0

সম্পাদকীয়

Posted in

































ধর্ম বিষম বিড়ম্বনা। এর স্বনিযুক্ত ধ্বজাধারীরাই আবহমান কাল ধরে কালিমা অর্জনের কাজটি খুবই নিপুণভাবে করে আসছেন। সম্প্রতি এক ধর্মীয় উৎসবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এই ভাবনাটি প্রাসঙ্গিক মনে হল।

আসলে এই যে উৎসবকে আমরা ধর্মীয় তকমা দিয়ে থাকি, তার মূল চলনটি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক। এই সূত্রটি ছিন্ন হলে কোনও ধর্মীয় উদ্‌যাপনই তার প্রার্থিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। একথা খুব কম মানুষই মাথায় রাখেন আর ধর্মীয় নেতাদের কাছে এর তাৎপর্য ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশের নানা প্রান্তে। অথচ তারা জুড়ে গেল একটি নাছোড় যোগসূত্রে। সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহরে উর্দু কবি ও চিন্তক জাভেদ আখতার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে আর বুকার প্রাইজ জয়ী লেখক এবং সামাজিক কর্মী বানু আখতারকে আহ্বান জানানো হয়েছিল তাঁরই নিজের রাজ্য কর্নাটকের দসেরা উৎসবের উদ্বোধনে অংশগ্রহণের জন্য। দুটি ক্ষেত্রেই দুই ভিন্ন ধর্মের অনুশাসনে বাধা পড়ল স্বাধীনচেতা দুজনের গতিবিধিতে।

বলা হয়ে থাকে public memory is short - তবুও হয়তো অনেকেরই মনে আছে প্রগতিশীল বামপন্থী জমানায় ধর্মীয় ফতোয়ার জেরেই শহর ছাড়তে হয়েছিল তসলিমা নাসরিনকে। সেই লজ্জার ক্ষত আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তাতে যুক্ত হল আরও একটি।

সপ্তাহকাল পর বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ মিলনমেলা। দেশ ও বিশ্ব নানান কারণে টালমাটাল এমন এক পরিস্থিতিতে। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়' - সেই মানবতার ধর্মই যেন দেবীর অঞ্জলির মন্ত্র হয়ে ওঠে!

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শারদ শুভেচ্ছা!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in





 




গৌরচন্দ্রিকা

 সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) একটি স্পর্শকাতর বিতর্কিত বিষয়। 

   এই বিতর্কের ফ্রেমে রয়েছে মুখ ফুটে না বলা একটি প্রেমিস- হিন্দুসমাজের আইনে মেয়েরা অনেক বেশি জেন্ডার ইকুয়ালিটি এবং স্বাধিকারের স্বাদ পায়, তাই সমাজের বাকি অংশ ওদের অনুসরণ করবে –এটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই হওয়া উচিত। 

  এর প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভাবছেন যে রাষ্ট্র তাঁদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে খামোকা নাক গলাচ্ছে যা  হওয়া উচিত নয়। 

 গত ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ বিজেপি সাংসদ কিরোড়ী লাল মীণা রাজ্যসভায় একটি প্রাইভেট  মেম্বার্স বিলে পেশ করেছিলেন যার সার কথা হল দেশে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান আচার সংহিতা জারি করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হোক।  

সেই কমিটি যথাসময়ে রায় দিয়ে জানিয়েছে যে এই ইউনিফর্ম সিভিল কোড দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বড্ড দরকারি।

তবে এটা নিয়ে আইন প্রণয়নের অধিকার রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের বিধানসভার আছে। ভারতে  গোয়া হল প্রথম রাজ্য যেখানে ১৮৬৭ সাল থেকে পর্তুগীজদের তৈরি ইউনিফর্ম  সিভিল কোড চলছে। 

স্বাধীন ভারতে উত্তরাখণ্ড প্রথম রাজ্য, যারা জানুয়ারি ২৭, ২০২৫ তারিখে ইউসিসি বা “সমান নাগরিক সংহিতা”কে আইন হিসেবে ঘোষণা করেছে। এগুলো নাকি আগামী দিনে বাকি রাজ্যের জন্যে পথ দেখাবে। সম্ভবতঃ আসাম হবে দ্বিতীয় রাজ্য যারা ইউসিসি প্রণয়ন করবে। 

তবে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও জল মাপছে। কেন্দ্রীয় স্তরে আইন পাশ করেনি। 

এই শব্দকল্পদ্রুমের পরিবেশে বর্তমান প্রবন্ধে নিচের বিন্দুগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। মোদ্দা কথা-- ইউনিফর্ম সিভিল কোড ব্যাপারটা কী? এবং এটা যদি সবার জন্যে উইন -উইন গেম হয় তাহলে আপত্তির কারণ কী? এ নিয়ে কতদূর চেষ্টা করা হয়েছে এবং কোথায় আটকাচ্ছে? 

সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড 

যেকোন দেশের আইনকানুনকে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

এক, ক্রিমিনাল কোড –যা রাষ্ট্র এবং সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ; এর আওতায় আসবে চুরি-ডাকাতি, খুনজখম, শারীরিক  আক্রমণ, ধর্ষণ ইত্যাদি। 

দুই, সিভিল কোড—যা্র ভিত্তি হল  এক দেশ বা সমাজে বাস করার আচরণ বিধির সামাজিক কন্ট্র্যাক্ট। এতে রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি, বিচ্ছেদ, এবং সম্পত্তির কেনাবেচা, ব্যবসার নিয়ম, উত্তরাধিকার এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন ইত্যদি। 

ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান নাগরিক আচার সংহিতাঃ

কিন্তু এইখানে এসে কি একটু গুলিয়ে যাচ্ছে?

অনেক লিব্যারাল আধুনিক ভাবনা-চিন্তার লোকজন বলছেন যে  ক্রিমিনাল কোড তো জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশের সমস্ত নাগরিকের জন্যে সমান। খুন-চুরি-ডাকাতির অপরাধে শাস্তি দেবার সময় আইন বা রাষ্ট্র নাগরিকের জাতধর্ম দেখে না, একই আইনে একই শাস্তি দেয়। তাহলে একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রে সিভিল কোড এক হবে না কেন? 

--ভাল কথা; কিন্তু সিভিল কোডের অন্তর্গত অনেকগুলো আইন তো মূলতঃ সবার জন্যেই সমান! 

ব্যবসা করতে কন্ট্র্যাক্টের নিয়ম ও আইন, সেলস্‌ অফ গুডস অ্যাক্টের আইন, জি এস টি, ইনকাম ট্যাক্স, রেজিস্ট্রির নিয়ম, জমি বাড়ি সম্পত্তি কেনাবেচার আইন, মর্টগেজ বা সম্পত্তি বন্ধক রাখার আইন –সবই তো হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানী সবার জন্যে এক। তাহলে?

--আছে, তফাৎ আছে। ভারতবর্ষে সিভিল কোডের অন্তর্গত কিছু বিষয় বিভিন্ন ধার্মিক এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্যে আলাদা। সেগুলো হল মুখ্যতঃ তিনটি-- বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি এবং বিচ্ছেদ; সম্পত্তির উত্তরাধিকার, এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন।

সমান নাগরিক আচার সংহিতার সমর্থকেরা চাইছেন- ওই তিনটে ব্যাপারেও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্যে আলাদা আলাদা নিয়ম বন্ধ হোক।  সব ধুয়ে মুছে এক হয়ে যাক, ঠিক স্কুল ইউনিফর্মের মত।  

এখানে কর্ণাটকের স্কুলের হিজাব-বিতর্ক মনে পড়া স্বাভাবিক। 

আমরা সংক্ষেপে আলোচনার সুবিধের জন্যে দেশের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মভিত্তিক  সম্প্রদায়ের (হিন্দু ও মুসলিম) কোড বিল নিয়ে আলোচনা করব। 

হিন্দু কোড বিল এবং মুসলিম পার্সোনাল ল’

হিন্দু ল’ এবং মুসলিম ল’এর গোড়ার কাঠামোটি তৈরি হয়েছে কোম্পানির আমলে ক্রমশঃ ১৭৮৩ এবং ১৭৮৫ সালে, অর্থাৎ প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহে এবং প্রাচ্যবিদ্‌ উইলিয়াম জোন্সের অধীনে কিছু টুলো পণ্ডিত এবং মৌলবীদের ডেকে বিভিন্ন স্মৃতি বা সংহিতা (মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি) এবং কুরানশরীফ ও হাদিস্‌ ঘেঁটে। 

স্বাধীন ভারতে প্রণীত হিন্দু কোড বিলের (১৯৫৫-৫৬)  অন্তর্গত রয়েছে চারটে আইন—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৫; হিন্দু সাকসেসন অ্যাক্ট; হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট এবং হিন্দু অ্যাডপশন (দত্তক নেয়া) এবং  মেইন্টেন্যান্স (খোরপোষ) অ্যাক্ট।  

তেমনই ভারতের মুসলিমদের রয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাক্ট ১৯৩৭। এতে বিয়ে, তালাক, খোরপোষ, দান-দক্ষিণা সব কিছুর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে মুসলিম জীবনযাপন পদ্ধতির নির্দেশের ব্যাপারে চারটি উৎসকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। 

সেগুলো হলঃ কুরআন, সুন্না বা অহল -এ- হাদিস (হজরত মহম্মদের নিজের আচরণে যা  সিদ্ধ), কিয়াস (ব্যখ্যা টীকা ভাষ্য ইত্যাদি) এবং ইজমা ( বিদ্বানদের সর্বসম্মত ব্যাখ্যা)।  

এছাড়া রয়েছে পলিগ্যামি অ্যাক্ট ১৯৫৬; যার মাধ্যমে ভারতে  বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হলেও মুসলিমদের (অধিকতম চারজন স্ত্রী পর্য্যন্ত) এবং গোয়া ও পশ্চিম উপকূলের কিছু অঞ্চলে অন্য সম্প্রদায়ের জন্যেও একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী আইনসম্মত।

বলে রাখা ভাল বর্তমান বিশ্বে (২০২২ পর্য্যন্ত) ২০০টি দেশের মধ্যে ৫৮টি দেশে বহুবিবাহ আইনসম্মত; এর অধিকাংশই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের।

এখানে একটা ডিস্‌ক্লেমার দিয়ে রাখি। আইন যাই হোক, এখন বিশ্বের সর্বত্র, এমনকি ভারতের আদিবাসী এবং মুসলিম সমাজেও একপত্নীই দস্তুর। 

তার দুটো কারণ।

এক, এই ধরণের সিভিল আইনগুলো প্রেস্ক্রিপটিভ, ডিটারেন্ট নয়। যেমন হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন মানে এই নয় যে সমস্ত বিধবাকেই বিয়ে করতে হবে বা সব পুরুষকে বিধবাকেই বিয়ে করতে হবে বা তাদের শাস্তির ভয় দেখিয়ে  বাধ্য করতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দকে স্থান দেওয়া হয়েছে, করলে কোন বাধা নেই—এই আর কি! 

তেমনই মুসলিম সমাজে  দুই বা চার বিয়ের অনুমোদন মানে এই নয় যে সবাইকেই বেশি বেশি করে বিয়ে করতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতে মুসলিম সমাজেও প্রথম স্ত্রীর বর্তমানে তাঁর অনুমতি বিনা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের নিয়ম নেই। এটা আমরা পশ্চিম বঙ্গে নিজেদের চারদিকে মুসলিম লোকজনের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। দু’একটা ব্যতিক্রম ধর্তব্যের মধ্যে  নয়। 

দুই, আর্থিক, সামাজিক এবং চেতনার বিকাশ।

এখন মেয়েরা বেশি বেশি করে চাকরি বা আর্থিক রোজগারের জীবিকার দিকে ঝুঁকছেন, শিক্ষার প্রসার হচ্ছে। তাঁরা পড়াশুনো করে স্বতন্ত্র রোজগারের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। নিজেদের স্বাস্থ্য এবং শরীরের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন।

 ইউনিফর্ম সিভিল কোড মানে—ওইসব বিভিন্ন আইন বাতিল করে সবার জন্য কোন ধার্মিক রেফারেন্স ছাড়া একটাই আইন চালু করা। 

 আচ্ছা, তাতে অসুবিধা কী? বেশ আধুনিক এবং প্রগতিশীল শোনাচ্ছে তো। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারতে এরকমটা হওয়ারই কথা তো! অসুবিধেটা কোথায়?

সংবিধান সভার আর্টিকল ৪৪ এ নেহরুজি এমনই কিছু বলেছিলেন কিনা? 

--বলেছিলেন বটে, কিন্তু অসুবিধেটাও তখনই স্পষ্ট হয়েছিল। কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান প্রণয়ন সভার  ২৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ এর বিতর্কটি দেখলেই বোঝা যাবে। 

বোম্বাই থেকে কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধি স্বাধীন দেশের জন্যে ধর্মের অনুশাসনের উর্দ্ধে উঠে একটি সমান নাগরিকতার পক্ষে যুক্তি দেন। বিরুদ্ধে মাদ্রাজ এবং বিহারের প্রতিনিধিরা বলেন –এতে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বিবিধতা নষ্ট হবে। ঐক্য এবং একরূপতা এক কথা নয়।

শেষে একবছর পরে ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৯ সালে সংবিধান সভার এই বিষয়ে বিতর্ক সমাপ্ত করে নেহরু বললেন—তাড়াহুড়ো না করে এই প্রগতি জনতার উপর চাপিয়ে না দিয়ে  ধীরে ধীরে জনতার মধ্যে চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ওদের সম্মতি নিয়ে ট্র্যাডিশনে পরিবর্তন আনতে হবে। এবং ওঁর পরামর্শ মত ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ধারণাটিকে সংবিধানের ডায়রেক্টিভ প্রিন্সিপলের (মার্গদর্শী সিদ্ধান্ত) অধীনে আর্টিকল ৪৪ এ নিচের শব্দে বাঁধা হলঃ

Article 44. Uniform civil code for the citizens.

The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India.

ঠিক আছে, কিন্তু করে ফেলতে কিসের অসুবিধে? সত্তর বছর হয়ে গেল যে! 

হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে

--দেখুন, হিন্দুদের স্মৃতিশাস্ত্রে বিহিত আটরকমের বিয়ের মধ্যে শুধু ‘প্রাজাপত্য’ই আজকাল চলছে। এতে বাবা বা তাঁর অবর্তমানে পরিবারের কোন গুরুজন  ‘কন্যাদান’ করে আর বিয়ের কার্ডে প্রজাপতির ছবির নীচে ‘প্রজাপতয়ে নমঃ’ লেখা থাকে। প্রজাপতির নির্বন্ধে ডিভোর্সের কথাই ওঠে না, জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে হাঁসফাস করলেও। 

অবশ্য আজকাল যেটাকে লাভ ম্যারেজ বলা হয় সেটা মনু’র গান্ধর্ব বিবাহের (বর কনে নিজেদের সম্মতি বা পছন্দের হিসেবে)  আধুনিক রূপ মাত্র। 

তবে ইদানীং হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে কিছু সংশোধন হয়েছে। তাই সময়ের দাবিতে কিছু শর্ত  সাপেক্ষে ডিভোর্সের সুযোগ রয়েছে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে সপ্তপদী গমন এবং যজ্ঞ একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান। আর রয়েছে (হিন্দি বলয়ে) সাতটি শপথ (সাতোঁ বচন) নেওয়ার কথা, যেমন পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা- ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়া, ইত্যাদি। 

মুসলিম বিয়ে

কিন্তু মুসলিম বিয়ে হল পিওর কন্ট্র্যাক্ট। বিয়ে মসজিদে না হয়ে কারও বাড়িতে (কন্যার ঘরে)  হয়। পুরোহিতের স্থানে কাজি বসেন বটে, তবে পাঁচ জন সাক্ষী রেখে কন্যাকে বসিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়—আপনি কি অমুককে  কবুলনামায় লেখা শর্ত অনুযায়ী জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করতে রাজি?  

কন্যা তিনবার ‘কবুল’ বললে একই কন্ট্র্যাক্টের পাঁচ কপিতে ওরা দুজন, কাজি এবং সাক্ষীদের সইসাবুদ হয়ে গেলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ওদের দুজন এবং সাক্ষীদের কাছেও একটি করে ওই নিকাহ্‌নামা বা চুক্তির কপি থাকে। তাতে কন্যার সিকিউরিটি হিসেবে পূর্বনির্ধারিত ‘দেনমোহর’ কত টাকা তার উল্লেখ থাকে। বিয়ের সময় ওই টাকা মেয়ের হাতে দিতে হয়। 

যদি কিছু বকেয়া থাকে সেটা ডিভোর্স বা তালাক দিলে তখন দিতে হয়। একেবারে কন্ট্র্যাক্ট ও তার কনসিডারেশন! তবে বাস্তবে কী হয় সেটা অন্য প্রসংগ। 

চুক্তি বলেই মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্টে  তিন রকমের তালাকের প্রথা রয়েছে—আহসান, হাসান, এবং বিদ্যৎ।  ভাববার সময় না দিয়ে যখন মর্জি তখন তিনবার ‘তালাক’ বলে স্ত্রীকে ঘরের বাইরে করে দিলাম-এটাই ওই বিদ্যৎ তালাক। এটা প্রথাসিদ্ধ কিন্তু শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাই অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই রকম তালাক উঠে গেছে।

ভারতেও সুপ্রীম কোর্টের রায় মেনে আইন করে শুধু ওই তালাক-এ-বিদ্যৎ নিষিদ্ধ হয়েছে, বাকি দুটো নিয়ম যথাবৎ আছে।  

ক্রীশ্চান ম্যারেজ  অ্যান্ড ডিভোর্স অ্যাক্টের (১৮৭২) অনুষ্ঠান চার্চে হতেই হবে। কিন্তু ইসলাম ও ক্রিশ্চানিটি দুটোই আব্রাহামিক ধর্ম, তাই অনুষ্ঠানে কিছুটা মিল রয়েছে। পাদ্রী সবার সামনে ব্রাইডকে তিনবার জিজ্ঞেস করে সম্মতি পেলে পরমপিতা পরমেশ্বরের আশীর্বাদে বা দৈব ইচ্ছায় ওই জোড়াকে তখন বিধিসম্মত স্বামী-স্ত্রী বলে ঘোষণা করেন। তারপর বলেন –এখন তোমরা একে অপরকে চুমো খেতে পার।   

তখন ওরা সবার সামনে একে অপরকে চুমো খায়, ব্যস্‌।

হিন্দুদে্র শুধু মালাবদল হয়, সবার সামনে চুমো-টুমো খাওয়ার সুযোগ নেই।  এবার বলুন, এই তিনরকমের বিয়ের আইন তুলে দিয়ে কী করতে চান? কেমন কোড আনতে চান?

চুমো খাওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ভবিষ্যতে আইন মেনে চুমো খেতে হবে?

সাক্ষীসাবুদ-দেনমোহর করে রীতিমত চুক্তিপত্রে সই করে বিয়ে দেওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ওইরকম করতে হবে?

সপ্তপদী, যজ্ঞ, অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই তাই করতে হবে? 

আরও আছে। হিন্দু তেলুগু সম্প্রদায়ে মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে সবচেয়ে উত্তম সম্বন্ধ ধরা হয়। আমার এক কলীগ তিনভাই। ওরা ওদের আপন মামার মেয়েদের বিয়ে করেছে। 

এটা কি বাদ যাবে? নাকি সবাইকে মামাতো পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করতে হবে? 

মুসলমানদের মধ্যেও তুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করার চল আছে।ওদের হয়তো অসুবিধে হবে না? কিন্তু আমাদের, মানে উত্তর এবং পূর্ব ভারতীয় হিন্দুদের?

এছাড়া দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের বিয়ে হয় সাধারণতঃ মন্দিরে, যেমন ক্রিশ্চানদের হয় চার্চে। কিন্তু অন্য হিন্দুদের এমন নয়। 

তারপর অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হিসেবে ভারতে  ৪৬০০ আদিবাসী সম্প্রদায় আছে যাদের পূজার্চনা এবং বিবাহ সংস্কারের নিয়ম আমাদের থেকে ভিন্ন। ওদের সংস্কৃতিকেও কি দুরমুশ করে আমাদের মত করতে হবে? 

--ভাল জ্বালা! তার চেয়ে বিয়ের জন্যে এমন একটা আইন করা যায় না যাতে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে , নিজেদের জাত ধর্ম বাবা-মার অনুমতির তোয়াক্কা না করে ধর্মের দোহাই না দিয়ে বিয়ে করতে পারে? তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

  সে আইন তো কবেই হয়ে গেছে—স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪। অর্থাৎ হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের (১৯৫৫) একবছর আগে। তাতে শুধু ছেলের বয়েস ২১ হতে হবে, আর মেয়ের ১৮।। তবে প্রধানমন্ত্রী বলছেন শিগগিরই মেয়েদের বয়েসও আইন করে বাড়িয়ে ২১ করে দেওয়া হবে, ভাল কথা। কিন্তু মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্টে কনের বয়স ১৫ হলেই যথেষ্ট, কয়েক দশক আগে হিন্দুদেরও তাই ছিল। 

তফাৎ হল—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে আগে বিয়ে, পরে রেজিস্ট্রি। স্পেশ্যাল অ্যাক্টে আগে দরখাস্ত দিলে রেজিস্ট্রার দেবে একমাসের নোটিস, তারপরও যদি মিয়া-বিবি রাজি থাকে, তবে একই সঙ্গে রেজিস্ট্রি এবং বিয়ে। 

 তাহলে আর হৈ চৈ কিসের? 

কারণটা রাজনৈতিক, পরে আসছি। আগে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বলি।

হিন্দু ও মুসলিম কোডে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার

 হিন্দু কোড বিলে মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে কোন অধিকার ছিল না। প্রথমে সংশোধিত হয়ে মেয়েদের বসবাসের অধিকার স্বীকৃত হল, কিন্তু মালিকানা হক নয়। পরে ২০০৫ সালের সংশোধনে ভাই এবং বোনের সমান অধিকার স্বীকৃত হল। তারপর ২০২২ সালের একটি রায়ে সুপ্রীম কোর্ট বললেন যে বিবাহিত মেয়েরাও ভাইয়ের সমান অংশীদার, সমান ভাগ পাবে।

মুসলিম কোডে কিন্তু প্রাচীন কাল থেকেই সম্পত্তিতে বাবা-মায়ের পৈতৃক এবং স্বোপার্জিত সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত, সে বিবাহিত হলেও।  তবে সবসময় সেটা ছেলেদের সমান ভাগ নয়, কখনও ১/২, কখনও ১/৪। 

ব্যাপারটা বেশ জটিল। এর জন্যে উপযুক্ত সংস্থা হল ল’ কমিশন। ওদের দিয়েই এসব আইন ও ট্র্যাডিশনের  প্যাঁচ খুলে একটি আধুনিক সিভিল কোডের খসড়া বানানো হোক। 

তবে ল’ কমিশন কোন সাংবিধানিক(constitutional) অথবা বৈধানিক  (statutory) সংস্থা (body) নয়। এটি বিশুদ্ধ প্রশাসনিক  সংস্থা যা ভারত সরকারের নির্দেশে কোন নিশ্চিত ইস্যুতে এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য গঠিত হয়। 

এর দায়িত্ব হল আইনের সংস্কারের ব্যাপারে রিসার্চ করে সরকার চাইলে বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে  পরামর্শ দেওয়া। 

বর্তমান ভারত সরকার ইউ সি সি’র বিষয়ে ২০১৬ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি  জাস্টিস বি এস চৌহানের অধ্যক্ষতায় ২১ তম ল’ কমিশন গঠন করে।

 উনি এ’ব্যাপারে আম নাগরিক এবং সিভিল সোসাইটির অভিমত এবং পরামর্শ জানতে চেয়ে ৩/১০/২০১৬ তারিখে এক ১৬ বিন্দু প্রশ্নাবলী  সম্প্রচারিত করেন। নভেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় দশ হাজার উত্তর এবং মতামত পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে প্রেসকে জানিয়েও দেন।  

কিন্তু উনি ২০১৮ তে কোন রিপোর্ট পেশ না করেই অবসর নেন।     

অবশেষে ভারত সরকার গত ৮/১১/২২  তারিখে কর্ণাটক হাইকোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চিফ জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থীর অধ্যক্ষতায় ২২তম ল’ কমিশন গঠন করেছে। জাস্টিস অবস্থী কর্ণাটকের বিবাদিত হিজাব মামলার রায়দাতা যা কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের নীতিতেই সীলমোহর লাগিয়েছে। 

আশা ছিল,  মার্চ ২০২৩ নাগাদ ল’ কমিশন ইউ সি সি ইস্যুতে তাঁদের রেকমেন্ডেশন বা সুপারিশ ভারত সরকারকে জানিয়ে দেবেন।   কিন্তু মে’ ২০২৩ সাল এসে গেল, কমিশন নিশ্চুপ। 

সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) ও রাজনীতি

আসলে সমান আচার সংহিতা নিয়ে এত আগ্রহের পেছনে রয়েছে আরেকটি ইস্যু – মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। 

মোদীজি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিজেপি ও আর এস এসের  ঘোষিত তিনটে এজেন্ডা ছিল –রাম মন্দির নির্মাণ, সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড। এর জন্যে দরকার ছিল বড় মাপের সংখ্যাগরিষ্ঠতার।  সেটা পাওয়া গেল ২০১৯ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে। 

ব্যস্‌ ব্রুট মেজরিটির জোরে ৫ অগাস্ট ২০১৯ সালে বাতিল হল আর্টিকল ৩৭০, অবশ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ইত্যাদির আলাদা আইন, আলাদা পতাকার অনুমতি নিয়ে আর্টিকল ৩৭১ আগের মতই রয়ে গেল। 

 তারপর ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে অযোধ্যা মামলার রায় বেরোল। ৫ অগাস্ট ২০২০তে সংসদে মন্দির নির্মাণের জন্য বিশেষ ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা হল।

 বাকি রইল একটাই—সমান নাগরিক আচার সংহিতা, ইউনিফর্ম সিভিল কোড।

এতসব চেঁচামেচির একটাই লক্ষ্য—মুসলিম আইনে যে চারটে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে সেটা বাতিল করে সবাইকে এক পত্নীব্রতে থাকতে বাধ্য করা। 

ওদের যুক্তিঃ বেশি পত্নী মানেই বেশি সন্তান; এর মানে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তার মানে কোন এক ভবিষ্যতে ওরা মেজরিটি হবে এবং আমাদের দেশকে ফের ভাগ করবে। 

এটা খোলাখুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতারা এটাকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মোড়কে গম্ভীর মুখে বলে থাকেন।

  প্রধানমন্ত্রী সে’ বছর স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের কথা বলে এটাকে ‘a form of patriotism’  আখ্যা দেন। অর্থাৎ যাদের সন্তান বেশি তারা দেশকে ভালবাসে না। 

উনি সেটা বলতেই পারেন। ওঁরা পাঁচ ভাই, এক বোন। আবার উত্তর প্রদেশের  যোগীজিরা হলেন চার ভাই, তিন বোন

মোদীজির ভাষণের একই দিনে ১৫ই অগাস্ট, ২০১৯শের  স্বাধীনতা দিবসে আসাম সরকার ঘোষণা করে দিল যে যাদের দুটোর বেশি সন্তান রয়েছে তারা সরকারি চাকরি পাবে না এবং স্থানীয় স্তরে কোন নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না।

অবশ্য তখন এন ডি এ জোট থেকে বেরিয়ে এসে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে বলেছিলেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নতুন আইনের দরকার নেই। ওঁর একটিই সন্তান।  

এদিকে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং  ইউপির মুজফফরনগর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ  সঞ্জীব বালিয়ান সেই ২০১৯ থেকে নিয়মিত সংসদে বলছেন ভারতে জনসংখ্যা যে হারে বেড়ে চলেছে যে রিসোর্সে টান পড়ছে, করদাতাদের উপর বোঝা বাড়ছে, এখনই ১৩৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে, ভবিষ্যতে কী হবে? ওঁর আবেদনে ১২৫ জন সাংসদের সই ছিল।  

তবে  ডঃ রাকেশ সিনহার (আর এস এস বুদ্ধিজীবি এবং রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য) তিনবছর আগে  পেশ করা বিলটিকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য  এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মনসুখ মণ্ডাভিয়া অপ্রয়োজনীর বলে মতপ্রকাশ করে খারিজ করে দেন।   

ওনার মতে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর আশংকাজনক নয়।  জোর করে প্রতি পরিবার দুই সন্তানের লক্ষণরেখা টেনে দেওয়ার দরকার নেই। সরকারের প্রচেষ্টায় জনতা এখন অনেক জাগরুক, বাকিটুকু শিক্ষার আরও প্রসার হলেই হয়ে যাবে।   

তখন রাকেশ সিনহা বিলটি প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু উত্তর প্রদেশ সরকার দুই সন্তানকে বাধ্যতামূলক করার খসড়া বিল জুলাই ২০২১ শে বিধানসভায় পেশ করে। 

তবে জুলাই, ২০২১ এর সংসদে  দুই বিজেপি এম পির প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী  জানিয়েছিলেন যে NFHS III(2005-06) সার্ভে হিসেবে TFR 2.7 ছিল, তারপর NFHS IV (2015-16) অনুযায়ী কমে 2. 2 হয়ে গেছে। কাজেই আইন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই।  

তারপর গতবছর জুন মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে জানানো হয় যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মণ্ডাভিয়া কোনরকম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল আনার কথা ভাবছেন না যেহেতু NFHS V অনুযায়ী ভারতের টোটাল ফার্টিলিটি রেশিও স্থায়িত্ব দর ২.১  থেকে কমে ২.০ হয়ে গেছে। 

তবু গত ৯ ডিসেম্বর তারিখে দু’জন বিজেপি এম পি নিশিকান্ত দুবে এবং রবিকিষণ লোকসভায়  প্রাইভেট মেম্বার্স পপুলেশন কন্ট্রোল বিল পেশ করেছেন। রবিকিষণ, ভোজপুরি লোকগায়ক এবং গোরখপুরের বিজেপি এমপি, ওঁর তিন মেয়ে এক ছেলে। 

প্রধানমন্ত্রী না স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কে ঠিক? 

দুই বিপরীত মেরুর বক্তব্য বুঝতে হলে কিছু সরকারী ডেটা দেখুন। ২০১১ সালের সেন্সাস অনুয়ায়ী আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক নাগরিকদের  সংখ্যা ও অনুপাতঃ   

সম্প্রদায়             জনসংখ্যার প্রতিশত  

হিন্দু                     ৭৯.৮০

ইসলাম                   ১৪.২৩

খ্রীস্টান                     ২.৩০ 

শিখ                        ১.৭২

অন্যান্য                      ১.৯৫

মোট                     ১০০.০০


National Family Health Survey (NFHS-5) অনুযায়ী ভারতের গড় ফার্টিলিটি রেশিও ২.২ থেকে কমে ২.০ হয়েছে। আন্তর্জাতিক রিপ্লেসমেন্ট রেশিও হল ২.১। অর্থাৎ যে অনুপাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (নতুন জন্ম-নতুন মৃত্যুর সংখ্যা কাটাকুটি করে যা পাওয়া যায়) স্থির থাকে। তার মানে এখন ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশংকাজনক নয়। 

মাত্র পাঁচটি স্টেটের টি এফ আর ন্যাশনাল অ্যাভারেজের এবং রিপ্লেসমেন্ট রেশিওর থেকে বেশি। তারা হল—

বিহার (২.৯৮), মেঘালয় (২.৯১), উত্তর প্রদেশ (২.৩৫), ঝারখণ্ড(২.২৬) এবং মনিপুর (২.১৭)। এর কোনটিই মুসলিম বহুল রাজ্য নয়। অথচ, মুসলিম প্রধান জম্মু-কাশ্মীর(১.৩) এবং বঙ্গে (১.৬) টি এফ আর ন্যাশনাল গড়ের থেকে অনেক কম। 

তার মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর ধর্ম নির্ভর নয়, বরং শিক্ষার হার এবং জীবনযাপনের স্তরের উপর নির্ভরশীল। 

শেষপাতেঃ

এত আশকথা পাশকথার পর মোদ্দা কথাটা হলঃ

  • বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পত্তির ভাগাভাগির নিয়ম বৈচিত্র্যময় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি অন্য সম্প্রদায়কে স্পর্শ করে না। এর পরিবর্তন বা সংস্কার ওই সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে হলে তবেই তা সহজে সবার জন্যে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়। জোর করে সবাইকে বাটার সাত নম্বর জুতো পরানোত কী দরকার! 

  • যাঁরা নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নে আদালতের রায়ে মুম্বাইয়ের হাজি আলি দরগায় মুসলিম নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে উল্লসিত হচ্ছিলেন, তাঁরাই কেরালার শবরীমালা মন্দিরে নারীর প্রবেশের বিরুদ্ধে পথে নেমে অবরোধ গড়লেন। অর্থাৎ সমান নাগরিক সংহিতার ইস্যুটি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক এজেন্ডা। 

  • আবশ্যক বিভিন্ন ধার্মিক আচারের প্রগতিশীল সংস্কারগুলোর জন্যে ইউসিসি আদৌ জরুরি নয়, দরকারমত  ইস্যুভিত্তিক আইন পাশ করেই কাজটি করা যেতে পারে। তিন তালাক সংশোধন এবং শবরীমালা এবং হাজি আলি ইস্যুতে সুপ্রীম কোর্টের রায় তার প্রমাণ।

                           

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



















পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ' কবর 'কবিতা। ' বাংলা সাহিত্যে কাহিনী নির্ভর কবর' কবিতার রচনাকাল চলতি ২০২৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে।

১৯২৫ সালে 'কবর' কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। 'কবর' কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিএ ক্লাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য। ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়।

'কবর' কবিতা কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন 'অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট' শিরোনামে একটি আলোচনা লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়।

জসীম উদ্দীন তাঁর আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এমএ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'জসীম উদ্দীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তাঁর জন্যে বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিট্স, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- বিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীম উদ্দীনের কবিতা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল'.।

কবিতাটি কবির ’ রাখালী 'কাব্যে স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের কবিতাকে ড্রামাটিক মনোলগ বা একাকী কথন বলা হয়। যদিও গ্রামের এক বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্দীন ' কবর' কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি শোক গাথা হলেও বৃদ্ধের জীবেনর ক্ষণিকের হাসি- আনন্দের অনুভূতি উঠে এসেছে বেদনার মাঝে এ ভাবে ---এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এক সময় এই বৃদ্ধের যৌবন ছিল আর তার ঘরে এসেছিল ছোট্র নববধূ, তার ছিল সোনার মত মুখ।

বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে 'কবর' একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বেদনা বিধুর অনুষঙ্গ ছাড়াও কবিতাটিতে প্রিয়জনদেরকে ভালবাসার স্মৃতি কাতরতা উঠে এসেছে দুঃখ বেদনায় । গ্রামীণ জীবনের দুঃখ- বেদনা এবং স্নেহ- মমতা আর প্রেম ভালবাসার চিত্র অঙ্কন করেছেন কবি এই কবিতায় গভীর মমতায়। পল্লীজীবনের অসাধারণ ছবি তুলে ধরেছেন স্মৃতিময়তায়।

মানব জীবনের হাসি- আনন্দ, দুঃখ-বেদনার ক্ষণিক বিচ্ছুরণন আলো আঁধারিতে উঠে এসেছে। অপূর্ণ ভালোবাসার হাহাকার কবিতার শব্দগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। মৃত্যু আর শূণ্যতাকে মনে হয় আত্মার আর্তনাদ বলে।
কবিতাটির প্রথম স্তবকেই আড্মার আর্তনাদ যেন আমরা শুনতে পাই।

''এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

ভালবাসা প্রগাঢ় ভাবে মৃত্যু আর শূন্যতার মিশ্রনে হারিয়ে গেছে। ' এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,''
বেদনার নস্টালজিক অনুষঙ্গ কবি জসিম উদদীন অসাধারণ ভাষায় গভীর মন্ময়তায় চিত্রয়িত করেছেন।

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন কবর ' কবিতাটিতে কাহিনী বর্ণনাকারী এক গ্রামের বৃদ্ধ দাদু। আর শ্রোতা হলো তাঁর নাতি। নাতিকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দাদু তাঁর জীবনের সকল প্রিয়জনকে হারানোর আকুতি ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। যে পাঁচজন স্বজন হারানোর ব্যথা বৃদ্ধ দাদু এক এক করে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : বৃদ্ধের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনী ও মেয়ে। এরা নাতির দাদী, পিতা, মাতা, বোন ও ছোট ফুপু।

পল্লীকবি জসিম উদদীন বাংলা ভাষায় একক বর্ণনায় য়ে কাহিনী উপস্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়।
বৃদ্ধ কৃষকের বয়ানে এদের হাসি- আনন্দ, দুঃখ--বেদনার আর জীবনের সুক্ষ্মাতি সুুক্ষ্ম অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায়। এগুলো কবিতার পঙ্ তিমালা থেকে তুলে ধরলে বেদনার অনুভূতিগুলো সর্বকালের পাঠকের কাছে ধরা দেবে।
'বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।'

সে সময় দাদুর যৌবন কাল ---, যৌবনবতী দিদিমার বাপের বাড়ি যাবার সময়ের চিরায়ত অনুরোধ ব্যক্ত হয়েছে।' আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান- তলীর গাঁ।’ কবি কতটা সচেতন এটা অনুধাবন করা যায়।
আমাদের বৃদ্ধ দাদু তার যৌবনবতী বৌয়ের দেখতে যাওয়ার আগে শাপনার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সার করি দেড়ী।পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!' বাঙালির স্বামী - স্ত্রীর চিরন্তন প্রেমপ্রীতি - ভালবাসার শাশ্বত ছবি ফুটে উঠেছে উপরের লাইনগুলোতে।

এই কবিতার প্রথম অংশে কবির মুখ থেকে স্বামী স্ত্রীর ভালবাসার অনুরনন উপলব্ধি করি এই কয়টি লাইন থেকে,যা বৃদ্ধ দাদু নাতির হাসি থামানোর জন্য বলছে, 'হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
কবি জসিম উদদীন বৃদ্ধ কৃষকের যৌবনবতী বউয়ের সে সময়ের অভিব্যক্তি উঠে এসেছে এ কথায়--নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।’

প্রেম ভালবাসার অসাধারণ অনুরনন আমরা লক্ষ করি উপরের লাইন থেকে। এর মাঝেই ' কবর 'কবিতার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে । বেদনার মাঝেও ভরা যৌবনের নস্টালজিক অনুষঙ্গ যা, আনন্দের উদ্ভাসে সমুজ্জল।
আত্মজনের একটার পর একটা মৃত্যু ¡ বৃদ্ধ দাদুর হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে তুলেছে। নাতির মায়ের মৃত্যু দাদুর হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। নাতির মা বা বৃদ্ধের মেয়ে মারা যাবার আগে তার ছেলেকে ডেকে বলল,'
'বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
আমরা বৃদ্ধ দাদুর আত্মজনের বিয়োগ ব্যথার অশ্রু বির্সজনে বর্ণনা বাড়াতে না চেয়ে কবিতার শেষ স্তবকে তিনি নাতিকে কি বলেছেন আমরা দেখবো।
'ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।'

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত 'কবর' কবিতাটিতে বিষাদকরুণ ছন্দোময়তার অনুরণন পাঠককে বিষদগ্রস্ত করে।

তিরিশের দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় সে সময়ই জসীম উদ্দীন রচনা করেছিলেন 'কবর'। '

জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। এটি ছিল তাঁর নানার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লা এবং মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। পাঁচ সন্তানের মধ্যে জসীম উদ্দীন ছিলেন চতুর্থ। তাঁদের পরিবারকে কৃষিজীবীই বলা যেতে পারে। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী এমই স্কুলের শিক্ষক। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু'দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর 'কবর' কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। জসীম উদ্দীনের কবি প্রতিভা বিকশিত হয় শৈশবেই।

কবি ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই। একসময়ে তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের কল্যাণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গীতিকা-সংগ্রাহকের দায়িত্ব পান।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী।

এক শত বছর আগে লেখা পল্লীকবি জসিম উদদীনের 'কবর' কবিতা আজকের দিনেও সমান মর্যাদায় আসীন। তাঁর এ কবিতা কোনদিনই পুরনো হবে না। যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবি জসিম উদদীন ' কবর ' কবিতা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in



















১৮৩৯ সাল। বছর ছয়েক হল সমাজ সংস্কারক দেশের 'প্রথম আধুনিক পুরুষ' হিসেবে সম্মানিত রাজা রামমোহন রায় প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে গেছে আর সেই আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেন 'তত্ত্ববোধিনী সভা'। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার হলেও আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার দ্বার খোলা থাকত সভায়। এই সভা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রথম 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে ১৬ই আগস্ট। এই পত্রিকার সম্পাদক হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকা হল ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। এই পত্রিকায় সে যুগের দিকপালেরা নিয়মিত লিখতেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকগণ ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী আর লেখকদের লেখার মাধ্যমেই সে যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নবযুগ। যদিও পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার করা হলেও, এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজতত্ত্ব সহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মূল্যবান ও আকর্ষণীয় লেখা। এই পত্রিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করে তুলতে নিজেদের উন্নয়ন ও আত্মগঠনের প্রেরণা জাগানো লেখাও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এইভাবে তৎকালীন নবজাগরণের সময় বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এই পত্রিকা বিশেষ অবদান রেখেছিল। ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের প্রচারে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ববঙ্গে এ পত্রিকার মাধ্যমেই ব্রাহ্মধর্মের প্রসার ঘটে। পত্রিকাটি পড়ে ব্রজসুন্দর মিত্র অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সীমিত যোগাযোগ ও কর্মীর অভাব সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের কাজে পত্রিকাটি অন্যতম সহায়ক হয়ে ওঠে।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর মান নিরূপণ করার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির আদর্শ অনুসরণ করে গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সভ্য ছিলেন পাঁচ স্বনামধন্য ব্যক্তি— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আনন্দমোহন বসু, রাজনারায়ণ বসু এবং বিদ্যাসাগরের বন্ধু প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। বাংলাপিডিয়া থেকে জানতে পারি যে, তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো নির্বাচিত হতো পেপার কমিটির মনোনয়নের মাধ্যমে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দকৃষ্ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ ছিলেন সেই পেপার কমিটির সদস্যগণ। এখানে উল্লেখ্য যে, কমিটির অন্যতম সদস্য রাধাপ্রসাদ রায় ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র আর এই রাধাপ্রসাদ পত্রিকাকে একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীতে সাংগঠনিকভাবে বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর হাত ধরেই যেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রাণ প্রতিষ্ঠালাভ করে।

১৮৪০ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় পড়াশোনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে তাঁর প্রথম বই 'ভূগোল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। এই বইটিকে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানের বই হিসেবে ধরা হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনার এক নতুন দিগন্ত ও আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য শাখা যেমন পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের প্রচুর প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগুলো সাধারণ মানুষের কাছে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানা ও শেখার এক সহায়ক হয়ে উঠেছিল। দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা শুধু ধর্মচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। কিন্তু অক্ষয়কুমার চাইতেন এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হোক। শেষ পর্যন্ত অক্ষয়কুমার দত্তের ভাবনাই প্রাধান্য পায়। তাঁর সম্পাদনায় বিজ্ঞান ও যুক্তিসমৃদ্ধ লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ায় বাংলা সংবাদপত্রের মর্যাদা বাড়ে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বুদ্ধিজীবী আগে বাংলা পত্রিকাকে তুচ্ছ করলেও, তত্ত্ববোধিনীর বিষয়বস্তুর গভীরতা ও মান তাঁদেরও আকৃষ্ট করে।

অক্ষয়কুমার দত্তের মতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত ও পত্রিকার তথা সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটির অন্যতম সদস্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— দুজনেই ধর্মচিন্তা প্রসারের বিরোধিতার মাধ্যমে নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমারের মতোই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বাংলায় অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর লেখা 'বোধোদয়' ও 'জীবনচরিত' নামে বিজ্ঞানের দুই আকর গ্রন্থ পড়লে ও তাঁর 'ভূগোল খগোল বর্ণনম' সহ বিভিন্ন লেখা পড়লেই তাঁর বিজ্ঞানচর্চার গভীরতা টের পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে বাল্যবিবাহ রদ ও বিধবার পুনর্বিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে তিনি তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সংস্কারকের মানসিকতা প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির অনুবাদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। অক্ষয়কুমার দত্তের কিছু রচনার সংস্কার ও সংশোধন করে গিয়েছিলেন নিয়মিতভাবে। তত্ত্ববোধিনী সভার বেশ কিছু প্রকাশনা সম্পাদনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এই যেমন, পশ্বাবলী পত্রিকার দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম অংশে প্রকাশিত অক্ষয়কুমার দত্তের প্রবন্ধগুলো। তাঁর তত্ত্বাবধানে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে অক্ষয়কুমার দত্তের দর্শন ও বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার'। এই লেখাটির প্রথম ভাগ বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৫৩ সালে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকদের বিজ্ঞানের লেখা লিখতে শুধু উৎসাহ দিতেন না এমনকি লেখালেখির ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শও দিতেন। তিনি বাংলা ভাষায় পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখতে লেখকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন যেমনটা দিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় গণিতের বই রচনার পথিকৃৎ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে বাংলায় বীজগণিতের বই লেখার ব্যাপারে। প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী প্রথম পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখেছিলেন। পাটিগণিত বইয়ে শব্দ সংকলনের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের করা অনেক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন আর এই বীজগণিত বইয়েও তিনি বিদ্যাসাগরের কথা লিখেছেন ও তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছেন অনেক গণিত তথা বিজ্ঞান লেখককে বাংলায় গণিতের বই লেখার জন্য যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গণিত বিজ্ঞান গ্রন্থের লেখক জয়গোপাল গোস্বামী, পাটিগণিতাংকুর বইয়ের লেখক ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গণিতাংকুর বইয়ের লেখক চন্দ্রকান্ত শর্মা, পাটিগণিত বইয়ের লেখক কালীপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায় সহ অনেকেই। দুঃখের বিষয় এই যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পরমকারুণিক'

ঈশ্বর-ধারণার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তত্ত্ববোধিনী সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। আবার, অক্ষয়কুমারের উৎসাহদাতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, যাঁর কাছ থেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে শরিক হন। তাঁর যুক্তিবাদী মন ধর্মের নানা মতবাদকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল। তিনিও ধর্ম ও দর্শনের পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন আর যার ফলে ১৮৫৫ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ত্যাগ করেন। তত্ত্ববোধিনী সভা ত্যাগ করার পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও বাংলায় বিজ্ঞানের লেখার জন্য উৎসাহ যেমন থেমে যায়নি ঠিক তেমনি অক্ষয়কুমার দত্ত ও রচনা করে গেছেন বাংলায় বিজ্ঞানের নানা লেখা ও বই। ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা বিজ্ঞানের বই 'পদার্থবিদ্যা'। এক সময় সভার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটে এবং তাঁর সঙ্গে সভার পরিচালকদের অনেক বিষয়ে মতানৈক্য হয় আর এই মতানৈক্যর ফলে ১৮৫৯ সালের মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা উঠে যায়। এর সঙ্গে পেপার কমিটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পরিচালনা ও বই প্রকাশনার দায়িত্ব পড়ে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের ওপর। অক্ষয়কুমার দত্তের পরে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে৷

অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—দুজনেই ছিলেন আদ্যন্ত বিজ্ঞানপ্রেমী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। এ'বছর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক এই দুই নমস্য ব্যক্তির ২০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দুজনের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম আর সেই সাথে স্মরণ করি ১৮২ বছর আগের এই বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোর দিশারী 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'-কে।


তথ্যসূত্রঃ–
বাংলাপিডিয়া,
উইকিপিডিয়া (বাংলা ও ইংরেজি),
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান ভাবনা– ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র, অক্ষর পাবশিকেশনস্, ত্রিপুরা।

0 comments: