ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকহেঁশেল যাত্রা -১৮
স্মৃতির শহর – ৪
এই পর্বের লেখার শিরোনাম হিসেবে যখন এই নামটি বেছে নিই, যে শহর জানে আমার সব গোপন, গহন কথা, সেই শহর কলকাতার হেঁশেলের অন্দরমহলে একটু উঁকিঝুঁকি মারতে চেয়েছিলাম, একটু চেখে দেখতে চেয়েছিলাম ভিন্নধর্মী স্বাদের পরতগুলি। আপন খেয়ালে লেখাটি বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পাচ্ছি স্মৃতির শহর এক নয়, অনেক। আজন্ম-লালিত খাদ্যাভ্যেসগুলির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অন্যান্য রন্ধনশৈলীর ধরন-ধারণ তার ফলে একটা পর্যায়ে গিয়ে শহরগুলিও কেমন একে অপরের আত্মীয় হয়ে উঠেছে। এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক।
গতবার লিখেছিলাম বাঙাল ঘটির বিভেদ নিয়ে। যে সংঘাতের ইতিহাস বাঙালি জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল অধ্যায়। নব্বইয়ের শুরু থেকে যখন ইউরোপ, বিশেষত জার্মানি যাওয়া-আসা শুরু হল, আবিষ্কার করলাম বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে পড়লেও ওদেশে রয়ে গেছে এক অদৃশ্য পাঁচিল। এক্ষেত্রেও পুব-জার্মানরা যেন বাঙাল আর তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল পশ্চিম জার্মানির মানুষ ঘটি। এই সমান্তরালটি তৈরির সময় একথা খেয়াল রাখতে হবে যে বাঙাল-ঘটি শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে একধরণের বৈরিতার যে আভাস পাওয়া যায়, জার্মান অনুষঙ্গটি ঠিক তার সঙ্গে মেলে না। প্রথমত ওদের কোনও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নেই। দ্বিতীয়ত খাদ্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অসাদৃশ্য অনেক কম। খাওয়া-দাওয়ার মূল আদলটি বরাবরই এক। বরং অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয় দেওয়াল নির্মাণের পরই। একই জনগোষ্ঠী দুভাগ হয়ে যায়। দুধরণের সমাজ তৈরি হয়। পুবের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠতে থাকে সমাজবাদী শৃঙ্খলার মধ্যে আর এদিকে পশ্চিমে, পাঁচিল-পরবর্তী জাতকরা, ধনতান্ত্রিক আবহাওয়ায়। এঁর প্রভাব পড়ল খাওয়ায় টেবিলেও। পুবের মানুষ যখন সাউয়ারক্রাউট, কারটোফেলন সালাটের চিরন্তন স্বাদের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখেছেন, পশ্চিমের টিনএজারদের হাতে তখন পিৎজা বা বার্গার। ক্রমে দেখা দিল আরেকধরনের পরিবর্তন। প্রজন্মব্যাপী মাংস খাওয়ার অভ্যেস থেকে সরে আসতে লাগল পশ্চিমের অধিবাসীরা। নিজের করে নিতে লাগলেন ইতালিয়, ফরাসি, তুর্কি, স্পেনিয়, গ্রিক কিংবা ওলন্দাজ রান্নাবান্না। ফলত খাঁটি জার্মান রান্না বলতে আর কিছুই রইল না। বাড়িতে তো বটেই, বাড়ির বাইরেও, রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েও খোঁজা হতে লাগল সেইসব পদ। সেইরকমই একটি সিগারা ব্যোয়েক। সেবার তখন ওদেশে। অলোকদার বাড়িতে ইতিমধ্যেই থাকা হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন। একদিন সকালে হানস্ এলো আমাদের নিতে। সঙ্গে পাউলা আর টেরিজা – ওর দুই মেয়ে। পাউলার মাথায় আবার দুতি সোনালি বিনুনি। ওর মা বেঁধে দিয়েছে। আর ছোটটি – টেরিজার একমাথা এলোমেলো চুল আর দুষ্টুমিভরা দুটি চোখ। ওদের নাকি খুব খিদে পেয়েছে। তা আমরা গিয়ে বসলাম কাছাকাছি এক ছোট ক্যাফেতে। মেয়েগুলো কি যে অর্ডার করল তখন বুঝিনি। অচিরেই পরিবেশনকারী যা নিয়ে এলেন, প্রথম দর্শনে তাকে ফিশ ফিঙ্গার বলে ভুল হতে পারে। আবার সিগারেটও। যা থেকে এই সিগারা নামের জন্ম। কিন্তু নামে কিইবা আসে যায়? অস্ট্রিয়ানরা যা দিয়ে জগদ্বিখ্যাত আপফেলস্ট্রুডেল (Apfelstrudel) তৈরি করেন, সেই ফিলো পেস্ট্রি শিটের মধ্যে ভরে দেওয়া হয় মাংস, চিজ বা শাকের পুর। অতঃপর সিগারেটের আকারে পাকিয়ে ছাঁকা তেলে ভেজে নেওয়া হয়। এর ফলাফল হয় অবিশ্বাস্য। ধোঁয়া ওঠা এই সিগারা পরিবেশন করা হয়ে থাকে দইএর একধরনের ডিপের সঙ্গে। মেয়েদুটির মুখে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা পরিতৃপ্তির ছায়ায় আমরা যেন আমাদেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম।
0 comments: