Next
Previous
0

গল্প - শমীক ঘোষ

Posted in





হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আকাশটা। শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছে সমুদ্রটাকে। নাছোড় প্রেমিকের মতো আয়না হয়ে মেলে ধরছে সমুদ্রেরই সব রঙ।

নীল, ঘন নীল। তার মাঝে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা। ঢেউ ভেঙে পড়ছে তীরের কাছে এসে। আকাশের নীচটাও অমনই। নিরুত্তাপ হেঁটে যাচ্ছে সফেন-সাদা কয়েকটা মেঘ।

আধ ভাঙা চাঁদের মতো একটু হলুদ বিচ ঘিরে আছে সমুদ্রের নীলটাকে। তারপর আবার একই রকম চাঁদ ভাঙা গোল হয়ে ঘন সবুজ ঝাউগাছের সারি। বিচ আর ঝাউ সমুদ্রকে বেড়ে দিতে দিতে চলে গিয়েছে অনেক দূরে। মুছে গিয়েছে প্রায়।

ওই জায়গাটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল শবনম। ‘দ্যাটস গোয়া, রাইট?’

‘হু।’ আনমনা হয়েই উত্তর দিয়েছিল ঋতম।

‘তুঝে পতা হ্যায় ম্যায় কেয়া সোচ রহা হু?’ গলাটা একটু হাস্কি করে ফের জিজ্ঞাসা করেছিল শবনম। হাতটা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ঋতমের কনুই।

অনেক দূরে, সমুদ্রের ঠিক মধ্যিখানে কয়েকটা বিরাট আধডোবা পাহাড়। তার গায়ে আছড়ে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। ওগুলো ভেঙ্গুরলা রকস। কেউ কেউ আবার বলে বার্নট আইল্যান্ডস। পোড়া দ্বীপপুঞ্জ। সেই দিকেই তাকিয়ে ছিল ঋতম। একটু আনমনা।

‘ঋতম, আর ইউ লিসনিং?’

‘হ্যাঁ! কী?’

‘আকাশটা আর সমুদ্রটা দেখতে দেখতে কী মনে হচ্ছে জানিস? মনে হচ্ছে যেন বিরাট একটা নীল ঝিনুক হাঁ-মুখ করে খোলা। আর দূরের ওই নীল পাহাড়টা একটা মুক্ত।’ শুদ্ধ হিন্দিতে বলেছিল শবনম।

ঋতমের সামান্য হাসির ভঙ্গি করে।

শবনম এবার ছেলেটার কনুই ধরে ঝাঁকায়। ‘ইউ স্টিল বদার্ড অ্যাবাউট দ্য হোটেল থিং? আমরা তো জানতামই। জানতাম না?’

‘শবনম…’ ঋতম কী যেন বলতে গিয়েছিল। তার আগেই একটা দামাল হাওয়া ওদের স্পর্শ করে ছুটে যায় সমুদ্রের দিকে। শবনমের হ্যাটটা মাথা থেকে সরে, উড়ে যেতে যায়। খপ করে ধরে ফেলে ঋতম।

এই জায়গাটা একটু উঁচুতে। সমুদ্রের পাড় থেকে খাড়া উঠে এসেছে পাথর। নিদেনপক্ষে চল্লিশ-পঞ্চাশ ফিট। সেইখানেই কংক্রিটের এই বসার জায়গাটা। ভেতরে গোল করে সিমেন্টের বেঞ্চ বাঁধানো। পাশ দিয়ে সোজা উঠে গিয়েছে পিচ রাস্তা। অনেক পেছনে আধা মফস্বল শহরটাকে ফেলে রেখে। কিছুটা এগিয়ে বন্দরটা। তার আগেই ছোট্ট হোটেলটা। সি ভিউ লজ। হোটেলের মাথার পেছন থেকে নারকোল গাছের সারি উঁকি মারে।

মুম্বাই থেকে বেশ দূরে এই জায়গাটা। প্রায় গোয়ার কাছে। নাম ভেঙ্গুরলা। মহারাষ্ট্রের কোঙ্কান কোস্টে সিন্ধুদূর্গ জেলায়। খুব জনপ্রিয় কোনও টুরিস্ট স্পটও নয়। শীতকালেই লোকজন আসে বেশি। আশপাশের জায়গাগুলো থেকে আসে অনেকে। পিকনিক করতে।

এখানে আসার কথা ঠিক করেছিল ঋতমই। ‘ছোট্ট জায়গা। আমরা ছাড়া টুরিস্টই থাকবে না।’

‘তার থেকে গোয়া গেলে হয় না?’ শবনমের একটু আপত্তিই ছিল। ঋতম শোনেনি। প্রায় জোরই করেছিল।

হোটেল আগে থেকে বুক করেনি ওরা। ‘ফাঁকা জায়গা, কিছু একটা পাওয়া যাবে ঠিকই।’ স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল এখানে। তারপর সোজা ঢুকে গিয়েছিল সি ভিউ লজে।

সস্তার হোটেল। রিসেপশনের ডেস্কের পেছনেই দেওয়ালের চলটা উঠে গিয়েছে। সরু খাড়া সিঁড়ি দোতলার। শবনম নাক সিঁটকেছিল। কিন্তু দোতলার ঘরটা দেখে চমকে গিয়েছিল দু’জনেই। ঝকঝকে পরিষ্কার। একদম নতুন হাল ফ্যাশানের আসবাব। আর সমুদ্রের দিকের দেওয়ালটা স্বচ্ছ কাচের!

‘ওয়াও।’ চোখ চকচক করে উঠেছিল শবনমের।

‘ঘরটা আমরা নেব।’ আধার কার্ডটা রিসেপসনের লোকটাকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিল ঋতম।

‘ম্যাডামকা?’ শবনমের আইকার্ডটাও চেয়ে নিয়েছিল লোকটা। একবার চোখ বুলিয়েছিল। তারপর ঋতমের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপ দোনো মুসলিম হো?’

একটু থতমত হয়ে গিয়েছিল ঋতম। চমকে তাকিয়েছিল শবনমের দিকে। এমন কথা এর আগে কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করেনি। তড়িঘড়ি বলে উঠেছিল, ‘জি নেহি, বেঙ্গলি…’, তারপরেই আবার যোগ করেছিল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গলসে’।

অবিশ্বাস নিয়ে ফের শবনমের আধার কার্ডটা দেখেছিল লোকটা। ‘শবনম পারভেজ… বেঙ্গলি? আপ বাংলাদেশি তো নেহি?’

‘হম দোনো ইন্ডিয়ান… পাসপোর্ট দিখাউ?’ বলতে বলতেই হাতের পার্সটা থেকে পাসপোর্ট বার করে ফেলেছিল শবনম। কাটা কাটা গলা করে বলেছিল, ‘য়ো বেঙ্গলি হ্যায়, ম্যায় নেহি…’

‘ছেড়ে দে। অন্য হোটেল খুঁজে নিই। নইলে গোয়া…’

‘না, আমরা এখানেই থাকব।’ জোর গলায় বলে উঠেছিল শবনম।

রিসেপশনের লোকটা কিছুক্ষণ কী যেন ভেবেছিল। দূরে দাঁড়ানো বেয়ারাটার সঙ্গে কথা বলেছিল স্থানীয় ভাষায়। এক বর্ণও বুঝতে পারেনি ওরা। তারপর এগিয়ে দিয়েছিল রেজিস্টারটা। ‘সাইন কিজিয়ে।’

‘লোকটা ঘরটা দিল কেন বলতো?’ পিচ রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঋতম।

‘তুই এখানে আর টুরিস্ট দেখেছো একজনও? বোধহয় শেষে হাতছাড়া করতে চায়নি।’

‘ধুর! ফালতু! কালই গোয়ার চলে যাব।’

উত্তর দেয়নি শবনম। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এসেছিল বন্দরের সামনেটায়। বিরাট লোহার একটা গেট। পাল্লাদু’টো খোলা। ওপরে সাইনবোর্ড – ভেঙ্গুরলা পোর্ট।

ছোট্ট বন্দরটা। খুব বেশি হলে বিঘে খানেক। তার মধ্যেই দু’একটা পুরনো দিনের বাড়ি। টানা বারান্দা। কাচের বড় বড় শার্সি। ওপরে আদ্যিকালের টালির ছাউনি। ঘরগুলো সব বন্ধ। দরজাগুলোয় তালা ঝুলছে। হিন্দি আর ইংরাজিতে বোর্ড লাগানো ঘরের সামনে। একটায় লেখা পোর্ট অথরিটি। আরেকটায় কাস্টমস হাউস।

‘এখানে কাস্টমস হাউস?’ অবাক হয়েছিল শবনম।

‘এক সময় এই বন্দরের বেশ গুরুত্ব ছিল জানিস। যতদিন গোয়া পর্তুগিজদের অধীনে ছিল ততদিন ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ব্যবসা হত এই পোর্টটা দিয়েই।’

‘আই সি। কিন্তু অফিসগুলো বন্ধই থাকে? ও আজ মনে হয় ছুটি।’

ঋতম এগিয়ে যায় আরও। ছোট্ট চাতালটার পর লম্বা একটা জেটি। তার একদিক দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। একদম শেষ ধাপে একটা লোক ছিপ নিয়ে বসে আছে চুপচাপ। একটা নাইলনের মাছ ধরার জাল পড়ে আছে অন্যদিকে। অনেক দূরে একটা ফিশিং ট্রলার বাঁধা।

‘এই একটা ছবি তুলে দিবি?’ মোবাইলটা এগিয়ে দেয় শবনম।

ঋতম মাথা নাড়ে। ‘নাঃ! পারব না। আমার তোলা ছবি তো পছন্দ হয় না তোর।’

‘কী আর করা… বাজে ফটোগ্রাফার… তুলেই দে। পরে আর বলব না।’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা হাতে নেয় ঋতম। তাক করে শবনমের দিকে। হ্যাটটা খুলে ফেলেছে শবনম। এলো করে দিয়েছে চুলটা। ছোট্ট সবুজ ফ্রক পরা। নীল সমুদ্রের ব্যাকগ্রাউন্ডে সুন্দর দেখাচ্ছে। বেশ কয়েকবার ক্লিক করে। তারপর গ্যালারি খুলে দেখতে থাকবে ছবিগুলো।

‘দে, দে।’ হাত থেকে ফোনটা প্রায় কেড়েই নেয় শবনম। আঙুল দিয়ে নেড়ে নেড়ে ছবিগুলো দেখে। ঠোঁট ওলটায়। ‘বকোয়াস! একদম বকোয়াস!’

ঋতম ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘তুই নিজেই তুলে নে না।’

তাই তুলব। চোখগুলো গোল করে বলে শবনম। ফোনটা তুলে নেয় মুখের সামনে। তারপর পাউট করে সেলফি তুলতে থাকে।

সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নেমে যায় ঋতম। সমুদ্র এখানে আশ্চর্য শান্ত। কালচে নীল জলে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ। কতগুলো সাদা পাখি উড়ছে খুব নীচ দিয়ে। অনেকদূরে আধডোবা পাহাড়গুলোর গায়ে সূর্যের ছায়া।

একেই বোধহয় ন্যাচারাল হার্বার বলে। শান্ত সমুদ্রে জাহাজ নোঙর করতে সুবিধেই হয়। তাই বোধহয় অনেকদিন আগে এখানে এসে বন্দর বানিয়েছিল ডাচরা। তারপর বৃটিশরা। এই বন্দর ছাড়াও, তার আরও অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে।

‘হই!’ পেছন থেকে এসে ঋতমের চুলগুলো ঘেঁটে দেয় শবনম। ‘স্টিল অ্যাংরি? মাই অ্যাংরি বয়।’

ঝটকা দিয়ে শবনমের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় ঋতম। ঠান্ডা গলায় বলে, ‘নট ইয়োরস। আই অ্যাম নট ইয়োরস!’

মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে যায় শবনম। একটা কালো ছায়া খেলে যায় ওর মুখের মধ্যে। দু’টো হাত দিয়ে ঋতমের কনুইগুলো চেপে ধরে। প্রায় খিমচে দেয়। চোখ দুটো জ্বলে ওঠে যেন। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘অ্যান্ড ইউ আর ইকুয়ালি রেসপন্সিবল!’

ওদের দিকে হঠাৎ ঘুরে তাকায় সিঁড়িতে বসা লোকটা। একটু অবাকই হয় যেন। ছিপটাকে এক টানে তুলে ফেলে জলের ওপর। তারপর আবার ছুঁড়ে দেয় দূরে।

শবনম সামলে নেয় নিজেকে। ঋতমের হাত দু’টো ছেড়ে হনহন করে হাঁটতে থাকে পোর্টের গেটের দিকে। কী করবে ভেবে উঠতে পারে না ঋতম। একবার মাছ ধরা লোকটাকে দেখে। তারপর ঘাড় ঘোরায় আবার। বেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে শবনম। আস্তে আস্তে কয়েক পা হেঁটে সেদিকে এগিয়ে আসে ঋতম।

আকাশটাকে বেদম পোড়াতে পোড়াতে মাঝ আকাশ থেকে অল্প পশ্চিমে হেলে গিয়েছে সূর্যটা। লম্বা লম্বা ছায়া পোর্টের বাড়িগুলোর গায়ে। কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে এই গোটা চত্বরটাকেই। অথচ একদিন এই বন্দরটাও জ্যান্ত ছিল। কত মানুষের ভিড় লেগে থাকত এখানে। এখন মৃতপ্রায়। অতীতের এক টুকরো স্মৃতি। ঠিক ওদের সম্পর্কটার মতো।

বৃষ্টি ছিল খুব। মুম্বাই এয়ারপোর্টে নামার আগে সমুদ্রের ওপর চক্কর কাটছিল প্লেনটা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল ঋতম।

সমুদ্রের পর অনাবিল শহরটা। উঁচু উঁচু স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো সারা গায়ে আলো জ্বালিয়ে ভিজে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে আরও স্পষ্ট উঠছিল। শহরের ওপরে পুরু মেঘের চাঁই। অন্ধকারের এক টুকরোই যেন জমাট বেঁধে আছে। অথচ তার একটু ওপরেই আস্ত একটা গোল চাঁদ। নরম কুসুম রঙের জোৎস্নার আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে মেঘেদের ওপরের স্তরে। জমাট ধোয়ার মতো মেঘেদের উঁচু-নীচু সেই আশ্চর্য কমলা আলো মেখে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূরে চাঁদ অবধি।

তারপরেই ঘুরে গিয়েছিল প্লেনটা। নেমে এসে ঢুকে পড়েছিল মেঘেদের মধ্যে। টার্বুলেন্সে কাঁপছিল।

অন্যবার প্লেন মাটি ছোঁয়া মাত্র শবনমকে মেসেজ করে ঋতম। সেদিনও ফোনটা নিয়েছিল হাতে। তারপর রেখে দিয়েছিল আবার। শবনমই ফোন করেছিল বেশ কিছুক্ষণ পরে। ঋতম ততক্ষণে ট্যাক্সিতে।

‘রিচড?’

‘ইয়েস!’

‘মেসেজ করিসনি।’

‘খুব ক্লান্ত আজকে। পরে কথা বলি?’

‘ওকে। টেক কেয়ার।’ ফোনটা রেখে দিয়েছিল শবনম। নাকি কেটে গিয়েছিল নিজে থেকেই। তীব্র বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে। ট্যাক্সির উইনশিল্ডের দিকে তাকিয়েছিল ঋতম। কাচের গা বেয়ে নেমে আসা অফুরন্ত জলস্রোতে একটা লাল আভা। পরমুহূর্তেই জলটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল ওয়াইপার দু’টো। পরিষ্কার কাচের মধ্যে দিয়ে ঋতম দেখতে পেয়েছিল দূরের রেড লাইটটা। হঠাৎ কমে গিয়েছিল ট্যাক্সিটার গতি।

‘তুই মুসলমান বিয়ে করবি!’ মা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না।

ঋতম চুপ করেছিল। ‘অন্যকিছু হলে তাও আপত্তি ছিল না। ঘরে রাধামাধব আছে…। ’ দম করে উঠে গিয়েছিল মা। সোজা চলে গিয়েছিল ঠাকুর ঘরে। সিংহাসনের সামনে উঁপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছিল হাউ হাউ করে। দরজার বাইরে থেকে দেখেছিল ঋতম। একবার ভেবেছিল ভেতরে ঢুকে মাকে তুলে ধরবে। পারেনি।

সেবার ফেরার সময় দরজা অবধি আসেনি মা। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে শুধু একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল ঋতম। দোতলার বারান্দাটা অন্ধকার। তার এক কোণে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে কে যেন। অস্পষ্ট। দেখা যাচ্ছিল না ভালো করে। মা কি? বাঁ হাতটা মাথার কাছে একবার তুলেছিল ঋতম। মুহূর্তে সরে হয়ে গিয়েছিল অস্পষ্ট মূর্তিটা।

শবনম আবার ফোন করেছিল পরের দিন রাতে। সকাল থেকেই ঋতমের দিনটা কেটেছিল প্রচণ্ড অস্বস্তিতে। অফিসের গিয়েও সে মন বসাতে পারেনি কাজে। বারবার মা’র কথা মনে পড়ছিল। এমনিতেও তো আর ফেরা হবে না কলকাতায়। এই শহরই এখন তার আবাসভূমি। শুধু কলকাতার সঙ্গে যে নাড়ির টান, তা ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী?

ফোন তুলে অজুহাত দিতে গিয়েছিল ঋতম। ‘আজ যে কী ব্যস্ততা গেল…’

শবনম ঋতমকে শেষ করতে দেয়নি। ‘লিসন, ক্যান উই মিট?’

ফোন রেখে ঋতম শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। সে মনস্থির করতে পারছিল না কিছুতেই। কেমন যেন একটা অস্বস্তি।

ক্যাফেটা জুহুতে। একদম সমুদ্রের ধারে। জানলার পাশেই বসেছিল দু’জন। বিচটা দেখা যাচ্ছিল দূরে। অনেক মানুষ। মুম্বাইয়ের সমুদ্র দেখতে এসেছে।

দুটো পিৎজা অর্ডার করেছিল শবনম। সেজে এসেছিল খুব। কানে একটা বিরাট ঝুমকো দুল।

‘তোর মা আপত্তি করছে তাই তো।’

ঋতম সোজাসুজিই বলেছিল। ‘হ্যাঁ, মা মানবে না।’

শবনম চোখগুলো একটু বড় করেছিল। ‘আর তুই?’

‘আমি?’ ঋতম বাইরে তাকিয়েছিল। দূরে বিচের ওপর, একটা ছোট্ট বাচ্চাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার মা। বাচ্চাটা বালিতে হাঁটছে টলমল করে। পড়ে গেল হঠাৎ।

‘কী এসে যায় বলতো… আমি তো আর কলকাতায় ফিরব না… এইখানে থাকলেই হল। তাছাড়া মা’ই বা আর কতদিন। বুড়ো হচ্ছে, পরে হয়তো মেনেও নেবে…’

‘আব্বু মানবে না।’

‘তুই বলেছিস ওদের!’ অবাক হয়েছিল ঋতম!

‘হ্যাঁ, ফোনে। আব্বু মানবে না কিছুতেই।‘

‘হোয়াট দ্য হেল… কী এসে যায় তাতে? আমরা এখানে থাকব… মুম্বাইতে… কেউ মানবে না তাতে কী এসে গেলে আমাদের?’

‘মুজফরনগর থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে আমাদের গ্রাম। আমার মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ওই গ্রামে আমিই প্রথম মেয়ে যে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে গেছে। তারপর আলিগড়। হোস্টেলে থেকেছি। সেখান থেকে মুম্বাইতে চাকরি… কতলোকে কথা শুনিয়েছে। কিন্তু আব্বু শোনেনি। আব্বু না থাকলে এতটা আসতে পারতাম না আমি…’

‘কিন্তু উনি তো আপত্তি করছেন… এটা মুম্বাই শবনম। ভারতের ফিন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। এখান থেকে মুজফরনগর অনেক দূরে। অনেক অনেক দূর। এই যে তুই এখানে হাঁটু অবধি ফ্রক পরেছিস… পারতি এটা তোর গ্রামে পরতে… ওটা একটা অন্য ভারতবর্ষ শবনম… আমরা ওটা ছেড়ে এসেছি।’

‘অন্য ভারতবর্ষ! মুম্বাইয়ের সব জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া পাই আমি? সব সোসাইটিতে? হোয়াট আর ইউ সেয়িং…’

‘সেটা… সেটা সলভ করা যাবে,’ অধৈর্য্য হয়ে পড়ে ঋতম, ‘এটাই যখন ভাবিস তখন… তখন এগোলি কেন?’

মাথাটা নীচু করে ফেলে শবনম। হাতের কাঁটা চামুচটা আস্তে আস্তে ঠুকতে থাকে প্লেটের ওপর। অস্ফুটে বলে, ‘আই ডোন্ট নো… আই ডোন্ট নো…’

শবনমকে উবারে তুলে দিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে বিচের ওপর চলে এসেছিল ঋতম। খানিকক্ষণ হেঁটেছিল উদ্দেশ্যহীন। কত লোক বসে আছে বিচের ওপর। দূরে সারি সারি দোকান। আলো জ্বলছে। ঋতম সমুদ্রের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল। আরব সাগরের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ ছুটে এসে স্পর্শ করছিল ওকে। ভিজিয়ে দিচ্ছিল ওর জুতো। প্যান্টের নীচটা। হাওয়া ধাক্কা দিচ্ছিল ওকে। মুম্বইয়ের সমুদ্রের আঁশটে পচা গন্ধ নাকে এসে লাগছিল ওর। মনে পড়ছিল এই শহরের সব নোংরা, সুয়ারেজের জল এই সমুদ্রেই এসে মেশে।

ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়েছে ওরা। স্বচ্ছ কাচের জানলার বাইরে বিরাট একটা চাঁদ। কয়েকটা স্বচ্ছ মেঘ উড়তে উড়তে ঠোকা দিচ্ছে তার গায়ে। নরম সেই স্পর্শে চাঁদের গায় থেকে বালির মতো ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে জোৎস্না। মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের গায়ে। নরম কমলা করে দিচ্ছে জলটাকে। সমুদ্রপাড়ের ঝাউয়ের সারি এখন শুধুই কালো অবয়ব। দূরের আধডোবা পাহাড়গুলোও। লম্বা কয়েকটা ঢেউ ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে তাদের গায়ে। তারপরেই ভেঙে যাচ্ছে সাদা হয়ে।

কাচের দেওয়ালের সামনের কাউচটায় বসে রয়েছে শবনম। ঋতম বসে আছে খাটের ওপর।

মাস চারেক যোগাযোগ ছিল না ওদের। তারপর একদিন হঠাৎ একদিন ফোন করেছিল ঋতমই। শবনম তুলেছিল। ফের দেখা করেছিল ওরা। জুহুর সেই কাফেটাতেই। শবনমের হাত আঁকড়ে ধরেছিল ঋতম। ‘কান্ট উই গিভ ওয়ান লাস্ট ট্রাই?’ চুপ করেছিল শবনম। সামনে রাখা আইসক্রিমটা গলে জল হয়ে গিয়েছিল। ঋতমের হাতটা ধরেই তাকিয়েছিল দূরে সমুদ্রের দিকে। তারপর কখন যেন বলেছিল, ‘লেটস গো অন আ হলিডে টুগেদার। ওয়ান লাস্ট টাইম।’

দুপুরে পোর্টের ভেতর হঠাৎ রেগে যাওয়ায় কেমন লজ্জা করে উঠেছিল ঋতমের। একবার কি সরি বলবে?

‘আমাদের আলাপটাই অদ্ভুত না? একটা অ্যাক্সিডেন্ট। সেদিন আমি না এগোলে…’ হঠাৎ বলে উঠেছিল শবনম।

ঋতম উত্তর দেয়নি কোনও। তার মনে পড়েছিল সেদিনের ঘটনাটা। ভিটি মানে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস থেকে কাফপ্যারেডে যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট শেয়ার ট্যাক্সির লাইন নেই। অথচ একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। সকালে অফিস টাইমে স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাইরের বাস গুমটির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে সবাই। চারজন হলেই দৌড়ে যায় পাশের ওয়ালচন্দ হিরাচন্দ মার্গের রাস্তাটায়। তারপর একটা ট্যাক্সি থামিয়ে দৌড়ে উঠে যায়।

সেদিনও অমন ভাবেই ট্যাক্সি থামিয়েছিল ঋতম। সামনের দরজা খুলে উঠতে যাবে এমন সময় একটা মেয়ে হঠাৎ ছুটে এসে দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘ক্যান আই গো।’

মেয়েটা ফর্সা। টানা টানা চোখ। খুব সুন্দরী। কয়েক মুহূর্ত অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল ঋতম। তারপর গম্ভীর ভাবে বলেছিল, ‘নো।’ মেয়েটাকে প্রায় সরিয়েই ট্যাক্সিতে উঠে গিয়েছিল।

মেয়েটার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল ক’দিন পরেই। কাফপ্যারেড থেকে ডবল ডেকার বাসে উঠে। দোতলায় ঋতমের পাশের সিটেই এসে বসে পড়েছিল। তারপর হাস্কি গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘হোয়াই আর ইউ সো রুড?’

কথাটা মনে পড়তেই হেঁসে ফেলে ঋতম। শবনমের সেদিনের বলার স্টাইলটা নকল করে বলে, ‘হোয়াই আর ইউ সো রুড।’

ঠিক সেদিনের উত্তরটাই আবার বলে শবনম। হাত তুলে একই কায়দায়। ‘হাই মাই নেম ইজ শবনম।’

হেসে ওঠে ওরা দু’জনেই। ঋতম হেসে এগিয়ে যায় শবনমের কাছে। দু’হাত দিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে শবনম। মাথাটা টেনে নামিয়ে আনে ঠোঁটে।

শবনমকে তুলে ফেলে ঋতম। এনে ফেলে খাটের ওপর। এক টানে ছিড়ে দেয় জামাটা। তারপর এক সঙ্গে উন্মাদ হয়ে যায় সমুদ্র ও চাঁদ। স্বচ্ছ দেওয়ালটা ভেদ করে ঢুকে পড়ে হোটেলের ঘরটায়। চাঁদের আকর্ষণে উত্তাল হয়ে যায় সমুদ্র। তুমুল ঢেউয়ের ডগা দিয়ে সে স্পর্শ করে চাঁদের শরীর। উদ্দাম সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে ওদের বিছানায়। সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলতে থাকে ওরা। গলে গলে মিশে যায় একে অপরের শরীরে। তারপর কখন এক সময় ঘর ছেড়ে চাঁদটা ফিরে যায় আকাশে। চলে যায় সমুদ্রটাও। ঋতমকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে শবনম।

ভিজে একটা হাওয়া দুলিয়ে দেয় শবনমের শরীর। দুলিয়ে দেয় তার নীচের বিছানাটাও। গোটা পৃথিবীটাই যেন দুলছে। চোখ খোলে শবনম। মাথার ওপর একটা ঘন কালো আকাশ। একটা দুটো ম্লান তারা। আরও দূরে সরু লিকলিকে একটা চাঁদ। কতগুলো কালো মেঘ জমাট বাঁধছে তার গায়ে।

চমকে উঠে পড়ে শবনম। একটা নৌকায় বসে আছে সে! চারদিকে ঘন নীল রাতের সমুদ্র। তার একটু সামনে বসে আছে ঋতম। অদ্ভুত একটা পোশাক পরা। ছোট্ট আঁটোসাঁটো কালো একটা কোট। চকরাবকরা একটা জামা। নীচে কালো প্যান্ট।

‘ওলা সেনিওরিটা!’ শবনমকে দেখে একগাল হাসে ঋতম।

শবনম অবাক হয় বেশ। তার গায়েও অদ্ভুত একটা পোশাক। ঢোলা জামা। ঢোলা স্কার্ট। নৌকার ওপরেই বসে আছে সে। কতগুলো লোক দাঁড় টানছে।

ঋতম বলে ওঠে আবার, ‘মাগডু, আমরা এসে গেছি প্রায়। আর কয়েক ঘন্টা।’ হাত তুলে ঈশারা করে দূরে। শবনম দেখে, দূরে সমুদ্রের ওপাশে কয়েকটা ক্ষীণ আলো।

‘ওই যে মিঙ্গুরিয়া! ডাচ বন্দর! দেখতো পাচ্ছো মাগডু?’

এসব কী বলছে ঋতম? শবনম বুঝতে পারে না। ‘আমাকে মাগডু বলছিস কেন?’

একটু যেন দমে যায় ঋতম। ‘ফই সিঙ্কেরিয়ের। সিনিওরিটা মাদালেনা করদোসা। তাহলে কি তোমায় মাদালেনাই বলব?’

ফই সিঙ্কেরিয়ের! ঋতম তো হিন্দি বলছে না? এমন ভাবেই কথা বলছে কেন?

শবনম আবার কথা বলার চেষ্টা করে, ‘কী উল্টো পাল্টা বলছিস, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ তার নিজের ভাষাটাও এবার খেয়াল হয় শবনমের। এই ভাষাটা সে শিখল কবে?

‘তুমি খুব চাপে আছো। বুঝতে পারছি। গুলিয়ে গিয়েছে তোমার মাদালেনা! আমি পুরুষোত্থামা। মিগেল। আমরা আজ ভোরের আগেই মিঙ্গুরলা পৌঁছে যাব। তারপর ওখান থেকে জাহাজে করে সেঁইলো – শ্রীলঙ্কা কিংবা বাটাভিয়া। না হলে, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের রাজ্যেও চলে যেতে পারি আমরা।’

দূরে তাকায় শবনম। ডুবো কয়েকটা পাহাড় ঘন কালো হয়ে জেগে আছে অন্ধকারে। তাদের পেছনে কালো মেঘগুলো। ডুবো পাহাড়গুলোর নাম মনে পড়ে তার। ‘ইলহিয়াউস কুইমাদোস। পোড়া পাহাড়!’ ওই নামেই তো ওই পাহাড়গুলোকে ডাকে গোয়ার পর্তুগিজরা। বাবা বলেছিল অনেকদিন আগে।

চোখ বন্ধ করে ফেলে শবনম। আস্তে আস্তে যেন সব কিছু মনে পড়ে যায়। বাবা! পাদ্রে! ম্যাটেওস কারদোসা। চাবুক মারছিল আর চিৎকার করছিল পুরুষোত্থামা। কঁকিয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠছিল। আর দোতলার ঘরটায় বসে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে।

তড়িঘড়ি পাশে রাখা কাপড়ের পুঁটুলিটা আঁকড়ে ধরে শবনম। আশ্বস্ত হয় ভেতরে লুকিয়ে রাখা কাঠের বাক্সটার স্পর্শে। ওর মধ্যেই সমস্ত গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়ে এসেছে সে।

সমুদ্রের তীর ঘেঁষে গির্জাটা। আর তার একটু পেছনে তাঁদের বাড়িটা। চারদিক গাছে ঘেরা। ওই বাগানেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল পুরুষোত্থামার। একটা লগি দিয়ে গাছ থেকে আম পাড়ছিল ছেলেটা। তারপর তুলে নিয়ে রাখছিল ঝুড়িটায়। একটা আম তুলে নিয়েছিল মাদালেনা। দাঁত দিয়ে ফুটো করে চুষতে শুরু করেছিল। ফুঁশে উঠেছিল ছেলেটা।

‘আমটা আপনি নিলেন কেন?’ বলেছিল ভাঙা ভাঙা পর্তুগিজে।

‘তুমি জানো আমি কে?’

‘আপনি যেই হোন, আমের হিসেব মালিককে দিতে হবে।’

অপমানে লাল হয়ে গিয়েছিল মাদালেনা। ভেবেছিল বাবাকে বলে এখনই চাবুক লাগায় ছেলেটাকে। আমটা ছুঁড়ে ফেলে গটগট করে চলে গিয়েছিল বাড়ির ভেতরে।

গোটা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি মাদালেনা। তারপর সকালে উঠে খোঁজ নিয়েছিল। তাদের মালির ছেলে। দু’দিন আগে এসেছে গ্রাম থেকে।

ক’দিন পরেই পুরুষোত্থামাকে আবার দেখেছিল মাদালেনা। জল দিচ্ছিল গাছে। হেঁটে সোজা এগিয়ে গিয়েছিল সে। ছেলেটাকে ডেকে সে বলেছিল, ‘ওলা! আমার নাম মাদালেনা!’ ছেলেটা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল।

তারপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখা হত তাদের। পুরুষাত্থামা আম পেড়ে নিয়ে আসত তার জন্য। তারপর কবে যেন আম বাগানের ভেতরে গাছের সঙ্গে ঠেসে ধরে পুরুষাত্থামাকে সে চুমু খেয়েছিল। কিন্তু জেনে গেল বাবা।

‘ওই কালো ছেলেটার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?’

‘ও আমার বন্ধু।’ বলতে পেরেছিল মাদালেনা। আসলে বলতে চেয়েছিল, ‘আমি ওকে ভালোবাসি।’ বলতে পারেনি। ‘বন্ধু! চাকর ও! ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব! চাকরা মাথায় উঠে যাবে। তাছাড়া তুমি বড় হয়েছো! ওর সঙ্গে তুমি মিশবে না।’

‘তবে যে গির্জার পাদ্রে বলেন সব মানুষ ঈশ্বরের সন্তান।’

‘মুখে মুখে কথা বলবে না তুমি। তোমাকে আমি পর্তুগালে পাঠিয়ে দেব!’ চিৎকার করে বলেছিল বাবা। তারপর ছুটে বাইরে গিয়ে ডেকেছিল পুরুষোত্থমা কে। এক লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দিয়েছিল বারান্দা থেকে। তারপর চাবুক বার করে ওকে মারতে শুরু করেছিল।

পরদিন সকালেই বাবা ওকে নিয়ে গিয়েছিল গির্জায়। কনফেশন করতে বাধ্য করেছিল। কনফেশন করেছিল মাদালেনা। কিন্তু মনে মনে মা মেরিকে বলেছিল পুরুষাত্থামাকে সে বিয়ে করবে। তারপর ছুটে চলে গিয়েছিল মায়ের কবরের সামনে। অনেকক্ষণ কেঁদেছিল।

সন্ধেবেলা, সে চলে গিয়েছিল পুরুষাত্থামাদের ঘরের সামনে। একটা ঢিল নিয়ে ছুঁড়েছিল জানলায়। কোঁকাতে কোঁকাতে বেরিয়ে এসেছিল পুরুষাত্থামা। মাদালেনাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

‘তুমি… আমি সামনের সপ্তাহেই চলে যাব গ্রামে। সাহেবকে কথা দিয়েছে বাবা!’

‘শোনো মিগেল। আমরা এখান থেকে পালাব। ডাচদের একটা পোর্ট আছে কাছেই। মিঙ্গুরলা। বিরাট বন্দর। সিলোন, বাটাভিয়া, জাপান, সারা পৃথিবীর জাহাজ আসে ওখানে। ডাচদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা। ক’বছর আগেও ওরা ব্যারিকেড করেছিল গোয়ার সব জাহাজ। ওখানেই পালাব আমরা।’

পুরুষাত্থামা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘না, না, পাপ হবে।’

তার কয়েকদিন পরে একদিন রাত্রে জানলা বেয়ে দোতলায় মাদালেনার ঘরে চলে এসেছিল পুরুষাত্থামা। ‘কোলিদের একটা নৌকো মাছ ধরতে যাবে সমুদ্রে। আমাদের ছেড়ে দিয়ে আসবে মিঙ্গুরলায়। তবে টাকা লাগবে কিছু।’

আলমারি খুলে মায়ের একটা গয়না বার করে দিয়েছিল মাদালেনা।

মিঙ্গুরলার আলোগুলো অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কালো মেঘগুলো এখন ঢেকে দিয়েছে সমস্ত আকাশ। অদৃশ্য চাঁদটা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নেমে আসছে ওদের ওপর। কালো অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। মাঝিরা চিৎকার করছিল। ছোটাছুটি করে সামাল দিতে চাইছিল নৌকাটা। চোখ বন্ধ মাদালেনার। ওর হাতটা ধরে বসে আছে পুরুষাত্থামা। বিড়বিড় করে বলছে, ‘আর একটু। আর একটুক্ষণ।’

হঠাৎ যেন টাল খায় নৌকাটা। নড়বড় করে ওঠে। পুরুষাত্থামা চিৎকার করে ওঠে, ‘ডুবে গেলাম! ডুবে গেলাম!’ মাঝিরা চিৎকার করে। ‘তীর! তীরে এসে গেছি আমরা!’ চোখ খুলে ফেলে মাদালেনা। কিছুটা দূরে অন্ধকার একটা ঝাউবন। দুলছে সমুদ্রের হাওয়ায়।

‘মিঙ্গুরলা!’ চিৎকার করে পুরুষাত্থামা। লাফিয়ে জলের নামে দু’জনে। ঠান্ডা জলটা। বায়ের নীচের বালি সরে যাচ্ছে চোরাটানে। কোনওমতে দু’জনে উঠে আসে তীরে। সামনে গাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে খুব জোরে।

মাদালেনাকে জড়িয়ে ধরে পুরুষাত্থামা। ওরা দু’জনেই ভিজে গিয়েছে একদম।

হঠাৎ কারা যেন চিৎকার করে ওঠে। ‘হল্ট হাউডেন!’

চমকে তাকায় ওরা। ক’জন সৈন্য। হাতে বন্দুক ধরা। পুরুষাত্থামা বসে পড়ে মাটিতে। হাত দু’টো তুলে দেয় ওপরে। সৈন্যগুলো কিছু একটা বলে চিৎকার করে। শব্দগুলো একটাও বুঝতে পারে না মাদালেনা। শুধু পর্তুগিজ আর স্পিওন শব্দটা কানে লাগে। ডাচ! ডাচ সৈন্য!

পুরুষাত্থামা চিৎকার করে, ‘আমিগো! আমিগো!’ একটা সৈন্য এগিয়ে এসে বন্দুকের বাট দিয়ে একটা ধাক্কা মারে ওকে। ছিটকে পড়ে পুরুষাত্থামা। ছুটে যায় মাদালেনা। পুরুষাত্থামাকে তুলতে যায় টেনে। সৈন্যটা ওকে ধরে ছিটকে ফেলে দেয় বালির ওপর। তারপর এসে বন্দুকটা তাক করে মুখের কাছে।

একটা ঝাপটা মেরে বন্দুকটা সরিয়ে দিতে যায় মাদালেনা। সৈন্যটা হঠাৎ বলে ওঠে, ‘শবনম, শবনম!’

ছিটকে উঠে বসে শবনম। হোটেলের ঘরটা। বিছানার ওপর ও। পুরুষোত্থামা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘শবনম! তুমি ঠিক আছো তো…’

‘পুরু… কে ঋতম!’

‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’

শবনম উঠে যায় স্বচ্ছ দেওয়ালটার দিকে। বাইরে তাকায়।

আকাশ জুড়ে সারি সারি তুলোর মতো মেঘ। তার মধ্যেই শরীর ঘষছে একটা আস্ত গোল চাঁদ। কেটে কেটে যেন ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। তরল হয়ে গড়িয়ে নামছে নীচে। তারপর সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে।

ঋতম এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। হাত রাখে কাঁধে। ‘স্বপ্ন দেখছিলে?’

‘হ্যাঁ!’

‘আমিও, অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। দেখছিলাম তুমি আর আমি একটা নৌকায় গোয়া থেকে…’

‘মাদালেনা! একটা পর্তুগিজ মেয়ে!’ অস্ফুটে বলে ওঠে শবনম!

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় ঋতম! ‘হ্যাঁ, তুমিও… আশ্চর্য! এমন কি হতে পারে!’

<Single Space>

শেষ নক্ষত্রটা নিভে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে চাঁদটাও। ঝাউগাছের পেছনের আকাশে সামান্য আলোর উদ্ভাস।

বিচের ওপর এসে দাঁড়ায় ওরা দু’জন। একটাও লোক নেই কোথাও। শুধু একটা বিরাট নৌকা কাত হয়ে পড়ে আছে বালির ওপর। তার পাশে দড়ি বাঁধা একটা নোঙর। নোঙরটাকে পেরিয়ে আরও এগিয়ে যায় ওরা। চলে আসে সমুদ্রের একদম কাছে। কতগুলো ঢেউ গড়াতে গড়াতে এসে ছুঁয়ে দেয় ওদের পা।

‘ইন্টারনেটে দেখলাম জানিস, ডাচরা ভেঙ্গুরলাকে মিঙ্গুরলা বলতো।’

‘আচ্ছা ওরা কি সত্যিই পৌঁছতে পেরেছিল?’ শবনম জিজ্ঞাসা করে।

‘কে জানে… কতদিন আগের একটা ঘটনা… আশ্চর্য!’

‘আমরা পারব? পৌঁছতে?’

‘কোথায়?’ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে। দু’টো হাত জোড় করে বলে, ‘বিয়ে করবি আমায়?’

শবনম ফিক করে হেসে ফেলে। তারপর দৌড়ে চলে যায় সমুদ্রের ভেতর। পেছন পেছন ছুটতে থাকে ঋতম।