশ্চর্যের মহিমা।
(দুই)
বসন্ত শেষ হয়ে এসেছিলো। তবু রাস্তার দু’পাশের লালে লাল পলাশগাছগুলো অনেক দূর থেকেও চোখে পড়ছিলো। তমোঘ্নর পাশের সীটে বসে সুলগ্না স্টিয়ারিং-এর ওপর তমোঘ্নর রিস্ট-ওয়াচ বাঁধা হাতটা বারে বারে লক্ষ্য করছিলো। কিন্তু রিস্ট-ওয়াচটার স্ট্যাপের বা ডায়ালের ফাঁক দিয়ে চামড়ায় থেকে যাওয়া সাদা দাগটার চিহ্নমাত্র দেখতে পেলো না সুলগ্না। রিস্ট ওয়াচটা যেন কর্ণের কবজের মতো তমোঘ্নের কব্জিতেও জন্মগত উপহার।
কোম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে দেবে তমোঘ্ন। এখন শুধু গ্রামে ফিরে কাকার কাছ থেকে কারখানার জন্য জমিটা রেজিস্ট্রির অপেক্ষা। শেষ মিটিং-এ রেজিগনেশন জমা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলো। কেউ আপত্তি করেনি। তাহলে কি কোম্পানিতে ওর কোনওই গুরুত্ব ছিলো না! সেকথা ভাবতে ভাবতে গোটা পথটায় বেশ কয়েকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে তমোঘ্ন। তবে এই কোম্পানির সি ই ও থাকাকালীন ওর বিদেশের কানেকশানটা জোরালো হয়েছে। নিজে প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে ওকে কোনওই বেগ পেতে হবে না এ ব্যাপারে তমোঘ্ন আশাবাদী। তবু এই কোম্পানিতে রেজিগনেশন দিলে ওকে কোম্পানি থেকে দেওয়া সুযোগ সুবিধাগুলোও ছাড়তে হবে সেকথা ভেবে আগে বহুবার কারখানা চালু করবে ঠিক করেও পিছিয়ে এসেছে সে। আসলে অনেক অনেক দিন ধরে যখন রোদে-হাওয়ায় পাকা একটি বৃন্তচ্যুত কাজুবাদামকে যেভাবে জারিত করা হয় সেইভাবে জারিত হয়ে যায় জীবন, তখন সেই জীবন ছেড়ে আসা বড়োই কষ্টের। যদিও ওর এবারের ভাবনা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে সময়ের নিরীখে। ফোনে কাকার সাথে জমি সংক্রান্ত সব ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়েই ছিলো।
রাস্তার দু’পাশে যেখানে যেখানে বসতি সেখানে সেখানে অনেক চাষাভুষো মানুষকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখলো সুলগ্না। যদিও তাদের জীবন-যাপনের কষ্ট এ সি গাড়ির জানলার কাঁচ ভেদ করে ওদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিলো না। গ্রামের পথ ধরতেই তমোঘ্ন এসি-টা অফ করে সুইচ টিপে গাড়ির কাঁচগুলো নামিয়ে দিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রাণ ভরে হাওয়া নিতে লাগলো। সুলগ্না নিজের হাতটা দিয়ে তমোঘ্নর রিস্ট-ওয়াচ পরা কব্জিটা ধরে মনে মনে ভাবলো— সঠিক সময় সঠিক অনুঘটকের ভূমিকা বোঝার জন্য মনের আশ্চর্য জানলা উন্মুক্ত রাখতে হয়। কারণ প্রতিটা কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করাই থাকে মহাসময়ের বুকে।