গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পরাস্তাটা ভারি সুন্দর। দু’পাশে গাছ, গাছ আর গাছ। তিনরকম রঙের। আসলে এ সময় পাতারা রঙ পাল্টায়– কেউ সবুজ, কেউ হলদে আর কেউ লাল। এরা বলে ‘ফল কলর’। বাংলায় কী হবে? পাতাঝরা দিনের রং? চলতে চলতে সঞ্চারী বসু রায়ের মনে হচ্ছিলো— প্রকৃতির রূপ তো সবদেশেই আছে তবে এদেশটাকে ঈশ্বর বোধ হয় খানিকটা বেশি দিয়েছেন।
আমেরিকার এই শহরে সঞ্চারীর দ্বিতীয়বার আসা। মেয়ে-জামাই আর তাদের পনেরো বছরের মেয়ে নিকা থাকে। মাস চারেক থাকার কথা সঞ্চারীর, তবে এবাড়িতে কেমন খালি খালি লাগে। মেয়ে-জামাই দু’জনেই কাজে বেড়িয়ে যায়। নিকা সবে হাইস্কুলে পড়ে, তবু তারও বিশেষ সময় নেই, আজ এখানে কাল সেখানে ঘুরে বেড়ায়। ডেটিংও নাকি শুরু করছে। মানে সকলেই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
এখানে যেমন লাগে কলকাতার ফ্ল্যাটেও সঞ্চারীর এরকমই একাএকা লাগে। দু-কামরার ফ্ল্যাটটা কলকাতার ভালো এলাকাতেই। সরকারী চাকরি ছিলো সঞ্চারীর, তাই পেনশন আছে। আর্থিক দিকটা নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। স্বামী চলে গেছেন পাঁচ বছর হলো। মাঝেমাঝে মনে হয়, এই তো সবে তেষট্টি হলো, আরও কতদিন বেঁচে থাকতে হবে!
সে যাই হোক আজ সঞ্চারীর মনটা বেশ ভালো। মিনিট দশেকের ভেতর একটা পার্ক আছে, সেখানে যেতে হবে। আইডা বলেছে অপেক্ষা করবে— সঞ্চারীকে বাড়ি নিয়ে যাবে। কফির নেমতন্ন। আইডার সঙ্গে এই পার্কেই আলাপ। বয়স কত হবে... ষাট বোধহয় এখনও হয়নি। উজবেগিস্তান থেকে চল্লিশ বছর আগে এসেছিলো। এসে এখানেই থিতু হয়েছে। এই শহরে কেউ নেই ওর। বিবাহ-বিচ্ছিনা। ছেলে থাকে অনেক দূরে, কানাডায়। কত দেশে থেকে আইডার কত মানুষ যে আমেরিকার স্রোতে মিশে গেছে তার ঠিক নেই। ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকলে— কলকাতা থেকে কলম্বিয়া, মাদ্রাজ থেকে মরক্কো, উৎকল থেকে উরুগুয়ে— সব রকমের নমুনা পাওয়া যাবে।
পার্কের গেটেই দেখা হয়ে গেলো। গাড়ি পার্ক করছিলো। তাহলে তো এখান থেকেই যাওয়া যায়। আইডা সঞ্চারীকে জড়িয়ে ধরে বললো— “কাঁটায় কাঁটায় ঠি ই ই ক সময় তুমি এসেছো, বন্ধু! আচ্ছা, আমার গাড়িটা কিন্তু পুরোনো আর খুব ছোটো, মানিয়ে নিতে পারবে তো সানশারি…”
— “খুব পারবো, আইডা। গাড়ি তোমার যথেষ্ঠ ভালো। আমাদের দেশের অনেক গাড়ি এর থেকে অনেক খারাপ”
— “তোমার নামটা আমি ঠিক করে বলতে পারি না, মানে আমার জিভেই আসে না। তা তোমার নামের কোনও মানে আছে?”
— “আমাদের দেশের খানদানি গানে, মানে তোমরা যাকে ক্লাসিকাল মিউজিক বলো, তাতে চারটে ভাগ থাকে। তার তিন নম্বর অংশটাকে বলে সঞ্চারী।”
শুনে আইডা হৈহৈ করে উঠলো। একহাত স্টিয়ারিং-এ আর একহাত সঞ্চারীর কাঁধে রেখে বললো— “ ওহো, এইবার বুঝেছি। এই জন্যই তোমার স্বভাবটি গানের মতই মিষ্টি। আর তুমি তিন-নম্বরে মানে সবে অর্ধেক পার করেছো! তোমার গান এখনও অনেক অনেক বাকি… হা হা”
আইডার অ্যাপার্টমেন্ট আটতলায়। ছোট্ট এক-বেডরুমের বাসস্থান। সঞ্চারীর কলকাতার ফ্ল্যাটের থেকে ছোটো। অনেকগুলো কাচের জানালা–বাইরে তাকালে বড়ো রাস্তা আর গাছের মাথা দেখা যায়। ঘরদোর খুব যে গোছানো তা বলা যায় না, কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ একটা নীড়-নীড় ভাব আছে।
— “আইডা, তোমার বাড়িটা আমার খুব ভালো লাগছে। কি সুন্দর ব্যবস্থা। দেখো, তুমি তো আমার মতনই সাধারণ মহিলা…”
সঞ্চারীকে থামিয়ে দিয়ে আইডা বললো— “কফি লাটে চলবে তো?”
— “সব চলবে। আমি অত কফির নামটাম জানি না… হ্যাঁ যা বলছিলাম, তুমি সাধারণ, আমিও তাই, কিন্তু…”
— “কফি লাটে হলো এমন কফি, বুঝলে সানশারি, যা সকলেই বানাতে পারে। কাপুচিনো, এসপ্রেসো বা অ্যামেরিকানোর মতো এতে সেরকম কোনও বিশেষত্ব নেই তবে…”
— “বললাম তো যা বানাবে তাই ভালো লাগবে আমার। জানো আইডা, কলকাতার ফ্ল্যাটে মাঝেমাঝে আমার ভীষণ একলা লাগে, মনে হয় আর কতদিন কাটাতে হবে….”
— “কফি লাটে সাধারণ বলেই এতে যে কোনওধরনের ফ্লেভর মানে সুরভি দেওয়া যায়। আমি কী করি জানো? নতুন নতুন মশলা দিয়ে চেষ্টা করি…”
— “আচ্ছা, তোমার যে ফ্লেভর দেওয়ার ইচ্ছে তাই দাও, আমি আমার কলকাতার দিনগুলোর কথা বলছিলাম…
— “এই এক চিমটি মশলা দিয়ে নতুন ফ্লেভর আনাটায় আমি খুব বিশ্বাস রাখি। সামান্য ব্যাপার, কিন্তু কফির স্বাদ বেড়ে যায় অনেকটা।”
— “আইডা, জানো আজকাল সকলে এত ব্যস্ত যে কথা বলার সময়ই থাকে না তাদের…”
— এই সানশারি, কফিটা হতে থাক, ততক্ষণ চলো আমরা একটু নাচি…”
সঞ্চারী ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই আইডা একটা গান চালিয়ে দিলো। ওদের দেশের গান। আমাদের দেশের সুরের সঙ্গে মিল আছে। কোন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে যেন মেলে— আয় তবে সহচরী— বোধ হয়। নাকি ওরকম মনে হচ্ছে আজকে! সব আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে আইডা সঞ্চারীর হাত ধরে দুলে দুলে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। সেই ক্লাস নাইনে ইস্কুলে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ হয়েছিলো। তাতে কোরাস নাচে সঞ্চারী ছিলো, তারপরে আর কখনও নাচার সুযোগ হয়নি।
দু’জনেই খুব হাসছিলো, মিনিট দুয়েক পর সঞ্চারী ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। হাঁফ ধরে গেছে! আইডাও হাসতে হাসতে কফির দিকে গেলো। দম ফিরে পেয়ে সঞ্চারী বললো— “উফ, আইডা তুমি পারো বটে! ঈশ, আমি যদি তোমার মতো হতাম, আর আমাদের দেশে যদি এরকম…”
— “জানো সানশারি, কফি লাটে সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। দামও কমের দিকে। তবে একটাই মুশকিল, একই রকম স্বাদে অরুচি ধরে যায়। তাই, এই যে একটু আগে বলছিলাম না, কোনও একটা মশলা খুঁজে নিতে হয়। আজকেরটা তোমার ভালো লাগবে মনে হয়…”
— আইডা, সেই তখন থেকে আমি একটা কথাবলার চেষ্টা করছি আর তুমি কিছু শুনছো না, উত্তরও দিচ্ছো না…”
— “এই তো উত্তর দিলাম।”
— “কোথায় উত্তর দিলে?”
— “এই যে বলছি এতবার— কফি লাটে। সাধারণ, কিন্তু এক চিমটি মশলা দিতে পারলে নতুন স্বাদ এসে যায়। যেমন ধরো আজকের ওই নাচটা… হি হি...”
সঞ্চারী আইডার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে দু-এক পল। আইডা হাসছে মুচকি মুচকি। আইডার হাতটা বুকের কাছে নিয়ে চেপে ধরে সঞ্চারী বলে— “এই জন্যই তুমি এত ভালো আইডা, কি সোজা করে যে বুঝিয়ে দিলে! কফি লাটের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে...”