Next
Previous
Showing posts with label পথে প্রবাসে. Show all posts
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



আমার ভারতবর্ষ

মুসম্মন বুরুজ (শাহি বুরুজ)



নসিব-এ-হিন্দৌস্তাঁ

পর্তুগিজ যাজক বুজিও এদেশের লোককে খুব ভালো চিনতেন। সেই কবে মানুচ্চিকে বলেছিলেন, ' দারা অত্যন্ত ভালো লোক, উদার, বুদ্ধিমান, সুশাসক। কিন্তু সেটাই এদেশের লোকের কাছে তাঁর প্রধান দোষ। হিন্দুস্তানের লোকেরা নীচ স্বভাবের। তারা দারা শুকোহের মতো মহান, হৃদয়বান শাসককে ভক্তি করেনা। তাদের জন্য দরকার তাদের মতো'ই নীচ, নৃশংস, অত্যাচারী স্বভাবের শাসক।

বের্নিয়ার আর ত্যাভারনিয়েরও খুব অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, দিল্লি-আগ্রার সব প্রভাবশালী আমির-ওমরাহরা সারা জীবন বাদশা শাহজাহানের থেকে কী ধরনের সাহায্য, অনুকম্পা লাভ করেছিলেন। বাদশা শাহজাহানের দৌলতেই তাঁরা লাভ করেছিলেন ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু অসুস্থ, অসহায় বাদশাকে পুত্র অওরঙ্গজেব যখন আগ্রা দুর্গে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে গৃহবন্দি করলেন, তাঁরা কেউ টুঁ শব্দ করলেন না। পিতৃপ্রতিম বাদশাহকে তাঁরা নীরবে, সভয়ে, সশংক ত্যাগ করলেন।


হিন্দুস্তানের সর্বকালের সবচেয়ে বিলাসী, সম্পদশালী, জাঁকালো রাজা নির্বাসিত হলেন আগ্রা দুর্গের এককোণে। তখন তাঁর রাজত্ব বলতে শুধু মুসম্মন (শাহি) বুরুজ আর শাহজহানি মহল। শুশ্রূষা বলতে কন্যা জহানারা বেগম। তবে অওরঙ্গজেব বাদশাহের জনানা মহলকেও সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই জীবিত বেগম আকবরি মহল আর ফতেহপুরি মহল। শাহজহানের প্রথম সন্তান শাহজাদী পরহুনর
বেগমও ছিলেন সেখানে। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিলোনা। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেখাশোনা করতেন বাদশাহ এবং সঙ্গিসাথিদের। তিনি চলে যেতে দায়িত্বে আসেন একজন নীচ স্বভাবের খোজা সর্দার, মুতমদ। মানুচ্চির ভাষায়, 'বেবুনে'র মতো চেহারা তাঁর। প্রতিপদে বাদশাকে অপদস্থ করাই ছিলো তাঁর প্রিয় কাজ।
বাদশাহ শাহজহান তখন খুবই ধর্মমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কোরান পড়তেন, জপ করতেন, পণ্ডিতদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বাকি সময় শাহজহানি মহলের ঝরোখা থেকে তাজের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করা মানা ছিলো। একে ওকে চিঠি লিখতেন বলে অওরঙ্গজেবের আদেশে বাদশার মহলে কালি-কলম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিঠি বলতে শুধু অওরঙ্গজেব আর তাঁর মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করে লেখা পত্ররাজি। যার মধ্যে শুধু অওরঙ্গজেবের চিঠিগুলি উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি সমানে দোষারোপ করতেন দারা আর তাঁর ওয়ালিদসাহেবকে। একমাত্র বক্তব্য, যদি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এতোদিনে হিন্দুস্তান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হয়ে যেতো।

বাদশা শাহজহান পূর্বপুরুষ, যেমন আকবর আর জহাঙ্গিরের সূর্যদর্শনের জন্য নির্মিত লালপাথরের বুরুজটিকে নতুন ভাবে বানিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলের যমুনা নদীর শোভা দেখার জন্য। আগ্রা দুর্গের এটিই সব চেয়ে উঁচু নির্মাণ। সতেরো শতকে তিনের দশকে তৈরি আটকোনা মর্মর পাথরের এই প্রাসাদটির সৌন্দর্য এক কথায় অনুপম। এই প্রাসাদটির মর্মর পাথরের জাফরি, কুলুঙ্গি আর দেওয়ালের ইনলে কারুকাজ পিয়েত্রা দুরা শৈলীর। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে গোল বুরুজ আর চমৎকার ফোয়ারা। বন্দি বাদশা শাহজাহান এখানেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ আট বছর। এই প্রাসাদের ঝরোখা থেকেই তিনি তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাঁর অন্তিম শয্যাও পাতা হয়েছিলো ঠিক এর মাঝখানে। গ্রেট মুঘলদের উপযুক্ত একটি কীর্তি, মুসম্মন বুরুজ।

তখন বয়স চুয়াত্তর। পয়লা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৬। সোমবার। বাদশাহ বুঝতে পারলেন দিন শেষ হয়ে এলো। কিন্তু তিনি সজ্ঞানে, সচেতন আছেন। জহানারার অনুরোধে লিখলেন পুত্র অওরঙ্গজেবের অপরাধ মার্জনা পত্র। লিখলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটিও। কীভাবে অন্ত্যেষ্টির কাজ করতে হবে, তার নির্দেশ। জহানারা কাঁদছিলেন। তাঁকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বাকিদের বললেন জহানারার যত্ন করতে। রাতের থেকেই তাঁর জন্য কোরান পাঠ শুরু হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনিও শেষ প্রার্থনা সমাপন করলেন। ভোর তিনটে নাগাদ বাদশাহ শাহজাহানের ইন্তেকাল হলো।

জহানারা অনুরোধ করলেও অওরঙ্গজেব 'শাহি দাফন' মঞ্জুর করলেন না। আগ্রা থেকেই সইয়দ
মহম্মদ কনৌজি আর কাজি কুরবান এসে তাঁর মরদেহের পরিচর্যা করে একটি চন্দন কাঠের কফিনে স্থাপন করলেন। অওরঙ্গজেব এলেন না। পুত্র মোয়াজ্জামকে পাঠালেন। যমুনা নদীতে বজরা করে নিয়ে যাওয়া হলো তাজমহলে। মমতাজমহলের পাশের কবরে বাদশা শাহজহান সমাহিত হলেন দুপুর নাগাদ।

এসবই মনে পড়ছিলো যখন মুসম্মন বুরুজের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে বাদশাহের সাড়ে তিনশো বছর পর তাজকে দেখছিলুম আমরা। শাহজহানকে মনে পড়ছিলো। তাঁর শান-শওকত, অজেয় প্রতাপ, অপার ধনসম্পদ। এভাবেই শেষ হয়। মনে পড়ছিলো পাদরি বুজিওর ভবিষ্যদবাণী। এদেশের লোক ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণেই বেছে নেয় অওরঙ্গজেবের মতো শাসক। দারাশুকোহ তাদের জন্য অপাংক্তেয়। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের নসিবও এক নরক থেকে অন্য নরকের কুম্ভীপাকে আবৃত্ত হতে থাকে। পরিত্রাণ পেতে অনেক রক্তক্ষয়, শহাদৎ….


আমরা হয়তো ভুলিনা। আবার মনেও রাখিনা। এই আমাদের ভারতবর্ষ...

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



আমার ভারতবর্ষ
রাজারানি মন্দির

দেবতার নেশা থাকেনা। মন্দিরের থাকে। এমন একটা দেশে জন্মেছি যেখানে এই নেশার জোগান পথেঘাটে। মন্দিরের আটদিকের শিখরে যেমন দিকপালেরা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, দেখে যান, অপলক পাথরের চোখ দিয়ে। আমি মানুষ সেভাবেই তাঁদের দেখে যাই। বুঁদ হয়ে ভাবি, এমন বন্ধু আর কে আছে?

সে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় একহাজার বছর ধরে। একভাবে, ত্রিভঙ্গমুদ্রায়, একটা সাজানো কুলুঙ্গির ফ্রেমে। দু'হাত মাথার উপর, ধরে আছে বৃক্ষশাখা। ওষ্ঠাধরের হাসিটি লিওনার্দো কোনওদিন দেখতে পেলে মোনালিসা আঁকা ছেড়ে দিয়ে পায়রা পুষতেন। তাহার নামটি শালভঞ্জিকা। তার চারপাশে অজস্র নায়িকা, যক্ষী, সুরসুন্দরী
নিরীহ দর্শকদের বেঁধে রাখে মোহমদির অপাঙ্গমায়ায়। দেবা না জানন্তি, আপ্তবাক্যের একটি পাথুরে প্রমাণ। মন্দিরটা তৈরি হয়েছিলো একাদশ-দ্বাদশ শতকে। কলিঙ্গ শিল্পস্থাপত্যের শেষ উজ্জ্বল নিদর্শন এবং একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এর জগমোহনটি নিখুঁত কলিঙ্গশৈলীর প্যাগোডাধর্মী হলেও এর বিমান বা শিখরটি পঞ্চরত্ন এবং অবিকল যে শৈলীটি মধ্যভারতের খাজুরাহো-কেন্দ্রিক চন্দেল স্থাপত্যের একটি মূর্ত রূপ। সম্ভবতঃ সারাদেশের একমাত্র পূর্ণ দেবালয়, যেখানে কোনও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই মন্দিরটি সৌন্দর্যতত্ত্বের দিক দিয়ে এককথায় অনুপম। ঐতিহাসিক, শিল্প বা সমাজতত্ত্ব যে কোনও নিরিখেই হোক না কেন। সব কিছু নিয়ে এই নির্মাণটি একটি এনিগমা হয়ে রয়ে গেছে।
আমাদের দেশের মেয়েরা তো সততই সুন্দর। অর্ধেক আকাশ হয়ে বাকি আকাশটাকে ধরে রাখে। এটাও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালে পুলকবাবুর গপ্পো। সেটা জানেন না বুঝি? একবার মান্না দে আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এক মফস্সলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন গাড়িতে। কারুর খোঁজও করছিলেন বোধ হয়। এমন সময় সামনের একটি বাড়িতে খোঁজ নেবার জন্য করাঘাত করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে এসে দাঁড়ালো। পুলকবাবুরা যাঁর খোঁজ করছিলেন তাঁর কথা আর মনে নেই। দরজার ফ্রেমে শুধু মেয়েটিই রয়েছে তখন। 'কী কথা তাহার সাথে' কিছুই মনে নেই তাঁর। গাড়িতে
ফিরে এসে মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো অধরা কিছু শব্দ, লাইন করে। এভাবেই তৈরি হয়েছিলো মান্নাদার সেই অমোঘ প্রশ্নময় গানটি। " ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !" আমাদের কলেজকালের শোনার, শোনানোর গান। ইমপ্রেস করে ফেলা গ্যারান্টিড। এখন মেয়েদের ইমপ্রেস করার ধরণটা বোধ হয় বদলে গেছে। তা যাক। জানিনা, জানিনা কেন এমন হয়? তুমি আর নেই সে তুমি।
এখানেই মজাটা। সেই মেয়েগুলো কিন্তু মন্দিরের গায়ে হাজার হাজার বছর ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও ক্লান্ত হয়না। পুরোনো হয়না। সামনে গিয়ে যেই দাঁড়াই, ধক করে বুকে বাজে। "ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !!"

রাজারানি মন্দিরের সামনে এসে হঠাৎ এসে দাঁড়ালে এই গানটাই মনে পড়ে যায়। নামটাই দেখা যাক না কেন? রাজারানি মানে রূপকথার মানুষ নয়। ওটা এক ধরণের বালিপাথরের নাম। যার মধ্যে হলুদ আর লালচে আভা পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে। মাপের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তেমন কিছু বিপুল নয়। বিশেষত সমকালীন পুরী জগন্নাথ মন্দির বা ভুবনেশ্বর লিঙ্গরাজ মন্দিরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলেনা। ১৭.৯ মিটার উঁচু পঞ্চরথ দেউলটির জগমোহন ত্রিস্তর। বিস্ময়করভাবে এই রেখদেউলটির নকশা 
খাজুরাহোর মন্দিরগুলির সঙ্গে মেলে। কলিঙ্গ শৈলির থেকে পৃথক। মন্দিরটির স্থাপত্য পঞ্চাঙ্গ রীতির। এর মধ্যে পাভগ, তালজঙ্ঘা, বন্ধন, উপরজঙ্ঘা এবং বারন্দা নামের পাঁচটি অংশ রয়েছে। ভিত্তিভূমির পাভগ অংশে আবার রয়েছে পাঁচটি অলংকৃত স্তর; খুর, কুম্ভ, পট্ট, কানি এবং বসন্ত। এর উপরের গণ্ডি ও শিখর অংশ ঘিরে রেখেছে ছোটো ছোটো অঙ্গশিখর। শীর্ষে যথারীতি আমলক ও কলস। জগমোহনটি বর্গাকার এবং নিরলংকার। সচরাচর অন্য সমস্ত কলিঙ্গ
মন্দিরের জগমোহন বা পীড় অংশটি বিশেষভাবে অলংকৃত থাকে এবং আয়তাকার। এই মন্দিরটির জগমোহন ও গর্ভগৃহ ব্যতিক্রমী নিদর্শন। এই দুই অংশ দেখলে মনে হবে হঠাৎ কোনও কারণে এর নির্মাণ পরিত্যক্ত হয়েছিলো। এই রকম একটি সাড়ম্বর প্রস্তুতির মন্দিরে গর্ভগৃহ শূন্য। প্রবেশপথে নাগ এবং নাগিনী মূর্তি ও শৈব দ্বারপাল সূচিত করছে এটি শিবমন্দির হিসেবেই নির্মিত হয়েছিলো। এর সঙ্গে লকুলীশ মূর্তির ভাস্কর্যও শৈব আনুগত্যের প্রতি নির্দেশ করে। সেই সূত্রেই ধারণা করা হয় কোনও রকম বিগ্রহরহিত হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরটি ইন্দ্রেশ্বর শিবের প্রতিই উৎসর্গীকৃত ছিলো। কৃষ্ণচন্দ্র পাণিগ্রাহী বলেছেন একাম্রপুরাণে এই রকম উল্লেখ পাওয়া যায়।

মন্দিরটির নির্মাণ সময়কাল বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতেরা মোটামুটিভাবে একই সময় নির্দেশ করেছেন। ব্রাউনসাহেবের মতে এই মন্দিরটি অনন্ত-বাসুদেব মন্দিরের সমসাময়িক, অর্থাৎ এগারো বারো শতক নাগাদ। সরসীকুমার সরস্বতী এই মত সমর্থন করেন। ফার্গুসন সাহেব বলেছেন মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১০৫ সালে। মন্দিরটির স্থাপত্যকলা যেহেতু মধ্যভারতের শৈলির অনুরূপ তাই একটা মত রয়েছে যে বুন্দেলখণ্ডের সোমবংশীয় রাজারাই প্রকৃত নির্মাতা। তবে টাকাপয়সা যেই জুগিয়ে থাকুক না কেন, এই মন্দিরটি কলিঙ্গের ভাস্কর ও স্থাপত্য শিল্পীদের জয়গান অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে প্রায় হাজার বছর ধরে।
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





   
 আমার ভারতবর্ষ
গোলকোণ্ডা: কুতুবশাহি করামত
গোলকোণ্ডা দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিলো চারশো ফুট উঁচু একটি গ্র্যানাইট পাহাড়ের উপরে। চারদিকে ধু ধু ঊষর সমভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজকীয় নির্মাণটির দৃশ্য এককথায় রোমাঞ্চকর। দুর্গটির আকার রম্বাস সদৃশ। চারদিকের ভূবলয় ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। দুর্গের বাইরের প্রাকারটির পরিধি সাত কিমি।প্রাকারটি গভীর, প্রশস্ত পরিখা দিয়ে ঘেরা। তিনটি প্রাচীরের বৃত্ত এই
দুর্গকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছিলো। পাহাড় থেকেই গ্র্যানাইট পাথর কেটে প্রাকার ও অন্য নির্মাণগুলি করা হয়েছিলো। ভিতরে ঢোকার পথ ছিলো মোট আটটি। তবে তার মধ্যে চারটি ছিলো প্রধান। পূর্বদিকে ফতেহ দরওয়াজা। পশ্চিমে মক্কা দরওয়াজা। উত্তরে বঞ্জারা আর উত্তর-পশ্চিমে পত্তনচেরু দরওয়াজা। হায়দরাবাদের দিক দিয়ে এলে ফতেহ দরওয়াজা দিয়েই ঢুকতে হয়। ফতেহ দরওয়াজা অর্থাৎ বিজয়দ্বার।

তিনটি প্রাকারশ্রেণীর প্রথম প্রাকারটি ঘিরে আছে সম্পূর্ণ পাহাড় এবং চারদিকের সমভূমি। দ্বিতীয় প্রাকারটি রয়েছে পাহাড়ের পদদেশে। তৃতীয়টি ঘিরে আছে Citadel বা বালা হিসার অংশটি। প্রাকারগুলি মোটামুটিভাবে সতেরো থেকে চৌঁত্রিশ ফুট চওড়া। পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট উঁচু। তিনটি প্রাকার মিলিয়ে মোট সাতাশিটি অর্ধচন্দ্র বুরুজ রয়েছে। যেখানে সান্ত্রী ও অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত থাকতো। বিশাল গ্র্যানাইটের ব্লক সাজিয়ে তাদের নির্মাণ
করা হয়েছিলো। উত্তর -পশ্চিম কোণায় রয়েছে পেটলা বুর্জ। মানে বিশাল উদর বুরুজ। অওরঙ্গজেবের কামানের গোলায় এই বুরুজটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সুলতানের কারিগররা মুঘল সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য একরাতের মধ্যে কাগজবোর্ড দিয়ে অবিকল একটি নকল বুর্জ তৈরি করে দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি।
বহু বুরুজে তেলুগু লিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি কুতবশাহিদের আনুকূল্য বেশ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

বাইরের প্রাকারটির আটটি দরওয়াজার নাম, ফতেহ, বাহমনি, মক্কা, পত্তনচেরু, বঞ্জারা, জামালি, নয়াকিলা আর মোতি দরওয়াজা। প্রধান দরওয়াজাটি এখন ফতেহ দরওয়াজা। কুতবশাহি পতনের পর এই প্রবেশ পথ দিয়ে বাদশা অওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মোয়াজ্জেম গোলকোণ্ডার দখল নিতে ঢুকেছিলেন।


গোলকোণ্ডা দুর্গের যে অংশটি চলতি কথায় এখন 'গোলকোণ্ডা', সেটির আসল নাম 'বালা হিসার'(Citadel)।একটা উঁচু গ্র্যানাইট পাহাড়ের চূড়ায় এই সুরক্ষিত রাজমহলটির নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। এই মুহূর্তে পর্যটকরা প্রবেশ করেন বালা হিসার দরওয়াজা দিয়ে। এটাই দুর্গের কেন্দ্রস্থল। ঢোকার মুখে বিশাল দরজাটি কাঠের। তার সর্বাঙ্গে পিতল বাঁধানো কীলক হাতিফৌজের আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষা করতো। বালা হিসারের স্থাপত্যের আদর্শ ছিলো বাহমনি রাজ্যের নির্মাণ কৌশল।

বালা হিসার দেউড়ির রক্ষী ছিলেন অ্যাবিসিনিয়া থেকে আসা সৈন্যদের বাহিনী। ঐ পথ দিয়ে ঢুকলেই শুরু হয়ে যেতো হাবসি সৈন্যদলের এলাকা। নাম, হাবসি কমান। ভিতরে প্রথমেই একটি খিলান দেউড়ি রয়েছে। যার নাম 'তালি ফটক' বা Clapping Pavilion। ওখানে দাঁড়িয়ে তালি দিলেই সুদূর পাহাড় শিখরে বারাদরির রক্ষীরা শুনতে পেতেন সেই শব্দ। তার সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি সেকালের কামানের নমুনা। বাঁদিকে বাদশাহি আশুরখানা। ফতেহ দরওয়াজা আর মুসা বুর্জের মাঝামাঝি যে বিশাল প্রাসাদের অবশেষ দেখা যায় সেটি দিওয়ান মহল। সেখানে মীর জুমলা মহম্মদ সয়ীদ থাকতেন। পরবর্তীকালে তা মদন্না-অক্কান্নার বাসভবন হয়ে যায়। ডানদিকে চলে গেছে গোলকোণ্ডা কিলার বিশ্বখ্যাত মিনাবাজার, নগিনাবাগ। যেখানে ছিলো এদেশের সব চেয়ে বিলাসবহুল ও মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিপণীগুলি। নগিনাবাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুলতানের অনুগত সেনাধ্যক্ষ আব্দুল রজ্জাক লারি'র নাম। যিনি শেষ পর্যন্ত মুঘল সৈন্যদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তাঁকে আহত, মুমূর্ষূ অবস্থায় নগিনাবাগেই পাওয়া গিয়েছিলো। তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। স্থানীয় লোককথার সূত্রে লারি একজন প্রবাদপ্রতিম বীর হয়ে যান। হাবসি কমান ধরে সোজা পশ্চিমদিকে গেলেই প্রথমে হাতিশালা আর অতিথিশালার টানা কাতার।

বালা হিসার দরওয়াজা পেরোলেই টানা রাস্তার বাঁদিকে রয়েছে সিলাহখানা বা অস্ত্রাগার। সিলাহখানার ডানদিকে ছিলো সেনাবাস। তৃতীয় প্রাকারটি পর্যন্ত সেটি বিস্তৃত ছিলো। অস্ত্রাগার পেরোলেই দুর্গের 'অন্দরমহল' শুরু হয়ে যেতো। সিলাহখানার বিপরীতদিকে একটি প্রাচীন মসজিদের অবশেষ পাওয়া যায়। তার পর থেকে দেখা যাবে একের পর এক বিস্তৃত অঙ্গন। রাজপ্রাসাদের পূর্বদিকে একটি সমতল স্থান রয়েছে যেখানে সুলতান সৈন্যদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন। তাকে ময়দান-এ-জিল্লুখানা -ই আলি বলা হতো। তাত্ত্বিকভাবে সৈন্যরা ঐ মসজিদের সামনে আল্লাহ তালার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু সেখানে সুলতান নিজে উপস্থিত থাকার জন্য তিনিও একসঙ্গে অভিবাদিত হয়ে যেতেন।এর দক্ষিণদিকেই বিখ্যাত মদন্না-অক্কন্নার প্রাসাদ ও প্রশাসন ভবন। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের আর্থিক মেরুদণ্ডের ভিত্তি ভবনগুলি। আর ছড়ানো ঘাসজমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট্টো, কিন্তু নয়নাভিরাম প্রার্থনা ভবন, তারামতী মসজিদ। এই নির্মাণগুলো পেরিয়ে এগোলেই শুরু হয়ে যায় গোলকোণ্ডার সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত্য ও জেল্লাদার অংশ। মূল রাজপ্রাসাদটির আবাসিক অংশ এখান থেকেই আরম্ভ হয়। এই অট্টালিকাগুলি দোতলা থেকে ছ'তলা পর্যন্ত উঁচু। হারেম, সরাই, ঘরের পর ঘর,অন্তঃপুর, বিশাল হলঘর, ফোয়ারা, ঝিল সব কিছু নিয়ে সেকালের স্থপতিদের শিল্প ও নির্মাণকৌশল এখনও দর্শকদের মুগ্ধ করে। সমগ্র রাজপ্রাসাদ মহার্ঘ গালিচা, বাতিদান, বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, পর্দা দিয়ে সাজানো ছিলো। গোলকোণ্ডা দুর্গ দখল করার পর অওরঙ্গজেব সেখানে বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি এতো বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকতে পছন্দ করতেন না।

একটি বিশাল অঙ্গন ঘেরা রানিমহল থেকেই দুর্গের জনানামহল শুরু হয়ে যায়। অঙ্গনের ঠিক মাঝখানে একটি সুরম্য ফোয়ারা। আয়তাকার ক্ষেত্রটিকে ঘিরে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সারিসারিপ্রাসাদ আর অট্টালিকা। একের পর এক দেখা যাবে রাজসিক প্রাসাদ আর তার ভিতরের বিশাল আর্চদেওয়া ঘরদুয়ার। একের ভিতর দিয়ে অন্যটি চলে যাচ্ছে। গোলকোণ্ডা দুর্গের স্থপতিদের আরেকটি বিস্ময়কর কীর্তি এই জলসম্পদে কৃপণ প্রকৃতি থেকে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করা। পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত দুর্গমচেরুভু ( গোপন জলাশয়) থেকে তাঁরা জল প্রবাহিত করে আনার কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন। আরও চমকপ্রদ ছিলো নিচে থেকে চারশো ফুট উপরে জল তোলার প্রযুক্তি।

বালা হিসার ওঠার সিঁড়ি এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পাহাড় চড়ার পাথরের ধাপগুলি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে উপরে। মাঝামাঝি জায়গায় সম্প্রতি একটি দেবীমন্দির তৈরি হয়েছে। এটি অর্বাচীন নির্মাণ। তার দুদিকে দুটি বিশাল গ্র্যানাইট পাথরের প্রাকৃতিক স্তম্ভ অজানা রহস্যে সোজা ,সন্তুলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পরেই রয়েছে বিশাল অম্বরখানা বা শষ্যাগার। আর একটু উপরেই রাজপরিবারের প্রার্থনার জন্য ইব্রাহিমশাহের তৈরি করা মসজিদটি। এর স্থাপত্য মূলত বাহমনি মেহরাবের ধরনে হলেও পরবর্তীকালে এই নির্মাণে কুতবশাহি মিনারগুলি যোগ করা হয়েছিলো। মানে চোদ্দো শতক থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ক্রমপর্যায়ে এর নির্মাণ হয়েছিলো। পাহাড়ের শিখরে বালা হিসারের শীর্ষ প্রাসাদ ‘বারাদারি’ দেখা যায়। এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকাটি নির্বাধ দেখা যায়। 'বারাদারি' শব্দের অর্থ বারোটি দুয়ার দেওয়া উদ্যানভবন। কিন্তু এর অর্থসম্প্রসারণ ঘটে গেছে সময়ের সঙ্গে। এই প্রাসাদটি দোতলা । এর শীর্ষে রয়েছে সুলতানের মসনদ বা সিংহাসন। সেখানে বসে তিনি আয়েশ করে পারস্যের শিরাজি সেবন করতে করতে নিজের রাজ্যদর্শন করতেন। এই সমস্ত নির্মাণের স্থাপত্যের প্রধান অবলম্বন ছিলো বিশাল মাপের, নানা আকারের গ্রানাইট পাথরের চাঁই। দুর্গের নিরাপত্তাই ছিলো প্রধান শর্ত। তাই তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হতোনা। বালা হিসারের এক কোণে একটি বৃহৎ সুড়ঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায়। সংকটকালে রাজপরিবার এই সুড়ঙ্গটি দিয়ে আট কিমি দূরের গোশামহল নামে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে পারতেন। এখন সেটি বন্ধ আছে।
এদেশে ​​​​​​​মধ্যযুগে ​​​​​​​স্থানিক ​​​​​​​রাজা ​​​​​​​বা ​​​​​​​সুলতানদেরও ​​​​​​​কী ​​​​​​​পর্যায়ের ​​​​​​​সম্পদ ​​​​​​​বা ​​​​​​​সমৃদ্ধি ​​​​​​​ছিলো, ​​​​​​​গোলকোণ্ডার ​​​​​​​দুর্গ ​​​​​​​বা ​​​​​​​কুলি ​​​​​​​কুতুব ​​​​​​​শাহি ​​​​​​​রাজবংশের ​​​​​​​প্রতাপ ​​​​​​​দেখলে ​​​​​​​সেটা ​​​​​​​টের ​​​​​​​পাওয়া ​​​​​​​যায়।
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in






আমার ভারতবর্ষ

সুলতান ও গান্ধর্বী

---------------------

খুব গর্ব করার মতো বীরপুরুষ ছিলেন না তিনি। বাবা শুজাত খানের রাজত্ব পেয়েছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মেরে, তাড়িয়ে দখল করেছিলেন মালওয়ার মসনদ। কিন্তু সে রাজত্ব রক্ষা করার মতো এলেম ছিলোনা। রানি দুর্গাবতীর সঙ্গে লড়াইতে সর্বস্ব খুইয়ে শুধু প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মালওয়ায়। শরীরে, মনে একেবারে ঘায়েল আশ্রয় খুঁজেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম সঙ্গীতের কাছে। যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বনে-প্রান্তরে। এমন সময় খোঁজ পা'ন সেই নারীর, যাঁর সঙ্গে তিনি জড়িয়ে তিনি একদিন হয়ে যাবেন এক রূপকথার নায়ক।

সুলতান হিসেবে অনায়াসে দখল করতে পারতেন সেই নারীকে, গায়ের জোরে। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা'র জোর তুর্কিদের অস্ত্রের জোরের থেকে একটু আলাদা। তিনি বিবাহ করতে চাইলেন তাঁর দয়িতাকে। বাপ ঠাকুর থান সিং গুজ্জর রাজপুত, রাজি ন'ন যবনের হাতে মেয়েকে সম্প্রদানে। লড়াই একটা হলো, কিন্তু এক তরফা। আসলে কন্যা নিজেই তো রাজি ঐ সুপুরুষ, সুর-পাগল সুলতানের স্বয়ম্বরা হতে। ঐতিহাসিক ফিরিশতা ছিলেন এই কাহিনীর কথাকার। কিংবদন্তির উর্ধ্বে আমরা যা জানতে পারি, তা ফিরিশতার পুথি থেকেই। নায়িকার নাম রূপমতী। রূপকথার নায়িকাদের সব কিছুই মাত্রা-ছাড়া। রূপমতীও তাই। পাগলকরা রূপ, মজিয়ে দেওয়া গান, ডুবিয়ে দেওয়া শায়রি। সে রকমই তো বলে সবাই। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এক হিন্দু মেয়ে আর আফঘান সুলতানের বিবাহ হয়েছিলো ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি রীতিতে। এখনও বিরল সে জাতীয় ঘটনা।

রাজধর্ম থেকে রুচি হারিয়েছিলেন তো আগেই, রূপমতীকে পেয়ে বাকিটাও গেলো। গান বাঁধা আর গান গাওয়া। দুজনে দুজনকে চোখে হারান। রাজত্ব উৎসন্নে যায়। আকবর বাদশা এসব দেখে পাঠালেন আধম খান ফৌজদারকে। মুঘল ফৌজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিলোনা বায়জিদ খান ওরফে বাজ বহাদুর খানের। রণে ভঙ্গ দেওয়াই সাব্যস্ত করলেন তিনি। পুরো অন্তঃপুরকে পিছনে ফেলে রেখে দেশান্তরে গেলেন। আধম খানের লক্ষ্য ছিলেন রূপমতী। কিন্তু আধম খানও বলপ্রয়োগ করেননি তাঁকে পেতে। শুধু পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন সভ্যভাবে। রূপমতীর তা মঞ্জুর ছিলোনা। বাজ বহাদুর ছাড়া আর কেউ নয় তাঁর হৃদয়েশ্বর। সাক্ষাৎপ্রার্থী আধম খান তাঁর বিষপানে মৃত শরীরটির সাক্ষাৎ
পেয়েছিলেন। তার আর পর নেই। একটা রূপকথার জন্ম এভাবেই। লাইলা-কয়েস, শিরিঁ-ফরহাদ, হীর-রানঝা জাতীয় উপকথার অংশ হয়ে গেলো দু'টি ঐতিহাসিক রক্তমাংসের মানুষের গল্প। তার আর জোড়া পাওয়া যায়না কোথাও।

মাণ্ডুতে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু রূপমতী-বাজবহাদুরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চিরকালের সুরসৌরভ আর ভালোবাসার আঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মনে বাজে। সুলতানের হারেমে থাকতেন না রূপমতী। তাঁর জন্য একটা ছোট্টো পাহাড়ের উপর মহল বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাজবহাদুর। সেই প্রাসাদের ছাদ থেকে নাকি কখনও নর্মদাকে দেখা যেতো। এটা জনশ্রুতি, সত্য নয়। সুলতান রূপমতীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন 'রেওয়া কুণ্ড'। সেই সরোবরটি থেকে জল এনে রূপমতী পুজোআচ্চা করতেন। 

বাজবহাদুরের প্রাসাদটি একটু নীচে। দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেই প্রাসাদের অলিন্দ থেকে রূপমতীর মহল স্পষ্ট দেখা যায়। বাজবহাদুর ছোটো রাজা। মুঘলদের মতো জমকালো, বিপুল স্থাপত্য তাঁর সাধ্যাতীত ছিলো। কিন্তু সীমায়িত মাত্রায় ইসলামি স্থাপত্যকলা অনুসারী এই সব নির্মাণগুলি এখনও মুগ্ধ করে তাদের শৈল্পিক সংযমে। দূর দূর পর্যন্ত ঊষর, গৈরিক ঢেউখেলানো মাটি, উঁচুনীচু পাথুরে প্রান্তর আর সবুজ লতাগুল্মের সুতোবাঁধা মালওয়ার দিগন্তরেখা একটা অন্যধরণের উদাসসুরে মনের স্কেলটা বেঁধে দেয়। পিলু, কাফি না মুলতানি, ঠাহর করে ওঠা যায়না।

বাজবহাদুরের গানের গল্প, রূপমতীর ফারসি আর ব্রজভাষায় রচিত গীতিসম্ভার, সবার উপরে শ্রেণীনির্বিশেষ জনতাকে মজিয়ে রাখা ট্র্যাজিক প্রেমের কালজয়ী ফর্মুলা, এই সব নিয়ে মস্তো লেখা লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এখন তা থাক। আমরা এই রাজারানির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন নির্মাণগুলির থেকেই না হয় খুঁজে নিই সেই সব লীলা অভিরাম ছবি।







0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো কোম্পানি


পম্পা ও বিরূপাক্ষ


“দক্ষিণ ভারতে বাক্য প্রচলিত আছে : গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান। অর্থাৎ গঙ্গার জলে স্নান করিলে যে পুণ্য হয়, তুঙ্গার জল পান করিলেও সেই পুণ্য। তুঙ্গার জল পীযূষতুল্য, মৃত-সঞ্জীবন।

কোনো এক স্তব্ধ সন্ধ্যায়, আকাশে সূর্য যখন অস্ত গিয়াছে কিন্তু নক্ষত্র পরিস্ফুট হয় নাই, সেই সন্ধিক্ষণে কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমস্থলে ত্রিকোণ ভূমির উপর দাঁড়াও। কান পাতিয়া শোনো, শুনিতে পাইবে তুঙ্গভদ্রা কৃষ্ণার কানে কানে কথা বলিতেছে;

নিজের অতীত সৌভাগ্যের দিনের গল্প বলিতেছে। কত নাম—হরিহর বুক কুমার কম্পন দেবরায় মল্লিকার্জুন—তোমার কানে আসিবে। কত কুটিল রহস্য, কত বীরত্বের কাহিনী, কত কৃতঘ্নতা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম বিদ্বেষ কৌতুক কুতূহল, জন্মমৃত্যুর বৃত্তান্ত শুনিতে পাইবে।


তুঙ্গভদ্রার এই ঊর্মিমর্মর ইতিহাস নয়, স্মৃতিকথা। কিন্তু সকল ইতিহাসের পিছনেই স্মৃতিকথা লুকাইয়া আছে। যেখানে স্মৃতি নাই সেখানে ইতিহাস নাই। আমরা আজ তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিপ্রবাহ হইতে এক গণ্ডূষ তুলিয়া লইয়া পান করিব।“

(তুঙ্গভদ্রার তীরে- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)

এ চত্বরের পায়ে পায়ে ইতিহাস ঘুরে বেড়ায়। মন্দিরে পাওয়া শিলালিপিগুলি যদি সন্ধান

করা হয় তবে পাওয়া যাবে এর শুরু সেই সাত শতকে। নয়-দশ শতকে প্রথমে চালুক্য, তার পর হোয়সল রাজত্বের আমল থেকে এই দেবস্থানের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ পাড়ের এই বিপুল মন্দির স্থাপত্য গৌরবের শীর্ষে পৌঁছোয় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কালে। বর্তমান মন্দিরটি গড়ার কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় দেবরায়ের সময়। সম্পূর্ণ হয় সেকালের 'মহারাজাধিরাজ' কৃষ্ণদেব রায়ের আনুকূল্যে। মন্দিরটির প্রচলিত নাম বিরূপাক্ষ মন্দির। অন্য নাম পম্পাপতি মন্দির। 'পম্পাদেবী' নদীরূপা এক স্থানিক জনপ্রিয় দেবী। তাঁর সঙ্গে শৈব সংস্কৃতির সংযোগ ঘটানো হয়। 'বিরূপাক্ষ' শিবের অন্যতম বিভূতি। পম্পাদেবী তাঁর সহচরী হয়ে ওঠেন।

এই দেবালয়ে বিরূপাক্ষ শিবের মন্দিরটি মুখ্য হলেও পম্পাদেবীর আলাদা মন্দির রয়েছে। তুঙ্গভদ্রা নদী ও বিরূপাক্ষ মন্দির হয়ে উঠেছিলো বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র।

এককালের একটি গৌণ দেবালয় থেকে সাত-আট শতকের মধ্যে দেশের
একটি মুখ্য ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কারণও ছিলো। আট শতকের চালুক্য রাজা বিক্রমাদিত্যের মহারানি লোকমহাদেবী ছিলেন এক উচ্চাকাঙ্খী রাজমহিষী। তিনি চেয়েছিলেন পম্পাপতি মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পিছনে তাঁদের রাজকীয় প্রতাপের চিহ্ন যেন আঁকা থাকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম থেকেই মধ্য পুরাণযুগে রাজাকে দেবতার প্রতিচ্ছবি করে লোকমনে বিশ্বাস সৃষ্টি করার প্রয়াস শুরু হয়। এই চালুক্য রানি দাক্ষিণাত্যে সেই পথটিই অনুসরণ করেছিলেন। মন্দিরের ভাস্কর্যের কল্পনা ও নির্মাণ
আপাতভাবে রামায়ণ, মহাভারত বা কৃষ্ণলীলায় বর্ণিত দেবতাদের প্রতিফলন হলেও গূঢ়তঃ তারা ছিলো রাজকীয় মহিমার প্রতিভূ। পরবর্তীকালের রাজারাও সেই ঐতিহ্যই বজায় রেখেছিলেন।

মূল মন্দির ছাড়াও এই প্রকল্পের অন্যান্য নির্মাণগুলি, যেমন গোপুরম, রঙ্গমণ্ডপ, নান্দী, স্তম্ভসারি, প্রদক্ষিণ ইত্যাদি জুড়ে ছড়িয়ে আছে রাজকীয় জাঁক ও দাপের অবিরল প্রতীকগুলি। ১৫৬৫ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ও হাম্পির গৌরব অস্তমিত হলেও লোকবিশ্বাসে বিরূপাক্ষ-পম্পার গরিমা ম্লান হয়নি। নিঃসন্দেহে এই মন্দিরটি এদেশের একটি দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন পূজাস্থল।

রামায়ণের কালে তুঙ্গভদ্রার নাম ছিলো পম্পা নদী। এর তীরেই অঞ্জানেয় পর্বতে মহাবীর হনুমানের জন্ম। মায়ের নাম অঞ্জনা। বিরূপাক্ষ মন্দিরে এই নদী দেবীর মর্যাদায় পূজিতা হ'ন। অসংখ্য হিন্দু তীর্থভূমি এখনও দাঁড়িয়ে আছে এর দু’তীরে। শৈবমতের প্রধান কেন্দ্র যেমন, শৃঙ্গেরি সারদাপীঠমে ছিলো আদি শঙ্করের মূল অধিষ্ঠান। রয়েছে মন্ত্রালয়ম শ্রী রাঘবেন্দ্রস্বামী মঠ, কুর্নুল আর আলমপুরে। মহবুবনগরে যোগালম্ব মন্দিরের খ্যাতি দক্ষিণকাশী হিসেবে। অন্ধ্র, কর্ণাটক আর তেলেঙ্গানা

রাজ্যের এইসব তীর্থ আর সীমানা ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছে রূপসী নদীটি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গরিমাময় অতীতকে ধারণ করে রয়েছে বিরূপাক্ষ মন্দির ও তুঙ্গভদ্রার রোমান্টিক আবহ। বাঙালির হৃদয়ের কাছে এই মন্দির তুঙ্গভদ্রা নদী'কে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবত তার পর থেকে বাঙালি পাঠকের, বৃহত্তর অর্থে বাঙালিমননে এই স্থানখণ্ডটির একটি স্থায়ী জায়গা হয়ে গেছে।

হাম্পির প্রত্ন অবশেষের তীর ধরে, বিরূপাক্ষ মন্দিরের ঘাট ছুঁয়ে, এই মায়াবী কল্পকথার জগৎটি বোধ হয় শেষ হয় না।