Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





আমার ভারতবর্ষ-৪

ব্যাপ্ত হোক...

দিনটা ছিলো ইস্টার।

ইস্টার প্রাচীন পূর্ব সেমিটিক প্রজনন, প্রেম ও যুদ্ধের দেবী ইশতারের সঙ্গে জড়িত একটি উদযাপন, কিন্তু খ্রিস্টিয় ঐতিহ্যে তা একটা ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে এসেছিলো। নিউ টেস্টামেন্ট বলে, ইস্টার পর্বটিই সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ খ্রিস্টিয় উদযাপন। তাঁদের মতে এর মধ্যে দিয়েই মৃত্যুর উপর শাশ্বত জীবনের জয় ঘোষণা করা হয়। খ্রিস্টের নশ্বর পার্থিব অস্তিত্বের পুনরুত্থান তত্ত্বটি অনেকে স্বীকার করেন না। কিন্তু এর সঙ্গে বিজড়িত প্রাগৈতিহাসিক লোকাচার, যেমন পূর্বপুরুষদের আত্মার প্রতি প্রার্থনা বা খ্রিস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন সেমেটিক ইহুদি প্রথা পাসওভার ও সামূহিক শোকপর্ব লেন্টকে যদি যুক্তির বিচারে বাতিলও করা হয়, তবু "ব্যাপ্ত হোক জীবনের জয়...." আহ্বানটির মানবিক মূল্য স্বীকার করতেই হবে। ইস্টার হয়তো সেই জন্যই একটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যাপন।
---------------------------

দুঃখশোক, তৃষ্ণার উপর জীবনের জয়'কে যিনি মানুষের একমাত্র সার্থকতা হিসেবে স্বীকার করেছিলেন, ইস্টার উদযাপন করতে কিছুদিন ​​​​​​​আগে তাঁর কাছে যাবার ইচ্ছে হয়েছিলো। নাহ, খ্রিস্ট ন'ন, তাঁর দর্শনগুরু শাক্যমুনি গৌতমবুদ্ধকে স্মরণ করে যে 'শান্তিস্তূপ'টি নিপ্পনভক্তরা স্থাপন করেছিলেন ধবলগিরি বা ধৌলি'তে, সেখানেই রওনা দিলুম কিছুক্ষণ বসার জন্য। কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা। শব্দহীন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাওয়া সেই মানুষদের, যাঁদের দৌলতে পৃথিবী এতো হিংস্র অপহ্নবের শিকার হবার পরেও মানুষের বাসযোগ্য হয়ে রয়ে গেছে।

------------------------------------------


শহর থেকে একটু দূর, নদী পেরিয়ে অনুচ্চ পাহাড়টির কাছে যাওয়া। ভোরসকালে গাড়ির ভিড় থাকেনা। যতোটা উপরে যাওয়া যায়, ততোদূর গাড়ি পৌঁছে যায় অনায়াস। ভোরের আলোয় সেই শাদা বিরাট স্তূপটির পিছনে যখন সূর্য একটু একটু করে বেড়ে ওঠে, পশ্চিমমুখী মূল প্রবেশ থেকে তাকে খুব বিনম্র মনে হয়। এই টিলাটি এককালে পিয়দস্সি অশোকের প্রিয় ভূমি ছিলো। দয়ানদীর পারে এই পাহাড়টির ভিত্তিভূমিতে অশোক স্থাপন করেছিলেন তাঁর দণ্ডনীতির বিশদ শিলালিপি। কিংবদন্তি বলছে এই প্রান্তরেই কুখ্যাত কলিঙ্গযুদ্ধের রক্তস্নান দেখে চণ্ডাশোকের ধর্মাশোক হয়ে ওঠা। যদিও এসবের কতোটা কাহিনী, কতোটা ইতিহাস, বলা যায়না, তবু এর স্থানমাহাত্ম্য অস্বীকার করার মতো নয়। প্রামাণ্য বৌদ্ধ ইতিহাসে প্রাচীন ধৌলি রাজ্য ও তার প্রভাবের ইতিবৃত্ত অনেক সূত্রেই আমরা দেখতে পাই।
----------------------------------------------
১৯৭২ সালে জাপান বুদ্ধ সঙ্ঘ এবং কলিঙ্গ-নিপ্পন বুদ্ধ সঙ্ঘের মিলিত প্রয়াসে, জাপানের নিচিরেন বৌদ্ধগোষ্ঠীর নিপ্পনজেন মিয়োহোজি মঠের প্রধান ভিক্ষুর তত্ত্বাবধানে এই স্তূপটির স্থাপনা হয়। নাম দেওয়া হয় 'শান্তিস্তূপ'। অগণ্য শ্রেষ্ঠ মন্দিরের দেশ, ওড়িশা ও ভুবনেশ্বরের গরিমা মনে রেখেও এই স্তূপটি বিশালত্ব ও গাম্ভীর্যে মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য স্বতোৎসার আকর্ষণ করে চলেছে। এর চারপ্রান্তে বুদ্ধের বাল্যমুদ্রা, ভূমিস্পর্শমুদ্রা, ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রা এবং মহাপরিনির্বাণের অনুপম মূর্তিগুলি নির্মিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বাস রিলিফ প্যানেলে বুদ্ধের জীবনকালের ধারাবিবরণী এবং কলিঙ্গ ইতিহাসে বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিবৃত্তও দেখা যায়। ওড়িশার দিগগজ ভাস্করদের যোগদানে এই সব কলাকৃতি যে আধুনিক ভারতের ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের একটা পর্যায় হয়ে উঠতে পেরেছে, সেটা নিশ্চিত। শৈলি বিচার করলে এই সব ভাস্কর্য দেশের দুই শ্রেষ্ঠ ঘরানা, কলিঙ্গ ও মথুরা'র মিশ্রণ।


সচরাচর পুরী যাবার পথে ব্যস্ত পর্যটকের দল ত্বরিত যাত্রাভঙ্গ করে এই স্তূপটি দেখতে আসেন। কিন্তু শুধুমাত্র পর্যটক আকর্ষণ নয়, এর কাছে চাইলে আরো অনেক কিছু পাওয়ার আছে। এই অর্বাচীন নির্মাণটির হয়তো অনুরাধাপুরা বা সারনাথের মতো কোনও গরিমাময় ইতিহাস নেই ; কিন্তু এই ঠিকানায় দুদণ্ড শান্তিতে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো মৌন অবকাশ দেশের খুব কম দেবস্থানেই পাওয়ার সুযোগ হয়। ঐ উঁচু পাহাড়ের শিখর থেকে দেখা দয়ানদী, আদিগন্ত সবুজ প্রান্তর, ভাসানো হাওয়ার প্লাবন, নীলাচলের দিকচিহ্ন ঘেরা অপার চরাচর , আমাদের দশ ফুট বাই দশফুট পৃথিবীর গারদখানার শিকল থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও, মুক্তি দেয়। সব সাধনই তো বাঁধন ছেঁড়ার। কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী হওয়ার ক্ষণিক আনন্দ কখনও কখনও হরিপদ কেরানিরও নসিব হয়ে যায়, এইভাবে।