Next
Previous
0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

 

চিন্তার পাকশালা যদি মগজ হয় তবে অনেক চিন্তা জন্ম নেয় বাথরুমে। তা সে পড়ুয়াই হোক বা সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীই হোক বা অর্থনীতিবিদ। এখানে বাথরুম বলতে শৌচাগার এবং স্নানঘর দুটোই একসাথে যেখানে আছে। কথিত আছে আর্কিমিডিস চৌবাচ্চার জলে চান করতে নেমে প্লবতা বা বায়োয়েন্সির সূত্র আবিষ্কার করে ফেললেন। এরকম অনেক সাহিত্যিক বা কবি আছেন যাঁরা বাথরুমে বসেই কোনও লেখার সূত্র ভাবেন বা কবিতার ছন্দ ও শব্দ আওড়াতে থাকেন। গায়কেরা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে গানের প্রথম কলি হয়তো গেয়েই উঠলেন। বাথরুমের ভেতর গল্পের প্লট এবং কথা যত সৃষ্টি হয় তা যদি লেখা থাকতো; হায়, সে কাজ কেউই করে যায়নি। চিত্রকরের কত ছবির প্রাথমিক আইডিয়া আসে বাথরুমে বসে। এমনকি, দৈনন্দিন থেকে ইস্পেশ্যাল ডিশ রান্নার প্রাথমিক প্রস্তুতির চিন্তার অঙ্কুর ফুঁড়ে বেরোয় গৃহিণী থেকে বড়ো হোটেলের শেফের এই আঁতুরঘরেই। খাওয়া-শোওয়া যেমন-তেমন হলে যদিওবা চলে বাথরুম হওয়া চাই মনের মতো। সে যত এলেবেলেই হোক, এই একমাত্র একটা জায়গা যেখানে মানুষ কিছুটা সময় নিজের সাথে কাটাতে পারে, মুখোমুখি হতে পারে। পৃথিবী থেকে সংসারের যাবতীয় ঘটনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে নিজের সাথে থাকতে পারে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-অপ্রেমের আবেগ একান্ত নিজের করে প্রকাশ করার জায়গা। কিছুটা সময় হলেও মানুষ পাখির নীড়ের মতো একটা আশ্রয় খুঁজে পায় এখানে, নাটোরের বনলতা সেনের মতো দুদণ্ড শান্তি দেয় এই বাথরুম। কালের গতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রাতঃকৃত্য এবং স্নানের জায়গা খোলা মাঠ পুকুর ধানসিঁড়ি-নদী ছেড়ে বাড়ির কাছাকাছি ঘেরা জায়গা, সেখান থেকে একেবারে শোবার ঘরে এসে পৌঁছেছে। এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই ঘরখানা যে আবশ্যিক কলঘর থেকে ফ্যাশনেবল অলঙ্কারের মতো ডিজাইনার রেস্টরুমে পরিণত হয়েছে। অতিথির মনে ঈর্ষা জাগাতে পারে কোনও হোটেল বা বাড়ির রেস্টরুম।

বহু মানুষেরই বাথরুম নিয়ে খুঁতখুঁতানি থাকে। বড়ো হতে হবে, মেঝে বেসিন কমোড সব পরিষ্কার ঝকঝকে-তকতকে থাকতে হবে ইত্যাদি। হোটেলে ঢুকেই ঘরের চেয়ে বাথরুম চেক করাটা অত্যন্ত জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে। বাথরুম নিয়ে সাধারণত মহিলাদের মধ্যে একটা সন্তোষ-অসন্তোষ কাজ করে যেমনটি তাদের রান্নাঘর বা কিচেন নিয়ে। অনেক পুরুষেরও আছে। এই আমারই যেমন বাথরুম পরিষ্কার হলেই হলো, বাতিকটা নেই। ছোটো হলে কোনওরকমে ম্যানেজ করে নিই, বড়ো হলে হাত-পা ছড়িয়ে কাজগুলো করা যায়, মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে। বাথরুমে তিনটে জিনিস থাকলে মোগাম্বো খুশ— কমোড, শাওয়ার আর বড়ো আয়না। শারীরিক অসুবিধের জন্যে কমোড আবশ্যিক হয়ে গেছে তবে কোথাও না থাকলে কোনওরকমে কষ্ট করে ম্যানেজ করে নিই। শাওয়ারে চান করতে খুব ভালো লাগে মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজছি। শরীর বেয়ে যখন অনেকগুলো জলের স্রোত নেমে আসে সেই দেখে সত্যি বলছি শিহরণ জাগে। আর নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে দেখতে একটা বড়ো আয়না থাকলে তো কথাই নেই। এগুলো সব তৈরি হয়েছে প্রাক-যৌবন থেকেই। কূপের থেকে যতই বেরিয়ে বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হয়েছি ততই বুঝতে পেরেছি একটা পরিবর্তন আসছে আস্তে আস্তে, নিজেকে রোখার চেষ্টা করিনি। পাল্টে যাচ্ছি ক্রমে। আমিও তা অনুসরণ করতে করতে বদলে গেছি। মানুষের জীবন যাপনে কত পরিবর্তন ঘটে গেলো গত ষাট বছরে আর বাথরুমের হবে না তাও কি হয়? কলঘর, চানঘর, পায়খানা যখন থেকে বাড়ির মধ্যে এবং তারও পরে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো তখন থেকেই তার বিবর্তনের সাথে নামের পরিবর্তন হতে থাকলো, বাথরুম, ল্যাট্রিন, টয়লেট, ডব্লু-সি, ওয়াশরুম থেকে হালফিলকালে রেস্টরুম। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা ছোটো ঘরের দেয়ালে সাঁটা এই শব্দগুলো সময়ের সাথে বদলে যাচ্ছে। অনেক রেল স্টেশনে প্রসাধন লেখা থাকে। আসমুদ্রহিমাচল এবং বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে গ্রামীণ সমাজে ল্যাট্রিন (হিন্দিতে অর্থ টাট্টি) শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করেছি আবার শহর ও মফঃস্বলের বাড়ির বাথরুম ফ্ল্যাটে এসে টয়লেট। ক্লাব, হোটেলে বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে ডব্লু-সি, ওয়াশরুম। রেস্টরুম সর্বাধুনিক ফ্যাশনেবল শব্দ। তবে যে নামেই ডাকো তুমি কাজটি আমার বাথরুমের।

এই আমি একসময় চার দেয়ালের মধ্যে চান করতেই পারতাম না। জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছি বাড়ির খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে পেছনে দুটো শৌচাগার, ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা। সিঁড়ি দিয়ে কয়েকধাপ উঠে তারপর সেই ঘর, নিচেটা অনেকটা গর্ত। এই ছিলো তখন মফঃস্বলে শৌচাগারের চেহারা। স্নানের ব্যবস্থা আলাদা। যেহেতু মফঃস্বল তাই শহরের ছোঁয়াও থাকতো কিছু বাড়িতে যাদের আর্থিক স্বাচ্ছল্য ছিলো যেমন আমাদের পাশে জ্যাঠামশাইদের বাড়িতে ছিলো স্যানিটারি সিস্টেম, তখন তাই বলা হতো। বাড়িরই মধ্যে মাটির নীচে ট্যাঙ্কে জমা হতো ময়লা ও ভর্তি হলে মিউনিসিপ্যালিটিকে জানালে গাড়ি এসে পরিষ্কার করে চলে যেত। বাড়ির মধ্যে অথচ নিয়ম মেনে একটু ছাড়া ছাড়া, দরজার মুখ বাড়ির পাঁচিলের দিকে। পড়নে গামছা। ওই বাড়িতে ছাদের ওপর জলের ট্যাঙ্ক ছিলো, পাম্প চালিয়ে মাটির তলা থেকে জল তোলা যেত। কিন্তু চানের ঘর ছিলো আলাদা, বালতিতে কলের জল ভরে মগে করে মাথায় ঢালতে হতো। কলকাতার সাদার্ন মার্কেটের পেছনে আমার মামাবাড়িতে নীচে ও ওপরে দুটো তলাতেই ছিলো বাথরুম, ঘরের পাশে। দোতলার বাথরুমের ভেতরেই স্যানিটারি সিস্টেম, কর্পোরেশনের আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজের সাথে যুক্ত, শাওয়ার-ওলা চানের ঘর, মাঝে একটা দরজা। একতলায় অবশ্য দুটো ঘর আলাদা আর চৌবাচ্চায় থাকতো জল। তবে দুটো তলাতেই লোহার সিস্টার্ন ছিলো মাথার অনেকটা ওপরে আর তার থেকে হনুমানের ল্যাজের মতো একটা লোহার চেন ঝুলতো যেটা টানলেই হুড়হুড় করে জল পড়ে বেসিন ধুয়ে দিতো। রোজ সকালে জমাদার এসে ওপর ও নীচের বাথরুম/শৌচাগার ধুয়ে পরিষ্কার করে দিতো। বড়ো বাথরুম প্রথম দেখি ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস সেলুনে ছ’বছর বয়সে। আয়না লাগানো সেই বাথরুমে শাওয়ার ছিলো। মামাবাড়ির ছাদে দুটো ট্যাঙ্ক ছিলো— একটায় কর্পোরেশনের পরিষ্কার জল নীচের চৌবাচ্চা থেকে পাম্পের সাহায্যে তোলা হতো আর একটায় থাকতো গঙ্গার ঘোলা জল যেটা প্রেসারে আপনি ওপরে উঠে যেত। রাস্তায় হাইড্রেন্ট থেকে এই ঘোলা গঙ্গার জলে লম্বা হোসপাইপ দিয়ে তখন রাস্তা ধোয়া হতো রোজ সকালে ও বিকেলে। আমার মেজপিসির বাড়ি ছিলো পাইকপাড়ায়, টালার ট্যাঙ্ক কাছেই থাকাতে প্রেসারে জল আপনি দোতলার ওপরে উঠে ট্যাঙ্ক ভরিয়ে দিতো, পাম্পের দরকার হতো না। মেজপিসির বাড়িতেও স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও চান করার ঘর আলাদা, চানের জন্যে শাওয়ার ছিলো। পিসেমশাই ছিলেন চেন স্মোকার, এত সিগারেট খেতেন যে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়েও সেই আমেজ নিতেন। মধ্য কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রীটে ছোটোপিসির বাড়ি, একতলায় উঠোন তার একপাশে কলের নীচে বড়ো চৌবাচ্চা সেখানেই পুরুষেরা মগে জল নিয়ে চান করে। পুরনো কলকাতার যেমন ছবি আগেরদিনের সিনামায় দেখা যায়। মেয়েদের জন্যে চানের কলঘর আলাদা। স্যানিটারি ল্যাট্রিনও একতলায়। শোয়ার ঘরের মতো বড়ো এলাহি বাথরুম প্রথম দেখি আমার চোদ্দ বছর বয়সে গোয়াতে বি এন আর হোটেলে। তখন গোয়া ছিলো জেলেদের একটা গ্রাম, যাকে বলে ফিশিং হ্যামলেট, কয়েকটা সাদা রঙের প্রাসাদের মতো বাড়ি, ভাস্কো-ডা-গামার একটা পাথরের মূর্তি। আর ওই একটাই ভদ্রস্থ হোটেল। সেই প্রথম কমোডের সাথে আলাপ ও পরিচয় কিন্তু পরিচয়টা ভালো হয়নি, চেয়ারের মতো বসে সুবিধে না হওয়ায় তার ওপরে উবু হয়ে বসতেই হলো। কমোডের পেছনেই ফ্লাশ, বোতামে আঙুল ছোঁয়ালেই জল। তবে পোর্সেলিনের সাদার সাথে সোনালি বর্ডার দেওয়া গোল কল দেখে মুগ্ধ। ঘোরালেই জল, কলে ও শাওয়ারে। গরম ও ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থাও ছিলো, সেই প্রথম গিজার চিনলাম।

আমাদের বাড়িতেও বাড়ির পেছন থেকে শৌচাগার স্যানিটারি সিস্টেম হয়ে ভেতরে আসতে বেশি সময় নেয়নি, চীনের সাথে যুদ্ধের পরেই মিউনিসিপ্যালিটির বিশেষ অনুদানে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়িতে পাতকুয়া ছিলো আর সেখান থেকে বালতিতে জল তুলে মাথায় ঢেলে চানের যে আরাম ও মজা পেতাম তা চার দেয়ালের স্নানঘরে বালতি থেকে মগে করে জল মাথায় ঢেলে পেতাম না। খুব ছোটোবেলায় পাতকুয়ার পাশে বসতাম আর ভারিতে জল ঢেলে দিতো। একটু বড়ো হতে যখন নিজেই বালতি করে জল তুলতে শিখলাম তখন যতখুশি জল তুলি আর ঢালি। বর্ষাকালে পাতকুয়া ভরে জল অনেকটা ওপরে চলে আসতো, মগে করে জল তোলা যেত কিন্তু আমি সেই বালতি করেই জল তুলে চান করতে মজা পেতাম। শীতকালে কুয়োর জল গরমই থাকতো। গঙ্গার কাছে বাড়ি থাকায় জোয়ার-ভাটায় কুয়োর জল ওঠা-নামা করতো। কোনও বছর ভারী বর্ষায় জল কুয়ো উপচে পড়তো, তখন ঠাকুমা ওখানে চান করতে মানা করতেন। পুজো-পার্ব্বনের সময় মায়েদের সাথে গঙ্গায় চান করতেও মজা পেতাম। ডুব দিলে মাথার ওপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে ভেবেই পুলকিত হতাম। এটা আরও ভালো অনুভব করতাম সমুদ্রে চান করার সময়। ভারতে দুই সমুদ্র উপকূলের অনেক সাগরতটেই চান করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে।

স্কুলে আঁকা শেখার ক্লাস থাকায় যেটুকু আঁকতে শেখা, তার বেশি কখনো চেষ্টাও করিনি যদিও মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে আঁকা নামে কিছু দাগ টানতে হয়েছে। অবশ্য পড়াশোনার জন্য আঁকাটাও এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। খুব খারাপ যে আঁকতাম তা নয়, বিষয়বস্তু চেনা যেত ভালোই তবু আঁকা অভ্যেস করিনি কখনো। কিন্তু বিকেলে গঙ্গার ধারে বসে পশ্চিমের আকাশে রঙ বদলের সাথে মেঘেদের আকার ও আকৃতি বদলের সময় নানা বিচিত্র চিত্র কল্পনায় উঠে আসতো। ঠিক তেমন করেই বাড়ির ড্যাম্পধরা দেয়ালে দেখতে পেতাম কত ছবি, কখনও পশুর, কখনও পাখির বা মানুষের। মানুষের মধ্যে আবার বিভিন্ন চেহারার, বয়সের, পোশাকের। কারোর নাক লম্বা, কারোর ত্যাড়ছা টুপি, কারোর মুখে পাইপ। একই দেয়াল, একেকদিন একেকভাবে আমার সামনে একেকচরিত্রের আকার নিয়ে দেখা দেয়। আর এইটা সবচেয়ে বেশি পেতাম ওই বাইরের শৌচাগারের দেয়ালে। তাই অনেক সময় নিয়ে বসে থাকতাম। কল্পনায় কত গল্প তৈরি হতো। ভাবালু বনার শুরু ওখানেই। বাড়িতে ঘরের দেওয়াল পঙ্খ করা, কোনও ছবি আশা করাই যায় না কিন্তু রান্না ঘরের মলিন অ্যালা রঙের দেয়ালে এবং লম্বা টানা বারান্দার ড্যাম্পধরা দেয়ালে অনেকরকম ছবি দেখতে পেতাম। স্যানিটারি হবার পর মন খারাপ হয়ে গেলো, ঝকঝকে দেয়াল। বছর দুই যেতেই ড্যাম্প এসে গেলো আর আমার মনখারাপের মুক্তি হলো, আনন্দ গেলো বেড়ে, সময়ও কাটাতাম অনেকটা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আগের ওই ছবিগুলো আর পেতাম না, এখানে নতুন ছবি, বেশিরভাগই বিদেশি মনে হতে লাগলো। অনেক পরে বিশ্লেষণ করে বুঝেছিলাম আমার ওই কল্পনার ছবিগুলো পাল্টে যাবার সাথে পড়ার বিষয় পরিবর্তনের যোগসূত্র আছে। ছোটোবেলার ওই ছাপ-ওলা দেয়াল থেকে বিস্তার পাওয়া কল্পনার জাল আরও বড়ো হয়ে হারিয়ে ফেলেছি কারণ ততদিনে কলঘর বাথরুম ল্যাট্রিন থেকে টয়লেট হয়ে ওয়েস্টার্ন ক্লোসেট বা ডবলু সি-তে বিবর্তিত হয়ে গেছে, দেয়ালে বসেছে চকচকে সেরামিক টালি। এসেছে ইন্ডিয়ান ও ওয়েস্টার্ন সিস্টেম, কমন টয়লেট বদলে গেছে অ্যাটাচড ডবলু সি-তে। কিন্তু আপন মনে ভাবুক হতে তো আপত্তি নেই, ছবি না থাক ততদিনে কল্পনা অন্য দিকে জাল ছড়িয়েছে।

আরেকটা অদ্ভূত জিনিস আমার মধ্যে তৈরি হলো যার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আর স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি এরকম হতে পারে। এটা হয়েছিলো ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে। পরীক্ষার আগে টয়লেটে বসে পড়ার কথা মনে পড়তো আর আউড়ে নিতাম একেকটা চ্যাপ্টার বা প্রশ্নের উত্তর। এতেও অনেকটা সময় চলে যেত কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনের কনসেন্ট্রেশন বোধহয় ওখানেই পেতাম। আমার তো মনে হয় মনে কনসেন্ট্রেশনের বাথরুমই আদর্শ জায়গা, এমনকি মেডিটেশনের পক্ষেও। টয়লেটে বসে পড়ার অভ্যেস অনেকের আছে। কেউ খবরের কাগজ বা কেউ গল্প বা কবিতার বই আবার কেউ পড়ার বইও পড়ে। দেশে-বিদেশে অনেক ভালো হোটেল বা সার্কিট ও গেস্ট হাউসে দেখেছি ডবলু সি-তে বুকশেলফে বই, ম্যাগাজিনের পাশে চেয়ার বা ইজি চেয়ার রাখা আছে, ইনডোর প্ল্যান্ট দিয়ে সুন্দর সাজানো। এ সেইসব লোকেদের জন্যে যারা এখানে একটা নিভৃতি খুঁজে পান, নিজের মনের মতো জায়গা। বাথটাবে শুয়ে বই এবং সুরার সাথে কত লোক ঘন্টা কাটিয়ে দেন। আর চান ঘরে গান তো কথাই আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ‘নাবার ঘরে’ গান তৈরি করে ফেলতেন। আমারও যে গান পায় না তা বলি না। কাওকে শোনানোর দায় নেই, কেউ শুনে ভালো বা খারাপ বললেও আমার কিছু এসে যায় না কারণ ওই জায়গা আমার নিজস্ব শিল্প চর্চার জায়গা। শুধু শিল্প? তাহলে বলি, আমার পরীক্ষার পড়া মনে করার চেয়েও যেটা বড়ো হয়ে দেখা দিলো আমি পরীক্ষার দিন প্রশ্ন ভাবতে এবং তার উত্তর ভাঁজতে শুরু করলাম ওই টয়লেটে বসেই। এবং আরও আশ্চর্যের ঘটনা হলো যেসব প্রশ্ন ভাবতাম তার অনেকগুলোই পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্রে দেখতে পেতাম। এটা একদিকে যেমন আনন্দের অন্যদিকে ভয়েরও কারণ অভ্যেস হয়ে যাচ্ছিলো, নির্ভরতা বাড়ছিলো; আর পরে কখনও যদি না মেলে? কারণ টয়লেট থেকে বেরিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তরগুলোই আরও একবার দেখে নিতাম। এভাবে হাফ-ইয়ার্লি, প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পার করে দিলাম। আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার বছর প্রথম পত্রের পরীক্ষা রাজ্যের রাজনৈতিক ডামাডোলে নির্দিষ্ট দিনে হয়নি, পিছিয়ে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় পত্র ইংরেজি দিয়ে শুরু হয়েছিলো। যথারীতি সকালে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে প্রশ্ন ও উত্তর মনে মনে আওড়ে নেওয়া। পরীক্ষা দিতে যেতাম রিক্সা করে, আমার সাথে আরও দু’জন বন্ধু যেত। তাদের বললাম আমার মনে হচ্ছে এই প্রশ্নগুলো আসতে পারে। প্রশ্নপত্রে দেখলাম বেশ কয়েকটা মিলে গেছে কিন্তু আমার হাত কাঁপছে। সম্ভবত উত্তেজনায়, একটা অসম্ভবের সম্ভাব্য পরিণতি দেখে। পরের পরীক্ষার দিন সকালে ওই দুই বন্ধু এসে হাজির, টয়লেটে গিয়েছিলি? কী প্রশ্ন শুনলি? কিছুটা বললাম সত্যি, কিছুটা বানিয়ে। ওরা চলে গেলো। যে কটা সত্যি বলেছিলাম সবকটাই এসেছে, মিথ্যেগুলো নয়। ওরা তাতেই খুশি। এইটা আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেলো। আজও কোনও সমস্যায় পড়ে গেলে এবং সিদ্ধান্তে আসতে হলে আমি সেই টয়লেটের শরণাপন্ন হই। লেখার সূতিকাগারও।

পৃথিবীর গোপন রহস্যের সন্ধান আমার শিক্ষার বিষয়। তার জন্যে পাথর, মাটি, জীবাশ্ম পড়তে, চিনতে, জানতে হয়, হাত দিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। পড়ার সময়েই জেনেছিলাম মাটি-পাথরের সাথে থাকতে গেলে তাদের সাথেই ওঠাবসা করতে হবে, শহুরে জীবন শহরেই ফেলে আসতে হবে যখন মাটির সাথে থাকবো। তারই প্রথম স্বাদ পেলাম বিএসসি পড়ার প্রথম বছর ফিল্ডে বাঁকুড়ার মেজিয়া গ্রামে প্রথম রাতেই। প্রকৃতির ডাক, বড়ো। কি হবে! চারিদিক ঘুটঘুট্টে অন্ধকার, ত্রিসীমানায় কোথাও আলো নেই। অগত্যা কলেজের এক কর্মী লণ্ঠন হাতে আমাকে মাঠের পথ দেখালো। সেই প্রথম মাঠের অভিজ্ঞতা। যদিও শীতকাল তবু সাপের ভয়। ভালোয় ভালোয় সে যাত্রা নির্বিঘ্নে কাটার পর মাঠের অভ্যেসও হয়ে গেলো। ছাত্র জীবনে সেই যে বাইরে টয়লেট নিয়ে ট্রেনড হয়ে গেলাম আর কোথাও কখনও অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। টয়লেট নিয়ে নানা জায়গায় বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এ জীবনে এক বিরাট সঞ্চয়।

চাকরিতে জয়েন করার পর প্রথম তাঁবুতে থাকার অভিজ্ঞতা হলো। শুধু থাকা নয়, সার্কাস দলের মতো অফিস থেকে তাঁবু জিপের পেছনে ট্রেলারে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে মাঠে খাটানো থেকে কাজ শেষ হলে তাঁবু গোটানো পর্যন্ত সব হাতে কলমে শেখা হয়েছে। আমাদের ব্যবহারের জন্যে ছিলো এল বা লিভিং টেন্ট। সেটা খুলে টাঙানোর পর একটা চমক। তাঁবুর তিনটে ভাগ— মাঝখানে বড়ো একটা ঘর দুটো বাঁশের ওপর ভারসাম্য। তাঁবু দু প্লাই কাপড়ের, বাইরেরটা সাদা, আকাশ দেখে, আর ভেতরে ফুলছাপ প্রিন্টের হলুদ কাপড়, মানুষ দেখে। অনেকগুলো দড়ি দিয়ে মাটিতে লম্বা হুক পুঁতে বাঁধা থাকে। বড়ো হলের মতো ঘরে থাকা-শোওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা— ফোল্ডিংখাট, টেবিল, চেয়ার, বাক্স ইত্যাদি রাখা। এই ঘরে দুটো জানলা আর দু’দিকে দুটো কাপড়ের দরজা। একদিকে দরজার বাইরেটা চিক দিয়ে ঘেরা, ব্যালকনি আর অন্যদিকে দরজার বাইরে পেছনে অ্যান্টিরুম। শোয়ার ঘরে অনেকগুলো কাপড়ের পকেট। আর থাকতো দুটো ছোটো তাঁবু যাকে এন বা ন্যাচারাল টেন্ট বলা হয়। বোঝাই যাচ্ছে একটা প্রকৃতির কাজ এবং অন্যটা স্নানের জন্যে। প্রকৃতির কাজের জন্যে মাটিতে গর্ত করে সেই মাটি পাশে রাখা থাকতো, কাজের পর মাটি চাপা দেওয়ার জন্যে। একটা এরকম গর্তকে কয়েকদিন ব্যবহারের পর পরিত্যাগ করে জায়গা বদল হয়ে আবার তাঁবু পড়তো। যারা এই সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি তারা খুবই অসুবিধের মধ্যে পড়তো। চাকরির জন্যে চাকুরিজীবী নিজে মানিয়ে নিলেও অনেক পরিবারেরই মেনে নিতে অসুবিধে হয়েছে এবং টানা ছ’মাস তারা একলা বাড়িতে থেকেছে। অনেকে গ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকলেও প্রকৃতির ডাকে হয় তাঁবু নয়তো মাঠই ভরসা কারণ গ্রামের বাড়িতে ল্যাট্রিন থাকতো না। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে গেছে। এখন আর তাঁবু নিয়ে কেউ ফিল্ডে কাজে যায় না। কাছাকাছি টাউনে হোটেলেই থাকে সব। কিন্তু তাঁবুর বিকল্প নেই বিশেষ করে যারা প্রকৃতি প্রেমিক। রাতের উন্মুক্ত আকাশ তা সে চাঁদ থাক বা না থাক প্রতিটা রাত নতুন করে নগ্ন হয়ে দেখা দেয়, ভাবতে শেখায়, কল্পনার বীজ বুনতে সাহায্য করে। গ্রাম বা টাউনের হোটেলের অপরিষ্কার ল্যাট্রিনের চেয়ে বুঝেসুঝে ব্যবহার করলে ন্যাচারাল টেন্ট অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।

তবে এমন অনেক জায়গায় গিয়ে থেকেছি যেখানে থাকার মতো তাঁবুর জায়গা থাকলেও এন টেন্টের জন্যে জায়গা পাওয়া যেত না। তখন মাঠই ভরসা। এরকম গুজরাতে কচ্ছ্ব জেলার একটা ঘটনা। তাঁবু ফেলার পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে কাজে যাচ্ছি, কিছুটা গাড়িতে গিয়ে তারপর হেঁটে। দু’পাশের জঙ্গল থেকে সার দিয়ে অনেক পুরুষমানুষ দাঁড়িয়ে পড়লো। গার্ড অব অনার দিচ্ছে মনে হবে। কিছু না বুঝেই এগিয়ে গেছি। আবার বিকেলে যখন তাঁবুতে ফিরছি অন্য রাস্তা দিয়ে একজায়গায় দেখি সেই জঙ্গলের দু পাশে সার দিয়ে মহিলারা দাঁড়িয়ে। সঙ্গের সহায়কদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, শিখলামও বলা যায়, এসব জায়গায় গ্রামের পুরুষেরা সকালে মাঠে যায় আর বিকেলে মহিলারা। অপরিচিত কেউ সেখান দিয়ে গেলে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপরে আগে থেকে জেনে নিয়ে তাদের প্রাতঃকৃত্যে যাতে বিঘ্ন না হয় সেইরকম পথ ধরতাম। কচ্ছ্বেরই অন্য একটা গ্রামে ক্যাম্প শিফট করে তাঁবুর জায়গা না পেয়ে গ্রামের বাইরে একটা পরিত্যক্ত ঘরে ডেরা গেড়েছি। ঘরে না আছে দরজা না জানলা কিন্তু গর্তগুলো আছে। টালির ছাদ। তাঁবুর দরজার কাপড় দিয়ে দরজা জানলার গর্ত ঢাকা দিলাম। গরমকাল, দিনের তাপ পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। ঘর গোছাতেই দুপুর হয়ে গেলো। দুপুর শেষের দিকে ড্রাম ও বাঁশির আওয়াজ পেলাম, গ্রামের দিকেই আসছে। বিয়ে করে গ্রামের ছেলে বউ নিয়ে ফিরছে। আমার ঘরের পাশ দিয়েই যাবার সময় কার নির্দেশে তারা আমায় প্রণাম করলো, আমিও কিছু উপহার দিলাম। তারা বিদায় নিল। নিঝুম সন্ধ্যের কিছু আগে পথে মানুষের পায়ে চলার আওয়াজে ঘরের বাইরে একফালি বারান্দায় বেরিয়ে দেখি দুই সখী নিয়ে সেই নতুন বউ চলেছে, অলঙ্কারহীন, আটপৌরে শাড়ি জড়িয়ে। আমাকে দেখে লজ্জাবতী লতার মুখখানি বেশ মিষ্টি লাগলো। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্তের শেষ আভার রঙ গায়ে তার, আমিও এমন দৃশ্য মনে মেখে নিচ্ছি। কিছুপরে দেখি সেই তিন সখী খিলখিল করে হাসতে হাসতে ফিরছে। কৌতুহলে জিজ্ঞেস করি চৌকিদার তথা পাচককে। সে বলে নতুন বউ ‘সন্ড্যাস’ গেছিলো। পরদিন সকালে আমার ‘সন্ড্যাস’-এর জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলো চৌকিদার। জায়গাটা ছিলো সম্ভবত ময়ূরদের বাড়িঘর। তারা এমন এক কিম্ভূতকিমাকার দেখে প্রথম ক’দিন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আমায় ভয় দেখাতে লাগলো, এই বুঝি ঠোক্কর মারে। পরে অবশ্য এমন গোবেচারা নিরীহ ভালো মানুষ তাদের যে কোনও ক্ষতি করবে না সেটা ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে আমার সামনে কিছু দূরেই হাঁটাচলা করতো, হয়তো পাহাড়াও দিতো।

কর্মজীবনে কলকাতায় অনেক বছর ছিলাম। সেসময় আর সবার মতো আমারও জ্যোতিবাবুর মতো আই বি এস বা ইরিটেশনাল বাওয়েল সিনড্রোম শুরু হয়। ফলে রাস্তাঘাটে টয়লেটের খোঁজ চলে। তখনও সুলভের যুগ আসেনি। আমার টার্গেট ছিলো সিনেমা হলগুলো, বড়ো অফিস বিল্ডিং, লাইব্রেরি এসব যেখানে বাধা কম, সুড়ুৎ করে কাজ সেরে বেরিয়ে আসা যায়। তবে এই অসুবিধে বেশিদিন থাকেনি, চিকিৎসায় মুক্তি পাই। কয়েকবছর জাহাজে চড়ে সমুদ্রে গবেষণার জন্যে যেতে হয়েছিলো। জাহাজে টয়লেট ছোটো হলেও বেশ গোছানো। হাত-পা ছড়িয়ে কিছু করা যেত না বটে কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধে হতো না। তখন জল দিয়ে ফ্লাশ হতো। বছর কয়েক আগে উত্তর মেরু অভিযানে গিয়ে অত্যাধুনিক জাহাজে ‘ফাইভ স্টার’ ওয়াশরুম এবং আজকালকার এরোপ্লেনের মতো হাওয়া-ধোওয়া ফ্লাশ। একবার এক ট্যুর অপারেটরের সাথে ব্যাংকক গিয়ে পাট্টায়ার সমুদ্রসৈকতে। সহযাত্রী পুরুষ মহিলা অনেকেই আছে, আছে আমরা ছাড়াও অন্য ভাষাভাষীর লোকেরা। কেউ একজন বলে উঠলো তার ছোটো বাথরুম পেয়েছে। এতক্ষণ কারোর কিছু অনুভূতি হয়নি বা হলেও প্রকাশ করেনি, যেই শুনলো একজনের কাছে অমনি অনেকেরই সেই ইচ্ছে চাগিয়ে উঠলো। কাছেই ‘পে অ্যাণ্ড ইউজ’ ঘর। যার প্রথম পেয়েছিলো সে গেলো এবং স্মার্টলি ফিরে এল। অন্যেরা জিগ্যেস করাতে বললো ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ টাকা, ছোটোতেই। তারপরেই দেখি সে নেমে গেলো সমুদ্রে। আর তাকে দেখাদেখি আরও অনেক পুরুষ মহিলা। ভিনভাষার লোকেরাও। কী এক ছোঁয়াচে ব্যাপার যে ভাষা অতিক্রম করে পৌঁছে যায় বার্তা। এও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

একেক দেশে একেকরকম টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলেও কোথাও সেরকম অসুবিধে হয়নি। আমার দু’বেলা চান করার একটা বাজে অভ্যেস, বা বাতিক বলাই ভালো, সে হিমঘর বা চুলো যেখানেই থাকি না কেন। যেসমস্ত হোটেলে শুধুমাত্র বাথটাব থাকে সেখানে অসুবিধে করেই টাবের ভেতর দাঁড়িয়ে চান করতে হয়। তবে যেহেতু গরম জলে চানের অভ্যেস করিনি কখনও তাই সাধারণ হোটেলে গরম জলের ব্যবস্থা না থাকলেও অসুবিধে হয় না। আমার মতো সুবোধ বালক আর কোথায় পাবে হোটেলওয়ালা। আর এখন প্রায় সব হোটেলেই ওয়েস্টার্ন সিস্টেম থাকায় আমার খুব সুবিধে হয়েছে। কয়েকবছর আগেও জিগ্যেস করে ঘর নিতে হতো, ইন্ডিয়ান হলে বাতিল। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে সার্কিট হাউসের টয়লেট ব্যবহার করে খুব আনন্দ পেতাম। আরামদায়ক বিশাল ঘর। তখন কবিতাও লিখতাম সেখানে, কাগজ পেন বই ম্যাগাজিন সবকিছু মজুত থাকতো।

জাপান বেড়াতে গিয়ে অদ্ভূত অভিজ্ঞতা। শৌচের জন্যে টয়লেট পেপার ব্যবহার স্ট্রিক্টলি ফরবিডন্‌। টয়লেট সিটের সাথে দু’পাশে চারটে করে আটটা ফেদারটাচ বোতাম। কার কী কাজ জানি না। বুঝতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে, হিমসিম। যাই হোক, অবশেষে বোঝা গিয়েছিলো, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ওয়াটার জেট, এয়ার জেট ইত্যাদি। ইকনমি গেস্ট হাউসে চানের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা। কমন বাথ। কিন্তু মিনিমাম একশো’ ইয়েন স্লটে ঢোকালে চানের জন্যে দশ মিনিট শাওয়ার পাওয়া যায়। ইচ্ছেমতো পজ করে সাবান-শ্যাম্পু করা যায়। হায়, কে জানতো যে দশ মিনিট শাওয়ারের নীচে কতটা সময়! প্রথম দিন বোকা বনে গেছি, দামী ইয়েন গচ্ছা গেলো। পরদিন বন্ধুদের সাথে পালা করে ওই একশো ইয়েনে দুজন পরপর চান করে পয়সা উশুল।

ভারতে যত ইতিহাস-প্রসিদ্ধ রাজা-সম্রাটের খণ্ডহর বাড়ি-প্রাসাদ দেখেছি কোথাও বাথরুমের ব্যবস্থা দেখিনি। এমনকি গাইডকে জিগ্যেস করেও সদুত্তর পাইনি। মধ্যপ্রদেশে মান্ডুতে রূপমতির প্রাসাদে স্নানের এলাহি ব্যবস্থা কিন্তু শৌচাগার দেখিনি। সেদিক থেকে গ্রিস এবং তুরস্কে এই স্মৃতিগুলোও সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে। তুরস্কে কাপাডোসিয়া অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য গুহা আছে। এক-একটা গুহা এত বড়ো যে প্রাচীনকালে মানুষ গুহা কেটে মাটির নীচে শহর বানিয়ে ফেলেছিলো প্রধানত শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে। প্রায় ছত্রিশটা এরকম ‘পাতালশহর’ আছে যার মধ্যে কেমাক্লি পাতালশহর সবচেয়ে বড়ো। মাটি থেকে প্রায় আশি মিটার নীচে অবধি রাস্তা নেমে গেছে সরু টানেলের মতো। এর মধ্যে বেডরুম, খাবারঘর, স্নানঘর, শৌচালয়, মজুতভাণ্ডার, সুরাভাণ্ডার, আস্তাবল ইত্যাদি সব আছে। প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম গ্রীক দেবী আর্টেমিসের মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম তুরস্কেরই এফেসসে। এখানেই আছে হ্যাড্রিয়ান ও নাইকির মন্দির। তিনবার পুনর্নিমাণের পরও ভূমিকম্পে ৪০১ খ্রিস্টাব্দে আবার ধ্বংস হয়ে যায়। ভাঙাচোরা স্থাপত্যের মধ্যে আছে পূবমুখী সেলসাস লাইব্রেরি, উন্মুক্ত থিয়েটার, জলশৌচের ব্যবস্থা ও স্নানাগার। পাথরের বেঞ্চে সার দিয়ে পা-ঝুলিয়ে বসা শৌচের ব্যবস্থা প্রধান শাসনকর্তাদের জন্যে। শীতের দিনে ওই পাথরের ওপর কর্মচারীদের বসিয়ে দেওয়া হতো বসার জায়গা গরম করে দেবার জন্যে যার ওপর তেনারা এসে বসবেন। শৌচের জন্য নালা দিয়ে বয়ে যেত জল।

আমাদের দেশে প্রাতঃকৃত্য ব্যাপারটা কখনওই ভালো চোখে দেখা তো হতোই না বরং নোংরামির অঙ্গ বলে ভাবা হতো। এমনকি ঘৃণার চোখেও দেখা হতো। সেই লিগ্যাসির কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। যার জন্যে জীবন যাপনের সাথে এত স্বাভাবিক এবং আবশ্যিকভাবে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও এটাকে প্রয়োজনীয় অভ্যেস ভেবে উন্নত ব্যবস্থায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি। আজও গ্রামে গ্রামে লোকেরা মাঠে যেতেই অভ্যস্ত, সরকারিভাবে চেষ্টা করেও নিভৃতে এই কাজটি করাতে পারা যায়নি বরং উঠেছে আপত্তি। গ্রামই বা বলি কেন, শহরেও তো পুরুষদের রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে একটা দেয়াল বা গাছতলা হলেই মুত্রত্যাগের বাসনা জেগে ওঠে। লজ্জা পুরুষদের ভূষণ নয় বলেই যা ইচ্ছে করার প্রবণতা থাকে। মহিলাদের লজ্জাটা শাসন করে বলে তাদের মধ্যে সংযমের আপ্রাণ চেষ্টা থাকে। আমাদের মনে বাথরুমকে কখনওই পবিত্র, অবরুদ্ধ মন্দির বলে মনে হয় না অথচ এখানেই আমরা নিজেদের নিজের সামনে নগ্ন করি, এখানেই আমরা মুক্ত, নিঃসঙ্গ। সৃষ্টির মূল উৎসস্থল এখানেই তা বুঝলেও মানতে চাই না। এখানেই গায়ের কাপড় খোলার সাথে সাথে খসে পড়ে সামাজিকতার খোলস, আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হয়, গান গাইতে বাসনা জাগে। দেশ-বিদেশের সাহিত্যেও বাথরুম একরকম প্রায় ব্রাত্য। বাংলায় বুদ্ধদেব বসুর এই নিয়ে একটা প্রবন্ধ আছে যা পড়ে আমার এই চেষ্টিত লেখার অনুপ্রেরণা। চলচ্চিত্রে খোলা উঠোন, কল, চৌবাচ্চা পুরনো দিনের ছবিতে দেখা যেত। আজকাল বিদেশী সিনেমায় দরজা খোলা বাথরুমের ভেতর চরিত্রদের বিভিন্ন কর্মাবস্থায় দেখা যায়। তবে বেশ কিছু সিনেমায় বাথটাবে নায়ক বা নায়িকার স্নানের দৃশ্য, হত্যার দৃশ্য আগেও দেখা যেত। ‘মহানগর’ (১৯৬৩) ছবিতে সত্যজিৎ রায় স্পষ্ট করে বাথরুম আর টয়লেটের তফাৎ করে দিয়েছিলেন। বাড়িরটা বাথরুম আর সওদাগরি অফিসেরটা টয়লেট। বাথরুম থেকে বীণা উঁকি মেরে বৌদিকে পুঁইশাকের ঘন্ট রান্নার বিষয় জিগ্যেস করে আর ওদিকে আরতি প্রথম মাইনের টাকা পেয়ে আনন্দের আবেগ প্রকাশ করতে অফিসের টয়লেটে যায়, টাকার গন্ধ শোঁকে। আর এক ক্লাইমেক্স দৃশ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত ইডিথকে হন্তদন্ত হয়ে টয়লেটে ঢুকতে দেখে আরতিও ঢুকে পড়ে। ইডিথকে মিথ্যে অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে জেনে সেই মুহূর্তে জীবনমরণ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, চাকরি ছেড়ে দেয়। একদিকে আনন্দের আবেগ প্রকাশের জায়গা অন্যদিকে কঠিন পরিস্থিতিতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা টয়লেট হওয়া সত্ত্বেও এই স্থানটিকে কেউ সেভাবে ব্যবহার করলেন না পরবর্তী পরিচালকেরা। একটা অন্ধকার বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলে জীবনের অঙ্গ করে নেওয়া আজও সম্ভব হলো না। সুবিধার্থে শোবার ঘরে অ্যাটাচড বাথ করলেও এখনও অনেকে গামছা পড়েই সেখানে যান। আগে তবু গোঁসা ঘর থাকতো অনেক বাড়িতে এখন বাথরুমই হলো জীবনের ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশের লুকনো জায়গা। তাই নিজেকে চেনাজানা এলোমেলো ভাবনার প্রয়োজনে বিশ্রামের জন্যে চাই একটা রেস্টরুম।