Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৭

ফাইনহালস ঘরের দরজা অবধি হেঁটে গেল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় ঢুকছে না কীভাবে গত নয় বছর ধরে আপনি স্কুলে শিক্ষকতা করে চলেছেন!’

‘কোনো সমস্যা হয়নি আজ অবধি’ ইলোনা উত্তর দেয়… “কারণ আমি ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যেতে ভালবাসি, এবং এখনও এই কাজটাই করে চলেছি।’

‘এখনও? এখন স্কুল কোথায়?’

‘অবশ্যই, এখনও। অন্য জায়গায়, অন্য বাড়িতে স্কুল বসছে।’

‘এদিকে আপনাকে আবার এই বাড়িতেই থাকতে হবে। আপনাদের প্রিন্সিপাল খুব চালাক, এদিকে সব দেখাশুনা করবার জন্য এই বাড়িতে সবচেয়ে সুন্দরী শিক্ষয়িত্রীকে রেখে গিয়েছেন।’ ফাইনহালস লক্ষ্য করলো যে ইলোনার মুখ লাল হয়ে উঠছে। সে বলে চলে… ‘সবচেয়ে সুন্দরী আর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য!’ সে ঘরের জিনিসপত্রের দিকে একঝলক তাকিয়ে বলে ওঠে… ‘আপনার কাছে ইউরোপের মানচিত্র আছে?’

‘নিশ্চয়ই আছে।’ সে উত্তর দেয়।

‘পিন আছে?’ প্রশ্নটা শুনে ইলোনা বেশ মজা পেয়েছে এটা বোঝা যায়। তবে সে ইতিবাচক মাথা নাড়ে।

‘তাহলে হে দেবী, আমাকে কৃপা করবেন!’ ফাইনহালস বলতে থাকে, ‘ইউরোপের ম্যাপ আর কিছু পিন দেবেন আমায়!’ জামার বাঁ দিকের পকেটের বোতাম খুলে একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে তার মধ্যে কী সব ছিল সেগুলো নিজের হাতের চেটোতে ঢেলে দিল সে। দেখা গেল, ছোট ছোট লাল কার্ডবোর্ডের তৈরি নিশান।

‘আসুন’ ফাইনহালস হাসে, ‘একটা মজার খেলা খেলব আমরা।’ … ইলোনার দ্বিধা চোখ এড়ায় না তার… ‘আসুন, খেলি। কথা দিচ্ছি একবারও আপনাকে ছোঁব না!’



ইলোনা ধীরে ধীরে তার টেবিলের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে ম্যাপের শেলফের সামনে দাঁড়ায়। ফাইনহালস চারপাশে বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে যখন সে তার সামনে দিয়ে এগিয়ে যায়। তাকে ম্যাপের শেলফ থেকে ভারি রোলটা বের করতে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে যায়। ইলোনা রোলের দড়ির গেরো খুলে ধীরে ধীরে উঁচুতে টাঙ্গিয়ে দেয়। ফাইনহালস তার পাশে দাঁড়ায়। হাতে ছোট ছোট লাল নিশান… ‘হে ভগবান!’ সে বিড়বিড় করে… ‘আচ্ছা, আমরা কি জন্তু জানোয়ার? এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’

-‘হ্যাঁ, আছে!’ সে নরমভাবে বলে ওঠে তার দিকে তাকিয়ে। সে লক্ষ্য করে যে ইলোনা খুব আড়ষ্টভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে… ‘নেকড়ে বাঘ ভয় পাই আমি!’ বলে উঠে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে… ‘নেকড়ে বাঘেরা যে কোন সময় প্রেম, ভালোবাসা এসবের অবতারণা করতে পারে। খুব বিরক্তিকর ব্যক্তিত্ব হয় এরা। দয়া করে’… সে শীতলভাবে বলে… ‘এরকম কিছু করবেন না।’

‘কী?’ ফাইনহালস চমকে ওঠে।

‘প্রেম ভালবাসার কথা বলবেন না!’… খুব নরমভাবে বলে সে।

‘আপাতত একদম নয়। কথা দিচ্ছি।’ সে মনোযোগ দিয়ে ম্যাপের দিকে তাকায় এবং লক্ষ্য করে না যে পাশে দাঁড়ানো ইলোনা ছদ্ম গাম্ভীর্যের নিচে মুচকি হাসিটা লুকিয়ে ফেলেছে।

‘হ্যাঁ’ সে ম্যাপের সামনে থেকে নড়ে না… ‘পিনগুলো দিন’… সে অধৈর্যভাবে ম্যাপটার সামনে দাঁড়িয়ে নিখুঁতভাবে ছাপানো ম্যাপের পাহাড়পর্বত জঙ্গল, শহর সবকিছুর উপর দিয়ে হাত বোলায়। পূর্ব প্রুশিয়ার পূর্বকোণ থেকে সোজা একটা রেখা এসে ওরাডিয়াতে নেমেছে। মাঝে লেমবার্গের কাছে রেখাটা একটু আঁকাবাঁকা। ফাইনহালস অধৈর্য ভঙ্গিতে তাকায় ইলোনার দিকে। ইলোনা একটা আলমারির বিশাল ড্রয়ারের মধ্যে খুঁজতে থাকে। আলমারির মধ্যে ভাঁজ করা জামাকাপড়, শিশুদের ডায়াপার, একটা বড় ন্যাংটো পুতুল সব দেখা যায়। সে একটা বড় টিনের বাক্স ভর্তি পিন নিয়ে আসে তাড়াতাড়ি। ফাইনহালস লাল আর নীল মাথাওয়ালা পিনগুলো বেছে তুলে নেয় চটপট বাক্স থেকে। পিনগুলো ছোট কার্ডবোর্ডের নিশানের মধ্য দিয়ে গলিয়ে ম্যাপের মধ্যে সাবধানে গেঁথে দিতে থাকে সে।



বাইরে থেকে নানারকম শব্দ আসতে থাকে আবার। দরজা খোলা বন্ধ করবার দুমদাম শব্দ, ভারি বুটের পদশব্দ, সার্জেন্ট এবং সৈন্যদের কথাবার্তার শব্দ। ফাইনহালসের দিকে ইলোনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়…

‘কী হয়েছে?’ ভীতচকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে সে।

‘কিচ্ছু না!’ নির্বিকারভাবে জবাব দেয় সে… ‘প্রথম ব্যাচের জখম রুগিরা এসে গেছে।’ সে একটা ছোট নিশান ম্যাপের মধ্যে ‘নাগিভারাদ’ লেখা ছোট বিন্দুর উপরে গেঁথে দেয়। তারপর যুগোস্লাভিয়ার উপরে হাত রাখে সে; আরেকটা পিন সাবধানে গেঁথে দেয় বেলগ্রেডের উপরে। তারপর আরেকটা গেঁথে দেয় রোমে। জার্মানির সীমানার এত কাছে প্যারিসের অবস্থান দেখে একটু বিস্মিত হয় সে। বাঁ হাত প্যারিসের উপরে রাখে সে, তারপর ডান হাত ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে আসে স্তালিনগ্রাদের উপর।

সে লক্ষ্য করে যে স্তালিনগ্রাদ আর ওরাডিয়ার মাঝের দুরত্ব প্যারিস আর ওরাডিয়ার মাঝের দুরত্বের চেয়ে অনেক বেশি। সে কাঁধ ঝাঁকায়। মাঝের দুরত্ব বোঝবার জন্য স্থানের বিন্দুগুলি সাবধানে পিন দিয়ে গেঁথে রাখে।

‘ওহ!’ ইলোনা অস্ফুটে আর্তনাদ করে… সে তার দিকে তাকায়। ইলোনাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। মুখটা শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। বাদামী, মসৃণ গাল, গাঢ় রঙের চোখের মণি। তার চুলের গুচ্ছ কপালের উপরে নেমে এসেছে। তবে ছবিতে যেমন দেখাচ্ছে, তেমন নয়। কপালের অনেকটা উপরে এখন গুচ্ছগুলি। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠেছে তার।

‘খেলাটা বেশ মজার না?’ সে নরমস্বরে প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ,’ সে বলে, ‘অসহ্য! বলা যায়… বলা যায়, খুব অদ্ভুত!’

‘ব্যাপারটা পরিষ্কার, সেটাই বোঝাতে চাইছেন, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, একদম’ সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে… ‘একদম পরিষ্কার! ঘরে বসে বোঝা যাচ্ছে সব।’

নিচের হলঘরের কলরব অনেকটাই থেমে গেছে; কিম্বা হয়তো মাঝখানের দরজাটা বন্ধ বলে কিছু শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু ফাইনহালস হঠাৎ শুনতে পেল যে তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে। ‘বদমায়েশ’ … সার্জেন্ট চিৎকার করছে… ‘কোন চুলোয় গেছেন আপনি?’

ইলোনা তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলে ওঠে…‘আপনাকে ডাকছে কেউ?’

‘হ্যাঁ’

‘চলে যান!’ নরম স্বরে বলে সে… ‘আমি চাইনা যে কেউ আপনাকে এখানে দেখুক।’

‘আপনি এখানে কতক্ষণ আছেন?’

‘সাতটা অবধি।’

‘আমার জন্য অপেক্ষা করবেন- আমি আবার আসব!’

সে মাথা নাড়ে। মুখ লাল হয়ে ওঠে তার। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে সামনে, যতক্ষণ না ফাইনহালস সরে গিয়ে তাকে টেবিলের নিজস্ব কোণে যাওয়ার পথ করে না দেয়।

‘জানালার তাকে একটা প্যাকেট আছে। ওর মধ্যে কেক আছে। ওটা আপনার জন্য!’ বলে ফাইনহালস দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে হলের দিকে যায়।

সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে সে, যদিও মাঝের হলঘর থেকে সে সার্জেন্টের ‘ফাইনহালস’ বলে ডাকাডাকি শুনতে পেয়েছে। জোর্নার ছবির দিকে তাকিয়ে হাসে সে, বেয়াল্লিশের ব্যাচের ছবির পাশ দিয়ে যাবার সময়। অন্ধকার হয়ে আসছে। ইলোনার ছবিতে মুখটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, যদিও চাতালের মাঝ বরাবর ছবিটা টাঙ্গানো। চাপ চাপ অন্ধকার জমে আছে সিঁড়িতে। একতলার সিঁড়ির মাঝবরাবর সার্জেন্টকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে…

‘হে ভগবান! কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন আপনি? একঘণ্টা ধরে আপনাকে খুঁজে মরছি!’

‘আমি তো শহরে গিয়েছিলাম। পোস্টারের জন্য কার্ডবোর্ড কিনতে গিয়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু সেও তো প্রায় আধঘণ্টা হল ফিরে এসেছেন। আসুন, আসুন!’ হাত বাড়িয়ে সে ফাইনহালসকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে। ঘরগুলোর থেকে নানা রকম শব্দের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। রাশিয়ান নার্সরা হাতে ট্রে নিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।

জোকারহেলি থেকে চলে আসার পরেই সার্জেন্ট এখন ফাইনহালসের সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করছেন। অবশ্য সবার সঙ্গেই মোটামুটি ভালো ব্যবহার করছেন, আবার মাঝে মাঝে বেশ ঘাবড়ে যাচ্ছেন। কারণ এখানে নতুন প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলবার দায়িত্ব পড়েছে ওর কাঁধে।

সার্জেন্ট কেন মাঝেমাঝেই ঘাবড়ে থাকেন, সেটা ফাইনহালসের পক্ষে ঠিকঠাক বুঝে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনাবাহিনীতে এমন কিছু ঘটছে, যেগুলো ফাইনহালসের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; তাছাড়া এইসব ঘটনার গুরুত্বও তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবে সার্জেন্ট এসবে বেশ অভ্যস্ত, তিনি এদ্দিন এসব সামলে এসেছেন। কিন্তু বিষয়টা আর আগের মত নেই। সম্ভবত সেটাই তাকে পীড়া দিচ্ছে। অতীতে, কারো স্থানান্তর, দায়িত্ব হস্তান্তর এইসব ব্যাপারগুলোর নির্দেশ উপরমহল থেকে আসত ফোন মারফত। উপরমহলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত, যথাসম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করে সেই সিদ্ধান্ত যাদের জন্য জরুরি, শুধুমাত্র তারাই জানতে পারত। তাছাড়া অনভিপ্রেত ঘটনা খুব কম ঘটত। এইসব খবরাখবর ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। চরম পরিস্থিতিতে একটা ডাক্তারি পরীক্ষা হত, একটা ফোন কল আসত। ব্যস, ব্যাপার মিটে যেত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদম আলাদা। ফোন কলগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, অতীতে যারা ফোনের মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশ দিত, তারা এখন নেই; কিম্বা থাকলেও কোথায় আছে, সেটা জানা যাচ্ছে না। এখন ফোনের ওপার থেকে যারা কথা বলছে, তুমি তাদের চেন না, তারাও তোমাকে চেনে না। তারা আগের মত আর তোমায় সাহায্য করতে উদগ্রীব নয়, কারণ তারা খুব ভালো করে জানে যে তাদের প্রয়োজনে তোমার সাহায্য তারা পাবে না। যোগাযোগের সম্পূর্ণ যে সূত্র ছিল, সেটা একদম জট পাকিয়ে গেছে। এখন যেটা করণীয়, সেটা হল প্রতিদিন নিজের গা বাঁচিয়ে চলা। এতদিন অবধি টেলিফোনের মধ্যেই যুদ্ধটা সীমিত ছিল। এখন টেলিফোন ছাপিয়ে ব্যাপারটা মাথার উপরে এসে পড়ছে রোজ। দায়িত্ব, শব্দসঙ্কেত, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের চেহারা, আচার আচরণ প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। রাতারাতি এমন জায়গায়, এমন ডিভিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে, যেখানে একজন জেনারাল, তিন জন স্টাফ অফিসার আর কয়েকজন কেরানি ছাড়া আর কেউ নেই।

একতলায় পৌঁছে সার্জেন্ট ফাইনহালসের হাতটা ছেড়ে দিল। ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তারা। ঘরের ভিতরে ওটেন বসে আছে একটা টেবিলে। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ধূমপান করছে সে। যে টেবিলে বসে আছে, সেই টেবিলের উপরে সিগারেটের পোড়া দাগের গাঢ় একটা চিহ্ন আছে।

‘অবশেষে’… বলে উঠে সে খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখল। সার্জেন্ট ফাইনহালসের দিকে তাকাল, ফাইনহালস ওটেনের দিকে।

‘আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়!’ সার্জেন্ট কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে, … ‘যাদের বয়স চল্লিশের নিচে, এবং যারা স্থায়ী কর্মী অথবা রুগি নয়, তাদের ছেড়ে দিতে হবে। কিচ্ছু করার নেই! আপনাদের যেতে হবে।’

‘কোথায়?’ ফাইনহালস প্রশ্ন করে।

‘ফ্রন্টে, নিয়ন্ত্রণ রেখার কেন্দ্রে, এখনই!’ ওটেন বলে ওঠে। সে ফাইনহালসের হাতে মার্চিং অর্ডারের কাগজটা দেয়।

‘এখনই?’ ফাইনহালস হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।



(চলবে)