Next
Previous
1

প্রবন্ধ - পৃথা কুণ্ডু

Posted in


নদী ভালবাসেন? বেড়াতে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তিরতির করে বয়ে চলা জলের ধারা? ‘আমাদের ছোট নদী’ আর ‘অঞ্জনা নদীতীরে’ দুলে দুলে মুখস্থ করার সেই সহজপাঠের দিনগুলো মনে পড়ে? সুর করে পড়লে মনে রাখতে সুবিধে হত কিনা, বলুন? এখনও, সারাদিন অফিস করে ফেরার পথে লোকাল ট্রেনের বদলে বেশিরভাগ দিন লঞ্চঘাটের দিকে পা বাড়ান, নদীর বাতাসটুকু মেখে নেবার লোভে? কেন বলুন তো? আসলে ওই নদীটা বইছে প্রাণের মধ্যেই, আপনার-আমার শিরায় শিরায়, জীবনের বাঁকে বাঁকে কত না পলি জমিয়ে, কখনও পুরনো খাত ভেঙ্গেচুরে গড়ে নিচ্ছে নতুন গতিপথ। কখনও মিলিয়ে নিচ্ছে নিজের বুকের মাঝে উপনদীর স্রোত, শাখায় প্রশাখায় ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেকে, কখনও আবার ভেদ গড়ে দিচ্ছে এপার ওপারের মধ্যে। নদীর গান মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠলে ভেতর আর বাইরেটাকে মিলিয়ে নিতে সাধ জাগে অজান্তেই। শুধু নদীর গান নয়, নৌকা আর মাঝির গানও-- তাদের বাদ দিলে পারানির কড়ি দেওয়াও হয়ে ওঠে না, সোনার ধান বয়ে নিয়ে চলে যাবার শূন্যতাও ধরা পড়ে না এক-জীবন-ভরা নদীর জোয়ার ভাঁটার খেলায়। যিনি নদী নিয়ে এত এত লিখলেন, সেই ‘সোনার তরী’ থেকে বলাকার ‘চঞ্চলা’ হয়ে ‘শেষ খেয়া’-- তাঁর গানের ধারাও কি নদীর মত নয়?

স্কুলে সেই ভূগোলের বইতে পড়েছি, আদর্শ নদীর মধ্যে নাকি উচ্চগতি, মধ্যগতি, নিম্নগতি পরিষ্কার বোঝা যায়। উচ্চগতির মধ্যে একটা পাগলামো থাকে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাহাড় থেকে নামতে চাওয়ার মাতন থাকে। ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’য় সেই দুর্বার পাহাড়িয়া নদীর গতিবেগের আভাস। কিন্তু ছোটবেলায় শুনতাম, বেশিরভাগ শিল্পী গানটা গাইতেন চাপা গলায়, মাঝারি লয়ে- ভাল লাগত না তেমন। পরে যখন চমকে উঠলাম এ গানের অন্য রকম এক পরিবেশন শুনে- উঁচু স্কেলে, দ্রুত লয়ে, প্রায় এক দমে- তখন নদীর কথা রইল কেবল শুরুর দিকটায়, বাকি গানটা হয়ে গেল ‘স্তব্ধ চাঁপার তরু’র। নদীর উচ্চগতি খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েছি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। সে মাতনকে সুরে বাঁধতে চাননি কবি, শুধু কবিতা হয়েই রয়ে গেছে। বাঁধলে হয়ত নদীর উচ্চগতির সুর কেমন হতে পারে, তার একটা আদল পাওয়া যেত। কবিতাটা বহুবার শোনা; যেখানে বড় হয়ে ওঠা- সে এলাকার এক গণ্যমান্য মানুষ প্রায়ই আবৃত্তি করতেন কাছেপিঠের কোন না কোন অনুষ্ঠানে, শুনে শুনে কানে লেগে থাকত। মানে বুঝি আর না-ই বুঝি, বড় আপসোস ছিল, এমন একটা কবিতায় সুর দেওয়া হয়নি কেন? সে দুঃখও অবশ্য খানিকটা ঘুচেছিল অনেক পরে, যখন প্রথমবার ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ শুনেছিলাম ‘পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে’ চলা ‘সুরের সুরধুনী’কে নামিয়ে আনতে পারার মত এক ভগীরথের কণ্ঠে। ওই এক লাইনেই বুঝিয়ে দেওয়া, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ গান হলে কী হতে পারত!

মধ্যগতির নদীতে কত রকমের বৈচিত্র্য; টপ্পা, খেয়াল, হরেক রকমের রাগ-ভাঙা গান আর নানান লোকসুর তাতে মেশে উপনদীর মত, আর সে বৈচিত্র্যের এক-এক রূপ হয়ে শাখানদীর মত ছড়িয়ে পড়েন, ভাবনায়-ভালোলাগায় মনের অববাহিকার বিস্তীর্ণ মাটি ভিজিয়ে দেন দেবব্রত-হেমন্ত, কণিকা-সুচিত্রা-ঋতু গুহরা। একত্রিশ বছর বয়সে লেখা ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’র মত একটা গানের আসল ভাবের বয়স বুঝিয়ে দেন দেবব্রত, তাঁর নাটকীয় গায়কিতে। ‘চিরকুমার সভা’র হাসির আবহে বাঁধা ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’-এর মত একটি গান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় কেমন করে যে বেদনার গান হয়ে বেজে ওঠে, সে হিসেব ভেসে যায় স্রোতের লীলায়। অনেক পরে ‘পারমিতার একদিন’ ছবিতে নতুন করে ভাল লাগা এই গানের অভিব্যক্তিতেও কিন্তু সেই করুণ রসের ধারাটিই রয়ে যায়, কৌতুকের উৎসকে দেয় ভুলিয়ে। রক্তকরবীর বিশু পাগলের গান ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার’ নদীকে মিশিয়ে দেয় ‘দুখের পারাবারে’; বুঝি দেবব্রত বিশ্বাস ছাড়া আর কারও গলায় এমনি করে মানাত না, ‘কানায় কানায় কানাকানি এপারে ওপারে’ হলে শুনতে কেমন লাগে, তাও থাকত অধরা। অবশ্য সুচিত্রা মিত্র বা ঋতু গুহর গলাতেও এ গান শোনা আর এক রকম অভিজ্ঞতা বৈকি।

তবে নদীর গানে সবচেয়ে বেশি মন ছুঁয়ে যায় বাউল আর সারি, ভাটিয়ালি-ঘেঁষা সুর-- গান যিনি লিখেছেন, একথা তাঁর চেয়ে বেশি তো আর কেউ জানত না! শিলাইদহে বোটে বসে কোন এক অখ্যাত মাঝির গান শুনতে শুনতে যে মানুষটির মনে হত, জীবনটা ওইখান থেকে আবার শুরু করতে পারলে বেশ হয়, তাঁর লেখা নদীর গানের সংখ্যা আর সুর মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, লোকসুরের প্রতি তাঁর প্রাণের টান কতখানি। নদীর জলের ছলছল শব্দ, জোয়ার ভাঁটার টান, অতল গহন উদাসী ভাবের পাশাপাশি মরা গাঙে বান আসার তেজ-- সবকিছুই স্বর খুঁজে পায় বাউল বা সারি অঙ্গের অবাধ, উদার, খোলামেলা আঙ্গিনায়। ‘তোমার খোলা হাওয়া’ অনেকেই গেয়েছেন, আমাদের অনেকের খুব চেনা, প্রিয় গান, তবে এ গান যখন প্রাণ পায় সুচিত্রা মিত্রের গলায়, মনে হয় এর জন্যই বলা যায় ‘টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি’। একই কথা বলা যায় ‘আমার শেষ পারানির কড়ি’ সম্বন্ধে- কিন্তু সে গানের ভঙ্গি, ভাব আলাদা।

‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ প্রথম শোনা ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ ছবিতে, অনেক ছোটবেলায়- তখন মনীষীদের জীবন নিয়ে শিক্ষামূলক ছবি মাঝে মধ্যে টিভিতে দেখালে, একটু বসে দেখার অনুমতি মিলত। শিক্ষা কতটুকু কী পেয়েছিলাম সেই বয়সে, এতদিন পরে আর মনে নেই। কিন্তু ভুলতে পারিনি গানগুলো, বিশেষ করে ‘জয় মা বলে ভাসা তরী---ই’, ‘খুলে ফেল সব দড়াদড়ি---ই’, ‘যা হয় হবে বাঁচি মরি---ই’ বলে টান দিয়ে একটা করে ঝাঁকুনি, আর সেই সুরেলা ধাক্কায় মূল গায়কের সঙ্গে কোরাসের গলাগুলো কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া-- সব মিলিয়ে একটা আশ্চর্য উদ্দীপনা জাগার অনুভূতি। সেই গায়কের নাম জেনেছি বছর কয়েক পরে, আর অবাক হয়ে ভেবেছি, ওই গলাতেই ‘আমি ফিরব না রে’ এত অন্যরকম শোনায়! সেই একই নৌকো বাওয়া, বাঁধন-ছেঁড়ার উচ্ছ্বাস, জোয়ারের আমেজ আছে, কিন্তু ধাক্কা নেই, লগি ঠেলতে জোর দিতে হয় না, শুধু হাওয়ার মুখে গানের তরী ভাসিয়ে দিলেই হয়। আবার অন্য আমেজে গাওয়া ‘কে বলে যাও যাও’-- জোয়ার-ভাঁটা সেখানে একই গতির দুই অভিমুখ-- ‘ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে’ বলতে বলতে তারসপ্তকের পা অবধি চলে যাওয়া যায় অবলীলায়, আবার ‘জোয়ার জলে তীরের তলে ফিরে তরী’ বাইতে বাইতে আরাম করে মাঝের সপ্তকে নেমে খেলে বেড়ানো যায়- কোনটা জোয়ার, কোনটা যে ভাঁটা- ভেবে মরুক লোকে! ‘আর নাইরে বেলা নামল ছায়া ধরণীতে’ গাইলে আবার আর এক রকম মেজাজ- ‘জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে’-র টানে মিশে যায় ইমনের সাথে বাউল, ‘ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে’ গাইবার সময় গভীর জলতরঙ্গের আমেজে ‘পা’ থেকে কড়ি আর শুদ্ধ মা, ‘গা’ ‘ধা’ ছুঁয়ে ছুঁয়ে তুলে আনা এক রহস্যের অভিব্যক্তি মনে পড়িয়ে দেয় ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র ভাবসাদৃশ্য- কবিতায়, গানে, গায়নে কী গভীর ষড়যন্ত্র!

এ ষড়যন্ত্র পিছু ছাড়ে না, সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে উঠে আসার উপায় পর্যন্ত নেই! সেই সন্ধ্যার প্রায়-অন্ধকার একাকিত্বকে আরও জমাট, ভরাট বেদনার কুয়াশায় ভরে দিয়ে আবার পেছন থেকে ডাক আসে, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে...’। অসীম এই দূরত্ব পার হতে চাওয়ার আর্তি নিজের অতলে নিজেই ডুব দেয়, এক স্বর থেকে আর এক স্বরে যেতে গিয়েও ধরে রাখে ব্যবধানের সুরসাম্য। ঘরে আধা- বাইরে আধা- এমন ‘যে জন আছে মাঝখানে’র নিবিড় রিক্ততার বেদনা যে কেমন করে পূরবীর আবেশে সন্ধ্যার আকাশ বাতাস নদীজল স্তব্ধ করে দিতে পারে এমন ইন্দ্রজালে-- এ গান না সৃষ্টি হলে, গাওয়া না হলে চির রহস্যময়ী নদীও বোধহয় বুঝতে পারত না নিজের ‘অতল জলের আহবান’।

এই সন্ধ্যার আবহেই মনে পড়ে আর এক অবিস্মরণীয় নদীর গান, খেয়ার গান- কিন্তু ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হিসেবে তার ছাড়পত্র মেলে না- স্বয়ং কবি তাঁর ‘শেষ খেয়া’ কবিতায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের দেওয়া সুর অনুমোদন করা সত্ত্বেও- না! তা হলই বা, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানের আবেদন তাতে আটকায় না। ‘মুক্তি’ ছবিতে পঙ্কজকুমারের কণ্ঠে এ গানের প্রয়োগ সেই তিরিশের দশক থেকেই ইতিহাস-- কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠার ইতিহাস। ছোটবেলায় পড়েছি না, ইতিহাস বহতা নদীর মত! এক ইতিহাস থেকেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টির প্রেরণা আসে-- পরিবর্তনে, পরিবর্ধনে, সম্মিলনে। তাই হল আবার, যখন ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে এ গান নতুন করে গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁর শ্রদ্ধেয় পঙ্কজদার অনুমতি নিয়েই, কিন্তু ‘সঞ্চারী’ অংশে জুড়ে নিলেন ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি, নিজের সুরে। স্বরবিতানে জায়গা না মিলুক, রবীন্দ্রনাথের খেয়ার গান, নদীর গানের কথা বলতে গেলে ‘দিনের শেষে’কে বাদ দেওয়া- ‘অসম্ভব, সে অসম্ভব’।

‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ ভেসে নদী-মোহনার পানে শেষ খেয়ার এই অনির্দেশ্য যাত্রা একটু একটু করে বাঁক নিয়ে নেয় নিম্নগতিতে। স্রোত তখন মৃদু, লয় তাই ধীর, কিন্তু ব্যাপ্তি কী বিশাল! সেই স্রোতে আলতো করে খেলার ছলে গানের বাণীকে নৌকোর মত ভাসিয়ে দেওয়া যায়; সেখানে ঝড় নেই, উত্তাল ঢেউ নেই, আছে শুধু জীবনের দীর্ঘ চলার ভার-- তবে সেই ভার নিয়েও চিন্তা নেই, ডুবে গেলেও যা, ভেসে উঠলেও তাই-- সবই খেলা। ‘না হয় ডুবে গেলই, না হয় গেলই বা/ না হয় তুলে লও গো, না হয় ফেলই বা/... এই খেলাতেই আপন মনে ধন্য মানি।’ এ কথা সে নদীই বলতে পারে, যার অনন্তে মেশার সময় এসে গেছে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, যদি বলি-- এমন একখানা গান কিন্তু শোনার অভ্যাস বা জনপ্রিয়তার বিচারে ‘ওগো নদী আপন বেগে’, ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘এবার তোর মরা গাঙে’, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে’ এমনকি উচ্চাঙ্গ-ঘেঁষা ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার’-এর তুলনায়ও একটু যেন পিছিয়ে থাকে। আসলে এই বোধহয় নদীর নিয়ম, সে যখন সাগরে মেশে, পরম মোহনার সাথে সঙ্গমের জন্য নিজেকে ছড়িয়ে দেয় অপার করে, অশেষ করে- তখন তার আর নৌকা বওয়ার, হাজার হাজার যাত্রীকে খুশি করার দায় নেই। তখন তার শুধু অবরোহ-যাত্রায় সাগর-স্বরূপে ফেরাটুকু থাকে বাকি- আবর্তনে শেষ দুটো শব্দ তাই গড়িয়ে যায় মন্দ্র-ধীর স্রোতে, প্রায় নিস্তরঙ্গ, কেবল একটু বাতাসের ছোঁয়া-লাগা কম্পনে- গা মা পপা মা গা রা(কোমল) সা-তে – ‘গা-নে-র বা-ণী-’।

ভাগ্যিস, এ গানটাও গেয়ে রাখা হয়েছিল- অন্তত এমন কারও জন্য, যে নেহাত নালা হয়েও মজে যায়নি, সাহস করে মহানদীর স্রোতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, মিলিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত যে কিনা সমুদ্রের স্বাদ চেয়েছে।