ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১৪
ইনেস তাঁর বন্ধু গের্টকে নিয়েও বিশেষ চিন্তিত। গের্ট অবশেষে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়বার ব্যাপারে মনস্থির করেছে। আগামী হেমন্ত থেকেই ক্লাস শুরু হবে। সে হিসেব করে দেখেছে যে পাশ করে বেরতে আরও তিন বছর লাগবে; কারণ কিছু সেমিস্টারের ক্লাস সে এর মধ্যেই করা হয়ে গিয়েছে তাঁর। গের্ট এই বিষয়ে ইনেসের সঙ্গে বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আলোচনা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে নেওয়া সরু, হলদে সিলেবাসের বইটা নিজের পকেট থেকে বের করে যে যে ক্লাসের লেকচারগুলো শুনতে সে ইচ্ছুক, সেগুলোর পাশে একটা সোনালি রঙের পেন্সিল দিয়ে দাগ টানে।
ইনেস গের্টের পরিকল্পনা মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে মনে আগামী শীতের সময়টা কল্পনা করে সে। ফ্লকের সঙ্গে সে মাঝে মাঝে গের্টের এপার্টমেন্টে যাবে দেখা করতে। তবে খুব ঘনঘন যাবে না, কারণ গের্ট কাজে এবং পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। বের্নহার্ডের সুন্দর পোর্ট্রেটের পেন্সিল স্কেচগুলোর বদলে কালো রঙের কলেজ খাতায় আর ‘করপাস ইউরিস সিভিলিস’ এর অনেক খণ্ডে ভরে থাকবে গের্টের টেবিল। একজন উকিলের ঘরে আর কী কী থাকতে পারে, সেই বিষয়ে ইনেসের পরিষ্কার ধারণা নেই। ফলে সে আর বেশি কল্পনা করতে পারে না; তবে তাঁর মনে হতে থাকে যে গের্টের চেহারা ক্রমেই একঘেয়ে ক্লান্ত, বিরক্ত ধরনের হয়ে যাবে এবং সে সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকবে।
কিন্তু তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা? ফার্দিনান্দ আর বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে সন্ধের আড্ডাগুলোর সেরকম কোনো আকর্ষণ আর নেই। হতে পারে যে তুমি আইনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব করলে… ভবিষ্যতের উকিল অথবা বিচারক কিম্বা কৌঁসুলি যারা। এরা খুব গুরুগম্ভীর প্রকৃতির, সব সময় নিজের মর্যাদা বিষয়ে অত্যধিক সচেতন। তরুণ সঙ্গীতশিক্ষার্থীরা এমন নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে সবসময় সব ব্যাপারে চরম মতামত পোষণ করে না তারা। তবে গের্টকে ভবিষ্যতে স্থির করতে হবে যে সে হিটলারের পক্ষে না বিপক্ষে…
-‘গের্ট!’ ইনেস শুরু করে, … ‘তুমি কি হিটলারপন্থী?’
-‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’
-‘না, এমনিই… জিজ্ঞেস করলাম আর কি!’
ইনেসের হঠাৎ গের্টকে আইনের ক্লাসের ছাত্র হিসেবে কল্পনা করে হাসি পায়। সাধারণত ছাত্র মানেই মানুষ তাদের স্নেহের চোখে দেখে। কিন্তু গের্ট ছাত্র হিসেবে নিঃসন্দেহে হাস্যকর… একটা অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে চলেছে বলে মনে হয় ইনেসের। কারণ গের্ট খুবই সংবেদনশীল এবং সহজেই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। তাছাড়া যে কাজটা তাঁর পছন্দ হয় না, সেটা শেষ করা তো দূর, সে কিছুতেই বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। গের্ট নিজেও হয়তো নিশ্চিতভাবে এখনো বুঝতে পারছে না যে ভবিষ্যতে সে কী ভাবে ব্যাপারটা সামলাবে। তবে সে সমাজে ‘একজন’ হয়ে উঠতে চায়। সেটাই এই মুহূর্তে তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। ‘একজন’ হয়ে ওঠা মানে সমাজে একটা ভাল জায়গা, একটা ভাল ডিগ্রি, উপাধি ইত্যাদি।
গের্ট এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তবে নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট গর্ববোধ আছে তাঁর এবং এই বোধটাই তাঁর দুর্বলতা হয়ে উঠছে। কারণ সেটাই বদলে যাবার পথে তাঁকে ভিতরে ভিতরে বাধা দিচ্ছে। এই বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে পরিস্থিতি থেকে বেরতে পারছে না সে। তাঁর দ্বিধা এখনো কাটেনি এবং সে বিষণ্ণ তিক্ত মেজাজে সিলেবাসের হলুদ বইটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।
ইনেস শান্তভাবে তাঁকে নিরীক্ষণ করে। তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডলের রেখাগুলি, তামাটে হয়ে পুড়ে যাওয়া কপালের অর্ধেকটা কালো চুলের গুচ্ছে ঢাকা। তাঁর চোখদুটো গাঢ় রঙের, তীব্র এবং অস্থির। ঠোঁট এবং চোয়াল ক্রুদ্ধ, কঠিন, মাঝে মধ্যে সে মুখটা অল্প খুলছে যেন এখনই কোনও খেদ, অভিযোগ কিম্বা প্রতিবাদী সমালোচনার শব্দ বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু গের্ট কখনই অভিযোগ করে না। তাঁর গর্ববোধ তাঁকে সেটা করতে বাধা দেয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন সে অনেক কথা একসঙ্গে বলতে থাকে, সেসব কথাবার্তা উদ্ধত এবং বিদ্বেষপূর্ণ। যদি কোনও কারণে সে আহত হয়, তখন অবুঝের মত অনেক কথা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বলে দেয়। অনেক মানুষ এই কারণে গের্টকে একেবারেই পছন্দ করে না। তাঁকে উগ্র এবং বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করে। অনেকেই ইনেসকে সতর্ক করে গের্টের সঙ্গে মিশবার কারণে। আবার অনেকে অবাক হয় ইনেসের সাহসের কথা চিন্তা করে, কারণ সাধারণভাবে মানুষ মনে করে যে গের্টের মত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর। কারণ ইনেস গের্টের থেকে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং মানসিক শক্তির অধিকারিণী। তাছাড়া সে বের্নহার্ড এবং অন্যান্য বন্ধুদের যেভাবে সবসময় সাধ্যমত সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেভাবেই সে গের্টকেও সাহায্য করে থাকে।
তবে এইমুহূর্তে গের্টের জন্য ইনেসের বেশ চিন্তা হচ্ছে। এতদিন গের্ট ভবিষ্যতে কী করতে চায়, সে বিষয়ে ইনেস একেবারেই মাথা ঘামায়নি। কারণ গের্ট সপ্রতিভ উজ্জ্বল তরুণ, যদিও বিশেষ উচ্চাশা নেই জীবনে। এদিকে আবার গর্ববোধ আছে যথেষ্ট পরিমাণে। জীবনে কিছু একটা করতে চায় সে সাফল্যের সঙ্গে, নিজের কাজের জন্য একটা স্বীকৃতিলাভ করতে চায় সে। কিন্তু সম্প্রতি সে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে সিগারেট খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো একা বসে থাকছিল, আবার কখনও বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে মাতাল হয়ে বেড়াচ্ছিল; এতকিছু করে কোনও উপকার অবশ্য হয়নি। এসব কাণ্ড ঘটিয়ে সে আবার লজ্জিত হয়ে শাস্তি পাওয়া স্কুলের ছাত্রের মত মুখ নিচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক। সবকিছুই ইনেসের কানে এসেছিল। ইনেস তাঁকে একসঙ্গে ঘুরতে কিম্বা হাঁটতে যাবার কথা বলেছিল; সে একেবারেই রাজি হয়নি এবং হাজারটা বাহানা দেখিয়েছিল। ইনেসের যে একটু খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে সে মাঝে মাঝেই ফোন করে গের্টের খবরাখবর নিত। কারণ তার মনে হয়েছিল যে এসব বদমায়েশি আর ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে গের্ট হয়তো তার সঙ্গে দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ গের্ট নিজে থেকেই ইনেসকে ফোন করে দেখা করতে চায়; বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে, কারণ সে নাকি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে ইনেসকে একটা জরুরি কথা বলবার জন্য। এখন সে বলছে যে সে এখন সত্যিই ভালভাবে পড়াশুনা শুরু করতে চায়।
… ‘গের্ট, আসলে তুমি ঠিক কোন কারণে পড়াশুনা শুরু করতে চাও?’
-‘আমার বাবা মা সেটাই চান।’
-‘সেটা কি তুমি এতদিন জানতে না? জানা সত্ত্বেও তুমি সেই ব্যাপারে কোনও গুরুত্ব দাওনি।’
-‘কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি ভাল আঁকতে পারি। আমি একজন শিল্পী।’
-‘কবে থেকে তোমার বিশ্বাসে চিড় ধরল?’
-‘বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে।’
-‘তুমি এখন আর ছবি আঁকতে ভালবাস না?’
গের্ট যন্ত্রণাকাতর মুখে তাকায় ইনেসের দিকে… ‘তুমি তো সবই জানো।’ বলে সে… ‘কেন শুধুশুধু এই প্রশ্ন করছ?’ মুখটা অন্যদিকে ফেরায় সে… ‘আমি ভেবেছিলাম আমি আঁকতে পারব। কিন্তু আমি শুধু বের্নহার্ডকেই আঁকতে পারতাম। সে ছাড়া আর কাউকে, আর কোনওকিছু আমি আঁকতে পারি না। সে চলে যাবার পর আমি একটা রেখাও টানতে পারিনি কাগজে। আমার কোনও প্রতিভা নেই, ইনেস। ছবি আঁকতে নয়, আমি বের্নহার্ডকে ভালবাসি।’
অবশেষে গের্ট মুখ খুলেছে। আবেগমথিত খেদ আর অভিযোগের বন্যা বেরিয়ে আসছে এখন তার খোলা মুখ দিয়ে।
ইনেস স্তব্ধ হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে একদৃষ্টে গের্টের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যদিও এই বিষণ্ণতা চট করে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। মানুষের মনে হবে যে ইনেসের মুখমণ্ডলে অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে।
‘তুমি যদি পাশ করে উকিল হয়ে বেরোও, তাহলে কি তুমি আর বের্নহার্ডকে ভালবাসবে না?’ বলে ওঠে ইনেস, ‘তুমি কি তখন বদলে যাবে?’
(চলবে)
0 comments: