মুক্তগদ্যঃ প্রান্ত পলাশ
Posted in মুক্তগদ্য
মুক্তগদ্য
বন্ধু, বিদায় অথবা ববি
প্রান্ত পলাশ
বন্ধু, বিদায়। সংক্ষেপে ববি। যতবার ‘বন্ধু, বিদায়’ বলতে চেয়েছি, ততবার সংক্ষেপরূপ ‘ববি’ শব্দটি বুকের ভেতর মৃদু কাঁপন ধরিয়ে বুকের ভেতরই ঘাপটি মেরে বসেছে। পরক্ষণেই হয়তো কর্পূরের মতো হালকা গন্ধ ছড়িয়ে উবে গেছে, জড়িয়েছে নতুন সান্নিধ্যে। আর আমিও তো জড়িয়েছি কত শব্দে, নির্বিচারে নিরর্থকতায়। কিন্তু ‘বন্ধু, বিদায়’ বলতে পারিনি। আবার নতুন করে পুরনো ‘ববি’, একটি নারীনাম কাঁপন ধরিয়েছে। আমি চিৎকার করে ‘বন্ধু, বিদায়’ না ‘ববি’ বলে বায়ুস্তর ফুটো করে দেব?
তখন বয়স দশ। বাবার শিফট ডিউটি, কেরুতে। আমাদের দুটো পেয়ারা গাছ। কোয়ার্টারের সামনে পড়ে থাকা ছোট ছোট মাঠে আমার বয়সীরা গোল্লাছুট, সাতচাড়া, সন্ধ্যার অন্ধকারে এ-কোনা ও-কোনায় লুকিয়ে উঁকি উঁকি খেলত। আমার খেলা হতো না। মা সারাদিন ‘বই পড় বই পড়’ করত। দিনে পেয়ারা গাছে উঠে হেলান দিয়ে দেখতাম সবাই খেলছে। আর আমি বই হাতে। সে-সময় ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে ধারে আনা রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব গুহ, বিমল মিত্র, নিমাই ভট্টাচার্য... পড়তাম, না বুঝেই। বড় বোনের বান্ধবীরা বাসায় এলে ‘বাপ রে!’ বলে হেসে উঠত। তারপর একসময় কীভাবে জানি ফাঁকিবাজি শিখলাম। বই হাতে রাখলেও পড়তাম না। স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হলেই মা তো খুশি! একরাতে বাবা আমাকে বলল, ‘কী রে, তুই না কি সুযোগ পেলেই পেয়ারা গাছে উঠে বসে থাকিস? কী করিস ওখানে?’ আমি বলি, ‘পেয়ারা খাই, বই পড়ি’। বাবা হেসে বলল, ‘কবিতা-টবিতা লিখিস না কি? তোর চোখ-মুখ তো কেমন লাগে!’ ‘আরে না’ বলতেই বাবা বলল, ‘লিখবি না কি?’ আমি না বুঝেই হ্যাঁ বলি, বলি, ‘তুমি শিখাবা?’ বাবা খাতা আনতে বলে। আমি শেষ পৃষ্ঠা খুলি। ‘সুকান্তের আশা/ আশায় বাঁধিয়া ঘর, বসিয়াছে বৃক্ষতল/ আঁখিভরা জল সদা ছলছল/ কবে হইবে তার বৃক্ষের মতো শতদল’––এইটুকু বলে বাবা বলে, ‘পরের লাইনগুলো তুই লিখিস’। আমি স্কুল শেষ করেই পেয়ারা গাছে উঠি। হাতে খাতা। মাথায় ওই চার লাইন। কী লিখি কী লিখি...
বাবা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। আজও পরের লাইনগুলো লিখে উঠতে পারিনি। মা এখনও বলে, ‘তুই তো ভাল ছাত্র ছিলি, রেজাল্টও ভাল, কিন্তু কিছুই করতে পারলি না!’ মায়ের আক্ষেপ বুঝি। বুঝি বাবার আক্ষেপও। যে-বার আমার প্রথম বই ‘সাধুখালির রাত’ বেরুলো, বাবাকে কুরিয়ারে পাঠিয়েছিলাম। এক অসুস্থ সন্ধ্যায় বাবা বুকের ওপর আমার বইটি রেখে মা-কে বলেছিল, ‘ছেলেকে বেশি বকাবকি করো না, ও তো ভাল লেখে!’ মা-ই জানিয়েছিল এ-কথা। বাবা ভুলে গেছে কি না জানি না, কিন্তু আমি এখনও ওই চারের পরের লাইনগুলো খুঁজি, লেখার চেষ্টা করি, পারি না। বাবার হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিল। একটা বড় কাগজে বড় হস্তাক্ষরে বাবার লেখা ছিল, ‘মাতা-পিতা হারা সন্তান/ এই পৃথিবীতে মৃতের সমান’। পেয়েছিলাম টিনের ট্রাংকে। বাবা একটু বেশি অসুস্থ হলেই এই লাইন দুটো মনে পড়ে। চোখে জল আসে। হায়, ওই লাইনগুলো না দেখেই... না, আমি ‘মৃতের সমান’ হতে চাই না কখনও!
বিদায় ব্যাপারটিই আমার ভাল্লাগে না। খুব ছোট থেকেই দেখেছি কোয়ার্টার ছেড়ে যাওয়া। কত জেলা থেকে মানুষ চাকরির জন্য আসে। রিটায়ার্ড হলে চলে যায়। অন্যরা ঢোকে, যায়। ছোটবেলায় শিউলিরা যখন কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও, আমি ওকে বিদায় বলিনি। আমি পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ট্রাকে ভর্তি হচ্ছে আসবাব। ভাবছিলাম, আর বোধহয় পাঁচকড়ি খেলা হবে না, কাঁঠাল গাছের নিচে মিথ্যামিথ্যি চড়ুইভাতি হবে না। ওরা গাড়িতে ওঠার আগে শিউলি এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসেছিল। বলেছিল, আর দেখা হবে না। আমি ভাবতেই পারিনি, কেন দেখা হবে না। বকেছিলাম ওকে, ‘ধুৎ, আরেকবার বললে এক চটকনা দেব!’ ‘আইচ্ছা হবে’ বলে শিউলি গাড়িতে উঠে যায়। আমাদের আর দেখা হয়নি। শুধু একবার ওর বিবাহবিচ্ছেদের খবর পেয়েছিলাম।
আমি কাউকে বিদায় বলিনি। কাউকে বিদায় বলতে হবে কি না জানি না। আমাকেই ছেড়ে গেছে সব। আমি কিছুই ছাড়িনি। শৈশবের সেই পেয়ারা গাছ দুটো আমাকে ছেড়েছে। দু’বছর আগে সেখানে গিয়ে দেখি, সেই কোয়ার্টার নেই, সেই পেয়ারা গাছও নেই, নেই কাঁঠাল গাছটাও। সেখানে হলুদখেত। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠছিল বইহাতে একটি ছোট্ট ছেলের তরতর করে পেয়ারা গাছে ওঠার দৃশ্য!
যাওয়ার মাসখানেক আগে কাকলি বলেছিল, ‘বাবা রংপুর সুগার মিলে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে’। তখন কিশোর আমি। মেয়েরা যেমন হয়, কাকলিকে বড়ই দেখাত। ওর বাবা ছিল বড় কর্মকর্তা, থাকত বাংলোপাড়ায়। কাকলি প্রায় বিকেলে ওদের মালিকে পাঠাত আমাকে নিয়ে যেতে। যেতে ইচ্ছে করত না। বড় গেইট, দারোয়ান, মালি ঠেলে ওদের বাংলোয় যাওয়ার কথা ভাবলেই বুকটা কেমন করত। হয়তো হীনমন্যতা ছিল। আমি কানাপুকুরের পাড়ে ফেলে রাখা অসংখ্য গাছের গুঁড়ির একটিতে বসতাম, আর ভাবতাম ওই তো ওখানে কাকলিরা থাকে। ওদের মালি এসে দীর্ঘক্ষণ আমার পাশে বসে থাকত, বলত, ‘দিদি বলেছে আজ আপনাকে নিতে না পারলে খবর আছে!’ আমি যেতাম না। একদিন কানাপুকুরে কাকলি হাজির। আমার দিকে না তাকিয়ে মালিকে বলল, ‘তাকে জিজ্ঞেস করেন, আর কয়দিন ডাকলে বাসায় যাবে। বাসায় আসলে কী হয়’। কাকলি হনহন চলে যায়। আমি বড় মসজিদের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি। একদিন ওর বাসায় না গিয়ে উপায় থাকে না। রাতে নিমন্ত্রণ, আমাদের পুরো পরিবার। ওর ছোট বোন ডলি ‘দাবু’ বলে দুষ্টুমি করে। আমিও হাসি, আমার বড় বোনও হাসে। সেদিন রাতে কাকলি একটি গল্প বলতে চেয়েছিল। কিন্তু এক ঘটনায় তা আর বলা হয়ে ওঠেনি। তবে শুরু করেছিল। ‘একটি বক মহাসমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢেউয়ে ভেসে আসছে অমৃতফল। বকটা হা’... বলতেই হা হা করে কাকলি হাসছিল। সাথে আর সবাই। আবার সেই দু’লাইন, বকটা হা বলতেই হাসি। ‘আশ্চর্য, বললে বলো, নাইলে উঠে যাচ্ছি’ বলতেই কাকলি বাম হাতে চোখ ঢেকে ডান হাতে ইশারা দিল। দেখলাম প্যান্টের চেইন খোলা। আমার মুখ লাল হয়ে উঠল, আর কথা বেরোয়নি। পরের কথাগুলো থাক। যাওয়ার আগে কাকলি চিঠি দিতে বলেছিল। ওর মা বলেছিল, ‘বাবা, আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখো। কাকলি তোমাকে খুব পছন্দ করে।’ আমার আর চিঠি দেওয়া হয়নি। মুঠোফোনযুগে প্রবেশের পর আমার বাবা কাকলির বাবার নাম্বার যোগাড় করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘মুকুলবাবুর সাথে কথা বলে দেখ’। আমার আর ফোন করা হয়নি। ও এখন কোথায়, কার ঘরে, কয় সন্তানের জননী––আমার কিছুই জানা নেই। কাকলির সেই ছোট্ট মুখটা খুব মনে পড়ে। স্পষ্ট চোখে ভাসে। চোখে ভাসে ওদের আসবাবপত্র ঘরশূন্য হওয়ার দৃশ্য।
‘বন্ধু, বিদায়’ আমি কখনওই বলিনি। বিছানায় এলেই যে একে একে সব মুখ আছড়ে পড়ে, তাদেরকে কীভাবে বিদায় বলি। জানি ‘বন্ধু, বিদায়’ নেই, ‘ববি’ আছে? শুধু মনে মনে ‘ববি, ববি’ বলে চিৎকার করতে পারি। একমাত্র আমিই জানি ‘ববি’ শব্দে কোন ধ্বনি দীর্ঘ হয়ে আমাকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, আরেক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে বলে...