Next
Previous
Showing posts with label অনুবাদ সাহিত্য. Show all posts
0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৭
অংকুর সাহা 


হৃদয়ের গভীর আবহে নিবিড় অনুভূতির প্রকাশ হল প্রেম -- কাগজে কলমে তাকে রূপ দেয় কবিতা। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে তার প্রবাহ। নিবিড় আকর্ষণের গাঢ় বন্য মধু, গ্রামের দোকানে তার খোঁজ করে লাভ নেই, তাকে তুলে নিয়ে আসতে হবে চাক ভেঙে, পথে থাকবে বাধা-বিপত্তি, কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হবে পা, তীব্র চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে পশুরাজ সিংহ, তাকে ভয় পেলে চলবে না। প্রেমের জ্বলন্ত অঙ্গারে পুড়ে যেতে পারে দুহাত, কিন্তু সেই যন্ত্রনাটায় রয়েছে মুক্তির স্বাদ, মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রিক সার্কিটে তা পৌঁছে দেবে অনির্বচনীয় তাপ ও আলোক। দহনের অন্তহীন পুলক অথবা একাকিত্বের নৈর্ব্যক্তিক শান্তি -- এই দুই এর মাঝে-ই কেটে যায় মানব জীবন।

এই কিস্তিতে আপনাদের সামনে উপস্থিত আরও আটজন কবি -- চারজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের; বাকিরা এসেছেন চেকোস্লোভাকিয়া, জাপান, কানাডা এবং আয়ারল্যান্ড থেকে। একজন নোবেলজয়ী, অন্য একজন ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন না বলে অনেকেই হতাশ -- এমন তাঁর গদ্যের অভিঘাত স্বাধীন ও চিন্তাশীল মানুষের মনে। বিষম এবং সমলিঙ্গের দয়িত-দয়িতার পানে ধেয়ে যায় তাদের সকল ভালোবাসা। 

চেকোস্লোভাকিয়া নামক দেশটির বিবেক ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট। তাঁর চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল দেশটি -- অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের বোহেমিয়া প্রদেশে তাঁর জন্ম। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে যখন দেশটির জন্ম হয়ে, তাকে উদ্দেশ করে লেখা তাঁর প্রথম কবিতাটি। চোখের সামনে দেখেছেন অত্যাচার -- প্রথমে নাৎসি জার্মানির, পরে স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ার। তার নয় দশকের জীবনে রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার অন্ত ছিল না। তবু তিনি হাল ছাড়েননি -- প্রেম ছিল তাঁর অবলম্বন, ঘৃণা নয়। “A poem is not a phantasm, but a difficult and inconsiderable achievement like a workman’s labor.” -- তিনি লিখেছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায়।

মে সোয়েনসন প্রেমের কবিতা লিখেছেন সারাজীবন। প্রেম তাঁর কাছে, “Thick, concentrated, transparent amber that you bring home, the sweet that burns.” সাহিত্য-সমালোচক এবং “অজর-অমর-অধ্যাপক” হ্যারল্ড ব্লুমের (১৯৩০-২০১৯) মতে তিনি বিংশ শতাব্দীর এক প্রধান ও মৌলিক কবি। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে অকালমৃত রবার্ট কেনেডির শেষকৃত্য উপলক্ষ্যে তিনি লিখেছিলেন এক মর্মস্পর্শী কবিতা। ধরার প্রতিটি অবয়বের ভেতর তিনি প্রেম ও কবিতার সন্ধান পান, যা “spotted, original, spare and strange.” ফুলের ওপরে বসে থাকা প্রজাপতিও তাঁর কবিতায় রতিক্রয়ার শিহরণ আনে।

মুৎসুও তাকাহাশির সংকলিত কবিতাটি তাঁর একুশ বছর বয়েসে লেখা। তিনি পুরুষাঙ্গের একনিষ্ঠ পূজারী, তাঁর সেই একটাই ঈশ্বর -- তিনি বিশ্বাস করেন না যে প্রতিটি পুরুষ শিশু বালক থেকে কিশোর থেকে বলিষ্ঠ যুবকে পরিণত হবে, তার জীবন দর্শন হয়ে উঠবে নারীর দেহ, সমুদ্রের অতল থেকে তাকে সেঁচে তুলে আনতে হবে সুখ, নারীর যোনির অতলস্পর্শী গভীরতায় নিহিত থাকবে তার অন্তর্দৃষ্টির নিগূঢ়তা। গতানুগতিকের চেয়ে ভিন্ন তার কবিতা। ৪২ দিনের জন্যে তিনি নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে এসেছিলেন ১৯৭০ এর দশকে, জাপানে ফিরে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার তাপে লেখেন একটি নোবেল: নভেলা “পুণ্য তীর্থের কাহিনী”। 

পূর্ব ইওরোপের অপরূপ সাহিত্যসম্ভার ইংরেজি ভাষার পাঠক-পাঠিকার কাছে তুলে আনছেন চার্লস সিমিক গত পাঁচ দশক জুড়ে, তাঁর প্রকৃত নাম দুসান সিমিক। তিনি অনুবাদ করেছে ইভান লালিচ, ভাস্কো পোপা, টমাস সালামুন, নোভিকা তাদিচ, গুন্টার গ্রাস ও আরও অনেকের কবিতা। তাঁর স্বরচিত কবিতার বইয়ের সংখ্যাও তিরিশ পেরিয়েছে। “স্তন” কবিতাটির জন্যে তিনি বিখ্যাত। 

মার্গারেট অ্যাটউড জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। নারীবাদী ও প্রতিবাদী লেখক তিনি। নারী-স্বাধীনতা বিহীন এক ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যৎ সমাজের দু:স্বপ্ন দ্যাখেন তিনি। বেশ কিছু ভালো কবিতাও লিখেছেন তিনি, কিন্তু সেই তুলনায় পাঠকের মনোযোগ পান নি।

ইমন গ্রেনান তাঁর রচিত প্রতিটি বাক্যকে কবিতা ও গদ্য হিসেবে শক্তিশালী করে তুলতে আগ্রহী। কবিতার লাইন হবে দাঁতের যন্ত্রণার মতো, তা থামবে না কোনোদিন, আর থামলেও তার রেশ থেকে যাবে, অথবা বার বার ফিরে আসার ভয়।

টয় ডেরাকোট কবিতা ও গদ্য লেখেন কঠিন অথচ সর্বজনীন বিষয় নিয়ে: রাজনীতি, হিংসা, জাতিবিদ্বেষ, মাতৃত্ব, অথবা লিঙ্গ-সমতা।

রবার্ট হাস ক্যালিফোর্নিয়ার কবি, প্রাবন্ধিক। আমেরিকার পশ্চিম উপকূল তার সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য আর ভূমিকম্প সমেত তাঁর কবিতায় জীবন্ত; “A lyrical virtuoso who is able to turn even cooking recipes into poetry".

এই কবিদের সবার ভেতর একটি একটি বিষয়ে মিল: তাঁরা প্রেমের কবিতা লেখেন। আসুন এবার সেই কবিতাগুলি পড়ি:

ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট (চেকোস্লোভাকিয়া, ১৯০১-১৯৮৬)


নারী বিষয়ক সংগীত

নগরপ্রান্ত ছুঁয়ে নদীটি বয়ে যায়,
সাতটি সেতু তার গায়ে শোয়;
হাজার সুন্দরী হাঁটে নদীর তীরে 
কেউই কারো নয় সদৃশ।

হৃদয় থেকে তুমি হৃদয়ে যাও ছুটে 
প্রেমের আগুনে হাত সেঁকে নাও; 
হাজার সুন্দরী হাঁটে নদীর তীরে 
সকলেই সকলের সদৃশ।


দর্শন 

বিজ্ঞ দার্শনিকেরা বলেন 
জীবন এক মুহূর্তমাত্র।
কিন্তু বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে 
মনে হয় অনন্তকাল।

[এখন আর দেশটির অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাউকে যদি চেকোস্লোভাকিয়ার জাতীয় কবির অভিধা দিতে হয়, তিনি হবেন ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট। ১৯৮৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার -- “For his poetry which endowed with freshness, sensuality and rich inventiveness, provides a liberating image of the indomitable spirit and versatility of man.” চেক ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ইওয়াল্ড ওসার্স এবং ডেনা লোয়েইর।]

মে সোয়েনসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১৩-১৯৮৯)


প্রেম হ’ল 

হীরকখণ্ডের বর্ষণ 
হৃদয় নন্দনবনে 

আত্মার ফলটিকে 
কেটে দু টুকরো করা 

আলোকের ওষ্ঠ থেকে 
গাঢ় বসন্তের আগমন 

মাটির নিচের জল 
সূর্যের কিরণে নির্মিত ফাটল বেয়ে 

বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে
আনন্দে ঝিলমিল 

পাথর নয়, মেঘ দিয়ে 
বানানো মন্দির 

হৃদয়ের যত গর্জন ও 
সব হিংসার থেকে দূরে 

উন্মাদনাহীন শূন্যতার 
নেহাইতে পেটানো এলাকার বাইরে 

পরিবর্তনশীল শস্যদের ফাঁকে ফাঁকে 
নীল স্থায়িত্ব 

উত্তম জমিতে 
এক সংক্ষিপ্ত পদক্ষেপ 

রুটিতে দ্বিতীয়বার কামড় 

[মার্কিন সমকামী কবি, সাংবাদিক, সম্পাদক ও নাট্যকার। এগারোটি কাব্যগ্রন্থ। সতীর্থ কবি রিচার্ড উইলবার (১৯২১-২০১৭) এর মতে, “Her poems find the erotic in all form of natural energy, and whether they speak of nebulae or horses or human love, are full of a wonderfully straightforward and ebullient sexuality.” সুইডেনের কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার এর কবিতার প্রথম ইংরেজি অনুবাদক। কবিতা লিখেছেন আটশো’র বেশি, প্রকাশিত হয়েছে তার অর্ধেক। তাঁর সব কবিতাই পৃথিবীকে লেখা প্রেমপত্র। জীবনকে ভালোবাসেন তিনি, তার কবিতা তাঁর কবিতা জীবনযাপনের তীব্র উৎসব। কবিতাটি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত “মে সোয়েনসনের প্রেমের কবিতা” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

মুৎসুও তাকাহাশি: (জাপান, ১৯৩৭- )

মিনো

মিনো
বৃষ আমার
তোমার হাঁটু ছোঁয়ার আগেই
সই পাতিয়েছি তোমার সঙ্গে
তোমার শক্তপোক্ত পা পেয়ে উঠেছি 
আর তোমার বাঁকা চাঁদের মতো শিঙের 
ফাঁক দিয়ে দেখেছি দূরের সমুদ্র 
মাঠের পর মাঠ দাউদাউ হাওয়ায় 
একসঙ্গে দৌড়েছি আমরা 
শূন্যে গুঁতোয় তোমার শিঙ 
বাতাসে ওড়ে আমার দীর্ঘ কেশ 
রাতে ঘুমোই আমরা আলিঙ্গনে 
উদরে উদর, উরুতে উরু 
ভয়ঙ্কর সূর্যোদয় না হওয়া অব্দি 

[জাপানের এই প্রধান কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মেজাজে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক। সমকামী যৌনকামনা তাঁর সাহিত্যের এক মুখ্য উপাদান। কথাসাহিত্যিক ইউকিও মিশিমা’র (১৯২৫-১৯৭০) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ। পৃথিবীর নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর রচনা। চল্লিশটির বেশি কাব্যগ্রন্থ। কবিতাটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “মিনো, আমার বৃষ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ হিরোয়াকো সাতো।]


চার্লস সিমিক: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩৮- )

স্তন 

আমি স্তন ভালোবাসি,
টসটসে নিটোল স্তন,
একটি নির্জন বোতামের পাহারায়।

রাতের বেলা তারা আসে।
পৌরাণিক পশুকথামালা
তাদের দলে একশৃঙ্গ অশ্ব
বাইরেই থেকে যায় তারা।

সূর্যোদয়ের এক ঘন্টা আগের 
পুব আকাশের মতো মুক্তোখচিত,
পরশপাথর ছুঁইয়ে জ্বালানো 
গনগনে দুই উনুন 
তাদের দিকে মন দেওয়া উচিত।

তাদের বৃন্ত থেকে ঝরে 
অশ্রুত দীর্ঘশ্বাসের বিন্দু,
আমাদের লাল স্কুলবাড়ির মতন আননে 
সুস্বাদু স্বরবর্ণের স্বচ্ছতা আনে তারা।

অন্য কোনোখানে একাকিত্ব 
তার জাবদা খাতায় লেখে 
আর এক বিষণ্ণ নাম, দু:খ এসে 
দু মুঠো চাল ধার চায়।

কাছে এসে পড়ে: পশুর 
উপস্থিতি। খামার বাড়ির বালতিতে 
গরুর দুধ কাঁপে।

আমি নিচের থেকে উঠে এসে 
ছুঁতে চাই সেই কোমলতা, দুষ্টু ছেলে 
যেরকম চেয়ারে ভর দিয়ে 
তাকে থেকে চুরি করে খায় নিষিদ্ধ জ্যাম।
আলতো আমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় 
আলগা হয় বোতাম।
আমার হাতে পিছলে আসে তারা 
সদ্য ঢালা দু মগ বিয়ার।

যে সব মূর্খের তত্ত্বজ্ঞানে স্তনের কথা নেই,
তাদের মুখে থুথু দিই আমি;
রাত জেগে তারা দেখে যায় লোকে 
অথচ ঘরে রয়েছে অপরূপ চাঁদ দুটি..…..

তাদের স্পর্শে আঙ্গুল পায় 
নিজ স্বরূপ, ভূমানন্দ:
তারা কুমারী সাবান, নিষ্পাপ ফেনায় 
হাত ধুয়ে নিই আমরা।

ডিমের কুসুমে ভেজানো পালকের মতন 
কুর্নিশ করে আমার জিভ,
নরম রুটির মতন তাদের চেটে 
সম্মান জানিয়ে।

আমি জোর গলায় বলি:
কাঁকাল অব্দি নগ্ন নারী 
পৃথিবীর প্রথম ও শেষ অলৌকিক ঘটনা।

যে বুড়ো দারোয়ানটা তার মৃত্যুশয্যায় 
দাবি করেছিল পত্নীর নগ্ন স্তন 
শেষবারের মতন 
পৃথিবীর সেরা কবিদের একজন সে।

হে মধুর হ্যাঁ, হে মধুর না 
দ্যাখো, সারা পৃথিবী নিদ্রামগন।

এখন, সময়ের অন্তহীন স্থিরতায় 
হে আমার প্রিয়, কোমর জড়িয়ে 
কাছে টেনে নিই তোমায়, আর 

প্রতিটি স্তনের বৃন্ত 
গাঢ়, ভারী আঙ্গুল হয়ে 
ঝরে যাক আমার 
নিদ্রালু ঠোঁটের মৌচাকে।

[সার্বিয়ান-মার্কিন কবি এবং সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপক। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯০ সালে কবিতায় পুলিৎসার পুরস্কার পেয়েছেন। তিরিশটি কবিতার বই, দশটি প্রবন্ধগ্রন্থ, পূর্ব ইউরোপের কবিতার অনুবাদের অনেকগুলি গ্রন্থ। “ঘন করে বানানো চিনে ধাঁধার বাক্স” তাঁর কবিতা।]

মার্গারেট অ্যাটউড: (কানাডা, ১৯৩৯- )

সহবাস 

বিবাহ মানে একটা 
গৃহ নয় এমনকী তাঁবুও নয়

আরও আদিমতর, এবং শীতলতর: 

বনের প্রান্তে কিংবা মরুভূমির 
প্রান্তে 
প্লাস্টার খশা সিঁড়িতে 
পিছনের উঠোনে, উবু হয়ে 
বসি আমরা, পপকর্ন চিবোই 

সরে সরে যাওয়া হিমবাহের প্রান্তে 

যেখানে বেদনা ও বিস্ময় নিয়ে 
বুঝতে পারি অবিশ্বাস্য হলেও 
বেঁচে রয়েছি আমরা 

তারপর চকমকি ঠুকে আগুন জ্বলতে শিখি 

[অনেকগুলি জনপ্রিয় উপন্যাসের পাশাপাশি দু-ডজন কবিতার বই রয়েছে এই কবির। যে কোনো বছর পেয়ে যেতে পারেন সাহিত্যের নোবেল পুরষ্কার। তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত “সেবিকার কাহিনী” (“The handmaid’s Tale”) উপন্যাসে বর্ণিত গা-শিরশিরানো ভবিষ্যতের বিভীষিকা আংশিকভাবে হলেও সত্যি হতে চলেছে আমেরিকায়। উপন্যাসের সিকুয়েল “সুসমাচার” (“The Testament”) প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। কবিতাটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা ১৯৬৫-১৯৭৫” থেকে নেওয়া হয়েছে।]


ইমন গ্রেনান: (আয়ারল্যান্ড, ১৯৪১- )

বার্নার্ডের চিন্তাভাবনা 

তার শয়নকক্ষে থিকথিক করে একাকিত্ব ও যৌনতা: 
কার পা জড়িয়ে ধরে একজনের কাঁধ, কার
উত্তপ্ত হাত পেয়ে যায় একজনের উরু, বাহু
জড়িয়ে ধরে কার পিঠের মসৃন অরাল? সে বলে
আমরা ভুল বুঝি আর দমবন্ধ হয়ে আসে। ভালোবাসতে
পারি না, মিথ্যের ঝুলি খুলে বসি। চেরিগাছের
গোছা গোছা ফল লেগে আছে জানলার কাচে 
ভালো করে আকাশ দেখা যায় না। কামনা আমাদের
ক্ষইয়ে দেয়। এখানেই যাতনারসঙ্গে কামনার সুন্দর মিল
খেয়ে যায়: কার কফিনে আরেকটা পেরেক মারলো?
দাঁড়িয়ে দ্যাখো। নকশি কাঁথার গায়ের ফুলগুলো সমানে
হিসহাস-ফিসফাস করে যাচ্ছে আর যা জানে
সব বলে দিচ্ছে পর্দার গায়ের ফুলগুলোকে।

[কবির জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। সত্তর এর দশক থেকে বাস করছেন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ভাসার কলেজে অধ্যাপনা করেছেন তিন দশক। অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ; নিজেকে আয়ারল্যান্ডের কবি বলেন, মার্কিন কবি নয়। কবিতাটি “দি নিউ ইয়র্কার“ পত্রিকায় প্রকাশিত। ]


টয় ডেরাকোট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

ভগাঙ্কুর 

এবার আমার ভগাঙ্কুর তোমার মুখের মধ্যে নিলে,
আমি ভাববো না যে স্বাদটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না।
পাণ্ডুর শাদা বেরির ওপর থেকে আমি পাটলরঙা গুন্ঠন
সরিয়ে নিই। একা চেয়ে থাকে সে হাজার হাজার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে।
নারীর স্কার্টের ট্যাফেটার মতন আমি তার ত্বকের স্তরগুলোকে
আঙুল দিয়ে সরাই। খুব লাজুক আমার ভগাঙ্কুর, নবীন কিশোরীর মতন 
তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সামিল করতে হয় কামোন্মাদনায়।


প্রৌঢ় বয়েসের রতিক্রিয়া 

আমরা কি এখন অ-
যৌন দম্পতি, একে 
অন্যকে ছুঁই আলতো মৃদু 
মা যেমন শিশুকে ছোঁয় 
তার চেয়েও মৃদু,
আমাদের একজোড়া শরীর 
প্রিয়, প্রিয়, প্রিয় আমাদের হাতে?
তুমি আমায় স্পর্শ করো যেন তুমি জানো 
কোথায় বাস করে আমার প্রতিটি দেহকোষ।
আমি থাকি এখানে ওখানে যেখানে তোমার হাতের 
নিবিড় ছোঁয়া যেমন শিশুর চুলের ভেতর 
মায়ের নি:শ্বাস। তোমার হাত সরে সরে যায় 
আমার কাঁধ থেকে পিঠ হয়ে আমার নিতম্বে,
আমি ভুলে যাই তার মাঝে কী ঘটে গেছে 
হারায় আমার শরীর তোমার দুহাতে,
আমার মন বলে, এইভাবে মৃত কোষগুলো 
পথ হারাচ্ছে কেন, অবহেলায় সরিয়ে দেয় 
ছোটো ছোটো গ্রহগুলিকে? আপাদমাথা নাঙ্গা তুমি 
স্থপতির ডেভিডের মতন, বোঝার ক্ষমতা নেই 
তোমার, হে 

আলোর স্তনবৃন্ত 
আমার জিভের প্রান্তে।

[পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপনা করেন এই আফ্রিকান-আমেরিকান কবি। সাতটি কবিতার বই। আমাদের নির্যাতিত ও বিভাজিত করে যে বিষয়গুলি: জাতি, গাত্রবর্ণ, লিঙ্গ, যৌন নির্বাচন অথবা সামাজিক স্তর -- এ সবের বিরুদ্ধে এক একলা নারীর প্রতিবাদ তাঁর কবিতায়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত “নতুন ও নির্বাচিত কবিতা” কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে তাঁর দুটি কবিতা;]


রবার্ট হাস: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

চল্লিশ পেরিয়ে 

নারীটি আনমনে পুরুষটিকে বলে, “তুমি যদি কখনো
ছেড়ে যাও আমাকে, বিয়ে করো এক তরুণীকে আর বাচ্চা জন্মায় তোমাদের,
আমি ছুরি বসাবো তোমার হৃৎপিণ্ডে।” তারা তখন শয্যায়,
সে স্বামীর বুকে চড়ে বসে, সোজা তাকায় তার চোখে।
বলে, “বুঝতে পেরেছো কী? তোমার হৃৎপিণ্ডে।”


ফ্রিডা কাহলো: থুথুতে 

থুথুতে 
কাগজে 
ছায়ায় 
সব রেখায় 
সব রঙে 
সব মাটির ভাঁড়ে 
আমার স্তনে 
বাইরে ভেতরে 
দোয়াতে -- সৃষ্টির পরিশ্রমে 
আমার দুচোখে বিস্ময় -- সূর্যের 
সীমারেখায় (কোনো সীমানা নেই সূর্যের) আর 
সবকিছুতে। আর কথা বলা বাহুল্যমাত্র, রাজকীয় 
দিয়েগো আমার প্রস্রাবে -- দিয়েগো আমার মুখে -- আমার 
হৃদয়ে। আমার পাগলামিতে। আমার স্বপ্নে -- আমার 
ব্লটিং কাগজে -- আমার কলমের ডগায় --
আমার পেনসিলে -- প্রকৃতির শোভায় -- মুখের 
গ্রাসে -- কঠিন ধাতুতে -- কল্পনায় 
অসুস্থতায় -- কাচের আলমারিতে --
তার জামার কলারে -- তার চোখে -- দিয়েগো --
তার মুখে -- দিয়েগো -- তার সব মিথ্যাচারে।

টীকা: দিয়েগো রিভেরা (১৮৮৬-১৯৫৭) এবং ফ্রিডা কাহলো (১৯০৭-১৯৫৪) মেহিকোর ডাকসাইটে শিল্পীদম্পতি। দিয়েগোর ষ্টুডিও মেহিকো সিটির আসিয়েন্দা স্যান্ আনহেল এর নিকটে -- সেখানে ফ্রিডার হাতে লেখা একটি চিরকুটে এই কবিতাটি দেখে কবি সেটি কপি করেন এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

[ক্যালিফোর্নিয়ার কবি, তাঁর সারা জীবন কেটেছে সেখানে এবং ক্যালিফোর্নিয়া তাঁর কবিতায় জীবন্ত; বার্কলে শহরে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘকালীন অধ্যাপক। মহাকবি চেসোয়াভ মিউশের বন্ধু ও অনুবাদক। প্রতিবাদী ও পরিবেশবাদী সাহিত্যিক। দুটি কবিতাই ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত “অরণ্যের তলে সূর্য” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

মার্চ ২০২০ [ক্রমশ:]
0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৬

এবারের কিস্তিতে রয়েছে পৃথিবীর সবগুলি মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব: এশিয়া, ইয়োরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ওসিয়ানিয়া। সব মিলিয়ে ছয় মহাদেশের আটজন কবি।

যুগোস্লাভিয়ার কবি ইভান লালিচের শৈশব কেটেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার কালো ছায়ায় -- রাত্তিরে তাঁর ঘুম ভাঙতো জঙ্গিবিমানের প্রচণ্ড আওয়াজে। তাঁর প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু হয় নাৎসি বিমানহানায় বোমার আঘাতে -- “মরচে পড়া সূচ“ কবিতার সেটি বিষয়বস্তু। যুদ্ধ শেষের ঠিক পরেই যক্ষ্মারোগে মারা গেলেন তাঁর মা। বিষণ্ণতার স্মৃতি তাঁর কবিতার সর্বাঙ্গে। স্লাভ ভাষায় লেখা তাঁর মণিমুক্তাগুলি ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন মার্কিন কবি চার্লস সিমিক, যাঁর জন্ম সার্বিয়ায়।

“মৃত্যু এক মহান শিল্প; আমি সেই শিল্পে পারদর্শী,” স্বীকারোক্তি মূলক কবিতায় জোয়ার তুলেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ, কিন্তু তাঁকে গ্রাস করে তাঁর মানসিক বিষাদ। বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চিকিৎসা করেও কোনো উপকার হয়নি। কবি স্বামী তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁর অন্তহীন নৈরাশ্য ঈগলের নখর হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তাঁর হৃদয়। আর উপায় থাকে না দৃঢ় পায়ে আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া।

প্লাথের মতোই আরও দুই অকালমৃতা কবি: ইরানের ফরাঘ ফারোখজাদ এবং আর্হেন্তিনার আলেহান্দ্রা পিসারনিক। ইশ্বরের বিধানে তাঁদের তিরিশের দশক পার হওয়া নিষিদ্ধ। তবে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পঁচাশি বছর পূর্ণ করলেন ফ্লোর অ্যাডকক। তাঁর লেখনী এখনো সক্রিয়।

রাশিয়া এবং আমেরিকা, এই দুই দেশের মাটিতে বসে লেখা কবিতায় পঞ্চাশটির বেশি কাব্যগ্রন্থ ভরিয়ে ফেলেছিলেন ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো -- কিন্তু তার মধ্যেই সময় করে নিয়েছিলেন চার চারটি বিবাহের এবং আরও অসংখ্য নারী সংসর্গের। বর্ণময় ব্যক্তিত্বের প্রতিবাদী কবি।

সারাটা জীবন প্রতিবাদেই কেটেছে ইন্দোনেশিয়ার ডব্লিউ এস রেন্দ্রা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাডাম স্মলের। একজন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আর অন্যজন বর্ণবৈষম্যের। দ্বিতীয়জন জীবৎকালেই দেখে গিয়েছেন বর্ণবৈষ্যমের সমাপ্তি।

আসুন, আরও এক ঝাঁক কবির প্রেমের কবিতা পড়া যাক।

ইভান লালিচ: (সার্বিয়া, ১৯৩১-১৯৯৬)

মেলিসা সনেটগুচ্ছ থেকে

।।১।।

মৌমাছি 

মেলিসা, তোমার তনু মেলে ধরে মৌমাছির ডানা।
হে ভীত পুষ্পের ক্ষীণ গোপনতা, বিশুদ্ধ হুতাশ,
হে আঁখি, হে মেঘমেদুর দ্রাক্ষাফল, পেকে ওঠো,
দূরগামী দৃশ্যকুল, নাড়ি ছেঁড়া শিশুর মতন।

ঈশ্বরকে লজ্জা দেয় অন্ধকারে সোনালি শোণিত,
আমাকে অমোঘ হাতে শাস্তি দিল তার উপস্থিতি,
হে ধ্বনি, জড়িত রক্ত, প্রসারিত হোক তব শাখা 
গভীর গোপনে হোক বিয়োগান্ত নব রূপান্তর।

এমন রক্তের রঙে আঁকা হয় গ্রীষ্মের বিকেল 
দৃশ্যের অদূরে রক্ত ঝরে যায় আলোকের থেকে 
আমার অঙ্গুলি ভাঙে ভয়ঙ্কর অলঙ্ঘ্য দেয়ালে 

কিন্তু সে ভঙ্গুর হস্ত আবার কর্মঠ হতে পারে 
সন্ত্রস্ত মূক আননে অলৌকিক স্বর্গীয় শুভ্রতা 
তবে তনুলতা ছুঁলে, আসলে তা মৌমাছির ডানা।


।।২।।

রুটির গোপনতা 

তোমার গোপন বার্তা শোনাও আমাকে, হে মেলিসা,
যে সুখ আবেশ, তাকে ভালোবাসি, তুমি সেই সুখ।
প্রাগৈতিহাসিক স্তম্ভ ধসে যায় শহরে অন্তরে।
অসংখ্য ভুতুড়ে বাড়ি আমার সত্তায় বাস করে।

আকাশের কালো চাঁদ নি:শব্দে নামিয়ে দেয় ঝুরি
শক্ত স্তরে জমে থাকা বংশগত বিষাদকে ছুঁয়ে,
একশৃঙ্গ অহমিকা, রক্তকেশী মাথা রাগে দোলে 
হতবুদ্ধি বিদ্ধ করে নি:শ্বাসের কৃশ এলাকাকে।
সতত গোপন তুমি, হে মেলিসা, বন্ধুদের ডেকে 
বলে দেব, দিগন্তে পাহাড় কাঁপবে তোমার সোহাগে।
পরিণত গুপ্তকথা, প্রয়োজন তার নি:সন্দেহ,

সমুদ্রের দাঁত ঘিরে বৃত্তের মতন জলধারা,
মহৎ সৃষ্টির পূর্বে সংগোপন নিহিত ভূমিকা,
সীমারেখা স্থির নয় ছত্রাক ছড়ানো পীত রুটি।

[সার্বিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রধান কবি। এগারোটি কাব্যগ্রন্থ। যুগোস্লাভিয়ার লেখক ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন অনেক বছর। ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা থেকে অসংখ্য কবিতার অনুবাদ করেছেন মাতৃভাষায়; স্মৃতি এসে ভিড় করে তাঁর কবিতায়: “Memory: fragile in the face of the collapse of civilisations, but all we have. Memory allows the poet to recreate brief instants of personal joy as well as to conjure up a sense of the distant past. It allows each of us, as individuals condemned to solitude, to connect with a shared inheritance and feel, for a moment, part of a larger whole.’’ স্লাভ ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন চার্লস সিমিক।] 

সিলভিয়া প্লাথ: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩২-১৯৬৩)

চিরকুমারী 

সেদিন, বিশেষ করে সেই মেয়েটি
তার নতুন প্রণয়প্রার্থীর সঙ্গে 
খুব ধুমধামে বেড়াতে গেল বসন্তের বিকেলে 
তারপর হঠাৎ, নিজেকে বাঁধা পড়তে দ্যাখে 
পাখিদের অনিয়মিত কিচিরমিচির 
আর ঝরাপাতার জঞ্জালে।

এই আলোড়নে পীড়িত মেয়েটি 
লক্ষ্য করে তার প্রেমিকের এলোমেলো চলাফেরা,
ঘুচে গেছে তার গতির ছন্দ 
এসেছে ফুল আর লতাপাতার পাগলামি;
সে তাকিয়ে দ্যাখে ফুলের দিশেহারা পাপড়ি,
পুরো ঋতুটাই অসুখী।

তখন শীতের জন্যে তার তীব্র প্রার্থনা!
হিসেবি সাবধানতা চারপাশে ছড়ানো 
বরফ আর পাথরের 
শাদা ও কালো; প্রতিটি ভাবের চতুর্দিকে,
পাড় বসানো আর হৃদয়ের শীতল শৃঙ্খলা 
তুষারপালকের মতন খুঁতহীন।

কিন্তু এখানেই -- উদ্ভিন্ন হয় সে 
বিদ্রোহে, ভালোবাসায় জ্ঞানগম্যি হারায় 
অশ্লীল আনন্দে মাতে --
পৃথিবীতে জন্মানোটাই বেওকুফি; বোকারাই 
ইচ্ছেমতো ডুবে যাক উদ্দাম উল্লাসে;
সে সরে আসে নিখুঁতভাবে।

বিরূপ আবহাওয়ার প্রতিরোধে যেমন 
তার গৃহের চারপাশে সে দেয়াল আর 
কাঁটাতারের বেড়া বাঁধে 
কোনো সাহসীতম পুরুষও তাকে ভাঙতে পারবে না 
শাপশাপান্ত, হুমকি বা ধোলাইয়ের ভয় দেখিয়ে 
এমনকী প্রেম দিয়েও না।

[অকালমৃত কবি, ঔপন্যাসিক ও শিশুসাহিত্যিক। অসম্ভব প্রতিভাবান অথচ মানসিক পীড়াগ্রস্ত। ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয় ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের (১৯৩০-১৯৯৮) সঙ্গে। তিরিশ বছর বয়েসে তিনি আভেনের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে পুরোদমে গ্যাস চালিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় উপন্যাস “বেলজার” (১৯৬৩) এবং কাব্যগ্রন্থ “এরিয়েল” (১৯৬৫)। কবিতাটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া।]

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো: (রাশিয়া, ১৯৩৩-২০১৭)

প্রেমিকা আসবে 

বেলা আখমাদুলিনার জন্যে 

প্রেমিকা আসবে, প্রেমিকা আসবে দ্বারে,
দুহাতে জড়াবে, দুহাতে জড়াবে আমায়, 
দেখবে কেমন পাল্টেছে পরিবেশ,
বুঝবে আমার হৃদয়ের ওঠানামা।

বাইরে আঁধার, বৃষ্টির ঘনঘটা,
খোলা রয়ে যাবে ট্যাক্সির দরওয়াজা,
লাফে লাফে সিঁড়ি একপা, দুইপা, তিন,
উচ্ছ্বাসময়, কামনায় থরোথরো।

কড়া না নেড়েই ঘরে ঢোকে ভেজা মেয়ে,
কোলে তুলে নেয় আমার উপোসি মাথা,
চেয়ারে এলানো নীল রঙা ফার কোট 
মহাসন্তোষে স্খলিত শান্ত মেঝেয়।

টীকা:

বেলা আখমাদুলিনা (১৯৩৭-২০১০): কনিষ্ঠা রুশ কবি, বান্ধবী, সখা, প্রেমিকা। ১৯৫৪ সালে তাঁদের বিয়ে -- একজনের বয়েস একুশ, অন্যজনের সতেরো। পাঁচ বছরের সন্তানহীন বিবাহজীবন।

বেলার একটি বিখ্যাত উক্তি: কবিতা তখনই লিখবে, যখন আর উপায় থাকবে না, না লিখে। না হলে লিখবে না। “If there is a choice, don’t”.

[কবিতার রচনাকাল ১৯৫৬। রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ আলবার্ট সি টড।]


অপেক্ষা

আমার প্রেমিকা আসবে
দুহাত বাড়িয়ে আমাকে ভরে নেবে তাতে,
অনুভব করবে আমার ভয়, লক্ষ করবে পরিবর্তন।
বাইরের ঘন অন্ধকার থেকে, ঘুটঘুটে রাত্তিরে 
ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার জন্যে মুহূর্তটুকুও না থেমে 
ভাঙাচোরা বারান্দা পেরিয়ে হে ছুটবে সিঁড়ি বেয়ে 
ভেতরে জ্বলবে প্রেম আর প্রেমের সোহাগ,
ভেজা পোশাকে উঠে আসবে সে, দরজায় ধাক্কা না দিয়েই 
ঢুকবে আর দুহাত দিয়ে ধরবে আমার দুগাল,
তারপর খেয়াল হলে ওভারকোট খুলে চেয়ারে রাখবে,
কিন্তু তা পিছলে পড়বে নীল স্তূপের মতন।

[রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় জন্ম এই কবির। বাবা ছিলেন ভূতাত্ত্বিক। কবিতা রাজনৈতিক এবং বর্ণনাধর্মী -- কবিতার মাধ্যমে গল্প বলেন তিনি -- নিপীড়িত মানুষজনের কথা। বিতর্ক তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে সবসময়। অনেকগুলি গান রচিত হয়েছে তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে। পঞ্চাশটির বেশি কবিতার বই, তা ছাড়াও উপন্যাস, গল্পসংকলন ও প্রবন্ধগ্রন্থ। দ্বিতীয় কবিতাটি প্রথম কবিতার পুনর্লিখন, কবিতাটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা” থেকে নেওয়া। রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রবিন মিলনার গাল্যান্ড এবং পিটার লিভি।]

ফরাঘ ফারোখজাদ: (ইরান, ১৯৩৪-১৯৬৭)

দম্পতি 

রাত আসে
আর রাত পেরিয়ে অন্ধকার
আর অন্ধকার পেরিয়ে 
চোখ 
হাত 
আর নি:শ্বাসের ওঠা, পড়া, ওঠা, পড়া …….
আর জলের শব্দ 
কল থেকে ঝরে যায় ফোঁটার পর ফোঁটা

তারপর 
দুই লাল আলোর বিন্দু 
দুটি সিগারেট 
ঘড়ি টিকটিক 
আর দুই হৃদয় 
আর দুই নীরবতা 
আর দুই নির্জনতা 

[ইরানের নারীবাদী কবি এবং চিত্র-পরিচালক। তাঁর কবিতা প্রতিবাদ জানায় মানবিক উন্মোচনের মাধ্যমে। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগেই তিনি বিতর্কিত ও সমালোচিত। আয়াতোল্লাহ খোমেইনি ইরানে ক্ষমতা দখল করার পরে তাঁর কবিতা সারা দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন এক দশক। এখন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বহুপঠিত এবং সম্মানিত। কবিতাটির ফার্সি ভাষা থেকে ইংরেজি করেছেন হাসান জাভাদি ও সুসান স্যালি।]

ফ্লোর অ্যাডকক: (নিউজিল্যান্ড, ১৯৩৪- )

সুখী সমাপ্তি 

সঙ্গমের পালা শেষ হলো কি না
প্রেমিকা চাদর টেনে মুখ ঢাকলো
যতক্ষণ না প্রেমিকের জামার বোতাম লাগানো শেষ:
শরীর দেখতে লজ্জা নেই দুজনেরই --
একটু আগেই উদ্দাম হয়েছিল যারা -- এখন
ক্ষমা চাওয়ার দুর্বল প্রচেষ্টা।

এরকম অপরিচ্ছন্ন কাজকর্মে ঘৃণা তাদের
তবু তারা কয়েকদিন পরে আবার দেখা করতে রাজি হয়,
কারণ এই ঘৃণা থেকেই তাদের আকর্ষণ, তখন
হাতে হাত রেখে খুনসুটি, স্মৃতিচারণ
আবার ঘনিয়ে ওঠে শরীরী প্রেম --
আর হয় না অনুকূল পরিণাম, 
অথবা বন্ধুত্ব।

[নিউজিল্যান্ডের কবি, কিন্তু অনেক দশক বাস করেছেন ইংল্যান্ডে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি শিক্ষক এবং গ্রন্থাগারিকের কাজ করেছেন। নিউজিল্যান্ডের দুই বিখ্যাত লেখকের তিনি সহধর্মিনী। ভূষিত হয়েছেন দুই দেশের নানান পুরস্কারে। দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং মানবসম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতাটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা” থেকে নেওয়া হয়েছে।]

ডব্লিউ এস রেন্দ্রা: (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩৫-২০০৯)

বধূর জন্যে ঘুমপাড়ানি গান 

মেঘ ঝাঁকায়, বৃক্ষ দোলে,
পরিরা উড়ে যায় ডালপালার ফাঁকে:
নির্মল ঘন্টা বাজে দূরে।

আনন্দিত নির্জনতা, মধুর কামনা,
নেশার মত বাসনা, অভিলাষের ধূলি:
আমার বুকে মাথা রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

রক্ত লাল আকাশ, পত্রপুষ্পও গাঢ় লাল,
হৃদয় দোলে গাছের লালচে পাতায়
মন্ত্রের উচ্চারণে বাতাস ভারী।

নবীন স্বপ্ন, চাঁদের মতো স্মৃতিরা,
প্রেমের ব্যথা, উজ্জ্বল, ঝলমলে বিষাদ:
আমার বুকে স্বপ্ন রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

পৃথিবীর ঘুম ভাঙে,
দু:খ গলে গলে যায়:
আমি হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিই তোমায় 

নীরবতা আর ঘুম, ঘুম আর নীরবতা।
নীরবতাহীন মৃত্যু, মৃত্যুহীন নিদ্রা। 
আমার বুকে দু:খ রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

[উইলিব্রোদাস সুরেন্দ্রনাথ রেন্দ্রা ইন্দোনেশিয়ার কবি, নাট্যকার, অভিনেতা, সমাজকর্মী। জন্মসূত্রে ক্যাথলিক, কিন্তু ধর্মান্তরিত হন ইসলামে। সুহার্তো সরকারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য খাতায় তাঁর নাম উঠেছে কয়েকবার। ভাষা ইন্দোনেশিয়া থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন বার্টন রাফেল।]

আলেহান্দ্রা পিসারনিক: (আর্হেন্তিনা, ১৯৩৬-১৯৭২)

চিহ্ন 

সবাই সঙ্গম করে নীরবে
তারা নীরবতার প্রতিশ্রুতি দেয় 
আগুনের মতন, ঘরভরা নীরবতা 

হঠাৎ মন্দির হয়ে দাঁড়ায় সার্কাস 
আলোকের ঢাক বাজে।

যৌনতা, নিশীথ 

আবার একবার, কেউ পড়ে যায় তার প্রথম পতনে -- দুই নগ্ন শরীরের পতন, দুটো চোখের, অথবা চারটে সবুজ চোখের অথবা আটটা সবুজ চোখের, যদি আমি আয়নার ভেতরে জন্মানো চোখগুলোকেও ধরি (মধ্যরাতে, বিশুদ্ধতম ভয়ে, সব হারাবার বিষাদে), তুমি চিনতে পারোনি তোমার নিজের অনুভূতিহীন নীরবতার কণ্ঠস্বর, চোখের সামনে ধরে তোমার নিজের পাগলামির অবকাশে লেখা পার্থিব বার্তাসমূহ, তোমার দেহ যেন একটা গেলাস, এবং নিজেদের আর অন্যান্যদের গেলাস থেকে আমরা পান করি এক অসম্ভব পানীয়।

অভিশপ্ত আসবের মতন অভিলাষ ছলকে পড়ে আমার দেহে। আমার এই তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণায়, তোমার চোখের প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাঁচবো কী করে আমি? আমি যা কিছুর কথা বলি, তারা কোনোমতেই এই পৃথিবীর না। আমি এমন কিছুর কথা বলি, যার অভিপ্রায় রয়েছে অন্য কোনোখানে।

অন্তহীন শুভ্র নিশীথের স্মৃতিতে নগ্ন হয়েছি আমি। আত্মহারা, বিভোর, আর আমি রাত ভরে মেতে থাকি নিবিড় সঙ্গমে, কামুক কুকুরের মতন।

কখনও কখনও একই রাতের অবকাশে, বাস্তবের আতিশয্য আঘাত করে আমাদের। পোশাক ছেড়ে ফেলে, আতংকিত আমরা। আরশির কঠোর পর্যবেক্ষণে কুন্ঠিত আমরা, বুঝতে পারি আমাদের ক্রন্দন, আমাদের গভীর ক্ষত জন্ম নেবে আরশির থেকে।

নিশীথ নিজেকে মেলে ধরে কেবল একবারই। তাই সই। তুমিও দেখো। তুমি তো দেখেছই। দুজনে একান্তে থাকার যে ভীতি, আরশির ভেতর হঠাৎ আমার চারজন। আমরা কাঁদি, আমরা চোখের জল ফেলি, আমাদের ভীতি, আমাদের আনন্দ যা আমাদের ভীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর, আমার অশ্লীল চিৎকার, আমার মুখের অপশব্দেরা আমাদের যুগলকে চাবিবন্ধ করে দেয় আরশির ভেতর, কিন্তু কখনও আমাকে একা নয়। আমি জানি এই নিশীথের প্রকৃতি। আমরা পুরোপুরি তার চোয়ালের ভেতর বন্দী, এতটা গভীরে যে তারা অনুধাবন করে না এই ত্যাগস্বীকার, আমার সবদেখা চোখদুটোর এই অপবাদ। একটা আবিষ্কারের কথা না বলে পারিনা: বুঝতে পেরেছি, সঙ্গমের ভেতর আমি আর আমার ভেতরে সঙ্গম। এক মুহূর্তের ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে আমি জীবনভর ভয়ের কথা বলে যাই। অনুপস্থিতির গহ্বর। কিন্তু কে বলবে: সারা রাত কেঁদোনা? সব পাগলামি আসলে মিথ্যে। যেমন নিশীথ। যেমন মরণ।

[এসপানিওল ভাষা থেকে প্রথম কবিতার অনুবাদ করেছে সুসান বাসনেট। ফরাসি ভাষা থেকে দ্বিতীয় কবিতার অনুবাদ করেছেন পাত্রিসিও ফেরারি।] 

[আর্হেন্তিনার অকালমৃত কবি। মৃত্যুর পরে প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়েও পাঠক মহলে জনপ্রিয়। এখনো প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতা, গদ্য, ডায়েরি এবং তাদের নতুন নতুন ইংরেজি অনুবাদ। সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক এই কবি জাতিতে রুশ, ধর্মে ইহুদি আর জন্ম আর্হেন্তিনায়। কলেজে ঢোকার এক বছর পরে প্রথম কাব্যগ্রন্থ: “স্থলভূমি পেরিয়ে” (“লা তিয়েরা মাস আহেনা”, ১৯৫৫)। দর্শনের পড়া শেষ না করেই আর্ট কলেজে শিক্ষা শুরু করেন। পরের বছর আরো একটি কাব্যগ্রন্থ: “অন্তিম অপাপবিদ্ধতা” (“লা উলতিমা ইনোসেনসিয়া”, ১৯৫৬)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ তিনি বাস করেন প্যারিসে, সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন, সময় কাটান বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে। ফরাসি মহিরূহদের কবিতা অনুবাদ করেন এস্পানিওল ভাষায়-- এমে সেজেয়ার, আন্তোনিন আরতো, ইভ বনেফয়, প্রমুখ। দেশে ফেরার পর আরো তিনটি কবিতার বই এবং দেশজোড়া খ্যাতি। ১৯৬৯ সালে গুগেনহাইম ফেলোশিপ, ১৯৭১ সালে ফুলব্রাইট জলপানি -- দুটি ঈর্ষণীয় সম্মান। কিন্তু পরের বছর গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্লিনিকে বন্দী। শরীর একটু ভালো হলে তাঁকে শনি-রবিবার বাড়ি আসতে অনুমতি দেওয়া হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, তিনি বাড়িতে “সেকোনাল” নামক ঘুমের বড়ি প্রচুর পরিমাণে খেয়ে আত্মহত্যা করেন।]

অ্যাডাম স্মল: (দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৩৬-২০১৬)

আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে 

তারা প্রেমে পড়লো 
তারা প্রেমে পড়লো
তারা প্রেমে পড়লো

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
আইনের কী হবে রে?
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
আইনের কী হবে রে?
জনগণ সবাই বললে 
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা বলে, মার্টিন বলে 
কার আইন?
খোদার আইন 
মানুষের আইন 
শয়তানের আইন 
কার আইন?

কিন্তু লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে

তারা জেলে গেল 
তারা জেলে গেল 
তারা জেলে গেল 

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের
জনগণ সবাই বললে 
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের

ডায়ানা বলে, মার্টিন বলে
কী কয়েছিলে তোমরা?
কী কয়েছিল খোদা 
কী কয়েছিল মানুষ 
কী কয়েছিল শয়তান 
কী কয়েছিলে তোমরা?

কিন্তু লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে

ডায়ানা গলায় দড়ি দিল 
মার্টিন গলায় দড়ি দিল 
দুজনেই গলায় দড়ি দিল 

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
খোদা রক্ষে করো 
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
খোদা রক্ষে করো 
জনগণ সবাই বললে
খোদা রক্ষে করো 

ডায়ানা ও মার্টিন আইন ভেঙে মরলো 
খোদার আইন 
মানুষের আইন 
শয়তানের আইন 
কার আইন?

আর লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

[দক্ষিণ আফ্রিকার কবি, নাট্যকার, সমাজসেবী; ইংরেজি এবং আফ্রিকানস, দুই ভাষাতেই লেখেন। শ্বেতকায় সরকারের বর্ণবৈষ্যমের বিরোধিতায় তিনি ছিলেন অনমনীয়। তাঁর লেখা নাটকের অভিনয় দেশের সব রঙের চামড়ার মানুষ একসঙ্গে বসে দেখুক -- এই নিয়ে লড়াই করে সফল হয়েছিলেন তিনি। আফ্রিকানস (Afrikaans) ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্যারল লাস্কার।]

[ক্রমশ:]
0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৫

এবার আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করি নয় জন কবিকে যাঁরা বিষয়বৈচিত্রে ও মেজাজে বিভিন্ন মেরুর অধিবাসী। একজন নোবেলজয়ী, আরেকজনের এখনো সম্ভাবনা রয়েছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের।

মায়া অ্যাঞ্জেলু কালো আমেরিকার এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব -- শিল্প ও সাহিত্যের নানান প্রান্তে তাঁর আনাগোনা। কালো মানুষের সমানাধিকার তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তিনি শিল্পিত করে তুলতে পারেন প্রতিবাদের প্রকাশকে।

ডোনাল্ড হল সিরিয়াস কবিতা লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু সমসাময়িক বাঙালি কবি তারাপদ রায়ের মতন তাঁর রচনাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কৌতুক আর হাস্যরসের উপাদান।

জয়েস মনসুর ফরাসি সাহিত্যের এক দিকচিহ্ন, কিন্তু ইংরেজী ভাষার কবিতার পাঠক তাঁর সঙ্গে পরিচিত নন। তাঁর এক ডজনের বেশি কাব্যগ্রন্থের একটিও অনূদিত হয়নি ইংরেজিতে। তাঁর কবিতা পড়তে হলে ফরাসি কবিতার কয়েকটি ইংরেজি সংকলনই আমাদের ভরসা। পরাবাস্তববাদী কবিতা আন্দোলনের তিনি এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

এড্রিয়েন রিচ বাস করতেন আমাদের শহর থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে। তাঁর কবিতা পাঠ শুনতে গিয়েছি কয়েকবার, তবে মুখোমুখি পরিচয় হয়নি। ফোনে কথা বলে অনুমতি নিয়েছিলাম কবিতা অনুবাদের।

ইউরোপের কবিতার নিবিষ্ট পাঠকপাঠিকার কাছেও ওলন্দাজ ভাষার কবিতা অপরিচিত। হিউগো ক্লাউস সেই ভাষার এক মহীরুহ সাহিত্যিক। হাজার হাজার পৃষ্ঠার কবিতা, ষাটটি নাটক, কুড়িটি উপন্যাস, চিত্রনাট্য, অপেরা: কী আর লেখেন নি তিনি? আর রোমান-ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে দ্বন্দ্বে মেতেছেন নিয়মিত। খুব সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব।

আদনিস মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের এক প্রধান স্তম্ভ। তিনি আরবি ভাষাকে নতুন রূপ দিয়েছেন এবং তার কবিতাকে টেনে হিঁচড়ে এনে হাজির করেছেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতায়। নব্বই বছর বয়েসে এখনো তিনি সক্রিয়, প্রতিবাদী।

ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা দীর্ঘ, জটিল, দুরূহ এবং আদায় করে নেয় পাঠকের সমীহ ও অনুধাবন। তাঁর প্রেমের কবিতা কিন্তু সরাসরি আঘাত করতে সমর্থ হয় হৃদয়ে, সেখানে তীব্র অনুভূতির প্রকাশ।

টেড হিউজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজি ভাষার এক প্রধান কবি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর আচরণ নিয়ে অভিযোগ তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে, অসমাপ্ত রাখতে হয়েছে কবিতার কাজ।

চিনুয়া আচেবে আফ্রিকার কালজয়ী কথাকার -- সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর। তাঁর শীর্ণকায় “কবিতা সমগ্র” এর মধ্যেও রয়েছে কিছু শক্তিশালী কবিতা।

সাহিত্যে ও জীবনযাপনে, জীবনদর্শনে ও রাজনৈতিক ভাবনায় যতই তফাৎ থাক, এই কবিদের ভেতর একটাই মিল -- তাঁরা প্রেমের কবিতা লিখেছেন।

আসুন, আজকের পৃথিবীজোড়া হিংসা, জাতিভেদ, বর্ণভেদ আর হাড়হিমকরা ফ্যাসিবাদের দিনগুলিতে বাস করেও নতুন বছরকে স্বাগত জানাই কয়েকটি অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা পড়ে: 

মায়া অ্যাঞ্জেলু: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৮-২০১৪)

অনেকে এবং আরো 


অনেকে এবং আরো যারা আছে
চুম্বন করবে আমার আঙুলের প্রান্ত,
চেখে দেখবে আমার ঠোঁট,
আর আমার একাকিত্ব ঘোচাতে 
মেলে ধরবে তাদের উষ্ণ শরীর।

কিন্তু আমার চাই পরম বান্ধব। 

আরো, খুব কম দুয়েকজন রয়েছে,
যারা আমায় নিজের বংশমর্যাদা দেবে,
দেবে তাদের অর্থসম্পদ,
আমি অসুস্থ হলে শয্যাপ্রান্তে 
পাঠাবে তাদের প্রথম সন্তানকে।

কিন্তু আমার প্রয়োজন পরম বান্ধব।

পৃথিবীতে একজন, কেবল একজনই আছে 
যে তার নিভে আসা ফুসফুস থেকে 
বিনা দ্বিধায় অক্সিজেন ধার দেবে 
আমার ছিন্নভিন্ন বুকের জ্বালা মেটাতে।

এবং সে হল আমার প্রেম।

[কবির প্রকৃত নাম মার্গারিট অ্যান জনসন। কবি, নাট্যকার, মঞ্চশিল্পী, অভিনেত্রী, গায়িকা, চিত্রপরিচালক। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পৃথিবীখ্যাত কবিতার বই “আমি জানি খাঁচার পাখি কেন গান গায়?”। ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারী তিনি রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন স্বরচিত কবিতা “সকালের স্পন্দন”। আত্মজীবনী লিখেছেন সাত খণ্ডে। সংকলিত কবিতাটি ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “আমি নড়বো না” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

ডোনাল্ড হল: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৮-২০১৮)

ভ্যালেনটাইন 

কাঠবেড়ালি লাফায় ডালে,
পিছলে চলে সাপ।
তোমায় ছেড়ে যাবার কথা 
মনে ভাবাও পাপ।

ঝগড়া করে নীলপাখিরা,
ভালুক দেখায় পেশি।
তোমার সঙ্গে চিরজীবন 
অথবা তার বেশি।

লাফিয়ে চলে ব্যাঙ-ব্যাঙাচি 
শূকর গুরুভোজন।
কান দিই না কারুর কথায় 
দুজন মিলে কূজন।

[মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাহিত্য সমালোচক, শিশু-সাহিত্যিক। “দি প্যারিস রিভিউ” পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করেছেন প্রায় এক দশক। প্রকাশিত গ্রন্হের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি, তার মধ্যে বাইশটি কবিতার বই। সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার নানান নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে; কবিতাটি “দি নিউ ইয়র্কার” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।] 

জয়েস মনসুর: (মিশর ও ফ্রান্স, ১৯২৮-১৯৮৬)

উপগত 

তোমার সঙ্গে শুতে চাই পাশাপাশি
চুলোচুলি করবে আমাদের কেশগুচ্ছ 
আমাদের যৌনাঙ্গ সংঘবদ্ধ 
তোমার ঠোঁট আমার বালিশ।

তোমার পিঠে পিঠ রেখে শুতে চাই 
কোনো নি:শ্বাসও বিচ্ছিন্ন করবে না আমাদের 
ভালোবাসায় বাগড়া দেবে না কোনো কথা 
মিথ্যে বলবে না চোখের দৃষ্টি 
গায়ে থাকবে না একটি সুতো।

তোমার বুকে স্তন রেখে শুতে চাই 
উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত 
হাজার কাঁপুনিতেও ঝকমকে 
পুলকিত পাগলামির আবেশে নি:শেষ 

তোমার ছায়াতে আমি ছড়ানো 
তোমার জিভের আঘাতে আমি ব্যাকুল 
খরগোশের পোকাধরা দাঁতের কামড়ে 
মরলেও আমি সুখী।

[কবির জন্ম ইংল্যান্ডে, মা-বাবা মিশর থেকে আসা অভিবাসী ইহুদি; লিখতেন ফরাসি ভাষায়। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরাবাস্তববাদী শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলনে। ষোলোটি কাব্যগ্রন্থ, তার সঙ্গে প্রবন্ধ ও নাটক। প্যারিস শহরে তাঁর এপার্টমেন্ট হয়ে উঠেছিল পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। মাত্র আটান্ন বছর বয়েসে কর্কটরোগে মৃত্যু। কবিতাটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত “কান্না” কাব্যগ্রন্থ থেকে। ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ মেরি অ্যান ক’স।] 

এড্রিয়েন রিচ: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৯-২০১২)

তোমার স্তনের ওপর উড়ন্ত আমার মুখ 

তোমার স্তনের ওপর উড়ন্ত আমার মুখ 
শীতের ছোট্ট ধূসর বিকেল 
এই শয্যায় আমাদের একহারা তনু 
স্পর্শে বিহ্বল উত্তেজনার আনন্দময় তাপে হতবাক 
দৃঢ় অথচ কোমল একে অপরকে ঘিরে 
বাহুবন্ধনে খেলি আমরা দিবসের মোমবাতি 
অদ্ভুত আলো জ্বেলে যদি বাইরে ধরায় 
তুষার পড়তে শুরু করে গাছের ডালপালা সরিয়ে
দিন ফুরিয়ে রাত আসে জানান না দিয়ে 
চলবে আমাদের শীতের প্রমোদ 
হঠাৎ উদ্দাম ও কোমল তোমার অঙ্গুলি 
যেখানে থাকা উচিত আমার জিভের যা করা উচিত 
এক মুহূর্ত থেমে তোমার রসিকতায় হাসি 
হে প্রেম তোমার উষ্ণ সুগন্ধ শীতের কামনায় 

[নারীবাদী কবি ও সাহিত্যিক। শিকাগোর “পোয়েট্রি” পত্রিকা এক লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের “রুথ লিলি কবিতা পুরস্কার“ প্রদান শুরু করে ১৯৮৬ সালে; প্রথমবার পুরস্কারটি পান তিনি। ১৯৫৩ সালে তার বিবাহ এবং তারপর তিনটি পুত্রসন্তান। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় নারীবাদী ভাবনার গ্রন্থ “বৌমার তোলা ছবিগুলি”। পরবর্তী জীবনে নিজেকে লেসবিয়ান বলে ঘোষণা করেন; কথাসাহিত্যক মিশেল ক্লিফের সঙ্গে তাঁর ছত্রিশ বছরের দাম্পত্যজীবন ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুস শহরে। কবিতাটি ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “এজমালি ভাষার স্বপ্ন” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

হিউগো ক্লাউস: (বেলজিয়াম, ১৯২৯-২০০৮)

গ্রীষ্ম 

হঠাৎ অই তিন মাস ধরে 
খরা খরা খরা।

সাইপ্রেস ঝোপ রোদে পুড়ে লালচে, 
শাদা বিষহীন কাঁকড়াবিছে।

চারিদিকে কাগজ পোড়ে।
বকবক করে যায় প্রকৃতি 
আমি পচি।

তারপর, তোমার সঙ্গে দেখা 
এবং তখন থেকেই 
হাত ও চোখের মনোযোগ এলোমেলো 
আর কথা বলতে চায় না আমার জিভ।


ভালোবাসো অথবা ছেড়ে যাও 


যার বীজমন্ত্র: “ভালোবাসো অথবা ছেড়ে যাও”,

যার যোনি উপচে পড়ে 
সেমুই, দুধের দাঁত আর পাকা টসটসে ফলে,
যার এক পা পৃথিবীতে আলতো করে রাখা,
ঠুনকো, অস্বচ্ছ পাগলামির কামনায়,
যার মানসিকতায় পশ্চিমের ফেলে দেওয়া জঞ্জাল,
যার এক পা কম্পমান, ওঃ, ওঃ, 
আমার কপালে টোকা দেয় ছেনালের মতন, আর 
মাটির আশ্রয় খোঁজে,
সব সমেত ধসে ভেঙে ছিটকে পড়ে,
তার সেই নাগর ফোন করতে ভুলে যায় তাকে;

(বুঝতে পারি যখন প্রতিশোধকামী সঙ্গম শেষে 
মৃতের মতন নেতিয়ে পড়ে সে) 

(তার অপরূপ বুটিওয়ালা তিলবসানো মিশরী শরীর)

চুনের জলে ডেলা ও পোকার মতন 
ঘোরে তার বাসনা 
স্বাধীন জীবনযাপনের আকাঙ্খায়,
সঙ্গে থাকে বিষাদ,

ভাবতে পারো 
আমার অভিলাষের সব নারীর ভেতর 
তাকেও মনে রাখি সবচেয়ে বেশি,
যে ছেড়ে গেছে আমায়।

[বেলজিয়ামের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক, সেই সঙ্গে চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ওলন্দাজ এবং ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লিখতেন। তাঁর নাটকগুলি মঞ্চসফল ও নন্দিত; তাঁর একটি নাটক অশ্লীলতার দায়ে জড়িয়ে পড়লে তাঁর চার মাসের কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। পরে তা মকুব করা হয় গণপ্রতিবাদে। আলৎসাইমারে আক্রান্ত কবির স্বেচ্ছামৃত্যু গভীর ধর্মীয় ও নীতিগত বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল ইয়োরোপে। কবিতাগুলি ২০০৪ সালে প্রকাশিত “অভিবাদন” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। তাদের ওলন্দাজ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জন আয়রনস (১৯৪২- )।] 

আদনিস: (সিরিয়া ও ফ্রান্স, ১৯৩০- )

সূত্রপাত কবিতাগুচ্ছ 

।।১।। 

কেস

কেস বলতেন 
লায়লাকে দিয়ে আমি পোশাক বানিয়েছি আমার 
আর ঢেকেছি মানবতার শরীর।

আমি তাকে আগুনের পেছনে 
মুখ লুকোতে দেখি 
অরণ্যের নৈশ সখ্যে তিনি বিরাজমান 
অথচ ছেনালির শেষ নেই।

আমি তাকে 
অনিদ্রার সৈকত থেকে 
মুঠো মুঠো চাঁদ 
তুলে আনতে দেখেছি। 

টীকা: কেস: মধ্যপ্রাচ্যের পুরাণের প্রাচীন চরিত্র, লায়লার প্রেমিক। আমরা তাঁকে অন্য নামে জানি: মজনুন অথবা মজনু।

।।২।।

শূন্যতার সূত্রপাত

পৃথিবীর শরীর আগুন এবং 
জলকে ডাকে; দিন গোনে ভবিতব্যের।

এজন্যেই কি বাতাস পরিণত হয় তালবনে 
আর শূন্যতা হয়ে দাঁড়ায় নারী? 

।।৩।।

সাক্ষাতের সূত্রপাত

নারী ও পুরুষ: তাদের অভ্যন্তরে 
কাশবনের দেখা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে 
বৃষ্টির সঙ্গে ধুলোর 
ধসে যায় ঢিপি আর 
আগুন জ্বলে শ্বাসরুদ্ধ ভাষায়।


আমি শুধাই: আমাদের কোনজন কালবোশেখির 
মেঘ আর কোনজন দু:খের হালখাতা?
তোমার চোখে প্রাচীন বন্যতা 
তোমার মুখ কোনো প্রশ্ন শোনে না।


রাতের শেষ প্রহর আমি। আমি প্রেমে পড়ি যাতে 
রাত এসে পড়তে পারে দিনের শেষে 
আর বলতে পারি 
নারী ও পুরুষের 
দেখা 
নারী ও পুরুষের সঙ্গে। 


।।৪।।

নামের সূত্রপাত

আমার দিনগুলি তার নাম 
স্বপ্নেরা, যখন আমার বিরহের কথা শোনে 
ঘুম নেই আকাশের, তার নাম 
দুশ্চিন্তাও তার নাম 
আর বিবাহ, যেখানে আলিঙ্গন করে জল্লাদ 
ও কোরবানি, তার নাম।

গান গেয়েছিলাম একদিন, প্রতিটি 
ক্লান্ত গোলাপ, তার নাম 
পথযাত্রার শেষেও, তার নাম 
পথ কি শেষ হলো, বদলালো তার নাম?


।।৫।।

পথের সূত্রপাত

রাত হলো সাদা কাগজ -- আমরা 
কালি:

“কী আঁকলে তুমি মুখচ্ছবি, পুরুষ অথবা পাথর?”
“কী আঁকলে তুমি মুখচ্ছবি, নারী অথবা পাথর?”

উত্তর দিই না প্রেম করি 

আমাদের নীরবতার পথ নেই কোনো 
আমাদের প্রেমেরও নেই।


।।৬।।

যাত্রার সূত্রপাত

সাক্ষাৎকার শুরু হয়, সেই ফাঁকে অস্ত যায় সূর্য 
সাক্ষাৎকার শেষ হয়, রেখে যায় খোলা ক্ষত 
আমি এই গাছের কোনো শাখাপ্রশাখাকে আর 
চিনতে পারি না, বাতাসও ভুলে গিয়েছে 
আমার পরিচয় এই কি আমার ভবিষ্যৎ?
প্রেমিক প্রশ্ন করে আগুনকে।
নারীর মুখে জাগে প্রবাসযাত্রার অধীরতা 
পুরুষ পাল তুলে দেয় তাতে।

।।৭।। 

প্রেমের সূত্রপাত 

প্রেমিকেরা পাঠ করে ক্ষত আমরা রক্ত দিয়ে ক্ষত লিখি 
অন্য এক যুগে আমরা রাঙিয়েছি 
আমাদের প্রহর:
আমার মুখচ্ছবিতে সন্ধে,
তোমার চোখের পাতায় ভোর।

আমাদের পদক্ষেপে রক্ত ও কামনা।
প্রতিবার তারা মাথা তোলে, ডাল থেকে ছেঁড়ে আমাদের,
ছোঁড়ে তাদের প্রেম, ছোঁড়ে আমাদের,
হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয় গোলাপ।


।।৮।। 

যৌনতার সূত্রপাত -- ১

ঘর বারান্দা অন্ধকার 
হাত বুলোয় ক্ষতে 
ভাঙে শরীর 
ঘুম 

ভবঘুরেমি আর সব হারানোর মাঝামাঝি 

প্রশ্ন আর উত্তরের ফাঁক দিয়ে রক্তস্রোত 
বাকশক্তির গোলকধাঁধায়।


।।৯।।

যৌনতার সূত্রপাত -- ২

দেয়াল বেঁকে যায় বাহুতে, যৌনতা তোলে উঁচু গম্বুজ --
ছুঁড়ে দেয় 
দু:খের স্রোতে 
দু:খ 
তার কোমরের রশিতে বাঁধা -- দরজা খোলে যোনি --
ভেতরে যাই আমরা।

বাড়ছে আগুনের তেজ আর লণ্ঠনের পাশে রাত জড়োসড়ো 
আমরা গড়ে তুলি 
স্তূপ, ভরে দিই পরিখা 
আর মহাশূন্যে ফিসফিস করে বলি 
হাত বাড়াও। 

তিক্ততার আলো নদীর মতন বয়ে যায় 
দুকূল ছাপায়, আমরা জলকে 
আপন করে নিই, পোশাক বানাই 
নিজের দুকূলকে 
নদীর দুকূলের ইচ্ছে অনিচ্ছে মত …...


।।১০।।

শব্দের সূত্রপাত 
আমাদের দুথাক শরীর বজ্রবিদ্যুৎ 
তুমি বলো, আমি শুনি 
আমি বলি, তুমি শোনো, শব্দের টুংটাং 

আমাদের দুথাক শরীর নৈবেদ্য 
তোমার পতন, আমার পতন 
দিবাস্বপ্নের লেলিহান আগুন চারদিকে 
আমার পতন, তোমার পতন।

তোমার আমার মাঝে 
শব্দ জমে জমে 
আগুন জ্বলে।

।।১১।।

হাওয়ার সূত্রপাত

“রাতের শরীরে,” নারীটি বলে যায়, “ফিরে আসে 
রক্তাক্ত ক্ষত ও তাদের দিনগুলি…….”

ভোরবেলা শুরু করি আমরা, ছায়ার মধ্যে প্রবেশ 
গায়ে গায়ে জড়ানো আমাদের স্বপ্নেরা 
আর বোতাম খোলে সূর্য: “ফেনার ছদ্মবেশে সাগর 
এসে পড়বেই ঠিক।” আমরা 
পুঁথিপত্র পাঠ করে যাই দূরত্ব রেখে।

উঠে পড়ি আর হাওয়া মুছে দেয় পায়ের ছাপ 
ফিসফিস 
আমাদের গোপন সভা শুরু হবে 
আর চলে যাবো ……….


।।১২।।

জাদুর সূত্রপাত 

কীভাবে দেখা হলো আমাদের তাই নিয়ে বিস্ময়
ফিরে আসার পথটি খুবজতে হবে গোলকধাঁধায় 
আর বলবো: সৈকত জনশূন্য 
আর জাহাজডুবির খবর আনে 
হালগুলি।

আমরা কুর্নিশ করে বলতে পারি 
পথের শেষ।


।।১৩।।

পাগলামির সূত্রপাত 

যখন তোমার বাতাস বয় তার সীমাহীন অরণ্যকে ছুঁয়ে 
পুরুষটি বলে: মৃত্যুকে প্রজাপতির মতন দেখতে
আর যৌনতার মুখ পাগলামিতে ভরা।

এই তো সে দাঁড়িয়ে, পরনে কোরবানির পোশাক
তার ভবিষ্যৎ 
তার অতীত 
তার দিগন্ত
একটি কুঠার আর ধূলিকণার মতন শব্দেরা 
তার চোখের সামনে। 

[এই সংকলনের প্রথম কবি যিনি এখনো আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে আছেন, ধর্মীয় মৌলবাদের তীব্র বিরোধিতায় এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কঠোর সমালোচনায়;। মধ্যপ্রাচ্যের এই মহান কবি পা দিতে চলেছেন জীবনের দশম দশকে। তিনি বাস করেন ফ্রান্সে, ফরাসি এবং আরবি, দুই ভাষাতেই লেখেন। আরবি ভাষার কবিতায় আধুনিকতার জোয়ার এনেছিলেন তিনি। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন আরবি ভাষার প্রথম আধুনিক কবিতার “মাজাল্লাত শিইর“ কাগজ; আরবি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন খালেদ মাতোয়া।] 

ডেরেক ওয়ালকট: (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩০-২০১৭)


মুঠি 

আমার হৃদয় ঘিরে শক্ত দৃঢ় মুঠি 
ঈষৎ আলগা হলে আমি 
উজ্জ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলি; আবার 
বন্ধ হয় মুঠি। প্রেমের যন্ত্রণার সঙ্গে প্রেম 
সে কি আমার চিরদিনের নয়? কিন্তু একে 

প্রেম বলবো না কি বাতিক? এর মধ্যে আছে 
উন্মাদের দৃঢ় জাপ্টে ধরা, একে বলবো 
চিলচিৎকার করে রসাতলে পতনের আগে,
যুক্তিহীনতার শৈলশিরাকে আঁকড়ে থাকা।

শক্ত করে ধরো হৃদয়! তাহ’লে অন্তত বাঁচবে তুমি।

[মাত্র দেড় লক্ষের একটু বেশি মানুষ বাস করেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট লুসিয়া দেশটিতে -- কিন্তু তার মধ্যেই জন্মেছেন দুজন নোবেলজয়ী কবি -- দ্বিতীয়জন ডেরেক ওয়ালকট। মাতৃভাষা ফরাসি, কিন্তু সাহিত্যরচনা ইংরেজিতে। হোমারের “ইলিয়াড” মহাকাব্যকে তিনি নতুন করে লিখেছেন ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “ওমেরোস“ কাব্যগ্রন্থে। আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিন দশক। সংকলিত কবিতাটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত “সমুদ্র-দ্রাক্ষা” (“Sea-Grapes”) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।] 


টেড হিউজ: (ইংল্যান্ড, ১৯৩০-১৯৯৮)

ছুটে বেড়ায় পুরুষের পা 

যতক্ষণ না তারা জড়িয়ে মড়িয়ে শেষ পর্যন্ত হোঁচট খায় ধপাস
আর নারীর পাদুটো আঁকড়ে ধরে তাদের বাকি জীবনটুকুর জন্যে

পুরুষের বাহু ভারী জিনিস তোলে, অন্ধকারে হাতড়ায়, তারপর
আশ্লেষে ধরে নারীর বাহু
আর শুয়ে পড়ে দ্বৈতসত্তায় অবশেষে অবশেষে

পুরুষের মুখ তার বাক্যজাল চালায় ঢুকতে বেরোতে
আর নারীর মুখ খুঁজে পেয়েই আস্তানা গাড়ে তার ভেতরে

পুরুষের বুক ধাক্কা মেরেই চলে অবিরাম
নারীর স্তনাগ্রে এসে হবে তার বিশ্রাম

এক নাভি অন্য নাভি গায়ে গায়ে এফোঁড় ওফোঁড়
দুই দর্পণের মত সপাট মুখোমুখি

আর এইভাবে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
গাভীর দিকে এগিয়ে যাওয়া ষাঁড়ের মতন, থাকবে না স্থির
যে বাছুর খুঁজছে তার হারানো মাকে 
মরুভূমিতে থমকে দাঁড়ানো পথিক, তার মায়াময় ভ্রমার্তিতে 
খুঁজছে মরুদ্যানের জলাশয় 

তারপর সে পেয়ে যায় তার সাধের বস্তুটি, থামে আর চোখ বোজে 

সত্য আর গরিমা নেমে আসে ধরে আকাশ থেকে 

নতুন খোঁড়া কবরের পাশে, শোকাহতেরা দাঁড়িয়ে নেই আর 
আর তারা জ্বলে আকাশে 
আর পৃথিবী, কাঁচা ও নতুন, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন 
আবার শুরু করে সন্ধান 

অপার বিস্ময়ের পথে তীব্র বেগে।

[ব্রিটেনের কবি, অনুবাদক, শিশু-সাহিত্যিক -- অকালমৃত মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথের স্বামী ( ১৯৫৬-১৯৬২)। তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের কয়েক মাস পরেই আত্মহত্যা করেন সিলভিয়া। ১৯৮৪ সাল থেকে আমৃত্যু ব্রিটেনের জাতীয় কবি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ কবিতার এক প্রধান ব্যক্তিত্ব; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন বিতর্কে আকীর্ণ। শোনা যায় তিনি সিলভিয়াকে নিগ্রহ করতেন নিয়মিত। তাঁর আরেক ঘনিষ্ঠ নারী আসিয়া ওয়েভিল সকন্যা আত্মহত্যা করেন ১৯৬৯ সালে; তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছিল গ্যাসের আভেন থেকে। কবিতাটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “গুহার পাখি” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

চিনুয়া আচেবে: (নাইজিরিয়া, ১৯৩০-২০১৩)

প্রেমসঙ্গীত (অ্যানার জন্যে)

আমার নি:শব্দ প্রহরে তুমি 
অপেক্ষায় থাকো প্রেমিকা আমার
বাতাসে ভাসে ঘোর অমঙ্গল 
আর পাখিরাও 
দ্বিপ্রহরের শাস্তির ভয়ে 
তাদের গানের কলি 
লুকিয়ে রাখে 
কচুপাতায় মুড়ে …… কী গাব 
কী গান তোমায় শোনাবো আমি 
হে দুর্লভ প্রেম যখন উবু হয়ে বসা 
একদল ব্যাঙের গ্যাঙর গ্যাঙ উল্টে দেয় 
দিনের নাড়িভুঁড়ি -- সঙ্গে থকথকে বিলের 
গুণগান করে গলা ফুলিয়ে আর 
ঘরের ছাদে পাহারা দেয় 
পাটল-মাথা শকুন।

আমি গান গাই নীরব অপেক্ষায় 
তোমার শান্ত চোখের তারায় 
বয়ে বেড়াও আমার সব স্বপ্ন 
আমাদের ফোসকা-পড়া পায়ের ধুলো 
মুছে নিয়ে পরাও সোনালি ঘুঙুর 
ভালো দিন এলে আবার আমরা 
নাচবো নির্বাসিতের নাচ।

[আফ্রিকার আলোকিত হৃদয় চিনুয়া আচেবে -- কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক এবং কবিও। ইয়েটসের কবিতার পংক্তি দিয়ে তাঁর কালজয়ী উপন্যাসের নামকরণ: “সবকিছু ভেঙে যায়” (প্রকাশ ১৯৫৮) -- এখনো পর্যন্ত আফ্রিকার জনপ্রিয়তম উপন্যাস। তিনি নাইজিরিয়ার মানুষ, কিন্তু লেখক হিসেবে আন্তর্জাতিক; মাতৃভাষা ইবো, কিন্তু লিখেছেন মূলতঃ “ঔপনিবেশিকদের ভাষা” ইংরেজিতে। আফ্রিকা মহাদেশের প্রসিদ্ধতম লেখক তিনি; দু দশক অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার বার্ড কলেজে এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতাটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া হয়েছে।]