ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥৮॥
অজান্তেই বাঁশ ফুল খেয়ে ফিরে আসে হত দরিদ্র নীল গাই
জিভ তার যেই ছোঁয় জলহীন দগ্ধ বনানী তখুনি তা হয়ে পড়ে সবুজ অমৃত
পেরো
দৌড়চ্ছে পেরো দৌড়চ্ছে...। ছোট ছোট মসৃণ পাহাড় শৃঙ্খলা জনবসতিহীন। মহুয়া কেন্দ শিরীষ শাল সোনাঝুরি এঁকেবেঁকে পার হয়ে, পথ তৈরি করে পথ জানতে জানতে। যেন অনন্ত রাস্তা। শ্লথ হয়ে আসছে প্রাণ। তবু দৌড়। সব বিদ্রোহই প্রকৃত অর্থে ব্যর্থ বিদ্রোহ, এই চিন্তাই তাকে অবসন্ন করে দিচ্ছে। যেন মনে হয় হা হা শূন্য আকাশের নিচে কয়েকটি প্রতিবাদহীন উপজাতিকে বিপন্ন জেনে ভুল করেছে নাকি! ওরা জীবনভর কেউ জরাগ্রস্ত, কেউ নেশায় জর্জর, কেউ আবার অঙ্গে অঙ্গে কুঠগ্রস্ত। এমনিতেই প্রকৃতির এমন খেলা, যাকে দিয়েছে গৌরবর্ণ তার আছে অস্তিত্বের অহংকার ঘৃণা কিংবা স্বার্থপর দয়া। যাকে দিয়েছে সবুজ কোল তার দেহ কৃষ্ণবর্ণ আর অস্তিত্বের সংকট। তার আছে অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণুতা আর কুণ্ঠাবোধ। পুষ্ট ধানগাছে মাজরা পোকার মতো কুণ্ঠাবোধ খেয়ে ফেলছে তাদের বংশবীজ। কোনও শহুরে মানুষের সাড়া শব্দ পেলেই নিমেষে লুকিয়ে ফেলে নিজেদের।
ওই সাঁঝরাতের আলো আঁধারিতে পিঠের উপর জেরকাকে নিয়ে দু হাতেপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে টিবিরুগির বারান্দায় এসেই পেরো বিপদের গন্ধ পেয়েছিল। তার শরীর ঘিরে আর একটা অবয়বহীন চেতন শরীর আছে, একথাটা সাবজী গোরাচাঁদ খুব বলেন। বিপদের কথা আগেভাগে পেরো বুঝে যায় আর বাঁচার উপায়ও বের করে ফেলে। পেরো বুঝে গেছল আঁধারে এই যে অনায়াস নির্জনতা, নিশ্চয় বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠবে। তাই নিঃশব্দে জেরকাকে তার সাথীটার পিঠে দিয়ে গুঁড়ি মেরে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সাবজীও জানতে পারেননি। টিলার উপরে উঠে যখন দেখলো সেখানে টর্চের আলো আর সশস্ত্র মিলিটারি, তখন থেকে নিঃশব্দে দৌড় লাগলো জঙ্গলের দিকে। একসময় যখন দশ দিশা ঘন কালো ঘিরে ফেলেছিল তখন অন্ধকার চিরে দুটো গোল আলো দেখে চিনেছিল ওটা প্যাঁচার চোখ। এক সুনিশ্চিত আশ্রয় জেনে অন্ধকারেই গাছে তরতর করে উঠে পড়ে পেয়ে গেছিল এক কোটর আশ্রয়। ভোরে উঠে দেখল গাছটা একটা বিশাল বটগাছ।কোটরে অনেক পাকা বটফল জমা রয়েছে। সেই বটফল খেয়ে আবার তার দৌড় শুরু।
এখন গনগনে উত্তপ্ত দুপুর কিন্তু তার দৌড় থামার নাম নেই। পেরো দৌড়তে দৌড়তেই দেখল সেই মসৃণ তৃণভূমি শেষ এবার ছুঁচলো কাঁকর আর পাথর চাট্টান। জলাশয় কোথাও নেই গাছপালার দাগও নেই। পেরো জায়গাটা চিনতে পারল। একবার ছোটোবেলায় এই জায়গাটা পার হয়ে গেছিল। তার মা জেরকা আর সে। কিন্তু বেশি দূরে যেতে পারেনি। একটু একটু মনে পড়ে পেরোর। একটা ধূ ধূ টাঁড় খালি ময়দান। একটাও গাছপালা ছিলোনা। সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রচুর মানুষের হাড় মাথার খুলি আর তীর ধনুক বল্লম পড়ে ছিল। সেখানে শনশন করে হাওয়া বইছিল। যেন অনেক লোক ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিল। বেশিদূরে এগোতে পারেনি ওরা। আবার পিছনে ফিরে আসছিল। কিছুদূর পিছিয়ে আসতেই পুলিশ ওদের ধরে ফেলেছিল।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পেরো। আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে নাকি? পেরোর জীবনে কিন্তু এরকমটা অনেকবার ঘটেছে। একই ধরনের ঘটনা দুবার করে ঘটেছে। সেইদিন জেরেকা জেলে যাবার পর বহুদিন পেরো একা থাকতো। অবশ্য সাবজী ওর দেখাশুনো না করলে পেরোর হয়তো বাঁচা মুশকিল ছিলো। পেরো দাঁড়িয়ে পড়ে চারপাশটা ভালো করে দেখতে লাগলো। সোজা এগিয়ে গেলে হয়তো সেই মৃত্যুভূমি পাওয়া যাবে। ওখানে এত মানুষের হাড়গোড় কেন সেটা গোরাচাঁদের কাছে জানতে পেরেছে পেরো। আঠেরোশো কুড়িতে কোলবিদ্রোহতে মারাত্মক আদিবাসী নিধনে মেতে উঠেছিল ইংরেজরা। প্রচুর ঘোড়সওয়ার ইংরেজ বহুদূর তাড়া করে আদিবাসীদের ঘিরে ফেলেছিল আর নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। কিন্তু তারপর?
পেরো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানদিকে ঘুরে তাকাল। নাঃ, ওই রাস্তায় যাওয়া যাবে না। ওই দিকে গেলে সিংভূমের খনি অঞ্চলের দিকে পৌঁছে যাবে। সেটা সুবিধের হবেনা। তাছাড়া দু'বার ওই মৃত্যুপুরীতে যাবার ইচ্ছে নেই। ডানদিকে ঘুরেই কিযে হলো কিছু না জেনে বুঝেই বিদ্যুত্ বেগে দৌড়তে শুরু করল। আর সেটাই তার কাল হলো। কিছুদূর পরে হঠাত্ পথ শেষ হয়ে গিয়ে যেন অতল খাদে পড়ে গেল পৃথিবী। পেরো নিজেকে রোধ করতে পারলো না। গড়িয়ে পড়তে লাগলো পড়তে লাগলো...।