প্রনব্ধঃ আফরোজা খাতুন
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
ভাষা আন্দোলনে মেয়েরা
আফরোজা খাতুন
[লেখক পরিচিতি - প্রাবন্ধিক। নারী অধিকার অর্জন আন্দোলনে নিবেদিত। সম্পাদিকা, ফোরাম ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইন্ডিয়া। সহযোগী সম্পাদক, ইন্টারন্যাশানাল জার্নাল অফ বেঙ্গল স্টাডিস। অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন]
একুশ ফেব্রুয়ারি মানেই ভাষার জন্য লড়াই। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লড়াই। পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা,১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়ে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের (বর্তমান জগন্নাথ হল) দিকে মিছিল করে যাচ্ছিলেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ –র ২৭ জানুয়ারি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে, বিক্ষুব্ধ বাঙালী লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। মিছিল, সমাবেশ, বন্ধের মধ্য দিয়ে প্রদেশব্যাপী একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনের কর্মসূচি স্পষ্ট হয়।
রাজনৈতিক চক্রান্তে ভাগ হয়েছে বাংলা। অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী আবার হতচকিত হন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে জেনে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গবাসীর কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সেই বছরের ১৯ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আসার কথা উর্দুর সপক্ষে ভাষণ দিতে। তাই ১১ মার্চ সমগ্র দেশ জুড়ে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। বন্ধ, সমাবেশ ও মিছিল করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এমন গণবিক্ষোভ এর আগে সংগঠিত হয়নি। শাসকের বদল ঘটেছে মাত্র। ইংরেজদের জায়গায় এসেছে পাঞ্জাবী শাসক। পরাধীনতা যে কাটেনি, পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা টের পেয়েছিলেন। কারণ শুধু রাষ্ট্রভাষা উর্দুই নয়, পাকিস্তানের সমস্ত প্রদেশের স্কুলগুলিতেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুকেই গ্রহণ করার কথা ভাবা হয়েছিল। আর ছিল আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব। অথচ পাকিস্তানের ৬০ শতাংশ মানুষ তখন বাংলা ভাষাভাষী। আসলে প্রথম থেকেই পাকিস্তান সরকার ভেবে নিয়েছিল, আরামপ্রিয় ভীতু বাঙালীর বাসস্থান পূর্ব পাকিস্তান হবে তাদের উপনিবেশ – হবে খাজনা আদায়ের জমিদারি, শুল্ক আদায়ের বন্দর। এই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থলোভেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও এই জাতীয়তাবোধ যে স্থায়ী সংহতি রক্ষা করতে পারবে না, সেটা নেতৃবৃন্দ জানতেন। তাই শোষণ কায়েম রাখার কৌশল হিসেবে বিরাট সংখ্যক বাঙালীর মুখের ভাষা, কাজের ভাষা, সাহিত্যের ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রকল্প শুরু হয়। অবাঙালী প্রকাশকরা বাঙালীদের মনে ইসলামী উত্তেজনা জাগিয়ে রেখে স্থায়ী আনুগত্য পেতে চেয়েছিল। একে বঙ্গবিচ্ছেদের ব্যথা, এর পরেই বঙ্গসংস্কৃতি হারানোর আশঙ্কা – প্রচণ্ড নাড়া খেলেন পাকিস্তানের বাঙালীরা।তাই প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে একথা ১৯৫২-র ২৭ জানুয়ারি ঘোষণা করলে, বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেই বছরের (১৯৫২) ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণে সভা ও ঢাকার রাস্তায় মিছিল করেন। ১৯৫২ সালের ১১, ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে পালন করা হয় কালো পতাকা দিবস। বন্ধ, মিছিল ও সমাবেশের মধ্যে দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন যখন তুঙ্গে,ঠিক সেই সময় আন্দোলনকে দুর্বল করার অভিপ্রায়ে পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আইন পরিষদের সামনে সামনে মিছিল করে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবু সেদিন ভাষাপুত্র ও ভাষাকন্যারা সরকারের আইন অমান্য করেই বেরিয়ে পড়লেন আইন পরিষদের দিকে তাঁদের দাবি নিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করার অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন গাজিউল হক। মিছিল করার দুঃসাহসিকতার শাস্তিস্বরূপ পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী কেড়ে নিল কিছু যুবকের প্রাণ। মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে সব পুরুষ প্রাণ দিলেন, যুদ্ধ করলেন, আন্দোলনের শরিক হলেন, সেইসব পুরুষের ইতিহাস দৃশ্যমান হল। সমাজ, শিক্ষাক্ষেত্র, হোস্টেল সব জায়গার বাধা অতিক্রম করে যে মেয়েরা আন্দোলনের শরিক হলেন তাঁদের কথা আড়ালেই রইল,ইতিহাসের মূল স্রোতে আজও তেমন স্থান হল না।
আপসহীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকেই গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাণ। তাই ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ মূল ধারার বাইরে নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল প্রধান। তবে পাশাপাশি স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভূমিকাও কোনও অংশেই কম ছিল না। যদিও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ যথেষ্ট কম ছিল। কিন্তু তৎকালীন সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে মেয়েদের এই অংশগ্রহণও স্বীকৃতির দাবি রাখে। লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গে চলে যান। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ছাত্রীদের সংগঠিত করে, সচেতন করে,জাগিয়ে তুলে, আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। ভাষা-সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু বলেন, “বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্রীসংখ্যা ৬০/৭০ এর বেশি হবে না। তখনকার সময়ে ছেলেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। প্রক্টরের মাধ্যমে কথা বলা হতো। নিয়ম না মানলে দশ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষক ক্লাসে যাওয়ার সময় ছাত্রীদের কমনরুম থেকে ডেকে নিয়ে যেতেন। ছাত্রীরা মাথায় কাপড় দিয়ে,অনেকে বোরখা পরে ক্লাস করত। ক্লাসে মেয়েরা শিক্ষকের সামনের সারিতে বসত। কিন্তু সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সামাজিক বাধাবিপত্তি – বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হোস্টেল থেকে বের করে দেবেন অথবা অভিভাবকগণ পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন – সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে সংগ্রামী ভাইদের সঙ্গে সমভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল”।১
রওশন আরা বাচ্চু ২১-এর আন্দোলনে আহত হন। সেদিন সকাল থেকেই তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসেন। পাঞ্জাবী শাসক ১৪৪ ধারা জারি করেছে আন্দোলন বন্ধ করতে।ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে আইন পরিষদের দিকে যাবেন তাঁদের দাবি জানাতে।প্রায় তিনিটি ট্রাক বোঝাই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট ঘিরে ফেলে। বিপদজনক পরিস্থিতি বুঝে ভাইস চ্যান্সেলার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ১৪৪ ধারা ভাঙতে নিষেধ করেন। কিন্তু সেদিন ভাষা সৈনিকদের আটকানো যায়নি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সেদিন মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন ছাত্রীরা। ১০ জন করে ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আইন পরিষদের দিকে এগিয়ে যান। এইভাবে মেয়েদের তিনটি দল বেরোয়। রওশন আরা বাচ্চু এই মেয়েদের মিছিল বেরোনোর তত্বাবধান করেন এবং মেয়েদের তৃতীয় দলে অংশ নেন। ছাত্রীদের পিছনে বেরোতে থেকেন ছাত্ররা। অপরদিকে শুরু হয়ে জয়ায় কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার। এই দমন পীড়নের মধ্য দিয়েই মিছিল এগোচ্ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের দিকে, বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে। কিন্তু মেডিকেল কলেজের সামনেই পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলি শুরু হয়। দিশেহারা হয়ে রওশন আরা বাচ্চু আশ্রয় নেন ভাঙা রিক্সার স্তূপের মধ্যে। সেটাও নিরাপদ নয় বুঝে বহু কষ্টে কাঁটা তারের বেড়া ডিঙিয়ে একটা বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। তাঁর মতই আহত ভাষা-সৈনিক সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা পরিহিতা শামসুন, প্রমুখরাও সেখানে আত্মগোপন করেছিলেন। এমন আতঙ্কজনক অবস্থায় তাঁদের মনোবল একটুও দুর্বল হয়নি। বরং ন্যায় ও সত্যের লড়াইয়ে অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আরও কঠিন শপথ গ্রহণ করেন।
২১-এর আন্দোলন শুরু করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত রফিক, জাব্বার, সালাম, বরকত ও বহুজনের আহত হওয়ার ঘটনায়, এই আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নেয়। পুলিশের গুলিতে নিহত মৃতদেহগুলি পুলিশ ও সেনাবাহিনী জোর করে ছাত্রদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে য়ায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গোপনে কবর দিয়ে ভাবাবেগ কিছুটা দমন করা। কবর স্থানের চিহ্ন কাউকে জানতে দিতে চায়নি তারা। তবু কিছু সাহসী যুবকের অনুসন্ধানে কবরগুলি শনাক্ত হয়। আর তাই আজও ২১ ফেব্রুয়ারি আজিমপুর গোরস্থানে প্রভাত ফেরী করে শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।
১৯৫২-র অভাবনীয় ঘটনায় হতচকিত ছাত্রীরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে দলে দলে ভাগ হয়ে, বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন টাকা তোলার জন্য। আন্দোলন চালাতে গেলে অর্থ দরকার। এই গুরু দায়িত্ব কেউ অস্বীকার করেননি। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করেন। অনেক বাড়ির মহিলা তাঁদের হাত, কান, গলা থেকে সোনার অলঙ্কার খুলে ভাষা আন্দোলনের তহবিলে দান করেন। ২১-র নারকীয় অত্যাচারের অভিজ্ঞতায়, আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মূলত হোস্টেলের ছাত্রীরা যেমন অর্থ সংগ্রহ করেছেন, সেইসঙ্গে সারারাত জেগে পোস্টার লিখেছেন। রওশন আরা বাচ্চুর মতই মোসলেমা খাতুন, হালিমা খাতুন, কায়সার সিদ্দিকী, সারা তৈমুর, সুফিয়া খান, ডঃ শরিফা খাতুন, গুলে ফেরদৌস, মনোয়ারা ইসলাম, রওশন জাহান ইসলাম, প্রমুখ হোস্টেল-ছাত্রীরা এই ভাষা আন্দোলনের শরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভষা-সৈনিক সুফিয়া আহমেদ অবশ্য বাড়ি থেকেই আসতেন।আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায় থেকে, তিনি একেক দিন ঢাকার একেক এলাকায় চাঁদা তুলে নিয়ে আসতেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপস্থাপনায় কাজী খালেদা খাতুন, জুলেখা হক বা রওশন আহমেদ দোলনের মত অনেক স্কুল পড়ুয়া ২১-এর ভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণের সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের গেটে উপস্থিত হয়ে স্কুলে না ঢুকে তাঁরা সভায় চলে আসেন। বাড়ি ফেরার পথ তাঁরা ঠিকমত চিনতেন না। মিছিল ছত্রভঙ্গ হলে, বহুকষ্টে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐ ছাত্রীরা পথ খুঁজে বাড়ি ফেরেন।যুদ্ধের ভূমিকে মজবুত করতে এই যে মেয়েরা সক্রিয় ছিলেন, মূলস্রোতে তাঁরা জায়গা না পেলে হয়তো বা ইতিহাস খনন করে তাঁদের জন্য আগামীতে আলাদা ইতিহাস রচিত হবে।
২১-এর ভয়াবহ কাণ্ড ঘটার পর ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ ও সলিমুল্লাহ হল –এই দুটি জায়গাতে কন্ট্রোল রুম খোলেন। সেখান থেকে বর্তমান পরিস্থিতি ও আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচীর ঘোষণা অবিরাম চলতে থাকে। যাঁরা আন্দোলনের শরিক ছিলেননা, এবার তাঁদের মধ্যেও জেগে ওঠে সংগ্রামী চেতনা, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। সলিমুল্লাহ হল পুলিশ ঘিরে রেখেছিল আন্দোলনকে দুর্বল করতে।ছাত্রদের ঠিকমত খাবারও জুটতো না। সেই সময় ইডেন কলেজের ছাত্রী ভাষা-সৈনিক গুলে ফেরদৌস স্মৃতিচারণে বলেছেন – “আমরা হোস্টেলের মেয়েরা কোঁচড় ভরে খাবার নিয়ে জানালা গলিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের তুলে ধরা শার্টের ভেতর খাবার ঢেলে দিয়েছি। কারণ সলিমুল্লাহ হল পুরোটা পুলিশ দ্বারা প্রহরাবেষ্টিত ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে আবাসিক ছাত্ররা রাতের অন্ধকারে আমাদের কাছ থেকে খাবার নিয়ে খেত। কর্তৃপক্ষ মেয়েদের হোস্টেলের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের স্টাডিরুম ছিল রাস্তার পাশে। কাজেই সেই ঘরের জানালা দিয়ে আমরা সবকিছু দিতে পারতাম। তখন প্রতিরাতে সলিমুল্লাহ হল থেকে ভেসে আসত – ‘ভাইসব, সালাম, রফিকের রক্তের কথা ভুলে যেও না,শুনতে কি পাওনা তাদের আত্মার দীর্ঘশ্বাস, তাদের কান্না!’ ১৪৪ ধারা তখনও বলবৎ। হঠাৎ একদিন সলিমুল্লাহর কয়েকজন ছাত্র এসে জানাল, আজ রাতে হল সার্চ করা হবে। মাইক কেড়ে নেবে। কি করা যায়? আমরা ওদের আশ্বস্ত করে বললাম, মাইক দিয়ে যান। আমরা লুকিয়ে রাখব। সেদিন রাতের অন্ধকারে ওরা তিনটে মাইক আমাদের কাছে দিয়ে গিয়েছিল। ভেতরে পুকুরপাড়ে একটা বড় গর্ত ছিল। সেটাতে মাইকগুলো রেখে ওপরে বড়ইর কাঁটা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম।”২ পরিস্থিতির ভয়াবহতায়, ছাত্রীরা হোস্টেল থেকে বেরোনোর
অনুমতি পেতেন না। কিন্তু তাই বলে কি তাঁদের দমানো গিয়েছিল? অনেক সময় হোস্টেলের দেওয়াল টপকিয়ে যাতাযাত করেছেন। ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে প্রাচীরের ওপর উঠে ঝাঁপ দিয়েছেন। এরজন্য কর্তৃপক্ষ বকাবকি করলেও তাঁরা দমেননি। তাঁরা অভুক্ত ছাত্রদের জন্য খাবার নিয়ে গেছেন। জেলে বন্দী অনশনরত ভাষা-সৈনিকদের কাছে খাবার নিয়ে গিয়ে তাঁদের অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলনের এক কিংবদন্তী চরিত্র নাদেরা বেগম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে, সেই সময়ের সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ছাত্রীদের নেতৃত্ব দানের জন্য তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। কারাগারে তাঁর উপর কঠোর নির্যাতন চলে। তবু তাঁর মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি পাকিস্তান স্বৈরশাসক। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাঁর উপর পুলিশ বিশেষ নজর রাখত। যার ফলে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার প্রথম মহিলা সাংবাদিক লাইলা সামাদ, যিনি সাহিত্যিকও ছিলেন, ভাষা আন্দোলনের সংগঠক কর্মী হিসেবে তাঁর একটা বড় ভূমিকাও ছিল। সুফিয়া কামালের দুই মেয়েই (সুলতানা কামাল, সাইদা কামাল) তখন ছোট। তবু দুটি শিশুকে কোলে নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবেশে যোগ দিতেন। কামরুননেসা, আনন্দময়ী, ইলা বক্সী, বেনু ধর, এঁরা সকলেই ছিলেন ভাষা-সৈনিক। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে প্রথম জেলে যান নারায়ণগঞ্জের শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে শুনেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশ মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকায় যেন যেতে না পারে তার চেষ্টা করে সেখানকার মানুষ। শত শত গাছ কেটে, কয়েক মাইল জুড়ে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশের গাড়ি আটকানোর জন্য। স্বৈরাচারী শাসক বন্ড সই করে তাঁকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মমতাজ বেগম এই বন্ড সই-এর মুক্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান।এর ফলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে বিচ্ছেদ আসে। স্বামী তাঁকে তালাক দেন।সিলেটের ছালেহা বেগম, স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বলে সেখানকার ডি সি-র আদেশে তাঁকে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর আর পড়া হয়নি। সিলেটের অন্য ভাষা-সৈনিকরা হলেন যোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, প্রমুখ।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের আই এ ক্লাসের ছাত্রী ছিলেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি।ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়, তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরীক্ষার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ২১-এর মিটিং-এ যাবেননা ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলেন কিছু ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেয়ে গেছে মিলিটারিতে। পরীক্ষার পড়া বন্ধ রেখে,উইমেন্স হোস্টেল থেকে মেয়েদের একটা দল নিয়ে মিলিটারিদের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন। শুরু হয় পুলিশের লাঠি চার্জ। তার ঘা প্রতিভা মুৎসুদ্দির গায়েও পড়ে। তিনি জানাচ্ছেন – “একজন ছাত্র আমাকে কোলে করে বারান্দায় পৌঁছে দিল। আমরা দোতলায় ছাত্রীদের কমনরুমে গেলাম। সেখান থেকে দেখলাম মিলিটারি, মধুর ক্যান্টিন, কমার্স বিল্ডিং ও একতলা থেকে ছাত্রদের ধরছে। কেউ কেউ দেওয়াল টপকে মেডিকেল কলেজ ক্যাপাসে ঢুকে আত্মরক্ষা করছে। আমরা ৭ জন, - আমি, কামরুননাহার লাইলী(প্রয়াত), ফরিদা বারিক মালিক, হোসনে আরা আপা(ইংরেজী), লায়লা নুর(ইংরেজী) ও আরও দুইজন বেশ ক’ঘন্টা পর লাইব্রেরিতে যাই। ...যখন প্রায় সন্ধ্যা হয় আমরা ঠিক করলাম আলাদাভাবে ধরা না দিয়ে একসাথেই ধরা দেবো। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছই তারা আমাদের ভ্যানে উঠতে নির্দেশ দিল। ঐ সময় যত ছাত্র ক্যাম্পাসে লুকিয়েছিল সবাই এগিয়ে এলো। প্রায় কয়েকশত ছাত্রছাত্রী। প্রথমে আমাদের লালবাগ থানায় নিল – প্রত্যেকের নামে আলাদা ওয়ারেন্ট লিখল। এরপর রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে।”৩
জাতির স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক এই ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত কর্মসূচি তৈরী করে আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। কন্ট্রোলরুম থেকে ক্ষণে ক্ষণে ছাত্ররা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে চলে। ১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তির দিন। সকালে ‘গায়েবি জানাজা’ পড়া হয়। তারপর ১৪৪ ধারা অমান্য করেই জনসাধারণ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে শোভাযাত্রা করে বর্বর হত্যা কাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। শোভাযাত্রার মাঝে হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চলে। হাইকোর্টের কেরানী শফিউর রহমান এখানে শহীদ হন। এই ভাবে প্রতিদিন ঢাকা শহরে বন্ধ,মিছিল আর পুলিশ–জনতার সংঘর্ষ চলতে থাকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ বরকতের গুলির জায়গায় ছাত্ররা তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার। হোস্টেলের মেয়েরা ভোরে উঠে, খালি পায়ে সাদা শাড়ি পরে শহীদ মিনারে যান শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে। তাঁরা ছাড়াও অসংখ্য মেয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে সোনার অলঙ্কার খুলে দেন মিনারের পাদদেশে, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে।ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আকস্মিক ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের কাছে নির্দেশ আসে হোস্টেল খালি করার। সরকারের নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। সলিমুল্লাহ হলের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারপর মেডিকেল কলেজে ঢুকে শহীদের স্মৃতিস্তম্ভকে ধ্বংস করে ফেলে। তাই সেদিন কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয় –
‘ইঁটের মিনার ভেঙেছে, ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি পরিবার
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর’।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’)
পাকিস্তানের বাঙালী চেতনার শুদ্ধতার উদ্বোধন এই একুশে। গোটা দেশের বাঙালী ৫২-র একুশে একপ্রকার শপথ নিয়েই ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-র অবদান। তাই ভাষা-শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা শহীদ মিনার পাকিস্তান সরকার বারবার ভেঙে ফেলে, দৃঢ় করে তুলেছিল বাঙালীর মানসিক শক্তিকে। সেই শক্তির জোরেই সংগ্রামী অভিযান এবং জয়লাভ – যার শরিক ছেলে ও মেয়েরাও।
তথ্যসূত্র
১। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ভাষাকন্যা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ – ৪।
২। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ঐ, পৃ – ৪৪।
৩। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ঐ, পৃ – ৩০।
ঋণ স্বীকার
১। মজহারুল ইসলাম ও ডঃ চিত্ত মণ্ডল সম্পাদিত ঃ মহান একুশে – সুবর্ণ জয়ন্তী সংকলন, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা, ২০০২।
২। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ভাষাকন্যা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ঢাকা, ১৯৯৭।
৩। ‘একদিন’ দৈনিক পত্রিকা, কলকাতা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২।