অনুবাদ সাহিত্য : ইন্দ্রাণী ঘোষ
Posted in অনুবাদ সাহিত্য
অনুবাদ সাহিত্য
চার্লস ল্যম্ব -এর ‘দ্য ড্রিম চিলড্রেন’ অবলম্বনে
স্বপ্ন দেশের শিশুরা
ইন্দ্রাণী ঘোষ
শিশুরা গল্প শুনতে ভালবাসে বড়দের শিশুবেলার। কল্পনার ডানা ভাসিয়ে দেখতে চায় সেই ঠাকুরমার ঝুলির ঠাকুমার ছবিকে, যা তারা কোনদিন দেখে নি। এই খেয়ালকে ঝুলি থেকে বার করে সেইদিন এলিস আর জন আমার কাছ ঘেঁষে গুটিগুটি এসে বসল। আজ তারা ঠাকুমা ফিল্ড -এর গল্প শুনবে।
মাতামহী ফিল্ড থাকতেন নরফক -এর বাড়ীতে। সে এক বিশাল প্রাসাদ। শ্রীমতী ফিল্ড সে প্রাসাদের মালকিন না হলেও সে প্রাসাদ ছিল তাঁর প্রাণের বাসা। এই অট্টালিকার যত্নের ভার ছিল তাঁর উপর। সে বাড়ীর আনাচ কানাচ থেকে শুরু করে বড় বড় কাঠের প্যানেল ছিল গল্প খোদাই করা। জঙ্গলের শিশুদের কথা থেকে শুরু করে রবিন রেড ব্রেসটের সব গল্প। এক প্রতিপত্তিশালী ব্যবসাদার বাড়িটি কিনে নিল, ভেঙ্গে গেল সব গল্প। এলিস এই সময় তাঁর চোখ দুটোতে নরম উষ্ণতা মাখিয়ে ফিরে তাকাল। তার না থাকা মায়ের ছবি সে চোখের আয়নায় ভেসে উঠল। গল্প চলতে শুরু করল আবার।
মাতামহী ফিল্ডকে ভালবাসত সকলে, তাঁর মৃত্যুর পর, গ্রামের সব মানুষ ভিড় করে এসেছিল, তাঁর শেষ যাত্রাতে সামিল হতে। ফিল্ড ছিলেন ধর্মপ্রাণা, খ্রিস্টের সব ভজন ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। বাইবেলের অনেকটা অংশ ছিল তাঁর মুখস্থ। নৃত্য পটীয়সী ছিলেন ফিল্ড। যৌবনে তাঁর নৃত্যলীলায় মুগ্ধ ছিল সারা পৃথিবী, তারপর দুরন্ত ক্যান্সার কেড়ে নিল তাঁকে। এলিসের ছোট পা দুখানি যেন কেঁপে উঠল। গল্পের স্রোত বয়ে চলল, মাতামহী ওই বিশাল প্রাসাদে একা থাকতেন, আর অট্টালিকার আনাচে কানাচে অশরীরীরা তো থাকবেই। মাতামহী কিন্তু ভয় পেতেন না এদের। এক কোনার ঘরে একলা বসে তিনি দেখতে পেতেন ছোট দুটো ছায়া ওঠানামা করছে বিশাল সিঁড়ি বেয়ে। বাড়ীর অন্যরা কিন্তু বেশ ভয় পেত এই ছায়ামূর্তিদের। মাতামহী বলতেন, ওই শিশুরা কি বা করতে পারে আমায়? তিনি দেখতে পেতেন এই শিশু আত্মাদের, সাধারণ দৃষ্টির বাইরে গিয়ে। এই মুহূর্তে জন তার ঘন ভ্রু-যুগল কুঞ্চিত করে তাকাল, আবার তা সোজা করে দিল, সাহসের প্রমাণ দিতে।
গ্রীষ্মের ছুটি, খ্রিস্মাসের ছুটিতে ছোটদের ঠিকানা ছিল নরফকের এই রহস্য আর স্বপ্নে ঘেরা বাড়ি। সেই সময়ের শিশুরা রাজা সিজারের মর্মর মূর্তিগুলিকে জীবন্ত কল্পনা করত, কখন বা নিজেদের রাজা ভেবে বসত। ওই বিশাল বাড়ির মস্ত সিঁড়ি, মস্ত ওক প্যানেল, বিশাল বাগান, মলিন হওয়া ছবি সব মিলিয়ে ছোটদের কাছে এক ‘সব পেয়েছির জগত’। এই বাড়ীর আনাচে কানাচে নিভৃত অভিযানের হাতছানি অনেক বছর পর বড় হয়ে যাওয়া শিশুদের টানে আজও। বাগানে কর্মরত বৃদ্ধ মালী হয়ত দেখে ফেলত শিশুদের এই কল্পজগত, তবে সে থাকত নির্বিকার, গাছে রস ভর্তি কমলালেবুর মত বা গাছের মধুভর্তি ফুলের মত। আস্তে আস্তে দুলত পিচ গাছের ফল। রঙিন পাইক মাছ স্থির হয়ে থাকত জলে, যেন চারিদিকের ছোট ছোট অস্থিরতাকে সে ব্যাঙ্গ করছে বিজ্ঞের মত।
মাতামহীর নয়নের মণি ছিল সিনিয়র জন, তাঁর উদ্দামতা মুগ্ধ করত মাতামহীকে। বিশাল অট্টালিকার আনাচ কানাচ তাকে টানত না। রাজপুত্রের মত পক্ষী- রাজ হাঁকিয়ে সে ছুটত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কখন বা পিঠে করে নিয়ে যেত সেই ছোট ছেলেটিকে যার একটা পা অকেজো। সিনিয়ার জনও অসুস্থ হল, তাঁর একটা পা জখম হল। ডাক্তার তার জখম পা- টিকে বাদ দিলেন। এই পর্যন্ত শুনে এলিস তীব্র আপত্তি জানাল, দাবী করল গল্পের স্রোতমুখ ঘুরিয়ে দেবার জন্য। এই দুঃখের গল্প আর ভাল লাগলনা।
এবার তাদের আব্দার তাদের মায়ের গল্প শুনবে। মা কে তারা দেখে নি, তিনি নাকি পরমা সুন্দরী ছিলেন। তাঁর একরাশ সোনালী চুল আর নীল চোখের ছায়া যেন ছোট এলিসের মাঝে দেখা গেল। ভুলে যেতে হল অতীত আর বর্তমানের বিশাল দূরত্বের কথা। ঠিক এই সময় শিশুদুটি যেন মিলিয়ে গেল অসীমে। তারা যে আসলে স্বপ্নের শিশু। হাজার হাজার বছর ধরে ওদের অপেক্ষা করতে হবে লিদ নদীর তীরে এই পৃথিবীতে জন্মানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। জন আর এলিস স্বপ্নে এসেছিল। তারা স্বপ্নের শিশু। না বলা গল্প স্বপ্নে রয়ে গেল। ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমি আমার চিরকুমার কুর্সিতে এলিয়ে বসে আছি একা। কখন যে চোখে স্বপ্নরা ভিড় করে এসেছিল বুঝতেই পারি নি।