ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিকদ্বিতীয় পর্ব
গাড়ি করে আরও লোক থানাতে ঢোকে।দেখি, শহরের কিছু উঠতি বিল্ডারের দল।
গাছের নীচে জটলা বাড়ে। হাসির আওয়াজ কানে আসে। আশীষ সরকারকে বলতে শুনি--- কোথায় যাবে? কনজিউমার ফোরাম? যাক্ না, যেখানে খুশি যাক। আমার কোন চিন্তা নেই।
এদিকে প্রায় জনাদশেকের বয়ান হয়ে গেছে।
আমি উশ্খুশ্ করি। আমাদের বয়ান কখন নেয়া হবে?
-- ভেতরে গিয়ে বসুন। আগে এদেরটা হোক।
--- ক্যানো? মার আমরা খেয়েছি, ওরা মেরেছে। ওদের বয়ান আগে হবে ক্যানো?
---- না, না, আপনারা আগে মেরেছেন, গুলি চালিয়েছেন। ওরা তাই আগে কমপ্লেন করেছে, ওদের বয়ান আগে লেখা হবে।
এভাবে রাত চারটে বেজে যায়।
নিজেদের মধ্যে কথা বলি।
--- কে মারলো রে ? কি দিয়ে?
-- আরে পাঁচপাঁচ্জন মিলে একেক্জনে ধরে রেখেছে। অন্যেরা মেরেছে। অমিতাভকে তো হরিয়ানার গুন্ডা ভেবে মাটিতে পেড়ে ফেলে খুব মেরেছে। পেটের ওপর দাইনিং চেয়ার দিয়ে মেরেছে। পায়াগুলোর নীচে পেতলের পাত দেয়া ছিল। গোল গোল রক্তমাখা দাগ হয়ে গেছে।
অমিতাভ জামা তুলে দেখায়। আমার লাইসেন্স রিভলবার, মোবাইল সব কেড়ে নিয়েছে। পার্সও পাচ্ছি না। কাউকে কনট্যাক্ট করতে পারছি না। সব নম্বরতো মোবাইলে সেভ করা ছিল। ---কি করে এত সহজে মারতে পারলো?
-- আরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মোবাইল সায়লেন্ট করে ঘুমোচ্ছিলাম। যখন উঠে দরজা খুল্লাম, তখন কবাট পুরো আমার গায়ের ওপর পড়ে গেল, আগেই ভাঙা হয়ে গেছিল। আগের থেকে টের পেলে কি আর--।
রেণু বলতে শুরু করে--- আমাকে আপনাদের ব্যাংকের ওই মুখার্জির ছেলে বুকে আর তলপেটে দমাদ্দম লাথি মেরেছে। মিসেস্ মুখার্জি আর গুড্ডি সেনগুপ্ত, গুরবীন কৌর এরা মশারীর ডান্ডা কমোডের ভাঙা রড এসব দিয়ে মেরেছে।মাটিতে ফেলে পেটের ওপর বড় বড় গোদরেজের তালা দিয়ে তুলে তুলে মেরেছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। গুড্ডি সেনগুপ্ত আমার হাতের হীরের ব্রেসলেট জোড়া খুলে নিয়েছে।
সব্জিকাটার ছুরি দিয়ে আঙুলের ফাঁকে খোঁচাচ্ছিল যাতে হীরের আংটিটা নিতে পারে।শেষে ওর শ্বাশুড়ি এসে ওর হাত থেকে ওটা কেড়ে নেয়। দেখুন কেমন ঘা হয়ে গেছে। আর আপনাদের ওপরের মিসেস সিং, যার ওয়াশিং মেশিন খারাপ হওয়ায় আপনি কোম্পানি থেকে মেকানিক আনিয়ে দিয়েছিলেন, সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পরিষ্কার করিয়ে ছিলেন সে এসে আমাকে মারার জন্যে আর আপন
"---আর আপনাকে ঘর থেকে বের করার জন্যে ওস্কাচ্ছিল।''
--- আর প্রবীণ তুমি?
---শুনুন, আপনারা ওদের উস্কানিতে না বেরিয়ে ঠিক কাজ করেছেন। আপনাদের চেষ্টায় সি এস পি না আসলে আমাকে বোধহয় আরও মারতো। পাঁজরের হাড় দু-একটা গেছে মনে হয়, বড় ব্যথা।
আরে, ওরা যখন রেণুকে মারতে লাগলো, ওর মোবাইল কেড়ে নিল,--- আমি তখন দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রায়পুরের আই জি, অ্যাডিশনাল আইজি ওদের লাগাচ্ছিলাম। কিন্তু কোন কনট্যাক্ট হল না। তাই আপনাদের চেষ্টা করতে বলেছিলাম।
[ এতে হরিদাস পাল রঞ্জনের অপরাধবোধ কি একটু কমলো? তবে ওর ছোট মেয়ে আজও ফিল করে। বাংলা লিখতে পারে না, তাই www.eee-eee@wordpress.com ইংরেজিতে ব্লগ লেখে। ও লিখেছে যে ""চোখের সামনে বাপ-মাকে ঠ্যাঙানি খেতে দ্যাখা-- এর চেয়ে বড় আতংক কিছু হতে পারে না। তাই সেদিন বেরোতে পারিনি। কিন্তু এটা কোন জাস্টিফিকেশন নয়। আজও সেই মহিলার চিৎকার আমাকে তাড়া করে।'']
ইতিমধ্যে রাত চারটে বেজেছে। ওদের বয়ান শেষ হয়েছে। ওরা বিজয়ীর হাসি ছুঁড়ে দিয়ে প্রায় ক্রিকেট ম্যাচ জেতার ভঙ্গীতে গাড়িগুলো স্টার্ট করিয়ে চলে গেল।
এবার আমাদের পালা। কিন্তু একী? কোথ্থেকে হাজির হল সেই সাব ইন্সপেক্টর সাহু, আসল থানেদার কোরবায় যাওয়ায় আজকে রাতের মত ওই নাকি ইন্চার্জ!
ও বল্লো-- রাত শেষ হতে বেশি বাকি নেই। আপনাদের বয়ান সক্কালে লেখা হবে।
আমরা ঘরে গিয়ে দু'একঘন্টা লম্বা হয়ে তারপর আসছি। ততক্ষণ দুই মহিলা রেণু আর রায় ম্যাডম মহিলা পুলিশ থানায় যাবে, আর তিনজন পুরুষ এখানেই অপেক্ষা করবে। আমার কেমন যেন লাগে। কী বলবো বোঝার আগেই প্রবীণ গর্জে ওঠে।
--না, মহিলা থানায় কেউ যাবে না। ওখানে টর্চার করা হয়।
-- কে বল্লে?
-- আমি বলছি। মাস দেড়েক আগে আপনিই ঝুঠমুঠ চার্জ লাগিয়েআমার স্ত্রীকে রাত্তিরে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই মহিলা থানায় রেখেছিলেন। ওরা পরের দিন দুপুর পর্য্যন্ত আপনারই ইশারায় জল-গ্লুকোজ- ফলের রস কিচুই খেতে দেয় নি। ওপ পা ফুলে গিয়েছিল।
এবার আমি বলি--- না, আমরা পাঁচজন একসাথেই থাকবো। আমরা অপরাধী নাকি? স্বেচ্ছায় স্টেটমেন্ট দিতে এসেছি।
---- আপনাদের ভালোর জন্যেই বলা। সেফটির জন্যে।
---- বালের সেফটি! সিভিল লাইনস্ থানায় যদি আমাদের মহিলারা সেফ না হয় তো কি মহিলা থানায়? এর চেয়ে তো নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরা বেটার অপশন্।
--- সেখানে যদি আবার হামলা হয় ? মারে?
--- আপনাদের রাজত্বে যদি এরকমই হয় তো হবে! আমরা একসাথে থাকবো। যা থাকে কপালে।
-- ইয়ার্কি পেয়েছেন? আগে স্টেটমেন্ট নিন।
--- বেশ, পরিহার! এদের স্টেটমেন্ট নাও।
বাবলু বলে--- দাদা, আমি যাই। সকালে খবর পেলেই আসবো। আমি বিল্ডরদের অ্যাসোসিয়েশন এর সঙ্গে কথা বল্লাম। ওরা বলছে ---আমাদের রায়পরিবারের সঙ্গে কোন বিবাদ নেই। কিন্তু হরিয়ানাওলাদের বুখারির ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে।
দাদা, আমি বলেছি যে হরিয়ানাওলারা চুলোয় যাক, কিন্তু রায়পরিবার আমাদের ঘরের লোক, ওদের গায়ে যেন আঁচটুকু না লাগে।
প্রবীণ বয়ান দিতে শুরু করে। কিন্তু তিনলাইনের পরই রাইটারের কলম থেমে যায়। প্রবীণ যত বলে যে ---আমাদের ঘরে এত রাতে দরজা ভাঙা হল, এত লোক ঢুকে মারতে এল, ও ততই বলে-- এসব তো ম্যাটার অফ ইনভেস্টিগেশন। নীচের মারপিট ও গুলি চলার থেকে বলুন।
--- ধ্যাত্তেরি! আমার কথাটা না লিখলে কি ইনভেস্টিগেট করবেন? আর নীচে কোন ঝগড়া হয় নি, গুলিও চলে নি।
আমি একজন অ্যাডভোকেট। লিখে দিচ্ছি, সেটাই রেখে নিন।
ওরা তাতেও রাজি নয়।
শেষে প্রবীণ রেগে গিয়ে বল্লো-- স্টেটমেন্ট দেবো না। বাপ্কা রাজ হ্যায় ক্যা? শালে ভূতনীকে!এখানে কোন ন্যায় হবে না। যা বলার কোর্টেই বলবো।
পুলিশের দল হাই তোলে। আমার কেমন মনে হয়-- ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটের গলিতে রাতজেগে ক্লান্ত মহিলার দল। ফিক ফিক করে হাসি আসে।
এবার ওরা উঠে দাঁড়ায়। আমি বলি--- আমি বয়ান দেবো, বাড়ি যাবো।
ওরা বলে --দুই সেপাই রইলো। কিচু দরকার হলে বলবেন। সকাল বেলায় এসে বাকিদের বয়ান নেব।
কী করি? আকাশ ফরসা হচ্ছে। সিপাহীরা জামা খুলে বেঞ্চিতে শোয়ার জোগাড় করছে। আমাকে একজন জানায় --আপনাদের নামে তো এফ আই আর দর্জ হয়েছে। আর্মস্ অ্যাক্টের কিছু ধারা লাগিয়ে চালান কাটা হয়ে গেছে। ওরা আর আপনাদের বয়ান নিতে উৎসাহী নয়।
আমার বিশ্বাস হয় না। বাজে কথা। আমরা করেছিটা কী?
মাথা ধরে গেছে। বন্ধুর ফোন আসে। সব ঠিক আছে?
আমি বলি হ্যাঁ, সব শোরের বাচ্চা শুতে গেছে। আমাদের বয়ান রোদ উঠলে নেবে। তারপর বাড়ি গিয়ে শোব। ভাবীজি ঠিক আছে।
মাথা ধরেছে। পায়ে পায়ে বেরিয়ে থানার সামনে চায়ের ঠেলার কাছে দাঁড়াই। হাফপ্যান্টের পকেট হাতড়াই। হ্যাঁ, গোটা পাঁচেক কড়িমিঠি চায়ের জোগাড় আছে। বাকিদের ও ইশারায় ডাকি। চা ফুটছে।
প্রবীণ এসে বলে-- এখান থেকে চলুন, আগলা কদম কী হবে তাই নিয়ে কথা বলা দরকার।
---- হ্যাঁ, চা খেতে খেতে--।
--- ধ্যাৎ, বইপড়া বাঙালী বুদ্ধি! শিগ্গির, যত শিগ্গির পারেন এই থানার থেকে দূরে চলুন।
আমি হতভম্ব! কী হয়েছে?
--- আরে আমাদের অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট কাটা হয়ে গেছে। সি এস পি র কোয়ার্টারে ফাইনাল করতে গেছে, তাই টাইম নিয়েছে। শুতে যায় নি। আধঘন্টার মধ্যে এসে আমাদের অ্যারেস্ট করবে, পাঁচজনকেই।
--- দুর মশাই, আমাদের দুজনকে কেন করবে? আমাদের কাছে বন্দুকও নেই, চালাতেও জানি না। কেউ বিশেআস করবে না।
----- কেন সেধে বাঁশ পোঁদে ঢোকাচ্ছেন?
শিগ্গির চলুন। এটা তো পয়সা খাইয়ে করানো হচ্ছে। গতবার রেণু অ্যারেস্ট হলে আমি আর ম্যাডম রায় বেলের জন্যে তদ্বির করেছিলেম। তো আমাদের ওপর হরিজন অত্যাচার অধিনিয়ম এ অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরুল। আমি আর আপনার স্ত্রী পালিয়ে রায়পুর আর ভিলাইয়ে রইলাম, পুলিশ মন্ত্রী, পুলিশের বড়কত্তা , মানবাধিকার সব করে ওর জামিন করালাম। আপনি ছুটি নিয়ে বিলাসপুর কোর্টে ফলো আপ করলেন।
এখন আমাদের সবাইকে আর্মস্ অ্যাক্টে জেলে পুরলে জামানত কে করাবে? আপনার মেয়েরা ?বন্ধুবান্ধব? কদিন? অবারই চাকরি-বাকরি আছে। এসব ধারায় জামিন পেতে অন্তত: দিন পোনেরো লাগে। তারপর আজ রোববার। কাল ঈদের ছুটি। দু'দিন কোর্ট বন্ধ। ৪৮ ঘন্টার বেশি হাজতবাস হলে আপনার ব্যাংক বাধ্য হয়ে আপনাকে সাসপেন্ড করবে। এই অবস্থায় আপনি থাকবেন কোর্টে কেসের ফয়সালা হয়ে আপনি নির্দোষ সাব্যস্ত না হওয়া পর্য্যন্ত। তাতে কম করে দু'বছর লাগবে। আর ওরা drag করবে যাতে আরও বহুদিন চলে। ফলে আপনি আগামী দশমাস অর্থাৎ রিটায়ার হওয়া পর্য্যন্ত আদ্দেক মাইনে পাবেন। আর রিটায়ার হওয়ার পরও আপনার গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড সব আটকানো থাকবে। এরপরার আপনার লড়াই করার দম থাকবে? শিগ্গির পালান।
হরিদস পাল- ভ্যাবাগঙ্গারাম রঞ্জন কেঁপে ওঠে। বলে-- আমার বন্ধু উকিলের বাড়ি যাই? ওখানে গিয়ে প্ল্যান করি!
--- দুত্তোর! পুলিশ তো সেখনেই আগে খুঁজবে।
--- তবে চলুন রায়পুর। আপনাদের তো ওখানে পুলিশের টপ লেভেলে চেনা আছে, ওখানেই চলুন।হ্যাঁ, এই রক্তমাখা মারখাওয়া, এই হাফপ্যান্ট পরা খালি পা' অবস্থায়। সেটাই ঠিক হবে।
( রঞ্জনের নাটুকে সঙ্কÄ¡ জাগ্রত।)
পয়সা কই? গাড়ি কই? প্রবীণের গাড়ি তো সেই ফ্ল্যাটেই--।
রঞ্জন ওদের খালিপায়েই পা চালিয়ে মর্নিং ওয়াকের দলের মত স্টেডিয়ামের দিকে নিয়ে পেছনের গলিতে এক মার্কেট কমপ্লেক্সের ভেতরে
বন্ধ দোকানগুলোর সামনে মাটিতে বসায়। দেখা গেল প্রবীণের চোর পকেটে যা আছে তাতে রায়পুর যাওয়ার মত ডিজেল হয়ে যাবে। রঞ্জন ওর চেনা এজেন্সিতে ফোন করে গাড়ি চায়, আধঘন্টার মধ্যে, বোলেরো। ফিরে এসে ভাড়া দেবে। কিন্তু সাতসক্কালে পাওয়া গেল ইন্ডিকা। ড্রাইভার শুদ্ধু ছ'জন! পা' মুড়তে মুড়তে যন্ত্রণা হয়ে গেল। এ ওর কাঁধে মাথা, যতটুকু শোয়া যায়। গাড়ি যখন বিলাসপুর জেলার শেষ চেকপোস্ট পেরিয়ে রায়পুরের পুলিশি এলাকায় ঢুকছে তখন রেণুর লুকোনো মোবাইল বেজে উঠলো।
--- আমি এস আই পরিহার বলছি। বয়ান না দিয়েই চলে গেলেন যে? আপনারা এখন কোথায়?
রেণু মোবাইল সম্পূর্ণ ডেড্ করে দেয় যাতে টাওয়ার না বোঝা যায়।
আবার মোবাইল বাজে, এবার আমার। ছোটমেয়ে বলে ---বাবা, তোমরা কোথায়? আমরা ভীষণ চিন্তায় আছি। নিশ্চিন্তে বল, ঘরের ভিতরে আছি। কোন বাইরের লোক নেই।
সব শুনে বলে--- একটু আগে পুলিশ অফিসার মি: পরিহার এসেছিলো। বল্লো--তোমার বাবা কোথায়? ওনার স্টেটমেন্ট নিতে হবে। উনি কি রায়পুর গেছেন? ওনার মোবাইল নম্বর দাও।
আমি বলেছি যে কাল তো আপনাদের সঙ্গেই মাঝরাতে থানায় গেল। তারপর কোন খবর নেই। আর আমরা বিনা অনুমতি কারো নম্বর দিইনে। আপনার নম্বর রেখে যান, আংকল। বাবাকে জানিয়ে দেবো। প্রয়োজন বুঝলে উনিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
আমাদের গাড়ি রায়পুরেরেলাকায় ঢুকে গেছে। অত:কিম্? টপ লেভেলে কার চেনা আছে? অমিতাভ তিওয়ারির। আরে, ওকে ওঠাও, ড্রাইভারকে বলুক, কোন
দিকে।
একি? ওযে ওঠেইনা! ঘুম? ধাক্কা দাও। ঠেলে তোল। উঁহু! ওর মাথা গড়িয়ে পড়ে। বেঁহোশ! সবচেয়ে মার তো ঐ খেয়েছিলো!
আমি ভয়ে পাগল হয়ে যাই।
-- কাছেই হাসপাতাল। শিগ্গির নিয়ে চলো।
রেণু শেষ চেষ্টা করে। ড্রাইভারের জলের বোতল ওর মাথায় মুখে খালি করে। চোখের পাতা কাঁপে।
আস্তে আস্তে উঠে বসে। রাস্তা দেখায়, আমাদের ধড়ে প্রাণ আসে।
দাড়ি গিয়ে থামে মুখ্যমন্ত্রী নিবাসের উল্টোদিকে, বিশাল বাংলোর সামনে অন্তত: সেϾট্রদের দুটো ব্যারিয়ার। অ্যাডিশনাল ডিজি অফ পোলিস, রামনিবাসজী।
ভদ্রলোক যখন বিশবছর আগে চম্বলের দস্যুসাফাই অভিযানে গোয়ালিয়র এস পি হিসেবে নাম কামিয়েছিলেন তখন অমিতাভ ভোপালে TOI এর রিপোর্টার। সেই থেকে বন্ধুত্ব আজও অক্ষুণ্ন।
সিকিউরিটি ভেতরে গিয়ে নাম বলতেই উনি ডেকে পাঠালেন।
হিন্দিসিনেমার পবন দেব নাম ভিলেন রোলের নামকরা অভিনেতার মত চোখ, খাড়া নাক, পাকানো চেহারা, প্রায় সোয়া ছয় ফিট হাইটের জাঠসন্তান।
ভদ্রলোক লবিতে বসে চা-বিস্কুট খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। অমিতাভ ( পায়ে চটি নেই),প্রবীণ( একপায়ে লেডিস চটি), রঞ্জন( হাওয়াই চটি, বারমুডা) এবং উস্কোখুস্কো চেহারায় দুই মহিলাকে দেখে ওনার চোয়াল ঝুলে পড়ল।--
--কী ব্যাপার?সাতসকালে? কী হয়েছে?
উত্তরে অমিতাভ ওর জামাটা তুলে দেখাল। উনি শিউরে উঠলেন । --- কী করে হল? কে করেছে?
সংক্ষেপে শুনে লাফিয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে রেণুকে রত্না ধরে ধরে বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। এবার রেণু আর ব্যথা চেপে রাখতে পারছে না, ইউরিনের সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে। চোখ থেকেজলের ধারা। অনুমতি চেয়ে কফি টেবিলে পা লম্বা করে তুলে দিল। উনি দৌড়ে ভেতর থেকে পেন কিলার ট্যাবলেট আর বি-কমপ্লেক্স এনে সবাইকে দিলেন। রেণুকে বল্লেন-- চা' আর দুটো বিস্কুট খেয়ে তারপর ওষুধ খাবেন।
এর পর নাস্তা আসছে।
ভেতরে গিয়ে বিলাসপুরের আইজিকে ফোন লাগালেন।
--- কী হল? উঠেছেন? ঘুম হচ্ছে আপনার? আপনার নাকের ডগায় এসব কী হচ্ছে?
উত্তরে বিলাসপুরের বড়কত্তা বল্লেন-- আমি কিছু জানিনা। এরা আমার কাছে কেন আসেনি?
এবার উনি গর্জে উঠলেন।
-- না, আপনার কাছে যাবে না। বিলাসপুরের পুলিশকত্তাদের কোন বিশ্বাস নেই। আমি এদের রায়পুরেই মেডিক্যাল চেক আপ করচ্ছি। এখানের সিভিল লাইনস্ থানায় এফ আই আর লিখে জিরো লাগিয়ে বিলাসপুরে নিয়ে গিয়ে নম্বর দেয়া হবে। কিন্তু পুরো ইনভেস্টিগেশন রায়পুরের পি এইচ কিউ থেকে করানো হবে।
আমরা নাস্তা করে চটি কিনে( অমিতাভ ব্যক্তিগত ধার করলেন) থানায় এফ আই আর করাচ্ছিলাম। এখানেও থানেদার ঠিক করে লিখছিলো না।
বোঝাচ্ছিলো--- বিলাসপুর পুলিশের বিরুদ্ধে চার্জ লাগিয়ে লাভ নেই। ঝগড়া হয়েছে বুঝতে পারছি। তাবলে বেশি রঙ চড়িয়ে লেখাবেন না।
আরে, এখন না হয় আপনার কথায় লিখে দিলাম। এটাই তো শেষ কথা নয়। এরপর কোর্টে কেস হবে। বিল্ডার পয়সাওলা, বড় বড় দশটা উকিল লাগাবে। তারা এমন সব প্রশ্ন করবে যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি এক বছর বাদে সব গুছিয়ে বলতে পারবেন না। ফলে কেস কপ্পুর হয়ে উবে যাবে। এতটা বাড়িয়ে--।
উত্তরে আমি অমিতাভের জামাটা হাত দিয়ে উঠিয়ে দিই। রক্তমাখা ক্ষত দেখে এই বাক্যবাগীশ চমকে ওঠে। প্রবীণ ওর রায়পুরের মেডিক্যাল রিপোর্টটা ওর টেবিলে রাখে।
তিনটে পাঁজরের হাড় ভাঙা।
এরপর ও বিনা বাক্যব্যয়ে যা বলা হয় সেটা লিখে নেয়।
এরপর আমরা যাই পুলিশ হেডে্কায়ার্টারে।সেখানে ইম্পর্ট্যান্ট বৈঠক হচ্ছিল। অপারেশন গ্রীনহান্ট? তারপর ডিজি বেরোলেন ওনার গাড়িতে। আমাদের প্রায় দৌড় করিয়ে ওনার গাড়ির গায়ে দাঁড় করিয়ে সংক্ষেপে গল্পটা বলা হল। আমাকেও দাঁড় করানো হল।
--- দেখুন তো স্যার! এই বাঙালী ভদ্রলোক ব্যাংক ম্যানেজার। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। এই দম্পতির কী হাল করেছে দেখুন!
আমি হতবাক।
এই সেই বিতর্কিত Director General of Police বিশ্বরঞ্জন? যিনি সাহিত্যপ্রেমী(?), নকশালবিরোধী অপারেশনের মাঝে রায়গড়ে কত্থক সমারোহ দেখতে যান! রায়পুরে প্রয়াত মার্ক্সিস্ট কবি প্রমোদ বর্মার স্মৃতিতে প্রোগ্রামের আয়োজন করেন!
কিছুদিন আগে তো আমি নেট এ ওনার বার্কলে গিয়ে মানবাধিকার সেমিনারে বিনায়ক সেনকে নিয়ে বক্তব্যের বিরুদ্ধে দিল্লির অধ্যাপিকা নলিনী সুন্দরের মেমোর্যান্ডামে সই করেছি।
আর এখন হরিদাস পাল রঞ্জন বারমুডা পরে ওনার সামনে করুণাভিক্ষা করছে? এইসময় সাউন্ড ট্র্যাকে কী বাজবে?
"" চাচী গো, আমি মইলাম গো, বড় দায়ে ঠেকাইছে আল্লা!
ম্যাঘে দ্যায়্না পানি, কী করি গো নানী,
ক্ষ্যাত হইলো ফুটিফাটা গো,
বড় দায়ে ঠ্যাকাইছে আল্লা।''
বিশ্বরঞ্জন গাড়িতে বসে কথা শুনে নির্দেশ দিলেন ---সবাই যেন অ্যারেস্ট হয়! আর এদের বসিয়ে ভালো করে ডিটেইলড রিপোর্ট লেখাও। একজনকে এই কেসের ব্যাপারে এক্সক্লুসিভ দায়িত্ব দেয়া হল।
ওনার গাড়ি বেরিয়ে গেল। আমাদের নিয়ে এসি কনফারেন্স হলে বসিয়ে কফি-বিস্কিট দেয়া হল। আর কোনের দিকে কাঁচের দরজা দিয়ে এয়ার টাইট করা কামরায় একের পর এক আলাদা করে আমাদের বয়ান লেখাতে লাগলেন একজন চশমা পড়া সৌম্যদর্শন অল্পবয়সী অফিসার।
হলে বসে সেদিনের খবরের কাগজ পড়তে পেলাম। সিটি এডিশন খুলে আমাদের চক্ষুস্থির।
ভোরবেলাতেই আমাদের আসামী করে খবর ছাপা হয়ে গেছে।
খবরে কোথাও বিল্ডার বা তার স্ত্রীর নামগন্ধ নেই। -- ভাড়াটের সঙ্গে ফ্ল্যাটমালিকদের কমিটির ক্ষমতার লড়াইয়ে গুলি চলেছে। জাঠপরিবার ভাড়াটে এবং ক্রিমিনাল স্বভাবের। রেণু ক'দিন আগেও ৪২০ ধারায় ১৫দিন জেলে ছিল।এতে অন্য ফ্ল্যাটবাসীরা ওদের বাড়ি ছাড়তে বলে। এ নিয়ে বচসা হলে ওরা কমিটির প্রেসিডেন্ট মি: মূর্তির ওপর গুলি চালায়। পুলিশে খবর দেয়া হলে পুলিশ আসতে দেরি করে।
তখন ভাড়াটেদের পক্ষে রত্না রায় গিয়ে মিসেস মূর্তি ও অন্যান্যদের সঙ্গে হাতাহাতি করে। শেষে জাঠপরিবারের বেড়াতে আসা বন্ধু অমিতাভ আবার ব্যালকনি থেকে গুলি চালায়। তখন রায়েরা স্বামী-স্ত্রী অমিতাভের পাশে দাঁড়িয়ে প্ররোচনা দিচ্ছিল।
এবার সমস্ত কলোনীবাসী ভয় কে জয় করে যা থাকে কপালে, ভেবে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুক কেড়ে নেয়। তারপর
ওদের কাবু করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
অপরাধীরা থানায় অসহযোগ করে। উঁচুতলায় যোগাযোগের ধমকি দেয়। নিজেদের বয়ান দিতে অস্বীকার করে এবং ভোর রাতে সেপাইদের বড় বাইরে যাওয়ার সুযোগে পালিয়ে যায়। সূত্র অনুযায়ী অপরাধীরা এখন নাকি রায়পুরে এক পুলিশের হোমরাচোমরার আশ্রয়ে আছে।
আমরা মুখচাওয়াচাওয়ি করি।
দুপুরে মেয়ের ফোন এসেছিল।
-- বাবা, বেশ কিছু রিপোর্টার আর চ্যানেলের লোক এসেছে। কিন্তু বিল্ডারের লোকজন আর ফ্ল্যাটের কিছু লোক ওদের ওপরে আসতে দিচ্ছে না। নীচেই কান্না-কান্না সুর করে একতরফা ওদের বয়ান লেখাচ্ছে, ওরা তাই লিখে চলে যাচ্ছে। কেউওপরে আসছে না।
এদিকে তোমাদের রায়পুরের পুলিশের কাছে যাবার খবর পেয়ে বিল্ডার অমিত শর্মা নিজের লোকজন এনে আন্টিদের করিডোরে ফেলে রাখা ফ্রীজ, সোফা, টেবিল সব ঠেলেঠুলে ২১০ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢুকিয়েছে। আর ভাঙা দরজাটা কোনোরকমে ঠুকেঠুকে লাগিয়ে দিয়েছে।
সবার বয়ান শেষ, এবার আমার পালা। অফিসারের পাশে যে অল্পবয়েসী মেয়েটি কম্পুটারে টাইপ করছে তার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আমি তাকে বলি-- বেটি, চিন্তা না করো, হম সংক্ষেপ মেঁ লিখায়েঙ্গে।
কিন্তু বলতে গিয়ে আমার কথা আটকে যায়। হটাৎ যেন আমার গলা কেউ চেপে ধরেছে। কোথা থেকে একটা কান্না গলা ঠেলে উঠে আসছে। চব্বিশ ঘন্টায় এই প্রথম আমার কথা কেউ শুনছে, বলতে দিচ্ছে। একটু মানুষের মত ব্যবহার করছে।
একটু হেসে মাপ চেয়ে জল খেয়ে আমার বয়ান লেখাই। আমার সামনেই ভদ্রলোক পি এইচ কিউ এর নিজস্ব অফিসার এক মহিলাকে ফোনে নির্দেশ দেন।
বলেন-- এদের যে একতরফা মেরেছে সেটা স্পষ্ট। কাজেই তুমি কাল বা পরশু ওখানে সরেজমিনে তদন্ত করে একটা রিপোর্ট এখানে দিও।
এবার ফেরার পালা। সবাই বেশ উল্লসিত।
ডিজি নিজে বলেছেন-- কাজেই কাল বা ওই স্পেশাল অফিসারের তদন্তের রিপোর্ট জমা হলে সব কটা অ্যারেস্ট হবে।
আমি সন্দেহ প্রকাশ করি। ডিজির নির্দেশ মেনে তদন্তের প্রক্রিয়া পুরো না হওয়া পর্য্যন্ত কিছুই হবে না, যখন বিলাসপুরের কলেক্টর, এস পি এবং বিলাসপুরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বিল্ডার লবিকে ব্যাক করছে বলে খবর।
রাত্তিরে ইন্ডিকায় ছ'জন ফেরার সময় ক্লান্তি ও আয়ে ব্যথা চেপে ধরে। ঠিক হয় পুলিশ সঙ্গে করে তবেই ২১০ নম্বরে যাওয়া। কারণ ভেতরে কি অবস্থা করে রেখেছে কেউ জানেনা।প্রথম এϾট্র পুলিশের সামনে হওয়াই ভাল।
আমরা নিজেদের ফ্ল্যাটে যাব। মা ও দুইমেয়ে ওদের বন্ধু আছে। বড়শালীকে ওরা গিয়ে সন্ধ্যের সময় কোলকাতার ট্রেনে তুলে দিয়েছে।
কিন্তু রোববার রাত দশটায় বিলাসপুরে ঢুকে দেখি আই জি , এস পি , থানেদার সবাই কোরবায়।
কারণ, গুরুতর। বালকোয় নির্মাণাধীন কারখানায় বিশাল চিমনি ভেঙে পড়ে বেশ ক'জন শ্রমিক মারা গেছেন। লোকে চাইনীজ এক্সপার্টদের ঘেরাও করেছে।
তবে থানেদার ও সি এস পি একঘন্টার মধ্যে ফেরৎ আসছে, দেখা করবে।
ভাড়ার গাড়িটা এবার ছেড়ে দিতে হবে। মেয়েদের ফোনে নির্দেশ দিই--- ঘড়ি দেখে ১৫মিনিট পড়ে প্রাঙ্গণের সাইডের গেটের চাবিটা নিয়ে নীচে আসবি। আমার দ্বিতীয়
ফোন ফেলে চাবি দিয়ে দরজা খুলবি। তোর মা ও রেণুরা ১০০ মিটার দূরে রস্তায় আঁড়িয়ে থাকবে। ভাড়াটে গাড়ির ড্রাইভার আমার্সঙ্গে এসে রেণুদের ফোর্ড গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাইরে নিয়ে আসবে।
অপারেশন সফল হল।ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে জাঠপরিবারের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াবো, খাবর খাবো---- যতক্ষণ না থানেদার, সি এস্পি এরা ফেরে।
ও হরি! ৩০০ মিটারও যাইনি, গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। কে বা কাহারা একটা টায়ার চাকু দিয়ে ফাঁসিয়ে রেখেছে।
· দেখা গেল গাড়িতে জ্যাক নেই। আমি আর প্রবীণ হাঁটতে শুরু করলাম। অত রাত্তিরে কোথাও অটো রিপেয়ার শপ খোলা নেই। ২০০ মিটার হাঁটার পর এক যুবকংগ্রেসের অফিসে ইয়ং ছেলেদের গাড়ি দাঁড়ানো দেখে চাইলাম।
জ্যাক নিয়ে এসে আমার মাথায় ভাঁজ। আমি আনাড়ি, অমিতাভের সারা শরীরে ব্যথা, প্রবীণের অনেক আগের একটা অ্যাকসিডেন্টে হাঁটুর মালাইচাকি ভাঙা,-হাঁটু মুড়ে বসতে পারে না।
অবাক করলো জাঠসুন্দরী রেণু। চটপট বসে জ্যাক লাগালো, স্প্যানার লাগালো, চাকা খুলে বদলে ফেললো।
এবার রত্না বল্লো--সবাই মিলে এলোমেলো না ঘুরে তোমরা কোন হোটেলে ওয়েট কর। সি এস পি'র ফোন আসলে দেখা করে পুলিশ নিয়ে এসে তার পর তোমাদের ফ্ল্যাট ২১০ য়ে ঢুকবে। আমাকেও ডেকে নিও।
আর বাইরে খেও না। আমি সবার জন্যে একটা পাঁচমিশেলী তরকারী, ডাল আর আচার রেডি করে রাখবো।
আমরা আমাদের ফ্ল্যটে ফিরলাম। নীচে কিছু লোক খবর পেয়ে জমা হয়েছে। মা এসে রত্না কে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো।
বল্লো- এইসময় মেয়েদুটো থাকায় অনেক সুবিধে হয়েছে। নইলে খালি বাড়িতে আমার--।
রত্না রান্নাঘরের থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে লেবু ছিঁড়ে আনা ও উনুনে ঠ্যাং ঢুকিয়ে রান্নাকরার স্টাইলে কিছু করল।
এমনসময় টি আই মি: সিং কে নিয়ে জাঠ পরিবার ফিরে এলো। চারপাশের ফ্ল্যাটের থেকে কৌতূহলী মুখ এবং নীচের জমায়েত থেকে কিছু উৎসুক চোখ।
রত্না গেল ওদের সঙ্গে। মেয়েরাও গেল। আমি লোক্যাল চ্যানেলে কালকের ঘটনার রিপোর্টিং দেখতে লাগলাম।
অ্যাংকর ছেলেটি নাটকের সূত্রে আমার ভালই পরিচিত। গত কয়েকমাসে প্রোমোটার যখন আমাদের মিটার জ্বালিয়ে জলের লাইন কেটে আমাদের জ্বালাতন করছিল, তখন আসবো বলেও আসেনি। পরে বলেছিল-- আমি সব জানি, কিন্তু মালিকের মানা আছে।
এখন সে মাইক হাতে নিয়ে বলছে কি ভাবে রায়পুরের পুলিশের বড়কর্তাদের দাক্ষিণ্যে বিলাসপুরের গুলি চালিয়ে দেওয়া খতরনাক অপরাধীরা এখনও অ্যারেস্ট হয় নি, পালিয়ে গেছে।
ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বিল্ডার নয়, কালকের কিছু ফ্ল্যাটের বাসিন্দে কাঁদো কাঁদো সুরে শোনাচ্ছেন কেমন করে হরিয়ানা থেকে আসা এক অপরাধী চরিত্রের মহিলা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে হুড়্দঙ্গ্ মচিয়েছে। আর রত্না রায় বলে আর এক উৎপাত করনেওয়ালী বয়স্ক মহিলা এইসব অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্টের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
( মাওবাদী-ঘাসফুল আঁতাত?)
ইতিমধ্যে রত্নার ক্রুদ্ধ চিৎকারে প্যাসেজ কম্পমান। সমস্ত ফ্ল্যাটের দরজা ধড়াধড়্ বন্ধ হচ্ছে। মেয়েরা এসে বলে--- বাবা, শিগ্গির চলো, মাকে সামলাও।
আমি গিয়ে যা দেখলাম।
ওরা দুপুরে তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়েছে বটে, কিন্তু ছিটকিনি বন্ধ হচ্ছে না। দরজার ফ্রেম ভাঙা, বাথরুমের কমোড ভাঙা, বেডরুমের ভাঙা দরজায় সাদা সানমাইকার ওপর অস্যংখ্য লাথিমারা পায়ের ছাপ। গয়নার বাক্স ভাঙা, তোষকের তলায় রাখা জমি বিক্রির আগাম টাকা নেই কিচেনে মাইক্রো- ওয়েভ জ্বলে গেছে। এমনকি টপার-ওয়ারের কিছু মশলারাখার কৌটো নেই।
এইসব দেখার পর টি আই( কোলকাতার SHO ) রত্নাকে অনুরোধ করে-- ম্যাডাম, আপনারা স্টেটমেন্ট না দিয়ে রায়পুর চলে গেছিলেন, তাতে FIR ঠিকমত লেখা সম্ভব হচ্ছে না। ওপরতলায় আমাদের বদনামী হচ্ছে, একটু কোঅপারেট করুন। রত্না হটাৎ ফেটে পড়ে।
---- কিসের স্টেটমেন্ট মশাই! কিসের কো-অপারেশন? সারারাত আমাদের বসিয়ে রেখে বয়ান নেওয়া হয়নি, এখন ন্যাকামি হচ্চে?
দরজাভাঙা অবস্থায় আপনাআমাদের তুলে নিয়ে গেলেন। বল্লেন--- পুলিশ গার্ড আছে, সব সুরক্ষিত থাকবে। তাহলে কি করে প্রোমোটারের লোক এসে দরজা লাগায়? কি করে গয়না-টাকাপয়সা গাপ হয়ে যায়? তারপর থানার ব্যাকিংয়ে প্রেস-কেবল্ এ উল্টো সীধে স্টেটমেন্ট?
তারমানে পুলিশের লোক গয়না -টাকাপয়সা-পিস্তল চুরি করেছে?
আপনাদের থেকে এইসব জিনিসের ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক, তারপর স্টেটমেন্ট দেব, আগে নয়।
আপনি ছিলেন না বলে দায়িত্ব এড়াতে পারেন? সব তো আপনাদের ডিপার্টমেন্টের লোকজনই করেছে।
কত পয়সা খেয়েছেন আপনারা বিল্ডারের কাছে? বলুন!
আপনি খান নি? বেশ, তাহলে ফ্ল্যাটেলুকিয়ে থাকা চেহরাগুলোকে টেনে বার করুন। সবার ফ্ল্যাট সার্চ করুন। চোরাই মাল ঠিক পেয়ে যাবেন। আর না পেলে? সব কটাকে মারুন , হ্যাঁ, চোরের মার! ততক্ষণ মারুন যতক্ষণ না মাল ফিরিয়ে দেয়। তারপর আমার স্টেটমেন্ট নিতে আসবেন।
আমি ওর টাইরেড থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।
(মনে মনে জাস্টিফিকেশন খুঁজি-------- ফ্রান্সে নাজিরা হারার পর আন্ডারাগ্রাউন্ড গেরিলা ম্যাকি কোলাবোরেটরদের ওপর টর্চার করা, বাংলাদেশ মুক্ত হলে রাজাকারদের ওপর মুক্তিবাহিনীর টর্চার ইত্যাদি)।
সমস্ত অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে পিনড্রপ সায়লেন্স।
রত্না বিড়্বিড়্ করে-- কাপুরুষের দল! নীচে পুলিশ বসিয়ে ওপরে দাদাগিরি! পাঁচজন মিলে একটা মেয়েকে মারা!
---- আপনি শান্ত হোন ম্যাডাম! সব হবে, অপরাধীদের শাস্তি হবে, খোয়া মালপত্র উদ্ধার হবে। ঠিক আছে, আপনি না হয় পরেই স্টেটমেন্ট দেবেন। কাল রায়পুর মুখ্যালয় থেকে ম্যাডাম গুপ্তা আসছেন।