Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in

 














এবার ইউরোপ – ৩


আজও এ এক দু-চোখে ঘোর লেগে থাকা সময়। ভাবতে আর বলতে আরম্ভ করলে আর শেষ হতে চায় না। এতটা সময় কেটে গেছে অথচ বলার কথা যেন এখনও ফুরোয়নি। তাই ইতিমধ্যে দুটি কিস্তি লিখে ফেলেছি তবুও তিন দশক আগেকার সেই স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছি অনর্গল। এবং লক্ষ্য করছি এই ভ্রমণের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে পাশ্চাত্য হেঁশেল সংস্কৃতি। যেটা বাদ দিলে ঘটনাক্রম বর্ণহীন হয়ে পড়ে অনেকটাই।

আগের বার শেষ করেছিলাম এক স্বল্প পরিচিতের কাছ থেকে কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ের সুবাদে ক্ষুধার্ত অবস্থায় অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে পিৎজা পেয়ে। পিৎজা। চলুন এর জন্মবৃত্তান্ত একটু ঘেঁটে দেখা যাক। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের আগে জন্ম। মিশর আর গ্রিস ছাড়াও রোমানদের মধ্যে প্রাচীন সেই সময়ে চ্যাপ্টা রুটির ওপর চিজ ও অন্যান্য ফলের টুকরো ছড়িয়ে খাওয়ার চল ছিলো। সে ছিলো অন্য এক যুগ এবং একথা লিখলে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে তখনও আজকের পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় এই খাবারটি কেকের গোত্রভুক্ত। মজার ব্যাপার, যে জিনিসটির অন্তর্ভুক্তি পিৎজাকে করে তুললো মহার্ঘ্য, সেই টমেটো কিন্তু সেসময় এর স্বাদের অংশ ছিলো না। যে পিৎজা আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলো ইতালীয় ভাগ্যান্বেষীদের হাত ধরে আশ্চর্যজনকভাবে সেই আমেরিকাই সতেরো শতকে ইতালিকে উপহার দিলো টমেটো, যাকে ছাড়া শুধু পিৎজা কেন, কোনও ইতালীয় রান্নাঘর কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে উঠলো কালক্রমে। কিন্তু যে খাদ্যবস্তুটি অনায়াসে হয়ে উঠতে পারে হলিউডের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এক চলচ্চিত্রের বিষয়, আধুনিক সেই পিৎজার জনক দক্ষিণ-পূর্ব ইতালির নেপলস্‌ অঞ্চলের এক শেফ। ১১ জুন ১৮৮৯ নেপেলস্‌-এরই এক রেস্তোরাঁর মালিক এবং রাঁধুনি রাফায়েলে এসপোসিতো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। রাণি মার্গারিতার জন্য তৈরি করলেন এক পিৎজা, যাতে জাতীয় পতাকার অনুকরণে ব্যবহার করলেন টমেটো আর বেসিল। এদের মাঝখানে সদর্পে বিরাজ করছিলেন অবশ্যই আরেক অনবদ্য ইতালীয় সৃষ্টি, মোৎসারেলা চিজ! জন্ম নিলো পিৎজা মার্গারিতা। মনে রাখতে হবে তখনও পর্যন্ত এই বস্তুটি অভিজাত সম্প্রদায়ের খাদ্য তালিকায় জায়গা পায়নি। মূলত গরিব মানুষ অথবা ‘স্ট্রিট ফুড’ হিসেবেই বিবেচিত হতো। এমনকি ১৮৮৯ এর ওই বিপ্লব ঘটার পরও ১৯২৭-এর আগে কোনও রেসিপি বইতে জায়গা পায়নি ভুবনমোহিনী পিৎজা সুন্দরী। একটা তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে একশো একর পিৎজা গলাধঃকরণ করে থাকে মার্কিনিরা! অবিশ্বাস্য! তাই না?

সে যাই হোক সেদিনের সেই পিৎজায় দু-এক কামড় দিতে না দিতে হাজির হলো হানস্‌। এখন আমাদের গন্তব্য হ্যোক্সটার, হানসের মা-বাবার বাসস্থান আর হানসের বাবা যে শহরের পরিকল্পক। আমরা পৌঁছলাম দুপুরের খাওয়ার ঠিক আগে। দোতলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলের একটি ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো, যে ঘরটি সম্ভবত ছিলো হানসের ছোটো ভাই গ্রেগরের। ঝকঝকে আকাশ কিন্তু অক্টোবরের সূর্যের তেজ তেমন ছিলো না আর সেই সূর্যালোকে মিশে যাচ্ছিলো হালকা হিমেল বাতাস। এমন আবহাওয়ায় জার্মান পরিবারটি অতিথি আপ্যায়নের জন্য সঙ্গত কারণেই বেছে নিয়েছিলেন বাড়ির পিছনদিকের চমৎকার বাগানটি। আমরা পৌঁছনোর আগেই পাতা হয়েছিলো টেবিল আর চেয়ার। টেবিলের ওপর যে ঢাকাটি পাতা হয়েছিলো, তার এমব্রয়ডারির সৌন্দর্য ভুলিনি সেদিনের পর প্রায় একত্রিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও। কার হাতের কাজ ছিলো সেটা হানসের মা নিশ্চয়ই বলেছিলেন, কিন্তু আজ আর তা মনে নেই। যা স্পষ্ট মনে যা আছে, তা হলো এফা মানে হানসের মা আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন ব্রাউন রাইস (জার্মান ভাষায় নাটুর রাইস) আর চিকেন ইন ওরিয়েন্টাল সস। ব্রাউন রাইসের সঙ্গে এনকাউন্টার সেই প্রথম। পুষ্টির মানদণ্ডে আমাদের অতি পরিচিত সাদা ভাতের চেয়ে যে অনেক এগিয়ে আছে তখনও জানা ছিলো না মোটেই। একটু চটচটে, খোসাসমেত, সামান্য বাদাম-স্বাদের এই ভাতের সঙ্গে একটু ঝাল-মিষ্টি মেশানো চিকেন পদটির এক অপূর্ব মেলবন্ধন যে হয়েছিলো তা নিয়ে লিখতে গিয়ে যেন সেই স্বাদটি জিভে অনুভব করছি আর প্রায় লেখার টেবিলে মুখ থেকে কিছু ঝড়ে পরার উপক্রম হচ্ছে। একেকটা স্মৃতি থাকে যা চুম্বকের মতো মস্তিষ্কের এক কোণে আটকে যায়। আলাদাভাবে মনে রাখতে হয়না। এক বন্ধুত্বের উদযাপন যেন হয়েছিলো সেই মধ্যাহ্নভোজনে। আশ্চর্যের কথা এই যে তারপরে এত সময় কেটে গেলেও আর এতবার যাতায়াতের সুযোগেও আর কখনও যাইনি হ্যোক্সটারে। সময়টা থেমে রইলো, আমাদের বয়েসটা বেড়ে গেলো, রুডলফও (হানসের বাবা) চলে গেলেন দু’বছর আগে আর এফার স্মৃতি গেছে চিরতরে হারিয়ে।

সেবার হ্যোক্সটারে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিলো। ওই বিদেশভ্রমণের আগে পানীয় সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। পানীয় যে শুধু তুরীয় মেজাজে উত্তরণের হাতিয়ার নয়, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান আর কল্পনার (এবং আরও অনেক কিছুর) ফলাফল, তা বোঝা শেষ হয়নি এখনও, কিন্তু মনের অন্ধকার কোণে অনেকখানি আলো এসে পড়েছিলো ওই সময়ে। দেখেছিলাম পানীয় নিয়ে কোনওরকম ছুৎমার্গ না থাকলেও রয়েছে নির্দিষ্ট পারিবারিক অনুশাসন এবং চোখে-না-পরা একরকম ‘কোড অব কন্ডাক্ট’। তো একদিন বিকেলে হলো কি, হানস্‌ বললো, ‘চল তোদের আজ বিয়ার খাওয়াবো। তখন বিকেল ঝুঁকে পড়েছে সন্ধের দিকে। হানসের সঙ্গে আমরা রওনা হলাম স্থানীয় এক পাবের উদ্দেশ্যে। Kneipe— বাংলায় এই শব্দটি লেখা সহজ নয়। আগে ছিলো আস্তাবল আর এখন তা হয়েছে পানশালা। আমরা সটান চলে গেলাম দোতলায়, যেখানে বেশ কিছু টেবিল আর চেয়ার ইতি উতি ছড়িয়ে। হানস্‌ সেখানে ট্রে হাতে ঘুরতে থাকা একজন মহিলাকে কিছু বলতেই আমাদের টেবিলে হাজির হলো তিনটি বেশ বড়োসড়ো বিয়ার-ভর্তি মাগ! ফেনা কানা ছুঁয়ে আছে ঠিকই কিন্তু উপচে পড়ছে না। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে আরও ওয়াকিবহাল হয়ে জেনেছিলাম যে বিয়ার গ্লাসে ঢালার সময় ফেনা না হলে জার্মানিতে তা পানীয় বলে বিবেচিত হয়না। শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম বটে কিন্তু এই বিশেষ পানীয়ের প্রসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে জার্মানদের জাতীয় আবেগের বর্ণচ্ছটা প্রত্যক্ষ করার পর অবাক হওয়ার অবকাশ থাকেনি। এক এক অঞ্চলের একেকটা নিজস্ব বিয়ার, তাদের আলাদা আলাদা বর্ণ, গন্ধ আর স্বাদ— এ নিয়ে লোকগাথা আর গর্ববোধের শেষ নেই। শুধুমাত্র হেরিং মাছ আর ‘ক্যোলশ’ (কোলোন অঞ্চলের বিয়ার) খাওয়ার জন্য একবার আমাদের বন্ধুদম্পতি রলফ্‌ আর মনি (মনিকা) প্রায় দেড়’শ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছেছিলো এক বন্দর শহরে। সেকথায় পরে আসছি। আপাতত সেই প্রথম দিনের কথা বলি। বিয়ার পান তো শুরু করলাম প্রেৎসেল অনুষঙ্গে। ঘণ্টা দেড়েক পর মনে হলো চারপাশের আলো আর মানুষজন কেমন যেন একটু বদলে গেছে। অন্য টেবিলে যারা বসেছিলো তাদের কথা আর হাসির আওয়াজ কেমন যেন একটু দূরে চলে গেছে। আমি কারণটা বোঝার চেষ্টা করছি, হঠাৎ হানস্‌ বললো, ‘চল ওঠা যাক!’ কেন বললো, তা বুঝলাম নিচে নেমে। সুলগ্নার তখন আর হাঁটার ক্ষমতা নেই। তারপর থেকে যতদিন আমরা ওদেশে কাটিয়েছিলাম, রঙিন পানীয়ের ব্যাপারে ও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেছিলো।

হ্যোক্সটারের পালা চুকিয়ে হানসের ছোট্ট হলুদ-রঙা সিত্রোঁ গাড়িতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাইডেলবার্গের দিকে। তাই কি? হাইডেলবার্গ? নাকি হির্শবার্গ? যেখানে দেখা হবে বৌদি আর অলোকদার সঙ্গে। তার আগে যে অবশ্য কর্তব্যটি সেরে নিতে হবে তা হলো হাইডেলবার্গেই কারিন আর হানসের সদ্যজাত পুত্রকে দেখে নেওয়া। হানস্‌ যার নাম রেখেছে কাচ্চু।

আমাদের আরেক বন্ধু গাব্রিয়েলের গাড়িতে যেদিন প্রথম ওডেনহ্বাল্ড স্ট্রাসের ২ নম্বর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে নামলাম, উত্তেজনায় তখন গলা প্রায় শুকিয়ে কাঠ আর বৌদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝরাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনের বাগান দিয়ে বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বৌদির প্রশ্ন, ‘খিদে পেয়েছে তো?’ অতঃপর বৌদির হাতে পুরোদস্তুর বাঙ্গালী রান্নায় আমাদের ভুরিভোজ। কী ছিলো সেদিনের মেনুতে? মুগ ডাল, আলুভাজা, আলু ফুলকপির ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, চিকেন কোরমা আর গ্রীক ইওগার্ট। শেষতম এই বস্তুটির আস্বাদন আমরা বার্লিনে বারবারার বাড়িতে থাকতেই পেয়েছিলাম। কিন্তু এই জিনিসটি সম্পর্কে দুয়েক কথা না বললেই যে নয়! আদপে এই ইওগার্টের সঙ্গে আমাদের আটপৌরে দইয়ের একটাই বড়ো অমিল। তা হলো ইওগার্টের শেষ ধাপে তাকে ছেঁকে নেওয়া হয়, তার ফলে এটির ঘনত্ব হয় সাধারণ দইয়ের থেকে অনেক বেশি। আর বিশেষভাবে প্রতিপালন করা গরুর দুধের গুণে এটি হয়ে ওঠে এক অসামান্য সৃষ্টি। সেদিন নৈশাহারে আমরা খেয়েছিলাম ওয়াইন আর অলোকদার প্রিয় বিয়ার সহযোগে নানান ধরণের রুট, রকমারি চিজ আর আর আর পারমা হ্যাম। যার আলোচনায় বসলে কেটে যেতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর দিন দুয়েকের মধ্যেই আমাদের চলে যাওয়ার কথা সুইৎজারল্যান্ড। সেইমতো কাকভোরে বৌদি-অলোকদা আমাদের নিয়ে বেরোলেন মানহাইমের পথে, যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে পরবর্তী ‘মিটফার’ (সহযাত্রী) আমাদের জুরিখ পৌঁছে দেবার জন্য। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বৌদি আমাদের সঙ্গে দিয়েছেন পিৎজা— আগের দিন অনেক রাতে যা আমাদের দেবেন বলে তৈরি করেছেন আর দিয়েছেন ফলের রস। জার্মান সীমান্ত পেরিয়ে বাসেলে যখন ঢুকছি একফালি রোদ এসে পড়লো আমার চোখে। তন্দ্রা ছিঁড়ে গেলো।