Next
Previous
5

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in




রাস্তাটা হবার পর এই এলাকায় শহুরে ভাব খানিকটা এসেছে। তবে পুকুর, ধানক্ষেত, খড়ে ছাওয়া ঘর সবই এখনো আছে। তাহলেও জমির দাম বাড়ছে। পাঁচ-সাত বছরেই ভোল পাল্টে যাবে।

এই যে রাস্তার কাছেই প্রায় ছ কাঠা জমি নিয়ে একতলা বাড়িটা, এর মালিক রামরতন বক্সি ছিয়াশিটি বছর ধরাধামে কাটিয়ে গতমাসে ওপারে চলে গেছেন। একাই থাকতেন। ঠিক পেছনেই নাড়ু পিসীর বাড়ি, তারও আশিপেরিয়েছে। এক সময় যে আসত সে ই নারকোল নাড়ু পেতোতাই নাম হয়ে গেছে নাড়ুপিসী। রামরতনের জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যেই, বাড়ি-জমির মালিকানা একই সূত্রে পাওয়া। নাড়ুপিসীও একাই থাকে।
বেলা আড়াইটে-তিনটে হবে, নাড়ুপিসী খেয়েদেয়ে রদ্দুরে বসেছে। এমন সময় বিশুর আগমন। প্রোমোটার কানাই সরখেল পাঠিয়েছে।
-“ কী খবর নাড়ুপিসী, কেমন আছো গো? অনেকদিন আসা হয়নি এদিকে ..”
-“ আমড়াগাছি না করে যা বলার বল, ভ্যাজভ্যাজ করিসনি..”
নাড়ুপিসী শুধু ফোর-কেলাস পাশ, কিন্তু বুদ্ধি এই আশি বছরেও নতুন ব্লেডের মতো ধারালো। বিশুকে দেখেইব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
-“ মানে বলছিলাম কি, রামবাবু তো গেলেন। কী যে ভালো মানুষ ছিলেন…”
-“চুপ কর। ভালো মানুষ! আমার জমি থেকে তিনহাত বেড়া দিয়ে নিয়ে রেখেছে…এবার বেড়া ভেঙ্গে দেবো।”
বিশু দেখল এই লাইন নেওয়াটা ঠিক হয়নি। আজকাল টিভিতে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ বলে একটা কথা খুব শোনা যায়। বিশু অনেকটা তাই করল।
-“ তা তোমার দাদা না কি যেন হোতো, ভালবেসে বোন ভাইফোঁটায় একফালি জমি দিয়েই দেবে ভেবেছিল হয়তো … পাড়ার লোকজনের কাছে তো বদনাম শুনিনি ..”
গলার স্বরএকপর্দা রুক্ষ্ম করে নাড়ুপিসী বলল-“কানাই পেমোটার কী বলে পাঠিয়েছে খোলসা করে বল”
-“ না মানে, রামবাবুর তো আর কেউ থাকবার নেই এখানে, এ বাজারে জমিটার দাম কত হবে জানো? তুমি যদি কথাটথা বলিয়ে দাও তাহলে দালালি হিসেবে …”
- “ কী বললি, আমি দালাল?..”
-“ না না, মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেছে, ওই মধ্যস্থতা না কী যেন… ওই বাবদ ভালো টাকা পাবে গো..”
-“চুলোয় যাক তোর পেমোটার। ওইটা দেখেছিস?”
-“ কোনটা?”
-“ এদিকে আয় .. এইখান থেকে দ্যাখ …”
-“ কী দেখব ..”
-“ উফ তোর মতো গাধাটাকেকেন যে অত বড় পেমোটার পুষছে.. ওই কাপড় শুকোবার দড়িটা দেখেছিস ..”
বিশুর এতক্ষণ চোখে পড়েনি।
নাড়ুপিসী বলল –“ যে বাড়িতে যাবি হালচাল বুঝতে, কাপড় শুকোবার দড়িটা আগে দেখে নিবি। বিশেষ করে দুপুর বেলায়.. বাড়িতে কে এলো, কে চলে গেলো, সব বুঝতে পারবি। এতদিন সাদাসাদা পায়জামা আর গেড়ুয়া ফতুয়া শুকোতো।
“ওই দ্যাখ, ফতুয়ার জায়গায়ছোটছোট দুটো হাফ-প্যান্ট আর জামা ঝুলছে। ইস্কুল ডেরেস। রামের নাতি-পুতি এসেছে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে, এখানেই থাকবে”
নাড়ুপিসী উঠল। –“ এবার বিদেয় হ বাবা। তুই আবার আমার কাপড় শুকোবার দড়িটা দেখছিস যে বড় … জেনে রাখ আমারও হাফ-প্যান্ট, ফ্রক সব আছে..”
-“ অ্যাঁ, তোমার হাফ-প্যান্ট!!”
-“ হ্যাঁ রে আমারও পুতি, পুতিনি আছে, হাওড়ায় থাকে। আমি মরলেএখানে চলে আসতেবলা আছে …”
বিশু ফেরার পথ ধরল। যাচ্ছেতাই। কাজের খবর আনলেকানাইদা সাড়ে-তিনশো দেয়, আজ পঞ্চাশও দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

****

শীতের বেলা ঢলে এসেছে। একটু পরেই মাঠ থেকে গরুছাগল ফিরে আসবে। পাখিদেরও আর বেশি সময় নেই, সন্ধে নামবে। অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিল নাড়ুপিসী।
লোকে সাদা চোখে দেখেকাপড় শুকোবার দড়ি দুদিক থেকে টানটান করে বাঁধা। তা কিন্তু নয়। দড়িরএকদিকটাআসলে বাঁধা থাকে না। খোলা সেই ডগাটা বাতাসে এলোমেলো ভাসতে থাকে। সেদিক দিয়ে সাদা পায়জামা আর ফতুয়ারা একটা একটা করে কোথায় যে উধাও হয়ে যায় তা কি কেউ জানে?তবে হ্যাঁ, দড়ির ওপর তারপর যদিছোট ছেলেমেয়েদেরইস্কুল ডেরেস ঝুলতেদেখা যায় তাহলে অবিশ্যিদুঃখু করার কিছু নেই…