0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো কোম্পানি


পম্পা ও বিরূপাক্ষ


“দক্ষিণ ভারতে বাক্য প্রচলিত আছে : গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান। অর্থাৎ গঙ্গার জলে স্নান করিলে যে পুণ্য হয়, তুঙ্গার জল পান করিলেও সেই পুণ্য। তুঙ্গার জল পীযূষতুল্য, মৃত-সঞ্জীবন।

কোনো এক স্তব্ধ সন্ধ্যায়, আকাশে সূর্য যখন অস্ত গিয়াছে কিন্তু নক্ষত্র পরিস্ফুট হয় নাই, সেই সন্ধিক্ষণে কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমস্থলে ত্রিকোণ ভূমির উপর দাঁড়াও। কান পাতিয়া শোনো, শুনিতে পাইবে তুঙ্গভদ্রা কৃষ্ণার কানে কানে কথা বলিতেছে;

নিজের অতীত সৌভাগ্যের দিনের গল্প বলিতেছে। কত নাম—হরিহর বুক কুমার কম্পন দেবরায় মল্লিকার্জুন—তোমার কানে আসিবে। কত কুটিল রহস্য, কত বীরত্বের কাহিনী, কত কৃতঘ্নতা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম বিদ্বেষ কৌতুক কুতূহল, জন্মমৃত্যুর বৃত্তান্ত শুনিতে পাইবে।


তুঙ্গভদ্রার এই ঊর্মিমর্মর ইতিহাস নয়, স্মৃতিকথা। কিন্তু সকল ইতিহাসের পিছনেই স্মৃতিকথা লুকাইয়া আছে। যেখানে স্মৃতি নাই সেখানে ইতিহাস নাই। আমরা আজ তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিপ্রবাহ হইতে এক গণ্ডূষ তুলিয়া লইয়া পান করিব।“

(তুঙ্গভদ্রার তীরে- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)

এ চত্বরের পায়ে পায়ে ইতিহাস ঘুরে বেড়ায়। মন্দিরে পাওয়া শিলালিপিগুলি যদি সন্ধান

করা হয় তবে পাওয়া যাবে এর শুরু সেই সাত শতকে। নয়-দশ শতকে প্রথমে চালুক্য, তার পর হোয়সল রাজত্বের আমল থেকে এই দেবস্থানের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ পাড়ের এই বিপুল মন্দির স্থাপত্য গৌরবের শীর্ষে পৌঁছোয় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কালে। বর্তমান মন্দিরটি গড়ার কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় দেবরায়ের সময়। সম্পূর্ণ হয় সেকালের 'মহারাজাধিরাজ' কৃষ্ণদেব রায়ের আনুকূল্যে। মন্দিরটির প্রচলিত নাম বিরূপাক্ষ মন্দির। অন্য নাম পম্পাপতি মন্দির। 'পম্পাদেবী' নদীরূপা এক স্থানিক জনপ্রিয় দেবী। তাঁর সঙ্গে শৈব সংস্কৃতির সংযোগ ঘটানো হয়। 'বিরূপাক্ষ' শিবের অন্যতম বিভূতি। পম্পাদেবী তাঁর সহচরী হয়ে ওঠেন।

এই দেবালয়ে বিরূপাক্ষ শিবের মন্দিরটি মুখ্য হলেও পম্পাদেবীর আলাদা মন্দির রয়েছে। তুঙ্গভদ্রা নদী ও বিরূপাক্ষ মন্দির হয়ে উঠেছিলো বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র।

এককালের একটি গৌণ দেবালয় থেকে সাত-আট শতকের মধ্যে দেশের
একটি মুখ্য ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কারণও ছিলো। আট শতকের চালুক্য রাজা বিক্রমাদিত্যের মহারানি লোকমহাদেবী ছিলেন এক উচ্চাকাঙ্খী রাজমহিষী। তিনি চেয়েছিলেন পম্পাপতি মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পিছনে তাঁদের রাজকীয় প্রতাপের চিহ্ন যেন আঁকা থাকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম থেকেই মধ্য পুরাণযুগে রাজাকে দেবতার প্রতিচ্ছবি করে লোকমনে বিশ্বাস সৃষ্টি করার প্রয়াস শুরু হয়। এই চালুক্য রানি দাক্ষিণাত্যে সেই পথটিই অনুসরণ করেছিলেন। মন্দিরের ভাস্কর্যের কল্পনা ও নির্মাণ
আপাতভাবে রামায়ণ, মহাভারত বা কৃষ্ণলীলায় বর্ণিত দেবতাদের প্রতিফলন হলেও গূঢ়তঃ তারা ছিলো রাজকীয় মহিমার প্রতিভূ। পরবর্তীকালের রাজারাও সেই ঐতিহ্যই বজায় রেখেছিলেন।

মূল মন্দির ছাড়াও এই প্রকল্পের অন্যান্য নির্মাণগুলি, যেমন গোপুরম, রঙ্গমণ্ডপ, নান্দী, স্তম্ভসারি, প্রদক্ষিণ ইত্যাদি জুড়ে ছড়িয়ে আছে রাজকীয় জাঁক ও দাপের অবিরল প্রতীকগুলি। ১৫৬৫ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ও হাম্পির গৌরব অস্তমিত হলেও লোকবিশ্বাসে বিরূপাক্ষ-পম্পার গরিমা ম্লান হয়নি। নিঃসন্দেহে এই মন্দিরটি এদেশের একটি দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন পূজাস্থল।

রামায়ণের কালে তুঙ্গভদ্রার নাম ছিলো পম্পা নদী। এর তীরেই অঞ্জানেয় পর্বতে মহাবীর হনুমানের জন্ম। মায়ের নাম অঞ্জনা। বিরূপাক্ষ মন্দিরে এই নদী দেবীর মর্যাদায় পূজিতা হ'ন। অসংখ্য হিন্দু তীর্থভূমি এখনও দাঁড়িয়ে আছে এর দু’তীরে। শৈবমতের প্রধান কেন্দ্র যেমন, শৃঙ্গেরি সারদাপীঠমে ছিলো আদি শঙ্করের মূল অধিষ্ঠান। রয়েছে মন্ত্রালয়ম শ্রী রাঘবেন্দ্রস্বামী মঠ, কুর্নুল আর আলমপুরে। মহবুবনগরে যোগালম্ব মন্দিরের খ্যাতি দক্ষিণকাশী হিসেবে। অন্ধ্র, কর্ণাটক আর তেলেঙ্গানা

রাজ্যের এইসব তীর্থ আর সীমানা ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছে রূপসী নদীটি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গরিমাময় অতীতকে ধারণ করে রয়েছে বিরূপাক্ষ মন্দির ও তুঙ্গভদ্রার রোমান্টিক আবহ। বাঙালির হৃদয়ের কাছে এই মন্দির তুঙ্গভদ্রা নদী'কে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবত তার পর থেকে বাঙালি পাঠকের, বৃহত্তর অর্থে বাঙালিমননে এই স্থানখণ্ডটির একটি স্থায়ী জায়গা হয়ে গেছে।

হাম্পির প্রত্ন অবশেষের তীর ধরে, বিরূপাক্ষ মন্দিরের ঘাট ছুঁয়ে, এই মায়াবী কল্পকথার জগৎটি বোধ হয় শেষ হয় না।

0 comments: