0

সম্পাদকীয়

Posted in


সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' ছবিতে উৎপল দত্তের সংলাপ মনে পড়ে? সভ্যতার সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আসল সভ্য তো সেই মানুষ যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে একটা বোতাম টিপে একটি জনপ্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। স্বরচিত 'অতিথি' ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত 'আগন্তুক' সত্যজিৎ রায়ের শেষ সৃষ্টি। তিনি সেদিন ছিলেন এক আশ্চর্য ভবিষ্যকথকের ভূমিকায়!

একসপ্তাহ আগে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘর্ষের সূচনা ঘটেছে, তার অভ্রান্ত ছায়া কি সেদিন আমরা ওই সংলাপরচনার মধ্যে প্রত্যক্ষ করিনি?

কে ঠিক আর কে ভুল, এই বিচার এ মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক শুধু এইটুকু যে 'মরিছে মানুষ'!

ভাবলে অবাক লাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় হত্যালীলা যে জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তারা এখন অন্য ভূমিকায়। অপর পক্ষে যাঁরা, ধোয়া তুলসিপাতা নন তাঁরাও। এটি সর্বজনবিদিত। তৎসত্ত্বেও কোনও অনুমানের ভিত্তিতে, তৈরি করা একটি তত্ত্বের অজুহাতে কোনও দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা যায় কি? অবশ্যই না। তবুও এমন ঘটে। যেমন ঘটেছিল প্রথম এবং দ্বিতীয় গাল্ফ যুদ্ধের ক্ষেত্রে। অনেক রক্তক্ষয়ের পর আমরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলাম জয় অধরা থেকে গেছে সবার কাছেই।

কিঞ্চিৎ দূরত্বে ঘটমান এই দ্বন্দ্বের আঁচ হয়তো এখনও সেভাবে আমাদের গায়ে লাগছে না। কিন্ত যদি দীর্ঘায়িত হয় এই উন্মাদনা? কী হবে? ভেবেছেন কি?

সুস্থ থাকুন। সতর্ক থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in



















রাঙাডাক্তার গ্রামের পথ দিয়ে ফিরে আসছেন। ভাঙড়ের বাগবাড়ীতে তাদের সংগ্রাম পর্যুদস্ত হয়েছে। মন তার ভারাক্রান্ত। সেই মুহূর্তে তার মনে বার বার ফিরে আসছিল একটাই প্রশ্ন – ‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’
চল্লিশ দশকের শেষার্দ্ধ। তখন কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে এই তরুণ ডাক্তার গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। মেডিকেল টিম তৈরীর চেষ্টা করছেন। আন্দোলনকারী কৃষকদের চিকিৎসা করছেন। বিভিন্ন আন্দোলনে অংশও নিচ্ছেন।
সে সময়গুলো পেরিয়ে আজকে দিনে যদি দেখি, মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তেভাগা আন্দোলন থেকে নকশালবাড়ি, হাল আমলের কৃষক আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন। রাঙাডাক্তারের বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে এখনকার একবিংশ শতক। তার মৃত্যুর পর একত্রিশ বছর কেটে গেছে। আজকের দিনটা তার মৃত্যু দিন। নানা রোগ ব্যাধি, সামাজিক সমস্যা, ভোটের ডামাডোল এসবের মধ্য দিয়েও আজকের দিনে তেভাগা আন্দোলন খ্যাত রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষকে স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক।
‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’ এই প্রশ্নটা বোধ হয় সারা জীবনই রাঙাডাক্তাররের মনকে আলোড়িত করেছিল। সারা জীবন এর উত্তর তিনি খুঁজেছেন। সারা জীবনই তিনি সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়েও মতো সারা জীবনই এই বোধে অবিচল থেকেছেন, “A man can be destroyed, but not defeated”! আজীবন যোদ্ধা, ব্যক্তিত্বময় পুরুষ, আড্ডাবাজ, সবার ভালোবাসার এই মানুষটি তার সাধাসিধা দিন যাপন ও চর্চার মধ্য দিয়ে উপরোক্ত জয় ও পরাজয়ের উত্তরটা খুঁজেছেন।
মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে; কিন্তু যা যায় না, তা হলো তাকে পরাজিত করা। দুরারোগ্য ক্যান্সারের প্রত্যাশিত আক্রমনে এই রাঙা ডাক্তার বিগত ১৯৯০ সালের ৪ঠা মে প্রয়াত হয়েছিলেন; তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের (অধুনা ছত্তিশগড়ের) বিলাসপুরে। ডাক্তার পুর্ণেন্দু ঘোষের জন্ম ১৯২৩এর মহালয়ার দিন, বিহারের ভাগা কয়লাখনি অঞ্চলে। বাবা ছিলেন রেল কর্মী। তাই শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়, কখনো বিলাসপুরে, কখনো মানভূমে, কখনো কোলকাতায়। ১৯৪২ এ তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে আই এস সি পড়তে শুরু করেন। তারপর তিনি ডাক্তারী পড়তে ভর্তি হন কলকাতার কারমাইকেল কলেজে। ডাক্তারী পড়ার থার্ড ইয়ারে কবি রাম বসুর (সম্পর্কে মামাতো ভাই) হাত ধরে তিনি সক্রিয় ভাবে ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ডাক্তারী (এম বি বি এস) পাশ করেন। এরপর তিনি ঘরের সুখশয্যা ছেড়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে সুন্দরবনের কাকদ্বীপে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গ্রামে গিয়ে আন্দোলনকারী ও সংগ্রামরত কৃষকদের মধ্যে মেডিকেল ইউনিট গড়বেন। এর পরে ১৯৪৯এ রেল ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাঁতরাগাছি আসেন। তারপরে মেডিকেল ক্যাডার তৈরীর কাজে হাওড়ার আন্দুলে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সব মিলিয়ে এই মানুষটি মনে করিয়ে দেন চীনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ডাক্তার নরম্যান বেথুনের কথা। সন্দেশখালিতে ধরা পরার পর বসিরহাট সাব জেলে একরাত কাটিয়ে তাকে আসতে হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানেও জেলের মধ্যে থেকেও নানা দাবী দাওয়া ও অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে চলতে থাকে সক্রিয় আন্দোলন। তারপর আলিপুর জেল থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। ততদিনে কম্যুনিষ্ট পার্টির ভেতরকার অবস্থা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরে উঠেছে। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসে পার্টির সাথে সব সম্পর্ক প্রায় চুকিয়েই ফেললেন।

১৯৫৩ থেকে স্থায়ীভাবে তিনি বিলাসপুরে বসবাস ও ডাক্তারী প্রাকটিস করা শুরু করলেন। এ সময়ে রাজনীতির সাথে তেমন সম্পর্ক না থাকলেও সাধারণ মানুষদের সাথে তার ছিল অটুট সম্পর্ক। ১৯৬৮/৬৯ সালে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের যে আওয়াজ ভারতবর্ষকে উদ্বেল করে তুলেছিল, তিনি সেই আন্দোলনের শরিক হয়ে যান। তারই পরিণতিতে ১৯৭০ এ আবার তাকে জেলে যেতে হয়। এর পরবর্তী সময়ে কাকদ্বীপের পূর্বতন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ভোজপুরে কৃষকদের আন্দোলনে সামিল হন। উদ্দেশ্য সেখানে মেডিকেল ইউনিট গঠন করা। পুনরায় ভারতবর্ষের ঘোষিত জরুরী অবস্থার সময়ে তাকে আবার জেলে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিপ্লবী কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে তিনি যোগাযোগ রেখে চলেন। এই হলো সংক্ষেপে তার রাজনৈতিক জীবনের কথা।

এসবের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার বিভিন্ন প্রয়াস মনে রাখবার মতো। এইসব প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে সমাজের প্রতি, মানবতার প্রতি তার এক নিরন্তর দায়বদ্ধতা। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গল্পকার, লেখক, চিত্রশিল্পী ও নাট্যকার। এমন কি অভিনয়ও করেছেন। তিনি ছিলেন সম্পাদক। তার সম্পাদিত সেতু পত্রিকা (বাংলা ও হিন্দী ভাষায়) সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের কবিতার বই ‘লালগঞ্জে পৌঁছাবোই ও অন্যান্য কবিতা’ তেভাগা কৃষক আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সাতটি একাঙ্ক নাটকের সংকলন একত্রে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮/৮৯-এ। তার সব চাইতে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘তেভাগার স্মৃতি’ – যার মধ্যে ধরা আছে তার সময়কার কিছু সংগ্রামী মানুষের স্মৃতিকথা ও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার বিবরণ। ‘তেভাগার স্মৃতি’ বইটির হিন্দী অনুবাদও (তার ভাই অমল ঘোষ কৃত) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাহিত্যের পারষ্পরিক অনুবাদের মধ্য দিয়েও তিনি চেয়েছিলেন নানা ভাষা ও নানা মতের যোগসূত্র স্থাপিত হোক। তার নিজস্ব অনুবাদ কর্মের মধ্যে আছে কৃষণচন্দের উপন্যাস ‘ফুটপাথের দেবদূত’ ও শ্রীরাবিন শাঁ ‘পুষ্প’-এর গল্প সংকলন ‘লড়াই’ (আলোক রায়ের সাথে যৌথভাবে)।
তার পরিচালনায় বিলাসপুরের সেতু সাহিত্য পরিষদ বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশে একসময়ে উদ্যোগী হয়েছিল। এই সমস্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত লেখক, কবি ও রাজনৈতিক মানুষটিকে নিয়ে লেখা একটি সংকলনগ্রন্থ ‘চেরাবান্দারাজু : ব্যক্তিত্ব ও কবিকৃতি’। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছেন মধু ভট্টাচার্যর কাব্যগ্রন্থ ‘একটি শান্তির আস্তানা বানাবার জন্যে’ ; এই মধু ভট্টাচার্যবাবু যিনি একসময়ে বিলাসপুরে থাকতেন, ডাক্তারবাবুর সান্নিধ্য পেয়েছেন; এখন তিনি ভিলাইবাসী ও ডাক্তারবাবুর ‘সেতু’ পত্রিকাটিকে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাবুর উদ্যোগে সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিলাসপুরবাসী রেলকর্মী, সমাজিক ভাবে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ও লেখক মহাদেব রাও (বর্তমানে প্রয়াত)এর লেখা ‘মহাদেব রাও নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’। সেতু সাহিত্য পরিষদ ও ডাক্তারবাবুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ছবির অ্যালবাম ‘যারা আলো দিলেন’; উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ রোগীর চিকিৎসা করতেন, তাতে নাম মাত্র পয়সা নিতেন, কখনো বা পয়সা নিতেনই না। মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্য থেকে উঠে আসা এই মহান চিকিৎসকটির স্বপ্ন ছিল সমাজে যেন শোষণ না থাকে। মানুষ যেন সুখে শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে। আজীবন তিনি ছিলেন সহজ সরল নিরলস এক ছাত্র, তবুও আমাদের কাছে তিনি একজন মহান শিক্ষক। তাকে আমি বিলাসপুরে দেখেছি বেশ কয়েকবারই। পথ চলতি রাস্তা ঘাটের মানুষজনের সাথে তার ছিল সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক। নিজের জীবনে তিনি তার ব্যক্তিগত গন্ডীটাকে ভেঙ্গে হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন।
চার পাশে চলা কম্যুনিষ্ট আন্দোলনগুলো সম্পর্কে শেষ জীবনে তার নানা প্রশ্ন ছিল। বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে নানা ফাঁফ-ফোকর, সুবিধাবাদ, অন্যায়, অসম্পূর্ণতা এসব তিনিও নিজের চোখে দেখে গেছেন। এসব তাকে বিচলিত করেছিল, দুঃখ পেয়েছেন। সামাজিক আন্দোলনের এই সব ফাঁফ-ফোকর দেখেই হয়তো তাকে লিখতে হয়েছে –
‘বলেছিলাম-
জনতা হচ্ছে জল আর আমরা সেই জলের মাছ
কিন্তু জল যদি সরে যায়
তবে মাছেরা যে ধড়ফড়িয়ে মরে
সে কথা বুঝতেই পারিনি’।

মৃত্যুর পর ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের স্মরণে ‘খুঁজে ফিরি এক আদর্শ প্রাণ’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে তারই একটা লেখা কবিতা তুলে দিচ্ছি এখানে।
< ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা >
নিরাশা আর হতাশায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে
শুয়ে আছি অন্ধকার আকাশের নীচে!
নিরন্ধ্র আঁধার রাতে
কোনোখানে নেই কোন আশার আলোক
তারকার সারি কোথা লুকিয়েছে মুখ
অসহায় মন শুধু ভেঙে ভেঙে যায়।
এমন সময় -
তোমার উদীপ্ত স্বর চমক ভাঙায়,
‘সব্যসাচী, দূর করে দাও এই ক্লীবত্ব তোমার।
অসহায় নয় তুমি,
চারিদিকে চেয়ে দ্যাখো
ছিন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত শত শত বুভুক্ষু মানুষ
চেয়ে আছে তোমার দিকেতে।
তাদের দেখেছো তুমি,
কিন্তু দেখোনিকো তাদের হৃদয়
সেখানে অসংখ্য জ্বালা আর অঙ্গারের বেগ
নিত্য প্রজ্জ্বলিত হয়ে আগুন ছড়ায়
তারা তো তোমার পাশে
ওঠো, ছিঁড়ে ফ্যালো হতাশার মিথ্যা আবরণ,
মানুষের পরে মানুষের শোষণের
যতদিন শেষ নাহি হবে
ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা?’
[ বিলাসপুর, ২০-১২-১৯৮৯ ]

‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কিংবা তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলো আজ অস্তমিত। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় আমাদের সামনে! এরকম একটা বিভ্রান্ত সময়ে, আজকেও ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ ও তার জীবনবীক্ষাকে স্মরণ করা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়।

==== # ====

[ লেখার সূত্র –
১/ রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ – প্রশান্ত ভট্টাচার্য [ লেখক সমাবেশ, মে-১৯৯০ সংখ্যা]
২/ তেভাগার স্মৃতি – পূর্ণেন্দু ঘোষ , সেতু সাহিত্য পরিষদ।
৩/ স্বদেশ ( পত্রিকা) – ৬১ সংখ্যা/ ১৯৯০ ]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








দেবযানী অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানীর জীবনের প্রেম পূর্ণতা লাভ করে না। কচ ও দেবযানীর জীবনের ব্যর্থ প্রেমের এক বেদনা বিধূর উপাখ্যান শোনাতে চাই। দেবলোকের আচার্য বৃহস্পতি ছিলেন দেবতাদের পরম পূজনীয়। অন্যদিকে অসুর সম্রাজ্যে পূজনীয় ছিলেন আচার্য শুক্রাচার্য। বৃহস্পতি পুত্র কচ ও শুক্রাচার্যের বিদূষী পরমা সুন্দরী কন্যা দেবযানী। দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। দেবতাদের সাথে যুদ্ধে যে সকল দৈত্য নিহত হতেন শুক্রাচার্য তাঁর সঞ্জীবনীমন্ত্রের সাহায্যে তাঁদের জীবনদান করতেন। বৃহস্পতির এই বিদ্যা জানা না থাকার কারণে তিনি নিহত দেবসৈন্যকে জীবিত করতে পারতেন না। এই মন্ত্র জানার জন্য দেবতাদের অনুরোধে বৃহস্পতি তাঁর পুত্র কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান। কচ শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এক হাজার বৎসর তাঁর গৃহে অতিবাহিত করেন। এই সময় কচ ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করে গুরু শুক্রাচার্য এর সেবা করেন।তিনি গুরুকন্যা রূপসী তরুণী দেবযানীর সান্নিধ্যও আসেন। এক সময় দেবযানী কচের প্রতি আকৃষ্ট হন। ঘটনাক্রমে তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। দেবযানী কচকে ভালোবেসেই বারবার দৈতদের কবল থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন তিনি তাঁর বাবা শুক্রাচার্যকে বলে। একসময় দৈত্যরা কচের অভিসন্ধি জানতে পারেন। সেই কারণে, দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহকে খণ্ড খণ্ড করে কুকুরের খাবার হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য তাঁকে জীবিত করেন। এরপর দৈত্যরা কচকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য আবার কচকে জীবিত করেন। তৃতীয়বার দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহ ভস্ম করেন। এরপর উক্ত ভস্ম মদের সাথে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করান। দেবাযানীর পুনঃপুনঃ অনুরোধে তিনি আবার কচকে জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এইবারে শুক্রাচার্য দেখলেন কচ জীবিত হলে তাঁর পেট চিরে বের হবে। তাই তিনি উদরস্থ কচকে প্রথমে সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখালেন। এরপর মন্ত্রবলে কচকে জীবিত করলে, কচ শুক্রাচার্যের পেট থেকে বের হন, কিন্তু শুক্রাচার্য মারা যান। এরপর কচ, শুক্রাচার্যকে জীবিত করেন। এরপর আরো পাঁচশত বৎসর শুক্রাচার্যের আশ্রম থেকে কচ স্বর্গে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এই সময় শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কচ গুরু-কন্যা বিবেচনায় দেবযানীকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সাথে তিনি জানালেন যে তাঁরা দুজনই শুক্রাচার্যের শরীরের অভ্যন্তর হতে জাত, সেই কারণে দেবযানীর সাথে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়ায় ভাই-বোন। ক্ষুব্ধ দেবযানী কচকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি যে সঞ্জীবনী বিদ্যা অর্জন করেছেন, তা কার্যকরী হবে না। কচ পাল্টা দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন যে, দেবযানীর অন্তরের ইচ্ছা পূরণ হবে না। কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষিপুত্র তাঁকে বিবাহ করবেন না। এরপর কচ স্বর্গে চলে যান। ইনি অভিশাপের কারণে নিজে কখনও এই বিদ্যার সুফল পান নি। তবে তিনি যাঁদেরকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা ফললাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর " বিদায় অভিশাপ" কাব্য নাটকেকচের মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। এই বলে
কচ: আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে । । ভুলে যাবে সৰ্ব্বগ্লানি বিপুল গৌরবে । রবীন্দ্রনাথে "বিদায় অভিশাপ " তার এই বর বাস্তবে দেবযানীর কপালে জোটেনি।আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। কচ শেষে দেবযানীর কাছে এসে প্রার্থনা করলেন নিজের দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে। দেবযানী বিষণ্ণ হলেন। কচকে ডেকে তাকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। কচ একথায় বিস্মিত হলেন। কারণ গুরুকন্যা তার কাছে ভগিনীর সমান। দেবযানী বললেন – তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমার জন্যই তুমি বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো। এখন আমায় এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কচ চিন্তিত হলেন। তিনি দেবযানীকে বোঝাতে চাইলেন। দেবযানী কচকে বললেন
--হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহ--হেথায় সুলভ নহে হাসি।
যাও বন্ধু, কী হইবে মিথ্যা কাল নাশি--
উৎকণ্ঠিত দেবগণ।
যেতেছ চলিয়া ?
সকলি সমাপ্ত হল দু কথা বলিয়া?
দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায়? কচ বললেন,আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব।
দেবযানী--জানি সখে,
তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে
চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন
চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন
স্পর্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে,যেয়ো নাকো । সুখ নাই যশের গৌরবে।
দেবযানীর আঁকুতি ব্যক্ত করলেন--
হেথা বেণুমতীতীরে মোরা দুই জন
অভিনব স্বর্গলোক করিব সৃজন।'
কচ--নহে, নহে দেবযানী।
'দেবযানী প্রশ্ন --নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী?
বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন--
গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? কতদিন
যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি,
যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি,
অমনি সর্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া--
নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া
আলোক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই?
ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই
মোর কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে।
ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে । কচ-
শুচিস্মিতে,
সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে
এরি লাগি করেছি সাধনা ?
দেবযানী কচের কথার প্রতিবাদ করে প্রশ্ন করলেন--
বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে
এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি
কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি
করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়,
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে
সাধনা করেছ তুমি কী ধনের তরে
আপনি জান না তাহা। বিদ্যা এক ধারে,আমি এক ধারে-- কভু মোরে কভু তারে চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে "বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশ! দেবযানী কচকে বোঝালেন অতীত বছরগুলোতে উভয়ের নষ্টালজিক প্রেমময় অনুষঙ্গের কথা। বললেন তাঁকে দেবলোকে ফিরে না গিয়ে তাঁকে বিয়ে করে থেকে যেতে।
কচ দেবযানীর অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন –দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী। অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ করো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা করো।
একথা শুনে দেবযানী ক্রোধিত হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, নারী হয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করলেন কচ তাও কথা রাখলেন না। তাই তার পিতার কাছ থেকে কচ যত বিদ্যা শিখেছেন সব নিষ্ফল হবে। ও বাক্যে কচ ব্যাথিত হলেন। বললেন, বিনা অপরাধে তাকে দেবযানী এত বড় অভিশাপ দিলেন। কামে উত্তেজিত হয়ে তিনি কচকে অভিশাপ দিলেন। কচ ঠিক করলেন তাকেও শাপ নিতে হবে।কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা হয়ে তাকে ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী হতে হবে। দেবয়ানী ও কচের প্রেম পূর্ণতা পেল না।

সূত্র: মহাভারত। উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর

Posted in



















বর্তমান দেশে বিদেশে যখন কাদামাটির তৈরি স্থাপত্য ভাস্কর্যের উপর বিভিন্ন ধরনের রিসার্চ চলছে তখন আজ থেকে একশো সাত বছর আগে কবিগুরু দেখিয়ে গেছেন কিভাবে মাটিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ ঘটানো যায় শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলিতে মাটির র স্থাপত্য ভাস্কর্যের সঙ্গে ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া।

ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, পল্লী-ভাবনা, পল্লী-সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতা, মৌলিকতা -- এসবের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল শান্তিনিকেতনের এক একটি গৃহ। প্রত্যেকটি গৃহ কিন্ত তার স্বীয় স্বীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

কোণার্ক

আশ্রমের উত্তর দিক দিয়ে শুরু করি। উত্তর দিকে যে বাড়িটি রয়েছে তার নাম কোণার্ক। ‘কোণার্ক’ শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘কোণ’ ও ‘অর্ক’। ‘কোণ’ শব্দের অর্থ কোণ বা কোণা বা প্রান্ত। আর ‘অর্ক’ হল সূর্য। অতএব, ‘কোণার্ক’ শব্দটির অর্থ হল ‘সূর্যকোণ’। ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তর প্রান্তে এই বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়। প্রথমে দু’টি মাটির ঘর তৈরি করা হয়। এর বছর দু’য়েক পরে শুরু হয় এই মাটির বাড়ি পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। সালটি ১৯২১-২২। বাড়িটির স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

বাড়ি যে সাধারণ বাড়ি নয় এ কথা বলা বাহুল্য মাত্র। শুধু বাইরে নয় ভিতরেও একটা অভিনবত্ব রয়েছে।

বাড়িটির তল উঁচু প্লিন্থের। এই পিন্থ (Plinth) হল স্থাপত্যের একটি মৌলিক উপাদান। এটি দেখতে প্ল্যাটফর্মের মত । এটি স্তম্ভ ,মূর্তি বা অন্য কোনো কাঠামোর নিচে থাকে।

ঘরগুলোর সামনে বারান্দা রয়েছে। বারান্দাগুলো ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচ।

ঘরের উচ্চতার সঙ্গে তারতম্যের রেখে তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির মেঝে।

ঘরের মাঝে রয়েছে ভেন্টিলেশন। এই ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে দিনের আলোর প্রবেশের পথটি সহজ ও সুগম হয়েছে।

মূল ঘরের ভিতের উচ্চতা প্রায় দু’ফুটের বেশি।

ইস্পাতের থামের উপর পেটাই টালির ছাদ। বীম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ইস্পাত।

বারান্দার মেঝের উচ্চতা প্রায় নয় সাড়ে নয় ইঞ্চি।

এই ঘরের সামনেটা কাঁকর মাটি দিয়ে সুবিন্যস্ত ।

বাড়িটির সামনের দিকে শিমূল গাছের আধিক্য ছিল। অবশ্য অন্যান্য গাছও ছিল। তবে তার পরিমাণ কম।

কোনার্ক গৃহস্থাপত্যের দিক থেকে সহজ-সরল এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তায় গঠিত। সার্থক বাসপোযোগী পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল সহজ-সরল গৃহবিন্যাস, আলো-বাতাসের উন্মুক্ততা।


উদয়ন

এবার পূর্ব দিকে হাঁটা দিই। উদয়ন কেবলমাত্র একটি ঘর নয় এগুলিকে ঘরের সমষ্টি বলা যেতে পারে। ‘উদয়ন’ একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ হল ভোর বা সূর্যোদয়। এই গৃহের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯১৯-২০ সালে। তবে সমাপ্ত হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৮ বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সাল। বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এটি মূলত অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি।

বাড়িটি বেশ মজার। এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম উচ্চতা রয়েছে। যেমন বসার ঘরের এবং শোয়ার ঘরের যে উচ্চতা মাঝের ঘরগুলো উচ্চতা কিন্ত আলাদা। আবার কোন কোন অংশের উচ্চতা প্রায় তিন তলার কাছাকাছি। উচ্চতার তারতম্য হলেও কিন্তু ঘরগুলো কখনই বিশদৃশ্য বা বেমানান নয়।

দোতলায় রয়েছে লম্বা বারান্দা। বারান্দাগুলিতে জয়পুর ঘরানার কংক্রিটের জালির কাজ শোভা বর্ধন করেছে।

বারান্দাগুলোর বৈঠকে মেজাজকে মাথায় রেখে তৈরি।

বারান্দার কাজের সঙ্গে ঘরের কাজের বিস্তর ফারাক। ঘরের দেওয়াল শীতলপাটি ও কাঠের পাল্লা দিয়ে তৈরি।

দেয়াল ও মেঘের সংযোগস্থলটি মুড়ে দেওয়া ছিল।

সিলিংগুলিতে অবশ্য পাতলা কাঠের কারুকার্য ছিল।

কাঠের সিলিং এর ভাবনা গৃহপ্রবেশ নাটকে যতীনের ছিল।

ঘরের সামনে মোরামে ঢাকা উদ্যান।

অবশ্য ঘরের পিছন দিকেও ছিল উদ্যান , গুহাগৃহ , চিত্রভানু এবং জাপানি বাগিচার বিন্যাস ইত্যাদি। বিশিষ্ট লেখক অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় --- ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন,“ সামনের elevation এবং গৃহের পিছনের উদ্যান, গুহাঘর, চিত্রভানু, জাপানি বাগিচার বিন্যাস —- সব মিলেমিশে প্রাচ্য আভিজাত্যের নিদর্শনই বহন করে।”

উদয়ন যেন এক ‘ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যের’ দৃষ্টান্ত। নানান বৈচিত্র্যে ঋদ্ধ, রূপ-রস-গন্ধের বিন্যাসে শোভিত এই উদয়ন রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ছিল।


শ্যামলী

কবিগুরু তার ৭৫-তম জন্মদিনে (১৯৩৫ সালে) যে বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন সেই বাড়িটির নাম শ্যামলী। কবি অবশ্য নিজেই লিখেছেন ; —-

“শ্যামলী মাটির বাড়ি, এ আমার শ্যামলী, আমার শেষ আশ্রয়।”

এটি উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এ বাড়ির নকশা তৈরি করেছিলেন সুরেন কর। সুরেন কর ছিলেন কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শান্তিনিকেতনের একজন বিখ্যাত স্থপতি। তিনি ১৯২৭ সালে জাভা সফরে গিয়ে বাটিক শিল্প বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এই বাড়িটির স্থাপত্যের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটা মাটির বাড়ি , মাটির ছাদ , মাটির মেঝে।অভিনব পরিকল্পনা করলেন।

এই ঘরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ঘরে চৌকাঠ বলে কিছু নেই। এমনকি সিড়িও নেই। ঘর এবং পথের তফাৎ বোঝা যাবে না। মানে কবি বলতে চেয়েছেন পথ যেন অবাধে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। ঘরেই পথ আবার পথেই ঘর।

ঘরের চারিদিকে চুন বালির আস্তানা দিয়ে মাটির হাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। যাতে বাইরের উত্তাপ ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। সকালে ঘর যাতে ঠান্ডা থাকে। দেয়াল তৈরি হয়েছিল উলু-খড় ও মাটি দিয়ে মাটির সঙ্গে গোবর আলকাতরা আর বেনাগাছে টুকরা মিশিয়ে মসলা তৈরি করে দেওয়ালে আলকাতরা দেয়া হয়েছিল। এর ফলে উইপোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

পুরু লাল মাটির দেওয়াল। লালমাটির দেশের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এ বাড়ির ছাদটাও মাটির। কবির আমন্ত্রণে এ বাড়িতেই সস্ত্রীক এসেছিলেন গান্ধীজি। কাটিয়েছিলেন গুরুদেবের সঙ্গে বেশকিছুটা সময়। বাড়িটির সামনের অংশ বৌদ্ধ চৈতের আদলে তৈরি হয়েছিল।

ঘরের এক পাশে ছিল জাম , বেল , মাদার , কুরচি। আর অন্যপাশে তেঁতুল , আতা , শিরীষ , ইউক্যালিপটাস। সামনের আঙিনা ছিল গোলঞ্চের বাহার। পিছনের দিকে ছিল কাঁঠাল, আমসহ বিভিন্ন গাছ।

কবি বেলফুল সহ বিভিন্ন ফুলের টব দিয়ে সাজিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল বাতাবি পাতিলেবুর গাছ। লেবু ফুলের গন্ধ কবিগুরুর খুব প্রিয় ছিল।

এই বাড়ির দেওয়ালে হাই রিলিফ কাজ। হাই রিলিফ (High Relief) হল এমন একটি ভাস্কর্য যেখানে খোদাই করা মূর্তি বা নকশার অংশগুলি পটভূমি থেকে প্রায় অর্ধেক বা তার বেশি পরিমাণ খোদাই করা হয়। এর ফলে মূর্তিগুলো প্রায় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দেখায়।

দরজা দু’পাশে সাঁওতাল ও সাঁওতালি দম্পতির ছবি। (ছবিটি রামকিঙ্কর বেজের আঁকা)

মাটির সার্থক ব্যবহার যে কিভাবে করতে হয় তার প্রমাণ এই শ্যামলী গৃহটি।

শ্যামলী বাড়িটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। তিনি কখনও আম গাছে নিচে, কখনও গোলঞ্চ গাছের পাশে, হাজার মৌমাছির গুঞ্জনে রচনা করে গেছেন সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। রাণী চন্দ তাই সস্নেহ সুরে বলেন , শ্যামলীর চারদিক ঘিরে সে যেন এক ছোট ছেলের খেলা। ‘শেষ সপ্তক’-এ ‘চুয়াল্লিশ নম্বর’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ---

“আমার শেষবেলাকার ঘরখানি

বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,

তার নাম দেব শ্যামলী।


পুনশ্চ

কবির স্বপ্নের শ্যামলী টানা বর্ষণ আর ঝড়ের দাপটে ভগ্ন প্রায় হয়ে পড়ে। দেওয়ালের কিছু অংশ এবং ছাদের কিছু অংশ ভেঙে যায়। আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় মেরামতির কাজ। নতুন গৃহ নাম রাখা হল পুনশ্চ। শ্যামলীর একটা সংস্করণ পুনশ্চ। শিল্প সংস্কৃতির দিক থেকে এই বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এই ভিত ছিল বেশ খানিকটা উঁচু ।

ঘরের সামনে ছিল একটা স্টেপ বাগান।

পূর্ব দিকের বারান্দায় প্রথম সূর্যের কিরণ এসে পড়ত। কবি সেখানে লেখালেখির পাশাপাশি চিত্রকলাতেও মনোনিবেশ করেছিলেন।

আবার রৌদ্র যখন প্রখর হয়েছে তখন তাকে আড়াল করার জন্যেও এর বিপরীত কোণে দুটি জানলার লাগানো হয়েছিল।

ঘরের মধ্যেকার বায়ু চলাচলের সুগম ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বাড়িতে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সৌন্দর্য ।

প্রয়োজনের সাথে সৌন্দর্য চেতনার হর-গৌরির মিলন ঘটেছিল।

আসবাবপত্রের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছিল।

কাঠের বড় বড় বাক্সগুলিকে একদিকে যেমন স্টোর তেমনি বসার জায়গা সে ব্যবহার করা হয়েছিল

বাড়িটির গঠন শৈলীতে অভিনবত্ব আছে।


উদীচী

কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বাড়ি ছিল উদীচী । ‘উদীচী’ শব্দের অর্থ হল বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি এই বাড়িটির অবস্থান ছিল পূর্ব দিকে। দোতলা বাড়ি। ছোট ছোট ঘর। এটি তৈরি করা হয় ১৯৩৮ সালে।বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

পূর্ব দিকে অবস্থান হওয়ায় এর নাম ছিল উদীচী।

ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর ।

প্রথমে একতলার দিকটা ফাঁকা ছিল শুধুমাত্র কয়েকটি থাম তার ওপরে দোতলার অংশ নিচটা খোলা।

এগুলো ডুপ্লেক্স (Duplex house) বাড়ি বাড়ি গুলি এমন ধরনের আবাসিক ভবন যেখানে একই কাঠামোর মধ্যে দুটি পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে প্রতিটি ঘরে নিজস্ব প্রবেশপথ রাখার জায়গা এবং শয়নকক্ষ।

সুন্দর উদ্যান বিন্যাস এবং বাগানের পরিকল্পনা।

ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের সার্থক প্রয়োগ এটি।

তবে অন্যান্য বাড়িগুলো তুলনায় এ বাড়ির ব্যয় কম।

অজন্তা গুহার অনুকরণে করা হয়েছিল থামগুলি।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছের অবস্থান ছিল প্রাঙ্গণে।

এই বাড়ির চাতাল বারান্দা সিঁড়ি সবমিলিয়ে ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বলতম নিদর্শন।


সাধারণভাবে শিল্পী তার শিল্পসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান কখনও শব্দে, কখনও সুরে, কখনও বা রঙে। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ শুধু এসবের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখলেন না। তিনি প্রমাণ করলেন বাস্তুশিল্প বা স্থাপত্যকলাতেও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। শান্তিনিকেতনের এক একটি বাড়ি স্থাপত্যকার রবীন্দ্রনাথের সফলতম ফসল।পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপত্য নির্মাণে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।আশ্রমের রূপ পরিবেশ সামগ্রিক বাস্তুশিল্পের সাথে পরিবেশবান্ধব এক আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। খেয়ালি-কবি বাড়ি বদল করতে ভালবাসতেন। বলেছিলেন মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কিন্ত এগুলিকে বাস্তবায়নের জন্য কবিগুরুকে নানান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে পড়তে হয়েছিল। কিন্ত ভালো কাজেই বাধা আসে। কিন্ত সে বাধা ভালো কাজকে রুদ্ধ করতে পারে না। তাই বাধা এসেছে, সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি করেছে আবার সমাধানের পথ বেরিয়ে এসেছে। এভাবেই মানবনির্মিত পরিবেশ এবং প্রকৃতিনির্মিত পরিবেশের সার্থক সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এই গৃহগুলি। সৌন্দর্যবোধের সাথে সামগ্রিক জীবন বোধের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল যা এই আশ্রমটিকে এনে দিয়েছিল সজীবতা ও তপোবন-সুলভ মাধুর্যতা।





--------------------------

গ্রন্থঋণ

‘গুরুদেব’ - রানী চন্দ

‘রবীন্দ্রনাথ ও লোক সাহিত্য’ - ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য

‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ - অরুনেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ’ - ডঃ অতসী সরকার

পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৩

0 comments:

0

পথে প্রান্তরে - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার

Posted in









দ্বিতীয় পর্ব

গাড়ি ঠিক সাতটায় এল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম সোয়া সাতটায়। সেই একই রাস্তা। চেম্বুর হয়ে পুনার রাস্তা ধরো। আমরা সকালে বেড়িয়েছি। হ্যাঁ, এখানে সাতটা সকালই। আমি এখানে কাজ করেছি, থেকেছি। জানি। সকালে বেরোলে একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। বম্বে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। একবার জ্যামে পড়লে রক্ষে নেই। তাও গাড়ি চলছে ৪০এ। মাঝে মাঝে ৩০।

মহারাষ্ট্রের একটা পর্যটন কেন্দ্র। এখানে ভগবান, প্রকৃতি আর অ্যাডভেঞ্চার সব পাওয়া যাবে একসাথে। গ্রামে ভোরগিরি মন্দির আছে। সেখানে শঙ্কর মহাদেব বসে আছেন। ট্রেক করে – ট্রেক বললে মড মড লাগে—আসলে হেঁটে নেমে যাও। ৫/৬ ঘন্টা লাগবে নীচের গ্রামে পৌঁছোতে। পা ধরে গেলে হনুমান লেকের পাশে বসে যাও। বন জঙ্গলে ঘোরার সাধ থাকলে গাড়ি নিয়েই ঢুকে পড়া যায়। বড় কাঠবেড়ালি, প্যাঙ্গোলিন আর সাপ খোপ। এর বেশি প্রত্যাশা রাখলে ঠকতে হবে বলে দিলাম। সঙ্গি থামলেন।

পাথরের মাঝখান থেকে লিঙ্গটি মাথা তুলে আছে। ছোঁয়া যায়। তার চারপাশ দিয়ে জল বইছে।

পুনা থেকেও যাওয়া যায়। আমরা কিন্তু পুনা পর্যন্ত যাবো না। তার আগেই ‘চাকান’ থেকে বেঁকে যাব বাঁয়ে। এক দিন দু রাত যথেষ্ট। বম্বের অনেকের উইকেন্ড বেড়ানোর পছন্দের জায়গা।

কেমন যেন গা ছাড়া জানকারি।

দাও দাও, খাবার দাবার কিছু এনেছ কি সাথে?

বেশ চলছিলাম আমরা। বাঁয়ে ঘোরার পরই পাল্টে গেল আশপাশ। ফ্যাক্টরি এলাকা। আমার কিন্তু বেশ লাগে। জাতে মিস্ত্রি কিনা। চেনা শোনা নাম দেখলে ভেতরে একটা কথা উঠে আসে “ ও, এখানে তোমাদের আস্তানা বুঝি ?” ছোট ছোট টিলা সমান করে দিয়ে কারখানা সব। সার সার মোটর সাইকেল। মনে এল এরা সব থাকে কোথায়? কতদূর থেকে যাতায়াত করে? চোখে পড়ল বাবা ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। হেলমেট নেই। অবশ্য রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই। আমাদের আগেও নেই, পেছন থেকেও কেউ ওভারটেক করেনি এখনও। মজার মধ্যে একটা টিলা থেকে নামছি, আর একটায় উঠছি। পাহাড়ি রাস্তায় চলছি অথচ সবুজ নেই। রুক্ষ চারপাশ। চোখের আরাম সুন্দর সুন্দর কারখানা। অনেক লোক কাজ করছে।

মন খারাপ করে। আমার চোখের সামনে কেমন করে পুনার চারপাশ কারখানাময় হয়ে গেল। আমাদের বাংলাটা হল না। সিঙ্গুর, টাটা এই সব মনে ভাসছে।

সব ভালো, রাস্তা ভালো না। এত ভালো গাড়ি তাও বেশ ঝাঁকুনি।

একটু কথা বার্তা হচ্ছিল ভেতরে। বাইরে তাকিয়ে দেখি পাল্টে গেছে আশপাশ। আমাদের মন বুঝেছে প্রকৃতি। একটা পাহাড়ি নদি --- নদি বলব? নাকি ঝোরা? সোঁতা? ছোট্ট একটা গাঁ। সবাই সবার বন্ধু। একজন হাঁটু জলে নেমে হুস করে ঘুরিয়ে ফেলল জাল। এই একটা ছবি দারুন একটা ভারতনাট্যম মুদ্রার থেকেও ভালো লাগে আমার। তারপর সাসপেন্স। নর্তক জালের মাথা ছোট করছে আর দড়ি গোটচ্ছে হাতে। খুব সাবধানী গুটি গুটি হাঁটছে আর একটু, আর একটু করে আরো একটু গভীরে । দারুন একটা সাস্পেন্স থ্রিলার। কি মাছ উঠবে? কত মাছ উঠবে? উঠবে কি?

কোচির গল্প মনে পড়ল। মেরিন ড্রাইভ এ একটা মস্ত তেকোনা জাল টাঙ্গানো আছে বাঁশের মাথায়। একটু লোক জমলে জাল ফেলে তুলে আনে। আমাদের দেখে ফেলল। অ বাবা, তিন খানা চিংড়ি, একটা কাঁকড়া। হেসে বাঁচি না।

একটু এগোতেই দেখা গেল “কোন এক গাঁয়ের বধু” বসেছে কাপড়ের ডাই নিয়ে। গল্প করছে। কার সাথে? ঝোরার সাথে। মনের কথা নাকি নদিকে বলে দিতে হয়। মন একদম হাল্কা হয়ে যায়।

এই যাহ। তোমার যত বানানো কথা।

এই দেখ, তোমরা না জানলেই সেটা গাঁজাখুরি হবে?

দেখ, ওর হাত চলছে আর মুখও চলছে। বেলা বাড়ছে যে। এই স্নান সেরে ঠাকুরের পায়ে দুটি ফুল দিয়ে ওদের খেতে দিতে হবে না ?

ছোট্ট একটা সাঁকো --- এই, এই সাঁকোর ওপর দিয়ে কি গাড়ি যায়? এইবার খেতি দেখা যাচ্ছে। আমি সামনে ছিলাম ড্রাইভারের পাশে। আমি তো মোহিত হয়ে দেখছি, বলছি আর শুনছি গাঁয়ের কথা। ও আমায় বলল

“থামব সাব ছবি তুলবেন না”?

ঠিক কথা। ছবি তোলা উচিত। এই বার সবাই ছবি তুলতে শুরু করল। টিলার গায়ে ধাপে ধাপে নামছে খেতি।

“ঝুম চাষ, ঝুম চাষ”।

“মোটেও না। পরিযায়ী মানুষজন ঝুম চাষ করে জঙ্গল, গাছপালা জ্বালিয়ে দিয়ে। ঐ জ্বালিয়ে দেওয়া ছাই ওদের সার”।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল নেকলেস পরা পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। বম্বে থেকে গুজরাটের দিকে আমাকে প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে যেতে হত। যেদিন সন্ধ্যের মুখে পাহাড় এর ঢালে গাড়ি চালাতে হত, কপাল ভালো থাকলে বা সময়টা ঠিক হলে দেখতে পেতাম সন্ধ্যের ধূসর আকাশের ঘোমটা টেনে পাহাড় দাঁড়িয়ে। কালো। তার গলার কাছে সোনার কাজ করা নানান নকশার হার। দাঁড়িয়ে যেতাম চাবি বন্ধ করে। যে দেখেনি, বা দেখার সুযোগ হয়নি যার, সে ভাবতেও পারবে না পাহাড়ের সে রূপের কি মোহ!

ঝুম চাষের শুরু।

ছবি তোলা হল।

এসব ধাপ চাষ। দেখছ না ধাপে ধাপে নেমে গেছে সবুজের সারি। বললাম দাঁড়িও না। রাস্তা যা খারাপ গাড়ি চলছেই না। কেউ যেন কুড়ি কিলোমিটার বাঁচাবার জন্য এই পথ না ধরে। হেঁটে যাও, চলবে। গাড়ি এনো না এ পথে।

দাঁড়াতেই হল। ফুলের হাতছানি। মাদাম নেমেই গেলেন। ফুলেরা সভা করছে। সেখানে তিনি গেলেন তাঁর বক্তব্য পেশ করতে। আমিও নামলাম। একজন চেনা, সূর্যমুখির কুট্টি বোন। এনাদের সভাতেই গেছেন মাদাম। অন্যজন ভারি ছোট, ছোট্ট কন্যে। একদম কাছে যেতে হল ওনার সাথে কথা বলতে। আলাপ হল, সঙ্গে চলল আমার।

নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম ধাপ চাষের দিকে। একটা হাতছানি দিয়ে ঘুরে গেছে রাস্তাটা। একটা মোটর সাইকেল দেখা যাচ্ছে না? এই দেখ দেখ, একটা বাড়িও দেখা যাচ্ছে না মোড়ের মাথায়? বেট, মোটর সাইকেল ঐ বাড়িতেই থামবে।

ছবিকে পূর্ণতা দিয়েছে এখানে ওখানে ঝাঁকড়া মাথা গাছ। রঙের খেলাও আছে। ধুসর, গাঢ় সবুজ, সবুজ, কচি সবুজ, কালো রাস্তা। একটু ডান পাশ ঘেঁষে একা দাঁড়িয়ে একটা পোল। একজন তো থাকতে হবে দর্শক। নতুবা প্রশংসা করবে কে!

‘সেই পথ এসে মিলে গেল শেষে’ --- পাক্কা হাইওয়েতে। যদি ঠিক ঠাক মনে পরে এস এইচ ৫৪। স্টেট হাইওয়ে ৫৪। এটা পুনা থেকে আসছে। একদম পাটা রাস্তা। গাড়ি এবার শোঁ শোঁ করে ছুটছে।





0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















যুদ্ধমাঝে শান্তির দূত মাহমুদ দারবিশ



সুপ্রিয় বাসু,

বহুবছর পর তোমার ভাবানুবাদে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে দারুন লাগলো। মনে পড়ে গেলো মাহমুদ দারবিশের কবিতার কথা। ‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।

ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম কবিতা। সুপ্রাচীনকাল থেকে কবিতাই মানুষের দ্রোহ, প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। মন ও মননের ছান্দসিক প্রকাশের কারণে সব যুগেই কবি ও কবিতা সমাদৃত। যুগে যুগে স্থান, কাল ও সীমান্তের সীমা অতিক্রম করে কবিতা হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। মাহমুদ দারবিশের কবিতা এমনই—ভালোবাসা ও বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও আলিঙ্গন হাত ধরাধরি করে এগোয়। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।

মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’ ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক চেতনার কবিতার পাশাপাশি দারবিশ বার বার বলতেন শুদ্ধ কবিতার (Pure Poetry) কথা। কেননা তার কবিতা হলো বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে কথোপকথন। নির্দ্ধিধায় তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন ইসলামিক, খ্রিষ্টিয় ও ইহুদি মিথ। মোহময় সংগীতময়তায় আচ্ছন্ন তাঁর কবিতা। যেখানে রয়েছে জীবনের আশ্চর্যময়তা Mistry of Life এবং মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অন্য রূপান্তর। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলতে পারেন:- “যখনই আমি নিজেকে খুঁজি অসংখ্য মানুষের দেখা পাই যখনই তাঁদের খুঁজতে যাই তখন আমি একা নিঃসঙ্গ। তখন আমি লাখো জনতা।” (ম্যুরাল) এভাবেই তিনি আত্মপরিচয়ের অযুথ বাণী তুলে ধরেন কবিতায়। জীবনের যুযুধান সময়কে সামনে রেখে হাঁটতে থাকেন। কেননা একই সঙ্গে তিনি একা এবং অসংখ্য। (Individul Crowed) জাতিগত বিভেদের সমথনে যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি দম্ভ প্রকাশ করে, দুই মানুষের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, তখন একজন কবিকে তা সবচেয়ে বেশি আহত করে। সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে দারবিশের প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।

তুমি যেভাবে প্লাথের কবিতা পাঠিয়েছিলে,তোমার মতন করে দারবিশের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠাতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছে ছিল তোমাকে লিখে দেই একটা গোটা জীবন, যাক সব পেলে জীবন হয়ত অতৃপ্ততা চিনতো না। ভালো থেকো নিরন্তর। শেষ করার আগে দারবিশের কবিতায় খুব বলতে ইচ্ছে করছে -

Between Rita and my eyes
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and prays
To the divinity in those honey-colored eyes.
And I kissed Rita
When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids.
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita
Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous
Fired at by a rifle.
Rita’s name was a feast in my mouth
Rita’s body was a wedding in my blood
And I was lost in Rita for two years
And for two years she slept on my arm
And we made promises
Over the most beautiful of cups
And we burned in the wine of our lips
And we were born again
Ah, Rita!
What before this rifle could have turned my eyes from yours
Except a nap or two or honey-colored clouds?
Once upon a time
Oh, the silence of dusk
In the morning my moon migrated to a far place
Towards those honey-colored eyes
And the city swept away all the singers
And Rita.
Between Rita and my eyes—
A rifle.



শুভেচ্ছান্তে-
সুস্মি
১৭ মে, ২০২৫

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


১১

বের্নহার্ড এখনও চার্লসের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানে না। তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে প্রাণপণে নিজের বিস্ময় এবং বিরক্তি গোপন করবার চেষ্টা করে যায়। তাছাড়া তার রেওয়াজের সময় অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চার্লসের মত এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষ কেন তাকে বিশ্বাস করে এত ব্যক্তিগত কথা বলে চলেছে সে একেবারেই বুঝতে পারছে না। এদিকে চার্লস একেবারেই লক্ষ্য করছে না যে বের্নহার্ড অধৈর্য হয়ে উশখুশ করছে। সে বিরতিহীনভাবে নানা কথা বলে যাচ্ছে। এমন ভাবে বলছে যেন এই কথাগুলো এই মুহূর্তে সে শুধুমাত্র বের্নহার্ডকেই বলতে পারে। তার এখন এক সহমর্মী বন্ধু না হলেও, নিদেনপক্ষে একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা প্রয়োজন। ‘কারণ’ সে বলে… ‘আপনি বুঝতেই পারছেন যে আমি একবর্ণ বানিয়ে বলছি না। আমি তো আগাগোড়া আন্তরিক থাকতেই চেয়েছি, কিন্তু এই মুহূর্তে তো সেটাও সম্ভব নয়, তাই না?’ তার মানে সে বলতে চাইছে যে কাউকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে সে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, মানে তাকে কেউ ঠকিয়েছে। অর্থাৎ সে নিজের কাহিনী একটা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করেছে। অথচ সে যে সত্যি বলছে, অর্থাৎ তার নিজের যে কোনও দোষ নেই, সেটা বের্নহার্ডের কাছে প্রমাণ করবার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। কিন্তু গতকাল তার সঙ্গে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; ফলে সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা হয়তো সে নিজের মধ্যেই গোপন রাখতে পারত, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে আবার অনেকগুলো অতীতের সূত্র আছে। সেই সূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাগুলো আবার বেশ দীর্ঘ। সেই পুরো ইতিহাস না বললে বের্নহার্ড কিছুই বুঝতে পারবে না। আবার যাদের নিয়ে এসব ঘটনা, তাদের কাউকে বের্নহার্ড চেনে না। ফলে সবকিছু খুলে না বললে ব্যাপারটা একেবারেই বোধগম্য হবে না।



অবশেষে চার্লস একটু ঠিকঠাক বাক্য গঠন করে কথা বলতে শুরু করে এবং একেবারেই থামতে পারে না সে। সে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কথা বলে যায়। বের্নহার্ড মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে। সে এই প্রথম হাসল চার্লসের দিকে তাকিয়ে এবং হাসির মধ্যে কোনও মেকি, সাজানো ব্যাপার নেই। তার মনে হল যে যদি সে একটু কষ্ট করে কথাগুলো শোনে, হয়তো তাহলে চার্লসের কষ্টটা একটু লাঘব হবে। সে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘ঠিক কী হয়েছে?’ একটু সামনে ঝুঁকে বসে সে, যাতে বোঝা যায় যে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে সে সব কথা শুনছে। বের্নহার্ডকে চার্লস যেন অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চায়। কথা বলতে বলতে সেও ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপরে। বের্নহার্ডের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে প্রায় তার মুখে মুখ ঠেকে যায়।

‘আপনি আমার বন্ধু’ সে ফিসফিস করে, ‘ওঃ, আমার মনে হচ্ছে যে আপনি আমার বন্ধু হতে চাইছেন, তাই না?’

বের্নহার্ডের একটু অপ্রস্তুত বোধ হয়; যদিও এই ভিনদেশি ছেলেটির আবেগ তাকে স্পর্শ করে, কিন্তু এই আবেগের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ভাসিয়ে নেবার মত গতি আছে, যেটা তার ততখানি পছন্দের নয়। সে মৃদুস্বরে চার্লসের দিকে না তাকিয়েই বলে “Mais oui – soyez tranquille, je vous en prie, soyez tranquille!” (মাই উই— সইয়ে ত্রংকিল, জেভোসেঁপ্রি, সইয়ে ত্রংকিল) যার অর্থ হল ‘কিন্তু হ্যাঁ, শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন!’



চার্লস উঠে দাঁড়ায় তার দু’হাত আলোকিত টেবিলের উপরে রেখেই। তার হাতের আঙুলগুলো সরু সরু হলদেটে, বিশ্রী হাতের নখ।

‘ওঃ’ হঠাৎ তার কণ্ঠস্বরে একটু উদাস ভাব আসে, ‘ভাববেন না যে আমি আপনাকে খুব নাটকীয় কোনও গোপন কথা বলব। আমি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তাই না? মাপ করবেন। আসলে অনেক সময় আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত নই আপনার মত! গতকাল যা ঘটেছে, তার জন্য আমার দুর্বল শিক্ষাদীক্ষা দায়ী; নাহলে হয়তো ওই ঘটনাটা এড়ানো যেত। আপনার জানা আছে আশা করি যে আমার ধূমপানের অভ্যেস আছে। আসলে এটা ঠিক নেশা নয়, কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার সময়ে আমার ধূমপান করা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই অভ্যেসটা ছাড়তে পারছি না। এটা ভাল নয়, কারণ খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু একটা গোটা সন্ধ্যা যদি ধূমপান না করে থাকতে হয়, তাহলে সেটাও আমার পক্ষে কষ্টকর। না, কষ্টকর নয়, বিষণ্ণ, ওঃ না, বিষণ্ণ সঠিক শব্দ নয় এক্ষেত্রে। বরঞ্চ বলা চলে যে আমার অস্থির লাগছিল, কিছু ভাল লাগছিল না, কী যেন খুঁজছিলাম আমি… জিভের মধ্যে একটা বিশ্রী স্বাদ… সবার সব কথার উত্তরে কটু কথা বলেছি আমি। গতকালের ব্যাপারটা কতকটা এইভাবেই শুরু হয়েছিল। আমরা বন্ধুরা রবার্টের সঙ্গে বসেছিলাম। রবার্টের কাছে কোনও সিগারেট ছিল না। ওইখানে আরও দুটো মেয়ে ছিল, ওরা গান গায়, ওরা বলল যে ওদের সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না। তো… সেইজন্য আমি সিগারেট কিনতেও যেতে পারছিলাম না, যদিও আমার কাছে পয়সা ছিল (আসলে গতকাল ফাঁকেতালে আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে অনেক আগের ধার দেওয়া টাকাটা ফেরত পেয়েছিলাম।)। কিন্তু মেয়েদুটো যে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেনা, এটা একেবারে বাজে কথা… কারণ প্রতি সন্ধ্যায় আমি ওদের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে বিবি বারে বসে ড্রিঙ্ক করতে দেখি। যাকগে, কে আর প্রমাণ করতে যাবে যে ওরা গায়িকা টায়িকা কিচ্ছু নয়, বরঞ্চ একেবারে সাধারণ অসফল বার গার্ল। কারণ ওরা যদি সফলই হবে… তো ওরা যেটা নয়, নিজেদের সেটা প্রমাণ করবার কোনও দায় থাকত না। মিছে ভান করত না তাহলে!’

চার্লস নিজের সঙ্গেই রাগতস্বরে কথা বলে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা ঝরে ঝরে পড়ছে। বের্নহার্ডের অবাক লাগে। সিগারেট খেতে না পারা কিম্বা ওই মেয়েদের আপত্তি, যারা গায়িকা হতে পারে কিম্বা হতেই পারে বার গার্ল… ধূমপান না করা কিম্বা ওই মেয়েদের সফল হওয়া… এইগুলোর মধ্যে কোনওটাই এমন উগ্র আচরণের কারণ হতে পারে না।

চার্লস বের্নহার্ডকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে হিংস্রভাবে বলে ওঠে… ‘আপনার এত অবাক হবার মত কোনও কারণ ঘটেনি। আপনি জানেন না যে সারা সন্ধ্যা একঘেয়ে ধরনের মুখে পেইন্ট করা মেয়েদের পাশে থাকা কতখানি বিরক্তিকর, তাদের বোকা বোকা কথা শুনে যাওয়া, সর্বোপরি তাদেরই আপত্তির কারণে সিগারেট না খাওয়া… পুরো ব্যাপারটাই বিশ্রী এবং বিরক্তিকর। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে মেয়েগুলোর কণ্ঠস্বর কতখানি বোকা বোকা এবং অসহ্য! আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছি। অবশ্যই আমি চলে আসতে চেয়েছিলাম (ফিরে এলেই ভাল হত!); কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আপনাকে বুঝতে হবে গোটা ব্যাপারটা। সারাদিন স্কুলে, তারপর সন্ধেবেলায় এইসব… নিজেকে স্পঞ্জের মত মনে হচ্ছিল আমার।’

‘আপনি ঘুমোতে চলে গেলেন না কেন?’

-‘আমার রবার্টের সঙ্গে থাকবার কথা ছিল। আপনি বুঝবেন না, কিন্তু ব্যাপারটা খুব প্রয়োজনীয় আমার কাছে। রবার্ট একটু অদ্ভুত ব্যক্তি এবং আপনি যদি তার বন্ধুবৃত্তে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একটা সন্ধ্যাও রবার্টের সঙ্গ ছাড়া চলবে না আপনার। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। হতে পারে যে ওইখান থেকে নানা যোগাযোগ হল ভবিষ্যতে কাজকর্মের ব্যাপারে। যদিও এখন এসব আমার কাছে অতীত… অবশ্যই অতীত। আমি সেখানে আর যাচ্ছি না। আপনি জানেন জেরাল্ডের উপরে ঐ রোমানিয়ান নেকুপুষুর কতখানি প্রভাব? কিন্তু আপনি তো আবার জেরাল্ডকে চেনেন না।’



বের্নহার্ড গভীরভাবে ভাবতে থাকে। জেরাল্ড নামটা সে এর মধ্যেই শুনে ফেলেছে। এই নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সঙ্গীতশিক্ষকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা এখনও আছে তার কাছে। কিন্তু সেই জেরাল্ড চিকিৎসক, একজন নামকরা শল্যচিকিৎসক। চার্লস যার সম্বন্ধে বলছে, হয়তো তিনি অন্য কোনও ব্যক্তি।



(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.১

সাত সকালে গোটা গাঁয়ে খবর চাউর হল যে পুলিস জোগনাথকে গ্রেফতার করেছে। সবাই অবাক,

ব্যাটা জোগনাথ তো বৈদ্যজীর লোক। ওকে ছুঁতে পুলিসের হিম্মৎ হল? গ্রামের গুণ্ডার দল এবং

ভালোমানুষ –সবাই ঘাবড়ে গেল। গুন্ডাদের চিন্তা—যখন বৈদ্যজীর খাস আদমীকে পুলিস ছেড়ে কথা

কয় নি, তো আমরা কিসের খয়ের খাঁ! ভালোমানুষের দল ভাবল—পুলিস যখন নিজেদের লোকের সঙ্গেই

এমন করেছে, তখন সময় খারাপ হলে আমাদের সঙ্গেও কী করবে , কী না করবে -কে জানে!

পুলিশের সমস্ত গ্রেফতারি বেশ নাটকীয় হয়, এটাও ব্যতিক্রম নয়।

এটা না বললেও চলে যে ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার সমস্ত কৃতিত্ব পুলিশের। দারোগাজীকে

পড়ানো হয়েছিল যে বিপদজনক আসামীদের ধরতে উপযুক্ত সময় হল রাতের চতুর্থ প্রহর। তাই

জোগনাথকে ধরার জন্য ব্রাহ্মমুহুর্তই ঠিক হল--- যদিও সারাদিন জোগনাথকে গ্রামের মধ্যে

খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এবং তাকে থানায় ডেকে এনে আটকে রাখা খুব সহজ।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ পুলিস এসে জোগনাথের বাড়ি ঘিরে ফেলল। এটা জানা কথা যে এখানে

গোলাগুলির কোন সম্ভাবনা নেই। তাই সব পুলিসের হাতে রাইফেল! দারোগাজী তাঁর পিস্তলে গুলি ভরে

হেড কনস্টেবলের কানে কানে বললেন—কানপুর থেকে একদল বদমাশ কাল এদিকে এসেছে। হতে পারে

ওরা জোগনাথের ঘরে লুকিয়ে আছে।

হেড কনস্টেবল—হুজুর, কানপুর থেকে যারা এসেছে ওরা আচার্য ভাবের ভুদান আন্দোলনের

কার্যকর্তা।

‘ওটাই তো’, দারোগাজী ফুসফুস করে বললেন,’ আগেকার দিনে বদমাশেরা সাধুর বেশ ধরে ঘুরে বেড়াতো,

আজকাল অন্য বেশ ধরেছে’।

সমস্ত সিপাহী প্রথমে বজরঙ্গবলীর নাম জপল, তারপর বৌ-বাচ্চার মুখ মনে করল। অবশেষে

হাতিয়ার তুলে বদমাশের দলের সঙ্গে মুখোমুখি হতে এগিয়ে চলল। সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে তৈরি,

সবার প্রাণ ধুকপুক করছে।

বাড়ি ঘেরাওয়ের পর বড় বড় পদক্ষেপ নেয়া হল। সমস্ত সেপাই খৈনি না ডলে, বিড়ি না খেয়ে পজিশন

নিয়ে পাথরের মূর্তির মত আধঘণ্টা অপেক্ষায় বসে রইল। কেউ হাসে নি, কেউ কাউকে হাসায় নি।

একজন সেপাই জুতো খুলে বুকে হেঁটে সবার কানে কানে মন্তর দিতে লাগল—ধৈর্য ধর, কোন বিপদের

সম্ভাবনা নেই।

সবাই অভিজ্ঞ, জানে যে বিপদ কারও মুখের কথায় কাটে না। তাই সবাই বিপদের মধ্যেই ঘাঁটি গেড়ে

বসে রইল। দারোগাজী পিস্তল নিয়ে এবং হেড কনস্টেবল রাইফেল হাতে জোগনাথের দরজায় দাঁড়িয়ে।

একটা লোক গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে হেড কনস্টেবল ইশারায় ডাকল, কাছে এলে কানে কানে

প্রশ্ন করল,--পালাচ্ছিলে?

ও পালটা জবাব দিল—পালাবো কেন? সাতসকালে আপনাদের মুখদর্শন করার থেকে রেহাই চাইছিলাম।

দারোগাজী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন—স্‌ স্‌ স্‌!




হেড কনস্টেবল—এই বারান্দায় বসে পড়। সাক্ষী দেবে।

ও বলল, --এখানে বসার কী দরকার? কাল, পরশু, তরশু যেদিন ইচ্ছে খবর দেবেন। এসে সাক্ষী দিয়ে

যাব। আমি আপনাদের পর তো নই।

ও কেটে পড়ছিল। হেড কনস্টেবল ফের ওর কানে কানে বলল,--ঠিক আছে, যাও। কিন্তু খবরদার!

আমরা যে এখানে রয়েছি সেটা কাউকে বলবে না।

ও হেড কনস্টেবলের কানে নিজের নাক ঢুকিয়ে বলল—বলার কী আছে? গোটা গাঁ জেনে গেছে।

লোকটা চলে গেল। ঘরের পেছনে ওত পেতে বসে থাকা সেপাইদের এবার বিড়ি-খইনির নেশা চাগাড় দিচ্ছে।

প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে। একটু দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ পেছনের সারির

সেপাইদের কানে এল খড় খড় শব্দ। কেউ বোধহয় বাইরের দরজাটা খুলছে। চটপট কথাবার্তার আওয়াজ

ভেসে এল। এরা বুঝে গেল –ধর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের লগ্ন এসে গেছে। এরা বন্দুক ও

সঙীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।




ওদিকে দরজার কাছে কথাবার্তার স্বর আরও দ্রুত লয়ে চলছে এবং ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেপাইয়ের দল শরীরের ভেতর এক অস্বস্তি বোধ থেকে ছটফট করে কাশতে লাগল এবং প্রত্যেক

কাশির সঙ্গে শরীরের সমস্ত ছিদ্র থেকে পবন-মুক্তাসন! একটু পরে কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স এল।

বিপদ সংকেতের সিটি বেজে উঠতেই এরা দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে দৌড়ে পঞ্চাশ

গজ দূরের আমবাগানে। একেবারে নাটকীয় পরিস্থিতি!

ওরা দেখল-- জোগনাথ মাটিতে বসে আছে। দারোগাজী ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছেন। হেড

কনস্টেবল অন্যদিক থেকে সঙীন উঁচিয়ে রয়েছে। স্টেজে ব্লকিং হিসেবে দারুণ। শুধু ড্রপসিন নামাটাই

বাকি। সেপাইয়ের দল এসে দ্রুত কম্পোজিশন বদলে দিল। ওরা জোগনাথের শরীরের যতটুকু ভাগ

পিস্তল সঙীনের নিশানা থেকে বেঁচে রয়েছে সেখানে কব্জা করল। জোগনাথের একটুদূরে একটা বদনা

উলটে পড়ে আছে। পাশের খানিকটা জমি জলে ভেজা। দারোগাজী একটা সেপাইকে হুকুম করলেন—“ ওই

লোটা বাজেয়াপ্ত কর, প্রমাণ পেশ করতে কাজ দেবে”।

সেপাই বদনা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারিফের সুরে বলল—মোরাদাবাদী পিতলের লোটা! তারপর কী

ভেবে বলল—সীল লাগিয়ে দিই?

--এখন না, পরে হবে’খন।

সেপাই লোটার জল পড়ে ভিজে যাওয়া জমি দেখতে দেখতে বলল—‘ওই মাটিও খানিকটা তুলে নিয়ে রাখি?

এটাও প্রমাণ হতে পারে’।

হেড কনস্টেবল ধমকে উঠল—বেশি চালাকি কোর না। যতটুকু বলা হয়েছে ততটাই কর।

দারোগাজীর হুকুমে জোগনাথকে দাঁড় করানো হল। ওর শরীর সার্চ করা হল। ফের বেয়নেট খাপে ঢুকে

গেল, পিস্তল চামড়ার হোলস্টারে। সেপাইদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল।

একজন বলল-- ‘এ ব্যাটা বোধহয় সাতসকালে পেট সাফ করতে মাঠে গিয়েছিল।




দ্বিতীয়—কে বলতে পারে, হয়ত কাছাকাছি কোন বদমাশের দল আস্তানা গেড়েছে। ওদের খাবার এবং

জলটল দিতে গেছল।

তৃতীয়—এবার বৈদ্য্যজী ঝামেলা পাকাবেন।

চতুর্থ নীচুগলায় বলল—বৈদ্যজী এখন দারোগাজীর পকেটে; এবারের রেইড কাপ্তান সাহেবের হুকুমে

হয়েছে।

পঞ্চম—চুপ! চুপ! ওদিকে দেখ, কেমন তামাশা জমেছে।

জোগনাথ নিজের জায়গায় কোন লোকনৃত্যের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে ও নাচবে না।

হঠাৎ দারোগাজী ওর গালে জোরদার থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন—লোটা নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?

আঘাত সামলাতে ও খানিকক্ষণ চোখ মিটমিট করল। তারপর দারোগাজীর চোখে চোখ রেখে

বলল—আমাকে টুকরো করে কেটে ফেললেও উকিল না আসা পর্যন্ত কিস্যু বলব না।

দারোগাজী হেড কনস্টেবলকে বললেন—ব্যাটাকে হাতকড়ি লাগিয়ে নিয়ে চল। এখন ওর ঘরের

খানাতল্লাসি নেয়া দরকার।

‘একে জেরা করাও দরকার’, হেড কনস্টেবলের মন্তব্য।




পুরো ঘটনার বিবরণ দারোগার মুখ থেকে শুনতে চাইলে উনি যেমন বলবেনঃ

আজ থেকে আট দিন আগে গাঁয়ে চোর এসেছিল। পুলিস গ্রাম-রক্ষা-সমিতির সাহায্যে ওকে ধরার চেষ্টা

করেছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, চালাক চোর দলের একজন স্থানীয় লোককে ছেড়ে

দিয়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়। পুলিস ও গ্রাম-রক্ষা সমিতির সক্রিয়তার ফলে ওর অপরাধ করার

প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু দলের স্থানীয় লোকটি গ্রাম জুড়ে চোর নিয়ে চেঁচামেচির ফাঁকে গয়াদীনের

বাড়িতে হাত সাফ করতে ঢুকে পড়ে।

গ্রাম রক্ষা সমিতির হাঁক শুনে গয়াদীন পরিবারের সবাই জেগে ওঠে। তখনই কেউ দেখতে পায় যে

একজন সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাচ্ছে। পুলিস হাওয়ার বেগে পৌঁছে যায়, কিন্তু লোকটা বেমালুম হাওয়া। এই

সময় গয়াদীন পুলিসের হাতে চুরি হওয়া গয়না-অলংকারের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। জায়গাটাতে ভাল করে

খোঁজাখুঁজি করে পুলিস চলে যায়। ফের পনের দিন ধরে কড়া তদন্ত চলতে থাকে। শেষে পুলিস এই

সিদ্ধান্তে পৌঁছয় –হ্যাঁ, গয়াদীনের ঘরে সেই রাতে চুরি হয়েছে বটে! শুধু তাই নয়, যে চটপট সিঁড়ি ভেঙে

ছাদে চড়ছিল সে চোর না হয়ে যায় না!

তারপর গুপ্তচরের থেকে পুলিস জানতে পারল যে জোগনাথ পিতা রামনাথ, সাকিন শিবপালগঞ্জের ঘরে

এমন কিছু গয়না আছে যা গয়াদীনের বাড়ির হলেও হতে পারে। পাকা খবর পাওয়ায় আজ ভোর ভোর

পুলিস ওর ঘরে পৌঁছে যায়। জোগনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে লোটা হাতে কোথাও যাচ্ছিল। পুলিসের মুখোমুখি

হয়ে ও নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং নিজের সামনে ঘরের তল্লাশি করিয়েছে। এই তল্লাশি

আইন মেনে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের উপস্থিতিতে হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, এইসব পাড়ায় প্রথমত, লোকের দেখা পাওয়াই মুশকিল। দ্বিতীয়ত, যদি পাওয়া যায়ও

সে যে সম্ভ্রান্ত হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সে যাই হোক, তল্লাশি দু’জন সাক্ষীর সামনে হয়-- ছোটে




পালোয়ান পিতা কুসহর প্রসাদ এবং বৈজনাথ পিতা ত্রিবেণী সহায়। তবে বৈজনাথ হল ভিন গাঁয়ের

বাসিন্দা। এই ‘সম্ভ্রান্ত’ ব্যক্তিটিকে পাশের গ্রাম থেকে ডেকে আনা হয়।

জোগনাথ দেখিয়ে দিলে ভেতরের ঘরের একজায়গা খুঁড়ে একটা হাঁড়ি পাওয়া যায়। সেই হাড়িতে কিছু গয়না

ছিল। তার বিবরণ নিম্নানুসারঃ

একটি রূপার করধন (কটিবন্দ), দাম হবে পঞ্চাশ টাকা; এক জোড়া বিছিয়া, দাম ধর তিন টাকা; একটা

চাঁদির গয়না, দাম পঁচিশ টাকা। একটা নাকে ফুটো করে পরার সোনার গয়না, দাম হবে তিরিশ টাকা।

এগুলো বাজেয়াপ্ত করে লিস্টিতে ওই দুই সাক্ষীর সই নেয়া হয়েছে। হাঁড়ি সমেত গয়নাগুলো একটা

কাপড়ে বেঁধে সীল করা হয়েছে। সমস্ত প্রক্রিয়া জোগনাথের ঘরে বসে করা হয়েছে।

জোগনাথ গ্রেফতার হওয়ার সময় ঝগড়া হাতাহাতি করেছিল। ওকে ধরতে গিয়ে হেড কনস্টেবলের জামা

ছিঁড়ে যায় এবং হাতে চোট লাগে। জোগনাথকে কাবু করতে ন্যুনতম শক্তি প্রয়োগ করা হয়—ব্যস,

যতটুকু দরকার। পরে আহত সেপাই এবং জোগনাথের ডাক্তারী পরীক্ষা করানো হয়। সেপাই দুই

সপ্তাহের মেডিক্যাল লীভ নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেছে। জোগনাথের শরীরে গোটা কুড়ি নীলচে নিশান

আর চল্লিশটা আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে। সবগুলো মামুলী চোট, মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফল।

এই কাহিনীটি বৈদ্যজীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনানো হল। –পুলিস যা করে ঠিকই করে, এমন শাশ্বত

তত্ত্বে প্রথমবার বৈদ্যজীর সন্দেহ হল।

অবশ্য জোগনাথের সম্বন্ধে বৈদ্যজীর ধারণা খুব যে ভাল ছিল, এমন নয়। কিন্তু উনি যে দুনিয়ায় বাস

করেন সেখানে লোকের সম্মান সে কতটা ভালমানুষ তা দিয়ে ঠিক হয় না—দেখা হয় সে কীরকম কাজের

লোক। ওনার দলের লোকের মধ্যে একমাত্র জোগনাথ খোলাখুলি মাল খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর মদের

পয়সা যেখান থেকেই আসুক—নিজের পকেট বা অন্যের—দারু গেলার পরিমাণ কখনও কম হয়না। সব

মিলিয়ে ওকে একটি মাঝারি ধরণের গুণ্ডা বলা যায়।

বৈদ্যজীর সন্দেহ হচ্ছিল যে জোগনাথের গ্রেফতারির পিছে কোন রাজনীতির প্যাঁচ আছে। কিছুদিন ধরে

দারোগাজী যে ওনার বদলে রামাধীন ভীখমখেড়ীকে বেশি কেউকেটা ভাবছেন -এটা ওনার চোখে পড়েছে।

গোড়ায় মনে হচ্ছিল রামাধীন বোধহয় আফিমের চোরাই কারবারে দারোগাজীকেও পার্টনার বানিয়ে

ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে দারোগাজী ধোঁকা খেয়েছেন। বোধহয় ভেবেছেন যে রাজনৈতিক ল্যাং মারার

খেলায় রামাধীন ভীখমখেড়ী বৈদ্যজীর চেয়ে বেশি কাজের। সে যাই হোক, বৈদ্যজী সার বুঝেছেন যে

বর্তমান পরিস্থিতিতে জোগনাথের গ্রেফতারি হলে প্রথমে দারোগা যা চাইবেন তাই হবে। আসলে

রামাধীন ভীখমখেড়ী যা চাইছে তাই দারোগা চাইবেন।

কিন্তু রূপ্পন বাবু জিদ ধরেছেন—রামাধীনকে থানাতেই জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হোক। তাই বৈদ্যজী

ইচ্ছে না হলেও দারোগার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন।

দারোগাজী এখন আর ভোর বেলায় দুঁদে দারোগা নন, মানে যিনি চোখ পাকালে গ্রামবাসীর গায়ে নীলচে

নিশান আর আর আঁচড়ে দাগ ফুটে ওঠে। এখন ওর ভারী শরীরের উর্ধভাগে সিল্কের পাঞ্জাবি আর

নিম্নাংগে খাদির পায়জামা। ঠোঁটের কোনায় পানের পিক চুঁইয়ে পড়ছে। ওঁর মুখ থেকে বৈদ্যজীর পুরো

ঘটনা শোনা হয়েছে। বৈদ্যজী অবাক হন নি, কিন্তু একটা খটকা লাগছে—জোগনাথের ঘর থেকে পুলিস

একটা দেশি কাট্টা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেনি!




পুলিসের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সম্পর্কের দরুন উনি জানেন –এইধরণের গ্রেফতারির সময় পুলিস

অপরাধীর ঘর থেকে নিদেনপক্ষে একটা লোহার টুকরো হলেও বাজেয়াপ্ত করে। সেটাকে পিস্তল ধরে

নেয়া হয় আর একনজর দেখলেই কেন আঠেরশ এবং উনিশশ শতাব্দীতে মুষ্টিমেয় ইংরেজের সামনে

ভারতীয়রা হেরে যেত—সেই ঐতিহাসিক সত্য স্পষ্ট হয়।

ওনার মনে হল দারোগাজীকে ভদ্রতার খাতিরে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। তার ভূমিকা বাঁধতে গিয়ে উনি

প্রশ্ন করলেন—জোগনাথের ঘর থেকে শুধু গয়নাপত্র উদ্ধার হয়েছে? গাঁজা-ভাঙ-চরস বা আফিম

নয়?

--আমি আফিমের তল্লাসি করিনি তো। তাহলে লোকে বলত সেবার এক পার্টির এক চেলা আফিম শুদ্ধ

ধরা পড়েছে তাই এবার অন্য পার্টির একটাকে ধরা হয়েছে।




বৈদ্যজীর চোখ কপালে।

--পার্টি? কিসের পার্টি? এসব আপনি কাদের ভাষা বলছেন?

উত্তর এল রূপ্পন বাবুর থেকে—‘পুলিসের ভাষা’।

দারোগাজী চোখ মিটমিট করে ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজের মাথা সাফ রাখতে চেষ্টা করলেন। মনে মনে

ভাবলেন—বিলেতি মদের মধ্যে ‘জিন’ হল বড্ড দাগাবাজ। দেখতে সাদা জলের মত, কিন্তু পেটে পড়লে

জিভের আড় থাকে না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি!

উনি চোখ খুললেন। বৈদ্যজীর চেহারা বেশ গম্ভীর। দারোগা ভাবলেন—এইবার কোন ত্যাড়া কথা শোনা

যাবে, তাই উনি মন দিয়ে বৈদ্যজীর মুখের দীপ্তি দেখতে লাগলেন।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







ছাব্বিশ

ক্ষীরগ্রাম দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর আঙুলসহ ডান পায়ের পাতা পড়েছিল। দেবীকে এখানে যোগাদ্যা রুপে পূজা করা হয়।

জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান। কিন্তু এরপর কোনও ভাবে হারিয়ে যায় প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি। এরপরই সম্ভবত মহারাজার আদেশেই হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভূজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়। তবে, পরবর্তী সময়েও নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটিও কিন্তু অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদীঘির জলেই বলে জানা যায়। কেবল ৩১ বৈশাখ দেবীকে জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত।

এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে যায় এক অলৌকিক কাণ্ড। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় হঠাৎই নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে আসে ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিও। এরপর, মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির গড়ে তোলেন গ্রামের মানুষরা। সেই নতুন মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হন ফিরে পাওয়া দেবী মূর্তিটি। তাই এখন গ্রামে গেলেই দেবীরদর্শন পান বহিরাগতরা। পাশাপশি সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।

জানা যায়, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। সেই সময়ের সাক্ষী বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। তবে জানা যায়, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।

মন্দির থেকে অদূরে একটি টিলার উপর দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গাঁয়ের নাম ক্ষীরগ্রাম, আদরের ক্ষীরগাঁ। মন্দির আর ক্ষীরদীঘি থেকে খানিকটা দূরে গ্রামের এক প্রান্তে ধামাসদীঘি। কথিত আছে, মহীরাবণকে কৌশলে বধ করে লক্ষ্মণ যখন পাতাল ত্যাগ করতে উদ্যাত হন, তখন রাবণের আরাধ্যা দেবী মহাকাল প্রভু রামচন্দ্রের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হনুমানের কাঁধে চেপে মহাকাল এসে ওঠেন মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে। পুরাণ মতে, সেই সময় থেকেই দেবী মহামায়া বা মহাকালী কিংবা ভদ্রকালী যোগাদ্যা হয়ে রাঢ় বঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে পূজিতা হতে শুরু করেন। শাক্ত মতে এটি সতীপীঠ। দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানে আলাদা কোনও কালী মূর্তি নেই । দেবীর রত্নবেদীতে কালীমন্ত্রে পুজো করা হয় দেবী যোগাদ্যাকে।

0 comments: