0

গল্প - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



















লক্ষ্মীপুজোর দিন ধুম জ্বর নিয়ে গ্রামে ফিরল সুরেন। সেই সাথে সারা গায়ে ব্যাথা। গাঁটে গাঁটে ব্যাথা। ভ্যানরিক্সা থেকে নেমে ওইটুকু পথ পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দম বেরিয়ে যাবার জোগাড়। হাঁটু দুটো যেন খুলে পড়ে যাবে। ছেলে কালুর মাথায় পিঠে হাতে পুঁটলিগুলো, তাতে গুচ্ছের জিনিস। ভ্যানওলা ঢাকটা রেখে দিল বাড়ির দালানে।

বাড়ি মানে ওই মাটির দেয়াল আর টিনের চাল। একটা ঘর আর লাগোয়া দালান, তারই একটু ঘিরে রান্না করার জায়গা। মাটির দেয়ালে মসৃণ করে গোবর-মাটি লেপা। পুজো-পার্বন গেল বলে দেয়ালে নানা রঙিন ছবি-নকশা আঁকা। ফুল, লতা, পাখি, পুতুল আরও কত কী। গতবারে পুজোর পর কলকাতা থেকে ফিরে দর্মার দরজাটা পাল্টে টিনের দরজা করেছে। গ্রামের একপ্রান্তে, মানে প্রায় গ্রামের বাইরেই, সুরেনদের দশ ঘরের বাস। এটাকে বলে শবরপাড়া। সম্প্রতি লোকজন বাড়ায় গ্রামটা সুরেনদের শবরপাড়া অবধি চলে এসেছে। তাই নিয়ে ভটচায্যিমশাই কয়েকমাস আগে শুনিয়ে দিলেন, কি রে, তোরা তো এবার গ্রামে ঢুকে পড়লি। সুরেনও শুনিয়ে দিল, না মানে গিয়ে, আপুনারাই তো ইগিয়ে এলেন ইদিকে।

ফি-বছর দুগ্‌গা পুজোর সময় সুরেন কলকাতা যায় ঢাক বাজাতে। ও যখন ছোট ছিল তখন বাবার সঙ্গে যেত কাঁসর বাজাতে। চোরবাগানে একটা মস্ত বাড়িতে ওদের ঢাক বাজানো বাঁধা। বাপ মরে যেতে ও-ই এখন যায়, সঙ্গে কালু। গত বছরে বউ আর দুই মেয়েকেও নিয়ে গেছিল। খুব আনন্দ করেছিল ওরা সবাই। ঢাক বাজিয়ে যা টাকা পায় তার সাথে পুজোর পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে অনেক জামা কাপড় টাকাও পেয়ে যায়। বউ-এর করে দেওয়া ফর্দ মিলিয়ে সংসারের জন্য অনেক জিনিষও কিনে আনে। ও ফিরলেই অন্যরাও চলে আসে বাহারি প্যান্ডেল, আলো সব গল্প শুনবে বলে। সব ঘরের জন্যেই কিছু-না-কিছু নিয়ে আসে। সবাইকে আনা মিষ্টিও দেয়। রাতে চাঁদের আলোর নিচে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা বিলিতি মদের আসর জমায়।

এবারে ফিরতে দেরি হয়ে গেল অন্য একটা বড় বারোয়ারি পুজোয় বিসর্জনে ঢাকের মিছিলে ওর ডাক পড়ে বলে। একাদশীর রাতেই ও প্যান্ডেলে চলে গিয়ে রাতে ওখানেই শোয়। তিনরাত ওখানে শুয়ে বিসর্জনের পরদিন সকালে কালীঘাট হয়ে হাওড়া স্টেশনে আসতেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। সুরেন এলে অন্য সব বাড়ির মেয়েরা এসে জড় হোল। এবারে সেই আনন্দ নেই। মেয়েদের কান্নার রোল উঠল। সেই শুনে সুরেন বলে, মরা-কান্না কাঁদিস ক্যান, আমি তো মরি নাই ইখনও। যা যা সব মিষ্টি-জল খা গিয়া।

ওদের পাড়ার হেমব্রম সবার আগে খবর পেয়ে ছুটে আসে। সুরেনের অবস্থা দেখে পঞ্চায়েতে খবর দেয় এবং সেখান থেকে চিঠি করিয়ে প্রাইমারি হেলথ সেন্টার থেকে ডাক্তার নিয়ে আসে বাড়িতে। শিবসাধন নামে এই ছোঁড়া ডাক্তারের ওপর গ্রামের সক্কলের খুব ভরসা। সুরেনকে পরীক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তির জন্যে বলে। মশার কামড় থেকে এই জ্বর হয়েছে বলেই ওর ধারণা কিন্তু রক্ত পরীক্ষা না করলে কিছু বলা যাবে না। দেখভালের জন্যে সুরেনের বউ সাথে রইল হাসপাতালে। অন্যেরা সুরেনের ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিল।

তিনদিন পরে ডেঙ্গির জ্বর ছাড়লেও বাড়ি এল দশ দিনের মাথায়। গাঁটের ব্যাথা ও দুর্বলতা দুটোই খুব। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেনা। কোন রকমে ধরে ধরে দালানে এসে শোয়, বসে। এদিকে কালীপুজোর বায়না নিয়ে ফিরেছে। সেখানে যাবার জন্যে হেমব্রমকে বলে, তু যা না কলকাতায়। বাবুদের পাড়াতেই কেলাবের পুজো।

হেমব্রম কলকাতা আগে যায় নি। বড় শহরের গল্প শুনতে ভাল লাগলেও ‘ডর’ লাগে ওর যেতে। না বাপু, মুর ডর লাগে। কত্ত বড় শহর। হারায়ে যাব। তুমি যাও গিয়া।

পারলে কি তুরে বলতাম। হাগতি মুততি যাতি পারি না ঠিকমত। তু যা না, কাগুজে ঠিকানা আছে সিটা নুককে দিখিয়ে চলে যাবি।

হেম বাড়িতে এসে বউকে বলে। সে তো আনন্দে টগবগ করছে, আমুও যাব তোর সাথি।

সুরেনের কাছেই হেম ঢাক বাজাতে শিখেছে। ওর ঢাক আছেও একটা। বেজার মুখে সেটাকে নামায়। ধুলো ঝাড়ে। বিকেলে ঢাকে কাঠি পড়ে। ঢাক তালে তালে কথা বলে ওঠে। সুরেন আশ্বস্ত হয়। শবরপাড়া জানলো হেম কলকাতা যাচ্ছে ঢাক বাজাতে।

কালীপুজোর দুদিন আগে হেম তার মেয়ে রাধাকে নিয়ে ঠাণ্ডা জল-ভাত খেয়ে ভোর রাতে দুগ্‌গা কালী বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে মশারি আর আড়কাঠিও নিল। পাঁচ মাইল পথ হেঁটে রেল স্টেশন। ট্রেন আসতেই রাধার হাত ধরে উঠে পড়ল। ওরা দুজনেই এই প্রথম ট্রেন চড়ল। গ্রামের লোকেরা মিটিঙে মিছিলে ট্রেনে করে কলকাতা গেলেও শবরপাড়ার কেউ যায় না। কারণ ওদের কেউ ডাকে না। একমাত্র সুরেনই যায় প্রতিবছর ওই ঢাক বাজাতে।

হাওড়া স্টেশনে ভিড় দেখে হেমের চক্ষু ছানাবড়া। রাধা তো ভয়ে বাবার জামার খুঁট ধরে রেখেছে। কাকে জিগ্যেস করবে, সবাই তো ছুটছে। একটা পুলিশ দেখে তাকে ওই ঠিকানার কাগজটা দেখাল। কিন্তু পুলিশের কথা কিছু বুঝল না। পায় পায় স্টেশনের বাইরে এসে দেখে অনেকে ঢাক নিয়ে বসে আছে। এগিয়ে গেল সেদিকেই। একজন বয়স্ক লোক হেমকে ডাকল। সে কাগজটা দেখিয়ে জানতে চাইল কোন দিকে। লোকটা তার সঙ্গে রাস্তায় নেমে এল। রাধার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে, মেয়ে? হেম মাথা নাড়লে। লোকটা বলে, কিছু খেয়েছে?

কথা শুনে রাধা খাবার জন্যে বায়না করে। লোকটি দুজনকে পাউরুটি ঘুগনি খাওয়ায়। নিজেও খেল। সে দাম দেবার সময় হেম তার হাতে দশ টাকা দিয়ে বলল, মুর মান আছে। হেম জানতে পারল, লোকটা ঢাকিদের দালাল।

লোকটা হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ওদের যখন নিয়ে যাচ্ছিল সুরেনের কথামত গঙ্গা পেরোনোর সময় ব্রিজের ধারে গিয়ে প্রণাম করে নেয়। হ্যারিসন রোডের মুখে নিয়ে এসে ট্রাম লাইন দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল এরকম লাইন দ্বিতীয়বার যেখানে লাইন দিয়েই কাটবে সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে একটা কালীবাড়ি আসবে। ওখানে কাউকে কাগজটা দেখালেই পেয়ে যাবে।

হেম কাঁধে ঢাক আর পুঁটলি নিয়ে রাধার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বড় বড় বাড়ি, বাস দেখে অবাক হয়ে দুজনে তাকায়। মুখ তুলে চলতে গিয়ে কেবল লোকের সাথে ধাক্কা খায়। ঠংঠং শব্দ করে পাথরের রাস্তায় ট্রাম বিকট আওয়াজ করে থেমে যায়। দেখে রাধা বাপের জামা আঁকড়ে ধরে বলে, ইরি বাপ, রাস্তা দিয়ে টিরেন যায়!

হেম মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে এগোয়। এখানে দেশের রাজা মন্ত্রীরা থাকে। সিনেমা থেটার হয়। গ্রামের লোকেরা এখানে মিছিলে আসে, মিটিং হয়। সিনেমার হিরো হিরোইন সব এখানেই থাকে। আবার বাঘ সিংহদের থাকার মস্ত বড় বাগান আছে। হাতি ভালুক পাখিরাও সেখানে থাকে।

ওরা দেখে ফুটপাতে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে মানুষেরা কেমন গুটিসুটি মেরে থাকে। ওখানেই রান্না করে। ডাঁই করা ময়লা থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো খাবার বের করে খাচ্ছে। কত ঝলমলে দোকান। খাবারের, জামাকাপড়ের, বাসনের, আরও কত কি। রাস্তায় কয়েকটা প্যান্ডেলও দেখল। দেখতে দেখতে চলার গতি শ্লথ হয়ে যায়। হঠাত হুঁশ ফিরলে হেম মেয়েকে টানতে টানতে বলে, শিক্র চ শিক্র চ, দেরি হয়ে যাবে।

প্যান্ডেলে পৌঁছে পুজোর সেক্রেটারিবাবুকে সুরেনের অসুখের কথা বলল। হেমরা ওদের নির্দিষ্ট থাকার জায়গায় গিয়ে দেখে আরও তিনজন ঢাক নিয়ে বসে আছে। বিকেলে চারজনের ঢাকের আওয়াজে প্যান্ডেল গমগমিয়ে উঠল। রাধার সাথে আর একটি ছেলে কাঁসর বাজালো। বাজনা থামলে আলো জ্বলা প্যান্ডেল দেখে রাধা ওর বাপকে বলে, ইটা কুন রাজবাড়ি গো? কি সুঁদর বাড়ি! কত আলু! কত রকম নকশা!

অন্য এক ঢাকি বলল, রাজবাড়ি নয় গো খুকি, কাপড়ের প্যান্ডেল। আলো দিয়ে সাজিয়েছে। কত আলো দেখেছো? এরকম অনেক প্যান্ডেল আছে এই শহরে, এই পুজোর জন্য তৈরি হয় আবার খুলে ফেলে। যেমন সুন্দর সুন্দর প্রতিমা তৈরি হয় আবার পুজো মিটে গেলে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয়।

মুর নাম রাধা। আর আমু খুকি নই। রাধা একটু জোরের সঙ্গেই কথাটা বলল। তারপর জিগ্যেস করল, প্যান্ডেল খুলি দিবে? পিতিমা ভাসাই দিবে জলে? আমাদের গিরামে আলু নাই।

আলু পয়সা দিয়ে কিনতি হয়, গিরামে কে কিনবে? হেমব্রম মেয়েকে বলে।

একটা লোক এসে ওদের ডেকে নিয়ে গেল। সেক্রেটারীবাবু রাধাকে আর ওর বাবাকে নতুন জামাকাপড় দিয়ে বলল, এগুলো পড়ে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে প্যান্ডেলে চলে এস। উদ্বোধন হবে। বড় বড় নামকরা লোক আসবে। খুব ভালো করে ঢাক বাজাবে। আর রাধা তুই তো দারুণ কাঁসর বাজাস। তোকে কাঁসর বাজানোর জন্যে আলাদা টাকা দেব, বুঝলি? একশো টাকা। যা যা, তৈরি হয়ে নে।

কথা শুনে দুজনেই খুব খুশি। হাতজোড় করে নমস্কার করে ওদের ঘরে চলে গেল। রাধা বাপকে বলল, আমুও টিকা পাব, একশো! কি মজা। আমু ইচ্ছিমত জিনিস কিনবু সক্কলের জন্য। কত কী বিক্রি হচ্ছে।

নতুন জামাকাপড় পড়ে দুজনে প্যান্ডেলের বাইরে এসে নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে তাই দেখছে। একটা লোকের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে, উই লাল লাল ফুলো ফুলো কাঠির মাথায় উগুলো কি করে? দোকানদার একটা কাঠি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, বুড়োবুড়ির মাথার পাকাচুল, খায়, তুমি খাবে? মাত্র এক টাকা। রাধার বাপ টাকা দেয়, রাধা ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে।

ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। উদ্বোধন করবেন বোম্বের বিখ্যাত নায়ক তপনকুমার। সঙ্গে থাকছেন বাংলার গৌরব, নায়ক ইন্দ্রজিত ও দুষ্টুমিষ্টি নায়িকা আলোলিকা।

হেম রাধাকে টানতে টানতে নিয়ে এল প্যান্ডেলে। ঢাক নিয়ে চারটে ঢাকই রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই গাড়ির হর্ন বাজিয়ে চলে এল সবাই। এত ভিড় দেখে রাধা ঘাবড়ে গেছে। প্রদীপ জ্বালিয়ে আর চামড় নেড়ে উদ্বোধন হয়ে গেল। ঢাক বেজে উঠল প্যান্ডেল কাঁপিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর ঢাকের আওয়াজ থামল। নায়ক নায়িকারা ঢাকিদের কাছে এসে সবার সাথে হাত মিলিয়ে খুব প্রশংসা করল। রাধার গাল ধরে আদর করল। ইন্দ্রজিত রাধাকে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলল, খুব ভাল বাজিয়েছিস। মিষ্টি খাস।

ওদের পেছনে পেছনে ভিড়টাও চলে গেল। হেম রাধাকে বলল, দেখলি, সিনিমার হিরো হিরোনীকে? কী সুন্দর দিখ্‌তি লাগে। কত্ত ফস্‌সা।

রাধা খুশিতে ডগমগ। তার গাল ধরে আদর করেছে। টাকা দিয়েছে। সে বাড়ি গিয়ে সব গল্প করবে। ভাবল এরা কত ভাল লোক।

রাতে খাবার পর সেক্রেটারীবাবু একটা কাগজ নিয়ে এসে হেমকে দিয়ে টিপ সই করিয়ে নিইয়ে বলল, হেম, তুমি পাবে পাঁচশো প্রতিদিন আর তোমার মেয়ে রোজ একশো। এছাড়া যাতায়াতের খরচা ও বকশিস। রাধা বলল, আমু নাম সুই কুরতি পারি। সেক্রেটারীবাবু বলল, ঠিক আছে, খুব ভাল মেয়ে। লেখাপড়া করবে, কেমন?

রাতে ঢাকিরা সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। ঝলমলে আলো দেখে সবাই থ। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। থিক থিক করছে লোক। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যান্ডেলে ঢুকে ঠাকুর দেখবে বলে। এসব দেখে ওদের আর লাইন দেওয়া হয় না। কত রকমের দোকানে কত বিচিত্র জিনিস। কত রকমের খেলনা। দেখতে দেখতে রাধা ঠিক করে কার কার জন্যে কি কি কিনবে। সব থেকে অবাক হয়েছে এত্ত রকমের খাবার দেখে। অন্য ঢাকিদের ডেকে ডেকে জিগ্যেস করে কোন খাবারের কী নাম। সব নাম তো মনেও থাকে না। রোল, মোমো, ফুচকা, প্যাটিস এরকম কিছু কিছু মনে রাখতে চেষ্টা করে বাড়ি গিয়ে গল্প করা পর্যন্ত। বাকি সব কি রকম নাম। এসব দেখে রাধা অবাক হয়। ভাবে এত আনন্দ করে লোকে পুজোয়! ওদের গ্রামে তো এমন হয় না। রাধা দেখে রাস্তায় খাবার হোটেলের বাইরে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নোংরা জামা পড়ে থালাবাসন ধুচ্ছে। টেবিল মুছছে। ঘর পরিষ্কার করছে। দেখে ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এত আনন্দের দিনে ওদের কোন আনন্দ নেই। অবাকও হয়। মনে পড়ে যায় ওর গ্রামেও তো সব বাচ্চারা কেউ জানেও না শহরে এত আনন্দ আছে। তবে ওদের এরকম কাজ করতেও হয় না। ওরা খেলে, পড়ে, ঘুরে বেড়ায়, আম পাড়ে, পুকুরে ঝাঁপায়। শহরে যেমন আনন্দও আছে, কষ্টও খুব।

পরের দিনটা কয়েকবার ঢাক বাজানো ছাড়া তেমন কোন ব্যস্ততা ছিল না ওদের। তাই সেক্রেটারীবাবুর অনুমতি নিয়ে ওরা দুপুরে ঠাকুর প্যান্ডেল দেখতে বেরিয়েছিল। প্যান্ডেলের বাহার দেখে তাজ্জব, আসল নকল বোঝার উপায় নেই। বাড়ি, গুহা, মন্দির, পাহাড়, নদী, গ্রাম, ধানের গোলা সব এই কলকাতা শহরে। সারা দেশটা এখানে এসে জড় হয়েছে। গ্রামের প্যান্ডেল রাধার খুব ভাল লেগেছে। সত্যিকারের যেন। কত রকমের বাজি আর তার থেকে কখনও রঙিন আলো বেরোচ্ছে, কেউ আবার ওপরে হুশ করে উড়ে যাচ্ছে, কেউ দুম করে ফেটে উঠছে। নাম জেনেছে তুবড়ি, রংমশাল, ফুলঝুরি, হাউই, বোমা। ঘোরাঘুরি করে ওরা হাঁপিয়ে উঠলে সবাই রাতে ফিরে এল। কিছুক্ষণ বাজনা বাজানোর পর খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল। বাজি ও মাইকের আওয়াজে ঘুম আসতে চায় না কিন্তু ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল।

পরের দিনই কালীপুজো। ওরা সবাই সকালে উঠে গঙ্গায় গিয়ে চান করে এল। হেম রাধার হাত চেপে ধরে ডুব দিল। সূর্যের দিকে তাকিয়ে সবাই প্রণাম করল। পুজো রাতে তাই সকালে কোন ব্যস্ততা নেই। কেবল কয়েকবার ঢাক বাজানো ছাড়া। বাপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাধা একলা রাস্তায় বেরিয়ে গেল। এখন আর তার একা রাস্তায় ঘুরতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। অনাবিল আনন্দে তার মন পরিপূর্ণ। একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নানা রঙের মিষ্টি দেখছে, সিঙ্গারা, জিলিপি ভাজা দেখছে। লোভে একটা করে সিঙ্গারা, জিলিপি কিনে খেয়েও নিল। খুব ভাল লেগেছে। কালীবাড়িতে ঢুকে প্রণাম করে একটাকা বাক্সে ফেলেছে। কেউ কিছু বলল না অথচ গ্রামে মন্দিরের ভেতর ওরা ঢুকতে পারে না, বাইরে থেকে প্রণাম করে। মন্দিরের সামনে ভিখারিও দেখতে পেল। টংটং আওয়াজ করে চাকা ঘষরাতে ঘষরাতে ট্রাম চলে গেল। হুস হুস করে কেবল গাড়ি বাস যাচ্ছে। মানুষে টানা রিক্সা, ঠেলা ও ভ্যান গাড়ি শহরের রাস্তায় দেখে আগেই অবাক হয়েছিল যেদিন আসে। তবে গ্রামের হাটের মত মাটিতে বসে চুল কাটা, সবজি, ফল বিক্রি হওয়া দেখে এবার অবাক হোল। দোকানে দোকানে ভিড়। রাস্তায় ইজের পড়ে বাচ্চারা খেলছে। ঝলমলে সোনার গয়নার দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সামনে। চারিদিকে এত শব্দ শুনে যেমন মজাও পায় আবার কষ্টও হয়। কখনও কাছে কখনও দূর থেকে বাজি ফাটার শব্দ আসছে, প্রায় বিরামহীন।

মনে মনে ভাবছে শহরটা খুব ভাল। কেউ কারোর সাথে ঝগড়া করে না। ওদের গ্রামে সারাক্ষণ ঝগড়া, নয়তো এ ওর নামে নিন্দে করছে, খারাপ কথা বলছে। অবশ্য ওদের শবরপাড়ায় এসব খুব কম, কটাই বা লোক আছে। তবু কিছু-না-কিছু নিয়ে কথা ঝগড়া যে হয় না তা তো নয়। শহরের লোকেরা সবাই কত কাজ করছে, কত ব্যস্ত, সব সময় ছুটছে। আর ওদের গ্রামের লোকেরা কত অলস। ছেলেরা বিড়ি খেয়ে খেয়ে সময় কাটায়। ফসলের কাজে যা ব্যস্ততা। মেয়েরা কত খাটে। মাঠে, ঘরে সবসময় কাজ। তার ওপরেও বউদের ছেলেরা পেটায়, গালি দেয়। শহরের মেয়েরাও ব্যস্ত দেখে ভাল লাগে। ভাবে, ও লেখাপড়া শিখে শহরে এসে চাকরী করবে।

গ্রাম আর শহরের মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে ফিরে আসে। জানতে পারে রাত এগারোটায় পুজো শুরু হবে। তাই খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমিয়েও নেয় রাধা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারে কী একটা প্রতিযোগিতা হবে আর তার জন্যে আজও কিছু সিনেমার আর্টিস্ট ও নামকরা লোক আসবে। আলো, প্যান্ডেল, ঢাকের বাজনা শুনবে। তাই তারা যেন আটটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকে সেক্রেটারীবাবুর হুকুম।

রাত বাড়ার সাথে রাস্তায় প্যান্ডেলে ভিড় বাড়তেই থাকে। আকাশে বাজির আলো, রাস্তায় ইলেকট্রিকের আলো, সব আলোয় আলোকময়। বাজির শব্দও খুব। একেকটা শব্দে পিলে চমকে যায়, বুক ধড়ফড় করে ওঠে। তবে এসবে রাধা মজাই পায়। কলকাতা না এলে তো আর এসব দেখতে শুনতে পারত না।

ঢাকের শব্দে এগারোটায় পুজো শুরু ঘোষণা হয়ে গেল। সাড়ে এগারোটার সময় সেই তেনারা এলেন সব দেখে শুনে নম্বর দিতে। সুন্দর সাজাগোজা লোকেদের দেখে রাধা অবাক হয়ে যায়। সেক্রেটারীবাবু আর অন্যরা ওদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। ঢাকিরা নাচতে নাচতে ঢাক বাজাচ্ছে, রাধা আর সেই ছেলেটাও নাচতে নাচতে কাঁসর বাজাচ্ছে। পটাপট মোবাইলে ও ক্যামেরায় ছবি উঠছে। আলো ঝলকাচ্ছে। বাজনদারদের কাছে এসে সবারই চোখ পড়ল রাধার দিকে। পুঁতির মালা, কানে ঝোলা দুল আর কাঁচ টিপ পড়ে ওকে খুব সুন্দর দেখতেও লাগছিল। মাথার চুলে আবার একটা মালাও ঝুলিয়েছে। ওদের মধ্যে একজন মেয়ে রাধার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে নাম, গ্রামের নাম সব জিগ্যেস করে। তারপর বলে কি পড়ে, কোন ক্লাসে পড়ে। বয়স জিগ্যেস করতে ও বলে দশ। এরপরেই প্রশ্ন করে, এখানে কাঁসর বাজিয়ে কত টাকা পাবি? রাধা জবাব দেয়, দিন দিন একশো টিকা।

সেই মেয়েটা রাধার হাত ধরে সেক্রেটারীবাবুকে ডেকে বলে, ছি ছি, আপনি এতটুকু মেয়েকে দিয়ে কাঁসর বাজাচ্ছেন? জানেন, শিশুশ্রম বে-আইনি। আমি এখনই পুলিশে ফোন করছি।

সেক্রেটারীবাবু অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল, ও বাবার সাথে এসেছে, কাঁসর বাজাতে নয়। এখানে কাঁসর দেখে বাজানোর ইচ্ছে প্রকাশ করাতে আমি রাজি হই আর বাড়ির লোকেদের জন্যে ও কেনাকাটার আবদার করছিল বাবার কাছে তাই ওকে টাকা দেব বলেছি।

কিন্তু সেই মেয়েটি কোন কথাই শুনল না। পুলিশ এল। হেম, রাধা ও সেক্রেটারীবাবুকে নিয়ে গেল থানায়। কিছু পরে উকিলও পৌঁছয় কিন্তু শিশুশ্রমের মত গুরুতর অপরাধ বলে ওদের থানায় আটকে রেখে দিল।

পরদিন শিয়ালদহ কোর্টে ওদের হাজির করানো হলে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে রাধা শ্রমের বিনিময়ে টাকা পাচ্ছে। তাই তিনজনেই মুক্তি পেয়ে গেল। সেই সমাজকর্মী মেয়েটিকে অতিসক্রিয় বলে তির্যক মন্তব্যও করলেন বিচারক।

শহুরে সভ্যতায় বন্দি হয়ে রাধা একরাতে অনেকটা বড় হয়ে গেল। প্যান্ডেলে ফিরে হেমের ঢাকের তালে দুলে উঠল রাধার কাঁসর।

0 comments: