Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in
রাজায় রাজায়-চতুর্থ পর্ব

সিরাজ বনাম ইংরাজ –কলকাতা দখল ও কৃষ্ণগহ্বর

মুর্শিদাবাদ ছাড়ার এগারোদিন পর সিরাজ আর তার বাহিনী কলকাতায় পৌঁছল। সিরাজের দ্রুততার তুলনায় এগারোদিন অনেকটাই বেশি সময়। তাই এই বিলম্ব নিয়ে জল্পনাও অনেক। ফরাসিরা বলতে শুরু করল সিরাজ বোধহয় হারেমেই আটকে গেছে। কিন্তু দিনদশেক পরে যখন খবর এল চুঁচুড়ার এক বাগানে রাত্রিযাপন করে সিরাজ কলকাতার দিকে রওনা হয়েছে তখন সবার ভুল ভাঙলো। সিরাজ কিন্তু কলকাতা আক্রমণের আগে তার সৈন্যবাহিনী আর সেনাপ্রধানদের উজ্জীবিত রাখার জন্য চন্দননগরে ফরাসি ফ্যাক্টরির প্রধান জিন ল’কে চিঠি দিয়ে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাল। একথাও জানাল যে এই সাহায্যের প্রতিদান হিসাবে কলকাতা ফরাসিদের হাতে তুলে দেবে সে। হায়দ্রাবাদের চতুর্থ নিজাম সালাবাত জং যেমন মারাঠা আক্রমণের সময় সাহায্যের জন্য দাক্ষিনাত্যে তাদের যেমন কর মকুব করেছে সেও বাংলায় তাই করবে। তবে অবশ্য সিরাজ তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় এ কথাও জানাতে ভোলেনি যে যদি সাহায্য না আসে তাহলে তার পরিণতি ভালো হবে না। বুদ্ধিমান জিন ল’ সিরাজকে ভদ্রভাবেই জানিয়ে দিল যে ফরাসিদের দিক থেকে ইংরেজদের আক্রমণ করার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। সুতরাং তাদের পক্ষে কোনওরকম সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারছে না। সিরাজ কিন্তু আশা ছাড়ল না। কলকাতায় পৌছনোর আগে পন্ডিচেরিতে ফরাসি গভর্নরকে চিঠি পাঠিয়ে সাহায্যের আবেদন জানাল। জিন ল’ এই চিঠির কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে এই চিঠি পন্ডিচেরি পৌঁছতে কয়েকমাস লাগবে এবং উত্তর আসতে আরও কয়েকমাস। পরবর্তী কালে এই জিন ল’ সিরাজের হাতে আক্রান্ত ইংরেজদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেঁচে আসা ইংরেজদের জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য এবং আশ্রয় দিয়েছিল এই জিন ল’ যদিও পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে অনেক ফরাসি সম্পত্তি ধ্বংস করেছিল চন্দননগরে।

ওদিকে কাশিমবাজার থেকে খবর পেয়ে কলকাতা কাউন্সিল অস্ত্রশস্ত্র আর অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর জন্য মাদ্রাজ কাউন্সিল এবং হুগলীর ডাচ কাউন্সিলে কাতর অনুরোধ জানাল। সিরাজের আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব দেওয়া হল রজার ড্রেক এবং তার সহকারি জন জেপানিয়া হলওয়েলকে। রজার ড্রেক তখন ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান। হলওয়েল ছিল পেশায় ডাক্তার কিন্তু বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছিল। ডাচ কাউন্সিল সরাসরি ব্রিটিশদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দিল। তারা জানিয়ে দিল যে তারা মূলত ব্যবসা করতে এসেছে এবং তারা এমন কোনও পদক্ষেপ নিতে চায়না যাতে তাদের অকারণ বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়াও সরকারিভাবে ব্রিটিশ এবং ডাচদের মধ্যে এধরণের কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। অন্যদিকে চন্দননগরের ফরাসি প্রধান জিন ল’ এক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়ে দিল। জিন ল’ একথাও জানাল যে সিরাজের পক্ষ সমর্থন না করার কারণে তাদের হয়ত ভবিষ্যতে বিপদের মুখোমুখি হতে পারে তবুও গঙ্গাবক্ষে তাদের রণতরী নিরপেক্ষ অবস্থান নেবে। সিরাজ যে ধরণের ভয়ানক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ তাতে তাদের এই ভূমিকার জন্য কখন এবং কী ভাবে তাদের ওপর আক্রমণ নেমে আসবে কে জানে।

কোনও সাহায্যের আশ্বাস না পেয়ে ব্রিটিশরা ঠিক করল যে তাদের পক্ষে ইউরোপিয়ান অধ্যূষিত এলাকা ছাড়া আর কোনও এলাকা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তখনকার ইউরোপিয়ান অধ্যূষিত এলাকা বলতে এখনকার ডালহৌসি স্কোয়ার বা বি-বা-দি বাগ এবং তার পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের কিছু এলাকা। যুদ্ধের জন্য জায়গা খালি করার প্রয়োজনে উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকার দর্মা এবং খড়ের বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। এই অঞ্চলে মূলত গরিব খেটে খাওয়া বাঙ্গালিদের বাস। সিরাজের সৈনিকদের প্রতিহত করার জন্য শহরের আরও কিছু গরিব অধ্যূষিত এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। পরের দিন সিরাজের সৈন্যরা বড়বাজার অঞ্চলে আগুন লাগিয়ে দিল। ব্রিটিশ মহিলাদের ততক্ষণে শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আসা হয়েছে। পরের দিন পর্তুগিজ এবং আর্মেনিয়ান মহিলা ও শিশুদেরও ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আসা হল কিছুটা বাধ্য হয়েই। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যে সমস্ত পর্তুগিজ এবং আর্মেনিয়ান সৈন্যরা আছে তারা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিল যে তাদের পরিবারের সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধে যোগ দেবে না। ব্রিটিশ মিলিটারিদের অবস্থা এবং সৈন্যসংখ্যা সত্যিই হতাশাজনক। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় কলকাতার ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসার এবং জওয়ানের সংখ্যা ছিল ২৬০ এবং ভারতীয় জওয়ানের সংখ্যা ছিল ২২৫। এছাড়া কোম্পানির অধস্তন কর্মচারি ছিল ৪৫ জন। সব মিলিয়ে ৫৩০ জন। অন্যদিকে সিরাজের সৈন্যসংখ্যা প্রায় তিরিশ হাজার। কাশিমবাজারে ২৪ জন ইউরোপিয়ান আর ১৬ জন ভারতীয়ের সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যেই সিরাজের কারাগারে। ঢাকায় ৩১ জন ইউরোপিয়ান আর ১৫ জন ভারতীয়ের ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনী তখন নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত। লখিপুরের ২০ জন ইউরোপিয়ান আর ১১ জন ভারতীয়ের বাহিনী এত পথ অতিক্রম করে কলকাতা আসার পরিকল্পনা বাতিল করে দিল। সব মিলিয়ে সিরাজের ত্রিশহাজারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বন্দুকধারীর সংখ্যা মাত্র ৬৫০। দীর্ঘকাল ধরে ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তারা তাদের অপর্যাপ্ত গোলাবারুদ এবং সৈন্যবাহিনীর কথা লন্ডনের দরবারে পেশ করেছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। বারুদের অবস্থা এত খারাপ যে বাইরে থেকে আসা ব্রিটিশ জাহাজকে প্রথাগত ভাবে স্বাগত জানানোর জন্য গানস্যালুট করাও সম্ভব নয়। বাগবাজারের কাছে এক কারখানায় বারুদ বানানোর পরিকল্পনাও দক্ষতা ও অর্থের অভাবে বাতিল করতে হল। ফোর্ট উইলিয়ামের অনেক জায়গায় মেরামতির প্রয়োজন। বেশ কিছু জায়গার আদ্যোপান্ত সংস্কার না করলেই নয়। তা ছাড়াও যেভাবে প্রতিবছর ইউরোপ থেকে অফিসার এনে মাথার ওপর বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে সেনাবাহিনীর অধস্তন আধিকারিকরা খুব খুব্ধ। ওদিকে আবার ফরাসি আক্রমণের সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কর্নেল স্কট ৭৫০০০ টাকার একটা পরিকল্পনা পাঠিয়েছিল কলকাতার চারপাশে ৩৬ ফুট চওড়া আর ১২ফুট গভীর পরিখা খননের জন্য। লন্ডন কাউন্সিল সে আবেদন বাতিল করে দিয়ে জানিয়েছে যে এই মুহূর্তে এত টাকা পাঠানো সম্ভব নয়। ওদিকে আবার ফোর্টের চৌহদ্দি বাড়াতে গেলে আশেপাশের বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কিন্তু ঐ বাড়িগুলোতে ইউরোপিয়ান পরিবারদের বাস এবং তাদের পুনর্বাসন দেওয়াও ব্যয়সাপেক্ষ।

সুতরাং হাতে যা আছে তা নিয়েই পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ফোর্টের ভেতরে এবং বাইরে সৈন্য মোতায়েন করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল ব্রিটিশ বাহিনী। এই যুদ্ধের প্রথম আক্রমণ কিন্তু সিরাজের দিক থেকে আসেনি। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বেশ কয়েকটা ব্রিটিশ জাহাজ হুগলি নদীতে টহল দিচ্ছিল বিদেশি কোনও জাহাজের খোঁজে। সিরাজের আক্রমণের আগেই ব্রিটিশরা চারটে জাহাজ পাঠিয়ে দিল তান্না ফোর্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে। এই তান্না ফোর্ট ছিল এখন যেখানে বোটানিকাল গার্ডেন আছে সেইখানে। বিনা প্ররোচনায় এবং প্রায় বিনা বাধায় ব্রিটিশরা আচম্বিতে তান্না ফোর্ট দখল করে নিল এবং যা অল্পবিস্তর অস্ত্রশস্ত্র সেখানে ছিল তাও ধ্বংস করে দিল। পরেরদিন সিরাজের চারহাজার সৈন্য নদী পার হয়ে কলকাতা আক্রমণ করল। শুরু হয়ে গেল সিরাজ আর ইংরাজের যুদ্ধ। প্রথম দিকে ব্রিটিশরা কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সেদিন রাত্রে অনেক ব্রিটিশ কর্মচারি বিশেষ করে বাঙালি কর্মচারিরা রাতারাতি ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে ভয়ে পালাতে লাগল।সময় যত যেতে লাগল সিরাজের সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ প্রতিরোধ অতিক্রম করতে করতে প্রায় ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে চলে এল। প্রাণনাশের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি হলেও সিরাজের সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ সৈন্যদের পিছু হটিয়ে এগিয়ে চলল সমানে। ড্রেক এবং হলওয়েল বুঝতে পারল যে আর বেশিক্ষণ সিরাজের সৈন্যদের আটকে রাখা যাবে না। সন্ধ্যে আটটার সময় এক জরুরি মিটিং এ সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল যে পরিমাণ গোলাবারুদ মজুদ আছে তাতে দু’দিন বা মেরকেটে তিনদিনের বেশি চলবে না। সুতরাং হলওয়েলের প্রস্তাববমত সিদ্ধান্ত হল যে তার পরের দিন থেকে পিছু হটার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে । জরুরি কাগজপত্র এবং টাকাকড়ি তার আগে সরিয়ে ফেলতে হবে। মিটিং চলতে চলতেই রাত্রি প্রায় একটার সময় মিটিং রুমের পাশেই তীব্রশব্দে একটা গোলা এসে পড়তেই সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ভোরবেলা সিরাজের বাহিনী প্রায় ফোর্টের মধ্যে ঢুকে এল। গোলার আঘাতে বেশ কয়েকটা বাড়ির দেওয়াল এবং একটা চার্চ হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ল। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে গ্রেপ্তারের ভয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান কর্তা রজার ড্রেক ফোর্ট ছেড়ে পালাল। ড্রেকের দেখাদেখি আরও কিছু অফিসার এবং আবাসিক ফোর্টের ঘাটে বাঁধা নৌকায় গিয়ে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাটে আর একটাও নৌকা দেখা গেল না। ফোর্ট উইলিয়ামের উপপ্রধান পিয়ারকেস জানাল যে ড্রেকের অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। সকলে মিলে হলওয়েলকেই তাদের পরবর্তী প্রধান হিসাবে বেছে নিল। পরেরদিন দুপুরের আগেই ব্রিটিশ সৈন্যদের পর্যুদস্ত করে সিরাজের বাহিনী যখন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করছে হলওয়েল ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রিত ধনকুবের উমাচাঁদকে বলল সিরাজের প্রিয় মানিকচাঁদের মাধ্যমে সিরাজকে খবর পাঠাতে যে ব্রিটিশরা আত্মসমর্থনের জন্য তৈরি। সকাল থেকে প্রায় পঁচিশজন ব্রিটিশসৈন্য নিহত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আর যেন না বাড়ে। প্রায় চারটে নাগাদ গোলার আওয়াজ বন্ধ হল। পরিশ্রান্ত হলওয়েল এবং তার সহকারিরা যখন একটু বিশ্রাম নিতে গেল তখন শুরু হল এক নতুন উপদ্রব । কয়েকজন ডাচ সৈন্য সার্জেন্ট হেডলেবার্গের নেতৃত্বে বাঁশের মই দিয়ে ফোর্টের পাঁচিল টপকে ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে দিল। এই হেডেলবার্গ আর তার দলবল কয়েকদিন আগে ফোর্ট ছেড়ে পালিয়েছিল। এদের কোনওক্রমে সামলে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হলওয়েল সিরাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। হলওয়েল নিশ্চিত যে সিরাজ তাদের ক্ষমা করবে না এবং সিরাজের হাতে মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। আসলে আর দু-তিনমাসের মধ্যেই হলওয়েলের দেশে ফিরে যাবার কথা ছিল। নিয়মানুযায়ী যাওয়ার একবছর আগে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ন’মাস আগে প্রয়োজনীয় নোটিসও দিয়েছিল সে। কিন্তু তখন কে জানত এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের মুখোমুখি তাকে এই মুহূর্তে দাঁড় করিয়েছে সময়। আর সেই মুহূর্তে সিরাজের এক সেনাধ্যক্ষ হলওয়েলকে নিয়ে গিয়ে এক দীর্ঘ প্রাচীরের ওপরে এক প্রান্তে দাঁড় করাল। হলওয়েল মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখল প্রাচীরের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা। হলওয়েলের অভিবাদনের প্রত্যুত্তরে প্রত্যাভিবাদন জানাল সিরাজ। একটু পরেই বন্দি হলওয়েলকে হাজির করা হল সিরাজের সামনে। সিরাজ তার সেনাধ্যক্ষকে আদেশ করল হলওয়েলের হাতকড়া খুলে দেওয়ার জন্য। সিরাজ জানাল- একজন সৈনিক হিসাবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। রাজবন্দির যোগ্য সম্মানের সঙ্গেই তোমাকে কারাগারে রাখা হবে। কিন্তু ড্রেকের আচরণে আমি ক্ষুব্ধ এবং চরম অসন্তুষ্ট। ড্রেকের নির্বুদ্ধিতা এবং গোয়ার্তুমির জন্য বাধ্য হয়ে এমন সুন্দর সাজানো একটা শহরকে আমি ধ্বংস করতে বাধ্য হলাম।

সিরাজ সেইদিনের জন্য জনৈক ওয়েডারবার্নের বাংলোতে বিশ্রাম নিতে গেল। সিরাজ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল লুটপাঠ। সিরাজের সৈন্যরা যথেচ্ছ লুটপাঠ চালিয়ে যেখান থেকে যা পেল নিজেদের পকেটে ঢোকালেও কারো সাথে খারাব ব্যবহার করলনা। বরঞ্চ যারা ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে চলে যেতে চাইছিল তাদের টাকাকড়ি গয়নাগাঁটি চেয়ে নিয়ে ছেড়েও দিল। পর্তুগিজ আর আর্মেনিয়ানরা অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। সিরাজের সৈন্যরা তাদের বাধাও দেয়নি। সিরাজের সৈন্যরা অবাধে লুটপাঠ চালালেও সিরাজ ব্যক্তিগত ভাবে এই যুদ্ধে ধনসম্পদের দিক থেকে খুব একটা লাভবান হতে পারেনি । তাই লুন্ঠিত ধনসম্পদ যখন সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছিল সিরাজ দেখেও না দেখার ভান করা রইল। এত সবের মধ্যেও মিরজাফরের আস্থাভাজন সিরাজের এক সেনাধ্যক্ষ মির্জা আমির বেগ কয়েকজন ইউরোপিয়ান মহিলাকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে এক নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছিল। রাত্রে মিরজাফরের সাহায্যে বেশ কয়েকটা বিশদাঁড়ি বড় নৌকা করে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার জলপথ বেয়ে ড্রেকের জাহাজে তাদের বাড়ির লোকেদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ব্রিটিশরা মিরজাফরের এই বদান্যতার কথা মনে রেখেছিল এবং তার কিছুদিন পরে যথোপযুক্ত প্রতিদানও দিয়েছিল।

কিন্তু কয়েকঘন্টার মধ্যেই হলওয়েল আর ইউরোপিয়ান সেনাদের ভাগ্যে নেমে এল আরও ভয়ানক দুর্ভোগ। কিছু ইউরোপিয়ান সৈন্য আকন্ঠ মদ্যপান করে ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে প্রথমে ঝগড়া তারপর হাতাহাতি শুরু করে দিল। যুদ্ধক্লান্ত ভারতীয় সৈনিকেরা সিরাজের কাছে অভিযোগ জানাল এর একটা বিহিত করতে। বিরক্ত সিরাজ বুঝতে পারল যে এদের যদি বাইরে রাখা হয় তাহলে সারারাত ধরে চলবে এই তামাশা আর তার রাতের ঘুম বরবাদ হবে। সিরাজের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে একজন খবর দিল যে সৈন্যরা শৃঙ্খলাহীন আচরণ করলে তাদের কারাগারের একটি কুঠুরিতে বন্দি করে রাখাই এখানকার রেওয়াজ। সেই কুঠুরির নাম কৃষ্ণগহ্বর। এই কৃষ্ণগহ্বর দৈর্ঘ্যে ১৮ ফুট এবং প্রস্থে ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি। সিরাজ কুঠুরির মাপ না জেনেই হুকুম দিল যে আজ রাত্রের জন্য এদের কৃষ্ণগহ্বরে রাখা হোক। সিরাজের আদেশকে আক্ষরিক অর্থে মেনে নিয়ে সিরাজের বাহিনী ১৪৬ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে ঠাসাঠাসি করে কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে দিল। সন্ধ্যে সাতটা থেকে পরেরদিন সকাল ছ’টা পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বরের অন্দরে বাঁচার জন্য একজন অপরজনকে মাড়িয়ে বা অন্য একজনের ঘাড়ের ওপর উঠে একটু জলের জন্য হাহাকার করতে থাকল। সে দৃশ্য যে কী ভয়ঙ্কর তা কল্পনা করলেও গা শিউরে ওঠে। সিরাজের সৈন্যরা বাইরে বসে এই ভয়ংকর তামাশা উপভোগ করতে লাগল। আর মুষ্টিমেয় যে ক’জনের মধ্যে কিছু মনুষ্যত্ব তখনও অবশিষ্ট ছিল তারা ভয়ে সিরাজকে ঘুম থেকে জাগাতে পারল না। পরের দিন সকালে ১৪৬ জনের মধ্যে অর্ধমৃত অবস্থায় যাদের বের করা হল তাদের সংখ্যা ২৩। ১২৩ জন ব্রিটিশ সৈনিকের প্রাণবায়ু সে রাত্রে কৃষ্ণগহ্বরের অন্দরে নিঃশেষ হয়ে গেল। কৃষ্ণগহ্বরের এই হত্যাকাহিনী ইতিহাসের পাতায় জঘন্যতম হত্যাকান্ড হিসাবে আজও বেঁচে আছে। যে ২৩জন সে রাত্রে বেঁচে গিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল হলওয়েল স্বয়ং। সিরাজের নির্দেশে এই ১২৩ জনের মৃতদেহ পরের দিন সবার অলক্ষ্যে পরিখার জলে পুঁতে দেওয়া হল।

সিরাজের কাছে জীবনের চেয়ে অর্থের মূল্য অনেক বেশি। হলওয়েলকে ডেকে সিরাজ জিগ্যেস করল যে ফোর্টের মধ্যে যে ধনসম্পদ গচ্ছিত থাকার কথা তা কোথায় গেল? তার লোকেরা মাত্র ৫০০০ টাকার হদিশ পেয়েছে। হলওয়েল বলল এসবের ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা। রজার ড্রেক ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান এবং ধনসম্পদের হিসাব সেই একমাত্র দিতে পারবে। ক্ষুব্ধ সিরাজ হুকুম দিল যে হলওয়েল এবং তার দুই সঙ্গীকে যেন সেনাধ্যক্ষ মির মদনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর শুরু হল অত্যাচার। হলওয়েল এবং তার দুই সঙ্গীকে জৈষ্ঠমাসের প্রচন্ড রোদ্দুরে খোলা রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে এক খোলা ছাদের নিচে দু-দিন রেখে দেওয়া হল। তাদের সারা শরীর বড় বড় ফোস্কায় ভরে গেল। অসহ্য যন্ত্রণায় যখন তারা প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী তখন তাদের মুর্শিদাবাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার প্রায় দশদিন বাদে তাদের পেশ করা হল সিরাজের দরবারে। হলওয়েল এবং তার সঙ্গীদের অবাক করে সিরাজ হুকুম দিল তাদের যেন অবিলম্বে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং তারা যেখানে যেতে চায় সেখানে যেন সসম্মানে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়। সিরাজের এই সিদ্ধান্তের পিছনে তার মা আমিনা বেগম এবং দিদিমা সারফুন্নিসার প্রভাব ছিল বলে মনে হয়। আমিনা বেগম এবং সারফুন্নিসার সঙ্গে ইংরাজদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যার খবর সিরাজের জানা ছিল না। ইংরাজদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ করলে সেটা যে সিরাজের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে সেকথা সিরাজকে বুঝিয়েছিল তার মা আর দিদিমা। সিরাজ দরবারে ঘোষণা করল যে এই তিন বন্দি যথেষ্ঠ শাস্তি পেয়েছে এবং এখন তাদের কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কলকাতা দখল করে সিরাজ তার দাদু আলিবর্দির নামানুসারে কলকাতার নতুন নাম দিল –আলিনগর এবং ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে এক মসজিদ স্থাপনের হুকুম জারি করল। প্রথমদিকে কলকাতায় ইউরোপিয়ানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেও কিছুদিন পর ইউরোপিয়ানদেরও কলকাতায় প্রবেশের অনুমতি দিল সিরাজ। ডাচ ফ্যাক্টরিতে কিছুদিন কাটিয়ে সুস্থ হয়ে হলওয়েল ও তার সঙ্গীরা ফলতায় ফিরে গেল। ফলতা ছিল কলকাতার কাছাকাছি একটা ছোট্ট গ্রাম যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বিতাড়িত ব্রিটিশ পরিবারেরা।

এই যুদ্ধের পর ঢাকায় ব্রিটিশ ফ্যাক্টরি থেকে টাকা এবং জিনিসপত্র মিলিয়ে সিরাজের হাতে এসেছিল ১৪লক্ষ টাকা। এই যুদ্ধে ইংরাজদের কাছ থেকে মোট লুঠের পরিমান প্রায় ১কোটি টাকা বলে অনুমান করা হয়। যদিও কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় এক কলঙ্কজনক কাহিনী হিসাবেই লিপিবদ্ধ থাকবে তবুও এই ঘটনার তথ্য সম্পর্কে কিছু সন্দেহ থেকেই যায়? যদিও এই তথ্যের সত্যাসত্যে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না তবুও এই প্রশ্নগুলি সামনে না এনে এই কাহিনী শেষ করা যায় না।

এই ঘটনার সময় কলকাতার জনসংখ্যা ছিল চারলক্ষ। এটা কী করে সম্ভব যে এদের মধ্যে কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানতো না। দ্বিতীয়ত ইংরাজদের আত্মসমর্পণের পর সিরাজ কোনও ইউরোপিয়ানকে আটকে রাখার আদেশ দেয়নি। কোনও ইউরোপিয়ানকেই ফোর্ট ছেড়ে চলে যেতে বাধা দেওয়া হয়নি। তাহলে আত্মসমর্পণের তিনঘন্টা পরেও এই সব বন্দিরা ওখানে কী করছিল? তৃতীয়ত যতই চাপাচাপি করে রাখা হোক না কেন একটা ১৮ ফুট বাই ১৫ফুট ঘরে ১৪৬ জন মানুষকে কি রাখা যেতে পারে? সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব যতই বিতর্কিত হোক না কেন এই জঘন্য ঘটনা যে ঘটেছিল সে ব্যাপারে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। হলওয়েলের মতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা। ব্রিটিশরা সিরাজের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে সোজাসুজি নিজেদের হাতে নিয়ে নেবার পরিকল্পনা শুরু করেছিল এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই। সেই পরিকল্পনাই যে অবশেষে যে সিরাজের পরাজয় এবং অকালমৃত্যু ডেকে এনেছিল সে কথা আমরা সকলেই জানি। হলওয়েলের বয়ানে কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা শুনে আমরা এই পরিচ্ছেদ শেষ করব।

কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে একজন বৃদ্ধ সিপাইএর চোখেমুখে আমরা করুণার ছাপ দেখেছিলাম। ঐ বৃদ্ধ সিপাই আমাদের দুর্দশা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল। আমি তাকে ডেকে বললাম যে আমাদের দুদলে ভাগ করে আলাদা আলাদা কারাকক্ষে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে হয়ত এই রাতটার জন্য আমরা প্রাণে বেঁচে যাব। এই সামান্য ব্যবস্থাটুকু করলে আমি তাকে হাজার টাকা দেব সেই প্রতিশ্রুতিও দিলাম। সে কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে তার অক্ষমতার কথা জানালে আমার মনে হল টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দিলে হয়ত কাজ হতে পারে। আমি তাকে দু’হাজার টাকা দেবার কথা বললাম। বৃদ্ধ আর একবার চেষ্টা করবে জানিয়ে চলে গেল। আমাদের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে সে জানাল সিরাজ এখন নিদ্রিত এবং তার নিদ্রাভঙ্গ করার সাহস কারোর নেই। সিরাজের অনুমতি ছাড়া কিছু করা অসম্ভব।


রাত্রি যত বাড়তে লাগল আমাদের দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তৃষ্ণায় আমাদের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। যারা কারাকক্ষের পিছনের দিকে ছিল তারা সামনের দিকে আসতে চাইছিল। ওরা ভাবছিল সামনের দিকে থাকলে যদি জল দেওয়া হয় তবে জল পাবার আশা আছে। পিছনে থাকলে তো জল এলেও পাওয়া যাবেনা। আমাদের এই অবস্থা দেখে ঐ বৃদ্ধ সিপাই চামড়ার ব্যাগে করে জল আনার ব্যবস্থা করল। জল এসে পৌঁছতেই কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ধুন্ধুমার শুরু হয়ে গেল। যে সমস্ত বন্দিরা পিছনের দিকে ছিল তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ঠেলে, মাড়িয়ে, তাদের শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে আসতে আরম্ভ করল। বেশ কিছু বন্দি পদপিষ্ট হয়ে তখনই মারা গিয়েছিল। কিন্তু যে পরিমাণ জল এসেছিল তাতে গুটিকয়েক বন্দি (যার মধ্যে হলওয়েল নিজে এবং আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল বলে অনুমান) ব্যতীত আর কারও ভাগ্যে একবিন্দুও জোটেনি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে বন্দিরা মূত্রত্যাগ করে সেই মূত্র পান করতে লাগল। তার ফলে স্বস্তির বদলে তাদের শারীরিক আস্বস্তি আরও বাড়তে থাকল। সবার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। সিরাজ, মানিকচাঁদ আর সিপাইদের নাম করে তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। তারা প্রার্থনা করতে লাগল এর ফলে যদি সিরাজের সিপাইরা উত্তেজিত হয়ে তাদের আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে বা গুলি করে মেরে দেয় তবেই তাদের নরকযন্ত্রনা শেষ হবে।প্রায় প্রত্যেকেই শেষ শক্তি দিয়ে সারারাত আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে একে অন্যের ওপরে ঢলে পড়ল। রাত ভোর হবার আগেই কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তরে মৃতদেহের পাহাড় জমে উঠলো।


অন্য কয়েকজন মানুষের বদান্যতায় আমি সেই রাত্রে বেঁচে গিয়েছিলাম। যখন রাত্রি শেষ হয়ে ভোরের আলো দেখা গেল তখনও কেউ এলোনা দেখে একজন বন্দির সম্ভবত জনৈক কুকের মনে হল খুঁজে দেখা দরকার আমি জীবিত আছি কিনা। কারণ আমিই একমাত্র গেট খোলার ব্যবস্থা করতে পারি। লাশিংটন আর ওয়ালকট আমার জামা দেখে চিনতে পেরে মৃতদেহের স্তুপের নিচের থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আমাকে টেনে বার করে এনেছিল। আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য ওরা আমাকে গরাদের সামনে নিয়ে যেতে চাইছিল যাতে আমি একটু বাতাস পাই। কিন্তু জীবন সকলের কাছেই প্রিয়। গরাদের সামনে যারা বসেছিল তারা কেউ জায়গা ছাড়তে চাইল না। আমাকে নিয়ে ওরা যখন আবার পিছনে ফিরে যাচ্ছিল তখন ক্যাপ্টেন মিল মানবতার খাতিরে গরাদের সামনে নিজের জায়গা কিচ্ছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি হল। আমার জ্ঞান ফিরে এল। আমি পাহারদার সিপাইদের ডেকে সিরাজের কাছে এই ভয়ঙ্কর খবর পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই সিরাজের কানে এই খবর পোঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই সিরাজ যারা বেঁচে আছে তাদের মুক্ত করে তার সামনে হাজির করতে বলল।


কৃষ্ণগহ্বর থেকে মুক্তি পাবা পর আমার প্রতি সিরাজের দুর্ব্যবহার বাড়তেই থাকল। তার মূল কারণ এই যে রজার ড্রেক রণে ভঙ্গ দিলেও আমি সিরাজের হাত থেকে ফোর্ট উইলিমকে রক্ষা করার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তাছাড়াও সিরাজের সৈন্যবাহিনী আসার আগে ফোর্ট উইলিয়ামে রক্ষিত এবং গচ্ছিত সমস্ত ধনসম্পদ এবং অলঙ্কার আমি সরিয়ে দিয়েছিলাম সে কথা সিরাজ বুঝতে পেরেছিল। আর একটি কারণ হল আমি ফোর্ট উইলিইয়ামের দায়িত্ব নেবার পরেও উমাচাঁদকে মুক্তি দিইনি। যদিও আমি মনে করি উমাচাঁদকে বন্দি করা অন্যায় ছিল তবুও তাড়াহুড়োয় উমাচাঁদের কথা আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়লে আমি নিশ্চয়ই তাকে মুক্ত করে দিতাম। আমার প্রতি সিরাজের এই দুর্ব্যবহারের পিছনে উমাচাঁদের যথেষ্ঠ প্রভাব ছিল সে কথা বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। আমার সঙ্গে আরও যে তিনজনের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কোনও না কোনও কারণে উমাচাঁদের রাগ ছিল।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের চন্দননগর দখলের সময় উমাচাঁদের ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে হলওয়েল। রবার্ট ক্লাইভকে লেখা এক চিঠিতে হলওয়েল লেখে,

‘আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিরা কলকাতার ধনী এবং মহান ব্যবসায়ী উমিচাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ওনার মাধ্যমেই আমরা হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। সিরাজের যে সমস্ত সৈন্যরা চন্দননগরে নগররক্ষার কারণে অবস্থান করছিল তারা নন্দকুমারের অধীনস্থ ছিল। যদি নন্দকুমারের নির্দেশে ঐ সৈন্যবাহিনী চন্দননগর ছেড়ে না চলে যেত তবে আমাদের পক্ষে চন্দননগর দখল করা সম্ভব হত না।‘

হলওয়েলের বিবৃতির বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়। সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত এবং হত্যা করার কারণ যে শুধুই কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনার প্রতিশোধ সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না। আবার একথাও সত্য যে যে অজুহাতে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেছিল অর্থাৎ নবনির্মিত দুর্গ এবং পরিখা সেই সব কিন্তু যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। তবে কি সিরাজের কলকাতা আক্রমণের পিছনে অন্য কোনও গূঢ় কারণ ছিল। একথা মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে আসলে সিরাজের ধারণা ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের অভ্যন্তরে গচ্ছিত আছে বিপুল ধনসম্পত্তি। নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সেই গুপ্তধন কুক্ষিগত করাই হয়ত আসল উদ্দেশ্য ছিল সিরাজের। আদি অনন্ত কাল থেকে আজ অবধি রাজায় রাজায় যুদ্ধের কারণ ক্ষমতা দখল আর অর্থলুন্ঠন ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্রের কাঠামো হয়ত বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বদলেছে যুদ্ধের পদ্ধতিও। কিন্তু যুদ্ধের উদ্দেশ্য রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।