0

গল্প - সুস্মিতা হালদার

Posted in



মধ্যযামের বাগেশ্রী


(এক)

অম্বরীশ একটা মহা অন্যায় করে ফেলেছে। সত্যিই মহা অন্যায়। বয়েস কম কিছু নয়। ছত্রিশের কোঠায়। তবুও চাকরি পায় নি। ‘মা তারা লটারি’র টিকিট কেটেছিল বহুবার। সে আর জোটে নি। ‘মা তারা লটারি’টা কী দাদা? হ্যা হ্যা, ও তো সরকারি চাকরি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছিল অম্বরীশ। সরকারি পদে অ্যাপ্লাইও করেছে। কিন্তু ঐ যে লটারি বলে কথা, সে কি আর যার তার লাগে দাদা? লোকে তো বলে, লোকে বলতে পাড়ার লোকে না। তাদের এতো দায় পড়েছে যে অন্যের ছেলেকে নিয়ে মাথা ব্যথা করে! ঐ কলেজের কিছু টিচার, কোচিং-এর মাস্টার, বন্ধু-বান্ধব, এরাই সব বলে-টলে, ছোঁড়ার নাকি মাথা নেই তেমন। তাই চাকরি পায় না। আরে দাদা, চাকরি পেতে গেলে ‘লেজেন্ড’ হতে হয়, ‘লেজেন্ড’। তা সে কি আর ছোঁড়ার মাথায় ঢোকে? কী স্পর্ধা ছেলের! বলে, “সরকার এখানে-ওখানে সভা করে, বিনা পয়সায় চাল-ডাল, নানান ভাতা দিয়ে বেড়ালে ভাঁড়াড়ে টাকা থাকবে কী করে? তাতে চাকরি দেবে কী করে? পোস্ট কমিয়ে দিলে, লোকে চাকরি পাবে কেমন করে? সারাদিনে ট্রেন যদি একটি কী দু’টি চলে তাহলে যাদের দরকার তারা সবাই ট্রেনে উঠতে পারবে তো? বাস-ট্রেনের ক্ষেত্রে তো তাও ঝুলতে ঝুলতে যাওয়াও সম্ভব। কিন্তু চাকরি তো আর ঝুলতে ঝুলতে করা যায় না! মানে ওয়েটিং লিস্টে থেকে করা সম্ভব না!” ছেলে শুধু এটুকুতেই থেমে থাকে না। আরও দু’কথা শুনিয়ে দেয়। বলে কী জানেন? আরও বলে, “ধরুন, একটা পুকুর থেকে সবাই জল তুলে নিয়ে যাচ্ছে রোজ। এদিকে খরা চলছে, বৃষ্টি নেই, পুকুরে জল ভরছে না। তাহলে পুকুরটা আজীবন এই ভাবেই সার্ভিস দিয়ে যাবে তো? শুকিয়ে যাবে না তো?... আমাদের ভাঁড়ারও তাই। সেটা সংসারের হোক বা সরকারের। ভাঁড়ার থেকে যেমন টাকা বেরোবে, তেমন টাকা ঢোকাতেও হবে। এবার আপনারা বলবেন, টাকা ঢোকানোর জন্য তো অনেক ‘গ্রান্ট’ আছে। কিন্তু ওইটাই ভুল ধারণা। ‘গ্রান্ট’, ‘লোন’ এগুলোও স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। তাই কী দরকার? কাজ তৈরি করতে হবে। পোস্ট বাড়াতে হবে। তবেই ‘মানিটারি ফ্লো’ ঠিক থাকবে। তাহলে নীতিকথা কী হল কাকা? চাকরি করতে গেলে লেজেন্ড হওয়ার দরকার পড়ে না। চাকরি গড়তে গেলে লেজেন্ড হতে হয়, সেটা সরকারই হোক আর টাটা বিড়লা আম্বানিকাকাদের মতো কোন প্রাইভেট বডিই হোক।”

মুখে যতই বাকচাতুরি মারুক, কাজের নামে অষ্টরম্ভা। এই ছত্রিশ বছর বয়েস অবধি খালি বাপের পয়সায় খাচ্ছে আর একটার পর একটা ‘ডিগ্রি’ অর্জন করেই যাচ্ছে। শুনেছিলাম, ব্যাঙ্গালোর, পুনের দিকে তো ভালো স্যালারির কাজ পেয়েছিল। সব ওই প্রাইভেটে বলে আর বাড়ি থেকে ছাড়ে নি। তা সে বাড়ি থেকে রাজি হবেই বা কেন? প্রাইভেটে কাজের কি কোন গ্যারান্টি আছে? ও তো কর্পূরের মতো, এই আছে তো এই নেই। শেষ-মেশ শুনলাম এই তো বছর তিনেক আগে ওর মা-বাবা ঠিক করলেন, অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে তাদের নাড়ুগোপাল ছেলেটি ল’ পড়ুক। তিন বছরের ল’ পড়ার কোন বয়েস নেই। সরকারি ল’ কলেজে চান্সটা ঠিক পেয়ে গেছে। ল’ পাশ করে অন্তত ক’টা জামিন-টামিন করালেও তো বাঁধা পয়সা দাদা। কী হুমকি দিলেও তো প্রভাব-প্রতিপত্তির শেষ থাকবে না। অবশ্য ল’ পড়ে নাড়ুগোপাল লয়ার না লায়ার, কোনটা যে তৈরি হবে সেইটাই দেখার বিষয়। আমাদের দরকারে বিনা পয়সায় করে-টরে দিলেই হচ্ছে। ওই তো দু’টো কথা বলা, দু’কলম লেখা, এই তো কাজ একজন লয়ারের। তাতেও কত টাকা নেয় সব ভাবুন। এগুলো আবার কোন কাজ হল না কি? তার ওপর তো মিথ্যেকে সত্যি আর সত্যিকে মিথ্যে করা শিখবে। অবশ্য আমাদের দরকারে একটু আধটু সত্যিকে মিথ্যে যদি করে দেয় তো মন্দ না। হেঁ হেঁ। ওটা তো করেতই হয় দাদা, আমাদের মানে ওই (গর্বে একবচন আরকি) আমার প্রয়োজন বলে কথা।

কলেজে প্রথম বছরটা ভালোই কাটল। তৃতীয় সেমেস্টারেই হল গোল। অল্পবয়েসী একজন ম্যাডাম জয়েন করলেন কলেজে। বয়েস তিরিশের কমই হবে। অম্বরীশ গেল প্রেমে পড়ে। ‘ম্যাডাম’টিও কী নির্লজ্জ দাদা, বলে বোঝাতে পারব না। কী ইয়ে মানে সুড়সুড়ি… আপনি ম্যাডাম হয়ে ছাত্রের সাথে ইয়ে করতে শুরু করলেন? ছিঃ ছিঃ! অবশ্য এটা যদি উল্টো হতো তব্বে আর দেখতে হতো! মানে— এই আমার মেয়ে কী মেধাবী, জানেন? ওর বুদ্ধি-মেধায় ওর গাইড এত্তো প্লীজড্ যে ওকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। নিজে এসে বাড়িতে ‘অফার’ দিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য ক’টা মেয়ের হয় বলুন!

তা সে ছাড়ুন। আসল কথাটা বলি। তা ঐ অম্বরীশ আর ম্যাডামের প্রেমলীলা ইয়েতেই আটকে থাকে নি। যেই অম্বরীশ ফাইনাল ইয়ারটা পাশ দিল, অমনি করে নিল বিয়ে। উকিল হওয়ার জন্য যে কীসব রেজিস্ট্রেশান করাতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয় এখনও সেসবই করে উঠল না, কিন্তু বিয়ের রেজিস্ট্রেশান করে নিল ঠিক। ছ্যাঃ ছ্যাঃ দাদা, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ! কিন্তু অম্বরীশের মা-বাপেই বা কেমন? ওঁরা মেনে নিলেন? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল ঐ ম্যাডামটাকে। তার জায়গায় বললেন কিনা, “মা, আমার ছেলের কত জন্মের ভাগ্যি যে আমাদের বাড়িতে তোমায় পেয়েছি। তোমার ছায়ায় থেকে ছেলেটার যদি এবার কিছু একটা হয়। আমরা তো আর মানুষ করতে পারলাম না। তুমি ওকে ছাত্র হিসেবেই মানুষ কর।”

ছ্যাঃ ছ্যাঃ। আজ ওদের বিয়ে। ঐ যে শুনছেন, ও শুনবেন আর কী? এ তো আর আসল বিয়ে না। সকালে রেজিস্ট্রি হয়েছে। রাতে একটু খাওন-দাওন। না, না, না, না, পাড়া-পড়শি ডাকে নি। ছোঁড়া বলে, “বিয়ের সম্পর্ক তো দুই-বাড়ির মধ্যে। তাহলে পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব ডেকে খামোখা পয়সা নষ্ট করব কেন? আর পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব ডাকা মানেই তো খাল কেটে কুমির ডাকা। সব তো আসবে আর পি.এন.পি.সি. (পরনিন্দা পরচর্চা) করবে। তার চেয়ে কাছের মানুষদের নিয়েই শুভ কাজ হোক। তাই কি ঠিক নয়? কী বলেন মামা?” তাই না কি দুই-বাড়িতেই আটকা রেখেছে। কী কেচ্ছা, কী কেচ্ছা !

(দুই)

ফুলসজ্জার রাত। ঐশী আর অম্বরীশের। ঐশী এক গভর্নমেন্ট ল’ কলেজের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর আর অম্বরীশ ঐ কলেজেরই ছাত্র ছিল— ঐশীর ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। এই মাস কয়েক হল ল’ পাশ করেছে। অ্যাডভোকেটের এনরোলমেন্টের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। এখনও পায় নি। অম্বরীশ ঘুমিয়ে যেতেই বিছানা ছেড়ে উঠে এলো ঐশী। হেমন্তকাল। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। একটু একটু হিমেল হাওয়া বইছে বাইরে। তাই জানালাটা বন্ধই রয়েছে। বন্ধ জানালার কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। সত্যিই কি সে ভুল করল? মা-বাবার ওপর অভিমান করে বাড়িতে কিছুই জানায় নি বিয়ের ব্যাপারে। চাকরিসূত্রে বাড়ি থেকে দূরেই থাকতে হয়। একাই একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। পুজোর আগে এক শনিবার বাড়ি গিয়েছিল। প্রতি শনিবার চেষ্টা করে বাড়ি যাওয়ার। প্রতি সপ্তাহে না পারলেও অন্তত পনেরো দিন ছাড়া যায়। তখনই সে জানায় অম্বরীশের কথা। মা-বাবা কেউই রাজি হয় নি। না, নিজের পছন্দের বিয়ের সম্পর্ক, দেখা-শুনো করে নয়, তার জন্য যে ওদের আপত্তি তেমনটা ঠিক নয়। এ এক অন্য গল্প। ঐশীদের পারিবারিক রীতি, বংশে মেয়ে জন্মালে তার বিয়ে দেওয়া হয় না। এমন নিয়মের ইতিহাসও রয়েছে। অলিখিত এক ইতহাস। প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা। জন্মসূত্রে ঐশী ঘাটালের। প্রায় চার পুরুষ ধরে সেখানেই তাদের বসবাস। ঐশীর ‘বড়বাবা’ মানে ঠাকুরদার বাবা ছোট্ট একটা বসত গড়েন ঘাটালে। পরে দাদু, বাবা ওঁরা সেই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটাকেই দোতলা বাড়ির চেহারা দিয়েছেন। ঐশীর ‘বড়বাবা’রা চারভাই আর এক বোন। বড়বাবার বোন সবচেয়ে ছোট। প্রায় দুই পুরুষ পর বংশে প্রথম মেয়ে জন্মেছিল বলে উনি খুবই আদরে মানুষ। বড়বাবার ভাইরা সব চন্দ্রকোণা, পাঁশকুড়া, ডেবরা, তমলুক এসব জায়গায় কাজ-ব্যবসা ইত্যাদির সূত্রে ছড়িয়ে পড়েন। ওখানেই বসত-সংসার গড়ে পাকাপাকি ভাবে বাসিন্দা হয়ে যান। চার ভাইয়ের মধ্যে বড়বাবাই নাকি ওঁর মা-বাবাকে শেষ দিন অবধি দেখেছেন। ‘বড়বাবা’ বোনও (সম্পর্কে কী হবেন তা ঐশীর জানা নেই, তবে তাঁকে ‘বড়মা’ বলে সম্বোধন করে থাকে ঐশী) বড়বাবার সাথেই থাকতেন। অনেক দেখেশুনে সৎপাত্রেই বিয়ে দিয়েছিলেন। বড়বাবাই মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। কিন্তু বিয়ের একমাসের মাথায় উনি নিখোঁজ হয়ে যান। পরে ওঁর শ্বশুরবাড়ির গ্রামবাসীদের থেকে জানা যায়, ওঁর স্বামী ওঁকে নাকি বেচে দিয়েছিলেন। মোটা টাকার বিনিময়ে। পরে আর কোথাও খোঁজ পাওয়া যায় নি। সেসময় ছিল ইংরেজ আমল। সারা দেশ তখন উত্তাল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে। কত কত বিপ্লবী মরছেন তাঁদেরই ক’জনকে মনে রাখা হয়েছে, আর সেখানে একটা সাধারণ তৎকালীন গরীব বাড়ির মেয়ে পাচার হল না খুন হল সে নিয়ে আর কারই বা মাথা ব্যথা ছিল? এখনের দিনেই কি এরকম বাড়ির মানুষদের কেউ খুন, পাচার বা ধর্ষিত হলে শুধু নিউজ চ্যানেলের টি.আর.পি বাড়ানো ছাড়া আর কিছু হয়? ঐশীর বড়বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন খুঁজে বের করার। কিন্তু লাভ কিছু হয় নি। বড়মার তো অন্য গুণ কিছু ছিল না। না গান জানতেন, না নাচ, না লেখাপড়া। তাই সাধারণের ভিড়ে হারিয়েই গিয়েছিলেন। এই হারিয়ে যাওয়া কাহিনী নিয়ে তো উপন্যাস লিখবারও কিছু নেই ! আর সিনেমা তো দূর অস্ত ! … এই আঘাত বড়বাবা মেনে নিতে পারেন নি। তাই পরের প্রজন্ম থেকেই চালু করলেন এক নিয়ম। এবাড়ির মেয়েদের বিয়ে হবে না। বড়বাবার অন্য ভাইয়েরা তখন আলাদা হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা দাদার এমন ‘বে-আক্কেলে’ চিন্তায় সায় দেন নি। বড়বাবা যা করেছিলেন সেটা ছিল প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের ফল, নিজের ওপর অহেতুক দোষারোপ থেকে জন্ম নেওয়া আত্মগ্লানি। কারণ, সেই বিয়ের সম্বন্ধ বড়বাবারই করা। কিন্তু নিজের জীবনের শেষদিকে উনি তুলেও নিয়েছিলেন এই নিয়ম। বড়বাবার এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলের মানে ঠাকুরদার বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পিসি-ঠাকুরমার বিয়ে দেন নি। যদিও তার জন্য জীবনের শেষদিকে না কি অনুতাপ করেছিলেন। কিন্তু পিসি-ঠাকুরমা এই অসাম্য মেনে নেন নি। খানিক প্রতিশোধ স্পৃহা থেকেই ভাইয়ের মেয়েদেরও বিয়ে করতে দিলেন না। ঠাকুরদা বড়বাবার মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া কথামতো তিন পিসিরই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু পিসি-ঠাকুরমা মানে বাবার পিসি সেই সব সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তিনি নিয়ম করলেন বংশে কন্যাসন্তান জন্মালেই তাকে ভগবানের কাছে দীক্ষা নিতে হবে এবং যেতেতু ভগবানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা হচ্ছে তাই সে আর কোনদিন বিয়ে করতে পারবে না। পিসি-ঠাকুরমা ঠাকুরদার চেয়ে বয়েসে বড়। তাই বড়বাবার মৃত্যুর পর এবাড়ির রীতি অনুযায়ী উনিই হলেন পরিবারের কর্ত্রী। ঐশীদের পরিবারের নিয়মে বয়সে বড় সদস্য বা সদস্যাই হন পরিবারের মাথা। সেখানে তিনি নারী না পুরুষ তা দেখা হয় না। ঐশীদের বাড়িতে তাই ঠাকুরদা তাঁর দিদিকে খুবই সমীহ করে চলতেন, একপ্রকার অন্ধভক্তিই। সেই পিসি-ঠাকুরমার বাণীই আজও মেনে চলেছেন ঐশীর বাবা, মা আর পিসিরা, যার ফলস্বরূপ ঐশীদের বংশের এই শাখাটা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ঐশীই এই শাখার শেষ বংশধর।

ঐশী বরাবরই একটু সাবেকি মানসিকতার। তাই খানিক বংশরক্ষার স্বার্থে আর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে যৌবনে ঘর-বাঁধার স্বপ্নকে সে অস্বীকার করে নি। বরং যুক্তিতেই সে অটল ছিল, কোনরকম অন্ধ-বিশ্বাস বা তার নিজের প্রজন্মের বহুকামিতার স্রোতে গা না ভাসিয়ে। পিসিরা অম্বরীশের কথা শুনতেই ঝেঁঝিয়ে উঠল, এমন কি জ্যোতিষীদের কাছে তাকে ধরে নিয়ে গেল বশীকরণ করে তাকে সুপথে ফেরাতে। জ্যোতিষীরা বললেন, “শুক্রটা বক্র আছে, তাই এমন বিবাহ নামক কামোদ্রেক হচ্ছে”… হ্যাঁ, এরকমই ছাই-পাঁশ কী একটা বলেছিল,তার সারাংশ মনে আছে ঐশীর কিন্তু, কথাটা মনে নেই। এসব দেখে-শুনেও মা-বাবা কিছুই বলল না, উল্টে ঐশীকেই বলল, “বাড়ির নিয়ম কেন ভাঙবি সোনা? এতে তো পাপ হয়। পিসিরা যা বলছেন মেনে নে। তুই ছেলেটিকে ‘না’ বলে ক্ষমা চেয়ে নে। বল তোর পক্ষে সম্ভব না এ বিয়ে।” তখনই ঐশী ঠিক করে নিয়েছিল ফিরে গিয়েই বিয়ের আইনি কাজ কর্ম সব মিটিয়ে ফেলবে। আর মাস খানেক পরে রেজিস্ট্রিটাও সেরে ফেলবে। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছিল, তার আগেই দেওয়া হয়ে গেছে বিয়ের নোটিশ। কিন্তু সে কথাও চেপে গেল বাড়িতে, বাবা-মা-পিসি কেউ টেরও পেল না। তারপর কালীপুজো, ভাই-ফোঁটা এসব পেরোতেই বিয়ে, মানে রেজিস্ট্রি, যা সত্যিকারের বিয়ে। তবুও সেই বিয়েতে আসে নি তার মা-বাবা, পরিবারের আর কেউই। কারণ তারা জানেও না। শুধু এসেছিল দূর সম্পর্কের এক দাদা, একমাত্র তাকেই ডেকেছিল। যতই শাশুড়ি-শ্বশুর তাকে আদর করে কাছে টানুন, নিজের মা-বাবার তো বিকল্প হয় না ! কেমন রইল ওরা? জেদ করে বেরিয়ে আসাটা কি ভুল হল? আবছা চিন্তায় পুরোন দিনগুলো ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে আসছিল।

আজকাল আর কান্না পায় না তার। পরিবারের অন্ধকারাচ্ছন্ন রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এক সময় শুধুই কেঁদে কেঁদে কাটত এক-একটা মূহুর্ত। এখন সেসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই আর কান্না আসে না। শুধু চাপা কান্নাটা দলা পাকিয়ে থাকে গলায় আর চোখে।

—“আচ্ছা, নিজের মতো করে সংসার করতে চাওয়া, জীবনটা সাজানো কি বড় অপরাধ? সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, জীবনের অধিকারের কথা, যার মধ্যে রয়েছে পরিবার গঠনের অধিকারও, নেপথ্যে বিয়ের অধিকার। সুপ্রিম কোর্টের ডিসিশনেও তা স্বীকৃত। কিন্তু সমাজে ‘বিয়ে’র এক অদ্ভুত অবস্থান। কিছু লোকের মতে, এটি করতে হয়। কিন্তু সেখানে স্ব-ইচ্ছা দেখাতে নেই। দেখাতে হয়, মা-বাবা বা পরিবারের গুরুজনেদের আদেশে করতে বাধ্য হচ্ছে। কিংবা সমাজের চাপে। নিজে স্ব-ইচ্ছেয় ‘বিয়ে’ করেছ তো ধরেই নেওয়া হবে বিগড়ে গেছ। আর অন্য দিকে রয়েছে, ‘বিয়ে’, ‘পরিবার’ বিরোধী শিক্ষিত, প্রশ্নবাদী, বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন। এই আন্দোলন এখন অনেকখানাই প্রকট। এঁরা বলেন, বিয়ে করা ঘৃণ্য জিনিস, পরিবার মানুষের বোঝা, Income tax liability-ও এর কাছে অনেক মধুর। এঁরা একলা জীবন আর বহুকামিতাকে সমর্থন করেন। আর ডাস্টবিনের চাইতেও ঘৃণ্য মনে করেন, ভালোবাসা, আবেগ, কর্তব্য, মায়া আর প্রেমকে।”

নিজের মনেই ভেবে চলে ঐশী। বহুদিনের চাপা ভাপসা ক্ষোভ চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু শুনবে কে? বলতে পারছে কি কারোর কাছে? কোন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা মাইক্রোফোন নিয়ে? কিংবা কোন সেমিনারে? হলভর্তি অডিয়েন্সের সামনে? নাঃ, এগুলো কেউই শুনবে না। শুনলেও গুটিছয় ক’জন। ব্যক্তিগত আবেগ থাকে ব্যক্তিস্তরেই। সেটাই বাস্তব। ঐশীর জীবনে চাহিদা খুবই সীমিত। স্বল্প বললেও দোষ নেই। পড়াশুনো করে একটা চাকরি, নিজের আয়, সংসার, সন্তান আর সাথে সাথে ছোট-খাটো ভালোলাগাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। সে খুবই সাধারণ। কোন অসাধারণত্ব তার নেই। সাধারণের ভিড়েই সে মিশে যেতে চায়।

— “আচ্ছা, যদি ‘বিয়ে’ নামে এই প্রতিষ্ঠানটাই না থাকত? আপনি জানেনও না কে আপনার মা, কে বাবা। ঠিক পশুদের মতো। কি তার চেয়েও ছন্নছাড়া। তখন কীভাবে থাকবে আপনার এতো সম্পত্তি? বড় বড় অট্টালিকা? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স? কোম্পানি শেয়ার? মিউচুয়াল ফাণ্ড? … হুঁ, এগুলো তো উল্টোপাল্টা প্রলাপ মনে হবে। বুঝিয়ে বলছি। যদি মা-বাবা, পরিবার বলেই কিছু না থাকে তাহলে আপনাকে লেখাপড়া শেখাবে কে? প্রথম মাথা গোঁজবার ঠাঁইটা পাবেন কোথায়? যদি ‘বিয়ে’ বা সমতুল্য কোনো প্রতিষ্ঠানই না থাকত, ‘ফ্রি-সেক্স স্যোসাইটি’ হতো তাহলে কার সম্পত্তিতে ভাগ দাবী করতেন? পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাগ কমে গেলে তখন কেন ভাইয়ে-বোনে দাঙ্গা-মারামারি করেন? বা কোর্টে যান? কিংবা বুদ্ধির কৌশলে সহজ-সরল ভাইটি বা বোনটিকে পুরোপুরি চ্যুত করে নিজের নামে পৈতৃক সম্পত্তির সবটুকু লিখিয়ে নেন? … সমাজ ভেঙ্গে একলা থাকলে দেশটা গড়ে উঠত কীভাবে? ‘বিয়ে’ সমস্ত সম্পর্কের উৎস। ‘পরিবার’ গঠনের চাবিকাঠি। ছোট ছোট পরিবার দিয়ে গড়ে ওঠে একটা দেশ। বিয়েকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। বিয়ে মানে আগুনের চারধারে বনবন করে ঘুরিয়ে, সঙ সেজে নাটক করা নয়। এর আওতায় আসে সমস্ত অল্টারনেটিভ ওয়ে, লিভ-ইন-রিলেশ্যানশিপ বা নর্ম্যাল লাভ-অ্যাফেয়ার। বিয়ের ডিভোর্স, লিভ-ইন-রিলেশ্যানশিপ বা নর্ম্যাল লাভ-অ্যাফেয়ারের ব্রেক-আপ সমান। কোনো ফারাক নেই। দুটোরই যন্ত্রণা এ…ক…।”

রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে যদি এগুলো কেউ বলতেন, তাহলে শুনতে বেশ গুরুত্বপূর্ণই মনে হতো। অথবা কোন নিউজপেপার বা চ্যানেলের ডিজিট্যাল ডেস্কে কোন সেলিব্রিটি বা সেই চ্যানেলের বা পেপারের নিজেদের কোন প্রশ্নবাদী বুদ্ধিজীবী লিখতেন বা বলতেন, টি.আর.পি. বাড়ানোর জন্য খুব ভাল ‘কনটেন্ট’ হতো… ফেসবুক লাইভে এলে তো সামাজিক আন্দোলনের ঝড় বয়ে যেত। কোন সেমিনার বা গেস্ট টকের বক্তব্য হিসেবেও মন্দ হতো না, বরং আকর্ষণীয়ই হতো। কিন্তু যদি সেটা একটা জীবনের কথা হয়? যদি তা কোন অনামী সাহিত্যিক গল্পের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন? তাহলে? তাহলে তা ‘রিভিউ’তে ‘একঘেঁয়ে’, ‘জাতহীন’ একটা বস্তু হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হতো। ঐশীও বহুবার অনেককে এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিল। কিন্তু “মানসিক সমস্যা”, “সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং করাও” এসবই শুনতে হয়েছে তাকে। হুঁ… জীবনের সব গল্প লিখতে নেই। ম্যাড়ম্যাড়ে গল্পের পাঠক হয় না। অনেক লম্বা একটা শ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। দু’হাঁটুর ভাঁজে মুখ গোঁজে ঐশী।

(তিন)

ঐশীর প্রথম ক্লাস থেকেই অম্বরীশের ভালোলাগার শুরু। অন্য ক্লাস ‘বাঙ্ক’ করলেও সে শেষ সেমেস্টার অবধি একটিবারের জন্যও ঐশীর ক্লাস ‘বাঙ্ক’ করেনি। সেটা পড়ানো ভালোলাগার জন্য না কি মনের ভালোলাগা সে প্রশ্ন অন্য দুনিয়াতে রাখাই ভাল। ঐশী প্রথমে পছন্দ করত না। ভাবত লোকটি চরিত্রহীন। আর তাছাড়াও, ঐশী তখন অন্য একজনের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে। ছেলেটি আই.আই.টি., বম্বে থেকে পি.এইচ.ডি. করছে তখন। এতোদিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। যখন কলেজে ঢুকে প্রথম যৌবন হাতছানি দেয়, তখন কৃষ্ণেন্দুর প্রেমে পড়েছিল ঐশী। দীর্ঘ দশ বছরের সম্পর্ক। কিন্তু সে সম্পর্কেও ঐশী প্রেমই খুঁজে পেত না। তবু নদীর চোরা স্রোতের মতোই টিকে ছিল তাদের সম্পর্ক। চাকরিতে জয়েন করার দিন ভিডিও কলে কথা হয় অনেকক্ষণ ঐশী আর কৃষ্ণেন্দুর।

—“তাহলে, এবার তো নিশ্চয় তোর বাড়ি থেকে পাত্র দেখতে শুরু হয়ে যাবে। জানতাম এটাই হবে।” হ্যাঁ, এটাই ছিল কৃষ্ণেন্দুর প্রথম কথা, দিনের প্রথম বাক্যালাপে।

—“তুই খুব অখুশী। কারণটা জানতে পারি?” শান্ত গলায় প্রশ্ন করেছিল ঐশী।

—“অখুশী কোথায় হলাম?”

—“আমার বাড়ি থেকে বিয়ে কোনদিনই দেবেন না। না লাভ-ম্যারেজ, না অ্যারেজ্ঞড্। আমাদের ফ্যামিলিতে মেয়ে হয়ে জন্মালে বিয়ে করা চলে না। এটাই কাস্টম।”

—“দ্যাটস্ গুড। তুই জানিস, কত বড় লাকি তুই? তোর ফ্যামিলি অনেক প্রগ্রেসিভ। তাই এই সেকেলে বিয়ে, ফ্যামিলি এসবে বিশ্বাস করেন না। … আরে ইয়ার, উই আর ফ্রী নাও।”

—“মানে? তুই কোনদিনই বিয়ে করতে চাস নি আমায়?”

—“নো ম্যান। আমি বিয়ে কন্সেপ্টেই বিলিভ করি না।”

—“তবে কী চেয়েছিলি?”

—“টাচ উড, আমি ওপেন রিলেশ্যানশ্যিপে বিলিভ করি। ঐ একজনের সাথে বদ্ধ ঘরে সারাটা জীবন, দ্যাটস্ ডিসগাস্টিং। এখন যেমন আছি তেমন থাকব। বিন্দাস আছি।”

ছোট ছোট কতকগুলো পুরোন ঘটনা মনে পড়ছিল ঐশীর। মাস্টার্স করতে করতে ঐশী আর কৃষ্ণেন্দু একবার কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিল। ঐশী তখন কলকাতায় পেইং গেস্ট হিসেবে একজনের বাড়িতে থাকত। ওকে ক্যাবে ওই পিজিতে পৌঁছে দিয়ে কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কলকাতাতেই ওর বাড়ি। ক্যাবে যেতে যেতে ঐশীকে জিজ্ঞাসা করে কৃষ্ণেন্দু।

—“ডু ইউ হ্যাভ আই কার্ড উইথ ইউ?”

—“কেন? আই কার্ড নিয়ে কী করবি?”

—“এই হোটেল রেস্টুরেন্টে যাওয়া যেত।”

—“কেন? খিদে পেয়েছে?... তো চল। আই কার্ড চাচ্ছিস কেন তার জন্য? এটা কলকাতা, বম্বে না। এখানে খেতে গেলে আই কার্ড লাগে না।”

—“আরে ইয়ার, তুই কি কিছুই বুঝতে পারিছিস না? আই থট, ইউ আর ম্যাচিওরড এনাফ। খাবার খেতে চাই নি ডার্লিং। অন্য কিছু চেয়েছিলাম।”

কৃষ্ণেন্দুর ইঙ্গিতে ঐশীর মনে হয়েছিল, শহর-বাজারে থেকে ছেলে বখে যাওয়ার দিকে যাচ্ছে। এবার শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। মাঝে মধ্যেই ওর ব্যাগ সার্চ করে দেখত, কিন্তু কন্ডোমের প্যাকেট পায় নি কোনদিন। শুধু ব্যবহারে অন্য কিছু চাইছে বুঝত।

—“ওই, তুই চলে আয় না বম্বে। এতো লং ডিস্ট্যান্স রিলেশ্যানশ্যিপ বনবাসের মতো কষ্টের। আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ ইউ ফিজিক্যালি।… আই রিয়্যালি ফিল কী… আমি সেলফ কন্ট্রোল রাখতে পারছি না। আমার ইদানীং একটা ফিলিংস হচ্ছে। আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ সেক্স উইদ সামওয়ান।” কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে ঐশী একজন নামকরা সাইকোলজিস্টের কাছে ওকে নিয়ে যান। ওঁর মিডিয়া কভারেজ অনেকখানাই। হায় রে, কোন মান্ধাতার আমলে ঐশী পড়ে আছে? সাইকোলজিস্ট উল্টে ঐশীকেই বোঝালেন, “ইটস্ ভেরি নর্ম্যাল। তোমার পার্টনারের বিহেভিয়ার, কেস হিস্ট্রিতে কোন অ্যাবনর্ম্যালিটি নেই। আচ্ছা, ধর, তোমার একজন ছোট ভাই বা বোন আছে। সেই ছোট ভাই বা বোন হল মানে কি তোমার প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা, কেয়ার কমে গেল? তেমন, যদি তোমার পার্টনার অন্য কারোর সাথে অ্যাফেয়ারে যায়ও, সে যদি তোমাকেও ইকুয়াল সময় দেয় হোয়াটস্ দ্য প্রবলেম? … আগেইন তোমার প্রবলেম প্রিম্যারেজ ফিজিক্যাল ইনটিমেসি, সেক্স নিয়ে। বিয়ের আগে তোমার খিদে পেলে খাও না? পটি পেলে কর না? সেক্স ইজ সিমিলার টু অল দীজ্… ইটস্ আ নর্ম্যাল হিউম্যান ইন্সটিংক্ট। তোমার পার্টনারকে তার খুশী মতো থাকতে দাও। দেখবে রিলেশ্যানশ্যিপ ভাল আছে।”

সেইদিন ঐশীর মনে হয়েছিল, আমরা ব্যাক গিয়ার দিয়ে অ্যাকসেলারেটর দাবিয়েছি। গাড়ি পাঁইপাঁই করে ছুটে পৌঁছে গেছে মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। এরপর আরো পেছনে যাবে সমাজ, প্রাচীনযুগ। তারপর ধ্বংস। … তবু, নিজেই চেষ্টা করে গেছল ঐশী, কৃষ্ণেন্দুকে ‘সিভিলাইজড্’ করতে। কিন্তু…

ঐশীর কোন প্রয়োজন বা বিপদে কৃষ্ণেন্দু কোনদিনই পাশে এসে দাঁড়ায় নি। অবশ্য প্রফেশন্যালি ছাড়া নাকি অন্য কোন হেল্প করতে ও পছন্দ করে না। কিন্তু জুনিয়র, ব্যাচমেট, সিনিয়র ফিমেল ক্যান্ডিডেট নিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টে দিব্যি রাত কাটিয়ে ভোর করে ফেলতে পারে। বোন, বান্ধবী, দিদিদের সাথে বিছানায় শুতেও পারে নির্দ্বিধায়। বাকি তো রাতের ইতিহাস। অবশ্য এটায় তো ‘কালচারড্ মর্ডান ট্রেন্ড’। সাইকোলজিস্ট তো বলেছিলেন, ঐশীকে এগুলো মেনে নিতেই হবে এযুগে বাঁচতে গেলে।

… ঐশী সেইদিন ভিডিও কলে কিছু বলে নি কৃষ্ণেন্দুকে। কিন্তু সেইদিনই ঠিক করে নিয়েছিল, এই সম্পর্কে আর থাকবে না। ‘ওপেন রিলেশ্যানশ্যিপ’ মেনে নেওয়ার মতো বর্বর সে হয় নি এখনও।

অম্বরীশের সাথে যে তখনই সম্পর্কের বঁড়শিতে গেঁথেছিল নিজেকে, তেমনটা নয়। তবু, কোথাও ‘না-ভালোলাগার’ ভালোলাগা কাজ করত। অম্বরীশ দেখতে তেমন সুন্দর না। ওর চাইতে বেঁটে, রোগাও। মাথায় উলুখাগড়ার মতো চুল। ঘাড়ের একটু ওপরে দুলতে থাকে, ঝুলতে ঝুলতে। একটা সময় পড়াশুনো করত। লাইব্রেরিতেও দেখা যেত। ঐশী জয়েন করার মাস কয়েক পর থেকেই বাইক নিয়ে রাস্তায় উড়তে দেখা যায়। হাইওয়ের ধারে মাঠে-ঘাটে বসে থাকে। যখন হাট বসে, আশে-পাশের গ্রামগুলোয়, সেখানে গিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য এগুলো সবই শোনা কোথা। শোনা যায়, অনেক পুরোন, প্রেমের দুষ্প্রাপ্য গানের গ্রামোফোন রেকর্ডও নাকি খুঁজে বেড়ায়। ওটাই ওর এখনের নেশা। শুনে, ঐশীর ইচ্ছে হয়েছিল, ঠাসিয়ে দু’টো গালে চড় কষায়। আস্ত চরিত্রহীন ছেলে। উচ্চিংড়ে একটা। কিন্তু এই অপছন্দের মাঝেই কখন যেন পছন্দ হয়ে গেল। প্রেমের গানের রেকর্ড ছাড়াও ওর সংগ্রহে আছে, পুরোনদিনের নানান ডিজাইনের শাড়ি, বাংলার মায়েদের হাতে বোনা কাঁথা, ফেলে দেওয়া ভেঙ্গে যাওয়া পুরোন দিনের থালা-বাসন… বলা যায় সাবেকি জিনিসের একটা ‘মিউজিয়াম’ অম্বরীশের বাড়িটা। ওর আর একটা জিনিস মন কেড়েছিল ঐশীর। সেটা ‘হিয়ার-সে এভিডেন্স’ না, মানে কারোর থেকে শোনা নয়, নিজের পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা। অম্বরীশ তখনও কলেজে পড়ছে। লাস্ট ইয়ার, ফিফ্থ সেম। ঐশীর বর্তমান কলেজ থেকে বেরিয়ে একটু দূরে একটা গঙ্গার ঘাট আছে। কলেজে ঢোকার আগে ঐশী যায় সেখানে। ওদের তো ইভিনিং কলেজ। এক গরমের দুপুরবেলা। ঐশী একটু আগেই পৌঁছে গেছল। ভাবল, একবার গঙ্গার ঘাটে ঘুরেই আসি। ঘাটের মুখোমুখি যেতেই একটা সরু নরম গলায় কবিতার স্বর ভেসে এল কানে। অম্বরীশ না? হুঁ, দেখে সঙ্গে একটি দোসর (সে বান্ধবই, বান্ধবী নয়, ওরই মতো উচ্চিংড়ে) জুটিয়ে কাব্য চর্চা করছে। জলের দিকে মুখ করে ছিল। তাই, ঐশীকে দেখতে পায় নি ওরা। কবিতাটা মন দিয়ে শোনে ঐশী… শামসুর রাহমানের না? ঠিক মনে করতে পারল না। কিন্তু ধাঁচটা শুনে মনে হল।

“আমার মাতামহী, সবার অলক্ষ্যে যিনি শাদা অথচ সুদীর্ঘ
চুল আঁচড়াতেন মধ্যদিনে কাঠের কাঁকুই দিয়ে আর
সন্ধ্যা হ’লেই মুরগীর বাচ্চাগুলোকে দর্বায় পোরার জন্যে
অস্থির পায়ে করতেন ছুটোছুটি — যত আন্দোলিত হতেন আমার
মাতামহের ডাকে ততটা আর কিছুতেই নয়।
বুঝি তাই কবিতার ডাক তাকে কখনও কাছে টানেনি।


না, তাঁরা কেউ পা রাখেননি নিঃসঙ্গতার উথালপাথাল
সমুদ্র-ঘেরা কবিতার দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু ঐ পুণ্যজনের
স্মৃতির অজর শরীরে
কবিতার সোনালি রুপালি জল ছিটোচ্ছে
তাঁদেরই এক ফ্যাকাশে বংশধর
সময়ের হিংস্র আঁচড়ে ক্রমাগত জর্জর হ’তে হ’তে।”

—“ঐ ম্যাম…” সাকরেদটি আড়চোখে দেখে ফেলেছে ঐশীকে। কনুই দিয়ে খোঁচা মারে কবিতাচ্ছন্ন অম্বরীশকে।

—“হ্যাঁ ম্যাম, আসুন ম্যাম।” উঠে দাঁড়ায় অম্বরীশ, “এই একটু কবিতা পড়ছিলাম। এতোদিন এক্সামের প্রেসারে মাথা ধরে গেছে। তাই ছাড়াচ্ছিলাম। আমরা একটু পরেই ক্লাসে যাব।”

ঐশী মুচকি হেসেছিল, “আমি কি তার জন্য বকেছি? এক-আধদিন আমার ক্লাসও ‘বাঙ্ক’ করতে পার। লাইসেন্স দেওয়া রইল।” এই প্রথম অম্বরীশকে সে ‘তুমি’ বলল। এতোদিন ‘আপনি’ করেই বলত। এই কলেজে থ্রি-ইয়ারস্ এল.এল.বি.। তাই বয়েসের কোন উর্ধ্বসীমা নেই। অনেক ছাত্র-ছাত্রীই আছেন ঐশীর চাইতে বয়েসে বড়। তাই ঐশী ওঁদের সবাইকে “আপনি” করেই বলে। এই ‘তুমি’টা কি শুধু ক্লাস বাঙ্কের ‘লাইসেন্স’, না কি?... অম্বরীশের ঠোঁটে ছোট্ট হাসি খেলে যায়। হাসি না শৃঙ্গার? দুপুর রোদে ঐশী দেখে অম্বরীশকে।

(চার)

ঐশীকে সবাই শুধু ব্যবহার করেই গিয়েছে, ইমোশন্যালি না তো কোন না কোন কাজ করিয়ে নিয়ে। বন্ধুদের, জুনিয়র, সিনিয়রদের নোটস, থিসিস তৈরি করে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে সবরকম কেরিয়ার গাইডেন্স, পারিবারিক সাহায্য সবই করেছে সে। অথচ তার দরকার তো দূরের কথা, ফ্রাস্ট্রেশনে, একাকিত্বে কেউ দু’টো মিনিটও খরচ করে নি। অ্যাডভোকেট বন্ধুরা বিনা পয়সায় কোন কথাই বলে না। তাদের এক সেকেণ্ডেরও মূল্য অনেকখানা, পয়সার দরে। অথচ ঐশী যখন তার বিয়ের কথা বলেছিল, অম্বরীশের নাম তখনও করে নি, বন্ধুরা কেউ বলেছিল, “তুই বিয়ে করে জীবনটা শেষ করবি? এমনটা করিস না। তুই এতো ব্রিলিয়ান্ট।” একজন তো বলেই দিয়েছিল, “তুই বিয়ে করলে তো সবসময় অ্যাভেইলেবল্ থাকবি না। এরপর বাচ্চা হবে। তাহলে আমি হেল্প পাব তো?”

কত সুন্দর জগৎ তাই না? আমরা ফ্লেশ-ট্রেডকে শাস্তি দিই। কিন্তু একজন মানুষকে সব দিক থেকে এভাবে নিংড়ে নেওয়াটা দোষের নয়, না? যে সাহায্য করে তাকে এক্সপ্লয়েট করাটা খুব গুণের? তার কি ব্যক্তিগত জীবনও থাকতে নেই? ঐশীর এক নারীবাদী বান্ধবী (তাকে ‘বন্ধু’ বললে খুব রেগে যায়, কারণ সে লিঙ্গ সচেতন) ঐশীর বিয়ের খবরটা শুনে বলেছিল, “হাউ ডিসগাস্টিং! তোরা পুরুষ ছাড়া থাকতে পারিস না বলেই, পুরুষরা এতো পেয়ে বসে। একা থাকবি, হাউজ-হেল্পিং নিয়ে বা কোন এন.জি.ও., আশ্রম, হোম এদের সাথে থাকবি, তবে তো স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে বাঁচবি। তা নয়, সেই বিয়ে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স… ফাক্!”

অথচ সেই বান্ধবী নিজেই বিবাহিতা। পালিয়ে বিয়ে করেছিল, গ্র্যাজুয়েশান পড়তে পড়তেই। যদিও এখন নিজে অনেক সোস্যাল সার্ভিসের সাথে যুক্ত। নিজের একটা নারী জাগরণের এন.জি.ও. রয়েছে। ঐশীর অবিবাহিত জীবন কাটানোতে কোন ভয় বা কষ্ট নেই। ভয় পায় সে একাকিত্বকে। যেদিন তার পিসিরা, মা-বাবা থাকবেন না, সেদিন সে পুরোপুরি পরিবারহীন হবে। সেইদিনটার কথা ভেবে আতঙ্ক লাগে। পরিবারহীন জীবন কি সত্যিই কাটানো খুব সহজ? তাহলে অনাথশিশুদের দত্তক নেওয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থা রয়েছে কেন?

ঐশীর বন্ধুদের কথাগুলো শুনলে অম্বরীশের কথা মনে পড়ে যায়। অম্বরীশের বলার ধরণ নকল করে নিজেই ভাবে ঐশী, “দিদি, বিয়ে করলেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভিক্টিম হয়ে যাও, আর ভোট দিতে গেলে কোন ভায়োলেন্স হয় না তো? রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গেলে সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স হয় না তো? কলেজে র‍্যাগিং নামক কোনও ভায়োলেন্স নেই তো? না কি ঐ ভায়োলেন্সগুলো খুব মধুর লাগে। এ গল্পটা পুরোন হয়ে গেছে দিদি, নতুন গল্প দাও। ভায়োলেন্স সর্বত্রই আছে। সেটার জন্য নিজে অ্যালার্ট হও। রাস্তায় বেরোলে অ্যাক্সিডেন্ট হতেই পারে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে গেলে পা পিছলে পড়তেই পার, তা বলে কি ঐ “ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক চিরকাল”টি হয়ে থাকবে?” কিংবা অম্বরীশ হয়তো মাথা চুলকে, চোখদু’টো কুঁচকে বলত, “আমাদের যুবসমাজ যে হারে সংসার জীবন পরিত্যাগ করে কর্মে বলীয়ান হওয়ার আন্দোলনে নেমে গেল, তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীরাও মুখ লুকোবে স্বর্গে বসে। ভাববে, আহারে তারা যদি এমন বীর হতে পারত! রবীন্দ্রনাথ বা বাকি কবিগুলো তো নিজেদের লেখাগুলো মর্ত্যে রেখে আসায় ছিঁড়তে না পারার কষ্টে মাথার চুল ছিঁড়বে। ভাববে, কী ভুল করেছি, প্রেম-ভালোবাসার কথা লিখে, এর চাইতে প্রেম-ত্যাগের আন্দোলন শুরু করলে কলমগুলো ধন্য হতো। সংসার প্রত্যাহার, অ্যাবর্শ্যান ভাল বটে, পপুলেশান নির্মূল হবে। কিন্তু সকলের কর্মমুখরতার হুড়োহুড়িতে জড়বস্তুগুলোর ওভার জড়ুলেশন (পপুলেশনের কাজিন ব্রাদার) হয়ে যাবে। তাতে করে ওদেরকে সরকার নির্বাচন শিখতে হবে মানুষের অবলুপ্তির আগে।”

কথাগুলো নিজের মনে ভাবতে ভাবতে ঐশী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

—“নিজের মনেই হাসছ যে। অনেকক্ষণ তো বসে আছ। চল, শোবে চল।” আলতো করে ঐশীর কাঁধে হাত রাখে অম্বরীশ।

—“তুমি ঘুমোও নি?”

—“একটুখানি। তোমার যদি অসুবিধে থাকে তাহলে আমি অন্য রুমে শিফট করে যাচ্ছি। বা তুমিও অন্য রুমে শুতে পার। প্রথম প্রথম তো একটু আনকমফোর্টেবল লাগতে পারে, মানে লাগবেই, মানে ওটাই স্বাভাবিক। তাই…”

—“আমি অন্য জিনিস ভাবছিলাম।”

—“মা-বাবা?”

—“হুঁ।” ঐশী ঘাড়-নাড়ে।

—“ওঁদের ধীরে ধীরে বোঝাতে হবে। সময় দিয়ে।”

—“আসলে, ওঁরা ওবাড়িতে সবাই বয়স্করা থাকেন। কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে…”

—“অন্য কোন ব্যবস্থায় হবে না। আমি কথা বলে রেখেছি আমার মা-বাবার সাথে। ওঁরা বলেছেন, আমরা সবাই একসাথে থাকব। কোন বাড়িতে কতদিন সেসব নিয়ে তোমার মা-বাবার সাথেও কথা বলতে হবে। আমার কোন সমস্যা নেই মা-বাবাকে নিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে। কিন্তু তোমার চাকরি তো এদিকে। ঘাটালে তো আর পাকাপাকিভাবে থাকতে পারবে না। এদিকেই তোমায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে হবে এবার। সেটা তুমি ভেবে দেখ।”

রাতের অন্ধকারে অম্বরীশের গলাটা বড় অদ্ভুত লাগল। ঐশী নিজের থেকে আলতোভাবে এগিয়ে গেল অম্বরীশের কাছে। বুকে মাথা রাখল। অম্বরীশের দ্রুত প্রশ্বাস-নিঃশ্বাসে ঐশী বুঝল ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এই প্রথম ওরা দু’জন দু’জনকে ছুঁলো — এতো কাছ থেকে।

—“ভয় নেই, শ্লীলতাহানির কেস করব না।” মৃদু গলায় বলল ঐশী।

—“ধ্যাৎ, তুমি তো ম্যাডাম মানুষ। তাই ভয় হয়। পাছে বকা দাও।”

—“আমাকে ছুঁতেও এতো ভয়?”

—“ছোঁবো? সত্যিই চাও?”

এ এক অন্য আলিঙ্গন। আড়ষ্টতার রসমেশান কুণ্ঠামাখা এক অভিসার। অভিসার? হুঁ… এখনও যামিনী রয়েছে। বেলা হতে অনেকখানিই বাকি। নিশীথ প্রহরী এখনও জাগে। একটা লোক মুখে শিস দিতে দিতে পেরিয়ে যাচ্ছে অম্বরীশের বাড়ির পাশ দিয়ে। শিসটায় খেলছে একটা সুর। খুব চেনা, না? “তুমি আছ আমি আছি তাই, অনুভবে তোমারে যে পাই…”

(সমাপ্ত)

0 comments: