0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


১৫



মেয়েটার মুখের অভিব্যক্তি ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। কেমন অদ্ভুত! গ্রেকের একবার মনে হল, মেয়েটা বোধহয় হাসছে। কিন্তু হাসি নয়। মেয়েটা এমনভাবে সেজেছে, যে আসল মুখশ্রী চাপা পড়ে গেছে। যাতে কেউ চিনতে না পারে, হয়তো সেই জন্য সেজেছে এমন। মেয়েটার হাতে একটা টাকার নোট। বাচ্চারা যেভাবে টাকাপয়সা হাতে নেয়, মেয়েটা সেইভাবে টাকাটা ধরে আছে। টাকার নোটটা যেন একটা ফুলের গুচ্ছ, কিম্বা যেন একগাছি বেত।

গ্রেকের দিক থেকে নজর না সরিয়ে সরাইখানার মালিক মেয়েটাকে একবোতল ওয়াইন আর দু তিনটে সিগারেট দিল। মেয়েটার দিকে একবারও তাকালো না সরাইখানার মালিক। একটাও বাক্য বিনিময় করলো না তারা। গ্রেক পকেট থেকে দলামোচড়া টাকার নোটগুলোর মধ্য থেকে ফলওয়ালি বুড়ির দেওয়া ঠিকানা লেখা কাগজের টুকরোটা টেনে বের করে টেবিলে রাখলো। টাকাগুলো আবার ঢুকিয়ে রাখল পকেটে।

সরাইখানার মালিক লোকটার চোখ দুটোর দৃষ্টি পরিষ্কার পড়তে পারছে সে এখন। মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসছে। মেয়েটার হাতে ওয়াইনের সবুজ রঙের বোতল, আর দু তিনটে খুচরো সিগারেট। অন্ধকারে মেয়েটার সাদাটে চকচকে মুখমণ্ডল, লিপস্টিক রাঙা ঠোঁট, হাতে ধরা বিষণ্ণ সাদা সিগারেটগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা ছোট করে হেসে পর্দাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। সরাইখানার মালিক অদ্ভুতচোখে চেয়ে আছে গ্রেকের দিকে। চাউনিটা কেমন যেন ভয়ঙ্কর। আচ্ছা, খুনিদের চাউনি কি এরকম হয়?

গ্রেকের হঠাৎ শরীর শিরশির করে উঠল। সে এখনই চলে গেলে হয়তো লোকটা খুশি হবে। তার এখনই চলে যাওয়া উচিত। বাইরে নৌকা নাগরদোলাটা দুলতে শুরু করেছে। ট্রামগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে। একটা অদ্ভুত বিষাদ ঘিরে ধরেছে তাকে। বিরক্তিকর, নরম, উষ্ণ ফলগুলো টেবিলে পড়ে আছে তার সামনে। কফির কাপে মাছি ভনভন করছে। গ্রেক মাছিগুলো তাড়িয়ে দিল না। নিজেই দুম করে উঠে পড়ল টেবিল থেকে, - ‘বিল, প্লিজ!’ জোরে চেঁচিয়ে বলল সে। হয়তো নিজেকে সাহস দেবার জন্যই কথাটা একটু চেঁচিয়ে বলল সে।

দৌড়ে এলো লোকটা। গ্রেক পকেট থেকে টাকা বের করল। সে দেখতে পেল ফলগুলোর উপরেও মাছি বসেছে। ধীরে ধীরে বিরক্তিকর গোলাপি রঙের ফলের গায়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কালো কালো বিন্দুগুলো। সে ওই ফলগুলো কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছে, এটা ভেবেই গা গুলিয়ে উঠলো তার হঠাৎ।

‘তিন পেঙ্গো” --- বলে উঠলো সরাইখানার মালিক। গ্রেক লোকটাকে টাকাটা দিয়ে দিল। লোকটা গ্রেকের আধখাওয়া পানীয়ের গ্লাসটার দিকে তাকাল একবার, তারপর গ্রেকের বুকে আটকানো মেডেলগুলোর দিকে, তারপর টেবিলে রাখা কাগজের টুকরোটার দিকে হাত বাড়াল। যদিও প্রায় একই সময়ে গ্রেকও হাত বাড়িয়েছিল কাগজের টুকরোটার দিকে। লোকটা বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। লোকটার বড় মোটা বিবর্ণ মুখটা অসহ্য লাগছিল গ্রেকের। লোকটা কাগজের ঠিকানাটা দেখেছে। এই সরাইখানার ঠিকানাটাই লেখা আছে। লোকটার হাসিটা আরও বিশ্রী লাগছে এখন। গ্রেকের আবার ভীষণ ঘাম হতে লাগল।

‘আপনার কি কাগজের টুকরোটা আর প্রয়োজন আছে?’ প্রশ্ন করল সরাইখানার মালিক লোকটা।

-না!’ গ্রেকের উত্তর শুনেই লোকটা বলে উঠল… ‘বিদায়!’

গ্রেক দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠল ‘ হাইল হিটলার!’ আসলে এটা তো তাকে বলতেই হত। কিন্তু লোকটা কোনো উত্তর দিল না। গ্রেক বেরিয়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল যে লোকটা তার গ্লাসের উচ্ছিষ্ট বাকি ব্র্যান্ডিটা অদ্ভুত হিংস্র ভঙ্গিতে মেঝেতে ঢেলে ফেলছে। অন্ধকারে টেবিলের ফলগুলোর উষ্ণ গোলাপি রঙ মনে হচ্ছে একটা বাদামি শরীরের মধ্যে দগদগে গোলাপি ক্ষতচিহ্ন।

গ্রেক রাস্তায় নেমে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সে। ডিউটির সময়টা শুরু হওয়ার আগেই হাসপাতালে ফিরে যেতে লজ্জা বোধ করছিল সে। বেঁটে লেফটেন্যান্টের খ্যাঁকখেঁকে বিদ্রুপাত্মক হাসিটা মনে পড়ছিল তার। কিন্তু এখন ফিরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলে একটু ভালো হত। কড়া ধাঁচের কিছু খেতে পারলে ভালো হত। তবে খাওয়ার কথা মাথায় আসা মাত্র ফলগুলোর বিশ্রী গোলাপি রঙটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। কুৎসিত লাগছে এখন তার গোলাপি রঙটা। ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে। হাসপাতাল থেকে সোজা যে মেয়েমানুষের কাছে গিয়েছিল সে লাঞ্চের সময়ে, হঠাৎ তার কথা মনে পড়ল। মেয়েটার যান্ত্রিক চুম্বন… উফফ, তার গলার কাছে এখনও ব্যথা করছে। সে বুঝতে পেরেছে… কেন হঠাৎ ফলের কথা মনে আসামাত্র বমি পেয়ে যাচ্ছে তার। মেয়েটার অন্তর্বাসের রঙ আর ফলগুলোর রঙ একই। মেয়েটা অল্প অল্প ঘামছিল। শরীরটা বেশ উষ্ণ ছিল। দুপুরবেলায় এত গরমের মধ্যে মেয়েমানুষের কাছে যাওয়া মুর্খামি ছাড়া কিচ্ছু নয়।

আসলে সে তার বাবার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। বাবা তাকে বলেছিল মাসের মধ্যে অন্তত একবার হলেও যেন সে কোনো মেয়েমানুষের কাছে যায়। মেয়েটা খারাপ ছিল না। বেশ ডাঁটো, ছোটখাট চেহারা। সন্ধেবেলায় হয়ত মেয়েটাকে আরও সুন্দর লাগে। তার কাছে যা টাকাকড়ি ছিল, মেয়েটা সবই নিয়ে নিয়েছিল। তাছাড়া তার পরনে দু’খানা ট্রাউজার দেখেই মেয়েটা ধরতে পেরেছিল তার মতলব। মেয়েটাই তাকে ওই ইহুদী দর্জির ঠিকানা দিয়েছিল।

সে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। তার শরীর খারাপ লাগছে। ঠিকঠাক পুষ্টিকর কোনো খাবার খাওয়া উচিত ছিল তার। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন খিদে মরে গেছে। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না তার। সবকিছুই উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটে চলেছে আজ। একদম ভুলভাল। দুপুরবেলার মেয়েমানুষ, নোংরা ইহুদী দর্জি, নৌকা নাগরদোলা… যদিও নাগরদোলার অভিজ্ঞতাটা আজ একদম নতুন, তবুও ব্যাপারটা অদ্ভুত। তাছাড়া সেই বুড়ি ফলওয়ালি, আপ্রিকট, এদেশের অদ্ভুত লোকজন, সরাইখানার মালিক লোকটা… উফফ, অসহ্য ব্যাপার সব। তবে সরাইখানার মেয়েটা খুব সুন্দর ছিল। বেশ ভালো লাগছিল দেখতে। কিন্তু একই দিনে দু’বার মেয়েমানুষের কাছে যাওয়া ঠিক নয়। দূরে অন্ধকারে সবুজ পর্দার সামনে হয়তো মেয়েটাকে ভালো লাগছিল তার। কাছে গেলে হয়তো আবার ঘামের দুর্গন্ধ পাওয়া যাবে। তাছাড়া, এই মেয়েগুলোর কাছে সেরকম বেশি পয়সাও নেই যে দুপুরবেলা গরমের মধ্যে এরা তরতাজা থাকবে, চনমনে হয়ে ফুলের মত সুগন্ধ ছড়াবে।



একটা রেস্তরাঁর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল গ্রেক। শক্ত লম্বা সবুজ গাছের টবের মাঝে মাঝে রাস্তার উপরে চেয়ারগুলো পাতা। এক কোণে বসে সে একটা সোডা অর্ডার দিল… ‘বরফ দিয়ে’ পরে ওয়েটারকে ডেকে বলে দিল। ওয়েটার মাথা নাড়ল। গ্রেকের কাছেই এক দম্পতি বসেছিল। তারা রোমানিয়ান ভাষায় কথা বলছিল।

গ্রেকের বয়স তেত্রিশ। ষোল বছর বয়স থেকে তার পেটের সমস্যা। ভাগ্যগুণে তার বাবা ডাক্তার ছিলেন। খুব বড় ডাক্তার, এমন নয়। তবে সেই ছোট শহরের একমাত্র ডাক্তার, এবং তাদের যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল। কিন্তু মা ছিলেন খুব মিতব্যয়ী। গ্রীষ্মে তারা নদী অথবা ঝর্ণার ধারে কিম্বা আল্পসের পাদদেশে কোথাও বেড়াতে যেত। শীতে তারা বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকত এবং খুব সাধারণ খাবারদাবার খেত। শুধু কোনো অতিথি এলে ভালো খাওয়াদাওয়া হত বাড়িতে। তবে অতিথিও কমই আসত। তাদের ছোট শহরে সব সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান সরাইখানাতেই হত, এবং তার সরাইখানায় যাবার অনুমতি ছিল না। অতিথিরা এলে ওয়াইন পরিবেশন করা হত, কিন্তু যতদিনে সে ওয়াইন পান করবার মত বড় হল, ততদিনে তার পেটের সমস্যা ধরা পড়েছে। তারা সবসময় প্রচুর আলুর স্যালাড খেত। মনে হয় সপ্তাহে তিন চার দিন তো খেতই। বড় হবার পরে মনে হয় সে আলুর স্যালাড ছাড়া আর কিছু বিশেষ খায় নি। একজন ডাক্তার তাকে পরে বলেছিলেন যে দীর্ঘদিন অনাহারে থাকলে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়, তার পেটের অসুখের লক্ষণগুলো ঠিক সেরকম এবং আলুর স্যালাড তার জন্য বিষ। তাদের ছোট শহরে রটে গিয়েছিল যে সে অসুস্থ। ছোট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে, সবার হাঁড়ির খবর জানে। মেয়েরা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাত না। তার অসুখটা অন্য কোনো ডাক্তারকে দেখিয়ে সারিয়ে নিয়ে আসবার মত টাকাকড়িও তার বাবার ছিল না। স্কুলেও সে খুব ভালো ছাত্র ছিল না। ১৯৩১ সালে হাইস্কুল থেকে পাশ করবার পরে, যে কোনো একটা ইচ্ছে পূর্ণ করবার জন্য তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন তার বাবা মা। সে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল।



সে হাগেন শহরে চলে গিয়েছিল। একটা হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়েছিল। সারা সন্ধে জ্বরগ্রস্তের মত শহরে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছিল সে, কিন্তু সেখানে কোনো বেশ্যার দেখা পায় নি। পরদিন ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে গিয়েছিল। সেখানে আট দিন ছিল সে। আট দিন পরে তার টাকাকড়ি ফুরিয়ে গিয়েছিল। সে বাড়ি ফিরে এসেছিল। ফেরবার সময় ট্রেনে ক্লান্ত, অসুস্থ শরীরে, তার মনে হচ্ছিল যে সে মরে যাবে। বাড়িতে বিস্ময় এবং আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সে ফিরে আসবার পরে। তাকে তিন সপ্তাহ ঘুরে বেড়াবার জন্য যথেষ্ট টাকাকড়ি দেওয়া হয়েছিল। বাবা অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিলেন, মা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তার পরেই সেই বিশ্রী ঘটনাটা ঘটেছিল। তার বাবা তাকে চেম্বারে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে সারা শরীর পরীক্ষা করেছিলেন।

শনিবারের বিকেল ছিল সেটা। সে কোনোদিন ভুলবে না। বাইরে জনশূন্য পথঘাট। চারিদিক নিস্তব্ধ। এমনিতে তাদের পরিবার এবং ছোট শহর খুব শান্তিপূর্ণ। তার মনে আছে অর্ধচেতন অবস্থায় বাড়ি ফিরে সে অনেকক্ষণ ধরে বাড়ির বেল বাজিয়েছিল। ঘণ্টার শব্দটা মনে আছে। আর মনে আছে তারপর বাবার চেম্বারে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। সে ওই বড় চ্যাপ্টা মুখটা যেটা থেকে সবসময় হাল্কা বিয়ারের মত গন্ধ বেরোয়, সেটাকে ঘেন্না করে। অনেকটা সময় ধরে সারা শরীরে থাবড়ে থাবড়ে পরীক্ষা করেছিলেন। কাঁচাপাকা ঘন চুলওয়ালা বিরাট মাথাটা দেখেছিল সে, যেটা অনেকক্ষণ ধরে তার তলপেট পরীক্ষা করছিল।

‘তুমি উন্মাদ!’ বলেছিলেন বাবা। খুঁটিয়ে তার শরীর পরীক্ষা করে অবশেষে তার মাথাটা তুলে হাল্কা হেসে বলেছিলেন তিনি… ‘তুমি উন্মাদ! সারা মাসে একবার কি দুবার কোনো মেয়েমানুষের কাছে যাবে, তাহলেই যথেষ্ট।’ সে জানত যে বাবা ঠিক বলেছিলেন। সন্ধেবেলায় মায়ের সঙ্গে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হাল্কা চা খাচ্ছিল সে। মা কোনো কথা বলেন নি। কিন্তু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। সে খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল।

দু সপ্তাহ পরে সে মারবুর্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গিয়েছিল। যদিও সে বুড়ো বাবাকে একেবারেই পছন্দ করত না, তবুও বাবার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিল সে। তিন বছর পরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ধাপ পেরিয়েছিল, দু বছর পরে ইন্টার্ন পাশ দিয়ে এবং তার একবছর পরে ডাক্তারি পাশ করেছিল। ১৯৩৯ সালে জেলা শহরে প্র্যাকটিস করবার অনুমতি পেয়েছিল সে। ক্যাডেট সার্জেন্ট হিসেবে ফিল্ডে যেতে হত তাকে। যুদ্ধ ভালো লাগেনি তার কোনদিন। কিন্তু যুদ্ধের ফলে নতুন নতুন কাজের চাপ বেড়ে চলছিল। তাছাড়া তার পদ কিম্বা ডাক্তারি ডিগ্রি কোনটাই যেন সমাজের চোখে যথেষ্ট ছিল না তখন। সেরকম কোনো পদক কিম্বা সম্মান যুদ্ধের বাজারে নিজের জন্য আদায় করতে পারেনি সে। বাড়িতে ফিরবার পরে সবাই তার বুকের দিকে চেয়ে থাকত। মা তাকে এসব কিছু মেনে নিতে বলত, আবার এমন কিছু কথা চিঠিতে লিখত, যেগুলোতে অদ্ভুত খোঁচা থাকত।

‘হিউগো ছুটিতে এসেছিল। সে ইকে*-ওয়ান পদক পেয়েছে। এদিকে লেখাপড়ায় তো শুনেছিলাম কসাইয়ের পরীক্ষাতেও পাশ করেনি। শোনা যাচ্ছে যে শীগগির নাকি সে অফিসার হয়ে যাবে। আমার তো অবিশ্বাস্য লাগছে। ভেসেনদঙ্ক বিশ্রীভাবে আহত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে একটা পা কেটে বাদ দিতে হবে।’ – পা বাদ যাওয়াটাও সমাজে বিখ্যাত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল তখন।

সে আরেকটা পানীয় নিল। বুদ্বুদগুলো তাকে আরাম দিচ্ছে। শরীরটা ঠাণ্ডা হচ্ছে কিছুটা। যদি সম্ভব হত, তাহলে সে আজকের দিনটা তার জীবনের খাতা থেকে মুছে দিত। ইহুদী দর্জিকে ট্রাউজার বেচে দেওয়া থেকে শুরু করে জনবহুল মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে একশো পেঙ্গোর নোট দিয়ে ফল কেনা… ধুসস, যত ভুলভাল ব্যাপার। দৃশ্যগুলো মনে পড়ামাত্র তার ভীষণ ঘাম হতে শুরু করল। হঠাৎ তার পেট বিদ্রোহ ঘোষণা করল। সে বসে বসেই চারিদিকে তাকিয়ে কোথায় টয়লেট আছে, খুঁজতে লাগল।

সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে গল্প করছে। কেউ কোথাও যাচ্ছে না।

সে উদ্বিগ্ন চোখে খুঁজতে খুঁজতে এক কোণে একটা সবুজ পর্দা দেখতে পেল রেস্তরাঁর কাউন্‌টারের পাশে। সে ধীরে ধীরে উঠে সোজা এগিয়ে গেল সবুজ পর্দাটার দিকে। যাবার পথে একজন ক্যাপ্টেন যে এক মহিলার সঙ্গে ছিল, তাকে স্যালুট করতে হল তার। সবুজ পর্দা অবধি পৌঁছে সে বুঝতে পারল যে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। অবশেষে তার শান্তি হল।

চারটের মধ্যে সে হাসপাতালে পৌঁছে গেল। মিটমিটে হাসি হেসে ছোটখাট চেহারার লেফটেন্যান্ট যাবার জন্য তৈরি হয়ে বসে ছিল। কালো ট্যাঙ্ক ইউনিফর্ম পরে বসেছিল সে। বুকে অনেক পদক ঝলমল করছে। গ্রেক জানে। পাঁচটা। লেফটেন্যান্ট গ্রেককে ডেকে বলল, ‘তোমার বাক্সটা এসেছে।’ লোকটা ওয়াইন আর মাংসের স্যান্ডুইচ খেয়েছে। কাছে দাঁড়ানোতে গ্রেক লোকটার মুখে গন্ধ পেল।

বাহ!... গ্রেক নিজের বিছানার পাশে জানালার দিকে বাক্সটার হাতল ধরে টেনে নিয়ে গেল।

‘হ্যাঁ, ভালো কথা!’ বলে উঠলো লেফটেন্যান্ট… ‘তোমার ব্যাটেলিয়ন জোকারহেলিতেই রয়ে গেছে। তোমার ক্যাপ্টেন তো কোথাও যাবার মত অবস্থায় ছিলেন না। স্মিৎজ রয়ে গেছেন তার সঙ্গে।‘

‘দুঃখিত!’ গ্রেক বাক্সটা খুলতে লাগল।

‘কিন্তু আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে।‘ বলে উঠলো লেফটেন্যান্ট… ‘আমাদের সবাইকে যেতে হবে এখান থেকে। তোমাকেও…’

‘আমাকেও?’

‘হ্যাঁ!’ লেফটেন্যান্ট আবার হেসে উঠলেন। হঠাৎ তার মুখটা খুব গম্ভীর দেখাতে লাগল… ‘পরের কমব্যাট পেট্রোল আসবে এখানে।’

গ্রেকের আবার পেটের মধ্যে কষ্ট হতে লাগল। শ্বাস নেবার সঙ্গে সঙ্গে সে মাংসের স্যান্ডুইচের গন্ধ পেল। গা গুলিয়ে উঠল তার। ক্যানের মাংসের টুকরোগুলোর কথা ভাবলেই তার মাছির ডিমের কথা মনে পড়ে। সে দৌড়ে জানালার কাছে গেল পরিষ্কার বাতাসের জন্য। বাইরে আপ্রিকট ভর্তি একটা গাড়ি যাচ্ছে।

গ্রেক বমি করতে লাগল। অদ্ভুত শান্তি পেল সে বমি করে।

‘ডিনারের জন্য শুভেচ্ছা জানাই!’ চেঁচিয়ে বলে উঠল লেফটেন্যান্ট।


(চলবে)

*ইকে -আইসেন ক্রস (Eisen Cross) লোহার ক্রস পদক নাৎসিবাহিনীর সৈনিকদের সম্মানজনক পুরস্কার।

0 comments: