Next
Previous
0

গল্প - জয়তী রায়

Posted in




















হস্তিনাপুরের আকাশে বিকেলের রক্তিম আলো, গঙ্গালহরীর উপর শেষ চুম্বনের আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ছে। চরাচর অতিমাত্রায় শান্ত। প্রাসাদের কোথাও কোথাও প্রাণহীন স্তিমিত আলো টিপটিপ করে জ্বালিয়ে দিল কেউ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে নিঃশব্দ শ্মশানের হাহাকার বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যময় হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের অন্দরমহলের প্রধান কেন্দ্রে মহারানীর মহল।
রাজকীয় মহিমার সঙ্গে ছড়িয়ে আছে রুচির প্রাচুর্য। বিবাহের পূর্বে,দুর্যোধন, নিজ পরিকল্পনায় নির্মাণ করিয়েছেন মহলের প্রতিটি কক্ষ। নিছক রাজমহল নয়, তরুণ প্রেমিকের আকাঙ্খার তুলিতে প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে অঙ্কিত ছবির মত সুন্দর বাসস্থান। তেমন একটি কক্ষে স্বর্ণআসনে চুপ করে বসে ছিল ভানুমতী। এটি তাঁর প্রধান শয়নকক্ষ। চতুর্দিকে দর্পণ। মৃদু আলোতে বহুগুণ উজ্জ্বল ভানুমতির বিষাদ মুখশ্রী। এখনো এত রূপ! নিজের উপর ধিক্কার জাগে তাঁর। এই কক্ষ নির্মিত যাঁর স্বপ্ন দিয়ে, যাঁর অঙ্গুলি স্পর্শে বেজে উঠত শরীর, প্রতিটি রাত ছিল নতুন, বিচিত্র কল্পনার ভাবে নিরন্তর বিস্মিত করে দেওয়ার প্রচেষ্টা প্রিয়াপত্নীকে! কোথায় সে এখন! কোথায় তাঁর দুর্যোধন! শুনেছে, প্রাসাদে আগামীকাল প্রবেশ করছে পান্ডব। এই কক্ষ আইনত এখন দ্রৌপদীর! পাঁচস্বামীর সোহাগে সঙ্গমে ভরে উঠবে দুর্যোধনের একান্ত নিভৃত প্রণয়কুঞ্জ।শিউরে ওঠে ভানুমতী। বলা হয়েছে, যা যা আছে গুছিয়ে নিয়ে মাতা গান্ধারীর কক্ষে চলে যেতে। এখন থেকে ওইটি তাঁর পাকাপাকি বাসস্থান। মাতা ছেড়ে দিচ্ছেন প্রাসাদ। চলে যাচ্ছেন অরণ্যে। বুদ্ধিমতী নারী। অপমান সহ্য করতে হবে তিনি জানেন, ধৃতরাষ্ট্র কিছুই বোঝেন না। হয়ত আগের মত হুংকার দিলেন, ক্ষেপে উঠলেন তখন উপেক্ষার হাসি হাসবে পান্ডবপক্ষ। বিশেষ করে ভীম। ভানুমতি শুনেছে, ভীম নাকি প্রস্তাব দিয়েছে চাইলে তাঁর অঙ্কশায়িনী হতে পারে ভানু। এইটুকু কৃপা করতেই পারে সে। শোনামাত্র বাঘিনী হয়ে লাফিয়ে উঠে টুঁটি কামড়ে ধরতে ইচ্ছে করেছিল। জেগে উঠেছিল কলিঙ্গ রাজকন্যার বীরাঙ্গনা রূপ। এখনো হাতে অসি ধরলে... !

ভানুমতির আয়ত চক্ষুদুটি স্মৃতিভারে নত হয়ে আসে। এই শোকবিহ্বল প্রাসাদ পরাজয়ের অসহ্য গ্লানি রঙহীন বৈধব্যের তীক্ষ্ণ অভিশাপ ... গঙ্গার জলে ভেসে যায়... ভানুমতির মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। মনে পড়ে কত কথা মনে পড়ে!

********

দায়া নদী। শান্ত। তিরতির জলধারা দিয়ে ঘিরে রেখেছে কলিঙ্গ দুর্গপ্রাকার।
নদী কত জানে। কত দেখে।
শুধু নদী কেন, অদূরে স্থির গম্ভীর পর্বতশ্রেণী ধূমায়িত শরতের মেঘ বুকে ধারণ করে দন্ডায়মান। কত কিছু প্রত্যক্ষ করে তারা।
এক্ষুনি যেমন কলকল হাসির শব্দে চমকিত ভোরের পাখিগুলি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল প্রাকারের শীর্ষ ছুঁয়ে। রক্তিম সূর্যের মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এমন অফুরান হাসি পবিত্র করে ভূমণ্ডল। হাসির উৎস সন্ধানে চলে যেতে হবে দূর্গচত্বরে রাজক্রীড়াঙ্গনে। যেখানে এখন চলছে মল্লযুদ্ধ। ধূলিধূসর দুটি রমণী শরীর প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে। একটি অল্প স্থুলাঙ্গী অপরজন ছিপছিপে বেতসলতা তরুণী। মল্লভূমি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জনাকয় সুন্দরী যুবতী। তাঁরা কৌতুকে লক্ষ্য করছিল অদূরে অনুষ্ঠিত মল্লক্রীড়া। এঁদের মধ্যে থেকেই একজন কিঞ্চিৎ আদেশের সুরে বলে উঠল--খেলা শেষ হতে চলেছে। উপালা, গাত্রমার্জনী প্রস্তুত রেখো। কর্পূরপানীয় ফল আর মিছিরি তৈয়ারি রাখিস।
উপালা নাম্নী তরুণীটির গভীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় রুষ্ট স্বরে বলল--অপেক্ষা করো দেবীমিত্রা। শেষটুকু দেখেই যাই।
উত্তরে মিত্রা নাম্নী রাশভারি যুবতী কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আবার কলকল ধ্বনি বেজে উঠল। ভূলুণ্ঠিত স্থুলাঙ্গী শরীরের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে ক্ষীণ আকৃতির যোদ্ধা। পরিশ্রমী মুখে ফোঁটাফোঁটা স্বেদবিন্দু। যেন শিশিরভেজা পদ্ম।
সখীদের হাতের স্বর্ণথালিকায় সযত্নে আগলে রাখা সতেজ সুগন্ধি ফুল ঝরে পড়তে লাগল বিজয়িনীর শরীরে। জয়ধ্বনি উঠল--জয়। রাজকন্যা ভানুমতীর জয়। স্বচ্ছন্দ পায়ে প্রস্তর ধাপ বেয়ে উপরে উঠে আসতে লাগল সপ্তদশী রাজকন্যা। সখিদের উদ্দেশ্যে আদেশ করল--শকট প্রস্তুত যেন থাকে। আহারাদি শেষে ভদ্রে কুশারি মল্লকে নিজ গৃহে পৌঁছে দেওয়ার প্রযত্নে ত্রুটি যেন না হয়।

*******

‌ শক্তিশালী সমৃদ্ধিশালী স্বাধীন রাজ্য কলিঙ্গ। সমৃদ্ধ নগর। ঝলমল ভাব। প্রশস্ত রাজপথ। দুইপাশে সুন্দর সাজান অট্টালিকা। মধ্যে মধ্যে বাগান। বিপণি। প্রস্তরনির্মিত দেবালয়গুলির সুউচ্চ চূড়ায় স্থাপিত স্বর্ণকলস রৌদ্রালোকে ঝলমল। সকালের পুজাঅর্চ্চনা শুরু হয়েছে। পুষ্প অগরু ধুপ বেলপাতা চন্দন মিশ্রিত সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। স্বর্ণঘন্টার গম্ভীর মহিমাময় শব্দ পর্বতগাত্র স্পর্শ করে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নগরে। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলির সঙ্গে চরিত্রগত দিক থেকে কলিঙ্গ ব্যতিক্রমী। সমুদ্র- নদী -পাহাড় -ঘেরা রাজ্যটির সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি বেশ ঈর্ষণীয়।
‌ কর্মব্যস্ত নগরী থেকে দূরে রাজসভাগৃহ। সমতল থেকে একটু উঁচুতে ছোট একটি টিলার উপর নির্মিত সুরম্য প্রাসাদ। সাগর হতে তুলে আনা মূল্যবান ঝিনুক আর মুকুতাচূর্ণ লেপন করার ফলে, অপরূপ মণিময়দ্যুতি ঝলক দিচ্ছে সভাগৃহের সর্বত্র। সভাগৃহের আয়তন দৈর্ঘ প্রস্থে ছোটখাটো মাঠের সমান হবে। মাথার উপর সোনার কাজকরা চাঁদোয়া। স্থানেস্থানে মুক্তা আর স্ফটিক নির্মিত ঝালর, সেগুলি বাইরের বাতাসের স্পর্শে বেজে বেজে উঠছে মধুর শব্দে।
‌ সিংহমুখ রাজসিংহাসনের উপর উপবিষ্ট রাজ্যের বর্তমান নৃপতি সর্বাধিনায়ক চিত্রাঙ্গদ। দুধারে সারি দিয়ে বসে আছেন অমাত্যরা। রাজা জনপ্রিয়। রাজা প্রজার সুসম্পর্কের মত বিরল ঘটনাটি অবশ্য কলিঙ্গর ইতিহাসে অপ্রতুল নয়। রাজা চিত্রাঙ্গদ সম্পর্কে শোনা যায় , ইনি নাকি অসীম ধৈর্যবান। হাসিহাসি মুখে জটিল সমস্যার সমাধান প্রায়শঃই করে ফেলেন।
‌ কিন্তু, কন্যার বিবাহ নিয়ে তাঁর মনে ইদানিং দোলাচল চলে। একটিমাত্র কন্যা। বিবাহ সুসম্পন্ন হলে তিনি সুখী হবেন। সমস্যা হল, রাজার কন্যার বিবাহের মধ্যে রাজনীতির প্রবেশ অনিবার্য। এই মুহুর্তে আর্যাবর্তের অবস্থা ভালো নয়। পান্ডব - কৌরবের মত খ্যাতিমান রাজবংশের জ্ঞাতি বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ। কলিঙ্গ মিত্রপক্ষ সম্রাট জরাসন্ধের সমর্থন কৌরব যুবরাজ দুর্যোধনের প্রতি। এইরকম টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে রাজকুমারীর স্বয়ম্বর! চিন্তার কারণ আছে বইকি।

*******

‌ রাজকন্যা ভানুমতী। রাজার অতি আদরের কন্যা। তাঁর মহলে প্রবেশ করলেই মন ভালো হতে বাধ্য। ঐশ্বর্য এখানে প্রকট নয়। সোনা হীরে জহরতের ঝলকানি দেখা যায়না। বরং শোভন সরল রুচিসম্মত উপায়ে সজ্জিত। বাতাবরণ পূর্ণ মৃদু চন্দন সৌরভে। সেইসঙ্গে মহল সংলগ্ন উদ্যানের থেকে ভেসে আসে ফুলের সুগন্ধ।
‌ মহল জুড়ে কক্ষের পর কক্ষ। বসবাস নিমিত্ত নির্দিষ্ট কক্ষগুলি ছাড়া, সুন্দর সুচারু রূপে রাখা আছে, পাঠকক্ষ। নৃত্য সঙ্গীত কলা শিক্ষাকক্ষ। এমন প্রায় দুইশত কক্ষ আছে মহলে। রাজকন্যার গুণের অবধি নেই। নৃত্য এবং সঙ্গীত -- দুটিতেই সে পারদর্শী। এছাড়া আরো একটি দুর্লভ গুণ হল, সে একজন মল্লবিদ। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রনীতি , গণিত এবং কাব্য সাহিত্য চর্চায় সে সমান আগ্রহী।
‌ সারাদিন মল্লযুদ্ধে কেটে গেছে। মধ্যাহ্ন আলাপচারিতা রমণীমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এখানেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সোনার কারুকার্য করা ছোটছোট মখমল আসনে উপবিষ্ট অভিজাত কুমারীর দল। এঁরা রাজকুমারীর সখী। রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কন্যা। ময়ূরপাখা আন্দোলিত হচ্ছে মৃদুমৃদু। কেউ কেউ কাব্য রচনা করে পড়ে শোনানোর চেষ্টা করছে। কেউ বা নিজের পরিহিত বস্ত্রের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছে। কেউ তাম্বুল খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে দর্পণে নিজেকে দেখছে। স্বল্পবাক ভানুমতী অর্ধশয়ান ভঙ্গিতে উপবিষ্ট নিজ আসনে। আজকের প্রধান আলোচ্য বিষয় পন্ডিত বিদ্যাভূষণ এবং তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী! রাজকুমারীর প্রিয়সখী সুপ্রিয়ার হাসি আর থামে না। মহামাত্য কন্যা সুপ্রিয়া রাজকুমারীর কাছের মানুষ। সে বলেই চলেছে--ওহে ভানু। ওহে ভানু। কি হবে গো তোমার!
‌ভানুমতী অপ্রতিভ মুখে চুপ করে আছে বটে কিন্তু দুই চোখে ফুটে আছে অসংখ্য প্রশ্ন। সে ধমক দিয়ে বলে-- তুই থামবি সুপি। মহামতি বিদ্যভুষণের এমন দুর্মতি হল কেন , ভাবছি তাই।
‌হাসি চাপার অক্ষম প্রয়াসে সুপ্রিয়ার গৌরবরণ মুখ পলাশ রঙ ধারণ করেছে। চাঁপাকলি আঙ্গুল হেলিয়ে
দুলিয়ে সে বলে--ভেবে আর কিছু হবে না গো সখী। আগামী বসন্তপঞ্চমীর দিন ধার্য হয়েছে তোমার স্বয়ম্বর। বিদ্যাভূষণের অব্যর্থ গণনা অনুযায়ী ঘটনা ঘটবে ওই দিন। প্রস্তুত থেকো।
‌ সামনে মানুষ প্রমাণ স্ফটিক দর্পণ। নিজেকে দেখছিল ভানু। নারীসুলভ সৌন্দর্যে তেমন বিশ্বাস করে না সে। অন্যমনস্ক ভাবে দেখে, তাঁর উজ্জ্বল ত্বক। কটিদেশ অতিক্রম করা ঘন কেশরাশি। শরীরের ঈষৎ পুরুষালী গঠন। বিশাল দুটি চক্ষুতে অলজ্জ ঋজু দৃষ্টি।
‌--কি দেখো সখী?
‌ভানু দেখছিল তাঁর মৃণালের মত সুগোল কমনীয় মণিবন্ধ। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে তির্যক গম্ভীর সুরে বলে--নিতম্ব বা স্তনের সৌন্দর্য দেখছি না। মল্লবিদ্যা, শরসন্ধান, ভারোত্তোলন সব শিখেছি , সে কি এমনি?
‌ মহামতির গণনা যদি সঠিকও হয় , তবে তুই কি মনে করিস? জেনে রাখ, দশজন পুরুষকে ধরাশায়ী করাও আমার কাছে কিছু নয়! আমাকে অপহরণ করবে এমন সাধ্য কার!
‌হেসে কুটিপাটি হতে গিয়ে রাজকন্যার রুষ্ট মুখ পানে চেয়ে ধীর গলায় বলে সুপ্রিয়া--যে ভাবেই তোমার বিবাহ হোক, আমার শর্ত ভুলে যেও না।
‌ অমাবস্যার আকাশে চাঁদের আলোর মত হাসি ফুটল রাজকন্যার মুখে--আমার স্বামীর প্রিয়সখা যিনি, তিনি হবেন তোমার স্বামী... তাইতো? যদি তিনি বৃদ্ধ পক্ককেশ আর মূর্খ হন, তবু?
‌ছদ্মরাগ দেখিয়ে সুপ্রিয়া বলে--
‌--হ্যাঁ। তবু।
‌-- তাহলে আগামী বসন্ত পঞ্চমী?
‌--আগামী বসন্ত পঞ্চমী।

********

মহাসমারোহে এগিয়ে এলো স্বয়ম্বরের দিন। গান্ধার, মদ্র , মিথিলা, চেদি, অবন্তী, মগধ, বৎস, কোশল, হস্তিনাপুর- বিশেষ আমন্ত্রিতের তালিকায় আছেন মগধসম্রাট জরাসন্ধ।
‌ জরাসন্ধের বয়স ভানুমতীর দুইগুণ। উপযুক্ত পুত্র, দুই কন্যা ... সংসার পূর্ণ। তবু, শ্রীমৎ জরাসন্ধের আত্মীয়তা কামনা করে কলিঙ্গ। দুইরাজ্যের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের প্রাচীন প্রথা কন্যাদান।
রাজার মূল্য তাঁর যোগ্যতায়। বয়স এখানে বিবেচ্য নয়।
‌ ভারতবর্ষ টালমাটাল। রাজায় রাজায় রেষারেষি তুঙ্গে। ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় সমাজ স্পষ্টত দুটিভাগে বিভক্ত। একদিকে আছেন মগধ অধিপতি জরাসন্ধ এবং তার অনুগামীর দল। যেমন , শিশুপাল কংস নিষাদ রাজ একলব্য। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন। কলিঙ্গরাজ নিজেও জরাসন্ধের পক্ষে। অন্যদিকে আছে যদুবংশীয়রা। তাদের মিত্র বাহিনী হল, রাজা দ্রুপদ - পান্ডব -বৃষ্ণী, সর্বোপরি যদুকুলপতি কৃষ্ণ।
রাষ্ট্রের এমন অবস্থায় বিবাহ একটি গুরুতর বিষয়। পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী আর কলিঙ্গ রাজকুমারী ভানুমতী--কূটনীতির পাশা খেলায় দুটি কন্যাই উৎকৃষ্ট ঘুঁটি। দ্রৌপদী লাভ হয়েছে পান্ডব ভাগ্যে। এখন ভানুমতীর স্বয়ম্বরসভা কৌতুহলের কেন্দ্রে।

********

বসন্ত পঞ্চমী।
কলিঙ্গ রাজ্যের চতুর্দিকে উৎসব। কোনো ত্রুটি নেই আয়োজনে। অতিবড় নিন্দুক পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, মহারাজ চিত্রাঙ্গদ ছাপিয়ে গেছেন পাঞ্চালরাজ্যের অহঙ্কার। কলিঙ্গকন্যার সঙ্গে কিসের তুলনা!
রাজ অন্দরমহলে চলেছে প্রসাধনের তুলির শেষ টান। মাল্য চন্দন আর স্বর্ণালঙ্কার ভূষিতা রাজকন্যার পরণে, স্বর্ণজরি খচিত সূক্ষ্ম রক্তবর্ণের দুকূল। স্তনপট্ট থেকে শুরু করে উর্ধাঙ্গের উত্তরীয় স্বর্ণ আর রক্তবর্ণের মিশেল। সখীরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাজকন্যা আজ অপ্রতিহত। সাক্ষাৎ রতিদেবী। স্বয়ম্বর সভার সমস্ত পুরুষ মদন শরে নিহত হবেন একথা নিশ্চিত। সুপ্রিয়া বলল:
--চলো সখী। সময় হল।

সভা আলো করে বসে আছেন প্রতাপশালী রাজারাজড়া। স্মিতহাস্য। মণি মুক্তা অলংকার শোভিত। অভিজাতভঙ্গি। শতশত দাস দাসী নিয়ত সেবা করে চলেছে। চামর দোলাচ্ছে যুবতীরা। কস্তুরীর সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। মুহুর্মুহু ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে শীতল গোলাপজল। সামনে সিংহাসনে আসীন রাজা চিত্রাঙ্গদ। মুখে স্মিত হাসি। সম্মানিত অতিথিদের দিকে সজাগ দৃষ্টি।
দুর্যোধন নিজ আসনে বসে আছে। সঙ্গে আছে সুহৃদ কর্ণ। এমন সময় বেজে উঠল নানাধরণের বাদ্যযন্ত্র। পুলকিত ঘোষক তারস্বরে ঘোষণা করতে লাগলেন রাজকুমারীর আগমন বার্তা। উৎসুক অতিথিবৃন্দ শেষমুহুর্তে ভঙ্গি পরিবর্তন করে নিজেদের আকর্ষক করার চেষ্টায় ব্যস্ত। সকলের তৃষিতচক্ষুর সামনে সখীসহ প্রবেশ করলেন রাজকুমারী ভানুমতী। সভাগৃহ ভরে উঠল রঙে রঙে। কত ধরণের। রঙের তরঙ্গ। বেজে উঠল সুর। রমণী শরীরের বিভঙ্গ ঘিরে জেগে উঠল ঢেউ। দৃষ্টিমাত্র পৃথিবী দুলে উঠল দুর্যোধনের। দীর্ঘ দীর্ঘ দূর পার হয়ে জেগে উঠল সে। কন্যার মুখে স্বচ্ছ ঊর্নার আড়াল। তথাপি এমন ব্যাকুলতা! ঐ কন্যার দৃঢ়চলন দেহের বিভঙ্গে আত্মপ্রত্যয় ইনি নিয়মিত শরীরচর্চা করে থাকেন? হিসাবশাস্ত্র , ন্যায়শাস্ত্র ... সর্বক্ষেত্রে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করেছেন। ইনি প্রকৃত অর্থে সহধর্মিণী হতে পারার যোগ্য। বরমাল্য হাতে এগিয়ে আসছে ভানুমতী। বুকে কাঁপন জাগে। এ কন্যা চাই ই চাই। বরমাল্য থামে। চম্পক অঙুলির হেলনে দুলেও ওঠে। দুরন্ত সুগন্ধ ঘিরে ধরে দুর্যোধন চেতনা। ঘোষক প্রাণপণ বলে চলে---
মহাধিপতি কৌরব কুলতিলক যুবরাজ দুর্যোধন। মহাবীর। মহাযোদ্ধা। উচ্চ বংশ ...
ভানুমতী শুনছে না। অপেক্ষা করছে না। উপেক্ষার ঝঙ্কার তুলে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে, সাপরিষদ বসে আছেন মগধসম্রাট। নাকের পাটা ফুলে উঠল দুর্যোধনের। তুমি আমার। যদি বিবাহ করি, তবে তোমাকেই... আর কেউ না। কখনো না।
বাঘের মত লাফিয়ে ওঠে। পরোয়া নেই আজ। কর্ণ আছে। সে সামলে নেবে। কিছু বোঝার আগেই ভানু দেখল সে শূন্যে। চরকির মত বৃত্তের চারপাশ ঘুরেই বাইরে ছিটকে পড়ল দুর্যোধন। শিক্ষিত সারথির কানে পৌঁছে গেল প্রভুর আদেশ। পলকের মধ্যে হাজির রথ। রাজকুমারী সহ বায়ুবেগে উড়ে চলল রথ। পিছনে ধেয়ে আসা ক্রুদ্ধ জনকলরোল দমন করতে মহাবীর কর্ণ একলাই যথেষ্ট।

*********

রাত গভীর। স্তব্ধ হস্তিনাপুর নগরী। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে প্রাসাদের মর্মর সৌধ। অলৌকিক আলোয় স্নান করছে দুজন নারী পুরুষ। চিনে নিচ্ছে পরস্পরকে। নারী অভিমানী। পুরুষ ক্ষমাপ্রার্থী।
---চেয়ে দেখো প্রিয়ে। প্রকৃতি আজ নরম। নতজানু। এখনো মুখ ফিরিয়ে থাকবে?
---ওমন করে হরণ করে কেউ?
---ওমন করে উপেক্ষা করে কেউ? আমিও সম্রাট হব একদিন। তুমি হবে সম্রাট মহিষী। ভারত নায়কের একমাত্র মহিষী। দ্বিতীয় নারী আসবে না জীবনে। তুমি আমার প্রেম, ভানু। আমার সাহস। শক্তি। আমার প্রেয়সী।
প্রেয়সী! রাজারকন্যা সে! ছোট থেকেই জানে ভবিতব্য কি হয়! রাজার জীবনে বহু রানীর মধ্যে একজন অথবা প্রধানা হয়ে থাকা তাঁদের বিধিলিপি...সেখানে প্রেয়সী! একমাত্র নারী! স্বামীর নিবিড় আলিঙ্গনে ডুবে যেতে যেতে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।
কথা কত কথা .… স্বপ্নের কথা। বিষাদের কথা। প্রতারণার কথা... পরতে পরতে নিজেকে উন্মোচিত করতে থাকে দুর্যোধন। রাত ফুরোয়। কথা বাকি থাকে। প্রতীক্ষা হৃদয়ে নিয়ে শুরু হয় আবারো প্রতীক্ষা। চাঁদের শেষ আলোটুকু শরীরে মেখে নিয়ে পুরুষ বলে--
-- ভারত সম্রাট হতেই হবে আমাকে। তুমি দেখো, কেমন করে বিজয়ীর মুকুট পরে তোমার সামনে এসে দাঁড়াই।
ভানুমতী দেখে, এক স্বপ্ন দেখা মানুষ। রাজা নয়। শিল্পী। কল্পনার তুলিতে এঁকে চলেছে ভবিষ্যত। চোখ দুটি সুদূরে প্রসারিত। কত দূর পর্যন্ত দেখছেন রাজা।
---অনেক কাজ ভানু। অনেক কাজ। পরিবর্তন করতে হবে শাসন ব্যবস্থার। কৌরবসেনা এখন অজেয়। আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

***********

কেটে গেছে দীর্ঘ ঋতুকাল।
দুটি সন্তানের জননী এখন ভানুমতী। কন্যা লক্ষ্মণার বিবাহ সম্পন্ন হয় দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণের অতি সুদর্শন পুত্র শাম্বর সঙ্গে। আর পুত্র লক্ষ্মণ ? ইতিমধ্যে নিজেকে প্রমাণ করেছে যোগ্য হিসেবে।
সময় কাটছে ভানুমতীর...অন্দরমহলের দায়িত্ব কম নয়। এখানেও রাজনীতি আছে। আছে পারস্পরিক ঈর্ষা। রাজমাতা গান্ধারী উদাসীন। রাজঅন্তপুরের ছলনা কপটতা কূটনীতি অভিযোগ অভিমানের প্রবল ধাক্কা আছড়ে পড়ে তাঁর উপর। ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে--কাব্যচর্চা, শরীরচর্চার দুরন্ত দিনগুলি মনে পড়ে। সে অবুঝ নয়, ক্ষত্রিয় রমণী, স্বামী দুর্যোধন এখন আগামী দিনের সম্রাট হবার লক্ষ্য স্থির। সেখানে নিজের একাকীত্ব নিয়ে ভাবতে বসলে চলে? দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ -যুবক দল এখন রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছে। যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে। রাজসভায় আজকাল তেমন কেউ আসে না। সারাদিন রাত মন্ত্রণা কক্ষে কেটে যায় সকলের। সম্বাদ প্রতিনিয়ত আসছে। পান্ডব অরণ্য হতে ফিরে নতুন করে সাজিয়েছে ইন্দ্রপ্রস্থ। শুনেছে, পাটরানী দ্রৌপদীর ইঙ্গিত বিনা একটি কথা বলার ক্ষমতা কেউ রাখে না! এমন কোন অলৌকিক উপায় জানা আছে ঐ নারীর? অরণ্যবাসের মত কঠিন সময়েও সে থাকে স্বামীদের সঙ্গে। রাজনীতির পরামর্শে আছে অধিকার। এখন রাজ্য চালনার মন্ত্রণাসভায় সে উপস্থিত থাকে। আর, এই যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ? শ্রীকৃষ্ণ! শুনেছে তিনিও না কি সখীর অভিমানের কাছে নতজানু। গোটা রাষ্ট্রের আনাচে কানাচে আলোচিত দ্রৌপদী নাম।
আর ভানুমতী? বিবাহ পূর্বের কথা মনে পড়লে বিস্ময় জাগে। একজন পুরুষের সমকক্ষ ছিল সে। আজ সাধারণ রাজঘরণী মাত্র। অভিমানে বিদীর্ণ হয় ভিতর। তীব্র অভিমান। দুর্যোধন সময় পায় না। সন্তান সময় পায় না। দায় আর দায়িত্বর শিকল আরো বেদনার। ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে। কিঙ্করী খবর দেয়--- বস্ত্র আর অলঙ্কার নিয়ে শ্রেষ্ঠী নিজে এসেছে। দিন কতক পরে পাশা খেলার আয়োজন করা হয়েছে। আমন্ত্রিত পান্ডবের সঙ্গে থাকবে দ্রৌপদী।

********

অক্ষক্রীড়ার জন্য রাজকীয় আয়োজন চলছে হস্তিনাপুর জুড়ে। কোনো ত্রুটি যেন না থাকে। দুর্যোধন প্রমুখের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। মনের ভিতর সন্দেহ দানা বাঁধছে। নিছক প্রমোদ ক্রীড়া হতে চলেছে? না কি আরো ভয়ানক কিছু! দুর্যোধন ভুলেও আসছেন না এদিক পানে। মন্ত্রণাগৃহের কপাট বন্ধ। ভিতরে শকুনি কর্ণ আর দুঃশাসন। ভানুমতীর ব্যক্তিগত গুপ্তচর অপালা অতন্ত্য চতুর। সে এবং তার অধীন সংবাদ বাহিকার দল কাজ করে নিপুণ। তথাপি ব্যর্থ তারা। রাজমন্ত্রণাগৃহের আশে পাশে ছায়া প্রবেশের অনুমতি নেই।

অপালা বিরক্তির সঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করে। শারীরিক সমস্ত রকম ছলাকলা প্রয়োগ করেও দ্বারের প্রহরীর গম্ভীর চক্ষু টলাতে পারেনি। সে রাগত স্বরে বলে-- মাতুলের ফন্দি। রানী মা, মাতুল শকুনি মস্ত বিপদ বাঁধিয়ে ছাড়বে এই বলে দিলুম।
ভানুমতীর প্রধানা সহচরী মিত্রা মৃদু তিরস্কার করে---থামো অপালা। নিজের কাজ করো। বহু অতিথি সমাগম হচ্ছে রাজধানীতে। এখন অনেক কাজ। ভানু চুপ করে রইল। দ্রৌপদী আসছে। লক্ষযোজন জুড়ে পদ্মগন্ধ ছড়িয়ে আসছে গর্বিতা নারী। কিছুদিন আগে সম্পন্ন হয়েছে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ। সে না কি এলাহী কান্ড। ময়দানব নির্মিত ইন্দ্রপ্রস্থ সভাগৃহ হার মানায় দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভাকে। সেখানে দুর্যোধন তুমুল অপদস্থ হয়েছে, সে কথা কানে এসেছে তাঁর। দ্রৌপদীর প্রবল উপহাস শানিত ছুরিকা হয়ে বিদ্ধ করেছে স্বামীর হৃদয়। ভানু এইটুকু জানে , দুর্যোধন কঠিন অভিমানী। অভিমান হলে জলবিন্দুটুকু স্পর্শ করে না। সহজে ভুলতে পারেন না অপমান। তাঁর সম্মান হানি করল ঐ দর্পিতা নারী? দুর্যোধন তিনরাত্তির বিনিদ্রিত ছিলেন।একটা শব্দ উচ্চারণ করেন নি। আষাঢ়ের মেঘের মত গম্ভীর মুখ। থমথম। সেই তিনি কি না রাজকীয় আয়োজন করছেন পান্ডবদের জন্য? সমাদর করে নিয়ে আসছেন দ্রৌপদীকে? এ ও সম্ভব? বিশ্বাসযোগ্য? ভানু ছটফট করে। কোথাও গরমিল আছে। আছে ফাঁকি। অরণ্যে পেতে রাখা ফাঁদের মত। উপরে নরম সুন্দর ঘাসের আস্তরণের নিচে মরণ গহ্বর! প্রিয়বান্ধবী সুপ্রিয়া এখন অঙ্গরাজ কর্ণের পত্নী। অঙ্গরাজ্য হতে সে আসছে আমন্ত্রিত হয়ে। সুপ্রিয়া বুঝবে। রহস্য ঠিক কোথায়? ভানু অপেক্ষা করে। উৎকণ্ঠিত চোখের সামনে দিন কাটে অথবা কাটে না।
কত কথা মনের গভীরে আছে লুকিয়ে। সুপ্রিয়া ছাড়া কাকে বলবে সে! মন ভালো নেই। মন ভালো নেই। উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে দেখা যায়, আকাশ জুড়ে মেঘ করে এসেছে ঘন হয়ে। এমন কত মেঘমেদুর রাত যাপন করেছিল দুর্যোধন সঙ্গে। সে সব শুধুই স্মৃতি। রাজনীতির কুটিল আবর্ত গ্রাস করে নিয়েছে অনেক কিছু। অনেক নরমমুহুর্ত। উষ্ণসঙ্গ। প্রেমের মধুরক্ষণ।

********

সুপ্রিয়ার স্বভাবটি পাহাড়ি নদীর মত চঞ্চল। ছলছল। কর্ণ অধিকাংশ সময় থাকেন হস্তিনাপুর। বিরহবোধ থাকলেও সুপ্রিয়া হাসিমুখে থাকে। বুদ্ধিমতী নারী জানে কতটুকু কোথায় চাইতে হয়! দুইসখী পরস্পরকে আঁকড়ে রইল অনেক্ষণ। চোখেরজল মুখচুম্বন সমাপ্ত হলে সুপ্রিয়া প্রশ্ন করে---সত্য বলো সখী। তোমার কি হয়েছে?
ভানু ক্লিষ্ট হেসে বলে---কই! কিছু না। জ্বলজ্বলে দুটি চোখ ভানুর উপর স্থাপন করে সুপ্রিয়া বলে--- গোপন করবে কেন? মনের কথা মনে রাখতে পছন্দ করো জানি। ছোট হতে দেখে আসছি। আমি যেমন চলবল তুমি ততোখানি নীরব। কিন্তু, আজ গোপন করোনা। কষ্ট বাড়বে।
বলা যায়? সব কথা বলা সম্ভব? পান্ডব আমন্ত্রণ ঘটনা অস্বাভাবিক লাগছে। কিভাবে বোঝাবে সে কথা? সুপ্রিয়া নিজেই বুঝে নেয় নিজের মত করে। ভানুর হাতের উপর হাত রাখে। নিবিড় স্বরে বলে---দেখো ভানু, এখন তোমার একটাই কাজ। দ্রৌপদী সমাদর। তিনি অতিথি। দেখো, কোনো অমর্যাদা যেন না হয়!

*********

সর্বনাশের চেহারা এত ভযঙ্কর হবে, ভানুমতী ভাবতে পারেনি। সেইদিন থেকে সুস্থবোধ করছে না সে। আজ কতদিন হয়ে গেল! কত জল বয়ে গেল গঙ্গানদী দিয়ে। রাজ্যহারা সম্পদহারা পান্ডব, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ আসন্ন। কে যেন ঘোষণা করে মহারাজ দুর্যোধন এসেছেন। ভানুমতী উঠে দাঁড়ায়। কিঙ্করী ছুটে আসে। হাত নেড়ে মানা করে সে। যেমন আছে, তেমন থাকুক। তেমন দেখুক স্বামী। এমন এলোমেলো। এমন সাধারণ। দুর্যোধন বিব্রত স্বরে বলে
---তোমার সঙ্গে কথা আছে ভানুমতী। এমন আচরণ কেন তোমার?এ ঘটনা নিছক রাজনীতি মাত্র। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কেন আসে দ্রৌপদী?
খর চোখে তাকায় ভানু। চোখের নিচে গাঢ় কালিমা। ঘুম আসে না। নরম শয্যায় অফুরান আরামের মধ্যেও চক্ষু বুজলে সে এসে দাঁড়ায়। রক্তাক্ত আহত বাঘিনী। দুটি হাত পাখির ডানার মত ছড়িয়ে উড়ে উড়ে পালাতে চাইছে। সর্বশরীরে অত্যাচারী শিকারির নখের দাগ। কে যেন নির্মম ভাবে নির্যাতন করে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। যোনি হতে বাহিত রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে অন্দরমহলের মর্মর হর্ম্যতলে। ক্ষতবিক্ষত শরীর। দুঃশাসনের কর্কশ টানে খুলে গেছে মেঘ- কুঞ্চিত- কেশরাশি। অন্ধের মত ছুটে আসছে নারী। বাতাসে উড়ছে চুল। পরিধেয় ছিন্ন। পিছনে উন্মত্তের মত ধেয়ে আসছে কালান্তক পুরুষ। তার দেবর। সেই দেবর, যে কিনা ভানুমতীর পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আজ সে উৎকট চিৎকার করছে। হা হা করে হাসছে। লোমশবাহু দিয়ে টেনে খুলে দিল বসন। উন্মুক্ত স্তন। দুঃশাসন বলছে--- বেশ্যা। বেশ্যা। তুই বেশ্যা। কে বাঁচাবে তোকে? কৌরব পুরনারী? হা!
নাহ। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ আবৃত করেনি নগ্নশরীর। ভানুমতী নিজেও চুপ করে ছিল। কেন ছিল?
কেন? কেন? তবে কি সে ও ছিল ঈর্ষায় আক্রান্ত? হায় মহাদেব। মানুষ নিজেকে সবচেয়ে কম চেনে!
স্বামী বলছেন, দ্রৌপদী ঘটনা নিছক রাজনীতি। দাম্পত্য সম্পর্কে পড়বে কেন ছায়া?

-- ভুল। স্বামী! ভুল! রাজনীতি হবে সমানে সমানে। নারীর বস্ত্রহরণ রাজনীতি হবে কোন হিসেবে? আপনার সেদিনের মর্ষকামী রূপ আমার অচেনা। কে জানে! সঙ্গমকালে মনে আসে কি না দ্রৌপদী -মুখ!
-ভানু! স্তব্ধ হও।
পত্নীধর্ম পালন করো।
---আর অভিশাপ! আমার সংসার ছারখার হয়ে যাওয়ার অভিশাপ! ভুলতে পারিনা।
---ক্ষত্রিয় রমণী ভয় পায় অভিশাপে? ভুলে যেও না, দ্রৌপদী সরলা অবলা নারী নয়। অন্যায় কিছু কম করেনি সে। বিচার করে দেখো।
ভানুমতী চেষ্টা করে। স্বামীর বিশ্বাসে নিজেকে ঢেলে নিতে।
বিষাক্ত জ্বলন অনুভূত হয় ভিতর অবধি। দ্রৌপদী কে? অহঙ্কারী দর্পিতা রমণী। কিসের অহঙ্কার? কোনো অংশে কম নয় সে। অথচ দেশের আনাচ কানাচ জুড়ে উচ্চারিত দ্রৌপদী নাম। পান্ডব যদি দ্রৌপদী ধনে ধনী তবে নয় কেন ভানুমতী সম্পদ কৌরবের? কিসের আস্পর্ধা এত! পাশা খেলার সময় এলো হস্তিনাপুর, ঠিক করে কথাই বলে নি কারো সঙ্গে। আপনমনে থাকত। পঞ্চস্বামী গর্বে গর্বিতা। অথচ বিপদ কালে কোনো স্বামী এগিয়ে এলো না রক্ষা করতে। তবু, এত অহঙ্কার! ভানুমতী শূণ্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। খচ খচ খচ ফুটতে থাকে কাঁটা। সমগ্র ভারত যেন অঙ্গুলিনির্দেশ করে তার দিকে---ঐ দেখো ভানুমতী। ঐ দেখো অপরাধী মহিষী। অপরদিকে শতহীরের দ্যুতির মত জ্বলজ্বল করে দ্রৌপদী মুখ। ভবিষ্যত ভারত -নায়কের মহিষীর মুখ। ভানুমতী শেষপর্যন্ত প্রতিনায়কের মহিষী?
কোথা হতে ভেসে আসে দুর্যোধন কন্ঠ--ভানু। ভানু। এদিকে তাকাও। আমি চলে যাচ্ছি। কথা বলো।
চমক ভেঙে যায়। মৃদু স্বরে উত্তর দেয় ভানুমতী---জয়ী হয়ে ফিরে আসুন সম্রাট।

-- আর মৃত্যু হলে? একবার আগের মত চুম্বন করবে না আমায়? একবার তোমার উষ্ণ আলিঙ্গন দাও আমায়। সেই উদ্দাম রাতগুলি একটিবার ফিরিয়ে দাও।
--বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে সম্রাট।
---এত অভিমান! যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাব। কতদিন দেখা হবে না। আর হবেই কি না কে জানে?
গালে হাত ছুঁয়ে গাঢ় স্বরে ডাকে দুর্যোধন--ভানু। রানী আমার। দ্রৌপদীর ঘটনা ভুলে যেতে পার? ক্ষমা করতে পার?
ভানুমতী চুপ করে থাকে। উত্তরের প্রত্যাশায় চেয়ে আছে দুর্যোধন। কি সুন্দর লাগছে। বর্ম শিরোস্ত্রান লৌহজালিকা--যুদ্ধবেশ পরিধান করে দৃপ্তপৌরুষে ঝলমল। ব্যগ্র আগ্রহে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটি মলিন হয় ধীরে ধীরে। নত কণ্ঠে বলে দুর্যোধন--মায়ের আশীর্বাদ পাইনি। তিনি মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। তোমার ভালোবাসা পেলাম না। তবু, তোমার কাছে যেন ফিরে আসতে পারি এই আশায় আমি রইলাম।

*********

বেজে উঠল যুদ্ধের জয়ডঙ্কা ।যুগোত্তম নায়ক শ্রীকৃষ্ণর স্বপ্ন সার্থক রূপ ধারণ করতে লাগল কুরুক্ষেত্রের ময়দানে। তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি , সাহস আর বীরত্বের সামনে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল বিরোধী শক্তি।
সঞ্জয়ের কাছে যুদ্ধ- বিবরণ শুনতে শুনতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন ধৃতরাষ্ট্র। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরাজিত হচ্ছে কৌরব? ব্যাকুল পিতা টলমল পায়ে ছুটে যাচ্ছেন এদিক ওদিক। দুর্যোধন কোথায়? আমার পুত্র কোথায়? হাহাকার শুনে স্তব্ধ, মাতা গান্ধারী।
প্রতিটি সংবাদ ভালো করে শুনছে ভানুমতী। পরিষ্কার বুঝতে পারছে এই যুদ্ধ পান্ডব- কৌরবের নয়। কৃষ্ণ এবং কৌরবের। জয়ী হবার সম্ভাবনা কমে আসছে ক্রমাগত- সে কথা রাজধানীর অন্দরমহলে বসেও বলে দেওয়া যায়। এর মধ্যে খবর এলো নিহত হয়েছেন মহাবীর কর্ণ। সুপ্রিয়া! সখী। আর্তস্বরে কেঁদে ওঠে কে? ভানুমতী ছুটে ছুটে যায় প্রাসাদের চারিদিক। অন্তঃপুরিকাদের সেবা করে। তরুণী রানিদের রাজকীয় শৃঙ্গার খসে খসে পড়ে। এই তো সেদিন কত আলো কত অলঙ্কার। আজ তারা একে একে শূণ্য মরুভূমির পথে হেঁটে যায়। নতমুখী তরুণীগুলির নীরব শোক ঘিরে থাকে ভানুমতীর চারিদিক। রাজসভা নিষ্প্রভ। আলো জ্বলে না। বিশাল কক্ষগুলি জুড়ে ঘুরে বেড়ায় বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে একদিন সম্বাদ আসে।

*******

কুরুক্ষেত্র। বাতাসে এলোমেলো দুর্যোধনের কেশ। ভানুমতী সযতনে সরিয়ে সাজিয়ে দেয় আবার। রাজার মুদিত চক্ষুর উপরে উড়ে এসে বসে ছোট পতঙ্গ। তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে মুছে দিতে থাকে মুখ। প্রশান্তির ছায়া নিয়ে ঘুমন্ত মুখখানি পরম সুন্দর।
ঊরুদেশ ক্ষতবিক্ষত। এখানেই আঘাত করেছিল ভীম? আহা। চূর্ণবিচূর্ণ অস্থি। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ধুলো বালি সরিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ভানুমতী। ধূলিশয্যায় শায়িত স্বামী। ওষ্ঠের বঙ্কিমরেখায় এখনো অহঙ্কার। অভিমান। এখনো শৌর্য। অস্তসূর্যের আলোয় ঝলমল করছে রাজকীয় ভঙ্গিমা। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সে। এমন আর কেউ না। কেউ না। এখনো যদি জেগে ওঠে এখনো যদি গদা হাতে দাঁড়ায় এখনো যদি বলে ওঠে রাজকীয় কণ্ঠে--এ রাজ্য আমার। একমুঠি ধূলিকণা কেউ নিতে পারবে না।
চিতা সাজানো চলছে।
শুষ্ক চোখে দেখে ভানু। কোথায় যাবে তার রাজা? সংসার সমুদ্রে এতদিন ভেসে ছিল দুজনে একসঙ্গে। কত ভাব বিনিময়। সেই কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ মান অভিমান। শরীরে শরীরে বেজে উঠত শঙ্খ। হৃদয়ের সুউচ্চ মিনারে গভীর জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গেছে কতদিন। এখনো রাজার মুখে লেগে আছে সেইসব আনন্দ বিষাদের ধুলিকণা।
হাত রাখে ভানুমতী। স্পর্শ রাখে। স্পর্শের ভিতর হতে বয়ে যায় মৃত্যুজয়ী কালের স্রোত। দুঃখ নেই। ভয় নেই। আর কোনো কাজও নেই।

********

আঁধার নেমে আসছে ক্রমশঃ। স্মৃতি - ভার সরিয়ে উঠে পড়ে ভানুমতী। শূণ্য প্রাসাদে আলো জ্বলে উঠুক। নতুন ইতিহাস কথা বলুক। কিসের বিষাদ? কিসের দুঃখ? মাতা গান্ধারী একশত পুত্রের জন্ম দিয়ে জননী হতে পারেন নি, পঞ্চস্বামীর পত্নী হয়েও অনাথাবৎ দ্রৌপদী, কিন্তু... ভানুমতী? চিরকাল থাকবে দুর্যোধন প্রেয়সী। নায়ক না হোক... প্রতিনায়কের একমাত্র মহিষী।