Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in

















আমার ভারতবর্ষ- ৩

একটি সমাধি ও সুন্দরীরা


তিনি ছিলেন কুলীন ইরানি রক্তের অভিজাত রাজপুরুষ। নাম, মির্জা ঘিয়াস বেগ। ইরানদেশ থেকে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের রাজসভায় সভাসদ হিসেবে। সঙ্গে ছিলো তাঁর পরিবার। স্ত্রী আসমত বেগম আর কন্যা মেহরুন্নিসা। সতেরো বছর বয়সে পরমাসুন্দরী মেহরুন্নিসা পড়ে গেলেন শাহ-এন-শাহ আকবরের ওয়ারিশ শাহজাদা সলিমের নেকনজরে। আকবর রাজি ছিলেন না। তাই বিবাহ হতে পারলো না। মেহরুন্নিসার বিয়ে হয়ে গেলো বিহারের সুবেদার ইরানি সেনাপতি শের আফঘানের সঙ্গে। কিন্তু সলিম তাঁকে ভুলতে পারেননি। বাদশা আকবরের ইন্তেকাল হলো ১৬০৫ সালের অক্টোবর মাসে। মসনদ পেলেন শাহজাদা সলিম। বাদশা হয়ে নাম নিলেন জহাঙ্গির। মানে, সারা পৃথিবীর রাজা। এবার তাঁর সময় এলো। দুবছর পরেই তিনি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করলেন শের আফঘানকে। কিন্তু মেহরুন্নিসা তৎক্ষণাৎ ধরা দেননি। তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো জহাঙ্গিরকে। তার পর সম্রাটের বিশ নম্বর বেগম হয়ে মুঘল অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন মেহরুন্নিসা। জহাঙ্গির তাঁকেই মালকা-ই-হিন্দুস্তান ঘোষণা করে নাম দিলেন 'নূরজহান'। তাঁর পিতা মির্জা ঘিয়াস বেগ বজিরে-আজমের পদ ও সাতহজারি মনসবদারি পেয়ে গেলেন জহাঙ্গিরের রাজসভায়। সেখানেই শেষ নয়। মির্জা ঘিয়াস বেগ দায়িত্ব পেলেন রাজকীয় কোষাগারের। উপাধি, ইতমদ-উদ-দ্দৌলাহ। অমিত ক্ষমতাশালী এই রাজপুরুষের ইন্তেকাল হলো ১৬২২ সালে। কন্যা নূরজহান তখন তাঁর পিতামাতার সমাধিস্থল হিসেবে নির্মাণ করলেন এই স্মৃতিসৌধটি। প্রসঙ্গত, বাদশা শাহজহানের প্রিয় বেগম আর্জুমন্দ বানু ওরফে মমতাজ মহল ছিলেন মির্জা ঘিয়াস বেগের পুত্র আবুল হাসান আসফ খানের কন্যা। বোঝাই যাচ্ছে, এই বংশের মেয়েরা কেমন রূপসী হতো।


মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এই সমাধিসৌধটি অনেক বিষয়েই অনন্য। এটি একটি গম্বুজবিহীন ব্যতিক্রমী নির্মাণ। উপরন্তু শ্বেতমর্মরে আবৃত প্রথম মুঘল স্থাপত্য। তাজমহলের উপযুক্ত পূর্বসূরি হিসেবে এরই নাম আসে। যমুনা নদীর পূর্বপারে মুঘল চারবাগ (চতুষ্কোণ বাগান পরিবৃত) ভিত্তিকে কেন্দ্র করে এটি নির্মিত হয়েছিলো। মূল প্রবেশপথটি পূর্বদিকে এবং পশ্চিমদিকে নদীর তীরে পশ্চিমপ্রান্তে লালপাথরের বিশাল তোরণ পারসিক শৈলীর, যাকে 'আইওয়ন' বলা হয়। 

উত্তর ও দক্ষিণেও উপযুক্ত জমকালো আইওয়ন রয়েছে। বর্গাকার পরিসরের মূল প্রবেশ তোরণটি পেরোলেই শ্বেতশুভ্র অনুপম সৌধটি চারদিকে বাগান, পদ্মসরোবর, ফোয়ারা ও জলপ্রণালী দিয়ে ঘেরা। ভিত্তিটি লালপাথরের। ছাদটি বর্গাকার 'বারাদরি' শৈলীর এবং চারদিকে খিলান দিয়ে শেষ হয়েছে। চূড়াটি চৌখণ্ডী পিরামিডের মতো এবং শিখরে পদ্মদল কলস দেখতে পাওয়া যায়। চারদিকে আটকোনী মিনারগুলির শীর্ষে ছত্রির কারুকাজ।

কেন্দ্রে একটি বর্গাকার হলঘরকে ঘিরে তিনটি আর্চ দিয়ে গড়া চারদিকে চারটি প্রবেশদ্বার আছে। ঠিক মাঝখানে মির্জা ঘিয়াস বেগ এবং তাঁর পত্নী আসমত বেগমের সমাধি। পাশের ঘরগুলিতে আছে নূরজাহানের কন্যা লাডলি বেগম ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সমাধি। সৌধটির ভিতরে ও বাইরে রয়েছে শ্বেতপাথরের উপর নানা রঙের ইনলে করা নক্শা। এইসব কারুকাজের সূক্ষ্মতা ও শিল্পমূল্যের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র মির্জা ঘিয়াস বেগের পৌত্রীর  স্মৃতিতে তাঁর  নাতজামাইয়ের  নির্মিত  তাজমহলের সঙ্গে।  সুরাপাত্র,  পেয়ালা-পিরিচ, সাইপ্রেস 
শাখা, নানা ধরনের ফুল, ফুলদানি ইত্যাদি ইরানিয় নক্শার আদলে। শিল্পী ছিলেন বিখ্যাত ইরানিয় স্থপতি ও আঁকিয়ে উস্তাদ মনসুর 'নক্কাশ'। নানা ধরনের চিত্রকর্ম ছাড়াও উপরদিকে খোদাই করা আছে কুরানের ৪৮, ৬৭ আর ৭৩ শুরার বাণীগুলি। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য এখানের জালি ও জাফরির কাজ। এ বিষয়ে বিশদ লিখতে গেলে একটি পৃথক বই হয়ে যাবে। তবে মুঘলদের স্বভাবসিদ্ধ লালপাথরের বিপুলাকার প্রাসাদ আর সৌধ নির্মাণের পরম্পরায় এই সৌধটি থেকে প্রথম শ্বেতপাথরের ব্যবহার শুরু হয়।


সিকন্দরায় আকবরের সমাধি আর আগ্রায় তাজমহলের মাঝখানে ইতমদদ্দৌলাহের এই সমাধি মুঘলদের শিল্পরুচিতে ইরানিয় শিল্পিত,মার্জিত নান্দনিকতার প্রবেশ সূচিত করে। যাঁদের ভারতীয় শিল্প, স্থাপত্য, গরিমার উত্তরাধিকার নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে, তাঁদের জন্য অবশ্যদ্রষ্টব্য এই নিদর্শনটি।



আগ্রায় দেখেছি সাধারণত স্থানীয় গাড়িচালকরা অত্যন্ত ভিড় আর অনিয়ন্ত্রিত ট্র্যাফিকের জন্য নদীর উপর শীর্ণসেতু পেরিয়ে এই জায়গাটিতে আসতে বিশেষ রাজি হননা। তবে জোর করলে চলে আসেন। হয়তো একটু বেশি ভাড়া চাইতেও পারেন। কিন্তু সেসবের জন্য পরোয়া না করে এখানে আসতেই হয়।

ইনশাল্লাহ...