Next
Previous
19

ধারাবাহিক : স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক


আমার বারুদবেলা ১২
স্বপন দেব



লোহাপুর হাসপাতাল চত্বরে এসে যখন পৌঁছালাম, তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি লোহাপুরের। তবে ভোরের আলোয় হাসপাতালের স্টাফ নার্স কোয়ার্টারগুলো দেখা যাচ্ছে। খুব বেশি খুঁজতে হয়নি। একটি কোয়ার্টারের সামনের দরজায় লেখা, অঞ্জলি চন্দ। এঁর সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, তখন উনি এন আর এস হসপিটালের ট্রেনী নার্স। পাস করে স্টাফ নার্স হিসেবে পোস্টিং হয়েছে এই লোহাপুরে। আমার দুপুরের খাওয়ার সময়ে উনি সামনে এসে দাঁড়াতেন, মাঝেমধ্যে নার্সিং হোস্টেলে ভালো কিছু পদ রান্না হলে লুকিয়ে নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এইসব কারণে আমি ওঁকে মা বলে ডাকতাম। এই নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে বিস্তর। আবার এই মহিলাটির মারফৎ আমি বেশ কিছু চিঠি পাঠিয়েছি পোস্ট করার জন্যে। 

দরজায় কোন ঘন্টি ছিলনা। আমি দরজায় ৪/৫ বার টোকা মারতেই দরজা খুলে অঞ্জলি আমাকে দেখে বিস্ময়ে হাঁ! আসুন আসুন করে মহা সমাদরে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাতেই আমিও হাঁ! নিজেকে একটা বেয়াকুব মনে হচ্ছিল। কোয়ার্টারে একটা মাত্রই ঘর। তাতে একটা ছোটো চৌকি। বিজলি নেই। হ্যারিকেন ভরসা। এবং সর্বোপরি অঞ্জলি একা! ওর সঙ্গে আর কেউ নেই! অঞ্জলিকে বললাম, রামপুরহাটে এসেছিলাম দেখা করে গেলাম। রাতে আবার ফিরে যাবো। “ওমা সেকি! এসেছেন যখন থেকে যান কিছুদিন।আপনার কোন অসুবিধে হবেনা।” 

আমি তখন তেইশ আর অঞ্জলি একুশ হবে হয়তো। সমস্যাটা এবং আসার উদ্দেশ্য দুটোই খুলে বললাম অঞ্জলি কে। ঠিক হল ওর পিসতুতো দাদা হিসেবে আমি ওর ঘরেই থাকব। আর আমার সকালের আর রাতের রান্না করে আমাকে খাইয়ে অঞ্জলি চলে যাবে পাশের কোয়ার্টারে ওর বান্ধবীর কাছে শুতে। এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম আমাদের সেইসময়ের পুলিশি নির্যাতন আর গ্রেফতারি এড়াতে কিভাবে আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হত ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিনের পর দিন, সে কথা বোঝানোর জন্য। দিন কুড়ি পরে অঞ্জলি একদিন হসপিটাল থেকে ফিরে বলল যে আমাকে নিয়ে নাকি খুব কানাঘুষো চলছে। হসপিটালের মেট্রন এবং স্বয়ং সুপার নাকি আমার সঠিক পরিচয় জানতে চেয়েছেন। আমি বুঝে গেলাম যে আমার এখানে থাকার দিন ফুরাল। অতএব, চলো মুসাফির বাঁধো গাঁঠোরিয়া! 

পরের গন্তব্য কাঁচরাপাড়া। এই শেলটারে এর আগেও থেকেছি আমি নিরুপদ্রবে। পেশায় ইনিও নার্স। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। বিধবা। নিঃসন্তান। কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে হসপিটালের মেট্রন। আমাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। কিন্তু বীরভূম থেকে প্রথমে হাওড়া এবং পরে শেয়াল’দা থেকে কাঁচরাপাড়া যাওয়ার পথে আরেক বিপত্তি! আগেই বলেছি যে এই সময়ে সিপিএম এবং নকশালরা উভয়ে উভয়কে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তো। ট্রেনে ব্যারাকপুর স্টেশনে একদল কলেজ ফেরৎ ছাত্র আমাকে চিনে ফেলে এবং শুরু হয় আমাকে মারধোর। যদিও ওদের মধ্যে আমার স্নেহাস্পদ এক ছাত্র ছিলেন এবং তাঁরই বদান্যতায় আমি ঐ ট্রেন থেকে নেমে অন্য ট্রেনে উঠে শেষ পর্যন্ত কাঁচরাপাড়া গিয়ে পৌঁছাই। আমার মাতৃসমা এই দিদির কাছে আমি এর আগেও শেলটার নিয়েছি। এবার কিন্তু উনি আমাকে সরাসরি বলেই দিলেন যে, এখানে থাকতে হলে বাইরে বেরোনো যাবেনা। এমন কি পরদিন থেকে উনি ডিউটিতে যাওয়ার সময়ে সত্যি সত্যি বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে যেতেন!এভাবেই ছিলাম দিন কুড়ি। কিছু করার নেই, খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছু পড়ার নেই, কারো সাথে যোগাযোগ নেই, এমন কি আমার কোনওসাংগঠনিক বা বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্মও নেই শুধু পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া! নিজের ওপরেই রাগ এবং ঘেন্না হতে লাগলো! এ কেমন বিপ্লবী আমি? এ কেমন কমিউনিস্ট? আমরা তো সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে নেমেছিলাম। শাসকেরা যে আমাদের ছেড়ে কথা বলবেনা এটা জেনেই তো আসা। নাঃ, যা হবার হোক, আমাকে কলকাতায় ফিরতেই হবে। যেভাবেই হোক আবার জড়িয়ে ফেলতে হবে নিজেকে সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে।

ডিউটি শেষে কোয়ার্টারে ফিরলে দিদিকে বললাম, কাল আমি কলকাতা ফিরে যাবো। আমার দিকে এক পলক চেয়ে উনি খুব নিস্পৃহ ভাবে বললেন, সাবধানে যেও। ওঁর এই নিস্পৃহতার কারণ ভীতি। খবরের কাগজটা উনিও পড়তেন, আমিও। প্রশাসন এবং পুলিশ তখন জাল গুটিয়ে আনছে। প্রতিদিনই শয়ে শয়ে ছেলেকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হচ্ছে।Combing Operation বা চিরুনি তল্লাসী নামে এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সি আর পি, লালবাজার আর লোক্যাল পুলিশের যৌথ পরিচালনায়। কারো বাড়ি থেকে কোনও পলাতক নকশাল ধরা পরলে তার সঙ্গে তার আশ্রয়দাতাকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে। ফলে, এখন আর অত সহজে গোপন আস্তানায় চলে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার অন্যদিকে, সিপিএম আবার যুক্তফ্রন্ট গড়ে ক্ষমতায় আসায় অনেক বেশী তীব্র হয়েছে নকশাল আন্দোলন। মেধাবী ছাত্ররা, প্রগতিশীল ডাক্তার, গীতিকার পথে নেমেছেন নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি ৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে আবার ফিরে এলাম কলকাতায়। আশ্রয়স্থল আমার মামার বাড়ি,পাইকপাড়ায়। খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে যেতাম আর বেশ রাতে বাড়ি ফিরতাম। দিন দশেকের মধ্যেই বেশ কিছু যোগাযোগ আবার পুনরুদ্ধার করে আমার করণীয় নির্দেশ পেয়ে গেলাম। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, আমাদের মধ্যে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের পেছনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা ছিল রাজাবাজার, বেলগাছিয়া আর আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে থাকা মুসলিম ভায়েরা। পেশায় এঁরা হয় রাজমিস্ত্রি, নাহয় মজুর। এঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। যেমন ছিলনা আমার আরেক গোপন ডেরার মালিক রামজী। কিন্তু, কাঁধে রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতির থলে নিয়ে এঁরা অনায়াসে এবং বিনা সন্দেহে যেকোনও বাড়িতে চলে যেতে পারতেন। পৌঁছে দিয়ে আসতেন প্রয়োজনীয় নথি বা কারো গোপন আস্তানার ঠিকানা। আমাদের নিজেদের মধ্যেই প্রচুর মুসলিম ছিল যারা প্রত্যক্ষ ভাবে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছে সেই সময়ে অকুতোভয়ে। বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হালিমের ছেলে বিপ্লব হালিম, আজিজুল হক এবং আরো অনেকে। আর ছিলেন খবরের কাগজ যাঁরা ফেরি করেন, তাঁরা। সেই সময়ে না ছিল মোবাইল না ছিল ল্যাণ্ড লাইনের প্রাচুর্য। পাড়ায় কারো বাড়িতে একটা ল্যাণ্ডফোন থাকলে তার ইজ্জতই আলাদা! এসএমএস বা ইমেইল-এর প্রশ্নই ওঠে না। ভরসা শুধু চিঠি আর চিরকুট। কিন্তু এগুলি পাঠাতেও তো বাহক চাই। তাই এই খবরের কাগজ ফিরি করিয়েরা, নির্দিষ্ট নিশানায় অব্যর্থ লক্ষ্যে কাগজের ভেতরে চিরকুট বা চিঠি রেখে কাগজে দড়ি বেঁধে ছুঁড়ে দিতেন সাইকেলে বসেই! আমি থেকে চারু মজুমদার অবধি সবাই এদের ব্যবহার করেছি পারস্পরিক যোগাযোগ রাখার জন্যে। আর এদের আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করে কাজে লাগাতেন যিনি, সেই রথীন ভট্টাচার্যের কথা কেউ কোনওদিন জানতে পারেনি। না, পুলিশ ও না।

সংগঠনের অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়েছে, আমাকে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সেটা হল পাইকপাড়ার বাইশ নং বস্তিতে আমাদের সমর্থক দের নিয়ে বৈঠক করা এবং তাঁদের রাজনৈতিক ক্লাস নেওয়া। কিন্তু আবার বিপত্তি!

সেদিনটা ছিল রবিবার। সকাল আটটা নাগাদ আমার মামাবাড়ির কাজের মাসি এসে খবর দিল, পাড়ায় চিরুনি চলছে গো! সব বাড়িতে ঢুকছে, এখানেও আসবে! তার মানে কোম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে। এরা একটা নির্দিষ্ট এলাকার সমস্ত বাড়িতে ঢুকে খানা-তল্লাসি চালায়। সঙ্গে থাকে বোরখা পরানো দুটি ছেলে যারা পাড়ার লোকেদের চেনে। অপরিচিত কাউকে দেখলে এরাই শনাক্ত করে দেয়। পুলিশ তুলে আনে থানায়। তারপর নির্দোষ প্রমাণিত হলে ছেড়ে দেয় নাহলে আটক। আমি বুঝে গেলাম কি ঘটতে চলেছে। বাড়িতে হানা দিলে ধরা তো আমি পরবই, কিন্তু তার সঙ্গে আমার বৃদ্ধ মাতামহ বা মামাটিকে কেন আর শূলে চড়াই? পাশেই আশুবাবুর বাজার। আমি একটা বাজারের থলি হাতে নিরুদ্বিগ্ন মুখে হাঁটা দিলাম বাজারের দিকে… (চলবে)