0

সম্পাদকীয়

Posted in



































বসন্তের দখিনা বাতাস গায়ে মেখে প্রবল হর্ষধ্বনি আর প্রতিশ্রুতির আবহে শেষ হলো ৪৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। একথা আমরা জানি, অনেক কারণেই এই আয়োজন অনন্য। এই মেলা একান্তভাবেই এই শহরের তথা বঙ্গ-জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেমন দুর্গাপুজো। বিশ্বের অন্যত্র বইমেলার চারিত্রিকতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই তালিকার ওপরে যে দুটি নাম, সেই ফ্রাঙ্কফুর্ট আর লন্ডন শহরের মানুষের চেতনায় সেই তরঙ্গ এমন বিপুলভাবে জেগে ওঠে না, যা ঘটে এখানকার বাঙালি মননে। এর প্রধান কারণ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এ জাতীয় মেলা মানেই হয় সত্বের কেনাবেচা অথবা বড় মাপের বাণিজ্যস্থল। 

কলকাতা বইমেলা এক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। সুদূর কৃষ্ণনগর থেকে কাঁধে ঝোলা নিয়ে মেলায় এসেছেন একটি তরুণ টিউশনির টাকা দিয়ে জীবনানন্দের ' শেষ খাতা ' সংগ্রহ করবেন বলে, এ দৃশ্য জগতের আর কোনও গ্রন্থমেলায় দেখা যায় না। আমাদের তাই দায়িত্ব ছিল এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বই ভালোবাসার এই সংস্কৃতিকে জাগর রাখার। দায়িত্ব ছিল আমাদের ভাষাগুলির দৈনন্দিন অবক্ষয়ের পটভূমিতে বাংলাভাষার অবিনশ্বর আয়ু সুনিশ্চিত করতে বইমেলাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার। 

কিন্তু কোথায় যেন একটা বদল হয়ে গেছে। ব্যবসার নিরিখে এ মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। আশার কথা। কিন্তু মানুষের আনাগোনার ছবিটি কি সর্বদা সত্যি কথা বলছে? বইমেলার কদিন এই প্রাঙ্গণটি বিবিধ মনোরঞ্জন আর সপ্তাহান্তে পারিবারিক মিলনমেলা এবং পিকনিকের জায়গা হয়ে ওঠেনি তো? একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি। সুস্থ সংস্কৃতি মনোরঞ্জনের ক্ষেত্র রচনা করতে পারে অবশ্যই, কিন্তু এর উল্টোটা? 

প্রশ্নটা তাই ভারসাম্যের। যার বড় অভাব আমাদের জীবনে। ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি না পেলেও দুর্গাপুজোর কিছু এসে যেত না। কিন্তু বোধনের অনেক আগে বোধন ঘটিয়ে যেমন পাল্টে দেওয়া হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত এক সামাজিক উৎসবের চরিত্র, বইয়ের পাশাপাশি মনোরঞ্জন ও উদরপূর্তির বিশাল বন্দোবস্ত বইমেলায় টেনে আনছে তাঁদেরও, বই নামক এই সামগ্রীটির সঙ্গে যাঁদের সুদূরতম সম্পর্কও নেই। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটে অস্বস্তিকর এই প্রসঙ্গগুলির অবতারণা জরুরি মনে হলো।

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in









বাংলা ভাষা উচ্চারিত না হলে...


আমাদের দেশে হিন্দি দিবস আছে, বাংলা দিবস নেই। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলা দিবস নয়। যেহেতু আমাদের দেশে কোনো বাংলা দিবস নেই, ২১ তারিখটাকেই যেন মনে হয় আমাদের বাংলা দিবস--- আদতে যেটা কিনা ভারতবর্ষ নামক রাষ্ট্রের কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিতই নয়।

যাই হোক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এসে যদি আমাদের নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে ভাবতে শুরু করি, তাহলে দেখব নতুন করে না বললেও এটা খুব স্পষ্ট যে বাংলা ভাষার সমস্যা আর সঙ্কট দুটোই এখন বহুমাত্রিক এবং গুরুতর। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষার পিঠ প্রায়-আক্ষরিক অর্থে দেওয়ালে ঠেকে গেছে।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণগুলো তলিয়ে দেখতে শুরু করলে বুঝতে পারা যায় ভাষাগত সঙ্কটের এ কুনাট্য রঙ্গের নেপথ্যে একসাথে মজুত অনেকগুলো উপাদান।

প্রথমত, আজকের দিনে প্রচুর বাঙালি জীবিকার তাগিদে নিজভূম ছেড়ে ভিন রাজ্যে বা দেশে পাড়ি দিচ্ছে। পরবাসে থিতু বাঙালির মাতৃভাষা চর্চায় আবেগের পরিমাণ যতই নিখাদ হোক, সেই চর্চারও একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। মাতৃভাষা শেখার পরিকাঠামো না থাকলে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে কেউ শিখলে বা শেখালে সে একান্ত ব্যক্তিগত চর্চার ভিত প্রথম থেকেই হয় নড়বড়ে। এর প্রভাব স্পষ্টতই পড়ে পরের প্রজন্মের ওপর। ফলত তাদের কাছে মাতৃভাষা শিক্ষা বা চর্চা একপ্রকার অসম্ভাব্য প্রকল্প হয়ে ওঠে। বড় জোর অক্ষরজ্ঞান বা প্রাথমিক ভাবে পড়তে আর লিখতে পারাটাই যথেষ্ট কৃতিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর আনুপাতিক বিচারে জীবিকার তাগিদে ভিনদেশে বা ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া বাঙালির সংখ্যাটা কিন্তু আজ নেহাত কম নয়। অর্থাৎ এক রকম ধরে নিতে হবে যে আর এক বা দুই দশক পরে এই বিপুল সংখ্যক বাঙালির উত্তরসূরিরা মাতৃভাষার ওপর নিজেদের উত্তরাধিকার হারাবে।

এর সঙ্গে যোগ করতে হয় দেশের শাসকের তরফ থেকে এক দেশ এক ভাষার নামে সবাইকে এক জোয়ালে জোড়ার সাঙ্ঘাতিক প্রয়াস। দেশের বহুভাষিক কাঠামোকে ধ্বংস করে একভাষিক করার এ এক ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা। দায়িত্ব নিয়ে একটি ভাষার প্রচারক হতে গিয়ে বাকি সব ভাষাকে দুর্বল করার সুপরিকল্পিত মারণযজ্ঞ। এই উদ্যোগের শুরু অবশ্য আজ নয়, স্বাধীনতার আগে থেকেই।

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ বিষের ধোঁয়ার সলতে পাকানোর সময় থেকেই আগামির বিপদের আঁচ পেয়ে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে কাশীতে উত্তর-ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে কবিগুরু বলেন, “সাম্রাজ্যবন্ধনের দোহাই দিয়ে যে-ঐক্যসাধনের চেষ্টা তা বিষম বিড়ম্বনা। তারা ভাষা-বৈচিত্র্যের উপর স্টীম-রোলার চালিয়ে দিয়ে আপন রাজপথের পথ সমভূম করতে চায়।’’ পরে লিখলেন, “অন্য একটি ভাষাকেও (ইংরেজির বদলে) ভারতব্যাপী মিলনের বাহন করবার প্রস্তাব হয়েছে। কিন্তু, এতে করে যথার্থ সমন্বয় হতে পারে না; হয়তো একাকারত্ব হতে পারে, কিন্তু একত্ব হতে পারে না।’’

হিন্দিকে নিয়ে সেই চেষ্টাই সচেতন ভাবে হয়ে চলেছে স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে। আজ সেই উদ্যোগের আঁচ সাঙ্ঘাতিকভাবে পড়ছে নতুন প্রজন্মের ওপর। কেন্দ্রীয় সরকারি স্কুলে ভর্তি হলে একটা শিশু তার মাতৃভাষা বা রাজ্যের ভাষা (যদি না সে হিন্দিভাষী হয়) শেখার অধিকার হারায়। জাতীয় স্তরে যে কোনো ভাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে স্কুলস্তরে কেন্দ্রীয় পাঠক্রম (সিবিএসই) অনুসরণ করা ভিন্ন উপায়ও তেমন থাকে না। তাই ছাত্রছাত্রীদের একরকম বাধ্য হয়েই এই পাঠক্রমে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। আর সেই পাঠক্রমে মাতৃভাষার স্থান খুঁজতে প্রয়োজন অতি উচ্চশ্রেণীর আতস কাচ।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই ব্যবস্থা তো চলে আসছে স্বাধীনতার সময় থেকে। আজ তবে নতুন করে কীসের সঙ্কট তৈরি হল! উত্তরের গোড়াতেই সন্ধান মিলবে সর্ষের মধ্যে বাস করা ভূতেরঃ এই সঙ্কটের জন্য রাজ্য স্তরের পাঠক্রমও সমানভাবে দায়ী। অনতি অতীতে একটা সময় ছিল যখন রাজ্য সরকারি পাঠক্রমে পড়াশুনো করা প্রচুর বাঙালি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য পেয়েছে, কৃতী হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাঠক্রমের এবং পাঠ্যব্যবস্থার যতটা পরিবর্তন সাধন প্রয়োজন সেই অভিযোজনের চাহিদা অবহেলিত রয়ে গেছে এক বা একাধিক প্রজন্মে। ফলে কেন্দ্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার থেকে দিনে দিনে মানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে রাজ্যস্তরের পাঠ্যব্যবস্থা।

সমান্তরালে রয়েছে বিবিধ সরকারি কাজে (সেটা অফিস, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সহ সব রকম প্রতিষ্ঠানে) হিন্দি বাধ্যতামূলক রাখা। তাই অহিন্দিভাষী কাউকে এক রকম ঘাড় ধরেই হিন্দি শেখানো বা বলতে গেলে গেলানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা থাকা-না থাকাটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওপর। আর এই ব্যাপারে আমাদের নিজেদের উদাসীনতার কথা তো একরকম সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই বহুক্ষেত্রেই দেখা যায় দেশের অন্য অনেক রাজ্য বা গোষ্ঠীতে যখন নিজস্ব ভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা চলেছে তখন আমাদের হাতে থেকে যায় 'পদে পদে অপমান' নামক পেন্সিলটি।

সরকারি ছেড়ে অন্যত্র দৃষ্টি ফেরালেও অবস্থাটা তথৈবচ। কোনো দোকানে গেলে বা কোথাও গ্রাহক পরিষেবায় ফোন করলে বা নিদেন পক্ষে ট্যাক্সিতে চড়লেও আমাদের শুনতে হয় বিজাতীয় ভাষা, তাও আবার প্রচ্ছন্ন গর্বের সুরে। গর্বটা কিছুটা বাংলা না জানার আর কিছুটা বাঙালিকে হিন্দি বলাতে বাধ্য করার জন্য।

গোদের উপর বিষফোঁড়ার অভাব পূরণ করতে রয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যেই ঢুকে থাকা বেনো জলে অবগাহনের কৃতিত্বের আহ্লাদ। এই আহ্লাদের ঠ্যালায় 'বাবা' হয়ে যাচ্ছে 'পাপা' বা 'dad', 'ঢ্যাঁড়স' হয়ে যায় 'ভিন্ডি', ক্লান্তি পাল্টে গিয়ে হয় 'পারিশান'। এর সাথে যুক্ত হয় হুবহু অনূদিত অপপ্রয়োগ, 'কেন কি' , 'হাত ধুয়ে পেছনে পড়া', 'ভোট করুন', 'বেটা', 'ছুটি মানানো'র মত আরও কত কী! তেমনি 'দোল' বা 'কালীপুজো'র মতো শব্দগুলো 'হোলি' বা 'দিওয়ালি'র চাপে তো আজকাল মনে হয় সুদূর নীহারিকা। অনেক পরিবারকে দেখেছি যেখানে বাবা মা দুজনেই বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির শিশুর সাথে হিন্দিতে কথা বলে।

এর একটা প্রধান কারণ হয়তো ভাষা নিয়ে আমাদের অহঙ্কারটা দিনে দিনে অনেক কমে গেছে, বদলে যুক্ত হয়েছে একরকম সামাজিক বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। তাই 'রাজভাষা' হিন্দিকে অনুকরণ করে সেটা মেটানোর একটা ব্যর্থ প্রয়াস চলতে থাকে।

এখানে মনে হতে পারে যে পণ্ডিত মানুষেরা তো বলে থাকেন যে ভাষা বহমান একটা নদীর মতো, সময়ের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়, অন্য ভাষা থেকে নতুন শব্দ এসে যুক্ত হয়। এটা তো একেবারে ঠিক কথা। ভাষাচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং বাংলা ভাষার উৎপত্তি আর বিকাশের গতি নিয়ে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন যে আজ যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে কোনো পরিচিত দুটো লাইন নিয়ে যদি আধুনিক বাংলায় লিখে তারপর আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে পূর্ব যুগের প্রতিরূপগুলো কি রকম ছিল বা থাকা সম্ভব ছিল তা দেখা হয়, তাহলে তার কাঠামোটা অনেকটা এই রকম হবে:

সোনার তরীর লাইন:

"গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে"

আধুনিক বাংলা:

গান গেয়ে না বেয়ে কে আসে পারে
দেখে যেন মনে হয় চিনি ওরে


মধ্যযুগের বাংলা (আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ):

গান গায়্যা (গাইয়া) নাও বায়্যা (বাইয়া) কে আস্যে (আইসে) পারে,
দেখ্যা (দেইখ্যা) জেনঅ (জেনহ) মনে হোএ চিণী (চিনহীয়ে) ওআরে (ওহারে)


প্রাচীন বাংলা (আনুমানিক ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ):

গান গাহিআ নার বাহিআ কে আইশই পারহি
দেখিআ জৈহণ মণে (মণহি) হোই, চিণহিঅই ওহারহি


মাগধী-অপভ্রংশ (আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ):

গাণ গাহিঅ নাঁর বাহিঅ কই (কি) আরিশই পারহি (পালহি),
দেকখিঅ জইহণ (জইশণ) মণহি হোই,
চিণহিঅই ওহঅরহি (ওহঅলহি)


মাগধী-প্রাকৃত (আনুমানিক ২০০ খ্রিষ্টাব্দ):

গাণং গাধিঅ (গাধিত্তা) নাবং বাহি বাহিঅ (বাহিত্তা) কগে (কএ, বা কে) আরিশদি পালধি (পালে),
দেখখিঅ (দেকখিত্তা) জাদিশণং মণধি হোদি কোন (ভোদি) চিহ্নিত অমুশশ কলধি


আদিযুগের প্রাচ্যপ্রাকৃত (আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ):

গানং গাথেত্বা নারং রাহেত্বা করে (কে) আরিশতি পালধি (পালে)
দেকখিত্বা যাদিশং (যাদিশনং) মনেই (মনসি) হোতি (ভোতি), চিণহিয়তি অমুশশ কতে।


বৈদিক আনুমানিক (আনুমানিক ১০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ):

গানং গাথরিত্বা নারং রাহয়িত্বা ককঃ (কঃ) আরিশতি পারধি (=পারে),
দৃক্ষিত্বা (=দৃষ্টা) যাদৃশম মনোধি (মনসি) ভরতি, চিহ্ন্যতে অমুষ্য কৃতে (=অসৌ অস্মাভির জ্ঞায়তে)

ভাষার এই বহমানতা অনন্তকালের সে প্রায় সকলেরই জানা। এই বাংলা ভাষাতে তৎসম বা তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি কতরকম দেশী বা বিদেশী ভাষার প্রভাব আছে তা তো বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনের একটা অংশ জুড়েই থাকে এই ভিন ভাষার অস্তিত্ব।

কিন্তু তার সাথে এটাও জানা কথা যে যখন কোনো নতুন শব্দ ভিন ভাষা থেকে এসে ভাষায় এসে যুক্ত হয় তখন সেটা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু যখন অহেতুক ভাবে অন্য ভাষা থেকে প্রতিশব্দ নিয়ে এসে ভাষায় জোড়া হয় তখন কিন্তু তা ভাষাকে দুর্বল করে। ঠিক এখানেই এসে গোল বাঁধছে আমাদের আজকের ভিন ভাষার বেনোজলে। অকারণে অপ্রয়োজনে করা হচ্ছে ভিন ভাষার প্রয়োগ যেখানে তার বাংলা প্রতিশব্দর একটা প্রচলিত অস্তিত্ব রয়েছে। আর এটাই ভাষার সঙ্কটের একটা বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

'ভাষা ও সংকেত' প্রবন্ধে ঠিক এই রকমের একটা সঙ্কটের কথাই রাজশেখর বসু বলছেন: 'বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত হতে পারেন, কিন্তু গ্রীক ফারসি আরবি পর্তুগীজ ইংরেজিও আমাদের ভাষাকে স্তন্যদানে পুষ্ট করেছে। যদি প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ আমরা গ্রহণ করি, তবে মাতৃভাষার পরিপুষ্টি হবে বিকার হবে না। অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না। যদি বলি 'ওয়াইফের টেম্পারটা বড়ই ফ্রেটফুল হয়েছে' তবে ভাষা জননী ব্যাকুল হবেন। যদি বলি - 'মোটরের ম্যাগনেটটা বেশ ফিনকি দিচ্ছে', তবে আমাদের আহরণের শক্তি দেখে ভাষাজননী নিশ্চিন্ত হবেন।'

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলেন, সংখ্যার নিরিখে প্রথম দশটি ভাষার মধ্যে একটা। তাই অনেক হয়তো ভাবতে পারেন যে এই সামান্য অবক্ষয় এতো লোকের ভাষার ওপর কতটাই বা প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো এই ছোট ছোট অবক্ষয়গুলো কিন্তু সত্যি ভাষার এক বড়সড় বিপদ ডেকে আনে। ভাষাকে যদি নদীর মতো সতত বহমান হয়, তাহলে আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে ভারতবর্ষে যমুনার মতো নদীও একশো বছরের কম সময়ের মধ্যে মুমূর্ষু হয়ে পড়লো। তার প্রধান কারণ ছিল মানুষের তৈরী করা দূষণ। আর ভাষাতেও এই অপপ্রয়োগগুলো ঠিক একই রকমের বিষ বা দূষণ। সেই দূষণ কিন্তু ভাষার অপমৃত্যু ডেকে আনে খুব তাড়াতাড়ি।

বাঙালি বাঙালির সাথে কথা বলুক বাংলায়, লিখুক এই ভাষাতেই। সব কিছুর ফাঁকে নতুন প্রজন্ম জানুক বাংলা হরফ, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও পড়ি বাংলা বই। বাংলায় নতুন শব্দ আসুক, ভাষা সমৃদ্ধ হোক সেই নতুন শব্দে। নতুন প্রজন্ম শিখুক 'চ' এ চ্যাটজিপিটি, 'ই' তে 'ইনস্টাগ্রাম' আর 'র' এ রোবোটিক্স। কিন্তু অপ্রোজনীয় শব্দে ভাষাকে যেন ভারগ্রস্থ করে দেওয়া না হয়। তাহলে ভাষা শহীদদের সব প্রয়াসই শেষ হয়ে যাবে কয়েক দশকের মধ্যে, উত্তরাধিকারের সব যোগ্যতা হারাবো আমরা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সবার জন্য, অন্য ভাষার কণ্ঠরোধ বা অপমান করার নয়। হিন্দির ভাষার সঙ্গেও কোনো লড়াই নেই, হিন্দিভাষী সাধারণ মানুষ তো তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলবেই, তাতে কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু বাংলা যেন বাঙালিদের কাছে অগ্রাধিকার পায় সেটা দেখাটা ভীষণ জরুরি। এটা বাংলা ভাষার অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন।

বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির কাঠামোয় বাংলা থাকুক আমাদের আশা হয়ে, অঙ্গীকার হয়ে, অধিকার হয়ে, নিবিড় ঘন আঁধারে ধ্রুবতারা হয়ে। আর বাংলা থাকুক আমাদের ভালোবাসা ভালোভাষা হয়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস থাকুক শুধু একদিনের জন্য নয়, পালন করা হোক আমাদের মনে মনে বছরের প্রতিটি দিন।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in









আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। অর্থাৎ পার্বণ ছাড়া আমরা বাঁচিনা। পার্বণ মানেই গতানুগতিক জীবনের থেকে একটু অন্যরকম বাঁচা। স্বাদ বদল। তারপর আবার দৈনন্দিনতায় ফিরতে ভালো লাগে। একসময় পার্বণ বা উৎসবগুলো প্রবর্তন হয়েছিল সামাজিক কারণে। মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে। একসঙ্গে বাঁচতে শেখাতে। প্রকৃতির নানা দুর্বিপাকের মধ্যেও প্রাণের যে প্রকাশ আমাদের পূর্বপুরুষেরা লক্ষ্য করেছিলেন, এইসব সামাজিক পার্বণ তারই ফল। অন্তত আমাদের দেশের ক্ষেত্রে একথাটা সর্বৈব সত্য। তারপর ধীরে ধীরে আদিভারতের সঙ্গে বৈদিকভারতের মিলন ঘটল। জনজাতির পার্বণে ধর্মের প্রভাব পড়ল, নাকি ধর্মে জনজাতির পার্বণের প্রভাব পড়ল, সেটা রহস্য রইল। কিছু গুহ্যকথা রয়ে গেলো জনজাতীয় ধর্মের। আর আমরা দেখতে পেলাম, বেদান্তের শ্লোকে শ্লোকে অন্তরদেবতার প্রকাশ উদযাপন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বেদান্তে আনন্দকেই ব্রহ্ম বলা হয়েছে। কিন্তু ভেতরের সেই আনন্দের উৎস কিভাবে যে শুকিয়ে গেলো! আচারসর্বস্ব ধর্মের মধ্যে দিয়ে আমাদের সেইসব সামাজিক পার্বণের পুনঃপ্রকাশ ঘটল।

আসন্ন বসন্ত উৎসব এরকমই এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আরম্ভ হয়েছিল নিশ্চয়। ফাল্গুন মাসে যখন প্রকৃতি স্ফুটনোন্মুখ সেই সময়ে মানবের যৌবন উৎসব। প্রাচীন কাব্যসাহিত্যেও আমরা বসন্ত উৎসবের প্রভূত উল্লেখ পাই। জীবন যেন অনন্ত এক প্রাণের উল্লাস। কিন্তু উৎসবের পরেই যেমন অবসাদ অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তেমনই আমরাও বিষাদে ডুবে যাই উৎসবের পর। অথচ কত না আয়োজন! কত ফুলের নির্যাস, কত লতাকুঞ্জের নির্মাণ! কত নব নব খেলার কৌশল! তবু শেষ রক্ষা হয়না। কুঞ্জের লতা ছিঁড়ে যায়। চারিদিক থেকে রাত্রিশেষের কুবাতাস বইতে থাকে। আমার মনে পড়ে বাসবদত্তার কথা। সেও এমনি এক উৎসবরাত্রিশেষে ফিরে আসছিল। সন্ন্যাসীর গায়ে পা পড়ে ছিল তার। লজ্জিত হয়ে তাঁকে গৃহে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ধারণা ছিল, হয়ত সন্ন্যাসী তার গৃহে গিয়ে তুষ্ট হবেন! কিসে তুষ্ট? তার সেবায়, তার রূপে, তার যৌবনে। কেননা তার যৌবনের উৎসব তখনও অব্যাহত। যেদিন ব্যাহত হলো সেদিন সে সন্ন্যাসীর সান্নিধ্য পেলো। সেদিন জানা গেলো, বৃথা এই অহংকার। জীবন দুদিন বৈ তো নয়! তবু কেন আমরা জেনেশুনে এই খেলায় মাতি? মহাজনের পথে যাই বরং। হোরি বা ফাগুয়া খেলা উত্তর ভারতের ঐতিহ্য। সেখানে প্রবল শীত পড়ে। শীতে কুঁকড়ে থাকে প্রকৃতি ও প্রাণী, সকলেই। গাছের পাতা খসে পড়ে। ফুল ফোটেনা। বেশ কিছু জীব শীতঘুমে ডুবে থাকে। ফাল্গুন মাসে শীত কমলে সকলে জেগে উঠতে থাকে। গাছে গাছে নতুন পাতা ফুলের কুঁড়ি আড়মোড়া ভাঙে। শীতার্ত মানুষ তাই শীতবুড়ি হোলিকাকে রাক্ষসী মেনে পুড়িয়ে দেয়। সেই আগুনের তাতে নিজেদের সেঁকে নেয়। কিন্তু আমাদের এই পূর্বপ্রান্তে তো শীত তেমন জাঁকিয়ে পরেনা। শীত এখানে আরামদায়ক। তাই শীত চলে গেলে যে আমরা খুব খুশি হই তা নয়। তাই বসন্ত উৎসব বলে আমাদের তেমন কিছু নেই। বরং শারদোৎসব আছে। এমন সময়ে শ্রীচৈতন্যদেব গেলেন বৃন্দাবন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ব্রজবাসী হোরি খেলে। ভারী একটা উৎসব হয়। ভক্তিতে প্রেমে বৃন্দাবনের মানুষ রঙখেলায় মেতে ওঠে। ফিরে এসে তিনি একটি বৈষ্ণব উৎসব প্রবর্তন করলেন। সে উৎসবের নাম দোলযাত্রা। কেন দোল? কারণ কৃষ্ণকে মনে করে আনন্দে মন আন্দোলিত হচ্ছে। মনে দোলা লাগছে। তাই দোল। মহাপ্রভু বললেন- তোমরা সকলে এই দিনে কৃষ্ণকে আবীর দেবে। আর পরস্পরকে আবীর দেবে ও মিষ্টিমুখ করাবে। কিন্তু আবীর দেবার আগে জিজ্ঞেস করে নেবে, তোমাকে রঙ দিতে পারি? সম্মতি বিনা রঙ দেবেনা। মহাপ্রভুর এমন নিয়মের ভিতরের কারণ কি? আমার মন কৃষ্ণপ্রেমের রাগে রঞ্জিত। তুমি কি আমার মতোই প্রেমানুরাগে রঞ্জিত? তবে এসো তোমায় সেই রাগের রঙে রাঙাই। আমরা যেন শ্রীরাধার মতোই কৃষ্ণপ্রেমে রঞ্জিত হই। তাই ক্রমে আমাদের চিদানন্দস্বরূপ কৃষ্ণ ও তাঁর অজস্র প্রেমাস্পদার আবীর খেলার কাহিনী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো দোল। তাই বসন্ত মানেই রঙ। কিসের রঙ? কৃষ্ণপ্রেমের রঙ। অনুরাগের রঙে অনুরঞ্জিত হবার দিন।

কিন্তু আমরা বাইরে রঙ খুঁজতে যাই। ভিতরে রঙ তো খুঁজে পাওয়া যায়না! তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। আমাদের অন্তর্মুখীনতা যত কমছে, ততই অন্তরের আনন্দের উৎস শুকিয়ে আসছে। অনেকেই বলতে পারেন, দোল তো বেশ একটা সেক্যুলার উৎসব। তো তার মধ্যে কৃষ্ণ কেন? অন্তত সব সামাজিক উৎসবেরই তো বিবর্তন আছে! তাই কৃষ্ণকেও একটু মেলে ধরা যাক। কৃষ্ণ অর্থাৎ যিনি আকর্ষণ করেন। মনের মানুষ তিনি। শরীরের মধ্যে থেকেই তিনি আমাদের আকর্ষণ করছেন প্রতিনিয়ত। তাঁকে কেউ ব্যক্তি ভাবেন, কেউ নিরাকার এক অস্তিত্ব ভাবেন, কেউবা চরাচর জুড়ে এক নিখিল অস্তিত্ব অনুভব করেন। বৈষ্ণবীয় উৎসবে পরম অস্তিত্বের এই ধারণাটুকু কিন্তু একটি অত্যাবশ্যক শর্ত।

কিন্তু বিবর্তন আমাদের কোথায় এনে ফেলেছে! সেই উপলব্ধির জগত অন্তর্হিত। সীমিত শরীরের সীমিত ইন্দ্রিয়বল দিয়ে আমরা মাত্র সাতটি ভিন্ন ভিন্ন রঙ দেখতে পাই। এবং মূর্খের মতন ভেবে নিই, এ বিশ্বে মাত্র সাতটিই রঙ আছে। মিলিয়ে মিশিয়ে বাড়িয়ে কমিয়ে কিছু রকমফের ঘটতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু তাই কি? বিজ্ঞান তো বলছে আমাদের স্নায়ুকোষ মাত্র ওই কটি রঙের ছবিই মস্তিষ্কে পাঠাতে পারে। বাকি এই মহাবিশ্বে কত যে রঙ! হায় মানুষ! আলট্রা ইনফ্রার ছড়াছড়ি। ফ্রিকোয়েন্সি ধরবার মতন দেহ তৈরি নয়। আমরা তাই ওই দিয়েই নিজেদের ভরিয়ে রাখি। যে রঙ চোখে দেখা যায়না অথচ হৃদয়ে লাগে সেই রঙের সন্ধান করিনা আর।

অথচ বাইরের এই রূপ রস স্পর্শ গন্ধ শব্দ ও বর্ণের পৃথিবীর কিন্তু একটি আন্তরিক রূপ আছে। সেখানে সে অসীম। রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে রাণী যখন রাজাকে দেখতে পেলেন তখন আঁধার। বাইরের সব আলো নিভে গেছে। চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে। অথচ রাণীকি কম চেয়েছিলেন বাইরে রাজাকে দেখতে? তাঁর ধারনায় রাজার অনুপম সৌন্দর্য যে নয়ন ভরে দিতে পারত! কিন্তু আঁধারে, বাহ্যিক রূপের অন্তরালে এক অনুপম সৌন্দর্য তিনি উপলব্ধি করলেন। ঠিক যেমন আমরা অন্তরে পরমাস্পদের প্রেম অনুভব করি। সর্বসত্ত্বাকে এক শান্ত আনন্দে ভরিয়ে দেয় সেই অনুভুতি। অবশেষে রাজা ও রাণী সেই অনুরাগে রঞ্জিত হলেন। প্রেমের উৎসব, বসন্তের উৎসব শুরু হলো। তাদের সেই উৎসব জীবনকে অনন্তের স্পর্শ দিয়েছিল। কারণ তা আমোদ নয়। তাহলেই আসল কথাটা বলা হলো। যা আমোদ তা আনন্দ নয়। পার্বণের প্রয়োজন আছে বৈকি! কিন্তু হৃদয়ের একুল ওকুল ভাসানো যে আনন্দ আমরা উৎসব থেকে পেতে চাই তা পাওয়া হয়ে ওঠেনা।

আজকাল বেশির ভাগ সময়েই মনে হয়, আমরা বড় বেশি বাইরেটা নিয়ে মেতে আছি। তাৎক্ষণিক সুখ স্বাচ্ছন্দ আমোদ প্রমোদ আমাদের জীবনধারণের একমাত্র লক্ষ হয়ে উঠেছে। দুঃখ বস্তুটাকে আমরা সবলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। অথচ ওইটেরই প্রয়োজন জীবনে। দুঃখ আমাদের অন্তর্মুখ করে। নিজের মনের গহনে ডুব দিতে পারা যায়। নিজের সঙ্গে একা থাকতে থাকতে কখন যেন আত্মোপলব্ধি ঘটে যায়। তখন আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর, ভেবে ভেবে আকুল হই। ভালবাসার একটা উৎস খুলে যায়। বাইরে যা দেখি তাইই রঙিন লাগে। ধূসর মলিন সব সরে যায়। স্বার্থপরতা সরে যায়। দুঃখ আমাদের উদার করে। কিন্তু এখন আমরা ঘন ঘন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হচ্ছি। শোকের ওষুধ। দুঃখের ওষুধ। ব্যর্থতার ওষুধ। সফলতার ওষুধ। সব আছে। দুঃখের স্পর্শ থাকবেনা আর। সুখের খনির সন্ধান। প্লেজার হান্ট। ব্লিস নয়। যেন ডেড সী তে ভেসে আছি। উপরিতলেই সমুদ্র অবগাহন। অন্তরে কি আছে জানা নেই। এত যে শরীর আর মনকে আরামে আর সুখে রাখার চেষ্টা, আদতে তা যে কিসের জন্য তা আমরা জানিনা।

আর জানিনা বলেই মন্দিরে দেবতার থানে অবিরত ভিড়। মানতের বাড়াবাড়ি। কারণ ভগবান আমাদের সুখে রাখবেন। সুখ কি? জানিনা। ভগবানের কাছে কি চাইব? জানিনা। কি পেলে খুশি হই? জানিনা। জানিনা যে তার প্রমান, যা চাইছি তা পেলেই অনন্ত সুখের অধিকারি হতাম। হইনা। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাইনা। এক মহামানব বলে গিয়েছেন, আমার মা সব জানে। আমি কিছু জানিনা। মাঙনে সে আদমি ছোটা হো যাতা। তুমি জীবন মানে কি, তাই জানোনা, কেন জন্মেছ তাই জানোনা, অথচ উদ্ভট সব জিনিস চাইছ। লালচুসী চাইছ। পাঁচ সের চালের ভাত খাবে ভাবছ। একজালা জল খাবে ভাবছ। তাই কি হয়? মহামানব বললেন বিকারের রোগীর অমন হয়। বিকার কি? আমি এই দেহ, এই ভাবা। বিকারের রোগীর উপসর্গ কি? এই দেহকে অনন্ত সুখ দেওয়ার চেষ্টা। সে জানেইনা যে এই দেহ পুড়ে দেড় সের ছাই হবে। তবু চাই। উপায়? দেহের অতীত সেই পরম অস্তিত্বের সন্ধান এই রোগের ওষুধ। বৈদ্য বসে আছেন চুপটি করে। নিষ্ক্রিয় কিনা। ধীরে ধীরে শোকেতাপে দুঃখে পুড়ে সোনা হয়ে উঠবে রোগী। তারপর সে পাবে অস্তিত্বের সেই হিরন্ময় বর্ণ। যা তাকে পরম আনন্দের সন্ধান দেবে। অনুরাগের রঙ। সোই অনুরাগ বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়। প্রতি মুহূর্তে সেই রঙ তার মর্মে লাগবে। সে ব্যাকুল হবে। বলবে – রঙ দে চুনারিয়া। এয়সি রঙ দে কি রঙ নাহি টুটে রে। বাইরের উৎসব ফিকে হয়ে যাবে। মহামানব বলেছিলেন। বাইরে থেকে মনকে রাঙানো যায়না। একজনের একটি গামলা ছিল। তাইতে শুধু জল ছিল। লোকে তার কাছে গিয়ে বলত- ওগো, আমার কাপড়টি এই রঙে ছুপিয়ে দাও। ওমনি সে সেই রঙে ছুপিয়ে দিতো। একজন দূর থেকে দেখছিল। সে কাছে গিয়ে বলল- ওগো, তুমি যে রঙ দিয়ে সব কাপড় ছুপিয়ে চলেছ, আমাকে সেই রঙটি দাও। এই যে দূরে দাঁড়িয়ে জীবনের চলমানতা দেখা, প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন আশা আকাঙ্ক্ষা চাওয়া পাওয়া দেখতে থাকা, এইই আমাদের অস্তিত্বের সেই নিষ্ক্রিয় পরমকে অনুভবে আনে। আমরা বলতে পারি- ওগো, তুমি এই দেহকাপড়টিকে যে রঙে রাঙাতে চাও, রাঙিয়ে দাও। বরং তোমার ওই অনুরাগের রঙ কিছু আমাকেও দাও। আমি বাইরে হোরি না খেলে অন্তরে রাঙিয়ে দিই। উৎসব চিরকালের হবে তবে।

একজন সন্ন্যাসী হতে চায়। সে গেরুয়া পরে এসে দাঁড়িয়েছে। মহামানব মুখ তুলে চাইলেন। একি? একটা কি যা হয় পরলেই হলো? গৈরিক ত্যাগের রঙ। মনে ত্যাগ হলোনা বাইরে একখানা কাপড় জড়ানো হলো। ভয়ঙ্কর। মনের রঙ দেহে লাগবে। দেহ থেকে রঙ মনে যাবেনা তো! সময়ের মতো একমুখী গতি যে। ত্যাগের রঙে ছোপানো কাপড় পরে অসংযম, ভোগ, সে তো মিথ্যাচার! মনে মিথ্যের রঙ লাগবে!আর প্রতিনিয়ত তাইই হচ্ছে।

আমাদের শরীরসর্বস্ব জীবন। নিত্যনতুন খাদ্যের আয়োজন। নতুন নতুন ভোগের উপকরন। ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। যা চাইছি তা তক্ষুনি চাইছি। ছেলের হাতের মোয়া। কারোর হাতে সময় নেই। সুখের সন্ধানে অবিরত ছুটে চলেছি। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! ফলে অনন্ত আনন্দের সন্ধান আর পাওয়া হয়না। এইসব চাওয়াপাওয়া ছেড়ে দিলে বেশ লাগে কিন্তু। চুপ করে সর্ষে খেতের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি ঘরছাড়া মানুষকে। কেমন শান্ত দৃষ্টি। কোনও চাওয়াপাওয়া নেই। আছে শুধু অনুভব। একা কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র রঙ দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, পৃথিবীর যত ক্লেদ বোধহয় ওই কালো কালো অসংখ্য পাহাড়। ওদের মধ্যে থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং ঈশ্বর। তাঁর শুভ্রশরীর আমার মনে যে কি অপরুপ ভালবাসা এনে দিয়েছে! পারলেই ছুটে ছুটে যাই সেখানে। এ কেমন ভালবাসা? এ কেমন প্রেম? মানুষে মানুষে যে প্রেম তা নিতান্তই স্বার্থভিত্তিক। পারস্পরিক আদানপ্রদানে তার পরমায়ু। কিন্তু এই যে প্রেম, ঈশ্বরের মতন, তা আবিষ্ট করে, উদবুদ্ধ করে, এবং অবশেষে তা শরীরের সীমিত গণ্ডি ছাপিয়ে যায়। আমাদের দেহবোধ ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বনিখিলে। ঠিক যেমন একমুঠো আবীর আকাশে ছুঁড়ে দিলে তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সকলকে রঙিন করে। দোল তাই আনন্দের উৎসব। অনুরাগের রঙে রাঙিয়ে নেওয়ার উৎসব। সেই রঙ যেন মোর মর্মে লাগে। আমার সকল কর্মে লাগে। হে পরম, আমাকে রাঙাও। আমি আনন্দে উজ্জীবিত হই।

[দোল সংখ্যা জাগ্রত বিবেক ২০১৯]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

Posted in






কথামুখ

সুধীজন, আজ এমন একজনকে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো তাঁকে অনেকে মনে রেখেছেন হয়তো কিন্তু এটাও পাশাপাশি ঠিক বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন তিনি৷আপনারা মনে হয় অনেকেই নিশিপদ্ম বা হিন্দিতে অমরপ্রেম দেখে মুগ্ধ হয়েছেন৷মুগ্ধ হয়েছেন বাংলা নিশিপদ্মে উত্তমকুমার আর হিন্দি অমর প্রেমে রাজেশ খান্নার অসামান্য অভিনয়ে৷ আসল গল্পে এই চরিত্র দুটি ছিল না৷বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে এই চরিত্রর অস্তিত্ব ছিল না৷ এই চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা চলচিত্রের চিত্রপরিচালক এবং হিন্দি ;অমরপ্রেমের; চিত্রনাট্যকার এক এবং অদ্বিতীয় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷হ্যাঁ,া আজকের আলোচনা তাকে নিয়েই৷

১৯৪৮ সালে সামনে এল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমা ‘ধাত্রীদেবতা’। আর তাতে হঠাৎই সুযোগ পেয়ে গেল ওই ছেলেটি, রামরতন মাস্টারের চরিত্রে। সেখান থেকেই শুরু হল এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। তারপর সময় এগিয়েছে, নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছে ছেলেটিও। ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে কালক্রমে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিয়ে হয়েছে স্বনামধন্য একজন পরিচালক। সেদিনের আনকোরা ছেলেটিকে নিজের নামেই চেনে সবাই— অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার জগতে এই নামটির স্থান ঠিক কোথায়, নতুন করে বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই। শুধু একটাই কথা; সেদিনের কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমায় পার্ট পাওয়ার জন্য যারা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন আরও দুজন। তাঁরা অবশ্য তখন সেই সিনেমায় সুযোগ পাননি তাদের দুজনের নাম জহর রায় আর শম্ভু মিত্র৷ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যাঁর অগ্রজ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় যাকে আমরা সবাই বনফুল বলে চিনি৷ বাংলা সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাস বা ছোটগল্পে তার মত সাহিত্যকীর্তির নজীর খুব কমই আছে৷

১৯১৯ সাল, ১৮ই জুন জন্ম হয় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের৷ পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের কর্মক্ষেত্র ও স্থায়ী বাসস্থান বিহারের পূর্ণিয়া বিভাগের কাটিহার জেলার মণিহারীতে। মাতা মৃণালিনী দেবী। ভ্রাতা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়৷ এঁদের আদি পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শিয়াখালা গ্রাম। তাঁদের পরিবার "কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে" নামে পরিচিত ছিল৷ অরবিন্দের পড়াশোনা কাটিহারে। স্থানীয় স্কুল থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করার পর চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। সেই সময় কলাভবনে তার সহপাঠী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ মতো সাহিত্য পাঠ করতেন। নাটক গল্প ইত্যাদিতে তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান-পাঠ শেষ করে ভর্তি হন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু মন পড়ে থাকে নাটক, গল্প সিনেমায়। তৃতীয় বর্ষে কলেজের ভিতরেই তার পরিচালিত নাটক দেখে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন -

' ঢুলু, তোমার আর্টের লাইনে যাওয়াই ভালো। ওটাই তোমার ঠিক জায়গা।'

প্রসঙ্গত ঢুলু; ছিল অরবিন্দের ডাক নাম। পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র জগতে তিনি ঢুলুদা বা ঢুলুবাবু  নামেই পরিচিত হন। কলকাতায় ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে এসে বিমল রায়ের উদয়ের পথে সিনেমা দেখে আরো বেশি উৎসাহিত হন।

সময়টা তখন ভীষণ অশান্ত৷ ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ৷চারদিকে টালমাটাল , যাকে বলা যায় বিধ্বস্ত অবস্থা৷ধ্বস্ত বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন৷ অরবিন্দ বাবু তুলে নিলেন দায়িত্ব৷পরিচালনা করলেন একের পর এক ছবি৷ মধ্যবিত্ত সমাজ হাসতে শিখলো,নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো৷অফুরান প্রাণশক্তিতে হয়ে উঠলো ভরপুর৷দু একটি নাম করলেই বুঝবেন কি সব অসামান্য চলচিত্র যেমন মৌচাক, ধন্যি মেয়ে, নিশিপদ্ম৷অসামান্য চিত্রনাট্য,পরিচালনা আর অভিনেতা নির্বাচন এই তিনটি জিনিষের ত্র্যহস্পর্শে ম্যাজিক হয়েছিল ৷ চরিত্রানুযায়ী সঠিক অভিনেতা নির্বাচনে অসম্ভব মুন্সীয়ানার পরিচয় বহন করেছেন স্বনামধন্য পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ৷ আজও বহু সমালোচক মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন ৷এইসব চলচিত্র যেন মধ্যবিত্ত জীবনের জলছবি৷একঝলক টাটকা বাতাস৷ একেবারে দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসা কোনও অতিনাটকীয়তা নেই, নেই কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া৷

আগেই বলেছি নিশিপদ্মর কথা৷নিশিপদ্ম’ সিনেমাটির মূল গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। এর হিন্দি রিমেক ‘অমর প্রেম’ও তাই। কিন্তু এই সিনেমার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুটো অদ্ভুত তথ্য। প্রথমত, উত্তমকুমার বা রাজেশ খান্নার যে চরিত্রটি আমরা পর্দায় দেখি, সেটি বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্র নয়, তার নির্মাতা স্বয়ং অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। একথা আগেই লিখেছি ৷ মূল প্রভেদ অবশ্য দ্বিতীয় কারণের জন্য শুধুমাত্র একটি গল্পের ওপর ভিত্তি করেই সিনেমাটি তৈরি হয়নি। বিভূতিভূষণের দুটি ছোটগল্প মিশিয়ে তারপর সেটাকে নিজের মতো রূপ দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। ‘অমর প্রেম’-এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে ফিল্মফেয়ারও পেয়েছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷

২৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচিত্র , ৩টি টেলিফিল্ম ও একটি সিরিয়াল নির্মাণ করেছেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷



বিশ্বযুদ্ধ,অরবিন্দর চলচিত্র ও সমাজচিন্তাঃ-

ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি যে বছর শান্তিনিকেতনে পড়তে যান ঠিক সেই বছরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪২ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে ডাক্তারি পড়তে যান বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে। সে বছরই ভারত জুড়ে চলছে বৃটিশদের বিরুদ্ধে ”ভারত ছাড়” আন্দোলন। ১৯৪৫ সালে অগ্রজ ড. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) উৎসাহে চলচ্চিত্রে শিল্পে যোগ দেন যে সময় সারা ভারত উত্তাল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবি ১৯৫৯ সালে, বনফুলের গল্প নিয়েই ‘কিছুক্ষণ’।

শেষপর্যন্ত চতুর্থ বর্ষের ডাক্তারি পড়ায় ইতি টেনে চলে এলেন চলচ্চিত্র জগতে। প্রথমে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন । পরে কলকাতার বীরেন সরকারের নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন বিমল রায়ের অ্যাসিস্টান্ট হিসাবে। সেখানেহৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তার সহকর্মী ছিলেন। পরে নিজেই বড়দা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) গল্প নিয়ে 'কিছুক্ষণ' ছবিটি করেন। প্রথম ছবির পরিচালনাতেই মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছিলেন। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর একের পর এক ছবি করেছেন তিনি।

আহ্বান, নতুন জীবন, পিতাপুত্র, নায়িকার ভূমিকায়, ধন্যি মেয়ে, নিশিপদ্ম, মৌচাক, অগ্নীশ্বর এর মতো ছবি আজও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে।



মনে রাখা কিছু ছবিঃ-

প্রবল অস্থির সময়ে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু ওনার ছবি অস্থিরতা মুক্ত। দীনতা বা ভাঙনের কথা উনি শোনাতে চাননি, বরং ক্রমাগত ধ্বস্ত হওয়া মধ্যবিত্তের জীবনে উনি আনতে চেয়েছেন কিছুক্ষণের আরাম। নায়িকার ভূমিকায়, পিতাপুত্র, অজস্র ধন্যবাদ, নতুন জীবন, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, বর্ণচোরা, মন্ত্রমুগ্ধ, হুলুস্থুলু, কেনারাম বেচারাম সব ছবির মধ্যেই একটি সাধারণ বার্তা রয়েছে–মধ্যবিত্তের আপাত বিবর্ণ জীবন যাপনেও রয়েছে অজস্র রঙিন অবসর, রয়েছে অনেক কৌতুকময় মুহূর্ত।

‘ক্ল্যাসিক’ চলচ্চিত্র বানানোর চেষ্টা করেননি বলেই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কোনও অতি অভিনয় বা অহংকার ছিল না। সিনেমা যে একটি বিনোদন মাধ্যম এবং গল্পের টানেই যে দর্শক হল-মুখী হন এই সরল সত্যের প্রতি অনুগত ছিলেন সারাজীবন ৷কোনও সত্যের অপলাপ না করেই সারাজীবন মাধ্যমের প্রতি সৎ থেকেছেন৷ সরাসরি চলচিত্রের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন যেন৷কোনও পুরস্কারের জন্য পরোয়া করেননি৷ দর্শকদের ভালোবাসাই তাঁর একমাত্র পুরস্কার ও অহংকারের জায়গা৷



অরবিন্দর শান্তিনিকেতনঃ-

১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। আসলে, অরবিন্দের অগ্রজ ‘বনফুল’ বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় গুরুদেবের স্নেহধন্য ছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন এই কিশোর সম্পর্কে। তখন অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে কাজ করতেন। তিনি অরবিন্দকে পরামর্শ দেন যে বার্ধক্যে কবির শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ায় অরবিন্দ যেন একটু জোরে কথা বলেন। প্রণাম করার পরই গুরুদেবের জিজ্ঞাসা, ‘‘তুমি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’’ অরবিন্দ স্বর উচ্চগ্রামে তুলে উত্তর দিলেন, ‘‘না, আমি অরবিন্দ।’’ গলার জোর শুনে রবীন্দ্রনাথের সহাস্য মন্তব্য, ‘‘না, তুমি কানাই নও সানাই।’’

অরবিন্দবাবু তো বটেই, প্রায় সবাই শান্তিনিকেতনের ছাত্রাবাসে থাকতেন। সবসময় তো শান্ত থাকা যায় না, আর তখন সবার অল্প বয়স; সবাই ঘরের মধ্যেই দৌরাত্ম্য করতেন। একটা স্বাধীন পরিবেশ ছিল। এরমই একদিন অরবিন্দবাবু ও তাঁর বন্ধুরা ঘরে বালিশ ছোঁড়াছুড়ি খেলছেন। এমনই মগ্ন হয়ে গেছেন যে খেয়ালও করেননি ঘরে আরেকজন এসে উপস্থিত হয়েছেন। সেই সময়ই একটি বালিশ ওই আগন্তুকের পায়ে এসে পড়ল। সেটা তুলে নিয়ে আগন্তুক বললেন, “তোমাদের দেখে বেশ হিংসে হচ্ছে আমার। আমি এমন মজা করতে পারছি না।”

আগন্তুকের নাম জওহরলাল নেহরু; তিনি পরিদর্শনে এসেছিলেন হোস্টেলে…

আর একটি ঘটনার কথা না উল্লেখ করলেই নয়৷ গল্পটা এরকম অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যে সময় শান্তিনিকেতনে পড়তেন, তখন তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ। সবাই মিলেই নানা অনুষ্ঠান করতেন। অভিনয়, নাটক তো ছিলই। একবার একটি নাটকে নায়ক ও নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র। এছাড়াও ছিল নিজেদেরই একটি পত্রিকা, নাম ছিল ‘একেবারে যাতা’! তাতে প্রকাশকের জায়গায় লেখা থাকত ‘তুমি’, আর সম্পাদকের জায়গায় ছিল ‘আমি’। তারই প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। যাই হোক, একবার দোলের সময় একটি রংভরা চৌবাচ্চার মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফেলে দিয়েছিলেন অরবিন্দবাবু। নিছক মজার জন্যই এমন করা।

কিন্তু কণিকা গেলেন রেগে! সোজা চলে গেলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বিকেলে বসল বিচারসভা। রথী ঠাকুরের সঙ্গে উপস্থিত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। সমস্ত ঘটনা শুনে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যবস্থা’ করলেন। দুজনকে ডেকে পরস্পরের হাত মিলিয়ে দিলেন। বললেন, আর যেন তোরা দুটিতে কোনো ঝগড়া না করিস। সেই সময় শান্তিনিকেতনের গঠন, শিক্ষা এবং পরিবেশ কীরকম ছিল এইরকম টুকরো টুকরো ঘটনাই তাঁর প্রমাণ।



সিনেমার অরবিন্দ, অরবিন্দর সিনেমাঃ-

শুরু করব বিখ্যাত চলচিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে যিনি যথার্থই বলেছেন, বাণিজ্যিক সিনেমাও যে সুন্দর- লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সংলাপ যে আদৌ অসম্ভব নয়- কিছুক্ষণ একদা তা প্রমাণ করতে চেয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণযুগে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অগ্রগামী ও অগ্রদূত যেমন স্মরণীয়, তেমনই স্বচ্ছ ও সুস্থ বাণিজ্য ধর্মের জন্য অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অভিনন্দনযোগ্য থেকে যাবেন।

যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন তিনি৷ এখানেই অরবিন্দবাবুর সার্থকতা সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মেলবন্ধন ঘটেছিলো তাঁর হাত ধরেই৷ যেমন কাহিনী তেমন বাজারে হিট৷মুনাফা তুলেছে ছবি অর্থাৎ বাণিজ্যিক ভাবে চূড়ান্ত সফল৷

শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিলে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তিনি। নাটকে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে।



অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের চলচিত্রে সঙ্গীতঃ-

সংগীতেরও অনুরাগী ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়৷তাই তাঁর ছবিতে অসাধারন গানে ভরপুর৷"যা বলে ওরা বলে বলুক বা ধন্যি মেয়েতে 'বাঙালীর সেরা খেলা ফুটবল'; বা মৌচাক এর বিখ্যাত গানগুলি আজও ভোলা যায়না৷

";ফিল্মে গানের প্রয়োগেও অরবিন্দ কাকার মতো পরিচালকের বিরাট ভূমিকা। গানটা বুঝতেন তিনি,” বলেছেন সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ। অরবিন্দের বহু ছবির সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ‘বাঙালির তুমি ফুটবল’ থেকে বহু গানেই বাজিয়েছেন। অরবিন্দবাবুর ভাবনায়, ফিল্মে গান হবে সিচুয়েশনাল, প্রক্ষিপ্ত নয়। আবার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’-র লিরিক শুনে গানটির কথা ভেবেই নিশিপদ্ম-র চিত্রনাট্য পাল্টেছেন। বিভিন্ন গীতিকারকে দিয়ে চেষ্টা করিয়ে প্রণব রায়ের লেখা, ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা’-ই বাছাই করেন ধন্যি মেয়ে-তে। হেমন্তের ‘এখানে সবই ভাল’, ‘লাজবতী নুপূরের রিনিঝিনিঝিনি’, সন্ধ্যার ‘তিরবেঁধা পাখি’, ‘আমার সকল সোনা’, শ্যামল মিত্রের ‘আহা গোলাপগুলি’, ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে’, বা মান্নার ‘এ বার ম’লে সুতো হব’ কী ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’-এর মতো গানের জন্য অরবিন্দের ছবির কাছে বাঙালির ঋণ জন্মেও শোধ হবে না।



নাটকে ও থিয়েটারে অবদানঃ-

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তখন নিউ থিয়েটার্সে সহকারী পরিচালক। তুলসী চক্রবর্তী সেখানে প্রায় প্রতি ছবিতেই অভিনয় করেন আর দেদার আড্ডা দেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের সঙ্গে, ভাল গাইতেন বলে তাঁরা তাঁকে এক দিন গাইতে অনুরোধ করলেন। অরবিন্দবাবু লিখছেন ‘‘তুলসীদা বললেন— পঙ্কজ, তুমি তো বাবা রবীন্দ্রসংগীত গাও, আমি একটা নিজের সংগীত শোনাই। ‘বেশ বেশ’ সবাই বলে উঠল। তুলসীদা ডান হাতটা ডান কানে রেখে বাঁ হাতটা তুলে আ-আ-আ— করে তান ধরলেন, তারপর কাফি রাগে শুরু করলেন:— শিবরাত্রির পরের দিন/ শিবের হল সর্দি কাশি/ ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে/ জ্যেঠি কাকি মামি মাসি/ তাই শিবের হল সর্দি কাশি/ আদা দিয়ে চা করে...।’’ তাঁর সরস গদ্যে এ রকমই স্মৃতির আখ্যান ছবি বিশ্বাসকে নিয়েও। ১৯৫৪-য় নিউ থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে গেলে অরবিন্দবাবুরা কয়েক জন মিলে নতুন কাজের সন্ধানে একটা ছবির ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন ছবিবাবুর কাছে, তিনি বললেন ‘পাঁচশ টাকা করে পার ডে দিবি।’ সতীর্থ বন্ধু সুনীল বসু হাতজোড় করে কাঁচুমাচু মুখে ‘আড়াইশ’ দিতে পারবেন জানালেন, শুনে ছবিবাবুর মন্তব্য ‘একেবারে নীল ডাউন হয়ে হাফটিকিটের প্যাসেঞ্জার হয়ে গেলি যে, ডেটগুলো দিয়ে যা।’



ঢুলু বাবু চলে গেলেন রেখে গেলেন সবঃ-

সারা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে চিনতো ঢুলু বাবু বলে৷ একটা ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করব ৷অগ্নিশ্বর’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে উত্তমকুমারের নাম ঘোষিত হয়। কিন্তু আর কোনো পুরস্কার দেওয়া হবে না। পরিচালক হিসেবেও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় কোনো পুরস্কার পাবেন না। এই খবরটা জানতে পারার পর উত্তমকুমার সবিনয়ে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “এই ছবিটা সফল হওয়ার পেছনে শুধু আমি নই, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও আছেন। তাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তাঁকে যদি পুরস্কার না দেওয়া হয়, তাহলে আমিও নেব না।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এগুলো নিয়েই বেঁচে ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।

২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী বার্ধক্যজনিত রোগে ঢুলু বাবু চলে গেলেন অমরলোকে ৷বয়স তখন তাঁর ৯৭৷ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা কালে অসামান্য চলচিত্রের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য৷এসব কালোত্তীর্ন সৃষ্টি থেকে যাবে আমাদের কাছে৷সব ভুলতে বসা আজ বাঙালী মধ্যবিত্তের এ এক অহংকার৷



তথ্যসূত্রঃ

The Wall
আনন্দবাজার পত্রিকা
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
আলোছায়ার দিনগুলি/অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, দেজ

0 comments:

1

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in





প্রতি বছর নিয়ম করে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পালন করা হয় দেশ জুড়ে, এই শহরেও। মিছিল, মিটিং, সেমিনার করে পাড়ায় পাড়ায় লোকেদের মন থেকে অপবিজ্ঞান আর কুসংস্কার নিয়ে ধারণা দূর করতে নানা প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। কিন্তু সমাজে লোকেদের মন থেকে কুসংস্কার দূর তো হলই না বরং দিনে দিনে তা আরও ঊর্দ্ধমুখী। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কি মনে গেঁথে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার দূর হয়? সমাজের দিকে তাকালেই দেখা যায় বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ধর্মীয় পুজো, আচার এবং নানা সংস্কারের সাথে ওতোপ্রোত যুক্ত। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ বিজ্ঞানী, ডাক্তার এবং গবেষকও সংস্কারমুক্ত নন। নিজের এই অযৌক্তিক ব্যর্থতাকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে আপোষ করেন।

যুক্তিসম্মত যে কোনো জ্ঞানই তো বিজ্ঞান আর তা সাহিত্যও হতে পারে। প্রাণী আর প্রকৃতি, এদের নিয়েই তো যত শিক্ষা। যে শিক্ষা মানবহিতকর তাই তো প্রকৃত শিক্ষা। হিউম্যানিটিজ শব্দের অর্থ মানবিকীবিদ্যা যা শিক্ষার প্রাথমিক রূপ দর্শন। প্রকৃতি ও মানুষের সমাজ থেকে উঠে আসছে। কেউ ভাষায় অলঙ্কারস্বরূপ তাকে বর্ণনা করছে, কেউ আবার তার সত্যাসত্য প্রমাণ করছে। এর থেকেই কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ। এখনও কিন্তু এই দুটো বিভাগেই যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়।

আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি সমাজ থেকে আর কিছুটা ব্যক্তিগত ভাবে যাকে বলে ঠেকে শেখা, অভিজ্ঞতা থেকে অথবা ভাবতে ভাবতে নতুন কিছু উদ্ভাবন। মানুষের বিবর্তনিক ইতিহাসের যুক্তিটা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে চার্লস ডারউইন সাহেব মান্যতা পান। জন্মান্তরের ভূতটা মাথা থেকে নামতে সাহায্য করে। মানুষকে শিক্ষিত করতে গেলে তাকে ভাবার, যুক্তি তৈরির সুযোগ করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটাই তো যুক্তি বা লজিক তৈরির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে, শুধুমাত্র গিলিয়ে দেবার জন্যে নয়।

এই যুক্তি কাজ করছে সেই প্রথম মানব (হোমো হ্যাবিলিস) থেকে যারা বালি, মাটি ও পাথরের মধ্যে দেখল পাথর ছুঁড়লে সবচেয়ে বেশি দূর যায় এবং তা দিয়ে আত্মরক্ষা আবার শিকারও করা যায়। বিজ্ঞানের সূত্রপাত সেই যুক্তি থেকেই। আর পাথরকে ঘষে অস্ত্র তৈরি হল তার প্রথম প্রযুক্তি। সেই থেকে মস্তিষ্কের ক্রম বিবর্তন, এবং দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি। যুক্তিবাদী মন মানুষের জন্মগত।

বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব প্রাচীন। যা ধরে রাখে তাই ধর্ম। প্রকৃতি প্রতিটা প্রাণিকে ধরে রাখে সেটা প্রকৃতির ধর্ম। মানুষ প্রকৃতি আর তার প্রাণিজগতকে ধরে রাখলে সেটা মানুষের ধর্ম। আদি মানবের যুথবদ্ধ থাকার উপলব্ধি সংস্কৃতির প্রথম অধ্যায়। সেই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মানুষ। বিচিত্র ভৌগোলিক অঞ্চলে মানুষের বেঁচে থাকার সংস্কৃতি হল ভিন্ন। আধুনিক মানুষের সভ্যতা সেভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন নদীর অববাহিকায় নিজ নিজ ধর্মে। কিছু চতুর লোক এই ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজকে শাসন করতে শুরু করল, সংস্কৃতি হল প্রধান অস্ত্র। আদানপ্রদানের বদলে সংস্কৃতির আত্তীকরণ বিশেষ আকার ধারণ করল। ধর্ম আর সংস্কৃতিকে মিলিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করা হয়ে গেল। ব্যবহারিক সংস্কৃতির কিছু সংস্কারে পরিণত হয়। সংস্কার যতক্ষণ মানুষের হিতের জন্যে সেটা গ্রহণযোগ্য, নইলে তা কু-সংস্কার। সংস্কৃতি নদীর মত সদা বহমান, সময়ের সাথে পরিবেশের সাথে বদলিয়ে যায় কিন্তু যে সংস্কার স্থবির হয়ে যায় তা সমাজে ক্ষতি করে, কু-সংস্কার।

জন্মের পর জ্ঞান হওয়া থেকেই মানুষ সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে প্রথমে পারিবারিক আবহাওয়ায় ও পরে বাইরের সমাজে। পরিবার যদি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় তাহলে সংসারে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে তার প্রভাব শিশু মনে পড়তে বাধ্য। কুসংস্কার মানুষের মনকে দুর্বল করে আবার দুর্বল মনে কুসংস্কার বাসা বাঁধে। আজ যে বিজ্ঞানী সে তো শিশু থেকেই ওই সংস্কারাচ্ছন্ন পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার মধ্যেই বেড়ে উঠেছে ফলে তার মধ্যে সেই মনোভাব চেপে বসে আছে। এইবার সে যখন বড় হয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করল তখন আর পাঁচটা বিষয়ের মত সে যুক্তি দিয়ে বোঝার পরিবর্তে মুখস্থ করে কারণ তার উদ্দেশ্য গবেষণা বা চাকরি। বিজ্ঞান পড়াটা তার কাছে একটা ভবিষ্যতের উন্নতির স্প্রিংবোর্ড, নিজের মনকে বিজ্ঞানে আত্মস্থ করার জন্যে নয়। তাই বিজ্ঞানী হলেই সংস্কারমুক্ত হয় না। আজকাল পৌরাণিক গল্পের কিছু ঘটনাকে বিজ্ঞানের মোড়কে বাজারে চালানোর রাজনৈতিক চেষ্টা চলছে। স্কুল-কলেজে বৈদিক বিজ্ঞান চালু করায় সরকারি মান্যতা বিজ্ঞানের জায়গায় অপবিজ্ঞানের প্রাধান্য বাড়াতে সাহায্য করছে।

অদূরদর্শী মানুষ তার ভাবী অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কায় দুর্বল, নির্ভরতা-প্রবণ, যুক্তিহীন। বিশ্বাসের জন্ম সেখানেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি প্রকৃতির অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চয়তার জট ধীরে ধীরে খুলছে।বিজ্ঞানকে যুক্তি দিয়ে আত্মস্থ করতে না পারলে বিজ্ঞান-গবেষক বা বিজ্ঞানমনস্ক চাকুরীজীবী হওয়া যায় কিন্তু যুক্তিকে ব্যবহারিক কাজে লাগানোর মত বিজ্ঞানী তৈরি হয় না। এর জন্যে চাই আত্মশক্তি। অবশ্য আত্মশক্তি থাকলে বিজ্ঞানী না হয়েও যুক্তিবাদী মন হতে পারে। ব্যক্তিগত শিক্ষাই আত্মশক্তি তৈরিতে সাহায্য করে যেখানে নিজস্ব মতামত দ্বারা প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। এই জন্যেই রামমোহন বা বিদ্যাসাগর বিজ্ঞানী না হয়েও সংস্কারমুক্ত ‘মানুষ’ হয়েছিলেন। বিশ্বাস নয়, যুক্তি যা বহমান। সেটাই বিজ্ঞান, শিক্ষার কোনো স্বতন্ত্র শাখা নয়। এই আত্মশক্তি যার মধ্যে নেই সে বড় বিজ্ঞানী হয়েও সংস্কারমুক্ত হতে পারে না আবার চেষ্টা করে প্রাথমিককালে সংস্কারমুক্ত জীবন কাটালেও সেটা আপাত, সুযোগমত দুর্বল মনে সংস্কার আচ্ছন্ন করবেই। তখন অসহায়ের মত নিজেকে সমর্পন করে। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পাতা রয়েছে ভুবন জুড়ে, একমাত্র আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে যুক্তি দিয়ে সেই জাল কেটে বেরনো সম্ভব। শুধুমাত্র বিজ্ঞান দিবস পালন আর বক্তৃতায় যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে প্রোথিত গভীর বিশ্বাস দূর করা সম্ভব নয়, নিজের নিত্য ব্যবহারিক জীবনযাপন দিয়ে উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে। আপনি আচরি ধর্ম।

1 comments:

0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in







ভীষ্মের কথা মতো ব্রাহ্মণ দ্রোণ ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে যোগ দিলেন। দুর্যোধন প্রভৃতি ১০১ জন ভাই; যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এই পাঁচ পাণ্ডব; অন্ধক, বৃষ্ণি প্রভৃতি বংশের কুমার, এমনকি সূতপুত্র কর্ণও এসে দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলেন।

একলব্য এতক্ষণ মন দিয়ে রাজা হিরণ্যধনুর বলা আখ্যান শুনছিলেন। তার পর এক সময় বলে উঠলেন, আচার্য দ্রোণ কি এখন জীবিত, নাকি এও পুরাকালের কাহিনি?

নিষাদরাজ হিরণ্যধনু বললেন, জীবিত এবং তিনি হস্তিনায় থাকেন। তবে হস্তিনার আকাশে এখন দুর্যোগের কালো মেঘ! আর সেই মেঘ কেটে গিয়ে কবে সূর্য উঠবে, তা কেউ জানে না।

“কেন পিতা?” একলব্য জিজ্ঞাসা করেন।

হিরণ্যধনু জবাব দেন, যে দেশের রাজা অন্ধ হন, সে দেশের ভাগ্য অন্ধকার!

“তবে যে শুনলাম, ভীষ্ম আর রাজমাতা সত্যবতী রাজ্য চালান?”

“সিংহাসনের বাইরের লোক রাজ্য চালালে দেশের ভাল হয় না বৎস! চারদিকে বৈশ্যরা ওৎ পেতে আছে, কবে যুদ্ধ লাগবে সেই প্রতীক্ষায়!”

একলব্যের এ সব কথা শুনতে ভাল লাগে না। তিনি দ্রোণাচার্যের ধনুর্বিদ্যা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি হস্তিনানগরে গিয়ে ধনুর্বিদ্যা শিখে আসতে পারি?”

হিরণ্যধনু বলেন, পারো। কিন্তু দ্রোণাচার্য তোমাকে কি শিষ্য হিসাবে মেনে নেবেন?

“কেন নেবেন না? নিষাদ বলে?”

“না। নিষাদ বলে নয়। সূতপুত্র কর্ণও তো দ্রোণের শিষ্য। ভীষ্ম চাইবেন না, তিনি নিষাদ-ভীলদের ভয় পান। বনজঙ্গলের মানুষরা সব রাজা জরাসন্ধের পক্ষে।”

“একবার চেষ্টা করে দেখা করা যায় না?”

নিষাদরাজ বলেন, আমি তোমাকে বাধা দেব না, আবার যেতেও বলব না। ভীষ্ম কিন্তু সমস্ত খবর রাখেন। তুমি পিতার নাম হিরণ্যধনু বললে কেউ তোমাকে শিষ্য করবে না।

একজন নিষাদ যুবক বলে, ধনুর্বিদ্যা শিখতে নগরে যেতে হবে কেন? আমরাই তো সবচেয়ে ভাল ধনুকতীর চালাতে পারি, ওইজন্য আমাদের নাম ভীল। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা পশুদের শ্বাসের আওয়াজ পেয়ে তাদের তীরবিদ্ধ করতে পারি। কোন নগরের কোন আচার্য তা শেখাতে পারে, বলো শুনি?

একলব্য বলেন, মহাত্মা পরশুরামের কাছে দ্রোণাচার্য সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন। সেই শাস্ত্র পাঠ করলে জঙ্গলের ধনুর্বিদ্যা আরও শক্তিশালী হবে।

একলব্যের মা জাম্ববতী বললেন, সে যখন সময় হবে যেও খোকা। এখন চান করে তোমরা চাট্টি খেয়ে নাও দেখি। সূর্য ঢলে পড়ছে মাথা থেকে।

হিরণ্যধনুর অনুমতি নিয়ে নিষাদ পুরুষরমণীরা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। একটি মেয়ে বসে রইল চুপচাপ। তাঁর নাম অঙ্গা—অঙ্গাগ্রণী।

********************************


অঙ্গা’র নামটি বড় খটোমটো। এমন নাম দিয়েছিলেন পাঠশালার গুরুমশাই। নিষাদ মেয়েরাও ছেলেদের মতো পাঠশালায় যায়। অঙ্গাও যেত ছেলেবেলায়। তখন থেকেই সে একলব্যের অনুরক্ত। পাঠশালা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অনুরাগ আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই মাঝেমধ্যে নীল মেঘের মতো এক বনে এসে তারা দুজনে বসে। এমনই এক বসন্তকালের বনে অনেক ফুল ফুটে আছে, অঙ্গা সেই ফুল তুলে খোঁপায় গুঁজছে, কখনও বা একলব্যের কানে গুঁজে দিচ্ছে।

একলব্যের সে সবে মন নেই। ধনুর্বিদ্যা শিখতে সে যাবে হস্তিনানগরে। অঙ্গা বার বার বোঝাচ্ছে, হস্তিনা হল নগর, সেখানে অরণ্যচারী নিষাদ থাকবে কী প্রকারে? তাছাড়া ও রাজ্যের নিয়মকানুন জলা-জঙ্গল-পাহাড়ের মতো নয়। সেখানে একজন লোকের গাছ থেকে অন্য লোকে পেড়ে খেলে রাজপেয়াদা ধরে নিয়ে যায়। সকলে বাড়িতে খাবার জমায়। সোনাদানা ভরে রাখে সিন্দুকে। জঙ্গলের নিষাদরা সব ফেলে রাখে। সব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রত্যেক লোকের সমান অধিকার। হস্তিনায় গিয়ে একলব্য কী খাবে, কে তাঁকে খেতে দেবে? সে তো জঙ্গল নয়!

একলব্য বলে, কয়েকটা দিন তো মাত্র। শুনেছি, হস্তিনার কাছে কুরুক্ষেত্রে এক কালে কুরুজঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে পলাশ, তিল, আম্র, চম্পক, দেবদারু, স্থলপদ্ম, অশোক, কুরুবক, নাগকেশর, তিনিশ প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল। সেই বনে ফুটে থাকতো ফুল, ফলতো ফল। পারিজাত গাছকে জড়িয়ে থাকতো লতা।

অঙ্গা এসে একলব্যকে জড়িয়ে ধরে।

একলব্য বলতে থাকে, কত পাখি ছিল সেখানে! কোকিল আর ভ্রমর রব করতো!

অঙ্গা বলে, তুমি কবে গিয়েছিলে সেখানে?

একলব্য উত্তর দেয়, যেতে হয় না। জঙ্গল তো এমনই সুন্দর হয়। ঠিক সেই সময় দূর থেকে মৃদুমন্দ বায়ু এসে তাদের কামভাব জাগিয়ে তোলে।

তারা দুজনে উঠে যায় আরও ঘন বনে, যেসব জায়গায় ঢুকতে নিষাদরাও ভয় পায়। সেখানে থাকে জঙ্গলের আসল রাজা পশুরা। সেই ঘন বনের মধ্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এখন মধুমাস। অনেক জঙলি ফুল ফুটে আছে সেখানে। আমের মুকুলের অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকটি ঘুঘু পক্ষী আর কিছু শালিখ ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে কীসব আগডুম বাগডুম বলে যাচ্ছে। বনের সকল গাছ যেন কামভারে অবনত। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী সেই বনের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

অঙ্গা একলব্যকে জিজ্ঞাসা করে, আর কতদূরে যাবে একো?

একলব্য উত্তর দেয়, নীল মেঘের মতো এই জঙ্গলের ভিতর একটা গনগনে সূর্য আছে, সেখানে যাব আমরা!

“পুড়ে যাব না?”

“গায়ে বাকল পরে নিলে সূর্যদেব আর পোড়াতে পারেন না!”

“তুমি কি দেবতা যে সূর্য ঠাকুর তোমাকে ছেড়ে দেবেন?”

“না রে কন্যা, আমি নিষাদ, ভীল কখনও দেবতা হয় না!”

অঙ্গা বলে, আর কতদূর যাবে, আমার ভয় করছে!

“ভয়ই যদি পাবে, তবে এলে কেন?”

“কী জানি কে আমাকে তোমার সঙ্গে ঠেলে দিল গো ভীলবীর! সে বোধ হয় তনু ঠাকুর! বড় খতরনক চিজ, তনুর তীর-ধনুক দেখেছো? পাঁচ খানা মুখ তার—একটো মারে ভোরে, আরেকটো দুফরে, বাকিগুলান বিকাল-সাঁঝ আর রাত্তিরবেলা!”

একলব্য থমকে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণীর বদনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে।

মনে মনে মা জাম্ববতী আর বাপ হিরণ্যধনুর সম্মতি নিয়ে একলব্য অঙ্গাকে নিয়ে নীল মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ে। অঙ্গার অজনবি সুরতে একা তখন ফানা হয়ে গিয়েছে। অঙ্গা একলব্যকে বলে, “এই বলো না গো, আমি নিষাদকন্যা না রাক্ষসী?”

একলব্য জবাব দেয়, “তোমার শরীরখানি নিষাদীর, কিন্তু তুমি আসলে ডানাওয়ালা পরি। রাত গভীর হলে তোমার ডানা গজায়। অঙ্গার ওই বক্ষদেশে আছে যে তনুমন তা আসলে গন্ধর্ব গানের গোলা।’’

“তবে একখান গান গাও, আমার তনুর গান, মন-পসন্দ!”

একলব্য গান ধরে, হতাহমিতি চাক্রুশ্য...।

অঙ্গাগ্রণী তার পাহাড়ী মায়ায় একলব্যকে প্রেমাতুর করে তোলে। এই সেই পিরিতি, যাকে তন্ত্রসাধকরা কামনদী বলে থাকেন। নীল মেঘের মতো বনে একটি ক্ষুরধারা নদী এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণী তার উর্ধ্বদেশের বস্ত্র অনাবৃত করে গেয়ে ওঠে, তীরধারা বয় গো নদীর তীরধারা বয়। তার পর দুজন নেমে পড়ে সেই খরস্রোতা নদীতে। অঙ্গা তার দুই কৎবেলবৎ স্তন দ্বারা একলব্যের বক্ষ মর্দন করতে করতে বলে, তুমি কি দানো না যক্ষ, না গন্ধর্ব, নাকি নক্ষত্রপুরুষ? তুমি আমার ভীল, তুমি আমার তিল এই সব কথা আগে জানলে তোমাকে আমের ননীর মতো চুষে চুষে খেতাম!

একলব্য বলে, তিল থেকে তাল হয় শুনেচি বাপু, কিন্তু তিল থেকে একলব্য হয় কী প্রকারে!

“একলব্য মানে তাল। ফল নয়, এ হল সুরতাল। আমার গোটা দুনিয়া হল সেই একলব্য নামের তাল, আর দুনিয়া ছেনে তুমি যা পাও তাই হল তিল—হৃদয়মন। তোমাকে তালের আঁটির মতো চুষে খেয়ে ফেলতে বাসনা হয় গো জাম্বোর পো!”

“কেন অঙ্গাগ্রৈণী! এই নদীর স্রোতে আমাকে তো তুমি খাচ্ছোই। তবে আমিও ছাড়ার বান্দা নই। আঁটির ভেতরে থাকে যে শাঁস, যাকে তান্ত্রিক বলে রুহ, আমি সেই থানে যেতে চাই।

একলব্য অঙ্গাগ্রণীর ওষ্ঠ পীড়ন করতে লাগল। একলব্যের নিষ্ঠুর আক্রমণে অঙ্গার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। নদীর স্রোত এসে তাদের দুজনের সব বস্ত্র হরণ করে নিয়ে গেল। উর্ধ্বাঙ্গের পীড়নে নিম্নাঙ্গে জ্বলে উঠল কামনা। ঢেউ আসতে লাগল একের পর এক। বাসনার প্রবলতায় তরল এক বাড়বাগ্নি অঙ্গাগ্রণীর জঠরে প্রবেশ করে। আপ্লুত হয়ে ওঠে সে।

তার পর দুজনেই দেখে সেই তীরধারা নদী আর নেই। দূরে বায়ু বইছে মৃদুমন্দ। ছালবাকল খুঁজে পরে নিয়ে তারা ফিরে এল হিরণ্যধনুর নিষাদরাজ্যে। তখন সেখানে গান গাইছে নিষাদরমণীরা। সেই গানের ভাষা নেই কোনও। একটানা সুর যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে নদীর স্রোতের মতো, আর সেই সুরে ভর দিয়ে সূর্যদেব চলে যাচ্ছেন বিশ্রাম নিতে, দূরে কোথাও।

এমন সময় একলব্যের খুব বিষণ্ন লাগে। সূর্যাস্তের এই কালে মনে হয়, জগৎ সংসার সব মিছে। আর একটু পরে ভীলদের সভা বসবে। অঙ্গাগ্রণী বাড়ি চলে গিয়েছে। সন্ধ্যা গাঢ় হলে সে আসবে রাজা হিরণ্যধনুর মাটির ঢিপির কাছে। আজই সভায় ঠিক হবে, একলব্য হস্তিনায় গিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে কিনা! কয়েকটা লোক ইতিমধ্যে এসে গিয়েছে। মশাল জ্বালানোর তোড়জোড় করছে তারা। এমন সময় মাতব্বরের একটা দল এল। সভায় যে শুধু মাতব্বরদের কথা শোনা হয়, এমন নয়। রাজা হিরণ্যধনু সাধারণ অল্পবয়সীদের কথাও মন দিয়ে শোনেন। ভীল সমাজে কেবল পুরুষ নয়, মহিলারাও সভায় আসেন এবং তাঁদের মতামত দেন। হস্তিনানগরের রাজকার্যে যা হয় না বলেই শোনা যায়।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৬

১৯৩৩ সালে ফিল্স্কাইট অবশেষে ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে যুবদলের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। সাংগীতিক গবেষণার কাজও চলতে থাকে তার। তার লেখালেখি অন্য অনেক সঙ্গীত বিভাগে প্রশংসিত হতে থাকে। বেশ কিছু বিশেষ জার্নালে অল্প স্বল্প সম্পাদনার পরে ছাপা হয় তার পেপার। যদিও সে অচিরেই যুব দলের অঞ্চলপ্রধান হয়ে গিয়েছিল, যদিও সেই অঞ্চলের নাৎসি ঝটিকা বাহিনী এবং সুরক্ষাদলের ভার ছিল তারই কাঁধে, তবুও সঙ্গীত ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। সমবেত সঙ্গীত পরিচালনা করতে তার খুব ভালো লাগত। সমবেত পুরুষ কণ্ঠের দল অথবা পুরুষ, মহিলা মেশানো কোনো দল পরিচালনা করতে তার জুড়ি ছিল না। নাৎসি ঝটিকা বাহিনীর যে মূল দল, অর্থাৎ মড়ার খুলি বাহিনী১ র ভিতরে ঢুকবার অনেক চেষ্টা ছিল তার, কিন্তু সে কিছুতেই সফল হচ্ছিল না। দু’ দু বার তার আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছিল, সম্ভবত তার কালো চুল এবং ছোটখাট শারীরিক গড়নের জন্য।

কেউ জানে না যে সে নিজের বাড়িতে প্রবল খেদের সঙ্গে বহুবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখত। তার নিজেরও মনে হয়েছে যে শারীরিক ত্রুটির ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করা যায়না তার ক্ষেত্রে। যে জাতকে সে পাগলের মত পছন্দ করে, পুজো করে, সেই জাতের প্রতিনিধি লোহেনগ্রিনের২ মত আর্যসুলভ চেহারা একেবারেই নয় তার। তবে অবশেষে তার তৃতীয় আবেদন গ্রাহ্য হল। কারণ, সে বিভিন্ন দলের সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে দারুণ দারুণ সুপারিশ পেশ করেছিল। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায়, তার সঙ্গীতপ্রতিভার কারণেই তাকে ভুগতে হল। একবারও ফ্রন্টে পাঠানো হয়নি তাকে। বরঞ্চ বিভিন্ন পাঠক্রমের শিক্ষানবিশ এবং তার পরে কোথাও কোথাও শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হত তাকে। সব শেষে শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হতে লাগল। এছাড়া নাৎসি সুরক্ষাদলের গানের ক্লাসের দায়িত্ব ছিল তার উপরেই। সেখানকার গানের দলে তার পরিচালনায় তেরোটা আলাদা দেশের মানুষ আঠেরোটা আলাদা ভাষায় গান গেয়েছে। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত তানহয়সার দলের অংশ হিসেবেও গেয়ে এসেছিল তার পরিচালিত দলটি। সে প্রথম শ্রেণির ওয়ার মেরিট ক্রস সম্মান পেয়েছিল, যা সেনাবাহিনীতে খুবই বিরল এক সম্মান; তবে সেটাও কুড়ি বার বিভিন্ন পাঠক্রমে কাজ করবার পরে যখন তাকে ফ্রন্টে পাঠানো হল, তারো বেশ কিছু পরেকার কথা।

জার্মানির ছোট একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল তাকে ১৯৪৩ সালে। অবশেষে ১৯৪৪ সালে সে হাঙ্গেরির একটা ঘেটোতে যায় কম্যান্ডার হিসেবে। পরে রাশিয়ান বাহিনী এগিয়ে এসেছিল বলে, এই ঘেটো সম্পূর্ণ সরিয়ে ফাঁকা করবার দায়িত্ব ছিল তার উপরে। এখন উত্তরের এই ছোট ক্যাম্পের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। সমস্ত অর্ডার ঠিক ভাবে সম্পন্ন করাটাই তার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তবে কাজের মধ্যেও সব যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গীতপ্রতিভা আবিষ্কার করবার ঝোঁকটা তাকে পেয়ে বসেছিল। ইহুদীদের মধ্যে এই গুণটা তাকে বিস্মিত করেছিল। সে নবাগত বন্দিদের গানের অডিশন নিতে শুরু করেছিল। শূন্য থেকে দশ, এই ক্রমে গ্রেড দিত সে এই অডিশনে। খুব কম বন্দিরা শূন্য গ্রেড পেত। যারা পেত, তারা সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের গানের দলে ঢুকে যেত, এবং যারা দশে নেমে যেত, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দু’ দিনের বেশি ছিল না।

যখনই ক্যাম্প ফাঁকা করবার প্রয়োজন হত, সে এমনভাবে সেটা করত, যাতে কক্ষনো তার গানের দলে গায়ক গায়িকার কমতি না পড়ে। ভালো গায়ক গায়িকারা সব সময় তার দল আলো করে থাকত। যেকোনো প্রতিযোগিতা সে জিতে আসতে পারত এই দল নিয়ে। এই দলের জন্য সে গর্বিত ছিল। এমজিভি কনকর্ডিয়া কম্পানিতে থাকাকালীন যেমন খেটেখুটে দলটা তৈরি করেছিল সে, এবারও কম পরিশ্রম হয়নি তার। তবে এক্ষেত্রে শ্রোতা বলতে ছিল শুধু ক্যাম্পের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দিগণ এবং প্রহরীরা। তবে উপরমহলের অর্ডারের গুরুত্ব তার কাছে সঙ্গীতের চেয়েও বেশি। এদিকে সম্প্রতি তার উপরে অনেক অর্ডার ছিল। ফলে তার গানের দলটা ক্রমেই ছোট আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।

হাঙ্গেরির ঘেটো এবং ক্যাম্পগুলো সব ফাঁকা করে দিয়েছিল সে। এর আগে সে বড় ক্যাম্পে অনেকসময় পাঠিয়ে দিত ইহুদীদের। এদিকে এই ছোট ক্যাম্পে কোনো রেল যোগাযোগ নেই। ফলে সবাইকে এই ক্যাম্পেই মেরে দিয়ে ক্যাম্প ফাঁকা করতে হচ্ছে। তবে এখনও অনেক কম্যান্ডো আছে এই ক্যাম্পে। যারা ভালো গান গায়, এখনও কম্যান্ডোরা তাদের রক্ষা করে চলেছে। কারণ ফিলস্কাইট খুনোখুনি একদম পছন্দ করেনা। সে নিজে হাতে কোনোদিন কাউকে খুন করেনি, সেটা অবশ্য তার আফসোসের কারণ। সে পারে না। যদিও সে সব অর্ডার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। নিজে হাতে সব অর্ডার পালন করা জরুরি নয়। সেগুলো ঠিকঠাক পালন হল কি না, সেটা দেখলেই চলবে।

ফিলসকাইট জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে বিশাল সবুজ ফার্নিচার ভ্যানটা খোলা হবে এখনই। পেছনে আরও দুটো ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। একজন এসে সবুজ ভ্যানের চালকের কেবিনে উঠে গেল। ক্যাম্পের চিফ ব্লাউয়ের্ত আরও পাঁচজনকে নিয়ে এসেছেন ট্রাকগুলোর দরজাটা খুলবার জন্য। বিশাল সবুজ ট্রাকের পিছনের গদি আঁটা দরজাটা ধীরে ধীরে খোলা হল। ভেতরের মানুষগুলো আর্তনাদ করে উঠলো। হঠাৎ সূর্যের আলো এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তীব্র চিৎকার করছে মানুষগুলো। কেউ কেউ ছিটকে বেরিয়ে এল ভ্যানের বাইরে। ব্লাউয়ের্ত তাদের লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে। লাইনের শুরুতে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ কোট পরা কালোচুলের এক মহিলা। আধময়লা পোশাক। হয়তো কোটের ভিতরে পোশাক ছিঁড়ে গেছে, তাই উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে একহাতে কোটটার সামনের দিক আঁকড়ে আছে আব্রুরক্ষা করবার জন্য। আরেক হাতে ধরে আছে বারো তের বছরের একটা মেয়ের হাত। এই দুজনের সঙ্গে কোনো মালপত্র নেই।

যে মানুষগুলো বেরিয়ে এসেছে, তাদের নাম ডাকার জন্য খোলা মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিলসকাইট নিঃশব্দে তাদের গুণতে শুরু করল। নানা বয়সের, নানা চেহারার, নানা পোশাকের নারী, পুরুষ, শিশু মিলিয়ে মোট একষট্টি জন। সবাই বেরিয়ে আসেনি ওই ভ্যান থেকে। মনে হয় ছয় জন ভেতরেই মরে গিয়েছে। সবুজ ভ্যানটা ধীরে ধীরে গিয়ে শ্মশানের চুল্লিঘরের সামনে দাঁড়াল। ফিলসকাইট মাথা নাড়ল পরিতৃপ্তির সঙ্গে। সব কাজ ঘড়ির কাঁটার মত এগোচ্ছে। ছ’টা লাশ ভ্যান থেকে বের করে ব্যারাকের ভিতরে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। ট্রাক থেকে বের করা সব মালপত্র গেটে প্রহরীদের কেবিনের সামনে স্তুপ করে রাখা আছে। সবুজ ট্রাকের পেছনে যে আরও দুটো ট্রাক দাঁড়িয়েছিল, সেগুলোর দরজা খোলা হল। মানুষ, মালপত্র সব নামানো হতে লাগল।

মাঠের মধ্যে পাঁচটা সারিতে মানুষগুলোকে দাঁড় করানো হতে লাগল। সবগুলো সারি ভরে উঠছে, লম্বা হচ্ছে ক্রমাগত। ফিলসকাইট সারিগুলো গুণতে লাগল এবার। ঊনত্রিশ জন করে আছে একেকটা সারিতে।

ব্লাউয়ের্ত হাতে একটা মেগাফোন নিয়ে বলে যাচ্ছে।

-‘সবাই শুনবেন। আপনারা এখন একটা ট্রানজিট ক্যাম্পে আছেন। খুব কম সময় আপনারা এখানে থাকবেন। এক একজন করে আপনাদের নাম ডাকা হবে, ফাইলে এন্ট্রি হবে। তারপর আপনারা ক্যাম্প কম্যান্ডান্টের কাছে যাবেন। আপনাদের পরীক্ষা করা হবে। তারপর আপনাদের সবাইকে স্নান করতে হবে। মাথায় নোংরা, উকুন এসব পরিষ্কার করা হবে। তারপর আপনাদের গরম কফি দেওয়া হবে। কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হবে।’ ব্লাউয়ের্ত ইশারায় নজরমিনারগুলির দিকে দেখায়, যেখান থেকে এই মাঠের দিকে মেশিনগান তাক করা আছে। এছাড়া তার নিজের পিছনেও পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে, সবার হাতেই মেশিনগান।

ফিলসকাইট অস্থিরভাবে জানালার সামনে থেকে সরে আসে। সে বেশ কিছু ব্লন্‌ড ইহুদীদের দেখতে পেয়েছে। হ্যাঁ, হাঙ্গেরিতে প্রচুর সোনালি চুলের ইহুদী আছে। কালো চুলের ইহুদীগুলো তবু একরকম, কিন্তু ব্লন্‌ড ইহুদিদের দু চোখে দেখতে পারেনা ফিলসকাইট। তাছাড়া একদম নর্ডিক জাতের মত আর্যসুলভ চেহারার ইহুদীদের নমুনাও সে কম দেখেনি। সে সবুজ কোট পরা সেই প্রথম মহিলাকে নাম নথিভুক্ত করবার পরে ব্যারাকে তার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখল। সে তার হাতের কাছে পিস্তলটা সেফটি ক্যাচ খুলে গুছিয়ে রাখল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই মহিলা তার সামনে গান গাইবে।

ইলোনা গত দশ ঘণ্টা ধরে ভয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ভয় তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি। গত দশ ঘণ্টা ধরে অনেক কিছু দেখে যাচ্ছে সে, খিদে, তেষ্টা, বিরক্তি, আতঙ্ক, দমবন্ধ করা পরিস্থিতি ইত্যাদি। তারপর একটু আগে যখন সূর্যের আলো এসে চোখে ধাক্কা দিল, কয়েক মিনিট ধরে অদ্ভুত ভালো লাগা এসে তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল—কিন্তু ভয় আসেনি। সে একাই কি তবে ভয়ের জন্য বৃথা অপেক্ষা করছে?

গত দশ ঘণ্টা ধরে একটা ভীতিপ্রদ অবস্থার মধ্যে রয়েছে সে। বহুবার সে শুনেছে এরকম পরিস্থিতির কথা। সেই শোনা কথাগুলো আরও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। কিন্তু সে নিজে যখন এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে, তার আর ততখানি ভয় করছে না। তার একটাই ইচ্ছে আছে এখন। যদি সে কিছুক্ষণের জন্য একা থাকতে পারে, তাহলে সে একটু প্রার্থনা করবে। এতদিন অবধি তার জীবন ঠিকঠাক চলেছে। পরিকল্পনা মাফিক চলেছে। কিছু পরিকল্পনা ভুল হয়ে গেলেও জীবনে তার খেদ ছিল না কোনো। তবে সে ভেবেছিল যে সে রেহাই পেয়ে যাবে। ধরা পড়ে যাবে, ভাবেনি। এখন ধরা যখন পড়েই গেছে, তাহলে… আর… আর বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যেই সে মারা যাবে।
(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in

শেষ পর্ব

নটে গাছটি মুড়লো আপাতত

মূলত সম্পাদকের আগ্রহে আড়াই বছর আগে যখন এ ধারাবাহিক লেখা শুরু করি, কী লিখব, কেন লিখব এই দ্বন্দ্বে ব্যতিব্যস্ত ছিলাম। কারণ সত্যি কথা বলতে কি, আমি রান্নার জগতে কিছু কৌতূহল আর আবেগ সম্বল করে ঢুকে পড়েছিলাম কোনও এক সময়ে, এ কথা যত না সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য হল জীবিকা এবং ভ্রমণের হাত ধরে নিজের অজান্তেই কোনও এক অসতর্ক ক্ষণে প্রবেশ করেছিলাম এই আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীতে। ধীরে ধীরে আপন খেয়ালেই কলকাঠি নেড়ে নিয়ন্তা কেউ যেন আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন একের পর এক পর্দা। শুরু হয়েছিল অভূতপূর্ব এক যাত্রা। কথিত আছে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনে মানুষকে তা উপহার দিয়েছিলেন প্রমেথেউস। পড়েছিলেন দেবতা জিউসের রোষানলে। বিবর্তনের পথে মানুষ সেই আগুনকে ব্যবহার করতে শিখল ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়োজনে। জন্ম হল ‘রান্না’ শব্দটির। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আঞ্চলিক যাপন সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব ফুটে উঠতে লাগল পাকশালাগুলির খুঁটিনাটি চারিত্রিকতায়। ক্রমশ বিশেষ একটি সমাজ ও সময়কে বোঝার ক্ষেত্রে রান্নাবান্নার হাল – হকিকত হয়ে উঠল এক প্রধান নির্ণায়ক। বিষয়টি এখানেই থেমে রইল না। বিশ্বব্যাপী প্রাচীন রন্ধনশৈলীগুলি লাভ করল বিশেষ স্বীকৃতি ও মর্যাদা। তৈরি হল অসংখ্য স্কুল – যেখান থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর তরুণ রাঁধুনির দল ছড়িয়ে পড়তে লাগল সর্বত্র। সৃষ্টি হল একটি নির্দিষ্ট পেশার। যাকে আদর করে হসপিট্যালিটি ইন্ডাস্ট্রি কাছে টেনে নিল। কিন্তু আমার মতো একজন আনাড়ির এই ঘ্রাণে আকৃষ্ট হওয়ার কোনও আপাতগ্রাহ্য প্রেক্ষাপট না থাকলেও আমার মতো অজস্র মানুষের ক্ষেত্রে বারবার এমন ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। আমার মতোই প্রত্যেকে আপন আপন চশমার ভিতর দিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করেছে আলাদা আলাদা রান্নাঘরগুলির অন্দরমহলে। রচিত হয়েছে আলাদা আলাদা হেঁশেল যাত্রা। এই কিসসা শেষ হবার নয়। কিন্তু দীর্ঘ কোনও যাত্রাপথে যেমন প্রয়োজন হয় একটু বিরতির, খানিক জিরিয়ে নেওয়ার, হেঁশেল যাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখনকার মতো তাই জিরেন। মগজের কোষগুলি আবার ভরে উঠুক হরেক রকম অচেনা খুশবুতে, তখন না হয় আবার আলসেমির সঙ্গে আরম্ভ হবে নতুন লড়াই।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in






উৎসর্গ - সব প্রজন্মের অতীতচারণে আগ্রহীদের


(১)

রাজা রাজবল্লভ সেনকে বঙ্গালের মানুষ আজ ভুলতে বসেছে। যে সাম‍্রাজ‍্য একদিন গৌড়-বঙ্গের ইতিহাসকে দাপট ও কৃতিত্বের সাথে শাসন করে গেছে সে বংশের বংশধরকে এত অপমান কেন সইতে হবে? জন্মগত রাজনীতি বা কুলাচার নাহয় তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার জন্মদাত্রী তনয়ারানী তো কোন দোষ করেনি সেদিন। আজ তাকে দোষ দিতে গেলে দোষ দিতে হবে জীবতত্ত্বের সৃষ্টির সহায়ককারী সেই যৌবনকুসুমকেই। নইলে

রাজা রাজবল্লভ সেনের এক বংশজকে আজ এত অপমান সহ‍্য করতে হত কি।

এইসব ভাবতে ভাবতে গোলকপতি নদীর পাড় দিয়ে আনমনে হেঁটে আসছিল। এই বঙ্গাল দেশে নদী তো আর নিছক কম নেই। এই তো! ওদের গ্রামের পশ্চিমে বইছে পদ্মা নদী, আবার উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী নদী এমনকি দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে প্রখ‍্যাত আড়িয়াল খাল ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থল। আবার গ্রামের মোড়ল বা প্রবীণদেরকেউ কেউ বলে কালিগঙ্গা নদী নাকিও আগে এ অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে একেবারে প্রবাহিত হত।

সেসব কথার আজ আর ওর কাছে কোন দাম নেই। ওকে এখন এই মুলুক ছেড়ে পালাতে হবে এটাই যেন পূর্ব নির্ধারিত। তাই আজ ওর মন একদম ভাল নেই। ইদানীং তার সাথে চকমাণিকপুরের এক আড়তদারের সাথে বেশ ভাব হয়েছে। সে লোকটি ও আজকাল সর্ষেস। ভিন্ন তৈলবীজের পাইকারী ব‍্যবসায় বেশ কৃতী। এখন দেশে ইংরেজের শাসন পত্তনের সময় থেকেই বর্ধমান নামের এই দামোদরতীরস্থ জনপদের খুব বাড় -বাড়ন্ত। তাই সেখানেই তাকে আসতে লিখেছে।

অবশ‍্য অনেক আগে মোগল-পাঠানদের আমলে এই বর্ধমানের নাম লোকের মুখে মুখে ফিরত। তবে তা যতটা আদিগন্ত কৃষিক্ষেত্রের অপর্যাপ্ত ভান্ডারের জন‍্য আর ততটাই শের আফগানের সুন্দরী বৌ তথা পরে হিন্দুস্তানের সম্রাজ্ঞী নূরজাহান বা মেহেরুন্নিসার জন‍্য। জাহাঙ্গীরের আমলে সবাই এই অঞ্চলটিকে জাহানাবাদ সংলগ্ন তালুকের পরিচয়ে একডাকে চিনত।

যদিও অতকিছু জেনে তার আর কোন লাভ নেই। সে এখন ভাল করেই বুঝে গেছে যে তার ভগ্নপ্রায় চালা ঘরে বাবুদের লেঠেলরা আগুন লাগাতে আর বেশী দিন অপেক্ষা করবে না । তার সাথে সে এও বুঝে গেছে যে নিছক এক চাকরানীর গর্ভে সে উৎপন্ন হয়েছে সুবিখ‍্যাত সেন বংশের এক দূরাচারী ও লম্পট রাজপুরুষের নিছক খামখেয়ালের বশে।

যদিও রাজানুগ্রহে সেই গর্ভাধানের মূল‍্যের মাসোহারাটি মৃত‍‍্যুর দিন অবধি তার মাতা রাজকোষ থেকে পেয়ে এসেছে। তবে মাতার মৃত‍্যুর পরেও গোলকপতি সেই অর্থ বা রাজন‍্য কূলের বংশমর্যাদা চাওয়ার স্পর্ধা দেখালে সে জেনে গেছে তার অনন‍্য পুরষ্কার হবে জীবন্তদেহে রাজবন্দী অবস্থায় সৎ ভ্রাতৃবর্গ তথা বর্তমান রাজশক্তির হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে মরা।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in






ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য ও সিনেমা

নীচের তলায় একই মাপের কুড়িটা ঘর, প্রতি ঘরে পাঁচটা চৌকি। ইউশেপের স্ট্রাকচার। দুটো সমান্তরাল লাইনে দশ-দশটা করে, আর মাঝখানের জোড়া দুটোঘর বেশ বড়া মাপের, তাতে স্টোর আর মহারাজদের খাবার ঘর। সবশেষে ডাইনিং হল। আমাদের ঠাঁই হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উলটো দিকের শেষের ঘর কুড়ি নম্বরে আমাদের নতুন ওয়ার্ডেন বীরেশদা, থুড়ি ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য।

উনি সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। আমাদের বিশেষ ঘাঁটান না, নিজের পড়াশুনো এবং সকাল বিকেল প্রেয়ারের সময় দু’বার দু’পাক ঘুরে নিজের কর্তব্য সারেন। আমি ওনাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করি। আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ এবং ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ ওনার পরিচালনায় হয়েছিল।

লাইব্রেরির চার্জও উনি নিয়েছেন। আমি ওনার প্রশ্রয়ে সাঁটিয়ে আগাথা ক্রিস্টির বাংলা অনুবাদ পড়ছি, একবারে দুটো করে বই নিয়ে আসছি।

আহা, প্রথমবার ‘দশ পুতুল’, ‘একটি খুন হবে’ পড়ার আনন্দ আজও অমলিন। আবার অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে ঝাঁ-চকচকে নতুন বই এল—“শার্লক হোমস্‌ ফিরে এলেন”। উনিই বললেন—তোর জন্যে আলাদা করে সরিয়ে রেখেছি, নিয়ে যা। কিন্তু তিনদিনে ফেরত দিবি’।

কিন্তু উনি একটু খোনা, মানে নাকিসুরে কথা বলেন।

শীত আসছে, আমিও ব্যাক লগ সামলানোর চেষ্টা করছি। একবার বাবা এসে কড়া করে ওয়ার্নিং দিয়ে গেছেন। এমন খারাপ ফল হলে আমাকে দক্ষিণ ভারতের মিশনের কোন স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের গ্যাং অফ ফোরের সংক্ষিপ্ত বৈঠক দিনে দু’বার করে হয়—সকালে জল খাবারের ফাঁকে পনের মিনিট আর রাত্তিরে খাওয়ার পর আধ ঘন্টা।

আমরা এখন অনেক শান্ত, কোন ঝামেলায় যেতে চাই না। এ’বছর ভালভাবে পাশ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক, কিন্তু দিন কেটে যাচ্ছে। যা চাই তা কি হয়?

রবিবারে রবিবারে সন্ধ্যেয় প্রেয়ারের পর ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হয়।

ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্র, কখনও কখনও আমেরিকান লাইব্রেরি বা বৃটিশ কাউন্সিলের কিছু। বছরে সাকুল্যে চারটে ফিচার ফিল্ম – কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’, পাহাড়ি সান্যাল, বসন্ত চৌধুরি এবং সুচিত্রা সেনের ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ বা অজয় করের ‘ভুলি নাই’।

একবার টম সইয়ারের গল্প অবলম্বনে একটি বাংলা ফিল্ম, যাতে শম্ভু মিত্র হলেন ভিলেন অঘোর কামার; আর একবার অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে বহুরূপী নাট্যদলের দিকপালদের নিয়ে তৈরি ‘মানিক’ যাতে ফাগিন হলেন ফকিরচাঁদ (শম্ভু মিত্র) আর ন্যান্সি হলেন লিলি (তৃপ্তি মিত্র)।

কিন্তু ওই সিনেমাতে ফকিরচাঁদের গলায় একটি গান ছিল—

‘পাথরচাপা এই কপালে যা হল তা ভালই হল,

তোমার চোখে আমার সাগর শুকালো তো

বয়েই গেল’।

পুরনো এক বাড়িতে আটকে রাখা ছেলেগুলো ঘুমুচ্ছে। পাজামা ও আলখাল্লা পরা শম্ভু মিত্র মৃদু হাসির সঙ্গে গানটা গাইতে গাইতে করিডোর দিয়ে যাচ্ছেন আর ‘বয়েই গেল’ উচ্চারণের সঙ্গে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন।

অল্প আলোয় তাঁর ছায়া দেয়ালে সরে সরে যাচ্ছে। লিলি তৃপ্তি মিত্র শুধু তাকিয়ে দেখছেন ফকিরচাঁদের চলে যাওয়া।

ওই সিকোয়েন্স, অভিনয় আর গান আমার বুকে একটা অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি করে দেয়, মানুষের জন্ম-মৃত্যু-জীবন কেমন অর্থহীন মনে হয়। আজও মাঝে মাঝে ওই ক’টা লাইন আর শূন্যতার বোধ আমাকে কব্জা করে ফেলে।

কিন্তু ওইসব সিনেমাগুলো ছিল ব্যতিক্রম। বেশির ভাগ সময়েই বহুবার দেখা সরকারি তথ্যচিত্রগুলো, যেমন সিন্ধ্রির সারের কারখানা নিয়ে, আমাদের ক্লান্ত করত। ফলে সবাই একঘন্টা পরে ঢুলতে থাকত। অনেকে আগে থেকেই শতরঞ্চি বালিশ নিয়ে এসে মাটিতে পেতে বসে যেত। আলো জ্বলে উঠলে তাদের গভীর ঘুম থেকে টেনে তুলে দিলে ওরা কোনরকমে ঘরে গিয়ে যে যার বিছানায় ডাইভ মারত, খাওয়ার ঘন্টা বাজার আগে যতক্ষণ ঘুমোনো যায় আর কি!

এমনি এক রাতে আমিও নিজের বিছানায়, হঠাৎ চৌকি নড়ে উঠল, দুলতে দুলতে কাত হয়ে গেল! ভূমিকম্প! আমি গড়িয়ে মেজেতে পড়ে গেলাম। অমনই ঘরে লাইট জ্বলে উঠল আর হা-হা-হি-হি!

অবাক হয়ে দেখছি গুরু সুইচ বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করছে আর প্রশান্ত আমার চৌকির পায়ের কাছে, বিশু পাশের দিকে। হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।

--এটা কী হচ্ছে?

--অপারেশন আর্থ-কোয়েক!

গুরুর চটজলদি জবাব। প্রশান্ত বোঝাল, এখন ঘরে ঘরে কেউ না কেউ ঘুমুচ্ছে। ওরা গিয়ে একজন পায়ার কাছে আর অন্যজন চৌকির একপাশে দাঁড়ালে গুরু ওয়ান-টু-থ্রি বলে লাইট নেভাতেই ওরা চৌকিটা একটু কাত করে দিচ্ছে আর ঘুমন্ত ছেলেটি আতংকিত হয়ে হুড়মুড়িয়ে পপাত ধরণীতলে।

কিন্তু অন্ধকার ঘর থেকে তিনমূর্তি আগেই চম্পট দিয়েছে। ফলে মাটিতে পড়া ছেলেটি হতভম্ব হয়ে ভাবছে হলটা কী?

গুরু অমিয়দা আমার হাত ধরে টেনে তুলে বলল—চ’ , আমাদের অপারেশন মাত্র শুরু হয়েছে। এবার তুইও হাত লাগা, সুইচ বোর্ড থেকে শুরু কর। দেয়ার উইল বি লট অফ ফান।

আমাদের অপারেশন আর্থ কোয়েক এগিয়ে চলে। একের পর এক ঘর পেরিয়ে যাই। দু’একটা খালি, কোন একটাতে কেউ ঘুমোয় নি।

ধীরে ধীরে আমিও মজার স্বাদ পেতে শুরু করি। এবার কোণের দিকে একটা ঘর, মাত্র একজন সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আলোটা আগে থেকেই নিভিয়ে রাখা। অন্যেরা পজিশন নেয়।

ওয়ান-টু-থ্রি! খাটটা দোলাতেই কাপড়ে মোড়া সাদা শরীর মাটিতে হুড়মুড়িয়ে পড়ে।

আর নাকি সুরে একটা চিৎকার—ওঁরে বাঁবা, মঁরে গেঁলুম!

আমাদের আক্কেলগুড়ুম। এ যে ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্যের মানে বীরেশদার গলা! আরে তাই তো, এটাই তো বারান্দার শেষ ঘর, উনি একাই থাকেন। আমাদের ঝোঁকের মাথায় খেয়াল ছিল না।

দে ছুট! দে ছুট! খাবার ঘন্টা বাজছে।



--গুরু, কেলো হয়েছে। আজ আমরা খেতে যাব না।

--হাঁদারাম, না গেলেই তো চোখে পড়ে যাব। আমরা সবাই যে যার থালা নিয়ে অন্যদিনের মতই খেতে বসব।

ডাইনিং হলে ঢোকার সময় চোখে পড়ল ঢালা বারান্দার অন্য কোণে বীরেশদা কয়েকটি জুনিয়র ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন আর আঙুল তুলে বারান্দার অন্যদিকে কিছু দেখাচ্ছেন।

ভাবলাম, ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে। কিন্তু পরের দিন খবর পেলাম ক্লাস এইটের ছেলেগুলো আমাদের নামে চুকলি করেছে যে এটা নাটের গুরু অমিয়দার চ্যালাদের কীর্তি, ওদের মধ্যে কেউ দিব্যি গেলে বলল যে বীরেশদার ঘর থেকে দু’জনকে দৌড়ে পালাতে দেখেছে।

বাজে কথা! ওদের ঘর দোতলায়। ওখান থেকে অন্ধকারে এত সব দেখা যায় না। মিথ্যে করে দিব্যি গেলেছে তো? এবারও অ্যানুয়ালে ফেল করবে।

গুরুর ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি হল দলবেঁধে একসাথে থাকা। তাহলে বীরেশদা কাউকে কিছু বলতে পারবেন না, কিন্তু একা পেলে?

পরের দিন ভোরবেলায় বিপ্লব বলল যে প্রেয়ারে যাবে না, অনেক রাত অব্দি পড়েছে, থার্মোডায়নামিক্সকে ঘায়েল করে ফেলেছে। এবার একটু ঘুমুবে।

গুরু মাথা নাড়ল। কিন্তু বিপ্লবের এক কথা। বড্ড ঘুম পাচ্ছে; আরে কিস্যু হবে না। তোমরা মশারির তিনটে কোণা খুলে দাও। আমি ওই একটার পেছনে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে ঘুমিয়ে থাকব। বাইরে থেকে কেউ টের পাবে না।

একঘন্টা পরে আমরা প্রেয়ার হল থেকে ফিরে এসে দেখি যা তা ব্যাপার! বিপ্লব মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য এসে ওকে খালি হাতেই চড় থাপ্পড় এবং দমাদ্দম কিল মেরেছেন। মাটিতে পড়ার পর একখানা গোদা পায়ের লাথি!

মারের চিহ্ন ওর গালে হাতে দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে উঠেছে।

গুরুর এমার্জেন্সি মিটিং। আমি বাদ, কেননা আমি নাকি লাইব্রেরির বইয়ের সুবাদে বীরেশদার প্রতি একটু ‘সফট’ আছি। কিন্তু সবাই চায় হার্ড অপারেশন।

সাতটা দিন কেটে গেল মানে মানে। শীতটা জাঁকিয়ে পড়ছে। আমার খাটের জানলার পেছনেই কলতলা।

রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেল। কলতলায় কিছু একটা হচ্ছে, একটা আওয়াজ।

কী হতে পারে? শেয়াল তো আজকাল এদিকে নেই। তাহলে কুকুর? চোখ কচলে মশারির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম।

এই ঠান্ডায় একজন কেউ খালি গায়ে সাদা ধুতি পরে থুপথুপিয়ে কাপড় কাচছেন , বিছানার চাদর, মশারি, লেপের ওয়াড়।

পরের দিন খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। গতকাল রাতে কে বা কাহারা ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্যের মশারির উপর এবং বিছানায় কিছু নোংরা পূতিগন্ধময় জিনিস কাগজের ঠোঙায় মুড়িয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছে। আশা করা যায় আশ্রম বালকেরা এই দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সূচনা দিবে। খবর দিলে তাহার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হইবে।

না, কোন আশ্রম বালক এগিয়ে আসে নি। কিন্তু আমি গুরুকে বললাম—এটা কিন্তু লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেল।



ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ছায়া

ওই বছর ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে কাশ্মীরে পাকিস্তানের বিশাল সৈন্যবাহিনী আমেরিকার থেকে সদ্য পাওয়া স্যাবর জেট ফাইটার প্লেন ও প্যাটন ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ চালায়। ভারতের ছিল ন্যাট এবং ফ্রান্সের তৈরি মিরাজ। আমাদের নিজের তৈরি বৈজয়ন্ত ট্যাংক তখনও মাটিতে নামে নি।

সে’সব পরে জেনেছি। তখন আমরা লালপাহাড়ির দেশে রাঙামাটির দেশে মিশনের স্কুলের হোস্টেলে থেকে এতসব বুঝি নি। কিন্তু নামগুলো বাতাসে ঘুরে বেড়াত। আরও ছিল—গিরিপথ হাজি পীর পাসের লড়াই; ক্যাপ্টেন হামিদের বীরগাথা। একটি জীপ ও সাধারণ বন্দুক নিয়ে প্যাটন ট্যাংকের মোকাবিলা।

আমাদের হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হলঃ

পাক-দানবের রণহুংকারে কাঁপে ওই কাশ্মীর,

বীরের রক্তে পূণ্যতীর্থ গিরিপথ হাজি পীর,

জাগো মৃত্যুঞ্জয়ী বীর।

এইসব।

কিন্তু খড়গপুরের কাছে কলাইকুন্ডা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান হানা ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আলফ্রেড কুকের বীরত্বের পর আমাদের আশাপাশেও বিমানহানার সম্ভাবনা দেখা দিল। সন্ধ্যের পর সব জানলায় কালো কাগজ আড়াআড়ি করে সেঁটে দেওয়া, কামরায় ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগল।

এক সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ আরাত্রিক “খণ্ডন ভববন্ধন জগবন্দন বন্দি তোমায়” শ’দেড়েক ছেলের সমবেত গলায় পূর্ণোদ্যমে চলছে এমন সময় তার ফাঁকে শোনা গেল আশেপাশের বাড়ি থেকে তারস্বরে সমবেত চিৎকার—মহারাজ, আলো নেভান। বিমান হানার সাইরেন বাজছে যে!

ওরে বাবা! চটপট প্রেয়ার হলের আলো নিভে যায়। আমরা নির্দেশ মত মাটিতে কনুই এবং হাঁটু ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি। দত্ত রমেনকে সাবধান করে—বুক বা পেট যেন মাটিতে না লাগে, খবর্দার!

এতক্ষণ অ্যাটাকের কাটা কাটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু বোম পড়ার হুড়ুম দুড়ুম একবারও নয়। বেশ খানিকক্ষণ পরে বেজে উঠল টানা সাইরেন—অল ক্লিয়ার!

তার মানে হানাদার বিমানগুলো পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ওপারে পালিয়েছে, যাকগে বাবা। কিন্তু বোমা পড়ল কোথায়?

পরের দিন জানা গেল ওটা ছিল বিমানহানার সুরক্ষা মহড়া, কোন হানাদারি বিমান এ তল্লাটে আসে নি। আমার মাথায় একটা বেয়াড়া ছড়ার লাইন কোত্থেকে এসে বোলতার মত ঘুরঘুর করছেঃ

খেঁদুবাবুর এঁদোপুকুর মাছ উঠেছে ভেসে,

পদ্মমণি চচ্চড়িতে লংকা দিল ঠেসে।।

কিন্তু এখন তো শীত এসেছে। যুদ্ধ থেমে গেছল দুর্গাপুজোর আগে। আমি বুঝতে পারছি আমার আর এখানে থাকা চলবে না। আমি বিপ্লবকে কড়কে দিয়ে ওর আর আমার মধ্যে একটা অদৃশ্য লক্ষণ রেখা টেনে দিয়েছি। সেটা সবাই খেয়াল করেছে।

প্রশান্ত বিশু এরা জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু আমি বলে দিয়েছি যে এটা পার্সোনাল ম্যাটার, এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে চাই না। গ্রুপের মধ্যেও কি একা হয়ে যাচ্ছি? গুরু অমিয়দা ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য থুড়ি বীরেশদার অপারেশনটায় আমাকে বাদ দিয়ে করল।

আমিও কিছুদিন আগে অপারেশন ব্যানানা অর্থাৎ পাইথাগোরাস থিওরেম গ্রুপের কাউকে না জানিয়ে জুনিয়র ছেলে প্রেমাংশুকে নিয়ে করেছি। পরে সবাই পিঠে চাপড়ে দিল, গুরু হাসল, কিন্তু ওর চোখ হাসে নি।

কিন্তু কোথাও কি কিছু ভুল করলাম? মনে একটুও শান্তি নেই কেন? ফের কিছু একটা করতে হবে। ক্লাসের ডে-স্কলার ছেলে দেবতোষ, বলল একটা নতুন হাসির সিনেমা এসেছে, মালঞ্চ হলে। বেশ মজার নাম—পতি সংশোধনী সমিতি। মঞ্জু দে, সাবিত্রী আরও কে কে যেন আছেন।

হঠাৎ টিউবলাইট জ্বলে উঠল।

--শোন দেবু, কালকে দুটো টিকিট কেটে এনে দিবি, সামনের লাইনের? কোন শো? উম্‌ম্‌, পরশু ম্যাটিনি, দুটোর শো। এই নে পয়সা।

স্কুলের টিফিনের সময় আমি আর প্রেমাংশু ডে-স্কলারদের ভিড়ের মধ্যে মিশে সোজা গেটের বাইরে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি বেশ স্পীডে, হাওয়াই চটির চটাস চটাস শব্দ। আমাদের চোখ রাস্তার দিকে।

মালঞ্চ হলটা আশ্রমের গেটের থেকে অন্ততঃ দেড় কিলোমিটার দূরে। যখন হলে অন্ধকারে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে সীটে গিয়ে বসলাম তখন সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছে। মহিলাদের এক গোপন সভায় মঞ্জু দে শপাং শপাং করে পতিদেবতাদের চাবকানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

সিনেমার অপারেশন সাকসেসফুল । সন্ধ্যের মুখে ফুটবল খেলে ফেরা ডে-স্কলারদের দলের ফাঁকে আমরা দু’জন আশ্রমের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলাম।

প্রেমাংশু উত্তেজিত।

--প্রদ্যুম্নদা, আশ্রম ছেড়ে যাবার আগে আরেকটা অপারেশন সিনেমা করতে হবে।

--মানে? তুইও এখান থেকে চলে যাবার কথা ভাবছিস?

--হ্যাঁ, বাড়িতে কথা বলেছি। বাবা এখন আসানসোল স্টিলে বড় পোস্টে রয়েছেন। আমার রেজাল্ট খারাপ নয়। ওখানকার পুরনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়ে টেন- ইলেভেনের পালা শেষ করব।

--তারপর কলেজ?

--হ্যাঁ, কলেজ। অনেক ফ্রীডম।

আমি ফোড়ন কাটি—অনেক ফ্রীডম, অনেক মেয়ে। কো-এড কলেজে পড়বি তো? নইলে গার্লস কলেজের গেটের আশেপাশে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ানোই সার হবে।

প্রেমাংশু লজ্জা পায়। তারপর হেসে ফেলে।

--ঠিক বলেছ। কো-এড কলেজ, অনেক মেয়ে, প্রজাপতির ঝাঁকের মত। জান, আমাদের কোয়ার্টার বেশ বড়। চমৎকার বাগান, মালি আছে। অনেক ফুল আর প্রজাপতি। খুব সুন্দর।

পরের দিন রোববারে হালুয়া মুড়ির জলখাবার খেয়ে আমরা তৈরি হচ্ছি চানের আগের লিমিটেড ওভার ক্রিকেট খেলার জন্যে, অবশ্যই টেনিস বলে। পার্কসার্কাস পাড়ায় পিচের রাস্তায় ইঁটের উইকেটে রবারের বলে খেলার সময় দু’একবার কারও বাড়ির দোতলার কাঁচ ভেঙেছে বটে, কিন্তু এখানে সব কাঠের দরজা জানলা, কাজেই আমরা অকুতোভয়।

কী করে যেন আমি আর বিপ্লব দুই প্রতিদ্বন্দ্বী টিমে। ওদের ক্যাপ্টেন প্রশান্ত, আমাদের রমেন। গুরু মহা আলসে, ও স্নানে যাওয়ার গামছা কাঁধে ফেলে আম্পায়ারিং করবে।

কিন্তু মুশকিল হল ফিল্ড সাজাতে গিয়ে, আমাদের একজন প্লেয়ার কম পড়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি প্রেমাংশু বারান্দা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।

বললাম ওকে ডেকে নে।

কিন্তু রমেন বলল ও তো অনেক জুনিয়র! আমার যুক্তি তাতে কি, ও অফ স্পিন ভালো করে, টেনিস বলও।

রমেন নিমরাজি হল।

কিন্তু ওদিক থেকে একটা অশ্লীল মন্তব্য উড়ে এল।

--অফ স্পিন কেন, লেগস্পিনও করাতে পারে। টেনিস কেন সবরকম বলও ঘোরাতে পারে।

কথাটা কে বলল? বিপ্লব!

মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এগিয়ে গেলাম ব্যাটিং টিমের দিকে।

--কী ব্যাপার!

বিপ্লব দু’পা পেছনে সরে গেল। প্রশান্ত এগিয়ে এসে আমাদের মাঝখানে দাঁড়াল।

-ছেড়ে দে, এসব খেলার মাঠের উড়ো কথা, তোকে তো বলা হয় নি, পার্সোনালি নিচ্ছিস কেন?

আমি থেমে যাই, তারপর পেছন ফিরে পিচের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি এমন সময় আবার শোনা গেল—আরে দু’জনে মিলে ক্লাস কেটে পতি-পত্নী সংশোধন না কি যেন একটা সিনেমা দেখতে গেছল। এখন পতিকে তো পত্নীর পক্ষ নিতেই হবে।

হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা!

এবার বিপ্লবও দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার মুখোমুখি। চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে থুতনি একটু উঁচুতে তুলে।

--কী করবি তুই? সত্যি কথা শুনলে গায়ে বিছুটি লাগে?

গুরু দৌড়ে এসে আমাকে পেছনে থেকে জাপটে ধরে পেছনে টানতে থাকে। আমি সরে যাবার আগে পা বাড়িয়ে বিপ্লবের দু’পায়ের মাঝখানে একটা লাথি কষাই।

একটা ওঁক শব্দ করে বিপ্লব মাটিতে বসে পড়ে। সবাই মিলে ওকে টেনে তোলে, ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। ও একবার ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে। কিছু বলে না, তারপর প্রশান্ত’র কাঁধে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে যায়।

গুরু, বিশু, রমেন আমাকে ঘিরে ধরে।

--এটা কী করলি পোদো? তোর আর বিপ্লবের মধ্যে কী হয়েছে আমরা জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু ওকে এভাবে মারলি? কেন?

আমি কোন কথা বলি না। আমার চোখে ভাসছে—বিপ্লবের যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ, চোখে জল। আর ওর দৃষ্টিতে রাগ-দ্বেষের বদলে যেন অবাক হওয়া বোবাদৃষ্টি।

0 comments: