Next
Previous
0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রাচীন কথা


বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন
কৃষ্ণদেব রায়



কথা দিয়েছিলাম যে আমাদের এই সিন্ধু অভিযানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের ফাঁকফোঁকরে পারলে আপনাদের একটু মহেঞ্জোদাড়োতে উইন্ডো শপিং-এ নিয়ে যাবো। আসুন, আজ একটা অন্য গল্প শোনাই, আর সেইসঙ্গে মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া এক পুরুষ আর এক নারী মূর্তি দেখে আসি। আমার এবারের কাহিনীর প্রচ্ছদ চিত্রটা লক্ষ্য করুন দয়া করে। এক শ্যামা নারী, বয়েস খুব বেশী হলে তেরো থেকে পনেরো। তাবড় তাবড় ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটির নাম দিয়েছেন এক আদিবাসী উদ্ধত নাচুনি মেয়ে। তবে আমি এবং আমার অগ্রজপ্রতিম ভিন্নদৃষ্টির ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য এই মূর্তিটির ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি। একজন ইতিহাসের ছাত্রকে গাইড করে উইন্ডো শপিং এ বেরোলে আপনাদের কিছু কথা শুনতেও হবে আর বলতেও হবে। পুরু ঠোঁটের এই শ্যামাঙ্গী মহিলাকে দেখে প্রথমেই দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর এক মহিলার কথা মনে পড়ে। বিশ্ববিখ্যাত দুই পুরাতত্ত্ববিদ হান্টিংটন এবং পিগট একে যথাক্রমে দ্রাবিড়ীয় এবং বালুচি বা আদি অস্ট্রেলীয় বলে মূল্যায়ন করেছেন। প্রাচীন সভ্যতায় দলবদ্ধ নৃত্য বা যূথবদ্ধ নৃত্য ও সঙ্গীত কলার প্রচলন অবশ্যই ছিলো। কিন্তু একক নৃত্যের ধারণা তখন ছিলো কি? আর একজন নৃত্যশিল্পীর একক নৃত্য যাঁরা দেখবেন, তাঁরা নিশ্চয় শহরের অভিজাত ধনী ব্যক্তি। তাঁরা কি একজন কু-মুখশ্রী যুক্ত, থ্যাবড়া নাক, অনুন্নতস্তনা (লক্ষ্য করুন, মেয়েটির স্তন কিন্তু মোটেই প্রকট নয়), ক্ষীণজঙ্ঘা, অপুষ্ট নিতম্ব, অস্বাভাবিক দীর্ঘ বাহুদ্বয় সংবলিত কোন নারীর মোহে আবিষ্ট হবেন? আরও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখুন, মেয়েটির এক হাতে প্রায় চব্বিশ পঁচিশটি এবং অন্য হাতে গোটা চারেক ভারী বালা পরা আছে। হাতে চব্বিশটি ভারি বালা পরলে তার হাত দিয়ে কি নাচের মুদ্রা বাহাতের চলমানতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?সোজা কথায় হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাচা সম্ভব? মেয়েটির গোটা শরীরে সব থেকে প্রকট এবং দৃশ্যমান তার যোনিপ্রদেশটি। কেন? আসছি সে কথায় পরে। তার আগে চলুন দেখে নিই আর একটি শীলমোহর, যেটি হরপ্পা প্রাঙ্গণ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। 

ধর্মীয় চেতনায় ‘কাম’ এর প্রাচীনতম প্রত্ননিদর্শন হরপ্পা থেকে পাওয়া এই ৪২০ নং শীলমোহরটি। দেখতেই পাচ্ছেন প্রচ্ছদের ছবি থেকে যে এখানে মহিষের শিংয়ের শিরোভূষণ পরিহিত তিন মস্তক বিশিষ্ট এক ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি উচ্ছৃত লিঙ্গে যোগাসনে উপবিষ্ট। আর তাঁর চতুর্দিকে বিভিন্ন হিংস্র পশুরা বিরাজ করছে। কৃষিজীবি হওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষ ছিলো হয় শিকারী-খাদ্যসংগ্রাহক, নাহয় পশুপালক। সেই সময়ে খুব স্বাভাবিক কারণেই মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান অন্তরায় ছিলো এই সব হিংস্র জানোয়ারেরা। এই ভীতি থেকেই ঐসব হিংস্র পশুর হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করতে অথবা তাদের শাসন করতে সক্ষম এমন এক দেবকল্পনার উদ্ভব হয়েছিলো সম্ভবত। যে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ হবে। শিবই সেই দেবতা যিনি সমস্ত পশুদের নিয়ন্ত্রণে আর বশে রাখতে সক্ষম। আর সেই কারণেই শিবের আর এক নাম পশুপতি। পশুপালকের জীবিকা থেকে কৃষিনির্ভর জীবিকায় উত্তরণের পরে কৃষিতে যখন পশুর ব্যবহার শুরু হলো ভূমি কর্ষণের জন্যে, এবং এই কর্ষণ ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাই তাদের জীবন ও জীবিকার প্রধান ভিত্তি হয়ে দেখা দিলো, তখনই মনে হয় এই পশুপতিরূপী আদি শিবের উচ্ছৃত লিঙ্গ সংযোজিত হলো লাঙলের প্রতীক রূপে। মনে রাখতে হবে যে, লিঙ্গ, লাঙল আর লাঙ্গুল এই তিনটে শব্দই কিন্তু এসেছে সংস্কৃতের লং ধাতু থেকে। জমি বা ভূমি কর্ষণের ক্ষেত্রে লাঙলের ব্যবহার আর সন্তান সৃষ্টিতে স্ত্রী-যোনিতে লিঙ্গের ব্যবহারকে একই প্রতীক কল্পনায় আনা হলো। অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হবে যে, যতদিন না হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হচ্ছে, ততদিন সিন্ধু প্রান্তরের এই মূর্তিটি কোনও সর্বজনগ্রাহ্য স্বীকৃতি পাবেনা শিব কিংবা অন্য দেবতা হিসাবে। এটিই আদি শিবমূর্তি কিনা এ ব্যাপারে প্রত্নতাত্ত্বিক মতপার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে পোশেলের বক্তব্যটি আমাদের জানা দরকার। পোশেলের বক্তব্য বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “মূর্তিটির ভঙ্গী, হাবভাব এবং পরিধান এসবগুলো মিলেই ইঙ্গিত দেয় যে ৪২০ শীলমোহরটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মূর্তিটি কোনও একজন দেবতার। এই দেব কল্পনার কৃষ্টিমূলক প্রসঙ্গগুলির বিচারে এই মহিষের শিং-এর শিরোভূষণটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ… মূর্তিটির রূপটি আমাকে একটি অপ্রতিরোধ্য সিদ্ধান্তে আসতে প্রণোদিত করে যে এটি একটি দেবমূর্তি, কারণ একে দেখতে একজন দেবতার মতনই।’’ 

এই মহিষের শিং নিয়ে দেবকল্পনার প্রাচীনত্ব ও ব্যাপ্তি সম্পর্কেও পোশেলের বক্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গানুবাদে, “প্রাচীন ভারতে, অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পুরাণগুলির সমসাময়িক কালে, মহিষ পূজার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এটি দক্ষিণভারতে, যেখানে দ্রাবিড় ভাষাসমূহ প্রচলিত, সেখানে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।” শিবের এই বিতর্কিত মূর্তিটি ছাড়া তর্কাতীতভাবে শিবলিঙ্গ সমন্বিত শিব পূজাকে সূচিত করে এইরকম বেশ কয়েকটি শীলমোহরের চিত্রগুলি সম্পর্কে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আলচিন দম্পতি তাঁদের গ্রন্থে এই আলোকচিত্র গুলি পরিবেশন করেছেন। এটা নিয়ে আলোচনার শেষে তাঁরা বলছেন, “অধিকন্তু, শিবের লিঙ্গ প্রতীকের মতন অবিকল প্রস্তরখণ্ড শহরগুলি থেকে পাওয়া গেছে।” আলোকচিত্রটিতে প্রস্তর লিঙ্গকে স্থাপন করার উপযুক্ত দুটি গোলাকৃতি বেদীও রয়েছে। মনশ্চক্ষে যদি লিঙ্গটিকে বেদীর ওপর স্থাপন করা যায়, তাহলে যে ছবিটা পাওয়া যায়, বর্তমান কালেও যোনিবেষ্টনী রহিত শিবলিঙ্গের যে অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে এটির কোনও ফারাক নেই। সুতরাং এমন প্রস্তাবনা করা যেতেই পারে যে হরপ্পা প্রাঙ্গণে আবিষ্কৃত এই শিলমোহরেই আদি শিবের প্রতিমূর্তি দেখা যায়।

ফিরে আসি সেই নগ্নিকা ব্রোঞ্জ মূর্তিটির কথায়, যাকে পুরাতত্ত্ববিদেরা উদ্ধত আদিবাসী নাচুনি মেয়ে বলেছেন। ১০.৮ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট এই নগ্ন নারীমূর্তিটিও পুরাতত্ত্ববিদদের এক বিতর্কিত বিষয়। আগেই বলেছি, যেহেতু এই মূর্তিটি এককভাবে একটি নগ্নিকা নারী মূর্তি, তাই একে নাচিয়ে মেয়ে বললে সে যুগে একক নৃত্যকলার প্রচলন ছিলো বলে ধরে নেওয়া হয়। তর্কের খাতিরে যদি সেটা মেনেও নি, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে এর কু-মুখশ্রীযুক্ত, থ্যাবড়া নাক, অবিন্যস্ত কেশবিন্যাস, গাত্রালঙ্কার, দাঁড়াবার ভঙ্গী, হাত দুটির অবস্থান এবং গ্রীবাভঙ্গী—এর কোনোটাই কিন্তু এক একক নৃত্য পরিবেশনকারীর সঙ্গে খাপ খায়না। মার্শাল যদিও একে এক আদিবাসী উদ্ধত নাচুনী বলে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু পোশেল বলেছেন, “এই ছোট্টো মূর্তিটি প্রকৃতই একজন নর্তকীকে প্রতিফলিত করে কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।” এই নগ্নিকা মূর্তিটি ১৯২৬-২৭ সালে খনন কার্যের সময়ে সাহনী কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ১৯৩০-৩১ সালে মহেঞ্জোদাড়ো থেকেই খনন কার্যের সময় ম্যাকে প্রায় অনুরূপ আর একটি নগ্নিকা মূর্তি আবিস্কার করেন। তৃতীয় মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয় মাত্র ২০০৪-০৫ সালে ভিরানা (Bhirrana) নামক স্থানে, যেটি মহেঞ্জোদাড়ো থেকে কয়েক শত কিলোমিটার দূরে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার একটি খনকার্যের সময় একটি ভারি লাল ভগ্ন মৃৎপাত্রের ওপর খোদিত অবস্থায় মূর্তিটি পাওয়া যায়। এটিও মহেঞ্জোদাড়ো প্রাঙ্গণ থেকে প্রাপ্ত দুটি ব্রোঞ্জ নগ্নিকা মূর্তির অনুরূপ (ফ্রন্টলাইন পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০০৮ সংখ্যা)। পোশেল যেহেতু বলেছেন যে, এই ছোট্ট মূর্তিটি প্রকৃতই এক নর্তকীর কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে এবং বাস্তবসম্মত ভাবে যেহেতু হাতে ২৪/২৫ টি ভারী বালা পরে নৃত্য পরিবেশনায় হস্ত সঞ্চালন অসম্ভব, তাই আসুন এই মূর্তিটি ঠিক কি হতে পারে সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

এটি আর যাই হোক, সন্তান প্রতিপালিকা কোন মাতৃমূর্তি নয়। কারণ, সন্তান প্রতিপালনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে অফুরন্ত দুধের ভাণ্ডরূপী সুবিশাল স্তন। সন্তান প্রতিপালক মাতৃমূর্তি তাই বিশ্বের সমস্ত স্থানেই অনিবার্যভাবে স্ফীতবক্ষা। কিন্তু এটির স্তন মোটেই সু-উন্নত নয়। এই মূর্তিটির যে অংশটা সবথেকে বেশী প্রতীয়মান এবং প্রকট, সেটি হলো মূর্তিটির যোনিদেশ বা কামাঙ্গ। দেহের বাকি সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে এটিই সবথেকে স্ফীত, সুবিস্তৃত, ভগরেখা প্রায় নাভিমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কামাঙ্গটি বিশেষ ভাবে উদ্ধত। কেন জানিনা, দেশী বিদেশী কোনও পুরাতাত্ত্বিক বা প্রত্নতাত্ত্বিকের নজর এদিকে পড়েনি। এই ব্যাপারে আমাদের, মানে আমার আর আমার শিক্ষকসম অগ্রজবান্ধব ঐতিহাসিক সুজিত আচার্যের বিশ্লেষণটা শোনানোর আগে, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করছি। “দেবীর সমস্ত অঙ্গের মধ্যে জননাঙ্গকে প্রধানতম বলে বিচার করা হয়েছে বলেই তাঁর নাম ভগবতী।” এর পর বেদে ঐশ্বর্যের দাতা হিসাবে ভগ নামক দেবতার উল্লেখ করে তাঁর জিজ্ঞাসা, “…আদিতে যে নাম ঐশ্বর্যবাচক, সেই নামই নারী-জননাঙ্গ বাচক হয়ে দাঁড়াল কি ভাবে?” উত্তরে আবার তিনিই বলেছেন, “সম্ভবত নারীর জননাঙ্গকেই পার্থিব ঐশ্বর্যের উৎস মনে করা হত, তাই।” (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ঃ লোকায়ত দর্শন, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬৮-৬৯)। আমাদের আলোচ্য এই স্ফীতযোনি, নগ্নিকা সিন্ধু সভ্যতার ফসল আর ‘ভগ’-এর উৎস বেদের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

আলোচনার এই পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের চাষবাসের চিত্রটা একটু দেখে নেওয়া যাক। সিন্ধু সভ্যতার প্রথমদিকে জলসেচিত সমতলভূমিতে নানা খাদ্যশস্য ও তরিতরকারীর চাষ-আবাদ হলেও ধানের চাষ কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে। রেডিও কার্বন নিরুপিত প্রত্ন তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি যে খ্রীঃপূঃ দুহাজার সালের কিছু আগে থেকে সিন্ধু সভ্যতার দক্ষিণাংশে ধানচাষের প্রচলন ছিলো (বি &আর আলচিনঃ দ্য রাইজ অফ সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া &পাকিস্তান, পৃঃ ১১৫-১১৬)। পূর্ব ভারত থেকেই ধান চাষ ক্রমশ পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ পূর্ব ভারত থেকে দুটি ধারায় ধান্যোৎপাদক মুণ্ডারী ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা---যারা নৃতাত্বিক বিচারে আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীভুক্ত, উত্তর ও পশ্চিম ভারত অভিমুখে ক্রমব্যাপ্ত হচ্ছিল। ভারতে কৃষিবিকাশে এই আদি-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর মুণ্ডা, কোল, সাঁওতাল প্রভৃতি ‘ব্রাত্য’ মানুষদের অবানের প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রভাবিত তথা আর্যগর্বী ইতিহাসবেত্তারা চিরকালই চরম ঔদাসীন্য দেখিয়ে এসেছেন। মুণ্ডারী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের এই চিরস্মরণীয় অবদানের প্রত্ন ইতিহাস “Origin of the Mundas” নামে এক বৃহৎ প্রবন্ধে সোভিয়েত প্রত্ন-তথা-ইতিহাসবেত্তা জি. এম. বনগার্ড লেভিন তুলে ধরেছেন। প্রত্নসাক্ষ্য তুলে ধরে বনগার্ড লেভিন দেখিয়েছেন, উত্তর ভারতে আর্য আগমনের বহু শত বৎসর পূর্ব থেকেই এই মুণ্ডারী ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা দিল্লীর নিকটবর্তী হস্তিনাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাঙ্গণে কৃষির সূত্রপাত করেছিলো। ক্রমাগ্রসরমান এই ধান্যোৎপাদক রা দক্ষিণ রাজস্থান পার হয়ে সিন্ধু সভ্যতার দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে খ্রীঃপূঃ দুই সহস্রাব্দের কিছু আগে। এই সময়কালেই বর্তমান গুজরাটের লোথাল থেকে পাঞ্জাবের কালিবঙ্গানের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমিতে ধান চাষ হতো। মুণ্ডারী ভাষীরা সিন্ধু প্রাঙ্গনে প্রবেশের পর সেখানে প্রচলিত হলকর্ষণ নির্ভর কৃষির উপযোগিতা বুঝতে পেরে ধান্যোৎপাদনেও লাঙলের ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে সঙ্গত অনুমান। এটা ঠিকই যে, কোনও হরপ্পীয় শীলমোহরে এখনও পর্যন্ত লাঙলের কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি। কিন্তু তবুও কালিবঙ্গানে উদঘাটিত একটি প্রাচীন ক্ষেত্র থেকে হলকর্ষনের নিশ্চিৎ সমর্থন পাওয়া গেছে। এই হলকর্ষিত ক্ষেত্রের চিত্রটি আলচিনদ্বয়ের গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। চিত্রটিতে একদিকে লম্বালম্বি ভাবে অতি নিবিড় কর্ষন চিহ্ন; আবার সেই একই কর্ষিত জমিতে যথেষ্ট ফাঁক রেখে আগের কর্ষণ রেখার সঙ্গে সমকোণ সৃষ্টি করে আড়াআড়িভাবে কর্ষণ করা হয়েছিলো (প্রচ্ছদ চিত্র দ্রষ্টব্য)। আলচিন গ্রন্থকার দ্বয়ের মন্তব্য, “চিহ্নগুলি সংকেত দেয় যে একটি কাঠের লাঙল বা ‘অড়’ ব্যবহৃত হয়েছিলো।” স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীদের জীবনে লাঙল এক সমৃদ্ধির বার্তাবাহক। তাই লাঙলের প্রতিরূপ লিঙ্গ, যা নাকি যোনি কে কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করে বীর্যক্ষেপন দ্বারা, সেই লিঙ্গ একসময়ে পশুপতি দেবতার দেহচ্যুত হয়ে বেদীর উপর স্থাপিত হয়ে পূজিত হতে থাকে --- যে প্রতীকের পূজা আজও ভারতময় প্রচলিত।

পূর্বভারতের মুণ্ডারী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা যখন শিকারী ও কৃষক, এই দ্বৈত ভূমিকায় বিরাজিত থেকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, মনে হয় তখন তারা প্রতি বছরই শিকারের স্বার্থে নতুন নতুন এলাকায় উপস্থিত হত। আর চাষের মরসুমে সেই নতুন এলাকায় জঙ্গল সাফ করে সম্ভবত ঝুম পদ্ধতিতে কৃষিকাজে ব্রতী হত। ফলত প্রায় প্রতি বছরই তারা এক কুমারী মাটিতে শষ্যোৎপাদন করতো। কুমারী কেন? কারণ এর পূর্বে সেখানে আর কোনওদিন কেউ চাষ করেনি। কৃষির এই প্রাথমিক পর্যায়ে বীজ বপন ও ফসল কাটা ইত্যাদি কাজগুলি মেয়েরাই করতো বলে পণ্ডিতদের ধারণা। ফলে এই কুমারী মাটিতে কৃষির সাফল্যের প্রত্যাশায় কিছু যাদু-বিশ্বাসের উদ্ভব হওয়াটাই স্বাভাবিক। কুমারী কন্যা, যতদিন না ঋতুমতী হচ্ছে ততদিন তার যোনি লিঙ্গ কর্ষিত এবং বীর্যধারণ করলেও গর্ভবতী হতে পারতোনা। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ধারণা হয়েছিলো যে এই কুমারি মাটিও যদি ঋতুমতী না হয় তাহলে তার গর্ভেও শষ্যোৎপাদন হবেনা। সেই বিশ্বাসেই তারা কৃষিক্ষেত্রে বীজবপনের আগে এক প্রথম রজস্বলা কিশোরীকে নগ্ন অবস্থায় ঐ কৃষিক্ষেত্রের ওপর বিচরণ করাত এই বিশ্বাসে যে এর ফলে কৃষিক্ষেত্রটিও রজস্বলা হবে এবং গর্ভে বীজ ধারণ করে সন্তান সম শষ্যোৎপাদন করবে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া একটি তথ্য থেকে আমরা জেনেছি যে বর্তমান কালেও ভীলেরা চাষের পূর্বে এই আচার অনুসরণ করে। মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া ঐ অল্পবয়েসী, “যখন প্রথম ফুটেছে কলি”, প্রথম রজস্বলা কুমারীর প্রতিরূপ বলেই অনুমান। যদি আপনারা এটাকে একটা গালগল্প, গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আমার তুনীরে কিন্তু আরো একটা অমোঘ বাণ আছে! কি সেটি? গৌহাটির কামাখ্যা মন্দিরে কামাক্ষী দেবীকে ঘিরে প্রায় অবিকল এই প্রথা আজও প্রচলিত। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অম্বুবাচির দিনগুলিতে কামেশ্বর শিবের পত্নী কামাক্ষীদেবীও ঋতুমতী হন। ধরিত্রীও ঋতুমতী হয়। এই সময়ে তিনদিন কামাখ্যা মন্দিরের ফটক বন্ধ থাকে আর পাশের নালা দিয়ে অবিরত বয়ে যায় লাল রঙের তরল। আর আশে পাশের তো বটেই এমন কি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও কৃষিজীবি নারী পুরুষেরা কেউ কলসী, কেউ বোতলে ভরে এই জল সংগ্রহ করে নিয়ে যান বীজ বপনের আগে মাটিতে ছেটাবার জন্যে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অম্বুবাচীর দিনগুলিতে কামেশ্বর শিবের পত্নী কামাক্ষীদেবীও ঋতুমতী থাকেন; ধরিত্রীও ঋতুমতী হয়। আর অম্বুবাচীর পরেই প্রস্তুত জমিতে বীজ বপনের ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এছাড়াও, পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এখনও প্রচলিত রীতি হলো নতুন শস্যের জন্য বীজ বপনের আগে ক্ষেত সংলগ্ন একটি পাথরে লাল রঙ লাগিয়ে দেওয়া হয়, রজস্বলা নারীর প্রতীক হিসেবে। স্পষ্টতই বোঝা যায় একটিপ্রাচীন যাদু বিশ্বাস কিভাবে ধর্মীয় প্রথায় রূপান্তরিত হয়েছে।

আর একটা কথা। ব্রোঞ্জের নগ্নিকা মূর্তিটির বাঁ হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে একটি বৃত্ত রচিত হয়েছে। প্রত্নবিদ পিগটের অনুমান যে সেই বৃত্তে একটা ছোটো লাঠি ছিলো। কিন্তু লাঠি না হয়ে এই শষ্যের কর্ত্রীর বা দেবীর হাতে একগুচ্ছি ধানের শীষ বসিয়ে দিলে কেমন হয়? তবে মনে রাখতে হবে যে লিঙ্গ ও যোনীর এই কল্পনা কিন্তু কামাবেগ প্রসূত নয়। বরং শষ্যোৎপাদনে সমৃদ্ধির কামনা প্রসুত। উচ্ছৃত লিঙ্গ ৪২০ নং শিলমোহরটি যদি আদি শিব এর প্রতিমূর্তি হয়, তাহলে নগ্ন, শিরোভূষণ বিহীন এই মূর্তিটিকেও আদি কালী হিসেবে ধরাই যেতো। কারণ দেবীদের মধ্যে একমাত্র কালীই নগ্নিকা এবং শিরোভূষণহীনা। তদুপরি, মূর্তিটির দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা আমাদের বামা কালী বা দক্ষিনা কালীর কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু, না। আমি আপাতত একে কালী না বলে এক রজস্বলা কুমারী মেয়েই বলতে চাই। অন্তত যতদিন না হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। 



(চলবে )