0

সম্পাদকীয়

Posted in



































এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়...

সত্যি বর্ষা এলো এবার যথাসময়ে আমাদের রাজ্যে। কিন্তু এলো যখন, লকডাউনের কবলে আমরা। যদিও কিছুটা শিথিল তার নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া উপায়ও তো কিছু ছিল না। একমাস এই সংযম পালনের পর সংক্রমণের হার অনেকটাই নিম্নমুখী। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান, ব্যবসার গতিপ্রকৃতি? তার রেখাচিত্র? তাও কি অধোমুখী নয়? জনগণের স্বাস্থ্য আর উপার্জন এই দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে সুনিশ্চিত রাখাই সরকারের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই সময়ের মধ্যেই আমরা হারিয়েছি প্রিয় চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং ভারতের একজন সর্বকালীন সেরা ক্রীড়াবিদ মিলখা সিং-কে। 

তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।

সুস্থ থাকুন। সচেতন থাকুন। শুভেচ্ছা নিরন্তর। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অচিন্ত্য নন্দী

Posted in

 




















চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ষাটের দশকের কবি। ১৯৮০ সালের ১৯ জানুয়ারী তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সত্তর দশকের কবি ও চলচ্চিত্র সমালোচক অচিন্ত্য নন্দী। দুই দশকের এই দুই কবির কথপোকথনে বারবার ঘেন কবিতা ও চলচ্চিত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে । সেই সময়ের ভারতবর্ষের আর্থ সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কেমন ছিলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের অবস্থান? সে বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে ধরা আছে এই সাক্ষাৎকারে।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। আপনি চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে নিয়ে কাজ করছেন। খত্বিক
ঘটক যেমন বলেছিলেন যে,উনি যে কোনওভাবে মানুষের গরিষ্ঠাংশের কাছে পৌঁছাতে চান। তার মতে নিছক সিনেমা মাধ্যমটির প্রতি মমত্ববোধ কোনও কাজের কথা নয়। যদি কোনও মাধ্যমকে নিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে যাওয়া যেত, তাহলে তিনি সেই মাধ্যমকেই গ্রহণ করতেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটা একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। খত্বিক ঘটকের এই রকম মনে হয়েছিলো। এটা ওনার ব্যাপার। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, কবিতার পর এই চলচ্চিত্র মাধ্যমটির প্রতিই আমার মমত্ববোধ জন্মেছে। এখন পর্যন্ত এই মাধ্যমটিই পারে অধিকাংশ মানুষের কাছে যেতে। এ ব্যাপারে এর চেয়ে কার্যকরী মাধ্যমের আবিষ্কার হলে তার ওপর আমার মমত্ববোধ দানা বাঁধবে কিনা সেটা পরের ব্যাপার। নাও বাঁধতে পারে।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘দূরত্ব’ ও ‘নিম অন্নপূর্ণা’র আগে আপনি কয়েকটি ডকুমেন্টারি তুলেছেন। এই ছবিগুলি সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার তৈরি ডকুমেন্টারির মধ্যে ‘ক্ষিরোদ নট্ট’ ও ‘কন্টিনেন্ট অব লাভ’ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। এছাড়া অন্যগুলোর সম্বন্ধে বলার কিছু নেই। আমার নিজেরই ভালো লাগে না।

অচিন্ত্য নন্দী: পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করতে গিয়ে এই ডকুমেন্টারি তৈরির অভিজ্ঞতাকে কতখানি কাজে লাগাতে পেরেছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ডকুমেন্টারি করতে গিয়ে অনেক সময়ই সবকিছু সঠিকভাবে ভেবে-চিন্তে সুটিং করতে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না; অনেক ক্ষেত্রে উচিতও নয়। তখন Spot decision নিতে হয় । এই ধরণের অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে বড়ো ছবির ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কাজে লাগে।

অচিন্ত্য নন্দী: আমাদের দেশে ডকুমেন্টারি তৈরির সমস্যা সম্বন্ধে বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ডকুমেন্টারির জন্য পৃথক কোনও দর্শকসমাজ আমাদের দেশে নেই। সরকার অথবা কোনও বেসরকারী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধরণের ছবিগুলি তোলা হয়। ফলতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো হয় Propaganda ছবি | ‘Hours of furnace’-এর মতো ডকুমেন্টারি এদেশে হয় না। এই ধরণের বাধাবন্ধকতার মধ্যেও সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, শান্তি চৌধুরী, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবত্তী-রা ডকুমেন্টারি করেছেন। ইদানিংকালে দেখা গৌতম ঘোষে’র ‘Hungry Autumn’ ও উৎপলেন্দু’র ‘মুক্তি চাই’ আমার ভালো লেগেছে। এই ধরণের ছবি ডকুমেন্টারির জগতে নতুন দিগন্ত।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনি ‘দূরত্ব’ ছবিটির জন্য Film Forum-এর ‘দাদাসাহেব ফাল্‌কে’ পুরষ্কার পেয়েছেন। ‘দূরত্ব’ আঞ্চলিক ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এই একটি ছবি করেই আপনি চলচ্চিত্র সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছেন। সাধারণ দর্শকদের মধ্যে স্বভাবতঃই ছবিটি সম্বন্ধে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে। তবু ছবিটি রিলিজ চেন পাচ্ছে না কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ‘দূরত্ব’র রিলিজ চেন না পাওয়াটা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। অনেক ছবির ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যা দেখা দিয়েছে বা দিচ্ছে। যতদিন না প্যারালাল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যায় ততদিন পর্যন্ত এই প্রতিবন্ধকতা থেকেই যাবে । এ নিয়ে তো বিস্তর আলোচনা, লেখালেখি, পরিকল্পনা হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘দূরত্বে’র পর আপনি ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি সম্পূর্ণ করেছেন। কমলকুমার মজুমদারে’র ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পটির যে মুড তা কি ছবিতে অক্ষুণ্ন রাখায় অনুপ্রাণিত ছিলেন, অথবা অন্যরকম কিছু ভেবেছিলেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কমলকুমার তার গদ্যে ভাষার বাঁধুনি ও শব্দের কাজ দিয়ে একটা অদ্ভূত এফেক্ট সৃষ্টি করেন। এটা এমনই একটা ব্যাপার যে ফিল্ম অথবা অন্য কোনও ভাষায় এর অনুবাদ হয় না। তাছাড়া একটি বিশেষ লেখাকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করতে গিয়ে পরিচালকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য ও ব্যাখ্যা

এসেই যায়। ফলে মূল কাহিনীর বিস্তার অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায়। নতুন চরিত্র, নতুন সংলাপ, কাহিনীর নতুন মোড় আসে। এসব হয়, কেননা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ সত্যজিৎ রায়ের হাতে ‘চারুলতা’ হয়ে যায়। তাছাড়া, কমলকুমার করতে গিয়ে আরও নতুন কিছু বিষয় এসেই পড়ে। মনে করুন, ‘নিম অন্নপূর্ণা’র যেখানে লতির হাতে পাখিটা কামড়ে দেয়, সেখানে কমলকুমার লিখছেন, ‘... এই বাড়িখানি যেন বা ‘শ্রীমধুসূদন’ বলে উঠেছিলো।’ ফিল্মে ঠিক এইভাবে বলা যায় না। অথচ কমলকুমারের কিছু অন্ধ ভক্ত, অন্ধের ভক্তি অনেক সময়ই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি দেখে একটা ‘গেলো গেলো’ রব তুলেছেন।

অচিন্ত্য নন্দী: কী কী কারণে আপনার দ্বিতীয় ছবির জন্য কমলকুমার মজুমদারে’র ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পটিকে বেছে নিয়েছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কমলকুমারের কাহিনী দুর্ভিক্ষের সময়কার। আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি সেখানে হয়তো আক্ষরিক অর্থে দুর্ভিক্ষ নেই। কিন্তু একটা চাপা দুর্ভিক্ষ সমস্ত Third World জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঔপনিবেশিক কাঠামোর অন্তর্গত এই সমস্ত দেশে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে শহরকে সাজানো হয়েছে। কলকাতা, বম্বে অথবা ইস্তাম্বুলে সেই একই চিত্র। গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মানুষ প্রতিদিন শহরে আসছে দু’মুঠো অন্নের সংস্থানের জন্য। হয়তো কলকারখানায় কাজ নিচ্ছে। কাজ চলে গেলে বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্তের শেষ ‘Identity’-কে বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এরা কারা? এরা তো প্রলেতারিয়েত নয়। এদের কি Peasant বা Worker বলতে পারেন? এরা একটা সম্পূর্ণ নতুন Class. এদেরকে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করেছি, ভেবেছি। কমলকুমারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় এদেরকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়ার পর ছবি করার ব্যাপারটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি একই সঙ্গে আমাদের দুঃসময়ের ডকুমেন্টারি এবং আদ্যন্ত বিষাদময় একটি নিটোল কবিতা। এর মধ্যে চায়ের দোকানের ছেলেটির চটুল হাবভাব এবং হালকা গান গাওয়ার ব্যাপারটা ঢোকানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আপনি যদি ‘Poetic’, বলতে যা বোঝায়, ছবিটিকে তাই বলতে চান, তাহলে আমার আপত্তি আছে। ছবিটি আদৌ তা নয়।

অচিন্ত্য নন্দী: আমি কবিতার কথা বলেছি। কবিতা শুধুমাত্র কাব্যিক মেজাজের অভিব্যক্তি নয়। কবিতা রাগ, হতাশা, অথবা বিষাদময়তার অভিব্যক্তিও হতে পারে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ঐ চায়ের দোকানের ছেলেটি সম্পর্কে বলছি, শহরে মফঃস্বলে চায়ের দোকানগুলিতে এই ধরণের ছেলেদের কাজ করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রায়ই একটা Homo-Sexual relation থাকে। এরা একই সঙ্গে চাটুকার এবং অন্য সব কিছু৷ এদের আচার-আচরণে একটা উদ্বৃত্ত উচ্ছ্বাস সবসময় লক্ষ্য করা যায়, যাকে আপনি ‘চটুল হাবভাব’ বলতে চেয়েছেন। এদের দেখলে মনে হয় কোনও অতীত নেই, স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ তো দূরস্থান। ব্যাপারটার একটা বিশ্বাস্য চিত্ররূপ দিতে চেয়েছিলাম ছেলেটির মাধ্যমে। তবে আপনার মনে হতেই পারে যে এটা ছবিটির মূল সুরের সাথে খাপ খায়নি। সেক্ষেত্রে এটা ছবির একটা ক্রটি।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনার ছবিতে বেশ কয়েকবার বৈদ্যুতিক ট্রেনের সশব্দ চলে যাওয়া দেখানো হয়েছে। কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কলকাতার বস্তিগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে হয় গঙ্গার ধারে অথবা রেল লাইনের পাশে। আমি দুটোকেই নিয়েছি।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনার ছবিতে বারবার বৈদ্যুতিক ট্রেনের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে, যন্ত্র সভ্যতার এই প্রতিভু ভেঙেপড়া সমাজ কাঠামোর ওপর একটা ধাতব আঘাত হানছে। দীর্ঘ অনাহারে ব্রুজ’র ছোট্ট সংসারটি এমনিতেই নড়বড়ে। বৈদ্যুতিক ট্রেনের এই সশব্দ যাওয়া আসা তাকে যেন খান্‌ খান্‌ করে ভেঙে দেবে। এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে মানবিকতার প্রশ্ন তোলা হাস্যকর। ট্রেনের এত ব্যবহার বারবার মস্তিষ্কে আঘাত করে। বেঁচে থাকা নিয়ে ভীষণ অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ব্যাপারটা আপনাকে ঠিক ঠিক Communicate করেছে। ট্রেনের আলো, শব্দ এবং আনুষঙ্গিক অন্য সবকিছুর Treatment দিয়ে এই ধরনের একটা এফেক্ট যাতে দর্শকমনে গড়ে ওঠে তার চেষ্টা করেছি।

অচিন্ত্য নন্দী : ‘নিম অন্নপূর্ণা’র একটি দৃশ্যে দেখি, ব্রজ বাড়ি ফিরে স্ত্রী গ্রীতিলতাকে বলে একটা আত্মহত্যার ঘটনা। লোকটির আত্মহত্যার আগের মুহূর্তে ব্রজ তাকে দেখেছে। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে চমকে গিয়েছে। তার মনে হয়েছে, লোকটি হুবহু তার মতো দেখতে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অস্পষ্ট থেকে গেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এর আগের কয়েকটি দৃশ্য মনে করুন। অন্য কোনও উপায় না দেখে ব্রজ চাকরির জন্য একটা ফ্যাক্টরির মালিকের প্রলোভনে সাড়া দেয়। সেই ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘট চলছিলো। ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে এলে ধর্মঘটী শ্রমিকরা ব্রজকে নির্মমভাবে পেটায়। ঘরে ফেরার পথে রেল ব্রীজের ওপর থেকে ব্রজ লোকটিকে আত্মহত্যা করতে দেখে। মানুষের মনের মধ্যে দু’রকম Crisis কাজ করে। (১) Inner crisis, (২) Financial এবং বেঁচে থাকতে চেয়ে অন্যান্য Support না পাওয়ার জন্য Crisis. এখন Inner crisis-এর শিকার হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তরা। ব্রজর ক্ষেত্রে Crisisটি ছিতীয়। ওর এই মানসিক অবস্থা একটা Supreme tension-এর রূপ নেয় ফ্যাক্টরিতে মার খাওয়ার পর। এই ধরনের tension-এ যে কোনও মানুষের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হতে পারে। ব্রজরও হয়েছিলো। তবে আত্মহত্যা করার মতো মানসিক জোর ব্রজর ছিলো না। সে রাস্তায় দেখা Suicide Case-টিতে নিজেকে Identify করে। তবে সচেতনভাবে একটা আত্মহত্যার ঘটনার সাথে নিজেকে একাত্ম করে দেখার শহুরে মানসিকতা ব্রজর নেই। সে যখন ঘটনাটা গ্রীতিলতাকে বলে তখন তার অবচেতন মন কাজ করে।

অচিন্ত্য নন্দী: ছবিটিতে যে কটি সংলাপ আছে তা প্রায় কবিতার পংক্তির মতো মোক্ষম। একজন কবি হিসেবে এ ব্যাপারে কোনও বিশেষ চিন্তা-ভাবনা কাজ করে থাকলে বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমরা যে ধরণের কবিতা লিখি বা পড়ি তাতে অনেক সময় মনে হতে পারে যে কবিতার দুটো লাইনের মাঝখানে একটা লাইন থাকা উচিত ছিলো কিন্তু নেই৷ এই জায়গায় পাঠককে যেন তার মননশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই জায়গায় কবিতার সাথে আধুনিক চলচ্চিত্রের একটা মিল খুঁজে পাই। চলচ্চিত্রেও দৃশ্যগুলিকে এডিটিং-এর সাহায্যে কবিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সংলাপের ক্ষেত্রেও তাই। অনেকগুলো কথা বলার আছে। ঠিক পরিবেশ যাচাই করে যদি দু’একটা সংলাপই শুধু থাকে, তাহলে অনেক কথাই বলা হয়ে যায়।

অচিন্ত্য নন্দী: আলোচ্য ছবিটিতে সংলাপের সংখ্যা এত কম যে, রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফূট করা উচিত যা কোনও কাব্যের সাহায্য ব্যতিত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে।” আপনি কি এই ধরণের চিন্তা পোষণ করেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : নিশ্চয়ই নয়। আমি রবীন্দ্রনাথের উক্তির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। এখন After all ফিল্ম একটা Audio-Visual Media এখানে সংলাপের বিরাট ভূমিকা আছে। একটার পর একটা নৈসর্গিক এবং অন্যান্য দৃশ্য তুলে ফেললেই সেটা সিনেমা হয়ে যায় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ছবিতে কম সংলাপ ব্যবহারের পক্ষপাতী। সাদামাটা বাংলা ছবিতে সংলাপের অহেতুক ব্যবহার আমাকে পীড়া দেয়।

অচিন্ত্য নন্দী : ছবির প্রায় শেষ পর্যায়ের একটি দৃশ্যের নির্মমতা খত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র (যেখানে ভাই মাতাল অবস্থায় বোনের ঘরে খদ্দের হয়ে এসেছে।) পর আর কোনও ভারতীয় ছবিতে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। অবক্ষয়ের এত চরম Exposure মানুষকে কভাবে Positive চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখুন, সব ছবিই যে দর্শককে প্রত্যক্ষভাবে Positive ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে এমন নয়। পন্টিকার্ভো’র একটি ছবি ‘কুইমাদা’। ছবিটা একটা খুন দিয়ে শুরু আবার আরেকটা খুন দিয়ে শেষ। কিন্ত অসম্ভব Inspire করে। অনেক সময় ছবিতে Negative বক্তব্যকে সামনে রেখেও আড়ালে সময় ও পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে দর্শককে সচেতন করে তোলা হয়। ‘নিম অন্নপূর্ণা’র ক্ষেত্র আলাদা। ব্রজর দ্বারা বিপ্লব সম্ভব নয়। সেখানে Reality-কে নির্মমভাবে দেখানো ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। দর্শক Reality-কে জেনে Conscious হোক। আপনি যে চরম Exposure-এর কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে বলি, এক্ষেত্রে এভাবে না দেখালে দর্শককে অবস্থার গুরুত্ব বোঝানো যায় না । আমরা, দর্শকরা ছবি দেখে Moved হই, হল থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরাই, রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম, সকালে উঠে ট্রাম, বাস বা ট্রেনের পেছনে বা গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে যেতে যেতে ভুলে যাই সব। ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ঠিক এভাবে দেখার ছবি নয়। অনেক দর্শক আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা ছবিটি দেখে বাড়ি ফিরে ভাত মুখে তুলতে পারেননি। আমার মনে হয়েছে এখানেই ছবিটা Successful৷ আমি জানি এ ছবি দেখতে দেখতে কোনও কোনও দর্শকের খুব খারাপ লাগবে। সে হল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইবে। একই সঙ্গে ছবিটা তাঁকে টেনে ধরেও রাখবে। হলের বাইরে যে-জগৎ সেটাও তো অনেকটাই ‘নিম অন্নপূর্ণা’র জগৎ।

অচিন্ত্য নন্দী : বাংলা ছবির অধিকাংশ দর্শকই এখনও দর্শক হিসেবে অপরিণত। এদেরকে চলচ্চিত্র সম্বন্ধে শিক্ষিত করে তোলায় একজন চলচ্চিত্রকারের দায়িত্ব কতখানি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দর্শকদের অপরিণত মনে করাটা খুব অযৌক্তিক। ভালো ছবি তাঁরা সারা বছরে কটা দেখতে পারেন? অধিকাংশ সিনেমা হাউসগুলোতে দেখানো হয় ‘সমাধান’ অথবা ‘মূকদ্দার কি সিকন্দারে’র মতো ছবি। বাস্তবিক, এই ধরনের ছবি দেখেই দর্শককে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর এঁদেরকে ভালো ছবির দিকে আকৃষ্ট করার জন্য সংখ্যায় অনেক অনেক ভালো ছবির দরকার আছে। ভালো ছবি বলতে আমি বলছি না যে শুধুমাত্র Intellectual-দের উপযোগী ছবিই করতে হবে। শিল্পগুণ সম্পন্ন Commercial ছবি করা যেতে পারে। একটা ফিল্ম তৈরি করতে অনেক টাকার দরকার। দর্শককে আকৃষ্ট করার মতো গুণ থাকা যেমন প্রয়োজন, যাতে টাকা উঠে এসে তার বাড়তি, যিনি টাকা দেন তার মুখে মুচকি হাসি ফোটায়, আবার ছবিটি শিল্পগুণ সম্পন্ন হওয়াও আবশ্যিক।

অচিন্ত্য নন্দী: দর্শন তৈরির দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তায়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : প্রধানত দর্শক, চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক এবং ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের ওপর এবং ক্ষমতায় থাকা সচেতন সরকারের ওপরও।

অচিন্ত্য নন্দী: ফিল্ম সোস্যাইটিগুলি কীভাবে এব্যাপারে সহায়তা করতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দক্ষিণ ভারতে দেখেছি অনেক ফিল্ম সোসাইটি তাদের বরাদ্দ ছবি নিজেরা না দেখে গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের দেখায়। এভাবে দর্শক তৈরী করার ব্যাপারটি অভিনব হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা । তাছাড়া একজন ফিল্ম সোসাইটির সদস্যর দায়িত্ব হলো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে আরও অনেক দর্শককে ভালো ছবির সন্বন্ধে সচেতন করে তোলা।

অচিন্ত্য নন্দী: আর সরকারের দায়িত্ব?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এত টাকার লগ্নি যে-শিল্পে, সেখানে সরকারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রগতিশীল সরকার চলচ্চিত্র মাধ্যমের সহায়তায় জনসাধারণের মধ্যে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া তৈরী করে যেতে পারেন। বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টি করে যত সহজে একটা সরকারকে উচ্ছেদ করা যেতে পারে, ঠিক তত অনায়াসে মানুষের মন থেকে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা মুছে দেওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে চিলির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সাধারণ মানুষকে রাজনীতি সচেতন করতে চেয়ে লেনিন চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি আইজেনস্টাইন, দোভজেঙ্কো ও পুদোভকিন নামে তিনজন যুবককে এই কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এবং এই তিনজনকেই আজকের পৃথিবী চেনে। ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটা প্রদেশে, যেমন মহারাষ্ট্র কি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে সরকারের ভূমিকা খুব প্রশংসনীয়। এইসব রাজ্যে সরকার উদার হস্তে টাকা দিচ্ছেন ভালো ছবি করার জন্য। এইসব ছবির মধ্যে বেশ কয়েকটি ভালো পয়সা ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকারকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেক্ষাগৃহ তৈরী হচ্ছে নতুন ভাবনার ছবির জন্য। দর্শক এগিয়ে আসছেন। এভাবেই হয়।

অচিন্ত্য নন্দী: সম্প্রতি কলকাতায় একটি ফিল্ম ক্লাবের (সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা) ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ ভারতের কিছু ছবি দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছিলো। এর মধ্যে ছিলো, ‘সংস্কারা’ ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’ ও ‘কোডিয়াট্টমে’র মতো ছবি। এদিকে যে সমস্ত বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে তার মধ্যে ভালো ছবি নেই বললেই চলে। বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবময় ধারাটি কি এখন দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রকাররা বহন করছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : লক্ষ্য করুন, বাংলা চলচ্চিত্র যে ক'জন পরিচালককে নিয়ে গর্ব করতে পারে, যেমন সত্যজিৎ, ঋত্বিক অথবা মৃণাল, তারা কেউ কিন্তু কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতি নন। এঁরা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ছবি করেছেন। চলচ্চিত্র আন্দোলন বলতে আমরা যা বুঝি, তা কোনওদিনও এদেশে দানা বাঁধেনি। বাংলা ছবির বর্তমান দীন অবস্থা তারই পরিণতি৷ পক্ষান্তরে দক্ষিণ ভারতের ফিল্ম সোস্যাইটিগুলি ভালো কাজ করছে। এবং ওখানকার সরকার ছবির মানোন্নয়নের জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করছে। এইটুকু বলা যায়। সেখানে যে-সব ছবি হচ্ছে তার সবই যে খুব উন্নতমানের, তা নয়। ভালো ছবির ভানসর্বস্ব অনেক বাজে ছবিও হচ্ছে। এখনই ওদের সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি না। তবে ওরা অনেক লোককে এ ব্যাপারে জড়িয়ে নিয়েছে। ওখানে সমবায় পদ্ধতিতে অথবা ফিল্ম সোস্যাইটির পৃষ্ঠপোষকতায় ভালো ছবি হয়েছে। ওদের আর একটা বড়ো সুবিধে হলো দক্ষিণ ভারতে সিনেমা হলের সংখ্যা আমাদের রাজ্যের থেকে অনেক অনেক বেশি। ছবির প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এটা একটা বাড়তি সুবিধে তো বটেই।

অচিন্ত্য নন্দী: বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : বেশ কয়েকজন তরুণ পরিচালক কাজ করে যাচ্ছেন। এঁদের ছবি মুক্তি পেলে বর্তমান অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতেই পারে।

অচিন্ত্য নন্দী: এঁদের কয়েকজনের নাম বলবেন? এবং এঁরা কি কি ছবি করেছেন অথবা করছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সৈকত ভট্টাচার্যের ‘অবতার’ আমরা দেখেছি । এছাড়া গৌতম ঘোষ তেলেগু ভাষায় ‘মাভূমি’ নামে একটা ছবি শেষ করে একটা বাংলা ছবিতে হাত দেবার কথা ভাবছেন। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী করছেন ‘ময়না তদন্ত’। নীতিশ মুখোপাধ্যায় ‘রবিবার’ নামে একটা ছবি করছেন। আর-আর-নাঃ, এই মুহূর্তে এঁদের নামই মনে আসছে।


বিদেশি পত্র-পত্রিকায় ‘নিম অন্নপূর্ণা’ :
The Times, London পত্রিকায় David Robinson:

‘... and Buddhadeb Das Gupta’s excellent Bitter Morsel is exceptional. Set in Calcutta it relates the fortunes of one of the multitude of families who come to the city in false hopes of a more prosperous life. Das Gupta’s characters are vivid and his message— the appalling moral degradation and corruption of poverty-is clear.’


Gardian পত্রিকায় Derek Malcom:
‘… one of the most remarkable films of recent times…’

উপরোক্ত সাক্ষাৎকারটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘প্রতিবিম্ব’ থেকে উদ্ধৃত।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - চম্পা

Posted in

 







আমার কাছে তিনি একজন শিক্ষকের মতো: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে স্মৃতি চারণায় বাংলাদেশের অভিনেত্রী চম্পা

সকালে ঘুম থেকে জেগেই একজন গণমাধ্যমকর্মীর ফোন পেলাম। তিনিই আমাকে দাদার মৃত্যুর খবরটা প্রথম দেন। খবরটা শুনেই আমি হতবম্ভ হয়ে গেলাম। তারপর সারাদিন কেটেছে বিষণ্নতায়। কোভিড মহামারির এই সময়ে— মাত্র দুই মাস আগে ফোনে তার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তখন একবারের জন্যও আমার মনে হয়নি তিনি অসুস্থ। তিনি একদম স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেছিলেন। মানসিকভাবেও যথেষ্ট শক্ত মনে হয়েছিলো। আমরা পুরানো দিনের আলাপ করেছিলাম। ছবির শুটিং, ডাবিংয়ের ছোটো ছোটো গল্প, ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘কতদিন ধরে তোমাকে দেখি না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসো।’ তার কিডনি সমস্যা ছিলো সেটা জানি। নিয়মিত ডায়ালিসিস করতেন সেটাও জানি। এর মধ্যে আমার বার বারই মনে হচ্ছিলো দাদাকে একটা ফোন করি। কিন্তু নানা কারণে আর ফোন করা হয়নি। সারাজীবন আমার এই আফসোস থেকে যাবে, কেন আমি তাকে ফোন করে খোঁজ নিলাম না। ‘লাল দরজা’ ছবিটি করার সময় তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচালক ও শিল্পীর সম্পর্ক ছাড়িয়ে পারিবারিক একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। তার ছোটো মেয়ে শিউলির সঙ্গে আমার একমাত্র মেয়ে এশার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তার দুই মেয়ের সঙ্গেই আমারও হায়-হ্যালো ছিলো। লাল দরজা শেষ যাওয়ার পরও দাদা ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বজায় ছিলো। তিনি মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করতেন। আমার স্বামী, আমার মেয়ের খোঁজ-খবর নিতেন। মহামারির মধ্যে আমাকে এবং আমার পরিবারের সবাইকে সাবধানে থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন। আমিও তাকে সাবধানে থাকতে বলতাম। দাদা আমাকে বোনের মতো দেখতেন। সম্বোধন করতেন ‘দিদি’ বলে।

এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। সেটা হলো দাদা যেমন আমাকে দিদি বলে ডাকতেন, তেমনি তার দুই মেয়ে— বাবলি এবং শিউলিও আমাকে চম্পাদি বলে ডাকতো। এ ব্যাপারটায় মনে মনে আমি বেশ মজা পেতাম। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমি ছোটোবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলাম। তাই ছিলাম স্নেহের কাঙ্গাল। দাদা এবং বৌদির আদর-স্নেহ যেন আমার সে অভাব অনেকটা পূরণ করে দিয়েছিলো। আমার অসুস্থতায় বৌদি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে নিয়ে যেতেন। এভাবেই আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটা আরও বেশি সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিলো। আমার মেয়ে এশা আর দাদার মেয়ে শিউলিকে একইসঙ্গে কানাডায় পড়তে পাঠাই, যদিও তারা দুই জন দুটি আলাদা বিষয়ে পড়াশোনা করতো। লাল দরজার পরে তার সঙ্গে আমার আর কোনও কাজ করা হয়নি। তারপরও আমার কাছে মনে হয়, আমি ভালো একজন মানুষের সৌহার্দ্য পেয়েছি, এই বা কম কী?

লাল দরজা ছবি করার আগে একদিন হঠাৎ একটি টেলিফোন পাই। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো ‘আমি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।’ নামটা শুনেই ভয় আর আবেগে আমার হাত কাঁপা শুরু করেছিলো। আগেও তো গৌতম ঘোষ, সন্দীপ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি, কখনও এমন হয়নি। খুশিতে কথা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে বললেন, ‘শুনুন, পদ্মা নদীর মাঝি আর টার্গেট-এ আপনার কাজ আমি দেখেছি। আপনার অভিনয় আমার ভালো লেগেছে। আমি লাল দরজা নামে একটি ছবি করছি। আপনি প্রধান চরিত্র করবেন। রাজি আছেন? থাকলে আজই সংবাদ সম্মেলন করে আপনার নাম ঘোষণা দেবো।’ আমি কোনও রকমে খালি একবাক্যে বললাম, রাজি। ছোটো করে তিনি আমাকে গল্পটা শোনালেন। বললেন, ‘আপনার চরিত্রটার জন্য স্বতন্ত্র কিছু মুখভঙ্গি দরকার হবে। চাহনি আর ঠোঁটের ভঙ্গি দিয়ে হৃদয়ের বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।’ আরও কী সব বললেন, উত্তেজনায় কিছুই শুনিনি। শুধু বললাম, আপনার সিনেমায় অভিনয় করতে চাই। আর বেশি কিছু জানতে চাই না। পরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি আমাকে কাস্ট করেছেন। তখন অডিশন ছাড়া সিনেমায় কাজের সুযোগ মিলতো না। কিন্তু তিনি আমার উল্লিখিত দুটি ছবি দেখার পর আর আমাকে নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করেননি।

কলকাতা গিয়ে তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন দেখলাম গুরুগম্ভীর একজন মানুষ। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি কথা বলছিলেন একেবারে সরাসরি, যাকে বলা যায় চাছাছোলা। সে জন্য প্রথম দিকে কথা বলতেও ভয় লাগতো। দূরে দূরে থাকতাম। কিছুদিন কাজ করে বুঝলাম, বাইরেটাই খালি শক্ত, ভেতরে আসলে হাসিখুশি ও সাদা মনের একজন মানুষ। আলাপ শুরু করলে আর থামতেন না। বেশিরভাগই সিনেমা এবং খাবারের গল্প। আর ঘুরে ফিরে আসতো ইলিশের কথা। তবে সম্পর্ক যত হাসিখুশিই থাক, কাজে কিন্তু কখনও ছাড় দিতেন না। শুটিং করতে গিয়ে কত যে ধমক খেয়েছি। তিনি চাইতেন সব সময় চরিত্রের মধ্যে থাকি। মাঝেমধ্যে শুটিংয়ের ফাঁকে হেসে উঠতাম। কখনও কারও সঙ্গে হয়তা আলাপে মশগুল হয়ে যেতাম। তাতে তিনি রাগ করতেন, বুঝিয়ে বলতেন, চরিত্রের বাইরে মনটা থাকলে কাজে শতভাগ মনোযোগ থাকে না। চিত্রনাট্যের আবহে থাকলে কাজটা ঠিকঠাক হয়। শুটিংয়ে আড্ডা সহ্য করতেন না তিনি।

একবার একটা দুঃখের দৃশ্য করার আগে কী কারণে যেন আমি খুব জোরে হেসে উঠেছিলাম। শুধু এই অপরাধে তিনি কয়েক ঘণ্টা শুটিং বন্ধ করে রাখলেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি চরিত্রের বাইরে চলে গেছো। যাও, কিছুক্ষণ একা থাকো। কারও সঙ্গে কোনও কথা বোলো না।’ ডাবিংয়ের সময়েও তার কড়া নিষেধ ছিলো, ঘুম থেকে উঠে কোনও কথা বলা যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই ডাবিংয়ে চলে আসতে হবে। কষ্ট বা দুঃখের জায়গাগুলোর ডাবিং আগে করতেন।

কাজ শেষ করার পর একবার কৌতুহলবশত তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ডাবিংয়ের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে ঘুম থেকে উঠে কারও সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছিলেন কেন? জবাবে তিনি আমাকে বললেন, ঘুম থেকে ওঠার পর কারও সঙ্গে কথা না বললে কণ্ঠের ভারিত্ব ভাবটা থাকে। আর কারও সঙ্গে কথা বললে কণ্ঠ পাতলা হয়ে যায়। দেশে ফেরার পর ছবির ডাবিং করতে গিয়ে বিষয়টা খতিয়ে দেখলাম আমি। তাতে আমার কাছে প্রমাণিত হলো, দাদার কথাই সঠিক ছিলো। এইভাবে তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তার মতো বড়ো পরিচালকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে জীবনের ঝুলিটা সমৃদ্ধ করেছি। শিল্পী হিসেবে এগুলোকে অভিনয় জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছি। এগুলোর কারণে পরে আমার কাজের ধরণটাই বদলে যায়।

আবারো বলতে চাই, অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি যাদের কাছে ঋণী তাদের মধ্যে তিনিও একজন। কাজ করতে গিয়ে তার কাছ থেকে সিনেমা ও অভিনয় বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। এগুলো আমার শিল্পীজীবনের প্লাস পয়েন্ট। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, তিনি সবার থেকে আলাদা। তার কাজের স্টাইলটাও একেবারে আলাদা। প্রচণ্ড ডেপথনেস নিয়ে কাজ করতেন তিনি, খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতেন। আমরা শিল্পী কলাকুশলী সবাই যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারি— এই জিনিসটা কিন্তু তার কাছ থেকে আমাদের শেখা। কীভাবে একটা ভালো কাজের জন্য মনোযোগ দিতে হয় এবং একটা কাজের সঙ্গে কীভাবে আরও ভালোভাবে ইনভলব হওয়া যায়— এই টেকনিকটাও তার কাছ থেকেই শেখা।

‘লাল দরজায়’ আমার কিছু জটিল সিকোয়েন্স ছিলো, যেগুলোতে ডায়ালগ নয় আমার চেহারা, আমার বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে সব বোঝাতে হবে। শুধু ডায়ালগ বলেই আমার বক্তব্য শেষ করলাম কিন্তু আমার ভেতরে কী ঘটছে সেটা বোঝালাম না সেটা হবে না। ডায়ালগ ছাড়াও নিজের ভেতরের অনুভূতি কীভাবে বোঝাতে হবে মানে অভিব্যক্তি দিয়ে কীভাবে বক্তব্যটা তুলে ধরা যায় সেটা তার কাছ থেকে শিখেছি। দাদার কাছ থেকে এমন কঠিন কঠিন কিছু বিষয় শিখেছি যেগুলো আমার আজও কাজে লাগছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তিনি আমাকে নানা পরামর্শ দিতেন।

দাদা সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সকালে চিরতার রস খেতেন। নিয়মিত যোগব্যায়াম করতেন। এসব নিয়ম আমাদেরও মেনে চলতে বলতেন। করোনার মধ্যেও কথা হতো। বলতেন, নিরাপদে থেকো। কয় মাস আগেই সর্বশেষ কথা হয়েছে। তার কথা শুনে মনে হয়েছিলো অনেকটাই সুস্থ এখন। বলতেন, কত দিন তোমাকে দেখিনি। করোনা কমলে এসে দেখা করে যেও। ভেবেও ছিলাম করোনা পরিস্থিতি একটু ভালো হলেই দেখা করে আসবো। সেই সুযোগ আর হলো না। এই কষ্ট আমার মন থেকে কোনওদিনই মুছে যাবে না।

দাদা চলে গেছেন। পেছনে রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি এবং তার অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। তার সঙ্গে কাজ করার নানা অভিজ্ঞতা, তার কাছ থেকে শেখা বিষয়গুলো আমার কাছে থেকে যাবে আজীবন। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে না থাকলেও, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সব অসাধারণ সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে।
লাল দরজা শুটিংয়ের দুটি মুহূর্ত


0 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

 




















 (১)

ভূমিকা

নিও -নর্মাল কে সি পাল

নতুন শতাব্দীর দুটো দশক পেরিয়ে গেলো। বিশ্বায়নের যুগে ঘরে বসে দুনিয়ার খবর— অডিও এবং ভিস্যুয়াল মাধ্যমে— আমরা পেয়ে যাচ্ছি। কথা চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে গেছে। নতুন কোনও জায়গায় গেলে আমরা অচেনা লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করি না। বরং মোবাইলে জিপিএস দেখে ঠিকমতো পৌঁছে যাই আমড়াতলার মোড়ে।

কিন্তু আচমকা চারদিকে শুনতে পাই যে এসবই নাকি ‘বেদে আছে’! সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট করছিলেন। গণেশের নাকে হাতির শুঁড় প্লাস্টিক সার্জারি করে লাগানো হয়েছিলো। রামায়ণের পুষ্পক বিমান আসলে প্রাচীন যুগের এয়ার ইন্ডিয়া।

অথচ কেউ খেয়াল করেন না যে পৌরাণিক যুগে রাজপ্রাসাদেও ইলেকট্রিসিটি ছিলো না। সর্বত্র দীপদান এবং মশালের আলো। এমনকি বৌদ্ধযুগেও বাসবদত্তা সন্ন্যাসী উপগুপ্তকে দেখছে প্রদীপের আলোয়— “প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাহার নবীন গৌরকান্তি”।

আর পৌরাণিক যুগে তো সবাই যাতায়াত করেন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে, মানে পশুতে টানা শকটে বা রথে। তাই দেবতারাও সব বলদবাহন, ময়ূরবাহন, অশ্ববাহন, হস্তীবাহন এবং মকর বা সিংহবাহিনী, এমনকি মুষিকবাহনও।

বাস্তববুদ্ধি ঘুলিয়ে দেওয়ার এ জাতীয় চেষ্টা যে কয়েক দশক আগেও হয়নি এমন নয়। যেমন সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য নয় পৃথিবী। এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তখন এসব শুনে বা কলকাতায় ও হাওড়া ব্রিজের গায়ে লেখাগুলো পড়ে আমরা সবাই হাসতাম, দেওয়াল লেখক কে সি পালকে কিছুটা প্রশ্রয়ের সুরে বলতাম পাগল। কিন্তু আজকাল অবস্থা বদলে গেছে। ওই কথাগুলো বলা হচ্ছে জোরগলায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে।

যেমন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে পেপার গবেষণাপত্র পড়া হচ্ছে যে প্রাচীন যুগে ভারতে বিমান ব্যবস্থা ছিলো। সেই বিমান অনেক উন্নত টেকনোলজিতে চলতো। তাতে মোটরগাড়ির মতো ‘ব্যাকগিয়ার’ ছিলো। হাইকোর্টের বিচারপতি বলছেন ময়ূর হলো খাঁটি ব্রহ্মচারী। তার চোখের জলে ময়ূরীর গর্ভসঞ্চার হয়। বোকাবাক্সতে দেখছি এমন দাবি যে জ্যোতিষেও ক্যানসার সেরে যায়। বা পতঞ্জলি আশ্রমের ৭৫০ টাকার প্যাকেজে করোনা রোগী ১০০% সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যে পরে কা কথা, দেশের প্রধানসেবক নিজেই গণেশের শুঁড়কে প্রাচীন প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বলে দাবি করছেন।

এখন কেউ হাসতে সাহস করে না। এ নিয়ে প্রশ্ন করে না। করলেই আপনি হয় দেশদ্রোহী, নয় তো ভারতের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্টে ঘা দিচ্ছেন।

মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা?

খবরের কাগজ বলছে রাজস্থানে নাকি মনু মহারাজ বা মনুস্মৃতির প্রণেতা মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপন করা হবে। তাঁকে দেখতে কেমন কেউ জানে না। কোথাও ছবিটবি দেখিনি। ইদানীং একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার হুজুক শুরু হয়েছে। সর্দার প্যাটেল, সাভারকর ,শ্যামাপ্রসাদ, নাথুরাম গডসে হয়ে গেছে। এবার আমাদের প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থের রচয়িতা মনুর পালা। যদিও দলিত সমুদায়ের বক্তব্য আমাদের সমাজে জাতপাতের ভাগাভাগি, ছোঁয়াছুঁয়ি এসব নাকি মনুস্মৃতিতে লিপিবদ্ধ, সেখান থেকে শুরু। তাই ওঁরা দেশের অদলাবদলি করে শাসন ক্ষমতায় থাকা বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোকে মনুবাদী পার্টি বলেন।

ইদানীং দলিতদের উপর অত্যাচার বেশ বেড়েছে।

অর্থাৎ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নামে যা খুশি বলাটা নিও-নর্মাল হয়ে গেছে। কারণ এর পৃষ্ঠপোষক হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা।

এর সামাজিক প্রতিফলন দেখছি বিশেষ করে তিনটে ব্যাপারে।

এক হলো খাদ্যাখাদ্য। ডাক্তার নয়, সরকার ঠিক করে দেবে আপনি কী খাবেন বা কী খাবেন না। শুধু তাই নয়, ফ্রীজে গোমাংস রাখা আছে এই সন্দেহে আদালতে না গিয়েই লোককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে।

দুই, নারীর কীসে ভালো তা অবলা কোমল ভারতীয় নারী বোঝে না। তার কেমন পোশাক পরা উচিত, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা চলাফেরা করা উচিৎ, কাকে বিয়ে করা উচিৎ নয়, সব ঠিক করে দেবে পুরুষের বা যুবকের দল, থুড়ি রাষ্ট্র। অর্থাৎ ভারতীয় নারী কোনওদিনই প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। তার বিয়ে তো ঠিক করে দেবে তার বাবা-মা। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য। কাজেই প্রাপ্তবয়স্ক চাকুরে মেয়ে যদি অন্যধর্মের ছেলেকে ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় বিয়ে করে তাহলে তার কথায় কান না দিয়ে তার বাবা-মা বা সমাজের কোনও অতি উৎসুক যুবকের তরফে ‘জোর করে ধর্মান্তরণ করা হচ্ছে’ অভিযোগ পেয়ে নতুন স্বামীকে জেলে পোরা যাবে। এটাই কয়েকটি রাজ্যে নতুন তৈরি ‘লাভ জিহাদ’ আইন।

তিন, দলিতদের ভারতীয় সমাজে ঠিক জায়গা কোথায়? আম্বেদকর কি হিন্দু ধর্মের দলিতদের প্রতি ক্রুরতার প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়ে যাননি? আম্বেদকর যে কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়েছিলেন, সে কি হিন্দু সমাজে দলিতদের প্রতি হয়ে চলা ক্রুরতার প্রতিবাদে?

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত মেয়েটিকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে হত্যা করার বীভৎস ঘটনাটিকে মেয়েটির মৃত্যুপূর্ব জবানবন্দী সত্ত্বেও যেভাবে সরকারি পুলিশ, ডাক্তার ও কিছু মিডিয়া মিলে মিথ্যে, এবং নিহতের পরিবারের ‘অনার কিলিং’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

তাহলে ভারতীয় বা হিন্দুসমাজের এই তিনটে বিষয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য কী? দেখুন, এখন আর একটি নতুন সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ হলো যাহা হিন্দু তাহাই ভারতীয়। বিশুদ্ধ বেদান্তদর্শন চর্চার সূত্রগ্রন্থে দেখছি বিভিন্ন মনু, গৌতম, পরাশর এবং যাজ্ঞবল্ক্য আদি বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকে উল্লেখ করে বলা হচ্ছে— শূদ্রের নেই বেদ পাঠে বা শ্রবণের অধিকার।1

আর মনুসংহিতায় নাকি আমাদের প্রাচীন আচার-বিচার, উচিত-অনুচিত মায় সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড সবই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমনকি কলোনিয়াল যুগে বৃটিশরা এ নিয়ে বেশি খোঁচাখুচি করেনি। তাই হিন্দু কোড বিল রচিত হয়েছিলো স্মৃতিশাস্ত্র বা সংহিতা বিশেষ করে মনুস্মৃতি মেনে।

--------------------------------

ব্রহ্মসূত্র; প্রথম ভাগ, ১/১/৩৮।

কেন? কারণ পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য ইত্যাদি অনেকগুলো সংহিতা থাকলেও মতভেদ হলে মনুর বিধানই বেদ-অনুসারী এবং মান্য বলে ধরা হয়।

“মন্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রশসস্যতে”। যার ব্যাখ্যা মনুর সাথে মেলেনা তা স্মৃতিশাস্ত্রের মর্যাদা পাবে না।

আবার ‘যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎক্বচিৎ’। অর্থাৎ যা এই বইয়ে আছে তা অন্য স্মৃতিগ্রন্থেও আছে, আর যা এতে নেই, বুঝতে হবে তা কোথাও নেই।

কাজেই রাজস্থানে মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপিত হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। মনুসংহিতাতে বাস্তবে কী বলা হয়েছে তা নিয়ে খতিয়ে না দেখেই বাজারে অনেক কথা বলা হয়।

দেখা যাক, সংহিতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুস্মৃতিতে বাস্তবে কী বিধান দেওয়া আছে।


বারোটি অধ্যায়ঃ

এতে রয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়।

প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। আরও বলা হয়েছে যে ব্রহ্মা এই শাস্ত্র মনুকে শিখিয়েছিলেন। (শ্লোক ১/৫৮)। মনু দশজন প্রজাপতি মহর্ষি (মরীচি, অত্রি, বশিষ্ঠ, নারদ, ভৃগু আদি)কে শিখিয়েছিলেন। এখন ভৃগু উপস্থিত জিজ্ঞাসু মহর্ষিদের শোনাচ্ছেন। (১/৫৯)।

এতে কী কী আছে?

প্রায় চল্লিশটির বেশি বিষয়ে এতে আলোচনা আছে। কিছু উল্লেখ করছি— পৃথিবীর উৎপত্তি, সংস্কারের নিয়ম, স্ত্রী সম্ভোগ, বিবাহের প্রকার, মহাযজ্ঞবিধি, শ্রাদ্ধবিধি, জীবিকা, খাদ্যাখাদ্য, সাক্ষীকে প্রশ্ন করার নিয়ম, স্ত্রীপুরুষের পারস্পরিক ধর্ম, মহাপাতক, উপপাতক, প্রায়শ্চিত্ত, দন্ডবিধি, সম্পত্তির নিয়ম, বর্ণসঙ্কর, বিভিন্ন বর্ণের আপদ্ধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম ইত্যাদি। (১/১১৮)।

এই তালিকাটি দেখুনঃ

--------------------------------------

2 মনুস্মৃতি, ডঃ রামচন্দ্র বর্মা শাস্ত্রী; পৃঃ ৯।


অধ্যায় ক্রমাংক বিষয়

১ সৃষ্টি থেকে প্রলয়

২ ভূগোল— আর্যাবর্ত, ইত্যাদি; ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে পালনীয় বিধি

৩ গার্হস্থ্য আশ্রম, আট প্রকার বিবাহ, কন্যার লক্ষণ, শ্রাদ্ধের নিয়ম

৪ গৃহস্থের আচারসংহিতা

৫ খাদ্যাখাদ্য বিচার, বেদবিহিত হিংসাকে অহিংসাকে মানা

৬ বানপ্রস্থের আচার আচরণ

৭ রাজার আচরণ; করব্যবস্থা, সাম-দান-ভেদ ও দন্ডের প্রয়োগ

৮ দন্ড বিধি (পেনাল এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড)

৯ স্ত্রীপুরুষ সম্পর্ক, উত্তরাধিকার, (সিভিল ও সিভিল প্রসিডিওর কোড)

১০ বর্ণাশ্রম ধর্ম, তাদের আচার-আচরণ বিধি

১১ নিয়মের অলঙ্ঘন করলে প্রায়শ্চিত্ত ও শাস্তি

১২ শরীর উৎপত্তি, স্বর্গ ও নরক গমন, ব্রহ্মবেত্তার লক্ষণ


এবার তিনটে কিস্তিতে মনুসংহিতা অনুযায়ী সমাজে শূদ্রের স্থান, নারীর স্থান ও খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে কথা বলবো। আমি চেষ্টা করবো এই স্বল্প পরিসরে মনুসংহিতার স্বরূপের বর্ণনা করে তিনটি ভাগে খাদ্যাখাদ্য, জাতিপ্রথা এবং নারীর অবস্থান নিয়ে উনি কি বলেছেন তা তুলে ধরতে। মনে হয় জাতিপ্রথা নিয়ে আগে কথা বলা উচিত। কারণ, ওটাই আমাদের সমাজের প্রাচীন কাঠামো। খাদ্যাখাদ্য বা নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে ওই কাঠামোকে মেনে।

[চলবে]

0 comments:

0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরকামী

Posted in

 




















১। বিনি সুতোর মালা -রঞ্জিতা সিনহা
২। রুপান্তরিত নারী – অনন্যা রায়
৩। শিখন্ডী- নবারুণ সুমন
৪। বিভেদ- সুপ্রিয় দত্ত
৫। When I sleep gloomy - Tracy Shivangee Sardars
৬। *যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, প্রবাদটি সত্যি হয়ে উঠেছে এক রূপান্তরকামীর জীবনে* - ঋত্বিকা
৭। *প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে রান্নার ব্যবসা শুরু দেবাঙ্গনার* - দেবাঙ্গনা
৮। *আইন পাস হলেও প্রতিনিয়ত সমাজের অবজ্ঞার শিকার ধ্রুবর মতো রূপান্তরকামীরা* - ধ্রুব

As a pillar of the LGBTQH or Lesbian, Gay, Bisexual, Transgendered and Queer, Hijra community, I have experienced several things, some being good, some bad and some are quite tragic. But I have learnt through my experiences to fight against the society and create a platform for these people.

The Transgender community is marginal and vulnerable in the society. They suffer from violence, harassment and discriminations. And these issues are increasing by leaps and bounds. The police refuse at times to lodge an FIR, if need be, against the harasser. To fight for their Right to Equality, I have taken to roads, gheraoed the local police stations, campaigned on streets with festoons and banners and sought help of the social media. As a member of West Bengal Transgender Board and a founder member of National Transgender Task Force, I feel blessed to run a shelter for LGBTQH community in Kolkata.

When Rritobak asked me to contribute for their Krorepotro (Supplementary) on this issue, I immediately agreed to the proposal as I feel these people also need to voce their issues. Along with some articles by writers from Bangladesh, Austria and Germany/UK, I have included here short pieces by my community people. Despite the pandemic situation and still unable to weather their position in this society, when many are fleeing homes and taking refuge at my home, I feel happy to share their experiences with the readers.

Ranjita Sinha


বিনি সুতোর মালা

রঞ্জিতা সিনহা


“আমার এ ঘর বহু যতন করে
ধুতে হবে মুচতে হবে মোরে।
আমাকে যে জাগাতে হবে…
কি জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”

রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো আমাদের মতো মানুষদের কাছে যেন এক নির্মম সত্যি। আমরা যতই নিজেদের কপট জৌলুশে বা চড়া সাজে নিজেদের সাজিয়ে রাখি না কেন, আসলে আমরা সবাই একা। তাই মনে মনে হয়তো খুঁজে বেড়াই একটা অবলম্বন। অপেক্ষা করে থাকি সেই মানুষটার জন্য, যার ছোঁয়ায় খুঁজে পেতে চাই নিজেদের পরিপূর্ণতা। বিতানের কাহিনীও অনেকটা সেইরকম।

হাওড়া জেলার এক গ্রামে বিতান থাকে। মামার বাড়িতে মানুষ ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে মামাবাড়িতে উটকো আগাছার মতো বড়ো হচ্ছে সে। দিদিমা যতদিন ছিলো লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পেরেছে। দিদিমা গত হওয়ার পর তাও বন্ধ। ছোটোবেলা থেকেই একরকম নরম মনের সে। ভিজে মাঠে ফুটবল বা ডাংগুলি খেলার থেকে মামাতো বোনের সাথে পুতুলের বিয়ে দিতে তার যেন বেশি ভালো লাগে। মামীমা যখন নুন-হলুদ মাখা হাতে খুন্তি নেড়ে তরকারি নাড়ে, মামীর হাতের সেই চুড়ির আওয়াজ তাকে কি রকম আনমনা করে দেয়। খুব ইচ্ছে করে বিতানের বাড়ির পিছনে খেলনা উনুন বানিয়ে, বুনো গাছের পাতা আর লাল ইঁটের গুঁড়ো দিয়ে মামীর মতো তরকারি রাঁধতে। মামার মুদির দোকানে বসার চেয়ে বোনের ফেঁসে যাওয়া ফ্রকটা সেলাই করতে তার বড়ো ভালো লাগে। সবার কাছে সে যেন অন্য টাইপের একটা ছেলে, কিরকম মেয়েলি মার্কা। দোলের দিনে মামাতো ভাইয়েরা রং মেখে গ্রামের পুকুরে চান করতে যায়, সঙ্গে আরও পাড়ার ছেলেরা, ইচ্ছে না করলেও যেতে বাধ্য হয় বিতান। খালি গায়ে পুকুরে ঝাঁপাতে সে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। গায়ে ভেজা গামছা জড়িয়ে আসার সময় মামাতো ভাই ও তার বন্ধুরা বারবার গামছা ধরে টানে। সে যেন মরমে মরে যায়। কেন কেউ তাকে বুঝতে পারে না? হয়তো সে নিজেকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না— কে সে? ছোটোবেলায় দিদুর মুখে শোনা সেই কুৎসিত দাঁড়কাকটা, যে রোজ পুকুরের জলে নিজেকে দেখে ভাবে এক সুন্দর দোয়েল। ভোররাতে এক পরী এসে চকমকী জাদুর ছড়ি দিয়ে সত্যি তাকে দোয়েল করে তুলেছে একদিন। হায়রে দিদুও নেই, দিদুর সেই গল্পের পরীও নেই। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে নিজের ভিতরে ভাঙতে থাকে বিতান। কেউ তাকে বুঝতে পারে না। নির্জন দুপুরে সবাই যখন ঘুমায়, বিতানের ইচ্ছা করে মামাতো দিদির লিপস্টিকটা ঠোঁটে মাখতে।

একমাত্র পাড়ার গঙ্গাদা তার বড়ো কাছের মানুষ। গঙ্গাদাকে দেখে সবাই হাসে, ঠাট্টা করে। সে পাড়ার জলসায় নাচে। মাঝে মাঝে কলকাতায় যায় কীসব কাজে। খুব ভালো মেহেন্দী পরায় গঙ্গাদা, তাই কলকাতা থেকে ডাকও আসে তার। গঙ্গাদা গ্রামে ফিরলেই বিতান তার কাছে যায়, অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে। গঙ্গাদার বাড়িতে বিতান নির্ভয়ে সব মাখতে পারে। সবার সামনে বিতান বলে ডাকলেও, গঙ্গাদা আড়ালে তাকে বলে তুই আমার বোন, আমার বিথি বোন গঙ্গাদার মুখে বোন কথাটা শুনে বিতান নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে। কিন্তু গঙ্গাদা দশদিন থাকে তো দু’মাস অন্য জায়গায়। তাই বিতানকে কঠিন বাস্তবের মধ্যে কাটাতে হয় দিনের পর দিন। সময় চলে যায় এইভাবেই। ১৬-র গণ্ডী পেরিয়ে ১৭-য় পড়ে বিতান। অনেকদিন হয়ে গেলো গঙ্গাদা গ্রামে আসেনি। কিছুদিন ধরে বড়ো মন খারাপ করছে বিতানের। কিছুতেই কিন্তু যেন ভালো লাগছে না। বাড়ির পিছনে তেঁতুল গাছের তলাটা বিতানের খুব প্রিয়। মামীর বকুনি, মামার মার কিম্বা যখনই মন খারাপ হয় সে এসে চুপ করে বসে থাকে এই তেঁতুল তলায়। সেদিন অলস দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে ছোটোবোন আর ভাইরা ইস্কুলে গেছে, বিতান তেঁতুল তলায় বসে সরু আমডাল দিয়ে মাটিতে আপন মনে দাগ কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ বেড়ার ওপার থেকে একটা বল এসে পড়ে তার সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিতান দেখে তার থেকে তার থেকে একটু বড়ো ছেলে বেড়া টপকে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে— “বলটা আমার”, কথাটা বলে সে বলটা কুড়িয়ে চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে বলে— “তুমি তো খুব ভালো আঁকো। বিতান কিছু বুঝে উঠতে পারে না, মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে কখন সে নিজের অজান্তেই ডালটা দিয়ে একটা আলপনা এঁকে ফেলেছে, বিতান চুপ করে থাকে। ছেলেটা বলে— “আমাদের সাথে খেলবে মাঠে।” ” এতদিন দাদারা, পাড়ার ছেলেরা তার শুধু পিছনেই লেগেছে, কিন্তু আজ কেউ তাকে ডাকলো খেলার জন্য। কিন্তু ক্রিকেট, ফুটবল বা ডাংগুলি— এইসব খেলা বিতান খেলতে পারে না। তাই সে ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলে। ছেলেটি বল নিয়ে চলে যায়, এই ছেলেটকে তো আগে কোনওদিন দেখেনি সে! হঠাৎ মনে পড়ে পাশের মিত্র জ্যেঠুদের বাড়িতে কলকাতা থেকে মিত্র জ্যেঠুর ভাইয়ের পরিবার এসেছে, কলকাতা থেকে গরমের ছুটিতে বেড়াতে। হয়তো “এ তাদেরই কেউ একজন। মামার ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে চারটের ঘণ্টা পড়তেই বিতান আমডালটা ফেলে দৌড় দেয় ছোটো বোনকে স্কুল থেকে আনতে। ”

সন্ধ্যার মুখে মামার দোকান থেকে আটার ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ফিরছিলো বিতান। পাশ দিয়ে সাইকেলের রেস করতে করতে যাচ্ছে দুটি ছেলে। হঠাৎ গ্রামের রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় একজন। ততক্ষণ অন্যজন তাকে না দেখেই সাইকেল চালিয়ে চলে গেছে অনেকদূর। বিতান ছেলেটির কাছে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি বলে— “আমাকে একটু হেল্প করবে?” বিতান দেখে কালকের সেই বল কুড়োতে আসা ছেলেটা। বিশ্রীভাবে পাশের খালে পাঁক মাখা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তার উপর তার সাইকেল। বিতান সাইকেলটা তুলে, পাঁক থেকে ছেলেটাকে তোলে। কোনওরকমে উঠে ছেলেটা বলে— “এখানে কোথায় কল আছে বলোতো?” বিতান দেখে ছেলেটির গা ভর্তি পাঁক। পচা খালের পাঁকের গন্ধে গা গুলায় বিতানের, কিন্তু ছেলেটাকে ছেড়ে যাওয়াটাও বাজে দেখায়। পাঁক মাখা অবস্থায় সাইকেল নিয়ে ছেলেটি এগিয়ে যায় বিতানের সঙ্গে দূরে কলটার দিকে। বিতান কল টিপছে। ছেলেটি হাত-মুখ ধুতে ধুতে কথা বলতে শুরু করে। বিতান জানতে পারে ছেলেটির নাম সুমন— সুমন মিত্র। মিত্র জ্যেঠুর ছোটো ভাইয়ের ছেলে। গরমের ছুটিতে জ্যেঠুর বাড়ি ঘুরতে এসেছে। সুমন, বিতানকে জিজ্ঞাসা করে সে আঁকা শেখে কিনা। বিতান না বলে ঘাড় নাড়ায়। মনে মনে ভাবে যেখানে তার লেখাপড়াই বন্ধ, সেখানে আঁকা শেখাটা তো বিলাসিতা। এরপর প্রায়ই পথে-ঘাটে কিম্বা তেঁতুল তলায় সুমনের সাথে দেখা হয় বিতানের। সুমন খুব সুন্দর কথা বলে। বিতানের খুব ভালো লাগে সুমনের থেকে কলকাতার গল্প শুনতে। আর তার থেকে বেশি ভালো লাগে সুমনকে। এই একজনই সে বিতানকে মেনে নিয়েছে ভালো বন্ধু হিসাবে। কারণ বাকিরা তো শুধু বিদ্রুপ আর কটাক্ষই করে তাকে নিয়ে। সেদিন দুপুর বেলা তেঁতুল তলায় সুমন গল্প করতে করতে বিতানের হাতটা যখন ধরেছিলো, বিতানের হঠাৎ যেন সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভেবেছে অনেক, এতদিন তো কারও ছোঁয়াতে ওর এমন হয়নি। দাদারা, ভাইরা, পাড়ার বিল্লু, গৌতম কারোর বেলায় তো এমন হয়নি কখনও! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে বিতান।

গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সেদিন সব ভাইবোন মিলে ঠিক করেছে অন্ধকারে লুকোচুরি খেলবে। বোনেরা মিলে দল ঠিক করেছে। সুমন ওর বোন আর মিত্র জ্যেঠুর ছেলেমেয়েরাও এসেছে খেলতে। বিশাল দল নিয়ে সবাই খেলতে রাজি হয়েছে। সুমন আর ওর বোন খুব উৎসাহী কারণ কলকাতায় এসবের এসবের আর চল নেই। অনেকক্ষণ ধরে খেলা আর মজা হচ্ছে। দাদা-দিদিরাও আজ ছোটোদের সঙ্গে একসাথে মেতেছে। এবারের দানে মেজদাদা বুজকা চোর। সবাই যে যার মতো লুকিয়ে পড়েছে। তেঁতুল তলাটা অন্ধকার তাই ভাইবোনেরা ওদিকটা যেতে চায় না। কিন্তু বিতানের তো বড়ো চেনা জায়গা তাই সে তেঁতুল গাছের মোটা গুঁড়িটার পেছনে চুপ করে লুকিয়ে আছে। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কার একটা নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে ওঠে বিতান। দেখে সুমনও লুকিয়ে আছে ওখানে। দু’জনেই চুপ করে অপেক্ষা করে বুজকাদার জন্য। গাছের পাশ দিয়ে দেখে বুজকাদা আসছে। সুমন কানের কাছে ফিস্‌ফিস্‌ করে বিতানকে বলে আরও কাছে এসে সিটিয়ে দাঁড়াতে। বুজকাদা যেন কখনই না টের পায় ওরা এখানে লুকিয়ে। বিতান আর সুমন জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে গাছের গোড়ায়। সুমনের সদ্য কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি বিতানের ঘাড়ে ফুটছে। সুমনের গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে এসে লাগছে। দু’জনেই চুপ করে অপেক্ষা করছে চোরকে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। বুজকাদা এগিয়ে আসে। বিতান তৈরি হয় ছুটে গিয়ে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। সে গুড়ির পেছন থেকে বেরোতে যাবে আর তখনই সুমন ওর হাতটা চেপে ধরে। বিতান অবাক হয়ে যায়। আর থেকেও বেশি চমকে ওঠে সুমন তাকে অন্ধকারে গাছের গোড়ায় চেপে ধরে কানের মধ্যে ফিস্‌ফিস্‌ করে বলে— “না তুই যাবি না, আমাকে ছেড়ে।” মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু যেন পাল্টে যায় বিতানের। সুমন তার ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছে বিতানের ঠোঁটটা । রক্তের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে তার। কোন অজান্তে সেও দু’হাতে চেপে ধরেছে সুমনকে। সুমনের ক্রমাগত নিঃশ্বাস এসে মিশছে বিতানের শ্বাসে। এ যেন পাহাড়ী ঝর্ণা এসে মিশছে আকুল নদীর স্রোতে। বুজকাদা চলে গেছে ওধার থেকে ধরতে পারেনি বিতান চোরকে, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে ধরা পড়েছে সুমনের উন্মুক্ত আহ্বানে। কতক্ষণ এভাবে ছিলো ওরা কে জানে? বিতান অনুভব করে সুমন ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে কারা যেন ধাপ্পা বলে চেঁচিয়ে ওঠে। আর তখনই ঘোর ভাঙে দু’জনের। চলে যেতে গিয়ে সুমন শুধু বলে “কোনওদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না তুই।” সুমন চলে যায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান তেঁতুল গাছের তলায়। অন্ধকারে বনের ওধারে থেকে নাম না জানা একটা পাখি ডেকে ওঠে। বিতান মনে মনে ভাবে এটা হয়তো কোনও দোয়েলের ডাক। হাজারো দোয়েল সেদিন ডেকে উঠেছিলো বিতানের মনে— ওখানের সেই অন্ধকারে, সবার অগোচরে।

বদলে গেছে সবকিছু। বিতানের রাজ্যে যেন সুমন তার রাজকুমার। সুমন যেন আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে ফেলেছে বিতানের শরীর মনকে। নির্জন দুপুরে কিম্বা সন্ধ্যেবেলা সবার আড়ালে মিত্র জ্যেঠুর চিলেকোঠায় সুমন যখন বিতানকে উন্মুক্ত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় উন্মাদ ভালোবাসার স্রোতে, বিতান খুঁজে পায় তার পরিপূর্ণতা, দাঁড়কাকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে নীল একটা দোয়েল পাখি।

কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে, তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে বিতানের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সুমন বলেছিলো “কাঁদছিস কেন বল” এবারের পুজো আমি তোর সাথেই কাটাবো।

শুরু হয় অপেক্ষা… রাত দিন অপেক্ষা। আর তার সাথে মনের গভীরে স্বপ্নের জ্বাল বোনা। কলকাতা থেকে ফিরতেই গঙ্গাদাকে বিতান উজাড় করে মনের সবকথা বলেছে। গঙ্গাদা পাশের বাড়ির দিদার মতো পান চিবিয়ে মুচকি হেসে বলেছে— “সবে তো পূর্বরাগ। দেখ আবার মীরার মতো যোগিনী না বনে যাস।” সপ্তমীর দিন ভোরের ট্রেনে এসে পৌঁছে ছিলো সুমন। বাড়ির অমতে সে এসেছিলো একা। বলেছিলো— কলকাতার পুজো অনেক দেখেছে সে। এবার গ্রামের পুজো দেখতে চায়। কিন্তু বিতান জানতো সুমন কীসের টানে ছুটে এসেছে সপ্তমীর সেই সকালে। ে যেন এক না বলা নিবিড় সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি এক গভীর অধিকার বোধ। পুজোর দিনগুলো সবাই যখন প্যাণ্ডেলে ভীড় জমিয়েছে, দু’জনে তখন কখনও নদীপাড় বা ছাদের পাঁচিলে পাশাপাশি কাটিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । সুমনের বুকে মাথা রেখে মনে মনে তার স্বপ্নের ছবিতে রং দিয়েছে বিতান। কিন্তু পদ্মপাতার জলের মতো সুমন বড়ো ক্ষণস্থায়ী, পুজোর কটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। ফিরে যাওয়ার সময় সুমন বলে, কলকাতায় গিয়ে তাকে নতুন কি যেন একটা চাকরীর ট্রেনিংয়ে ভর্তি হতে হবে। তাই এবার আর শীতে নয় সে আসবে সেই গরমের ছুটিতে। বিতান অত বোঝে না। সে শুধু প্রতীক্ষায় থাকে সুমনের ফেরার।

দিন কেটে যায় বিতানের প্রতীক্ষায় কোনও ভাটা পড়ে না। সবে জানুয়ারি মাস পড়েছে। এখন গ্রীষ্ম আসতে অনেক দেরি, হঠাৎ একদিন গঙ্গাদা বিতানকে এসে বলে, সে নাকি আসার সময় একটা জীপ গাড়িতে সুমনকে দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনের মাঠে একটা জীপ দাঁড়িয়ে। গঙ্গাদা ঠিকই বলেছে, তার সুমন সত্যি এসেছে তার কাছে। আবেগে ছুটে যায় বাড়ির ভিতর। ঢুকেই থমকে যায় বিতান। বাড়ির দাওয়ায় বসে চা খাচ্ছে সুমন, সঙ্গে বেশকিছু ছেলে-মেয়ে। হঠাৎ ঢুকেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। বিতানকে দেখে সুমন এগিয়ে এসে বলে কিরে তুই এখানে? বিতান কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার স্বপ্নের সুমন তার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনওরকমে বলে বিতান— ‘তুই এসেছিস শুনে তোর কাছে এলাম। ঠিক তখনই দাওয়াতে বসা একটি ছেলে বলে ওঠে— “এই নমুনাটা কেরে … সুমন?”’ সুমন তাড়াতাড়ি বলে তুই যা, আমি যাচ্ছি একটু পরে । বিতান বলে— “কখন আসবি? সুমন মৃদু বিরক্ত হয়ে বলে— তুই যা… না, আমি একটু পরেই যাচ্ছি।” বিতান চলে যায়। হঠাৎ করে মনের মধ্যে প্রদীপের শিখাটা কেউ যেন দপ করে নিভিয়ে দিয়েছে। বিকেল গড়িয়ে গেলো সুমন এখনও আসেনি। বিতানের যেন কিছু ভালো লাগছে না। ভীষণ যেতে ইচ্ছা করছে সুমনের কাছে। কিন্তু যেতে গিয়ে বারবারই পা-টা আটকে যাচ্ছে তার। কানের কাছে বেজে উঠছে বারবার— “কে রে নমুনাটা।” সন্ধ্যেবেলা বিতান ফের গিয়েছিলো মিত্র জ্যেঠুর বাড়ি। ওকে দূর থেকে আসতে দেখে সুমন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলো “বন্ধুরা গ্রাম দেখতে এসেছে তাই ব্যস্ত ছিলাম। তোর সাথে কাল দেখা করবো।” কোনওরকমে কাটিয়ে দিয়েছিলো সুমন আর বিতানও ফিরে এসেছিলো। পরের দিন ছোটোবোন যখন বললো সুমনরা চলে যাচ্ছে কলকাতায়, নিজেকে আর সামলাতে পারেনি বিতান, এক ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওদের জীপের কাছে। সুমনের সেই বন্ধুটা ঠাট্টা করে বলেছিলো— “সুমন তোর সখী আবার এসেছে।” দলের মধ্যে একটি মেয়ে সুমনকে জিজ্ঞাসা করেছিলো— “Who is this species Somu? Highly suspicious.” সুমন জীপ থেকে নেমে খেঁকিয়ে সবার সামনে বলেছিলো— “কী চাই তোর, কেন Disturb করছিস বারবার। বললাম তো পরেরবার এসে যাব তোদের বাড়ি, এখন যা—” সুমনদের জীপ বেরিয়ে যায়। বুকের মধ্যে ধস নামছে বিতানের। আর তারই ধাক্কায় যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলো। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দিশাহারা হয়ে ছুটে এসে তেঁতুলতলায় বসে পড়ে বিতান। অঝোরে কেঁদে চলে সে। গাছের ডালে দাঁড়কাকটা কেন এত কর্কশ হয়ে ডাকছে?

জ্বরের ঘোরে মাথা তুলতে পারছে না বিতান। গঙ্গাদা জোর করে মুড়ি আর জিলিপি খাইয়েছে। আজ দু’দিন সে গঙ্গাদার কাছে আছে। যখনই চোখ বন্ধ করে তখনই সুমনের সেই কথাটা ধাক্কা মারে মাথার ভিতর— “কী চাই তোর?” সত্যিতো কিবা চাইতে পারে সে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আজ সে নিঃস্ব। নামহীন-পরিচয়হীন এই সম্পর্ককে কেউ বুঝতে পারবে না কোনওদিন। তিনদিন পর মামার কাছে গেলে, মামা ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেয় বিতানকে। ফিরে আসে সে গঙ্গাদার কাছে। গঙ্গাদা বলে “এইভাবে বসে থাকলে কেউ তোকে খেতে দেবে না।” তাই বিতানকেও কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করবে বিতান? সে যে তেমন কিছুই জানে না। ক্লাস নাইনে পড়া বিদ্যা নিয়ে সে কী বা করতে পারে। কিন্তু বিতানের আঁকার হাত ভালো তাই গঙ্গাদা তাকে শেখাতে শুরু করে মেহেন্দী পরানো। ছোটো থেকেই বাড়ির মেঝেতে কিম্বা মাটিতে বিতান আলপনা আঁকতে পারতো ভালোই। তাই অল্পদিনের মধ্যে সে তুলে নেয় মেহেন্দী পরানোর কৌশল। সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। মামার বাড়ির সাথে কোনও সম্পর্ক নেই তার। সেও এখন গঙ্গাদার মতো গ্রামের লোকেদের কাছে টিটকিরির খোরাক। লোকেদের চোখে ব্রাত্য। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন সে গা-সওয়া হয়ে গেছে বিতানের। মাথার চুল লম্বা হয়ে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। ভ্রুটাকে সযত্নে নিজের আয়ত্ত্বে এনেছে সে। গঙ্গাদা বলে— “নিজের যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করবি, লোক তোকে খাওয়াও না পরায়ও না।” তাই ওদের কথা “Don’t care”। হ্যাঁ... সত্যি বিতান এখন অনেক শক্ত। হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়ার পরই তো মানুষ চলতে শেখে। কিন্তু যখন নির্জন দুপুরে বা ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মুখ, কানে বেজে ওঠে সেই কথাটা “আমায় ছেড়ে কোথাও যাবি না তুই।” মনে মনে ভাবে সে তো ছাড়তে চায়নি তাকে। অন্তরের সব শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলো তার জিওন কাঠিকে। কিন্তু কাঠি ভাঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে তারই অজান্তে। গঙ্গাদার সাথে বিতানও যায় মেহেন্দী পরাতে। নতুন, নতুন ডিজাইনও শেখা হয় আর তার সাথে হাতে কিছু পয়সাও আসে।

চন্দননগরের একটা মাড়োয়ারীর বিয়েতে মেহেন্দী পরানোর ডাক এসেছে গঙ্গাদার। মাড়োয়ারীর বিয়ে পয়সা দেবে ভালো। ওখানে গিয়ে দু’দিন থেকে বাড়ির মেয়েদের মেহেন্দী পরাতে হবে। বিতানও গেছে গঙ্গাদার সাথে। পয়সাওয়ালা বাড়ির বিয়ে তাই সবেতেই এলাহি আয়োজন। রোজ রাতে বাড়ির ছাদে, বাড়ির ছেলেরা জমায়েত হয়। মাঝরাত অবধি চলে হৈ-হুল্লোর। ছোটে মদের ফোয়ারা। সেখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ। সকালে মেহেন্দি পরানোর কাজ শেষ করে, রাতে ছেলেদের সাথে সময় কাটায় গঙ্গাদা। ঝুল পাঞ্জাবীর সাথে লম্বা দোপাট্টা উড়িয়ে হিন্দি গানের সাথে যখন কোমর নাচায় গঙ্গাদা, তখন সবাই যেন মাতোয়ারা হয়ে যায়। গঙ্গাদা হয়ে ওঠে মক্ষীরাণী। বিতান ভাবে মেয়েদের থেকেও তারা কোনও অংশে কম নয় পুরুষদের নজরে। মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির স্বাদ জাগে। তাকেও হতে হবে গঙ্গাদার মতো। পুরুষ হবে তার শিকার। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে হাতে মদের গ্লাস নিয়ে গঙ্গাদার নাচ দেখতে দেখতে একমনে ভাবছিলো বিতান কথাগুলো। আসর শেষে গঙ্গাদা এসে তাকে বলে, “সামনে বসা একজন লোক তার সাথে ভাব করতে চায়।” গঙ্গাদা নিজেই বিতানকে নিয়ে যায় লোকটার কাছে। লোকটা হেসে বলে “চলো মেরে সাথ।” নেশার ঘোরে মাথার ভেতরটা ঝিনঝিন করছে, কোনওকিছু না ভেবেই বিতান যায় লোকটার সাথে নিচের তলার একটা ফাঁকা ঘরে। ঘরে ঢুকেই বাল্বটা অফ করে দেয় লোকটা। অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। তার সাথেই বিতান প্রবেশ করে এক অন্য রাজ্যে।

রাতের অন্ধকারে বিতানের মধ্যে যে পুরুষ ঢুকেছে, তাকে সে চেনে না, কোনও সম্পর্কই নেই তার সাথে, তবুও বিতানের যেন ভালো লাগে। মনে হয় এখনও সে পরিপূর্ণ। ভোর রাতে ঘর থেকে বেরোবার সময় লোকটা বিতানকে তিনশো টাকা দেয় বলে পরে আবার ডেকে নেবো। টাকাটা নিতে গিয়ে বিতানের বুক কাঁপে। কী করছে সে? তবুও কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় টাকাটার দিকে। গতরাতের ঘটনা গঙ্গাদাকে বলতে, বিতানের গালে টোকা মেরে, মুচকি হেসে গঙ্গাদা বলে “এই তো মেয়ে আমার, ধান্দা করতে শিখেছে।” বিতানের দিকে তাকিয়ে গঙ্গাদা বলে “শোনো আমরা হলাম কাটা ঘুড়ি। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। যার সুতোয় লাট খাবো তার হয়েই উঠবো। তাই গোঁত খেয়ে মাটিতে পড়ার আগে উড়ে নে যতটা পারিস।” গঙ্গাদার কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেছে বিতানের। সত্যি তো দোয়েল পাখি না হয়ে কাঁটা ঘুড়ি হলেই বা দোষ কী। এত বড়ো আকাশে ওড়াটাই আসল। বিতানের ডানা নেচে ওঠে দূর আকাশে ওড়ার জন্য।

আজ দু’বছর হলো বিতানের ঠিকানা বৌবাজারে মিনা, চূর্ণী, চাঁদনীদের সাথে। গঙ্গাদাই তাকে কলকাতায় এনেছিলো। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো চাঁদনীর সাথে। চাঁদনী আসল নাম চন্দন। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা শাড়ি পরে যখন সে বেরোয়, তাকে সত্যি চাঁদের কণাই মনে হয়। আর বিতান? বিতান হালকা হেসে বলে— বিথি।

বিথি— সত্যি বিথি এখন নাম্বার ওয়ান ওদের গ্রুপে। হাই হিল আর লো-হীপ জিন্স পরে যখন রাস্তায় হাঁটে তখন অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে যায় কিছুদূর এগিয়ে। বিথি এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। একটার পর একটা গাড়ি বদলায়। এগিয়ে যায় একটার পর একটা— কিন্তু মনের ভিতরে সেই রং-এর দোয়েলটা মাঝে মাঝে বলে ওঠে— রাস্তার মোড়ে গাড়ির কালো কাঁচ নামিয়ে হয়তো সেই চেনা মুখটা ঠিক দেখতে পাবে একদিন। ইশারায় ডেকে নিয়ে, শক্ত করে হাতটা ধরে আবার বলবে— “আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তুই কোনওদিন।” কিন্তু বিথি জানে না “বিনি সুতোয় যে মালা গাঁথা যায় না।”


রুপান্তরিত নারী

অনন্যা রায় (নাম পরিবর্তিত)


সমাজ হাসছে, বন্ধু হাসছে,
হাসছে কত ছেলে.
তারা আমায় দেখবে বলে,
কাপড় টেনে ফেলে.
কেন আমার হাঁটা ব্যাঁকা,
কেন আমি মেয়েলী?
সৃষ্টি করলেন ভগবান,
আর তোরা, দিচ্ছিস শাস্তি।
আমি জিততে জানি,
জানি যুদ্ধ করতে।
আমি শিখণ্ডী, আমি মোহিনী
আমি হলাম সেই অর্ধনারীর রুপ।
বিষ্ণুর মতো পুরুষ দেহে,
অথচ মোহিনীর মতো সাজ।
ঈশ্বর আমায় সৃষ্টি করে বললেন,
নিজের মতো করে বাঁচ।
দেখতে দেখতে চলে যায়,
জীবনে কত যে চলার পথ।
অথচ সব দিনগুলি মনে পড়ে, যেই দিনগুলি বলে এবার নিজের মতো বাঁচ।
তাই তো বলি সমাজের প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষ,
হয়ে ওঠে লড়াইয়ের পথ।
বলে আমরা পৃথিবী চিনবৈ চিনবো,
বিশ্ব মোরা করবো জয়।



কবিতা: শিখন্ডী

নবারুণ সুমন


আমায় তোমরা চিনবেনা,
কবির কলমে কিংবা লেখকের লেখায় -
আমার তেমন ছুটোছুটি নেই,
আমায় তোমরা চিনবেনা।
কোনও এক মহাপুরুষ
তার কাব্যের মোড় ঘুরিয়ে ধরতে আমায় নামিয়ে এনেছিলেন পৌরুষের দাম্ভিক যুদ্ধের মাঝে,
কুরুক্ষেত্রের মাঝবরাবর
আমি একা,
অদ্বিতীয়া হয়ে তোমাদের
কবিকে জিতিয়ে দিলেম
যুদ্ধে, কাব্যে!
অথচ সেই যুদ্ধের পর আমায়
তোমরা খুঁজতে আসোনি!
কবির কাব্যে আমি হারিয়ে গেছি,
কি অবলীলায় সে যুদ্ধে জয় এসেছে, সম্রাট ফিরে পেয়েছেন তার সম্মান…
আর আমি?
অথচ পিতামহের হার ব্যতীত
এ জয় কী করে পেতেন
বাসুদেব কৃষ্ণ?
কী করে ফিরতেন স্বমহিমায়
কুরু সাম্রাজ্যের রাজপুত্রেরা?
আমি সেই
যার উপস্থিতি সমগ্র পুরুষসিংহের গান্ডীবকেও
ভূলুন্ঠিত করে
আমি সেই যার ছদ্মবেশকে
আশ্রয় করে অজ্ঞাত বাস করতেও পিছপা হয়না
বীরশ্রেষ্ঠের পৌরুষের মহিমা!
আমি তবু অসমাপ্ত থেকে যাই
কবির নিষ্ঠুর কাব্যের পরিহাসে!

আজ একবিংশ শতাব্দীর
মাঝে দাঁড়িয়ে
আমি আর এক কুরুক্ষেত্রে অবতীর্ণ,
যোদ্ধা হয়ে মহাকাব্যের পুনর্নির্মাণে!
আমি আমার সমস্ত লজ্জাকে
ছুঁড়ে ফেলেছি
তোমাদের সভ্য কুন্ডের আহুতিতে!
সুনিপুণ পরিচর্যায় অবহেলার গন্ধ মেখে, আমি গড়তে থাকি
মহাকাব্যের এক নবীন গাঁথা!
পৌরুষের মিথ্যে পোষাক ফেলে
আমি আজ কুরুক্ষেত্রের চক্রবুহ্যে ঘর বেঁধেছি;
তোমাদের অলক্ষ্যেই আমি বেড়ে উঠেছি প্রকৃতির লাবণ্য মেখে,
চিনতে পারছো আমায়?
আমি সেই মহাকাব্যের লুপ্ত রাজেন্দ্রনন্দিনী,
যাকে অতীত থেকে বর্তমানেও
আড়ালের ভীড়ে আটকা পরতে হয়,
আমি সেই যার নারীত্বের চাহুনি
তোমার পৌরুষকে করে খর্ব,
আমি সেই যাকে বলতে নেই
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ!”
যার কন্ঠে জেহাদী সুর এলে
গলা টিপে ধরে রাজশাসন!

আমি একে একে খুলে রাখলাম তোমাদের দেওয়া
— নাম
খুলে রাখলাম
— পোশাকের আগল
রাখলাম
— প্রদত্ত লজ্জা, সামাজিক ভয়ের নিয়মনীতি!
খুলে ফেললাম
— খোলসভরা পুরুষত্বের মিথ্যে আস্ফালন!

শেষ যুদ্ধ এখনো বাকি।
নগ্ন দেহের ভাঁজে
আমি তুলে ধরলাম আমার
আত্মপরিচয়,
সেজে উঠলাম অপরূপ দেবীত্বের সাজে।
এক হাতে ধরলাম মোহিনীর সুদর্শণ
অন্যহাতে অর্ধনারীর ত্রিশূল
গান্ডীব উঠলো তৃতীয়ায়
চতুর্থে থাক সভ্যতার নরমুন্ড!
এক লহমায় স্তব্ধ হলো
কুরুক্ষেত্রের হুংকার,
পাঞ্চজন্যে সুঘোষিত হলো
মহাভারতের “শিখন্ডী পর্ব”।।



বিভেদ

সুপ্রিয় দত্ত


কি যেন হারিয়েছি আমি
অনেককাল আগের কিছু হয়তো,
হয়তো সেটি আমার জন্য নয়
তাই সবাই বলে আমি নাকি অভিশপ্ত।।

পুরুষ খাঁচায় নারীর হৃদয়
এটাই নাকি আমার ভুল
আচ্ছা! তোমরাই বলো তো
জন্মের আগেই কত করেছে হত্যা, কন্যাভ্রূণ?

একই দেহে অর্ধ নারীর বাস
একই অঙ্গে রাধাকৃষ্ণ
তোমরাই বলেছো আলাদা করতে
এটি তোমার আমার নয় এটি ঈশ্বরের কর্ম।।

হাতে নয়, ভাবনা দিয়ে গড়েছেন তিনি
তোমায়, আমায়, আর এই ভুবনকে
কী করে করি আমরা একে অপরকে আলাদা?
যদিও বা হতে পারি এক হতে।।

পাষাণ খণ্ড! তারও আছে নাকি জীবন
পূজিত হয় সকলের হাতে।
জড়বস্তুকে নিয়েছো করে আপন
দূরে ঠেলে মোদের সমাজ থেকে।।

আঁধার কণা জীবন আমার
আলোর দিগন্ত নেই নয়নে।
চুপ সাগরেই ডুবতে হবে
কখনও পাবোনা ঠাঁই এই সমাজে?

ছোট্ট থেকেই শিখিয়েছে সবাই
এটা ছেলের কাজ, এটা মেয়ের কাজ।
জানি না কেন হৃদয় দিতো না সাথ বলতো হৃদয়
এটা মানুষের কাজ, এটা অমানুষের কাজ।।

সমাজ তুমি নাম দিয়েছো অনেক আমায়
জীবনের গতি সেই নামের সঙ্গে আজও।
পারলাম না করতে নিজেকে বিভেদ,
আমাতেই দূর্গা আমাতেই শিব
এভাবেই আমি বাঁচবো।।



Tracy Shivangee Sardars

When I sleep gloomy,
while looking for the warmth,
I hug my pillow in the dark room,
In my lonely bed,
Expecting a hand will slowly caress my forehead or may be a kiss on the forehead to make me awake or wishes me a peaceful sleep,
When I sleep gloomy.

The breeze from the window touches my eyes, hands and my body,
Feels like someone is watching over,
From the place where no one goes,
When I sleep gloomy.

A hand holding me tight not letting me loose even when I am at peace,
Voices around the wind tells a story of the war a woman fights alone,
if I can just let my unconscious mind hear them with pain in the eyes and smile on the lips,
when I sleep gloomy.

Tears roll down on my chick without letting me know it's emotions,
when I sleep gloomy




*যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, প্রবাদটি সত্যি হয়ে উঠেছে এক রূপান্তরকামীর জীবনে*
ঋত্বিকা
*লেটস আপ | অসম কথা*

• নদীয়ার বাসিন্দা রিক মালাকার সমাজের কাছে পুরুষ হলেও ছোটোবেলা থেকেই তার ভেতরে লুকিয়ে ছিলো এক নারীসত্তা। তা প্রকাশ ঘটেনি তখনও। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের কটুক্তি শিকার হতে হয়েছিলো আর পাঁচজনের মতো তাকেও।

• কিন্তু সর্বদা তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো রিকের মা। বরাবরই তার নেশা ছিলো রান্নার দিকে। একজন রূপান্তরকামী হয়েও লড়াই সে থামায়নি নদীয়া থেকে চলে যায় বোম্বেতে। বোম্বেতে গিয়েই চাকরি পেয়ে যায় সেখানকার স্বনামধন্য রেস্তোরাঁতে।

• কঠিন যাত্রা শুরু তার সেখান থেকেই। সেখানেও তাকে তারই সহকর্মীদের কটুক্তি শিকার হতে হয়েছিলো। উঠতে-বসতে বৈষম্যমূলক মন্তব্য করতো তারা। কিন্তু থেমে থাকেনি সে। তার কাজের মধ্যে দিয়ে কটূক্তির জবাব দিয়েছিলো।

• আস্তে আস্তে সেই রেস্টুরেন্টের অত্যন্ত ভালো একজন রাঁধুনি হয়ে ওঠে সে। যারা তাকে কিছুদিন আগেই বৈষম্যমূলক মন্তব্য করতো তাদেরই প্রিয়জন হয়ে ওঠে।

• তার পরেই হঠাৎ করোনা পরিস্থিতির ফলে চাকরি চলে যায় তার। লকডাউনে আটকে পড়েন মুম্বাইতেই। পরবর্তী সময় অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার বেঙ্গল সেক্রেটারি রঞ্জিতা সিংহয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে।

• তিনি পুরো ব্যাপারটি শুনে তাকে তাদের শেল্টার হোমে গরিমা গৃহে এক নির্দিষ্ট চাকরির বন্দোবস্ত করে দেন। সেই হোমের থাকা আবাসিকদের রান্না করার দায়িত্ব এখন ঋত্বিকার ওপরে। এত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তার নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে পেরে অত্যন্ত খুশি ঋত্বিকা।

• আগামী দিনের লক্ষ্য বড়ো মাপের রাঁধুনি হওয়া। সমাজে রূপান্তরকামীরাও যে কোনও দিক থেকে পিছিয়ে নয় তারই প্রমাণ হয়ে উঠে এসেছে ঋত্বিকা। আর ৫ জন মানুষের মতো সেও একজন পেশাগত রাঁধুনি।

*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*



 

*প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে রান্নার ব্যবসা শুরু দেবাঙ্গনার*
দেবাঙ্গনা
*লেটসআপ। অসম কথা*

• গতকাল ঈদ-উল-ফিতর এবং অক্ষয় তৃতীয়া উৎসবের আনন্দে মাতলেন রাজ্যবাসী। পাশাপাশি উৎসবের আঁচ পড়লো রূপান্তরকামীদের সেল্টার হোম গরিমা গৃহে।

• কোভিড পরিস্থিতির কারণে সমস্ত রকম প্রোটোকল মেনে, ছোট্ট করে নিজেদের মতো পালন করলেন দিনটি।

• তাছাড়া দিনটি আরেকটি কারণে তাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠলো। তাদের মধ্যেই একজন রূপান্তরকারী দেবাঙ্গনা।

• এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছোট্ট করে একটি রান্নার বিজনেস শুরু করলেন এই দিনে।

• বিশেষত তাকে উৎসাহ দিতে প্রথম দিনই তার কাছ থেকে রান্না করা খাবার কিনে রূপান্তরকারীরা পালন করে দিনটি।

• রান্না করা খাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ব্যবসাটি, এখন বহু সাধারণ মানুষের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

• কিন্তু একজন রূপান্তরকামী হিসেবে এই প্রথম উদ্যোগটি গ্রহণ করলো দেবাঙ্গনা। এবার দেখবার বিষয় সমাজ তাকে কীভাবে মেনে নেয়!

• এই কথা ভেবে দেবাঙ্গনার মতো রূপান্তরকামীরা পিছিয়ে নেই। এইভাবে ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপ নিয়ে রূপান্তরকামী মানুষেরা এগিয়ে চলেছে তাদের লক্ষ্যে।

*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*







*আইন পাস হলেও প্রতিনিয়ত সমাজের অবজ্ঞার শিকার ধ্রুবর মতো রূপান্তরকামীরা*
ধ্রুব
*লেটসআপ । অসম কথা*

• প্রতিনিয়ত প্রতারিত হতে হয় রূপান্তরকামীদের। আইন পাস হলেও সমাজ এখনো হয়তো পুরোপুরি মেনে নেয়নি তাদের! এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলো কলকাতার নিউটাউনের বাসিন্দা বছর ১৪-র ধ্রুবর জীবনে।

• এত অল্প বয়সে অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাকে। তাও খোদ নিজের পরিবারের কাছে। প্রতিনিয়ত তার বাবা তাকে মারধর করতো কারণ একটাই পুরুষ হলেও ধ্রুবর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছিলো তার নারীসত্তা। সেটা মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার।

• এর ফলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মাত্র ১৪ বছরের কিশোর বুঝতে পারেনি কী করবে। থানা পুলিশ করেও কোনও লাভ হয়নি। হঠাৎই কোনওভাবে যোগাযোগ করে অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার বেঙ্গল সেক্রেটারি রঞ্জিতা সিংহের সঙ্গে।

• তৎক্ষণাৎ সেই পরিস্থিতি থেকে ধ্রুবকের রঞ্জিতা উদ্ধার করে ঠিকই। কিন্তু ১৮ বছর না হওয়ায় তারা তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া হোমে, তাকে রাখতে পারেননি।

• এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোথায় যাবে এই বাচ্চা ছেলেটি, তার কারণেই রঞ্জিতা তাদের নিজস্ব হোম আস্থানাতে আশ্রয় দিয়েছে ধ্রুবকে।

• কিন্তু তার কি এখন এখানে থাকার কথা? এই বিষয় নিয়ে রঞ্জিতা বলেন, ১৮ বছরের আগের ছেলে-মেয়েদের জন্য রাজ্য সরকারের হোমগুলি আছে। কিন্তু এই হোমগুলিতে রূপান্তরকামীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না। এমনকি হোমগুলোতে অবহেলিত হয় শিশুরা।

• যার কারণেই হোমে যাওয়ার আগেই এই ছেলে মেয়েদের মধ্যে এক ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। সে বহুবার রাজ্য সরকারকে জানানো সত্ত্বেও রূপান্তরকামীদের জন্য কোনওরকম আলাদা হোম তৈরি করা হয়নি।

• যদিও ধ্রুবকে আপাতত নিজের কাছেই রেখেছেন তিনি। পরবর্তীকালে ধ্রুবর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ধ্রুবর মা তাকে স্বীকার করতে রাজি হলেও সমাজের চাপে পড়ে রাজি হননি তার বাবা।

• প্রতিবেশী সমাজ কী বলবে তার জন্যই নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে নিজের সন্তানকে।

*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*




0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



আমার ভারতবর্ষ- ২

দুর্গগুড়ি

তা হয়ে গেলো প্রায় হাজার দেড়েক বছর। খ্রিস্টিয় ছয়-সাত শতকে এই গ্রামটিতে ছিলো আদি চালুক্যদের রাজধানী। নাম আর্যপুরা বা আইয়াভোলে। আজ যাকে লোকে 'আইহোলে' নামে জানে। উত্তর কর্ণাটকের বাদামির কাছে একটা বিস্ময়কর স্বপ্নপুরী। এককালে এখানে একশো পঁচিশটি মন্দির দেখতে পাওয়া

যেতো। কালের কবলে যাবার পরেও চারদিকে ছড়ানো কতো যে চমকে দেওয়া নির্মাণ উৎসাহী মানুষদের জন্য অপেক্ষা করছে, তার ইয়ত্তা নেই।




ধরা যাক, এখানকার সব চেয়ে বিখ্যাত পুরা নিদর্শনটির কথা। নাম, দুর্গগুড়ি (দুর্গ-মন্দির)। বেশিরভাগ লোকই একে দুর্গামন্দির নামে জানে। কারণ এখানেই আছে আমাদের দেশের একটি প্রাচীনতম ও সুন্দরতম মহিষমর্দিনীর মূর্তি। মন্দিরটির নাম এসেছে 'দুর্গদাগুড়ি' থেকে । এর অর্থ, দুর্গের কাছে মন্দির। বৌদ্ধ চৈত্যের স্থাপত্যে নির্মিত এই মন্দিরটি ছিলো সূর্য, শিব বা বিষ্ণুদেবতার প্রতি নিবেদিত। দ্রাবিড় ঘরানার হলেও উঁচু ভিত্তিভূমির উপর রেখনাগর শৈলীতে নির্মিত শিখর ছিলো এর বিশেষত্ব। পরবর্তীকালে এদেশে হিন্দু মন্দিরগুলিতে এই স্থাপত্যশৈলীটিই সব থেকে লোকপ্রিয়তা পায়।

এই মন্দিরটি সম্ভবত আইহোলের সব থেকে সূক্ষ্ম কারুকার্যময় নির্মাণ। স্তম্ভ, দেওয়াল, প্রদক্ষিণ, ছাদ, সর্বত্র বিস্ময়কর মূর্তি, বাসরিলিফ ও খোদাইকরা কারুকার্য ছড়িয়ে আছে। মন্দিরটি সম্ভবত সাত-আট শতক নাগাদ নির্মিত হয়েছিলো। আমাদের দেশের প্রাচীনতম পুরানিদর্শনগুলির মধ্যে একে স্থান দেওয়া হয়।



চারদিকে স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা প্রদক্ষিণ বা অলিন্দ অংশটিতেই সব চেয়ে বেশি ভাস্কর্যগুলি দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজিতে বৌদ্ধ চৈত্যের ধরনে নির্মিত মন্দিরের মণ্ডপটিকে Apsidal বলা হয়। ভারতীয় স্থাপত্যে এর নাম 'গজপ্রস্থ' শৈলী। হাতির পিঠের মতো গড়ন এর। এই শৈলী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে বৌদ্ধ চৈত্যমন্দিরের অনুসরণে এদেশে শুরু হয়েছিলো। এই মন্দিরের শিখর বা বিমানটির কিছু অংশ এখনও টিকে থাকলেও বিশাল আমলকটি ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমে মুখমণ্ডপ ও তার পর সভামণ্ডপ পেরিয়ে যেতে হয়।

পশ্চিমি চালুক্যরা মন্দিরটি যখন নির্মাণ করেছিলেন, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তখন দেশে গুপ্তযুগের শান-শৌকতের স্মৃতি ম্লান হয়ে যায়নি। উত্তরভারতের প্রতাপী রাজারা ছিলেন কনৌজে যশোবর্মণ, কাশ্মিরে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। ওড়িশায় ভৌমকার বংশের শিবাকর উন্মত্তকেশরী তখন সিংহাসনে। দুর্গগুড়ির সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য মন্দির অবশেষ আমি দেখেছি ভুবনেশ্বরের পরশুরামেশ্বর মন্দিরে। এই দুই মন্দিরে স্থাপত্য বা ভাস্কর্যের উৎকর্ষ নিয়ে কোনও মন্তব্যই হয়তো যথেষ্ট নয়। তবে সেই সময়ের মন্দির স্থাপত্যে মিথুন বা যুগলমূর্তির প্রচলন তেমনভাবে দেখতে পাওয়া যায়না। কিন্তু পশ্চিমি চালুক্যদের দুর্গাগুড়িতে দেবদেবী নিরপেক্ষ যুগল ও মিথুন মূর্তির প্রাচুর্য একটু অবাক করে। এর পিছনে তৎকালীন জনজীবনে বৌদ্ধ তন্ত্র বা শৈব তন্ত্রের প্রাবল্য প্রতিফলিত হয়। পাথরে খোদিত এসব কবিতা তেরোশো

বছর কালের কবলে থাকার পরেও আমাদের চমকে দেয়। বুন্দেলখণ্ডি বা কলিঙ্গ মিথুনকাল্ট তখনও দু-তিনশো বছর দূরে। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে থেকে কয়েকটি নমুনা এখানে থাকলো।


আসলে এইভাবে বর্ণনা দিয়ে এই মন্দিরের কোনও সূত্রই পাওয়া যাবেনা। চোখে না দেখলে প্রত্যয় হয়না আমাদের পূর্বপুরুষেরা এদেশে কী পর্যায়ের শিল্পস্থাপত্য সৃষ্টি করে গেছেন। কেন নিজেকে 'ভারতীয়' ভাবতে গর্ব বোধ করি। হাজার অন্ধকারের প্ররোচনা যেন আমাদের সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে ম্লান না করতে পারে।




                          

0 comments: