Next
Previous
0

গল্প - সৌমিত্র চৌধুরী

Posted in

 




















একই সময় ঘুম ভাঙলো। স্বল্প মায়াবী আলোয় ভরে আছে ঘর। নজরে এল উপর-নীচ সরল রেখায় ঘড়ির কাঁটা। সকাল ছ’টা। নভেম্বর গতকাল বিদায় নিয়েছে। হাল্কা শীতের আমেজ। কম্বলটা সরিয়ে উঠে বসলেন গোকুল বাবু। পাশে তখনও গোলাপি বালাপোষের ভিতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন বন্দনা।

অন্যদিন এ সময় চা বানিয়ে ডাক দেন বন্দনা। আজ সে সবের বালাই নেই। ওর উঠবার কোনও তাড়াই নেই। অবশ্য গোকুল বাবুরও অফিস যাওয়া নেই। একেবারে অন্য রকম দিন। কথাগুলো মাথার মধ্যে ভুরভুরি কাটতেই ব্যথার একটা শিরশিরানি গলা বুক হয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায় অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন সদা ব্যস্ত গোকুল চন্দ। বুক নিঙড়ানো গভীর একটা শ্বাস ফেলে বন্দনার পিঠে ঠ্যালা মারলেন, ‘চা করবে না?’

বাচ্চা মেয়ের মতো ‘উঃ আঃ’ শব্দ তুলে পাশ ফিরলেন বন্দনা। ঘুম জড়ানো আদুরে স্বর, ‘আজ তুমি চা করো।’ দুটো গোল হয়ে গেলো গোকুল বাবুর। কপালে ভাঁজ। মাঝেমধ্যে যে রান্না ঘরে যাননি তা নয়। অনেক সময়ই রবিবার বা ছুটিছাটায় চা-কফি বানিয়েছেন। কখনও রিনি-বুম্বার আব্দার মেটাতে চালু পত্রিকায় ছাপানো রেসিপি মিলিয়ে সাম্মি কাবাব কিম্বা ভেটকি মাছের পাটিসাপ্টা বানিয়েছেন। তা বলে আজ সকাল হতে না হতেই রান্না ঘরে ঢুকতে হবে?

একরাশ প্রতিবাদ খলবল করে উঠলো গোকুল বাবুর বুকের মাঝখানটায়। কিন্তু প্রতিবাদ ঝগড়া করা ওঁর ধাতে নেই। হাড়ে হাড়ে জানেন বেফাঁস কিছু বলে ফেললে বা কথার অমত হলে বন্দনার ধারালো জিভ একেবারে ফালা ফালা করে দেবে।

একটু ভাবলেন গোকুল চন্দ। একেবারে আধুনিক অডিটের দর্শন— গভীরভাবে নিজের কাজ, কর্ম পদ্ধতি বিচার করো। গেন ইনসাইট অন ওন অ্যাক্টিভিটিস। বন্দনার মুখের কয়েকটা তো মামুলি শব্দ! সেটাই কেমন করে গতকাল অবধি অফিসের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসা রাশভারী অ্যকাউনট্যান্ট, সম্মানীয় জিসির আঁতে আজ মোক্ষম ঘা মাড়লো? আঘাতটা বুকে টনটন করছে। তার মধ্যে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি ছড়ালো একটা কথা। অফিসের বিলিং সেকশনের এক পুরানো সহকর্মী শৈবালদার উপদেশ। ঝপ করে মনে পড়ে গেলো। ‘আর যাই করো, অবসরের পর রান্না ঘরে কক্ষনো ঢুকবে না। ভুল করে যদি একবার ঢুকেছো ভায়া, আমার মতো বাকি জীবনটা নিঃশব্দ বন্দী দশায় ছটফট করবে।’

নিদ্রার নিশ্চিত আশ্রয়ে অনড় নিঃশব্দ বন্দনার দিকে চোখ রেখে বড়ো একটা শ্বাস ফেললেন। নেশা ত্যাগের বাসনায় দোনোমোনো মাতালের অবস্থা! শেষমেশ তরলটা গলায় ঢালার মতো দোটানায় আরও কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে হেরে গেলেন গোকুল বাবু। শয্যা ত্যাগে বাধ্য হলেন। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি সাজিয়েও বুকের চিনচিনে ব্যাথা কমাতে পারলেন না। অগত্যা আঘাত চেপে ব্যাজার মুখে রান্না ঘরে ঢুকলেন। সসপ্যানে গুনে গুনে দু’কাপ জল চাপালেন।

সময় মতো চা পেটে না পড়লে দিনের পরবর্তি কাজগুলো ঠিকঠাক হবে না। কাজ অনেক, সময় মতো শেষ করতে হবে। অফিস না থাকলেও সারা দিনে বাড়ির অনেক কাজ। দু’দিন আগেই গুছিয়ে নিয়েছেন। আজ আধ ঘণ্টার যোগব্যায়াম সেরে মাঠে একটু হেঁটে বাজার। তারপর বুম্বার সাথে অঙ্কের অধ্যাপকের বাড়ি। অধ্যাপককে অনুরোধ করতে হবে বছরের মাঝখানে পড়ানোর জন্য। কেমিস্ট্রি অনার্সের পড়ার চাপে বুম্বা অঙ্কে পিছিয়ে পড়েছে।

বুম্বার পর রিনি। দুপুর বেলা ওকে নিয়ে যেতে হবে ব্লেজার কিনতে। বুম্বার মতো পড়াশোনায় ভালো না হলেও রিনি খেলাধুলায় তুখোড়। গত বছর কলেজ স্পোর্টসের চাম্পিয়ান। রাজ্য ভলিবল দলেও আগামী বছর সম্ভবত খেলবে। এবার কলেজ স্পোর্টসের মার্চপাস্টে ওর ব্লেজার পরা বাধ্যতামূলক।

ব্লেজার কিনে বাড়ি। তারপর সন্ধ্যা বেলা বন্দনার চোখের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা। এত দিন ছেলে-মেয়ে-বন্দনা পরিবারের কাউকেই সময় দিতে পারেননি। ভাবছিলেন গোকুল বাবু। নাকে মুখে খাবার গুঁজে পিপুলপাতি থেকে হেঁটে খেয়া ঘাটে যাবার তাড়া নেই। ছুট লাগিয়ে আটটা বিয়াল্লিশের নৈহাটি লোকাল ধরতে হবে না।

উনত্রিশ বছর একই অফিসের বিভিন্ন বিভাগের কাজে হাত পাকিয়ে অভিজ্ঞতার রসে টাইটম্বুর হয়ে গতকাল অবসর নিয়েছেন গোকুল বাবু। সরকারি নিয়ম নীতি! জীবনের রেল গাড়িটাকে যেই ড্রাইভার ষাট নম্বর প্ল্যাটফর্মে থামালেন, ওমনি ডিউটি খতম। অন্য লোকের হাতে চাবি তুলে দিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে এক বুক দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফেরা।

গোকুল বাবু সেকসনের জুনিয়র একাউন্ট্যান্টের হাতে দুটো আলমারির চাবি তুলে দিয়ে যন্ত্রের মতো কয়েকটা সই সাবুদ সেরে কর্ম জীবনের ইতি টানলেন। টানতেই হলো। কাজের চাপে কখন যে সময়টা এসে গেলো ঠিক খেয়াল ছিলো না। আজ অফিস এবং বাইরের অনেকেই দেখা করতে আসছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডের চেকটা নিজের হাতে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসবার পরেই মিত্র-ঘোষ কোম্পানির মলয় শঙ্কর ঘোষ দেখা করতে এলেন। ঘুসুরির ঘিঞ্জি নস্কর পাড়ায় ওঁদের খুব নাম ডাক। পুরানো এক লুব্রিকেটিং ষ্টোরের মালিক। গত মাসেও মলয়বাবু এসেছেন। গোকুল বাবুকে ওনার কোম্পানির হিসাব-পত্র দেখভাল করতে বহুবার অনুরোধ করেছেন। আজকেও বললেন সেই কথা।

গোকুল বাবুর একই উত্তর, ‘এত দিন পরিবারকে একদম সময় দিইনি। ছেলে-মেয়ের দিকে তাকাবার ফুরসৎ পাইনি। এবার ওদের জন্য করবো। পুরো সময় ওদের দেবো।’

মলয়বাবু শুভেচ্ছা জানিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘গোকুল বাবু, এত সুন্দর স্বাস্থ্য আপনার। ভালো কাজ জানেন। আমার অনুরোধ বাড়িতে বসে থাকবেন না। অনেক অফিস আপনাকে চাইবে। একবার যদি আমার কোম্পানির অডিট, হিসাব-নিকাষটা দেখতেন! লাভের গুড় যে কোথায় চলে যাচ্ছে? আমার ফোন নম্বর, ফ্যাক্স, ই-মেল সবই দেওয়া আচ্ছে। যেদিন ইচ্ছে হবে যোগাযোগ করবেন, আমার কোম্পানির দরজা আপনার জন্য খোলা।’

তিনটে বাজতেই ডাক শুরু হলো। নির্দেশকের সশ্রদ্ধ আহ্বানে বিদায় সভার মধ্যমণি হয়ে বসলেন গোকুল বাবু। সভায় প্রথমেই মুখ্য বাস্তুকারের বক্তৃতা। বললেন, ‘গোকুল বাবু আমাদের গর্ব। এ বয়সেও ওঁর টানটান শরীর। তীক্ষ্ণ স্মৃতি শক্তি। ঈর্ষনীয় ওঁর হজম শক্তি আর কর্ম দক্ষতা। অবসরের আগের দিনও আমার অনুরোধে সকাল সন্ধ্যা ঘাড় গুঁজে কাজ করেছেন। বর্তমান অফিসের তামাদি হয়ে যাওয়া একটা প্রোজেক্টের লাভ লোকসানের হিসাব মিলিয়েছেন। পাতার পর পাতা সাদা কাগজে হিসাব কষা, তারপর কম্পিউটরে পাকাপোক্ত টাইপ। লেজার বুকে পোষ্ট করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছেন। এইরকম আদর্শ সরকারী কর্মচারী আমি জীবনে দেখিনি। আমি ওঁর দীর্ঘ সুস্থ জীবন কামনা করি।’

এরপর বড়োবাবু কান্না কান্না গলায় বললেন, ‘বিপদ-আপদে উপদেশ নেবার মতো সৎ অফিসার গোকুল বাবু। আমাদের প্রিয় জিসি। তাঁর অবসর আমাকে ব্যথিত করছে। যদিও জানি এই অবসর বিচ্ছেদ নয়। ইমেল বা টেলিফোনে আমাদের যোগাযোগ অটুট থাকবে। আরেকটা কথা। সফল একাউন্ট্যান্ট হিসাবে উনি চাইলে আগামিকাল থেকেই নতুন চাকরীতে যোগ দিতে পারেন।’

অনেকেই তারপর ভাষণ দিলেন। ডিরেক্টরও বহু প্রশস্তি এবং বিশেষণে গোকুলবাবুকে ভরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি ওঁর পুনর্নিয়োগের জন্য হেড অফিসে আবেদন করেছিলাম। অনেক তদ্বির করা সত্ত্বেও আজ অবধি কোনও উত্তর পাইনি।’

অবশ্য গোকুল বাবুর কোনও দুঃখ নেই তাতে। সভার শেষে বললেন, ‘এই অফিস থেকে অনেক পেলাম। কোনও দুঃখ অভিমান অভিযোগ নেই। এবার থেকে আমি পরিবারকে সময় দেবো। আমার ছেলে মেয়ে এখনও দাঁড়ায়নি। বাড়িতে আমার অনেক কাজ।’

অনেক সুখ্যাতি আর সম্বর্ধনার সঙ্গে সমস্ত সেকশন থেকেই প্রচুর উপহার পেলেন গোকুলবাবু। তারপর জীবনে প্রথমবার অফিসের গাড়িতে চেপে বাড়ি ফেরা। গলির মোড় থেকে বাড়ির দিকে হাঁটছেন। ড্রাইভারের হাতে ফুলের বোকে আর উপহারের জাব্দা প্যাকেট। পাশের বাড়ির বিপুল সামন্ত, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, জোড়াসাঁকো থানার জাঁদরেল ওসি লাঠি-ঠোকা সান্ধ্য ভ্রমণ থামিয়ে বাতিস্তম্ভের নীচে একটু ঝুঁকে বললেন, ‘কিহে গোকুল তোমার হয়ে গেলো! শুধু লড়াই আর কাজ, গ্রুপ ডি থেকে একাউন্টস অফিসার। একি সামান্য কথা! জীবনের গাড়িটা দুর্দান্ত গতিতে চালিয়েছো। যাক, এবার বিশ্রাম নাও। কাল থেকে পার্কে এসো কিন্তু।’

সাধারণ কথা কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মাথা নেড়ে বাড়িতে এলেন। ঢুকেই আরও মন খারাপ। বন্দনা রিনি বুম্বা সবাই বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে। আলোকিত হাজার বর্গ ফুটের সংসার বিষাদে ম্লান। গোকুল বাবুর সপ্রতিভ মুখে ঘনিয়েছে বিষণ্ণতার কালো ছায়া।

কালকের জমাট বাঁধা মন খারাপ আজ খানিকটা ফিকে। অফিসে যাওয়া নেই। আজ থেকে বাড়ির কাজ। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর প্রতি যত্ন নেওয়া। এসব ভাবতে ভাবতে অফিস পাড়া থেকে কেনা এক চামচ চা পাতা সসপ্যানের গরম জলে ছেড়ে দিয়ে ঢাকা চাপালেন। পাশের ঘরে ঘুমন্ত রিনিকে একবার দেখে এলেন। একটু পরে কোণের ঘরের পর্দা সরিয়ে বিছানায় পাঠরত বুম্বাকে বললেন ‘কী রে, কখন উঠলি?’

ততক্ষণে চোখ মুখ ধুয়ে বন্দনা চায়ের টেবিলে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে দুটো চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বাজার যাবে তো?’

— একটু তৈরি হতে দাও। মাঠে দু’পাক হেঁটে বাজারে যাব। ফিরে এসে গুছিয়ে কাগজ পড়া তারপর বুম্বার সাথে ওর স্যারের বাড়ি।

— ঠিক আছে। আজ তো তাড়া নেই।

— শোনো, আরেকটা কথা ভাবছি। চলো, সামনের মাসে সবাই মিলে আন্দামান ঘুরে আসি।

— কী করে হবে? রিনির সেকেন্ড সেমিস্টার জানুয়ারিতে। মার্চে বুম্বার ফাইনাল।

গম্ভীর মুখে চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে উঠে পড়লেন গোকুল বাবু। তারপর ধীরে সুস্থে বাজার। সকালের কুয়াশা ঢাকা শীতের বাজারটা যেন একটা প্রকৃতি পাঠ। অজস্র সব্জী ঢেলে বিকোচ্ছে বাজারে। শুধু ফুলকপিই কত রকমের। আর বেগুন? কোথাও ছিপছিপে তরুণ, কোথাও পালোয়ানের নধর কান্তি। নরম রোদ পিছলে যায় কোমল অবয়বে। এসব আগে চোখে পড়েনি। আজ তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখলেন। পার্শে মাছের কালচে পিঠ, বুকের কাছটা সাদা, চোখ ছোটো। বুম্বার প্রিয় মাছ। রিনি আর বন্দনার জন্য কিনলেন পাবদা। মাঝারি মাপ, উজ্জল গোলাপি ঠোঁট।

শোবার ঘরে আধশোয়া গোকুল বাবু কাগজ পড়ছিলেন। ছ’নম্বর জাতীয় সড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাঁদিকের মোড় থেকে আসা একটা ট্রাকের সাথে যাত্রী বোঝাই গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। গাড়িটা পাল্টি খেয়ে খাদে পড়েছে। বহু লোকের হতাহতের খবর ছেপেছে। তদন্তকারী অফিসার আক্ষেপ করেছেন। ‘গতি কমিয়ে যদি ব্রেক কষতো, গাড়িটা থামতো। অত স্পীডে কি ব্রেক ধরে?’ খবরটা পড়ছিলেন নিবিষ্ট মনে। ঠিক তখনই ঘর মুছতে এসে পুস্প দু’পা পিছিয়ে গেলো। ‘ও বৌদি, আজ দাদা বাড়িতে? রিটার হয়ে গেলো নাকি দাদার?’ কাগজটা ভাঁজ করতে করতে মনে মনে গোকুল বাবু বললেন, ‘রিটার হলো কি না হলো তাতে তোর কী রে? নিজের কাজটা ঠিক করে কর।’

দিনের কাজ শুরু করবার আগে অফিসে পৌঁছে এসময় চা খাবার অভ্যাস গোকুল বাবুর। গতকালও কাগজের কাপে ক্যান্টিনের চা খেয়েছেন। আজ চায়ের জন্য মনটা বড্ড আনচান করে উঠলো। আবেদন শুনে বন্দনা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে বললেন, ‘খালি পেটে চা পাবে না। ব্রেকফাস্ট করে নাও। তারপর দেখছি।’

বন্দনার ডাকে খাবার টেবিলে এলেন গোকুল বাবু। রিনি বুম্বাও খেতে এসেছে। অন্য দিন এর অনেক আগে একা ভাত খেয়ে দৌড় ঝাঁপ করে ট্রেনে উঠে পড়েন। আজ সবার সাথে টেবিলে বসা। গোটা পরিবার কবে যে একসাথে খাবার খেয়েছে মনে করতে পারলেন না গোকুল বাবু। খাওয়া শেষ করে বুম্বার দিকে তাকালেন,

— ক’টায় তোর স্যারের বাড়ি যাব বল তো?

— বাবা, বলতে ভুলে গেছি। কাল স্যারের সাথে কথা বলেছি। ইউনিয়নের রবিদা সঙ্গে ছিলো। স্যার পড়াতে রাজি হয়েছেন। তুমি আটশো টাকা দিও। মাসের প্রথমেই স্যারকে দিতে হবে।

মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে রিনি বললো, ‘বাবা, কলেজ থেকে ব্লেজার বানাবার অর্ডার যাবে। আমি গতকাল মাপ দিয়েছি। তুমি আমার হাতে টাকা দিয়ে দিও। বারশো’ লাগবে।’

অবাক দৃষ্টিতে রিনির মুখের দিকে তাকালেন গোকুল বাবু। কত বড়ো হয়ে গেছে মেয়েটা। কয়েক বছর আগেও অফিসে যাবার সময় দু’হাতে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতো মেয়েটা। বলতো, ‘আজ তোমাকে বাইরে যেতে দেবো না। আমার সাথে খেলতেই হবে।’

ঘরে এসে ছেলে আর মেয়েকে দেওয়ার জন্য টাকা গুনছিলেন গোকুল বাবু। ওরা দু’জন বেরিয়ে যাবার পরই ডিঙ ডং শব্দ তুলে কোনও অতিথি ঢুকলেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার নজরে এল। উপর তলার রাস্তামুখি ফ্ল্যাটের মিসেস স্যান্যাল হাসিমুখে সোফায় এসে বসলেন। পাশে বন্দনা।

নিজের সাথে কথা বললেন গোকুল বাবু্। আমার উপস্থিতি ওদের প্রাত্যহিক আড্ডায় নিশ্চয় ব্যাঘাত ঘটাবে। তারপর বিছানায় বাবু হয়ে নিঃশব্দে বসলেন। ভিতরে কেমন একটা অস্থিরতা। বুকটা জোরে ধক ধক করে উঠলো। ভয় পেয়ে টানটান শুয়ে পড়লেন। অবসরপ্রাপ্ত স্টেনোগ্রাফার পলু বাবুর কথা মনে পড়লো। শরীর স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো ভদ্রলোকের। কি যে হলো! অবসরের পরদিনই স্ট্রোক। প্রাণে বাঁচলেন কিন্তু বাঁদিকটা পড়ে গেলো। নিজের বুকের বাঁদিকে ধীরে ধীরে হাত বুলালেন গোকুলবাবু। কয়েকটা গভীর শ্বাস ছাড়বার পর একটু সুস্থ বোধ করলেন। দু’চোখে ঘুম নেমে আসছে। চোখ বন্ধ। টানটান শুয়ে থাকলেন।

কিন্তু অনভ্যস্ত দিবানিদ্রা ঠিকঠাক জমলোনা। রাস্তায় মাইক বাজিয়ে হকারের হাঁকডাক, রিক্সার ক্রমাগত প্যাঁপু, ড্রইং রুম থেকে মিসেস সান্যাল আর বন্দনার সম্মিলিত খিল খিল হাসি কানে আসছিলো।

গতকালের পাওয়া উপহারের চকচকে বইগুলো সাইড টেবিলে সাজানো ছিলো। প্রথম বইটা হাতে নিলেন গোকুলবাবু। সুন্দর বাঁধানো কবিতার বই। মনে পড়লো কলেজ জীবনে কবিতা লিখতেন। বিপ্লব, সমাজ বদল বা প্রেমের কবিতা। চাকরির প্রথম দিকেও পত্র–পত্রিকা পড়তেন। অথচ গত পঁচিশ বছর কবিতা পড়েননি কোনও। শুধু কাজ, বাড়ি আর অফিস। উন্নতি প্রমোশন ডিএ ব্যাঙ্ক লোন ভিন্ন জগৎ নেই। আজ অনেকটা মুক্ত। অফিসের প্রকাশনা বিভাগ থেকে তিনটে কবিতার বই পেয়েছেন। প্রুফ রিডার বসন্ত সাঁতরা উঠতি কবি। ওরই পছন্দের তিনটে বই। বসন্ত উপহার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলো, ‘দাদা পড়বেন। কবিতা পড়লে মন স্থিতু হয়। দুঃখ পালিয়ে যায়। কবিতার একটা বই টেনে নিলেন। প্রথম কবিতাটা পড়ে কিছু বুঝতে পারলেন না। পরেরটা পড়তে গিয়ে মনোযোগে বাধা পড়লো। উচ্চকিত কথা বলতে বলতে রিনি কলেজে বেরিয়ে গেলো। হয়তো মনে পড়লো না ওর বাবা আজ বাড়িতে।

এক কাপ চায়ের জন্য ভিতরটা আনচান করলো। কিন্তু বন্দনাকে ডাকলেন না, পাছে ওদের জমাট আড্ডাটা ভেঙে যায়। বইয়ের পাতা উল্টে এবার কবির নামটা পড়লেন, শঙ্খ ঘোষ। পরের কবিতাটা পড়লেন, ‘কথায় ভরে গিয়েছে সংসার/ সেখানে আজ আমার নেই ঠাঁই/ তুমি তোমার পাথর ভাঙা কোণে/ থাকতে দেবে? জরির রোশনাই ...।’

‘পাথর ভাঙা কোণ?’ সেটা কী? ভাবছিলেন গোকুল বাবু। এর মানে কি ধুলো আবর্জনা জঞ্জাল? চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠলো একটা পাথর ভাঙা কোণ। আবর্জনার স্তুপে ভরা ঘুসুরির শিল্পাঞ্চল। সালকিয়ার দূষণ। নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, একবার কি ফোন করবো ঘুসুরির ঘোষ বাবুকে? হাওড়ার মেয়ে বন্দনা জানলে চিৎকার করে উঠবে, ‘এত ভালো সরকারি চাকরির পর ঘুসুরির ভাঙা নোংরা গুদামে কাজ করতে যাবে?’

প্রশ্নটা যথার্থ। কিন্তু উত্তরটা প্রতিবেশী বিপুলদার কথা ধার করে দেওয়া যায়। একদিন সন্ধ্যা বেলা হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, ‘অফিসে তোমার পরিচয়টা আসল নয়। কৃত্রিম। তোমার চলন বলন হাসি গাম্ভীর্য সব মাপা। আরোপিত। অবসরের পর মুক্ত স্বাধীন জীবনে তোমার আসলটা প্রকাশ পাবে।’

চার দেওয়ালে নিঃসঙ্গ গোকুল বাবুর মাথায় এলোমেলো অসংখ্য কথা কেবলই উড়ে উড়ে আসছিলো। কাজ পাগল বাবার কথা মনে পড়লো। মায়ের প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে ঋজু মানুষটা বলছিলেন, ‘কেন এত কাজ করি? কর্ম ব্যস্ত থাকলে দুশ্চিন্তা ছটফটানি কমে যায়। মৃত্যু চিন্তা ঘেঁষতে পারে না।’

ভিতরের ছটফটানিটা মনে হয় একটু কমলো। গোকুল বাবুর ঠোঁটের কোনে হাসি। নিঃশব্দে মুঠো ফোনটা হাতে নিয়ে লাগোয়া ব্যালকনিতে এলেন। পটাপট ডায়াল করলেন। ঘুসুরির মিত্র-ঘোষ কোম্পানির যুগ্ম মালিক মলয় শঙ্কর ঘোষ ওপার থেকে বললেন, ‘আজকেই আসবেন? খুব ভালো কথা। চলে আসুন, আজ মাসের প্রথম দিন। আহিরিটোলা থেকে লঞ্চে বাঁধাঘাট। ওখানে আমাদের ড্রাইভার থাকবে।’

অফিসের ব্যাগে একটা কবিতার বই ঢুকালেন গোকুল বাবু। উপহারে পাওয়া নতুন জামাটা গায়ে চাপিয়ে বন্দনাকে ডাকলেন। বললেন, ‘হাওড়ায় নতুন কোম্পানিতে কাজে যোগ দেবো। এখনই বেরতে হবে। প্রথম দিনই দেরি হয়ে গেলো।’

বন্দনার কপালে ভাঁজ। গোল চোখ। বললেন, ‘সালকিয়ার ধুলো ধোঁয়া আবর্জনা। সেই নোংরা শিল্পাঞ্চল?’

— তাতে কী? ওখানেও একই কাজ। হিসেব আয়-ব্যায়-অডিট।

— তুমি যে বলছিলে বাড়ির কাজে সময় দেবে?

— তোমরা চাইলেই সময় দেবো। নতুন চাকরিতে চাপ নেই কোনও।

এবার বন্দনার ঘাড়ে হাত রেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন গোকুল বাবু। বললেন, ‘আজ মাসের প্রথম দিন। নতুন কাজে যোগ দিতে যাচ্ছি। দেরি করে ফেললাম।’

— সারা জীবন শুধু কাজ করে যাবে? কেবলই দৌড়ঝাঁপ! থামবে না একটু?

— গতি কমিয়ে গাড়ি থামাতে হয় জানো? হাই স্পীডে ব্রেক কষো, গাড়ি থামবে না। পাল্টি খেয়ে যাবে। বুঝলে!

অভ্যস্ত দ্রুততায় দোতলার সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নামলেন গোকুল বাবু। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে পর্যায় ক্রমে হাত আর ঘাড় নাড়লেন বন্দনা। অন্য দিনের মতোই, তবে দেরিতে। ততক্ষণে শীতের কুয়াশা পুরোপুরি কাটিয়ে রোদে ঝলমল করছে চারদিক।