বিশেষ রচনা: মকসুদা হালিম
Posted in বিশেষ রচনাবিশেষ রচনা
মুখপাত
শ্রীমতী মকসুদা হালিম বাংলাদেশের একজন উদারচেতা মননশীল মানুষ। তাঁর কাছে আমরা ঋতবাকের জন্য লেখা চেয়েছিলাম। সময় স্বল্পতায় তিনি তাঁর একটি ব্যক্তিগত অনুভব আমাদের কাছে উন্মুখত করেছেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরকে অতিক্রম করে বেশ কিছু সার্বজনীন প্রশ্নের উপরে আলোকপাত করেছে ।
সেই লেখাটি এখানে আমরা প্রকাশ করলাম ।
স্বগতোক্তি
মকসুদা হালিম
আমার মতো শ্রদ্ধেয়া একবার ভালবেসে কাছে টেনে নিয়ে আবার কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি
-এই অভিযোগের জবাব।
আমি মকসুদা হালিম কাউকে ভালবেসে কাছে টেনে আবার তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবো--- এ ধরণের মন মানসিকতা আমার নাই। যাকে একবার ভালবেসে পাশে স্থান দেই, সে আদরণীয়ই থাকে সর্বদা।
আমি কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দেই নাই। শুধু নারী জাতিকে অশ্রদ্ধা, আর অসম্মান, আমাকে ক্রুদ্ধ করে। যারা নারীকে সম্মান জানাতে পারে না, তাদের তো নারীর বন্ধু হওয়া সাজে না। এদেরকে আমি আন ফ্রেন্ড করি মাত্র, ছুঁড়ে ফেলি না।
কেউ কেউ অনুশোচনা করে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে, আবার কেউ কেউ এতো দাম্ভিক যে মাতৃসম কারো কাছে ক্ষমা চাইতেও তাদের অহংএ বাধে।
প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখো ! পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতায় নারীর মহিমা উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মগ্রন্থেই নারীর অসীম শক্তির মহিমা কীর্তন ব্যক্ত হয়েছে। কয়দিন আগেই একটা গ্রুপে বিতর্ক হচ্ছিলো-‘বিধাতা’ পুরুষ নাকি নারী ? সাব্যস্ত হল— ‘বিধাতা’ অবশ্যই নারী, নচেৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হলো কি ভাবে ?
হিন্দু শাস্ত্রে ‘বিধাতা’ জগজ্জননী ! আদ্যাশক্তি মহামায়া নারী। নিজের অংশ দিয়ে দেবতা সৃষ্টি করেছেন। স্বর্গলোকে বিপদগ্রস্ত হলে এইসব বাঘা বাঘা দেবতাদেরও কিছু করার ক্ষমতা নাই, তখন নারীশক্তির ডাক পড়ে ! মহাদেব শঙ্করের মতো ধ্বংসের দেবতাও নারীর পদতলে পিষ্ট হয়।
হাদিস বলে, ‘জননীর পদতলে জান্নাত। জননীকে সন্তুষ্ট রাখো, জান্নাত অবধারিত !’ পিতার কথা বলা হয় নি। আল- কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘শেষ বিচারে হাশরের ময়দানে প্রতিটা জীব মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হবে। পিতৃ নয়’!
সৃষ্টিকর্তা নরক সৃষ্টি করেছেন, কাদা দিয়ে। নারীর অঙ্গে কর্দম লেপন করেন নি। পুরুষের পাঁজরের হাড় ছিনিয়ে নিয়ে নারীকে সৌন্দর্য মন্ডিত, মহিমান্বিত, সকল শক্তির আধার আর কমনীয় করে গড়েছেন। এই পাঁজরের হাড় পুরুষ স্বেচ্ছায় দয়া করে দান করে নি। সৃষ্টিকর্তার এ হেন কর্মের তাৎপর্যও কেউ চিন্তা করে দেখে না। পাঁজরের হাড় যেমন জীবের বেঁচে থাকার উপকরণ সমূহকে সুরক্ষিত রাখে তেমনি নারীও পুরুষের সকল নিদান কালের ত্রাতা !
‘নারী নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ না করলে আমরা আজ বেহেশতে মহা আরামে বাস করতাম’—এই কথা যারা বলে, তারা নিতান্তই অধার্মিক ! কারণ আল্লাহ কোরআনে স্পষ্ট করে বলেছেন, এই পৃথিবীতে তিনি মানুষের আবাদ করবেন বলেই মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনকিছুই হয় না। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নারী এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছে। পুরুষ করতে পারে নাই।
পৃথিবীতে কোন নারী নবী-রাসুলের আবির্ভাব হয় নি সত্য কিন্তু নারী এই নবী রাসুলের জন্ম দিয়েছে ! নারী রাষ্ট্র শাসন করবে না, কারণ রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই অমানুষ ! নারী বিশ্ব শাসন করবে। জননী, জায়া, প্রেয়সী, ভগিনী কন্যা হয়ে নারী যে স্নেহ, মায়া, সহানুভূতি, প্রেম আর সেবা দান করে, বিশ্ব সংসার তার কাছে নতজানু ! ষণ্ড পুরুষের মতো নারীর গায়ে শক্তি নাই, সে গোলাপের মতো কোমল, যার ঘ্রাণে বিশ্ব জগত আমোদিত। নারী যে আন্তরশক্তিতে কি বিপুল শক্তিময়ী— বহু প্রাচীন কাল থেকেই পুরুষ সেটা টের পেয়ে শঙ্কিত হয়েছে ! নারীর শক্তি খর্ব না করলে তাদের অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যাবে, আর নয় তো পুরুষ মৌমাছির মতো নারীর দাসত্ব করে যেতে হবে।
তাই পুরুষ যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে, আচারের নামে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে নারীকে পদতলে পিষ্ট করে চলেছে। আর বেঁধে পিটালে, সিংহও তার স্বভাব ভুলে সার্কাসের ক্লাউন সাজতে বাধ্য হয় ! নারী যে আশালীন- অশ্লীল আচরণ করে তার জন্য দায়ী কে ? নারী, নাকি পুরুষ ? পরিবেশ আর পরিস্থিতি নারীকে অশালীন করে।
নারীর যৌবন আর সৌন্দর্যকে পণ্য করে পুরুষেরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা বানিয়ে নিজেদের উদর পূর্তি করে। তোমরা পুরুষেরা নারীকে নিয়ে বাণিজ্য করবে, আবার চাইবে নারী বোরখা পরে হেরেমে বন্দী থাকুক ? তেইশ জোড়া এক্স ক্রোমোজোমের সবটুকু নিয়ে নারী পরিপূর্ণ—স্বয়ং সম্পূর্ণ মানবী ! তার মধ্যে কোন ভেজাল নাই। একটা ওয়াই-এর ভেজাল নিয়ে পুরুষের কিসের এতো অহংকার ?