ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২২.২
বাদাম তো পাওয়া গেল না, তবে শনিচরের দেখা পাওয়া গেল এক নাপিতের দোকানে । চিকিৎসা
বিজ্ঞানের ভুবনে কোন প্রাকৃতিক চিকিৎসা বা নেচারোপ্যাথির যতটুকু সম্মান , চুলকাটার সেলুনের
দুনিয়ায় এই দোকানের ইজ্জত ঠিক ততটাই। মানে, দোকান কোথাও নেই আবার সর্বত্র আছে। ময়লা
ছড়ানো কাঁচা রাস্তার ধারে একটি নিমগাছ। তার নীচে চটের বস্তা বিছিয়ে বসে আছে নাপিতভায়া। তার
সামনে একটা ইঁট পাতা রয়েছে। সেই ইঁটের উপর শনিচর—না বসে, না দাঁড়িয়ে, কেবল আছে বলা যায়।
নাপিত পেছনের দিকের চুলে মেশিন চালাচ্ছিল। মাথার দু’পাশের ঝোপঝাড় কাটা হয়ে গেছে। সামনের
দিকে কিছু চুল এমন কায়দায় ছেড়ে দেয়া যে দূর থেকে গোল টুপির মত দেখাবে। সংক্ষেপে
বললে—শনিচর বিলিতি ছাঁটে চুল কাটতে বলেছে।
ও রঙ্গনাথের ডাক শুনতে পেল এবং নাপিতের পোক্ত হাত এবং মেশিনের চাপ উপেক্ষা করে ঘাড়
ঘোরাল। চোখের কোণা দিয়ে দেখে বলল—শিবপালগঞ্জের সব নাপিত কোথাও অশৌচের হাজামত করতে গেছে। তাই ভাবলাম, এবার এখানেই চুল কাটিয়ে দেখি।
বলার ভঙ্গী এমন যেন শনিচর প্রতি চারদিনে চুল কাটায়! তবে আসল কথাটা হল--- এটা রঙ্গনাথও
জেনে গেছে--- চুল কাটানোর ব্যাপারে শনিচরের খেয়াল একটু অদ্ভূত। অর্থাৎ সারা বছর না নিজে চুলে
হাত দেয়, না কাউকে ছুঁতে দেয়। হঠাৎ কোনদিন মুড হলে কোথাও ইঁট পেতে চুল কাটাতে বসে যায়।
এইরকম চুল কাটানোর চিন্তার দার্শনিক ভিত্তি কি-সেটা রঙ্গনাথ ভেবে পেল না। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে
রইল।
নাপিত যেই দেখল রঙ্গনাথ দাঁড়িয়ে পড়েছে অমনই চুল কাটা বন্ধ করে দু’আঙুলে শনিচরের মাথায় ঠেলা
মেরে বলল—উঠে পড়, তোমার হয়ে গেছে।
শোনামাত্র শনিচর উঠে ইঁটে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জেব হাতড়ে একটা দোয়ানি নাপিতের হাতে দিল। আর নাপিত সেটা না দেখেই ‘অচল’ বলে ফেরত দিল। শনিচর কোন কথা না বলে সেটি ট্যাঁকে গুঁজে আর একটি দোয়ানি নাপিতকে দিল এবং রঙ্গনাথকে চোখ মেরে ইশারা করল –এতক্ষণ নাপিতের সাথে মশকরা করছিল।
এরপর যেন কোন সেনাপতি যুদ্ধ জিতে শত্রুর রক্তে মাখামাখি হয়ে গর্বের সঙ্গে ফিরে এলেন –এমনই
ভঙ্গীতে সারা গায়ে গোছা গোছা কাটা চুল নিয়ে বীরদর্পে রঙ্গনাথের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। রঙ্গনাথ
তৎক্ষণাৎ তিন হাত পিছে সরে গেল। শনিচর রঙ্গনাথকে এই গ্রামে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় ও
বাদাম-খোঁজার গল্পটা শুনিয়ে দিল।
শনিচর বিজ্ঞের মত রায় দিল।
“শিবপালগঞ্জের যত বেনে-মহাজন-শেঠজির দল , সবকটা একেবারে যা খুশি তাই করে খাচ্ছে। দোকানে
দু’ছটাক বাদামও রাখতে পারে না”? ফের দেশের খাদ্যসংকটে যেমন দিল্লির থেকে বার বার সব ঠিক
হয়ে যাবে গোছের আশ্বাসবাণী শোনা যায় ঠিক তেমনই ঢঙে বলল, “ তবে চিন্তা কোর না, সব ঠিক হয়ে
যাবে”।
রঙ্গনাথ এবার শনিচরের কথাবার্তায় এক নবীন আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখতে পেল যা পিছিয়ে পড়া
দেশের উন্নয়নের জন্য খুব জরুরি। ভাবল, আহা এমন লোকের জায়গা তো প্ল্যানিং কমিশনে হওয়া
উচিত। ততক্ষণে শনিচরের কথাবার্তা আরও দু’চার মিনিট এগিয়ে গেছে। ও বলছিল, “বাবু রঙ্গনাথ,
শিবপালগঞ্জ এবার শুধরে যাবেই। এমন যা ইচ্ছে তাই করা চলবে না”। রঙ্গনাথ ভাবল—কথাবার্তা
বুঝি এখনও দোকানে বাদামের অভাবের সমস্যাতেই আটকে রয়েছে আর শনিচর বোধহয় বিষয়টা
অনর্থক টেনে লম্বা করছে। কিন্তু আরও খানিকটা শোনার পর বুঝল যে এসব কথার বাদামের
অমস্যার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। এ সব হল কথার কথা, যে ধরণের কথা আমরা সবাই কিছু না ভেবে
শুধু বলার জন্যেই বলি।
“--- বাবু রঙ্গনাথ, ভেবেছটা কি? এই শিবপালগঞ্জ-- সেই যে কী যেন বলে—ও হ্যাঁ, এ হল পুরো একটা
অ্যাটম বোম। যতক্ষণ ফাটেনি, ততক্ষণ ফাটেনি, শুধু সিলির-সিলির করতে থাকে। কিন্তু যখন ধড়াম
করে ফাটে তখন টের পাওয়া যায় যে মামলা ঠান্ডা নাকি গরম”।
তারপর একটা পুরনো প্রবাদ আউড়ে নিল—“ঘোড়ার লাথি শুধু ঘোড়াই সইতে পারে”।
আজ শনিচরের অবস্থা একটু অদ্ভূত লাগছে। বারবার হাত মুঠো করছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করে হাওয়া
টানছে। কখনও জোরে জোরে হাঁটছে, যেন এক্ষুণি ঘোড়ার লাথি খেয়েছে , কিন্তু সইতে পারে নি। আবার
কখনও কথা বলতে বলতে মুখ দিয়ে এমন ফেনা তুলছে যা কান অব্দি ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আজ ও চুল কাটিয়েছে। রঙ্গনাথ সব খেয়াল করেছে, কিন্তু ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছে না।
এবার ওরা একটা বড়সড় আমগাছের নীচের থেকে এগিয়ে গেল। একটা চিল জোরে ডাক ছেড়ে উড়ে গেল।
শনিচর বিরক্তিভরে বলল—“এই সালীও খামোখা চিঁ চিঁ করছে”। এক দমে আর একটা খবর ছাড়ল-
“রামাধীন ব্যাটা এবার নিজে আখড়ায় নামছে”।
দুটো উক্তির সম্বন্ধ বুঝতে অপারগ রঙ্গনাথ জিজ্ঞেস করল—“কোন আখড়ায়”?
শনিচর এমন সহজ প্রশ্ন শুনে তাজ্জব, উত্তর দিল না। বরং গায়ের থেকে কাটা চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে
দিতে দিতে বলল, “ হবে, এরও ওষুধ আছে। দেখতে থাকো। অ্যাটম বোম ফেটে যাক”।
আমবাগান ফুরিয়ে গেল। এবার ওরা সেই জায়গাটায় এসেছে যেখান থেকে কাশবন শুরু। পাকদণ্ডী
রাস্তায় রঙ্গনাথ সামনে চলেছে যাতে শনিচরের কাটা চুল হাওয়ায় উড়ে ওর দিকে না আসে।
আচমকা ও থেমে গেল।
কাশবনের ডালপালায় এক আশ্চর্য দৃশ্য! পথের দু’পাশে প্রায় একশ গজ জুড়ে কাশের ডগায় গিঁট বাঁধা,
যেন কাঠপুতলি নাচের স্টেজ জুড়ে সারি সারি কাঠপুতলি সেপাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা লোক
আরও নতুন নতুন গিঁট লাগাতে ব্যস্ত।
শনিচর ষাঁড়ের মত হাম্বারবে বলল—“আবে ও খডুস? এটা কি হচ্ছে”? তারপর রঙ্গনাথকে বলল,
“দেখছ এই গোঁয়ারগোবিন্দগু বেয়াড়াগুলোকে? গোটা জঙ্গল নষ্ট করে দিল। কে জানে কোন উল্লুক এই
গিঁট লাগিয়েছে”!
রঙ্গনাথ চমকে উঠে শনিচরকে ভাল করে দেখল। আজ যেন গালির ফোয়ারা একটু বেশি ছুটছে। বলল,
“এই গিঁট লাগানোয় কারও কোন ক্ষতি তো হচ্ছে না”?
“হচ্ছে না মানে? জেনে রাখ, এই জমি শিবপালগঞ্জ গ্রামসভার। বুঝলে বাবু রঙ্গনাথ”? বীরদর্পে এই
ঘোষণা করে ও গিঁট বাঁধতে থাকা লোকটাকে গালি দেবার উদ্দেশ্যে উটের মত ঘাড় উঁচু করল, আর ওই
ব্যাটা নারীদেহের কোন অঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে তার বর্ণনা দিয়ে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,”কাশের
গোছা তোমার বাপের”?
লোকটা পালটা জবাব দিল, “না তো কি তোমার বাপের”? ঝগড়া থামাতে রঙ্গনাথ মাঝখানে দাঁড়িয়ে
বলল—গালিগালাজ বন্ধ কর, ভাই”। ফের ঠান্ডা নরম স্বরে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এটা কী
করছ”?
“যা গোটা দুনিয়া করছে, আমিও তাই করছি”, ও ঘাড় গোঁজ করে কড়া মেজাজে জবাব দিল-- যেন ও
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মৌলিক কাজটি করছে।
শনিচর বলল,”এটা জানা আছে কি যে জায়গাটা শিবপালগঞ্জের গ্রাম-সভার গায়ে লাগা, আর গিঁট বাঁধলে
কাশের বেড়ে ওঠা অসম্ভব হবে? কোন খবরও রাখ না। চালান হয়ে গেলে পালিয়ে বেড়াবে। তখন তোমার
এই ‘গোটা দুনিয়া’ কোন কাজে আসবে না”।
--“কোন সালা আমার চালান করবে”?
--“চালান তোমার সালা নয়, বোনাই করবে! আমি! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখ, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে
আছি—মাত্র পাঁচহাত দূরে”।
রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে নিজের কথাটা আরও স্পষ্ট করল, “হ্যাঁ, রঙ্গনাথ বাবু এই আমি! আজই
যাচ্ছি প্রধান হওয়ার কাগজ জমা করতে। আর পনের দিন, ব্যস্। তারপর দেখে নিও রামাধীনের বুকে
চেপে বসে এখানে আসব। তারপর দেখব—কোন সালা আমার গ্রামসভার একগাছিও এদিক ওদিক করে”!
ও হো! তাহলে এই হল ব্যাপার। তাই ইংরেজ-ছাঁটে চুলকাটা হচ্ছে আর গাছের উপর বসা চিলের ডাকে
রাগ চড়ছে! অ্যাটম বোম ফাটবে! তাই গ্রামসভার জঙ্গল নিয়ে এতসব হুকুম জারি!
এবার গোটা ব্যাপারটা রঙ্গনাথের মাথায় ঢুকল। “নমিনেশন পেপার আজকেই জমা দেবে”?
“এখুনি! এই মুহুর্তে”! কাগজ আগে জমা করব, চান-টান পরে”। শনিচরের আবেগ তুঙ্গে। ও কাশের গিঁট
বাঁধতে থাকা লোকটার উপর হালকা নজর বুলিয়ে দেখতে চাইল এই ঘোষণার প্রভাব কতটুকু পড়েছে।
কিন্তু ফলাফল স্পষ্ট। শনিচরের উত্তেজনার প্রভাব শনিচরের মধ্যেই আটকে রয়েছে,--যেমন
আমাদের দেশের এশিয়া ও আফ্রিকার নেতা হওয়ার দাবি। ওই লোকটি ঠান্ডা মাথায় ধীর স্বরে বলতে
লাগল—ঠিক আছে, তুমিই না হয় গ্রামসভার প্রধান হলে। কাউকে না কাউকে তো হতেই হয়”। তারপর
তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “এইসব গ্রাম-পঞ্চায়েতও আসলে কি? একরকম সরকারি তামাশা”।
শনিচরের মনে হল ওকে অপমান করা হয়েছে। বলল, “বেশ, তামাশাই বটে। তবে পনের দিন পরে দেখে
নিও—কাশের একটা ডগা ছুঁলেও কী হতে পারে”।
লোকটি বেশি পাত্তা না দিয়ে বলল, “যদি তাই হয় তাহলে ছোঁব না। এই গিঁটলাগানো পুজো তো
শিবপালগঞ্জ থেকেই শুরু হয়েছে, ওখানেই থেমে যাবে”।
রঙ্গনাথ দেখল লোকটির সামনে কয়েক ডজন গিঁট লাগানো কাশ। বলল, “এটা আবার কিসের পুজা”?
--“কী জানি কিসের! শুনেছি হনুমানজি ওখানে কারও স্বপ্নে এসেছিলেন। ওনার হুকুম মেনে সবাই গিঁট
লাগাচ্ছে”।
শনিচর ঘাবড়ে গিয়ে হাত জোড় করল।
“তাহলে খুশিমত গিঁট বাঁধো ভাই। ধরম- করম নিয়ে কোন কথা হবে না”। কথাটা বলার পর ও মস্তিষ্কে
যতটুকু ঘিলু ছিল তার উপযোগ করে ভাবতে লাগল এবং রঙ্গনাথকে বলল, “ কিন্তু বাবু রঙ্গনাথ, আমি
তো এরকম কিছু শুনিনি। কার স্বপ্নে হনুমান এসেছিলেন? যখন সকালে এসেছিলাম, কাশের বনে কোথাও কোন গিঁট দেখিনি তো”।
রঙ্গনাথ উবাচ—“আমি কিছু জানি না। তবে আমাকে মামা বলেছিলেন -ওদিকে যাচ্ছ যখন কাশের ডগায়
একটা গিঁট বেঁধে দিও। তো আমি একটা বেঁধেছিলাম। মামাজী বলেছিলেন –এটা হনুমানজীর গিঁট”।
শোনামাত্র শনিচরের উপর হনুমানজীর ভর হল। লেজহীন বাঁদরের মত লাফ মেরে ও কাশবনের একটা
উঁচু ডালের কাছে পৌঁছে গিঁট বাঁধতে লেগে গেল। বাঁধতে বাঁধতে বার কয়েক ‘জয় বজরঙ্গ’ বলে চেঁচালো,
রামাধীনের উদ্দেশে গোটা কয়েক গালি দিল, শেষে বলল “সচ্চে কা বোলবালা হ্যায়, দুশমন কা মুঁহ কালা
হ্যায়”।
সত্যেরই হয় জিত, শত্তুর হবে চিৎ!
রঙ্গনাথ জুড়ে দিল, “রাম-নাম সত্য হ্যায়, সত্য বোলো মুক্তি হ্যায়”।
ভাগ্যিস এটা শনিচর শোনে নি, তাহলে খেপে যেত। কারণ, এই শ্লোগান শবযাত্রায় দেয়া হয়। তবে
ধার্মিক মতে এটা তো খাঁটি কথা আর রামনামের সঙ্গে যুক্ত কোন ধ্বনি যে কোন উপলক্ষে যেকোন
পরিস্থিতিতে দেয়া যায়। শনিচর একটা গিঁট বেঁধে ফের হনুমানজীর নাম নিল আর নিজের
আন্ডারওয়ারের পেছনে লেজ না থাকা সত্ত্বেও হাত মুছে দ্রুতগতিতে কাজ করতে করতে এগিয়ে চলল।
রঙ্গনাথের মনে ধীরে ধীরে শান্তি এবং আত্মগৌরবের এক ছায়া ঘনিয়ে এল। কিছু না ভেবেই আজ ও
এক নব-সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করে ফেলেছে। এর দর্শন-পুরাণ-কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে
একটাই—কাশের ডগায় গিঁট বাঁধো।
ও নিজেকে বুদ্ধ, মহাবীর , শংকরাচার্যের সঙ্গে একসারিতে দেখতে পেল। তারপর নিজের মনে
নিজেকেই প্রশ্ন করল,”ওস্তাদ, আমাকে তো চেনা আছে। কিন্তু তোমার কথা বল। এক নবীন
সম্প্রদায় সৃষ্টির চিন্তা তোমার মাথায় এল কী করে”?
(চলবে)
0 comments: