Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in






আগের পর্ব মে সংখ্যায় 
https://rritobak.blogspot.com/2023/05/blog-post_41.html




মসনদে সিরাজ- অশান্ত দু’মাস

মসনদে বসার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের প্রথম কাজ হল ঘসেটি বেগমের সঙ্গে হিসাব নিকাশ মেটানো। লাখ লাখ টাকা দিয়ে যে সব সেনাপ্রধানদের কাছ থেকে কথা আদায় করেছিল ঘসেটি বেগম তাদের আশেপাশে দেখা গেল না। ঘসেটি বেগমের টাকায় তাদের মধ্যে অনেকেই অন্য শহরে ঘরবাড়ি কিনে স্থিতু হয়েছে। মুর্শিদাবাদের আশেপাশে তাদের দেখতে পেলে সিরাজ যে তাদের আস্ত রাখবে না সে কথা তারা ভালোভাবেই জানত। এদের মধ্যে একজন মীর নজর আলি প্রায় ১২ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার অলঙ্কার এবং নগদ নিয়ে বেনারস পালিয়েছিল। সেখানে গিয়ে ঐ টাকা জুয়ায় লাগিয়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে সিরাজের মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পরে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে এক পূর্বতন নর্তকীর আশ্রয়ে বাকি জীবন কাটায়। এরকম অনেকেই ঘসেটির থেকে প্রচুর অর্থ নিয়ে তার বিপদের দিনে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কে চায় নররাক্ষস সিরাজের হাতে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে? ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করে মতিঝিলের সমস্ত অলঙ্কার, অর্থ এমনকি আসবাবপত্র রাজকোষাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে সিরাজ সেনাপ্রধানকে মতিঝিলে পাঠালো।সেই মূহুর্তে সিরাজের কাছে আত্মসর্পণ করা ছাড়া ঘসেটির কোনও উপায় ছিলনা। কিন্তু ঘসেটি যে এই অপমান মুখ বুজে মেনে নেবে না এবং মাত্র আটমাস আগে নওয়াজিসের রহস্যজনক মৃত্যু যে ঘসেটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলবে সে কথা বুঝতে পেরে সিরাজের দিদিমা, আলিবর্দির বিধবা স্ত্রী অর্থাৎ আমিনা এবং ঘসেটি বেগমের মা সিরাজকে বোঝালেন যে এই মূহুর্তে ঘসেটির সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রথমত প্রাসাদের অন্তঃপুরের কথা বাইরে বেরিয়ে যাবার ঝুঁকি আছে। ঘসেটি কখন যে কী করে বসবে কেউ জানে না। দ্বিতীয়ত মোগলরাজ দীর্ঘদিন আলিবর্দির কাছ থেকে কোনও রাজস্ব না পেয়ে তীব্র অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং তার অসন্তোষের কথা অনেকের কাছে প্রকাশ করেছে। তাছাড়া মারাঠাদের কাছ থেকে যে কোনও মূহুর্তে অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কা এখনও নির্মূল হয়নি। সর্বোপরি দেওয়ানদের মধ্যে এখনও অনেকে ঘসেটির কাছের লোক। হুসেন কুলির পর ঢাকার দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ ঘসেটির খুব কাছের লোক। একসময়ে রাজস্বের টাকা আদায় করে মতিঝিলে দিয়ে আসত এই রাজবল্লভ। কিছু টাকা নিয়ে ঘসেটির সঙ্গে আপাতত বিবাদ মিটিয়ে আসল সমস্যার দিকে নজর দেওয়াই এখন সিরাজের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর অন্যদিকে গৃহবন্দি ঘসেটি বেগমের ঘৃণা সিরাজের প্রতি যত বৃদ্ধি পেতে লাগল ততই সে অত্যন্ত গোপনে সিরাজের বিরুদ্ধে গভীর থেকে গভীরতর চক্রান্তে লিপ্ত হতে থাকল। যে ভাবেই হোক সিরাজকে গদিচ্যুত করাই এখন ঘসেটির একমাত্র লক্ষ্য।

এদিকে সিরাজের দরবারে প্রতিদিনই ঘটতে থাকল বিভিন্ন রদবদল। প্রথমেই বিতাড়িত হল মীরজাফর, সেনাবিভাগের কোষাধ্যক্ষ বা মীরবক্সি। সেনাবাহিনীর যাবতীয় খরচ-খরচার দায়িত্ব ছিল মীরজাফরের উপর। নবাব আলিবর্দির বেগম সারফুন্নিসা ছিল মীরজাফরের পিসি । সেই সুবাদে উড়িষ্যার সুবেদার পদে মীরজাফরকে নিযুক্ত করেছিলেন আলিবর্দি। কিন্তু রঘুজি ভোঁসলে যখন মারাঠা সৈন্যবাহিনী নিয়ে উড়িষ্যা আক্রমন করে তখন হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসেছিল মীরজাফর আর তার সাগরেদ রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্লাহ। আলিবর্দি মোগলসৈন্যদের নিয়ে ঐ বৃদ্ধবয়সে নিজে লড়াই করে মারাঠাদের দেশছাড়া করেছিলেন সেবার। মীরজাফরকে ওখান থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন আলিবর্দি। মীরমদনকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসে ওই পদে বসায় সিরাজ। সিরাজের প্রিয় বন্ধু এবং রাজপ্রাসাদের দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা মোহনলালকে নিযুক্ত করল প্রধানমন্ত্রীর পদে। সিরাজের খামখেয়ালিপনা , যথেচ্ছাচার, অশালীন ভাষা ও অসংযত ব্যবহারের জন্য দরবারের গুণীজনদের পক্ষে আত্মসম্মান রক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠলো।তাঁরা প্রত্যেকেই একে একে দরবারে আসা বন্ধ করে দিলেন। জগৎশেঠ মাধবরাই এর সঙ্গে যা ঘটলো তা সিরাজের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। জগৎশেঠ মাধবরাই এর কাছে একদিন সিরাজ সর্বসমক্ষে ত্রিশ লক্ষ টাকা চেয়ে বসল। সিরাজ বলল যে কোম্পানি আর বিদেশি ব্যবসায়ীদের টাকা থেকে ত্রিশ লক্ষ টাকা যেন তাকে অবিলম্বে দেওয়া হয়। মাধবরাই জানিয়ে দিল যে এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যে বিশ্বাস এবং নির্ভরতার সঙ্গে কোম্পানি এবং অন্য ব্যবসায়ীরা তার কাছে নিজেদের টাকা বিনিয়োগ করেছে তার থেকে একটি পয়সাও দেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে অমিতব্যায়ী সিরাজের অর্থের প্রয়োজন এত বেশি যে মাধবরাই এর এই প্রত্যাখানে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। ক্রোধান্ধ সিরাজ রাজদরবারে সর্বসমক্ষে মাধবরাই এর গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিল। জগৎশেঠ মাধবরাই যে এই অপমান সহ্য করবে না সে কথা বলা বাহুল্য। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী জগৎশেঠ গোপনে মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে দিল। এই চক্রান্তে ইন্ধন যোগাতে শুরু করল ঘসেটি বেগম। সবার অলক্ষ্যে রচিত হতে থাকলো আফসার রাজত্বের পতনের ইতিহাস। এই চক্রান্তে যোগ দিল অনেক জমিদার এবং ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যারা বা যাদের পরিবারের লোকেরা এবং মেয়ে-বৌরা কোনও না কোনও সময়ে লাঞ্ছিত হয়েছে সিরাজের হাতে কোনও না কোনও কারণে তা সে খাজনা সংক্রান্তই হোক বা অন্য কিছু। এদের মধ্যে একজন ছিল নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাই। কৃষ্ণচন্দ্র ছিল শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগী এবং বৈষ্ণববাদে বিশ্বাসী। গোপাল ভাঁড়ের মত বিখ্যাত উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন হাস্যরসিক যার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার গল্প এতদিন পরেও কিংবদন্তীর মত সকলের মুখে মুখে ফেরে, সসম্মানে বিরাজ করতেন কৃষ্ণচন্দ্রের রাজদরবারে। সিরাজের আচরণে অসন্তুষ্ট কৃষ্ণচন্দ্র ইংরাজদের হাতে দেশ কে তুলে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন এবং সেই কারণেই সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন বলে শোনা যায়। যদিও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার গ্রন্থে বলেছেন কোনও জমিদার বা রাজাই সে নদীয়া, বর্ধমান বা রাজশাহী যেখানকারই হোক না কেন এই চক্রান্তে জড়িত ছিলনা। তাদের কাজ ছিল রাজ্যশাসন নয় কেবল খাজনা আদায়। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে যে কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি সিরাজের কাজকর্ম , উদ্ধত এবং অশালীন আচরণ ও ভাষা মেনে নিতে পারেন নি। সিরাজের সমবয়সী বাইশ তেইশ বছরের ছেলেদের ওপর রাজ্যশাসনের গুরুদায়িত্ব দিয়ে যথেচ্ছাচারে মেতে উঠল সিরাজ। এর পরিণতি যে ভালো হবে না সে কথা আলাদা করে বোঝার কোনও দরকার নেই। বাংলার অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিরাজকে গদিচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল।

এই প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সিরাজের মাস্তুতো ভাই শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উস্কানি দেওয়া। মীরজাফর বিতাড়িত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মীরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছয় শওকতের কাছে। চিঠিতে লেখা হয় আলিবর্দি খানের সময়কার সমস্ত সেনাপ্রধান এবং রাজদরবারের সদস্যরা চায় সিরাজের জায়গায় নবাবের আসনে বসুক আলিবর্দির কনিষ্ঠ জামাতা সৈয়দ আহমেদ খানের সুযোগ্য পুত্র শওকত। তা না হলে সিরাজের নিষ্ঠুরতা এবং ক্রূরতার হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না। শওকতের নবাব হওয়ার পিছনে সকলের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। অনেকে বলে শওকতকে পুতুল রাজা বানিয়ে ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়াই ছিল মীরজাফর , মাধবরাই এবং তাদের দলবলের আসল উদ্দেশ্য। ক্ষমতাশালীদের সমর্থনে নবাব হবার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে শওকত প্রয়াত পিতার বন্ধু মোগল দরবারের উজির গাজিউদ্দিনের শরণাপন্ন হল। দ্বিতীয় আলমগীর তখন মোগলরাজ। গাজিউদ্দিন ছিল সত্যিকারের ক্ষমতাবান। দ্বিতীয় আলমগীরকে নবাব করার পিছনে পূর্বতন নবাব আহমেদ শাহ কে অন্ধ করে জেলে পাঠানোর চক্রান্তের নায়ক ছিল এই গাজিউদ্দিন। এই গাজিউদ্দিনই আবার পরবর্তীকালে দ্বিতীয় আলমগীরকে হত্যার চক্রান্তের নেতৃত্ব দেয় তৃতীয় শাহজাহানকে নবাব বানানোর লক্ষ্যে। মীরজাফরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মোগল যুবরাজ আলি গওহরকে হত্যার চক্রান্ত করেছিল এই গাজিউদ্দিন। আলি গওহর পালিয়ে গিয়ে পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় শাহ আলম নামে নবাব হয়েছিল। একথাও ঠিক যে সিরাজ আর শওকতের মধ্যে তফাৎ খুব একটা ছিলনা। দু’জনেই উদ্ধত, দাম্ভিক, অযোগ্য এবং নিষ্ঠুর। শওকতের কথাবার্তাও ছিল অত্যন্ত নিম্নস্তরের। একদিন দুপুরে দরবারভর্তি সভাসদদের সামনে সেনাপ্রধান কারগুজার খানের উদ্দেশ্যে শওকত বলল ,’ কারগুজার খান, বাংলার মসনদ দখলের পর আমাকে তার নবনিযুক্ত সেনাদের বেতন নিশ্চয়ই উপহার হিসাবে দেবে। কারগুজার রসিকতা করে বলল ,’ নিশ্চয়ই বাংলা জয়ের পর তাদের বেতন এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে এই সামান্য উপহার তারা হাসিমুখেই দেবে।‘ বেরসিক শওকত সাতপাঁচ না ভেবে বলে উঠল,’ তুমি আমাকে এত বোকা ভেব না। আমি আলিবর্দি খান নই যে যুদ্ধ করে জেতা বিপুল সম্পত্তির অংশ আমি সৈনিকদের দেব। তারা তাদের বেতনের অতিরিক্ত এক পয়সাও পাবে না।‘ তবুও সিরাজকে হটানোর জন্য ঘসেটি বেগম সহ সকলেই শওকতকে সমর্থন করতে রাজি হয়েছিল। শওকত ছিল চরম অশিক্ষিত এবং লিখতে পড়তে জানত না। তার ব্যবহার এবং মুখের ভাষা এত অশ্লীল এবং নিম্নমানের ছিল যে সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত পরিবারের সকলে কেবল তাকে এড়িয়ে চলত না সর্বসমক্ষে তার বিরোধিতা করতেও পিছপা হত না। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে শওকত কিছুটা সংযত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। সিরাজ যখন জানতে পারল যে শওকত দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে হটানোর চেষ্টা করছে তখন কালবিলম্ব না করে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পূর্ণিয়ার দিকে রওনা দিল। অপ্রস্তুত শওকত এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সিরাজেরর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ছাড়া শওকতের আর কোনও রাস্তা ছিল না। শওকতের পূর্ণ এবং নিঃশর্ত সমর্থন আদায় করে সিরাজ সেবার ফিরে এল । কলকাতায় ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণের তাড়া ছিল সিরাজের। তাই প্রাণে বেঁচে গেল শওকত সে যাত্রায়।

এদিকে কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের বিরোধ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছিল। ব্রিটিশদের ওপর একটা রাগ সিরাজের আগে থেকেই ছিল। তাতে ইন্ধন যোগালো আরও দুটি ঘটনা। নবাবের আসনে বসার পর সিরাজ রাজা রাজবল্লভের বিপুল সম্পদের হিসাব চাইল। সিরাজ জানত যে ঢাকার রাজস্বের টাকা কোষাগারে জমা না দিয়ে ঘসেটি বেগমের সঙ্গে ভাগ করে নিত রাজবল্লভ আর হুসেন কুলি। তখন আলিবর্দি মৃত্যুশয্যায়। হুসেন কুলি ইতিমধ্যেই সিরাজের হাতে খতম হয়েছে। তার জায়গায় এসেছে রাজবল্লভ। এখন ঢাকার রাজস্ব আদায় করে নিজের ভাগ লুকিয়ে রেখে বাকিটা ঘসেটি বেগমের কাছে পৌঁছে দেয় রাজবল্লভ। রাজকোষাগারে আসেনা এক পয়সা। একদিন রাজবল্লভ এসেছে মুর্শিদাবাদে। আলিবর্দির অনুমতি নিয়ে রাজবল্লভকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারারুদ্ধ করল সিরাজ। কিন্তু আলিবর্দির কানে যখন খবর এল সিরাজ রাজবল্লভের মুন্ডচ্ছেদের পরিকল্পনা করছে তখন কোনক্রমে সিরাজকে নিরস্ত করে বললেন যে আগে ঢাকার রাজস্ব আদায়-অনাদায়ের হিসাব নিকাশ হোক তারপর দোষী প্রমাণিত হলে রাজবল্লভের শাস্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল রাজবল্লভ। রাজবল্লভের পরিবারের সমস্ত লোকজন আর সব সম্পত্তি সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেবার নির্দেশ দিয়ে সিরাজ বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠাল ঢাকায়। আগেভাগে খবর পেয়ে বাড়ির সমস্ত মহিলা, অলঙ্কার এবং সমস্ত গচ্ছিত অর্থ নিয়ে পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাবার আছিলায় কলকাতায় পৌঁছে গেল রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভ ওরফে কিসেনদাস। ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর ড্রেককে প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে তার পরিবার এবং সম্পত্তি সিরাজের হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধ জানাল রাজবল্লভ। রাজবল্লভের অনুরোধে এবং ড্রেকের সম্মতিতে কোম্পানির কর্তারা রাজবল্লভের ছেলে কিসেনদাস আর তার আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়ে গেল। কিসেনদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়ার পিছনে ছিল আর একজন ব্রিটিশ অফিসার উইলিয়ম ওয়াটস। ওয়াটস ছিল কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান এবং আলিবর্দির দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি। কিসেনদাস রাজবল্লভের সমস্ত সম্পদ নিয়ে লুকিয়ে কলকাতায় কোম্পানির আশ্রয়ে চলে এল। এই খবর সিরাজের কানে পৌঁছতে দেরি হল না। সিরাজ ভেতরে ভেতরে কলকাতা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। শুধু রাজবল্লভ নয় আরও অনেক জমিদার এবং রাজস্ব আদায়কারী যে প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করে কলকাতায় পালিয়েছে সে কথাও সিরাজের কানে এল। যে ভাবেই হোক এই বিপুল অর্থ উদ্ধার করে রাজকোষে ফিরিয়ে আনতেই হবে। যে সমস্ত রাজস্ব আদায়কারীরা বিচারাধীন তাদের আশ্রয় দিয়ে কোম্পানি অন্যায় করেছে এবং তাদের অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেবার জন্য আদেশনামা পাঠাল সিরাজ। সঙ্গে পাঠাল সিরাজের প্রধান গুপ্তচরের ভাই নারায়ন দাসকে। নারায়ন দাসের অন্য আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। সিরাজের কাছে খবর ছিল যে কলকাতায় কোম্পানি এবং চন্দননগরে ফরাসিরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য নতুন করে পরিখা খনন এবং দূর্গ নির্মানের কাজ শুরু করেছে তার অনুমতি না নিয়েই। সিরাজ নারায়ন দাসকে এই ব্যাপারে অনুসন্ধান করার কথাও বলেছিল। নারায়ন দাস ছদ্মবেশে অনুসন্ধান চালানোর সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে এবং কোনও পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় তার বিরুদ্ধে কোম্পানি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনে। সিরাজ তখন শওকত জং-এর ঔদ্ধত্যের মোকাবিলায় ব্যস্ত। সিরাজের কাছে খবর এল যে কোম্পানির লোকেরা কিসেনদাসকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছে এবং পরিখা খনন ও দূর্গ নির্মানের কাজ বন্ধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তার ওপর নারায়ন দাসকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করে বন্দি করে রেখেছে। কলকাতার গভর্নর জেনেরাল নাকি একথাও বলেছে যে নবাবের আদেশে পরিখা বোজানোর কাজে তারা রাজি আছে যদি অসভ্য মুসলমানদের কাটা মাথা দিয়ে সেই পরিখা বোজানো হয়। এই কথা শোনামাত্র ক্রোধোন্মত্ত সিরাজ কলকাতাকে সম্পূর্ণ ফিরিঙ্গিমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধের আয়োজন শুরু করে দিল।

সিরাজের আদেশ অবজ্ঞা করে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান উইলিয়াম ওয়াট ড্রেককে বোঝালো যে ইউরোপে আর কিছুদিনের মধ্যেই ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ লাগতে পারে। তার প্রভাব যে বাংলায় এসে পড়বে না সে কথা কে বলতে পারে। অতএব ফরাসি আক্রমনের হাত থেকে বাঁচার জন্য কলকাতা এবং কাশিমবাজার দু’ জায়গাতেই নতুন দূর্গ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। উইলিয়াম ওয়াট গোড়া থেকেই সিরাজের বিরুদ্ধতা করে এসেছে। সিরাজকে গদিচ্যুত করার জন্য গোপনে ঘসেটি বেগম এবং মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শওকতকে নবাবের আসনে বসানোর চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল ওয়াট। এমনকি কিসেনদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেবার জন্য সুপারিশ করেছিল এই উইলিয়াম ওয়াট। সিরাজ যখন বেআইনি ভাবে তৈরি নতুন দূর্গ ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দিল কোম্পানি সে আদেশ না মানলেও চন্দননগরের ফরাসিরা কিন্তু সিরাজকে অমান্য করল না। কেবলমাত্র মেরামতির কাজের অনুমতি চেয়ে পাঠাল সিরাজের কাছে। মেরামতির কাজে তার কোনও আপত্তি নেই জানিয়ে দিল সিরাজ। ফরাসিরা নবাবের প্রেরিত অনুসন্ধানকারীদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে সিরাজের কাছ থেকে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল।

সিরাজের সৈন্যবাহিনী কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে ফ্যাক্টরির অফিসারদের গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে দিল। কয়েকজন পালিয়ে বাঁচলেও বেশিরভাগই গ্রেপ্তার হয়ে গেল। সিরাজের বাহিনী যথেচ্ছ লুঠপাট চালিয়ে একরকম দখল নিয়ে নিল ফ্যাক্টরির। উইলিয়াম ওয়াটের কাছে খবর এল যে সিরাজের আদেশে কাশিমবাজারের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রায়দুর্লভকে দেওয়া হয়েছে কাশিমবাজারের দায়িত্ব। মোহনলালকে আদেশ দেওয়া হয়েছে ঢাকায় কোম্পানির সমস্ত ব্যবসা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয় তা সুনিশ্চিত করতে। মীরকাশিম সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতার কাছে তান্নাস ফোর্টের দিকে রওনা হয়েছে। সৈন্যদের প্রত্যেককে দু’মাসের টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে যাতে তারা জান লড়িয়ে দিতে পারে। এর কয়েকদিন পরেই আরও সৈন্যবাহিনী এসে ফ্যাক্টরির মধ্যে বাইরে থেকে কোনও জিনিসের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিল। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি থেকে কাউন্সিলে খবর পাঠানো হল যে পরিখা খনন এবং দূর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ না হলে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি আক্রান্ত হবে এবং সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী পাঠানো হোক। একথাও জানানো হল যে শুধু কাশিমবাজার নয় ঢাকাতেও ব্রিটিশদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিরাজ স্বয়ং রাজমহলে অবস্থান করছে এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে সে কথা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সিরাজ তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। তার একমাত্র উদ্দেশ্য অহংকারী ব্রিটিশদের ডানা ছেঁটে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া। রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে সিরাজ আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী খাওয়াজা মহম্মদ ওয়াজিদকে বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়ে দিল। খাওয়াজা হচ্ছে বাংলার আর্মেনিয়ানদের মধ্যমণি এবং তৎকালীন বাংলার প্রথম তিন ধনী ব্যবসায়ীদের একজন। অন্য দু’জন জগৎশেঠ এবং উমাচাঁদ। সেই সময় বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল এই তিনজনের হাতে। খাওয়াজা ছিল নুন এবং সোরার একচেটিয়া ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায় তখনকার বাংলায় খাওয়াজার কথাই শেষ কথা। সিরাজ খাওয়াজার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে জানালো যে এই খবর যেন ব্রিটিশদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় যে সে আল্লার নামে শপথ করে বলছে যে তারা যদি অবলিম্বে পরিখা খনন এবং দূর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে রাজি না হয় এবং নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময়কার নিয়মানুযায়ী ব্যবসা করতে রাজি না হয় তাহলে সে তাদের রাজ্য থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসিত করবে। এ ছাড়াও সিরাজ খাওয়াজাকে জানালো যে সে যেন সিরাজের প্রতিনিধি হিসাবে ফরাসিদের ব্রিটিশদের প্রতি আক্রমণের জন্য অনুরোধ করে।

বারবার বলা সত্ত্বেও সিরাজের কথা কানে নিল না ইংরেজরা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গলো সিরাজের। রায়দুর্লভকে ডেকে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি দখল করার হুকুম দিল সিরাজ। জানাল পরের দিন সে নিজে সসৈন্যে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরিতে পৌঁছবে। পরের দিন কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটকে গ্রেপ্তার করে হুসেন আলি বেগ খানের জিম্মায় দিয়ে দিল। ওয়াটের গ্রেপ্তার সত্ত্বেও কোম্পানি জানিয়ে দিল তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকবে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই ভেঙ্গে পড়ল ওয়াট। স্ত্রীর আর্তনাদ এবং চোখের জল সহ্য করতে না পেরে ওয়াট সিরাজের সমস্ত শর্ত মেনে নিতে রাজি হয়ে গেল। সেই রাতে রাতের পোশাকে মাত্র দু’জন রক্ষী সঙ্গে নিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করতে এল ওয়াট। সিরাজের পাদস্পর্শ করে নতজানু হয়ে নিজের মুক্তি চাইল ওয়াট। সিরাজ জানিয়ে দিল তিনটি মুচলেকার বিনিময়ে সে ওয়াটকে ছেড়ে দিতে রাজি আছে। প্রথমত, রাজবল্লভ এবং অন্য জমিদারেরা যারা রাজস্বের টাকা চুরি করে কোম্পানির কাছে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সকলের পরিবার এবং তাদের সমস্ত ধনসম্পদ সিরাজের হাতে তুলে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত বিনা অনুমতিতে নির্মিত পরিখা বুজিয়ে ফেলতে হবে এবং দূর্গ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তৃতীয়ত সমস্ত ব্যবসার ক্ষেত্রে আগেকার ট্যাক্সের নিয়ম মেনে চলতে হবে। যতদিন পর্যন্ত কাউন্সিল এই তিন মুচলেকা স্বাক্ষর না করে ততদিন বন্দি থাকবে ওয়াট।

মুচলেকার অপেক্ষা না করে পূর্বপরিকল্পনামত কলকাতা অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিল সিরাজ।

সিরাজের কলকাতা অভিযান –পরের সংখ্যায়।