বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে,
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
--সুকান্ত
একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র ডেটা বলছে ২০২১ সালে আমাদের গোটা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ২৯,২৭২ জন। অথচ, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানো’য় মারা পড়েছে ৪৩, ৪৯৯ জন। তাহলে যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সবচেয়ে বড় খুনি? কারা চালায় অমন ভাবে গাড়ি? গতির নেশায় মাতাল হয়ে!
এদের কাছে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?
আছেই তো, মার্সিডিজ, পোর্শে, বিএমডব্লিউ,? কাদের আছে? যারা কোটি টাকার গাড়ি কিনতে পারে, জন্মদিনে নাতিকে অমন গাড়ি উপহার দিতে পারে।
তারপর সেই গর্বিত নাতি বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গাড়িতে বসে আর হাওয়াগাড়ি উড়ে চলে হাওয়ার বেগে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে। পথচারীরা ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যায়। আর ‘চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন’-- কেউ শোনে না।
চালকের কখনও মনে হয়-- ‘অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম’। সে গাড়ি থামায়, তবে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই অপরাধ থুড়ি দুর্ঘটনার সাক্ষ্য মুছে ফেলা। নেমপ্লেট বদলে দেয়া, রক্তের দাগ ধোয়া, ড্রাইভার বদলে নেয়া।
কিন্তু পিষে দেয়া মানুষগুলো? যাদের সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুটা বাঁচার সম্ভাবনা ছিল? না, এরা হাওয়াগাড়ি থামিয়ে সেই লোকগুলোকে তোলে না। তাহলে যে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাজারে বদনাম হবে।
ব্যাপারটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।
আসলে এদের হয়তো কোন দোষ নেই। দোষ তাদের যারা গাড়ির সামনে এসে গেছল। হাওয়াগাড়ি তো হাওয়ার বেগেই চলবে।
তবুও সুর্য এখনও পূবে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে।
তাই কিছু কেস খবর হয়। কিছু কেসে পুলিশ আসে, গ্রেফতার করে। জামিন হয়, মামলা চলে। মোটা টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। ভোলে না নিহতদের পরিবার। ওরা ভগবানকে ডাকে আর আশা করে-- একদিন ন্যায়ের দণ্ড নামিয়া আসিবে।
দুর্ঘটনার ডিফেন্স
কেস খেলে এসবের জন্য বাঁধা ডিফেন্স আছে।
এক, আমি চালাচ্ছিলাম না, আমার ড্রাইভার চালাচ্ছিল।
--তাহলে ড্রাইভার জেলে যাবে। আমার অর্থদণ্ড হবে, ড্রাইভারের পরিবারকে মোটা টাকা দেয়া হবে। ওরা মুখ বুজে মেনে নেবে। একেবারে বজ্রসেন-উত্তীয় কেস!
দুই, আমি চালাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মদটা একটু বেশি গিলেছিলাম। চোখে আবছা দেখছিলাম। কাউকে চাপা দিয়েছি? আমার কিচ্ছু মনে নেই।
--এটা ভাল ডিফেন্স। সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা কমে যায়। কেসটা ধারা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা থেকে অসাবধানে মদ খেয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অর্থাৎ ধারা ৩০৪ থেকে ৩০৪এ হয়ে যায়।
আহা, বেচারি! ভালমানুষ। একটু নেশা হয়ে গেলে কী করবে? ও খুনি নয়।
ফলে দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড। অথবা প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু অর্থদণ্ড। কেউ জিজ্ঞেস করবে না-- এই অবস্থায় কেন গাড়ি চালিয়েছিলে বা তোমার কাজের পুরো দায়িত্ব কেন তুমি বইবে না?
তিন, আমি পূর্ণবয়স্ক নই। ১৮ পূর্ণ হতে এখনও চার দিন বাকি! আমার বিচার প্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে না, জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে।
--এই কেসে গার্জেনদের দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড হবে। গাড়িটির লাইসেন্স একবছরের জন্য বাতিল। আর আদরে বাঁদর হওয়া কুলতিলক যাবেন সংশোধনাগারে ,মানসিক কাউন্সেলিং এর জন্য—সেটা তার নিজের মাসির বাড়িও হতে পারে। আর তাকে কয়েকমাস বা এক বছর কমিউনিটি সার্ভিস করতে হবে।
সেটা কী জিনিস কেউ জানে না। কোন আইনে বলা নেই। সেটা কি মন্দিরে করসেবা? হাসপাতালে কাউন্টারে বসা? নাকি এক লক্ষ বার রামনাম লেখা? শুধু বিচারক জানেন। কিন্তু আদরে বাঁদর ছেলের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের জন্য কোন ধনীর দু’বছরের জেল হয়েছে শুনেছেন কখনও? আমি তো শুনি নি। শুনলে বলবেন তো!
চেনা গল্পঃ চেনা ছক
১
রাজধানী দিল্লি; এপ্রিল ২০১৬। মার্কেটিং পেশার সিদ্ধার্থ শর্মা (৩২) কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্স এলাকায় একটি মার্সিডিজের নীচে পিষে গেলেন। যে ছেলেটি বাবার গাড়ি চালাচ্ছিল তার বয়েস ১৭ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হতে মাত্র চার দিন বাকি।
ছেলেটির লাইসেন্স ছিল না। পুলিশের রেকর্ড বলছে সে এর আগেও তিন বার ট্রাফিক আইন ভেঙে ফাইন দিয়েছে। তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিনবারই ‘মিথ্যে’ তথ্য দিয়েছিল। ছেলেটির পরিবার তাদের বাড়ির ড্রাইভারকে থানায় পাঠিয়ে দিল –যাও, গিয়ে বল যে তুমিই তখন গাড়িটা চালাচ্ছিলে।
সিসিটিভির ফুটেজ, চাকার দাগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে পুলিস বোঝে যে ছেলেটি সেদিন সন্ধ্যায় ট্রাফিক রুলে স্বীকৃত গতির চেয়ে বেশি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল।
পুলিস বলে নতুন আইন অনুযায়ী অপরাধীকে নাবালক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হোক। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (২০১৫) অনুসারে সেটা সম্ভব যদি নাবালকের করা কাজটি ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে। তাহলে শাস্তি - অন্ততঃ সাত বছরের জেল।
জুভেনাইল বোর্ড সব দেখেশুনে তার সাত পৃষ্ঠার রায়ে বলল—এই ছেলেটির বিচার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই হোক। ও যে কাজটা করেছে তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে মানসিক এবং শারীরিক , দু’দিক থেকেই, এমন অপরাধ করতে সক্ষম।
ফেব্রুয়ারি ২০১৯শে দিল্লির এক দায়রা আদালত ওই মতেই সায় দিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় খারিজ করে দিলে নিহতের বোন শিল্পা শর্মা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে ।
সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বেঞ্চ (জাস্টিস দীপক গুপ্তা এবং অনিরুদ্ধ বোস) হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মামলা খারিজ করলেন।
ওনাদের মতে ধারা পেনাল কোডের ৩০৪ লাগিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ নরহত্যার অপরাধ, কিন্তু মার্ডার বা খুন নয়। এটা ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে না। তাই ছেলেটিকে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (জুভেনাইল) মেনে বিচার করতে হবে।
কেন আসে না?
কারণ, অপরাধ যদি ‘জঘন্য’ হয় তাতে ‘ন্যূনতম’ এবং ‘অধিকতম’ দুই শাস্তিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ধারাতে শাস্তি হিসেবে খালি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ‘ন্যূনতম’ কোন শাস্তির কথা বলা নেই। অর্থাৎ এই অপরাধ ‘জঘন্য’ শ্রেণীর নয়। অতএব, অভিযুক্তের বিচার জুভেনাইল কোড হিসেবেই হবে, পেনাল কোডে নয়।
বেশ, কিন্তু জুভেনাইল অ্যাক্টের ধারা ২(৩৩) বলছে ‘জঘন্য’ অপরাধ সেটাই যাতে পেনাল কোডে কম-সে-কম সাত বছরের জেল বলা রয়েছে। কিন্তু এতে সাত বছরের বেশি শাস্তি আছে, সাতবছরের কম বা কম-সে-কম কোনও শাস্তি নেই।
জাস্টিস গুপ্তা এটাও বললেন যে খারাপ লাগলেও আমাদের আইন মেলে চলতে হবে। মানছি আইনে ‘ফাঁক’ আছে। কিন্তু আইনে সংশোধন তো সংসদের কাজ, আমাদের নয়। যেখানে আইনের দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে যে ব্যাখ্যয় নাবালকের জন্য ‘লাভ’ সেটাই মানতে হবে।
জুভেনাইল অ্যাক্টে ছেলেটির শাস্তি হতে পারে—গ্রুপ কাউন্সেলিং, কমিউনিটি সার্ভিস অথবা অর্থদণ্ড!
অভিযুক্ত আর একটা অতিরিক্ত দিনও গরাদের পেছনে কাটাবে না।
বিদ্বান ন্যায়াধীশদের ‘জঘন্য’ অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে এমন ব্যাখ্যায় আমার মত সাধারণ নাগরিক বুঝভম্বুল হয়ে যায়।
২
না, এসব নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তাই তো এত নিয়মকানুন, মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট (১৯৮৮), তার সংশোধনী (২০১৯) এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে লোককে আহত করা, নিহত করা, ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি হয়েছে।
কিন্তু তাতে কি মূল ছবিটা কিছু বদলেছে?
এখন আমরা তিনটে ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
২.১ দিল্লির লোধী কলোনি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯
একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ি তিনজন পুলিস অফিসার সমেত ছ’জনকে পিষে দিল। ঘটনাটি এরকমঃ
ভারতের নৌবাহনীর প্রাক্তন অ্যাডমিরাল নন্দার নাতি সঞ্জীব নন্দা গুড়গাঁওয়ে রাতভোর পার্টি করার পর তাঁর দুই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বি এম ডব্লিউ গাড়িটি চালিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে চলার কারণে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোধী কলোনির পুলিশ চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দু’জন পুলিশ এবং অন্য দুই পথচারি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজন পুলিশ ও অন্য এক পথচারি হাসপাতালে মারা যায়। সপ্তম শিকার বেঁচে ওঠেন।
গাড়িটি একটু এগিয়ে থামে, ওঁরা টের পান যে চাকার নীচে লোক। তাঁরা চটপট গলফ লিংকের একটি বাড়িতে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির চৌকিদারও ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন গাড়ির বনেট ও বাম্পার পরিষ্কার করে ফেলতে।
ওই দুজনকেও পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে আদালতে পেশ করে।
ক’দিন পরে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এসে নিজের সাক্ষ্য দেয়। পুলিশ তিনবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘culpable homicide not amounting to murder’এর মামলা রুজু করে।
(মানুষ মরতে পারে জেনেও কিছু করা এবং তার ফলে কারও মৃত্যু= culpable homicide বা নরহত্য্যা। কিন্তু যে নরহত্যা কাউকে মারার উদ্দেশে আগে থেকে ভেবে করা হয় সেটা খুন বা মার্ডার।
১৯৯৯ সালের বিচারে তিনজনই অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু এ’নিয়ে ফের বিচারের দাবি ওঠে।
২০০৮ সালের পুনর্বিচারে দিল্লির সেশন কোর্ট ২ সেপ্টেম্বর এদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের জেল হয়। এনডিটিভি’র স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে ডিফেন্স ল’ইয়ার সাক্ষীদের মোটা টাকা অফার করছে, আদালত তাদের চার মাসের জন্য লাইসেন্স রদ করে। বলা হয় যে গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার ।
কিন্তু অভিযুক্তরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সর্বোচ্চ আদালত ৩ আগস্ট ২০১২ তারিখে এদের দু’বছর জেলে বিচার চলাকালীন জেলে কেটেছে বলে মুক্তির আদেশ দেয়। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দু’বছর কমিউনিটি সার্ভিস করার নির্দেশ দেয়।
২.২ কানপুরের কিশোর, সাতমাসের মধ্যে দু’বার লোককে গাড়িচাপা দেয়া!
গত বছর অক্টোবর মাসে কানপুর শহরের এক ১৫ বছরের কিশোর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের উপর সাগর নিষাদ এবং আশিস রাম চরণ নামের দুই ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। সাত মাসও যায়নি ছেলেটি আবার ওইভাবে বাবার গাড়ি চালিয়ে চারজনকে গুরুতর আহত করেছে। ওই কিশোর কানপুর শহরের একজন নামজাদা ডাক্তারের সন্তান।
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যঃ ওরা বাবা সমানভাবে দোষী। কেন উনি নাবালক ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিয়েছেন! তায় দু’জনকে মেরে ফেলার পর আবার!
ছেলেটিকে আপাততঃ জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছে। তবে ছ’মাস আগের মামলাটির ধারা বদলে আরও কড়া করা হয়েছে—ধারা ৩০৪ এ (অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারা) থেকে ধারা ৩০৪ (নরহত্যা , তবে খুন নয়)।
২.৩ পুণের কুখ্যাত পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলার কেস!
এবছর ১৯ মে, শহর পুণে।
প্রোমোটর দাদু আদরের নাতি বেদান্ত আগরওয়ালকে ১৭ বছরের জন্মদিনে একটি পোর্শে গাড়ি (দাম এক কোটির কম নয়) উপহার দিয়েছেন। নাতির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে বন্ধুদের নিয়ে সারারাত উদ্দাম পার্টি করে ভোরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুণে শহরের কল্যাণী নগরে এক দু’চাকার বাহনকে ধাক্কা দেয়, দুজন আইটি প্রফেশনাল—অশ্বিনী কোস্টা এবং অনীশ অবধিয়া-- মারা যায়।
এক রাজনৈতিক নেতার হাসপাতালে ফোন এবং থানায় উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীদের সঙ্গে কথার ফলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সুপারিশে ছেলেটি দুয়েক ঘণ্টায় জামিন পেয়ে যায়। তাকে শাস্তি হিসেবে বলা হয় যারবেদা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ১৫ দিন ডিউটি করতে এবং পথ সতর্কতা নিয়ে তিনশ’ শব্দের একটি রচনা লিখতে!
এরপর শুরু হয় কভার আপ! যাতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে পুলিশ প্রশাসন, জুভেনাইল বোর্ড, রাজনৈতিক নেতা –সবাই অপরাধী পরিবারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
দেখা যায় তার রক্তের নমুনা বদলে তার মায়ের রক্ত দেয়া হয়েছে। তার রিয়েল এস্টেট প্রোমোটর দাদু ড্রাইভারকে ঘরে বন্ধ করে ধমকে বলেন—তুমি দোষ নিজের ঘাড়ে নাও; বল তুমিই চালাচ্ছিলে—আমার নাতি নয়।
পুলিশ বলছে ওকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিচার করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার আগে একটি বারে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদ খাচ্ছে, বিল দিয়েছে ৪৮০০০ টাকা।
জনরোষের ফলে পুলিশ ওর দাদু, মা, বাবা সবাইকে গ্রেফতার করে। এখন সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। আর ছেলেটিকে হাইকোর্ট বলেছে জুভেনাইল বোর্ডেরসংশোধনাগারে নয়, তার পিসির বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখতে—এটাই নাকি আইনসম্মত উপায়!
সরকারপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক নয়। তবু পুলিশ বলছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। করবে তো?
বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর
নবী মুম্বাইয়ের ঘটনাঃ এক ১৭ বছরের কিশোর সাত সকালে বাবার গাড়ি চালিয়ে ৬০ বছরের এক মহিলাকে মেরে ফেলে। এখানে ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই—তাই গাড়ির মালিকের শাস্তি হবে—তিনমাসের জেল এবং ১০০০ টাকা ফাইন। কিন্তু গাড়ির মালিক বাবা তো একমাস আগে মারা গিয়েছেন। তাহলে?
নয়ডার ঘটনাঃ
গত মে মাসের ঘটনা। প্রমোদ শর্মা সপরিবারে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে। গাড়িটি স্কুলগামী একটি মোটরবাইককে ধাক্কা দেয়। তাতে ১৫ বছরের অমন কুমার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সঙ্গের বাকি দুই ছাত্র হাসপাতালে।
৩ ‘সমরথ কো নাহি দোষ গোঁসাই’!
৩.১ হেমা মালিনীঃ বিজেপি’র মথুরা’র সাংসদ এবং মুম্বাই সিনেমার মহাতারকা
রাজস্থানের হাইওয়ে। জুন মাসের শেষ। হর্ষ খান্ডেলওয়াল সপরিবার মারুতি অল্টো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে একটা মোড় ঘুরতে হবে। ফাঁকা রাস্তা, তিনি ইণ্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি ঘোরালেন। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি মার্সিডিজ গাড়ি এসে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। খান্ডেলওয়াল এবং তাঁর পত্নী আহত হলেন। তাঁর ছ’বছরের ছেলেটির দুটো হাত দুটো পা ভাঙল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে চিন্নি গুরুতর আহত।
মার্সিডিজ থেমে গেছে। আরোহী হেমা মালিনী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। খান্ডেলওয়াল দম্পতি চাইছিলেন গুরুতর আহত বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হেমা’র কপালে সামান্য চোট লেগেছিল এবং ওঁরা অনুরোধে কর্ণপাত না করে মার্সিডিজ গাড়িটি ওখানেই ফেলে স্থানীয় বিজেপি নেতার গাড়িতে চড়ে ঝড়ের বেগে জয়পুর চলে গেলেন।
বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল। বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হর্ষ খান্ডেলওয়ালের মতে মার্সিডিজের স্পীড ছিল ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরে ড্রাইভার গ্রেফতার হয় বেয়াড়া স্পীডে গাড়ি চালানোর অভিযোগে।
হেমা টুইট করে বললেন—সব দোষ বাচ্চা মেয়ের বাবার। ও যদি ট্রাফিক রুল ভেঙে মার্সিডিজের সামনে না আসত তাহলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত।
হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাবা জবাব দিলেন—আমি রুল ভাঙিনি, আপনার ড্রাইভারকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমার দু’ বছরের বাচ্চা মেয়ে বেঁচে যেত যদি আপনি আপনার গাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন।
না, ওঁরা হেমা মালিনীর থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পান নি।
৩.২
‘বিগ বস’ সলমান খান এবং ফুটপাতে লোকচাপা
ঘটনার সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী
২৮/৯/২০০২
অভিনেতা সলমান খান মাঝরাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের উপর তাঁর টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি চড়িয়ে একজনকে মেরে ফেলার এবং চারজনকে ঘায়েল করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন।
অক্টোবর, ২০০২- কেস খেলেন পেনাল কোডের ধারা ৩০৪ (নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়)।
অক্টোবর, ২০০৩- মুম্বাই হাইকোর্ট ধারা বদলে ৩০৪এ করে দিল, অর্থাৎ নরহত্যা নয়, শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয়েছে।
৬ মে, ২০১৫- মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে শাস্তি দিল-- পাঁচ বছর জেল ।
সেদিনই মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্ত সলমানকে জামিন দিয়ে অন্তিম ফয়সালা পর্য্যন্ত শাস্তি স্থগিত করে দিল।
ডিসেম্বর, ২০১৫- মুম্বাই হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সলমান খানকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল।
জুলাই ৫, ২০১৬—মহারাষ্ট্র সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করল। সেখানে ৮ বছর ধরে মামলা লম্বিত রয়েছে।
কিন্তু আসল তামাশা বুঝতে হলে নীচের টিপ্পনিগুলো দেখুন।
দুর্ঘটনার পর যখন জনমানস বিক্ষুব্দ তখন বলিউডি গায়ক অভিজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করলেন—ফুটপাথ কি শোবার জন্য?
আমার বিনীত প্রশ্নঃ ফুটপাথ কি গাড়ি চালানোর জন্য? তাও ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে!
যুবক পুলিস কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল সলমান খানের দেহরক্ষী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে জবানবন্দী দিয়েছিলেন যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমান নিজে, তাঁর ড্রাইভার নয়।
কিন্তু মহামান্য মুম্বাই হাইকোর্ট তাঁর সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মানলেন না। কেননা, তিনি গোড়ায় সলমানের মদ্যপানের কথা বলেননি। তিনদিন পরে ১ অক্টোবর তারিখে বললেন যে মত্ত সলমানকে তিনি গাড়ি চালাতে বারবার নিষেধ করেছিলেন।
বলা হয়, পাতিলের উপর বয়ান বদলে দেবার প্রচণ্ড চাপ ছিল। শুনানিতে পাঁচবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করে। ডিউটিতে গরহাজির থাকায় পুলিশ বিভাগ প্রথমে সাস্পেন্ড, পরে ডিসমিস করে।
পত্নী ডিভোর্স দেয়, বাবা-মা অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে।
২০০৭ সালে তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি তখন যক্ষ্মারোগে মরণাপন্ন। শেষে ৪ অক্টোবর, ২০০৭ তারিখে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
তাঁর শেষ কথাঃ “আমি শেষ পর্য্যন্ত বয়ানে কোন পরিবর্তন করি নি। কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্ট আমার সঙ্গে রইল না। আমি চাকরিতে ফেরত যেতে চাই, বাঁচতে চাই। একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।
রবীন্দ্র পাতিল ছিলেন ‘মুখ্য সাক্ষী’। অনেকের সন্দেহ, মূল শুনানির সময় তাঁকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল যাতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন।
সলমানের ড্রাইভারঃ বয়ান বদল
সলমানের ড্রাইভার অশোক সিং ১৩ বছর বাদে হঠাৎ বয়ান বদলে বললেন—গাড়ি নাকি তিনিই চালাচ্ছিলেন, সলমান নয়। আরও বললেন যে টায়ার ফেটে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেছল।
কিন্তু সরকারি পক্ষ জোর দিয়ে বলে—এটা ডাহা মিথ্যে। এস ইউ ভি গাড়ির টায়ার ওভাবে ফেটে যায় না।
তারপর অশোক সিংকে আদালতে মিথ্যে বলার জন্য গ্রেফতার করা হয়।
যাঁরা বেখেয়ালে গাড়ি চালানোর শিকারঃ
২৮ সেপ্টেম্বর,২০০২ এর রাতে ফুটপাতে শুয়েছিলেন পাঁচজন। গাড়ি রাস্তায় ওঠায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়েন নুরুল্লা শরীফ। বাকি আহত চারজনের কারও কারও পা পিষে যায়। ওদের মতে সলমান চালকের আসন থেকে ডানদিকের দরজা দিয়ে নেমে আসেন।
সলমানের বক্তব্য অন্যদিকের দরজা নাকি জ্যাম হয়ে গেছল। সলমান মুক্তি পাওয়ায় ওঁরা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, পেয়েছেন বলে জানা যায় নি।
উপসংহার
আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান বছর পর্য্যন্ত এতগুলো কেসের বিহঙ্গম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলাম। যা মনে হল—বড়মানুষের গাড়িতে সাধারণ মানুষ চাপা পড়লে কিছু আশা না করাই ভাল।
পুলিশের প্রাক্তন উচ্চপদের আমলা শ্রী কিরণ বেদীর টুইটারের বক্তব্যটি আপাতত শেষকথা বলেই মনে হয়।
“ ইফ ইউ আর এ ভিআইপি, সেলিব্রিটি, প্রিভিলেজড্, রিচ অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাকসেস বেস্ট লীগ্যাল এইড, ইউ ক্যান অ্যাভয়েড জেল’।
0 comments: